বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ
খুঁজিতে যাই না আর
চাণক্য-শ্লোক : কে ছিলেন চাণক্য?
'চাণক্য' প্রাচীন ভারতের কূটনৈতিক ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নাম। পাঞ্জাব প্রদেশের অন্তর্গত তক্ষশীলায় চণক-ঋষির ঔরসে মহামতি চাণক্য খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে জন্মগ্রহণ করেন। চণক-ঋষির পুত্র বলেই তাঁর নাম হয় 'চাণক্য'। তাঁর জন্মগ্রাম 'চানকা' থেকে 'চাণক্য' নাম হয়েছে বলেও অনুমান করা হয়। এছাড়া 'বিষ্ণুগুপ্ত' নামেও তিনি পরিচিত। চাণক্যের বিখ্যাত ছদ্মনাম 'কৌটিল্য'। কুটিলবুদ্ধি পরায়ণ বলে তিনি এ নামে অভিহিত। 'কুটিলা' গোত্রভুক্ত হওয়ার কারণে তাঁর 'কৌটিল্য' নাম হয়েছে বলেও ধারণা করা হয়।
সে সময়ে মগধে 'নন্দবংশ' নামে এক রাজবংশ ছিল। ঐ রাজবংশের শেষ রাজা ছিলেন ধনানন্দ। ধনানন্দের সৎভাই ছিলেন (পিতা মহাপদ্মের ঔরসে দাসী 'মুরা'র গর্ভজাত) চন্দ্রগুপ্ত। রাজা ধনানন্দ প্রজাদের কাছে প্রিয় ছিলেন না। পিতা মহাপদ্মের মৃত্যুর পর তিনি দাসীমাতা মুরা ও সৎভাই চন্দ্রগুপ্তকে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দেন। অপমানিত চন্দ্রগুপ্ত তার ভাই ধনানন্দকে পরাজিত করে মগধের সিংহাসন দখলের চেষ্টা করেন। কিন্তু সে চেষ্টায় তিনি ব্যর্থ হন এবং জীবন বাঁচাতে জঙ্গলে গিয়ে নির্বাসিত জীবন-যাপন করতে থাকেন।
মহারাজ ধনানন্দের পিতৃশ্রাদ্ধে পৌরহিত্য করার জন্য একজন ব্রাহ্মণের প্রয়োজন হয়। ব্রাহ্মণ সংগ্রহের দায়িত্ব পড়ে মন্ত্রী শকটার উপর। তিনি চাণক্যকে মহারাজ ধনানন্দের পিতৃশ্রাদ্ধে পৌরহিত্য করার অনুরোধ জানান। সে অনুরোধ অনুযায়ী চাণক্য যথাসময়ে রাজপ্রাসাদে উপস্থিত হয়ে পুরোহিতের আসন গ্রহণ করেন। চাণক্যের চেহারা খুব ভাল ছিল না। পুরোহিতের আসনে কদাকার ব্রাহ্মণ চাণক্যকে দেখে মহারাজ ধনানন্দ ভীষণ ক্রুদ্ধ হন এবং তাকে তিরস্কার করে সেখান থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। পণ্ডিত চাণক্য প্রথমে রুষ্ট না হয়ে মহারাজাকে হিতবাক্যে বুঝাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু রাজা ধনানন্দ কোন প্রবোধ না মেনে অপর লোক দ্বারা চাণক্যকে যথেষ্ট অপমান করেন। চাণক্য ক্রুদ্ধ হয়ে সেখান থেকে চলে আসেন এবং এই অপমানের প্রতিশোধ গ্রহণের প্রতিজ্ঞা করেন।
চন্দ্রগুপ্ত যখন বিন্ধানের জঙ্গলে পলাতক ও নির্বাসিত জীবন যাপন করছিলেন, তখন ঘটনাচক্রে ঐ চাণক্যের সাথে তার সাক্ষাত হয়। চন্দ্রগুপ্ত তার সমস্ত কথা চাণক্যের কাছে খুলে বলেন এবং ধনানন্দকে পরাজিত করে মগধের সিংহাসন দখলে চাণক্যের পরামর্শ ও সাহায্য কামনা করেন। চাণক্য ছিলেন প্রখর প্রতিভাধর কুটিলবুদ্ধি-সম্পন্ন পণ্ডিত। চন্দ্রগুপ্ত চাণক্যকে তার গুরু, উপদেষ্টা ও মন্ত্রণাদাতা হিসেবে মেনে নেন। চাণক্যের সক্রিয় সহযোগিতায় চন্দ্রগুপ্ত ক্রমে একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন এবং গুরু চাণক্যের সুনিপুণ পরিকল্পনা অনুসারে ধনানন্দকে পরাজিত করে মগধের সিংহাসন দখল করেন। সিংহাসনে আরোহন করার পর মাতা 'মুরা'র নামানুসারে (নন্দবংশের পরিবর্তে) রাজবংশের নামকরণ করেন 'মৌর্যবংশ' এবং পণ্ডিত চাণক্যকে করেন তার রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী।
চন্দ্রগুপ্তের গুরু ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চাণক্য অবলীলায় বিলাসবহুল জীবন কাটাতে পারতেন জাঁকজমকপূর্ণ প্রাসাদে। কিন্তু তিনি তা না করে একটি শ্মশানে কুড়েঘরে সন্ন্যাসীর মত জীবন-যাপন করতেন। গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের চেহারা যেমন সুন্দর ছিল না, চাণক্যের চেহারাও তেমনি সুন্দর বা আকর্ষণীয় ছিল না। তাছাড়া স্বাস্থ্যেও তিনি ছিলেন দুর্বল। কিন্তু পাণ্ডিত্যে ছিলেন প্রায় সক্রেটিসের সমতুল্য। তিনি বিশ্বাস করতেন 'দেহের সৌন্দর্যের চাইতে চিন্তার সৌন্দর্য অধিকতর মোহময় ও এর প্রভাব যাদুতুল্য।' তিনি ছিলেন দক্ষ পরিকল্পনাবিদ, সিদ্ধান্তে অটল এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অত্যন্ত কঠোর। ক্ষমতার দৃশ্যপট থেকে দূরে থেকেও তিনি সর্ববিধ পরামর্শ দিয়ে রাজা চন্দ্রগুপ্তকে পরিচালনা করতেন। রাজা চন্দ্রগুপ্তের জীবনে চাণক্য ছিলেন সত্যিকার বন্ধু, দার্শনিক, গুরু এবং স্বর্গীয় দূততুল্য অভিভাবক। শ্মশানে থেকে (রাজ্য পরিচালনার পরামর্শদানের পাশাপাশি) অসংখ্য ভক্তদেরকে নৈতিক ও আর্থ-সামাজিক বিষয়েও তিনি জ্ঞানদান করতেন।
চাণক্যের অর্থবিষয়ক জ্ঞানের সংকলন হচ্ছে অর্থশাস্ত্র, যা 'চাণক্যের অর্থশাস্ত্র' নামে পরিচিত একটি কালোত্তীর্ণ গ্রন্থ। এ শাস্ত্রে আছে শাসকের উদ্দেশ্যে পরামর্শ, প্রজাদের নিরাপত্তা, কল্যাণ ও জীবনমান উন্নতকরার কৌশল। চাণক্য তার অর্থশাস্ত্রে রাজাকে এভাবে পরামর্শ দিয়েছেন- 'যে রাজা শত্রুর গতিবিধি সম্পর্কে ধারণা করতে পারে না এবং শুধু অভিযোগ করে যে তার পিঠে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে, তাকে সিংহাসনচ্যুত করা উচিত।' 'সকল উদ্যোগ নির্ভর করে অর্থের উপর। সে জন্য সবচেয়ে অধিক মনোযোগ দেওয়া উচিত খাজাঞ্চিখানার দিকে। তহবিল তসরুপ বা অর্থ আত্মসাতের চল্লিশটি পদ্ধতি আছে। জিহ্বার ডগায় বিষ রেখে যেমন মধুর আস্বাদন করা সম্ভব নয়, তেমনি কোন রাজকর্মচারীর পক্ষে রাজার রাজস্বের সামান্য পরিমাণ না-খেয়ে ফেলার ঘটনা অসম্ভব ব্যাপার। পানির নিচের মাছের গতিবিধি বোঝা যেমন অসম্ভব, রাজকর্মচারীর তহবিল তসরুপ বোঝাও তেমনি অসম্ভব। আকাশের অতি উঁচুতেও পাখির উড্ডয়ন দেখা সম্ভব, কিন্তু রাজকর্মচারীর গোপন কার্যকলাপ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া অসম্ভব।' চাণক্যের পরামর্শ ও নির্দেশনাগুলি শুধু রাজ্যশাসনের ক্ষেত্রে নয়, এ যুগের বড় বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনা ও সম্প্রসারণের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তিনিই অর্থশাস্ত্রের প্রথম প্রবক্তা বলে অভিহিত। চাণক্যের অর্থশাস্ত্র উপবেদের অন্তর্ভুক্ত।
এই বিজ্ঞ ও বাস্তবজ্ঞান-সম্পন্ন পণ্ডিতের সমাজ, সংসার, ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি সম্পর্কিত নীতিকথাগুলি (আজ আড়াই হাজার বছর পরেও) গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেনি। আজও তা 'চাণক্য-শ্লোক' নামে ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। কথাগুলি যে চাণক্যের তা হয়তো আমরা অনেকেই জানি না, অথচ কথাগুলি আমাদের খুবই পরিচিত। চাণক্যের এমন কিছু শ্লোক নিচে উল্লেখ করা হল-
১. অতি পরিচয়ে দোষ আর ঢাকা থাকে না।
২. অধমেরা ধন চায়, মধ্যমেরা ধন ও মান চায়। উত্তমেরা শুধু মান চায়। মানই মহতের ধন।
৩. অনেকে চারটি বেদ এবং ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করলেও আত্মাকে জানে না, হাতা যেমন রন্ধন-রস জানে না।
৪. অন্তঃসার শূন্যদের উপদেশ দিয়ে কিছু ফল হয় না, মলয়-পর্বতের সংসর্গে বাঁশ চন্দনে পরিণত হয় না।
৫. অবহেলায় কর্মনাশ হয়, যথেচ্ছ ভোজনে কুলনাশ হয়, যাচ্ঞায় সম্মান-নাশ হয়, দারিদ্র্যে বুদ্ধিনাশ হয়।
৬. অভ্যাসহীন বিদ্যা, অজীর্ণে ভোজন, দরিদ্রের সভায় বা মজলিশে কালক্ষেপ এবং বৃদ্ধের তরুণী ভার্যা বিষতুল্য।
৭. অহংকারের মত শত্রু নেই।
৮. আকাশে উড়ন্ত পাখির গতিও জানা যায়, কিন্তু প্রচ্ছন্নপ্রকৃতি-কর্মীর গতিবিধি জানা সম্ভব নয়।
৯. আদর দেওয়ার অনেক দোষ, শাসন করার অনেক গুণ, তাই পুত্র ও শিষ্যকে শাসন করাই দরকার, আদর দেওয়া নয়।
১০. আপদের নিশ্চিত পথ হল ইন্দ্রিয়গুলির অসংযম, তাদের জয় করা হল সম্পদের পথ, যার যেটি ঈপ্সিত সে সেই পথেই যায়।
১১. আড়ালে কাজের বিঘ্ন ঘটায়, কিন্তু সামনে ভাল কথা বলে, যার উপরে মধু কিন্তু অন্তরে বিষ, তাকে পরিত্যাগ করা উচিত।
১২. ইন্দ্রিয়ের যে অধীন তার চতুরঙ্গ সেনা থাকলেও সে বিনষ্ট হয়।
১৩. উপায়জ্ঞ মানুষের কাছে দুঃসাধ্য কাজও সহজসাধ্য।
১৪. উৎসবে, বিপদে, দুর্ভিক্ষে, শত্রুর সঙ্গে সংগ্রামকালে, রাজদ্বারে এবং শ্মশানে যে সঙ্গে থাকে, সে-ই প্রকৃত বন্ধু।
১৫. ঋণ, অগ্নি ও ব্যাধির শেষ রাখতে নেই, কারণ তারা আবার বেড়ে যেতে পারে।
১৬. একটি দোষ বহু গুণকেও গ্রাস করে।
১৭. একটি কুবৃক্ষের কোটরের আগুন থেকে যেমন সমস্ত বন ভস্মীভূত হয়, তেমনি একটি কুপুত্রের দ্বারাও বংশ দগ্ধ হয়।
১৮. একটিমাত্র পুষ্পিত সুগন্ধ বৃক্ষে যেমন সমস্ত বন সুবাসিত হয়, তেমনি একটি সুপুত্রের দ্বারা সমস্ত কুল ধন্য হয়।
১৯. একশত মূর্খ পুত্রের চেয়ে একটি গুণী পুত্র বরং ভাল। একটি চন্দ্রই অন্ধকার দূর করে, সকল তারা মিলেও তা পারে না।
২০. কর্কশ কথা অগ্নিদাহের চেয়েও ভয়ঙ্কর।
২১. খেয়ে যার হজম হয়, ব্যাধি তার দূরে রয়।
২২. গুণবানকে আশ্রয় দিলে নির্গুণও গুণী হয়।
২৩. গুণহীন মানুষ যদি উচ্চ বংশেও জন্মায় তাতে কিছু আসে যায় না। নীচকুলে জন্মেও যদি কেউ শাস্ত্রজ্ঞ হয়, তবে দেবতারাও তাঁকে সম্মান করেন।
২৪. গুরু শিষ্যকে যদি একটি অক্ষরও শিক্ষা দেন, তবে পৃথিবীতে এমন কোনও জিনিস নেই, যা দিয়ে সেই শিষ্য গুরুর ঋণ শোধ করতে পারে।
২৫. গৃহে যার মা নেই, স্ত্রী যার দুর্মুখ তার বনে যাওয়াই ভাল, কারণ তার কাছে বন আর গৃহে কোনও তফাৎ নেই।
২৬. চন্দন তরুকে ছেদন করলেও সে সুগন্ধ ত্যাগ করে না, যন্ত্রে ইক্ষু নিষ্পিষ্ট হলেও মধুরতা ত্যাগ করে না, যে সদ্বংশজাত অবস্থা বিপর্যয়েও সে চরিত্রগুণ ত্যাগ করে না।
২৭. তিনটি বিষয়ে সন্তোষ বিধেয়: নিজের পত্নীতে, ভোজনে এবং ধনে। কিন্তু অধ্যয়ন, জপ, আর দান এই তিন বিষয়ে যেন কোনও সন্তোষ না থাকে।
২৮. দারিদ্র্য, রোগ, দুঃখ, বন্ধন এবং বিপদ- সব কিছুই মানুষের নিজেরই অপরাধরূপ বৃক্ষের ফল।
২৯. দুর্জনের সংসর্গ ত্যাগ করে সজ্জনের সঙ্গ করবে। অহোরাত্র পুণ্য করবে, সর্বদা নশ্বরতার কথা মনে রাখবে।
৩০.দুর্বলের বল রাজা, শিশুর বল কান্না, মূর্খের বল নীরবতা, চোরের মিথ্যাই বল।
৩১.দুষ্টা স্ত্রী, প্রবঞ্চক বন্ধু, দুর্মুখ ভৃত্য এবং সসর্প-গৃহে বাস মৃত্যুর দ্বার, এ-বিষয়ে সংশয় নেই।
৩২. ধর্মের চেয়ে ব্যবহারই বড়।
৩৩. নানাভাবে শিক্ষা পেলেও দুর্জন সাধু হয় না, নিমগাছ যেমন আমূল জলসিক্ত করে কিংবা দুধে ভিজিয়ে রাখলেও কখনও মধুর হয় না।
৩৪. পরস্ত্রীকে যে মায়ের মত দেখে, অন্যের জিনিসকে যে মূল্যহীন মনে করে এবং সকল জীবকে যে নিজের মত মনে করে, সে-ই যথার্থ জ্ঞানী।
৩৫. পাপীরা বিক্ষোভের ভয় করে না।
৩৬. পাঁচ বছর বয়স অবধি পুত্রদের লালন করবে, দশ বছর অবধি তাদের চালনা করবে, ষোল বছরে পড়লে তাদের সঙ্গে বন্ধুর মত আচরণ করবে।
৩৭. পুত্র যদি হয় গুণবান, পিতামাতার কাছে তা স্বর্গ সমান।
৩৮. পুত্রকে যাঁরা পড়ান না, সেই পিতামাতা তার শত্রু। হাঁসদের মধ্যে বক যেমন শোভা পায় না, সভার মধ্যে সেই মূর্খও তেমনি শোভা পায় না।
৩৯. বইয়ে থাকা বিদ্যা, পরের হাতে থাকা ধন একই রকম। প্রয়োজনকালে তা বিদ্যাই নয়, ধনই নয়।
৪০. বিদ্বান সকল গুণের আধার, অজ্ঞ সকল দোষের আকর। তাই হাজার মূর্খের চেয়ে একজন বিদ্বান অনেক কাম্য।
৪১. বিদ্যাবত্তা ও রাজপদ এ-দুটি কখনও সমান হয় না। রাজা কেবল নিজদেশেই সমাদৃত, বিদ্বান সর্বত্র সমাদৃত।
৪২. বিদ্যা ব্যতীত জীবন ব্যর্থ, কুকুরের লেজ যেমন ব্যর্থ, তা দিয়ে সে গুহ্য-অঙ্গও গোপন করতে পারে না, মশাও তাড়াতে পারে না।
৪৩. বিদ্যাভূষিত হলেও দুর্জনকে ত্যাগ করবে, মণিভূষিত হলেও সাপ কি ভয়ঙ্কর নয়?
৪৪. বিদ্যার চেয়ে বন্ধু নাই, ব্যাধির চেয়ে শত্রু নাই। সন্তানের চেয়ে স্নেহপাত্র নাই, দৈবের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বল নাই।
৪৫. বিনয়ই সকলের ভূষণ।
৪৬. বিষ থেকেও অমৃত আহরণ করা চলে, মলাদি থেকেও স্বর্ণ আহরণ করা যায়, নীচজাতি থেকেও বিদ্যা আহরণ করা যায়, নীচকুল থেকেও স্ত্রীরত্ন গ্রহণ করা যায়।
৪৭. ভোগবাসনায় বুদ্ধি আচ্ছন্ন হয়।
৪৮. মিত ভোজনেই স্বাস্থ্যলাভ হয়।
৪৯. যশবানের বিনাশ নেই।
৫০. যাঁরা রূপযৌবনসম্পন্ন এবং উচ্চকুলজাত হয়েও বিদ্যাহীন, তাঁরা সুবাসহীন পলাশ ফুলের মত বেমানান।
৫১. যে অলস, অলব্ধ-লাভ তার হয় না।
৫২. যে গাভি দুধ দেয় না, গর্ভ ধারণও করে না, সে গাভি দিয়ে কী হবে! যে বিদ্বান ও ভক্তিমান নয়, সে পুত্র দিয়ে কী হবে!
৫৩. রাতের ভূষণ চাঁদ, নারীর ভূষণ পতি, পৃথিবীর ভূষণ রাজা, কিন্তু বিদ্যা সবার ভূষণ।
৫৪. শাস্ত্র অনন্ত, বিদ্যাও প্রচুর। সময় অল্প অথচ বিঘ্ন অনেক। তাই যা সারভূত তারই চর্চা করা উচিত। হাঁস যেমন জল-মিশ্রিত দুধ থেকে শুধু দুধটুকুই তুলে নেয়, তেমনি।
৫৫. সত্যনিষ্ঠ লোকের অপ্রাপ্য কিছুই নাই।
৫৬. সত্যবাক্য দুর্লভ, হিতকারী-পুত্র দুর্লভ, সমমনস্কা-পত্নী দুর্লভ, প্রিয়স্বজনও তেমনি দুর্লভ।
৫৭. সাপ নিষ্ঠুর খলও নিষ্ঠুর, কিন্তু সাপের চেয়ে খল বেশি নিষ্ঠুর। সাপকে মন্ত্র বা ওষধি দিয়ে বশ করা যায়, কিন্তু খলকে কে বশ করতে পারে?
৫৮. সুবেশভূষিত মূর্খকে দূর থেকেই দেখতে ভাল, যতক্ষণ সে কথা না বলে ততক্ষণই তার শোভা, কথা বললেই মূর্খতা প্রকাশ পায়।
৫৯. হাতি থেকে একহাজার হাত দূরে, ঘোড়া থেকে একশ হাত দূরে, শৃঙ্গধারী প্রাণী থেকে দশহাত দূরে থাকবে। অনুরূপ দুর্জনের কাছ থেকেও যথাসম্ভব দূরে থাকবে।
......................
.....................
অ
১. অকর্মারা সদাই ক্ষুধার্ত।
২. অকৃতজ্ঞের নরক বাস হয়।
৩. অখণ্ডিত রত্ন মেলে না।
৪. অতিদর্পে লঙ্কার পতন ঘটেছে, অতিমানে কৌরবদের পতন ঘটেছে,
অতিদানে বালির পাতাল বাস ঘটেছে, অতিরিক্ত সব কিছুই খারাপ।
৫. অতি পরিচয়ে দোষ আর ঢাকা থাকে না।
৬. অতিরিক্ত ভার পুরুষকে অবসন্ন করে দেয়।
৭. অধমেরা ধন চায়, মধ্যমেরা ধন ও মান চায়। উত্তমেরা শুধু মান চায়।
মানই মহতে ধন।
৮. অনেকে চারটি বেদ এবং ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করলেও আত্মাকে জানে
না, হাতা যেমন রন্ধন-রস জানে না।
৯. অন্তঃসার শূন্যদের উপদেশ দিয়ে কিছু ফল হয় না, মলয়-পর্বতের
সংসর্গে বাঁশ চন্দনে পরিণত হয় না।
১০. অন্যে যার গুণগান করে সে নির্গুণ হলেও গুণী। নিজের গুণগান নিজে
করলে ইন্দ্রও ছোট হয়ে যান।
১১. অবহেলায় কর্মনাশ হয়, যথেচ্ছ ভোজনে কুলনাশ হয়, যাচ্ঞায় সম্মান
নাশ হয়, দারিদ্র্যে হয় বুদ্ধি নাশ।
১২. অবিশ্বস্তকে বিশ্বাস করবে না, বন্ধুকেও বিশ্বাস করবে না, বন্ধু যদি
কখনও ক্রুদ্ধ হয়, সমস্ত গুপ্তকথা প্রকাশ করে দিতে পারে।
১৩. অভ্যাসহীন বিদ্যা, অজীর্ণে ভোজন, দরিদ্রের সভায় বা মজলিশে
কালক্ষেপ, এবং বৃদ্ধের তরুণী ভার্যা বিষতুল্য।
১৪. অমৃত ও বিষ উভয়েরই আকর হল জিভ।
১৫. অর্থলাভ জীবন ধারণের জন্য।
১৬. অর্থলাভের বাসনা কুকাজে সিদ্ধ হয় না।
১৭. অর্থ যার আছে সে মিত্র, স্বজন, সংসারে পুরুষ, সে-ই পণ্ডিত।
১৮. অসতর্ক লোকের প্রায় সকল কাজই সমুদ্রে বিদীর্ণ জলযানের মতো
নিশ্চিত বিনষ্ট হয়।
১৯. অহংকারের মতো শত্রু নেই।
আ
২০. আকাশে উড়ন্ত পাখির গতিও জানা যায়, কিন্তু প্রচ্ছন্নপ্রকৃতির কর্মীর গতিবিধি জানা সম্ভব নয়।
২১. আদর দেওয়ার অনেক দোষ, শাসন করার অনেক গুণ, তাই পুত্রকে ও শিষ্যকে শাসন করাই দরকার, আদর দেওয়া নয়।
২২. আপদের নিশ্চিত পথ হল ইন্দ্রয়গুলির অসংযম, তাদের জয় করা হল সম্পদের পথ- যার যেটি ঈপ্সিত সে সেই পথেই যাক।
২৩. আপন চরিত্র কখনও দূষিত করবে না।
২৪. আহারের সংস্থান ও আহারের শক্তি, রমণীয় পত্নী ও রতিশক্তি, ঐশ্বর্য ও দানশক্তি- এসব অল্প তপস্যার ফল নয়।
২৫. আড়ালে কাজের বিঘ্ন ঘটায়, কিন্তু সামনে ভালো কথা বলে, উপরে দুধ আর ভিতরে বিষ কলসির মতো, তাকে পরিত্যাগ করা উচিত।
২৬. আয়ু, কর্ম, ধন, বিদ্যা ও মৃত্যু- মানুষ মাতৃগর্ভে থাকাকালে এই পাঁচটি তাদের জন্য নির্ধারিত হয়ে যায়।
ই
২৭. ইন্দ্রিয়ের যে অধীন তার চতুরঙ্গ সেনা থাকলেও সে বিনষ্ট হয়।
২৮. ইন্দ্রের মন্ত্রিপরিষদ হল সহস্র ঋষি, ওই সহস্র ঋষিই তাঁর চোখ। তাই দুটিমাত্র চোখ থাকলেও তাঁকে সহস্রা বলা হয়।
উ
২৯. উপায়জ্ঞ মানুষের কাছে দুঃসাধ্য কাজও সহজসাধ্য।
৩০. উৎসবে, বিপদে, দুর্ভিক্ষে, শত্রুর সঙ্গে সংগ্রামকালে, রাজদ্বারে এবং শ্মশানে যে সঙ্গে থাকে সে-ই বন্ধু।
ঋ
৩১. ঋণ, অগ্নি ও ব্যাধির শেষ রাখতে নেই, কারণ তারা আবার বেড়ে যেতে পারে।
৩২. ঋণকারী পিতা, দুঃশীলা মা, রূপবতী স্ত্রী, মূর্খ পুত্র- এরা সকলেই শত্রু।
এ
৩৩. একই জিনিস কিন্তু- শব, কামিনী ও মাংস- এই তিনটি জিনিসকে যোগী, কামী ও কুকুর তিনভাবে দেখে।
৩৪. একটা কাজ শেষ করে পরবর্তী কাজ ধরতে বেশি দেরি করা উচিত নয়।
৩৫. একটি দোষ বহু গুণকেও গ্রাস করে।
৩৬. একটি কুবৃক্ষের কোটরের আগুন থেকে যেমন সমস্ত বন ভস্মীভূত হয়, তেমনি একটি কুপুত্রের দ্বারাও বংশ দগ্ধ হয়।
৩৭. একটি গাছে ছিল নানা রঙের পাখিরা, ভোরের বেলায় তারা দশ দিকে উড়ে গেল এতে দুঃখের কি আছে?
৩৮. একটিমাত্র পুষ্পিত সুগন্ধ বৃক্ষে যেমন সমস্ত বন সুবাসিত হয়, তেমনি একটি সুপুত্রের দ্বারা সমস্ত কূল ধন্য হয়।
৩৯. একবার বললেই যিনি বুঝে নিতে পারেন, যাঁর তাড়াতাড়ি হাত চলে, যাঁর হস্তাক্ষর সুন্দর এবং সর্বশাস্ত্রে যিনি সমদৃষ্টি তিনিই যথার্থ লেখক হতে পারেন।
৪০. একশত মূর্খ পুত্রের চেয়ে একটি গুণী পুত্র বরং ভালো। একটি চন্দ্রই অন্ধকার দূর করে, সকল তারা মিলেও তা পারে না।
৪১. একা একা তপস্যা, দুইয়ে মিলে পাঠ, তিনে মিলে গান, চারে মিলে ভ্রমণ, আর পাঁচে মিলে (করলে) ক্ষেতের কাজ। বহুতে মিলে করা চলে যুদ্ধ।
৪২. একা চাকা চলে না।
৪৩. এমনিতে কেউ কারও বন্ধু নয়, কেউ কারও শত্রু নয়, কারণেই শত্রু-মিত্র হয়ে থাকে।
ক
১. কবিরা কি না দেখে, স্ত্রীলোকেরা কি না করে, মদ্যপেরা কি না কল্পনা করে, কাকেরা কি না খায়?
২. করণীয় কাজ সময়মতো না করলে 'কাল'ই তার ফল শুষে নেয়।
৩. কর্কশ কথা অগ্নিদাহের চেয়েও ভয়ঙ্কর।
৪. কাক দিনের বেলা পেঁচাকে মারে, আর রাতে সেই পেঁচাই কাককে মারে। (যুদ্ধে সময়জ্ঞান খুবই জরুরি)।
৫. কাজ সমাপ্ত বা সফল হলে তবেই তা প্রকাশ করা উচিত।
৬. কাজে ব্যর্থ হয়ে তার নানা বিঘ্নের কথা শুধু মূর্খেরাই বলে থাকে।
৭. কাঠে দেবতা নেই, পাথরে বা মাটির জিনিসেও নেই। ভাবেই তিনি আছেন। ভাবের কারণেই সত্তা।
৮. কাম হচ্ছ এমন জিনিস যা ধর্ম ও অর্থ কোনওটাই বাড়ায় না।
৯. কামাসক্তের কার্যসিদ্ধি হয় না।
১০. কালই প্রাণীকে পরিণতি দান করে, কালই মানুষকে সংহার করে, সকলে যখন ঘুমন্ত- কাল তখন জেগে থাকে, কালকে অতিক্রম করা দুঃসাধ্য।
১১. কালকের করণীয় কাজ আজকেই করা উচিত।
১২. কুদেশে এলে অর্থ সঞ্চয় হবে কি করে? কুপুত্র লাভে জলাঞ্জলির(তর্পণ করার) আশা কোথায়? কুগৃহিণী থাকতে গৃহে সুখ হবে কি করে? কুশিষ্য পড়িয়ে গুরুর যশ হবে কি করে?
১৩. কুলীনের সঙ্গে সম্পর্ক, পণ্ডিতের সঙ্গে মিত্রতা এবং জ্ঞাতিবর্গের সঙ্গে মিলমিশ যে বজায় রাখে তার বিনাশ নেই।
১৪. কুয়োর জল, বটের ছায়া, যৌবনবতী স্ত্রী এবং ইটের তৈরি বাড়ি শীতকালে উষ্ণ এবং গ্রীষ্মকালে শীতল।
১৫. কূলের স্বার্থে একজনকে ত্যাগ করবে, গ্রামের স্বার্থে কূলকে ত্যাগ করবে, জনপদের স্বার্থে গ্রামকেও ত্যাগ করবে, আর নিজের স্বার্থে পৃথিবীকেও ত্যাগ করবে।
১৬. কোকিলের স্বরই হল তার রূপ, নারীর রূপ হল পতিব্রত, যে কুরূপ বিদ্যাই তার রূপ, আর তপস্বীর রূপ হল মা।
১৭. কোনও দিন সোনার হরিণ তৈরি হয়নি, আগে কখনও দেখাও যায় নি, তবু তাকে ধরার বাসনা হল রঘুনন্দনের। বিনাশকালে মানুষের বুদ্ধি হয় বাঁকা।
১৮. কোনও মানুষকেই অবজ্ঞা করবে না।
১৯. ক্রোধহীনতা সব কিছু জয় করতে পারে।
খ
১.খন্তা দিয়ে খুঁড়ে খুঁড়ে মাটি থেকে জল পাওয়া যায়, সেই রকম যে শুশ্রূষু সে গুরুগত বিদ্যাকে লাভ করে।
২. খারাপ সময় যতণ যাচ্ছে ততোণ শত্রুকে কাঁধে করে রাখবে, সুসময় এলেই পাথরের আঘাতে ঘটের মতো সে সখ্য ভেঙে ফেলবে।
৩. খুব বেশি কাছে আসায় হানির সম্ভাবনা, খুব দূরে থাকলেও ফল নেই। রাজা, আগুন, আর স্ত্রী এদের মধ্যপন্থায় সেবা করা উচিত।
৪. খেয়ে যার হজম হয়, ব্যাধি তার দূরে রয়।
গ
৫. গাছের ভয় বাতাসে, পদ্মের ভয় শিশিরে, পর্বতের ভয় বর্জ্রে, সজ্জনের ভয় দুর্জনে।
৬. গুণবানকে আশ্রয় দিয়ে নির্গুণও গুণী হয়।
৭. গুণহীন মানুষ যদি উচ্চ বংশেও জন্মায় তাতে কিছু আসে যায় না। নীচকূলে জন্মেও যদি কেউ শাস্ত্রজ্ঞ হয়, তবে দেবতারাও তাঁকে সম্মান করেন।
৮. গুরু শিষ্যকে যদি একটি অক্ষরও শিক্ষা দেন, তবে পৃথিবীতে এমন কোনও জিনিস নেই যা দিয়ে সেই শিষ্য গুরুর ঋণ শোধ করতে পারে।
৯. গৃহে যার মা নেই, স্ত্রী যার দুর্মুখ তার বনে যাওয়াই ভালো, কারণ তার কাছে বন আর গৃহে কোনও তফাৎ নেই।
ঘ
১০. ঘরকুণোর বিদ্যা হয় না, মাংসখোরের দয়া হয় না, লোলুপের সত্যবোধ নেই, যে স্ত্রৈণ তার তেমনি পবিত্রতা নেই।প
১. পরস্ত্রী, পরদ্রব্য, পরনিন্দা, পরিহাস এবং মান্যজনের সম্মুখে চপলতা ত্যাগ করবে।
২. পরস্ত্রীকে যে মায়ের মতো দেখে, অন্যের জিনিসকে যে মূল্যহীন মনে করে, এবং সকল জীবকে যে নিজের মতো মনে করে সে-ই যথার্থ জ্ঞানী।
৩. পরস্পরের গোপন কথা যে নরাধমেরা প্রকাশ করে, তারা উইঢিবির ভিতরকার সাপের মতো বিনষ্ট হয়।
৪. পরাধীন ভৃত্যের সম্মান কোথায়, কোপন ব্যক্তির সুখ কোথায়, স্ত্রীলোকদের সততা কোথায়, খল ব্যক্তির মিত্রতা কোথায়?
৫. পরের অধীনে জীবিকার্জন, আশ্রয়হীন বাস, ধনহীন ব্যবসায় সবই কষ্টকর, কিন্তু দারিদ্র্য সবচেয়ে কষ্টকর।
৬. পরের উপকারে যে এগিয়ে যায়, সে-ই সৎপুরুষ।
৭. পরের গোপন কথা শোনা উচিত নয়।
৮. পাপীরা বিক্ষোভের ভয় করে না।
৯. পায়ে বেঁধা কাঁটাকে যেমন হাতের কাঁটা দিয়ে তুলে ফেলা হয়, তেমনি করে এক শত্রুকে উপকার করে বশীভূত করবে, তাকে দিয়ে অন্য শত্রুর উচ্ছেদ ঘটাবে।
১০. পাশের রাজ্যের পরের রাজ্যের সঙ্গে মিত্রতা বিধেয় [পড়শীর পাশের বাড়িতে মিত্র করবে]।
১১. পাঁচ বছর বয়স অবধি পুত্রদের লালন করবে, দশ বছর অবধি তাদের চালনা করবে, ষোল বছরে পড়লে তাদের সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করবে।
১২. পুত্র যদি হয় গুণবান, পিতা-মাতার কাছে তা স্বর্গ সমান।
১৩. পুত্র, ভৃত্য ও ভার্যা যার বশে, অভাবেও যে অতি প্রসন্ন, সে এই পৃথিবীতেই স্বর্গবাস করে।
১৪. পুত্রকে যাঁরা পড়ান না, সেই পিতামাতা তার শত্রু, হাঁসেদের মধ্যে বক যেমন শোভা পায় না, সভার মধ্যে সেই মূর্খও তেমনি শোভা পায় না।
১৫. পুত্রের প্রয়োজনেই পত্নী, পিণ্ডের প্রয়োজনেই পুত্র, হিতের প্রয়োজনেই বন্ধু, কিন্তু ধনের প্রয়োজন সকল ক্ষেত্রেই।
১৬. পুরুষকারেই [পৌরুষ, উৎসাহ, চেষ্টা। ঈপ্সিত কাজ সফল হয়।
১৭. পৃথিবীর আবরণ সমুদ্র, গৃহের আবরণ প্রাচীর, দেশের আবরণ রাজা, স্ত্রীলোকের আবরণ চরিত্র।
১৮. প্রজাদের ক্রোধ সমস্ত ক্রোধের চেয়ে গুরুতর।
১৯. প্রজার সুখেই রাজার সুখ, প্রজার মঙ্গলেই রাজার মঙ্গল, নিজের মঙ্গল রাজার প্রিয় নয়, প্রজাদের মঙ্গলই রাজার প্রিয়।
২০. প্রদীপ অন্ধকার ভক্ষণ করে কাজল প্রসব করে, যে যেমন আহার গ্রহণ করে সে তেমনি হয়।
২১. প্রবাসে বিদ্যা বন্ধু, গৃহে ভার্যা বন্ধু, রোগীর বন্ধু ভেষজ, মৃতের বন্ধু ধর্ম।
২২. প্রাজ্ঞজনদের কাছে প্রজ্ঞালাভ হয়।
২৩. প্রাজ্ঞদের মধ্যেও দোষ খুবই দেখা যায়।
২৪. প্রাজ্ঞব্যক্তি যদি দরিদ্র হন তাঁর জন্য দুঃখ করার কিছু নেই, যার বন্ধু পণ্ডিত তার জন্য দুঃখ করার কিছু নেই, তেমনি নারী বিধবা হলেও যদি সে যদি পুত্রপৌত্র দ্বারা পালিত হয়, তাহলে তার জন্য দুঃখ করার কিছু নেই।
২৫. প্রাণ দিয়েও বিশ্বাস রক্ষা করবে।
২৬. প্রার্থীকে অবজ্ঞা করবে না।
চ
৭৩. চন্দন তরুকে ছেদন করলেও সে সুগন্ধ ত্যাগ করে না। গজরাজ বৃদ্ধ হলেও বপ্রক্রীড়া ত্যাগ করে না, যন্ত্রে ইক্ষু নিপিষ্ট হলেও মধুরতা ত্যাগ করে না, যে সদ্বংশজাত অবস্থা বিপর্যয়েও সে চরিত্র গুণ ত্যাগ করে না।
৭৪. চিন্তাই মানুষের জ্বর, বস্ত্রদের জ্বর হল রোদ, স্ত্রীলোকের জ্বর হল পতির অপ্রিয়তা, ঘোড়াদের জ্বর হল মৈথুন।
ছ
৭৫. ছয় কানে (অর্থাৎ তিন জনের কানে) গেলে গুপ্তকথা প্রকাশ হয়ে যায়।
৭৬. ছেলের প্রশংসা করবে না।
জ
৭৭. জগতে ত্রুটিহীন কাজ দুর্লভ।
৭৮. জন্মান্ধ দেখতে পায় না, কামান্ধও দেখতে পায় না, গর্বোদ্ধতও দেখতে পায় না, ধনবানও এদের মতো নিজের দোষ দেখতে পায় না।
৭৯. জরুরি কাজ মন দিয়ে তখুনি করে ফেলা উচিত, সময় মতো না করলে তা কষ্টসাধ্য হয়, অথবা একান্ত অসাধ্য হয়।
৮০. জলে তেল, খলে গোপন কথা, সৎপাত্রে সামান্য দান, প্রাজ্ঞে শাস্ত্র আপনা থেকেই বিস্তার লাভ করে। বস্তুর স্বভাবধর্ম অনুযায়ীই তা হয়ে থাকে।
ত
৮১. তস্করের ধর্ম কোথায়, দুর্জনের ক্ষমা কোথায়, গণিকাদের প্রণয় কোথায়, কামনাসক্তদের সত্য কোথায়?
৮২. তিনটি বিষয়ে সন্তোষ বিধেয়- নিজের পত্নীতে, ভোজনে এবং ধনে। কিন্তু অধ্যয়ন, জপ, আর দান এই তিন বিষয়ে যেন কোনও সন্তোষ না থাকে।
৮৩. ত্রিভুবনই আমার স্বদেশ।
দ
৮৪. দণ্ডদানে অতি নির্দয়তাকে সকলেই নিন্দা করে।
৮৫. দর্শনশাস্ত্র সমস্ত বিদ্যার প্রদীপ, সমস্ত কাজের উপায় এবং সমস্ত ধর্মের চিরদিনের আশ্রয়।
৮৬. দান করার স্বভাব, ভালো কথা বলার গুণ, ধীরতা ও ঔচিত্যবোধ- এসব অভ্যাস করে লাভ করা যায় না, এ চারটি স্বভাবগুণ।
৮৭. দান দারিদ্র্য দূর করে, চরিত্র দুর্গতি দূর করে, প্রজ্ঞা অজ্ঞানতা দূর করে, সম্যক্ চিন্তা ভয় দূর করে।
৮৮. দারিদ্র্য, রোগ, দুঃখ, বন্ধন, এবং বিপদ- সব কিছুই মানুষের নিজেরই অপরাধরূপ বৃক্ষের ফল।
৮৯. দারিদ্র্যও শোভা পায় যদি তার সঙ্গে ধৈর্য যুক্ত হয়, কাপড় যতই খারাপ হোক যদি তা পরিচ্ছন্ন হয়, তা মানিয়ে যায়। অন্ন-ব্যঞ্জন নিকৃষ্ট হলেও যদি তা গরম গরম খাওয়া যায়, তা হলে আর অত খারাপ মনে হয় না। তেমনি যদি স্বভাব সুন্দর হয়, রূপ না থাকলেও তাকে হতশ্রী মনে হয় না।
৯০. দুই ব্রাহ্মণের মধ্যে, ব্রাহ্মণ আর বহ্নির মধ্যে, স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে, এবং প্রভু ও ভৃত্যের মধ্যে থাকবে না। লাঙল ও বলদের মধ্যে থাকার মতো এগুলিও বিধেয় না।
৯১. দুধ যার দরকার সে হস্তিনী দিয়ে কী করবে?
৯২. দুধে মেশানো জল দুধেই পরিণত হয়।
৯৩. দুর্জন প্রিয়ভাষী হলেও তাকে বিশ্বাস করবে না। জিভে তার মধু, মনে বিষ শুধু।
৯৪. দুর্জনের সংসর্গ ত্যাগ করে সজ্জনের সঙ্গ করবে। অহোরাত্র পুণ্য করবে, সর্বদা নশ্বরতার কথা মনে রাখবে।
৯৫. দুর্বলের বল রাজা, শিশুর বল কান্না, মূর্খের বল নীরবতা, চোরের মিথ্যাই বল।
৯৬. দুষ্টা স্ত্রী, প্রবঞ্চক বন্ধু, দুর্মুখ ভৃত্য এবং সসর্প গৃহে বাস যে মৃত্যুর দ্বার এবিষয়ে সংশয় নেই।
৯৭. দেহ যতদিন সুস্থ আছে, এবং মৃত্যু যতদিন দূরে আছে, ততোদিন দেহী নিজের হিত করবে, মরে গেলে আর সে কী করবে?
ধ
১. ধনধান্যের আদানপ্রদানে, বিদ্যা উপার্জনে আহারে ও ব্যবহারে সর্বদা লজ্জা ত্যাগ করবে।
২. ধনবান, বেদবিদ ব্রাহ্মণ, রাজা, নদী ও বৈদ্য এই পাঁচটি যেখানে নেই, সেখানে বাস করবে না।
৩. ধর্ম, লোকাচার, চরিত্র ও রাজশাসন এরা বিবাদের ক্ষেত্রে চতুষ্পাদ- শেষেরটি যথাক্রমে আগেরটিকে বাতিল করে দেয়।
৪. ধর্মই মানুষকে ঠিক রাখে।
৫. ধর্মের চেয়ে ব্যবহারই বড়ো।
৬. ধর্মের জন্মভূমি হল দয়া।
৭. ধেনুর স্বভাব যে ঠিক মতো জানে, সে-ই দুধ খেতে পায়।
৮. ধ্র“ব ত্যাগ করে যে অধ্রুবের সেবা করে তার ধ্রুব-নাশ হয়, যা অধ্রুব তা বিনষ্টই।
ন
৯. নক্ষত্রটি কী বলে সর্বদাই যে তা জানতে চায়, সম্পদ তাকে ছেড়ে যায়। সম্পদই সম্পদের শুভনক্ষত্র। অন্য নক্ষত্রেরা কী করতে পারে?
১০. নখযুক্ত ও শিংওলা প্রাণী, অস্ত্রধারী, নদী, স্ত্রী ও রাজকূলকে কখনও বিশ্বাস করবে না।
১১. নদীতীরের গাছ, পরের হাতের অর্থ, স্ত্রীর উপর ছেড়ে দেওয়া কাজ- এসবই বিফল হয়।
১২. নদীর ধারে যার ক্ষেত, স্ত্রী অন্যের প্রিয়পাত্র, পুত্র দুরাচার ও উদ্ধত সংসার যে তার কাছে মৃত্যুতুল্য এতে কোনও সংশয় নেই।
১৩. নানা পরীক্ষ নিরীক্ষা করেই বিঘ্ন কাটাতে হয়।
১৪. নানাভাবে শিক্ষা পেলেও দুর্জন সাধু হয় না, নিম গাছ যেমন আমূল জলসিক্ত করে কিংবা দুধে ভিজিয়ে রাখলেও কখনও মধুর হয় না।
১৫. নারী ঘৃতপূর্ণ ঘটের মতো, পুরুষ তপ্ত অঙ্গারের মতো, তাই ঘৃত ও বহ্নিকে প্রাজ্ঞজন একত্র স্থাপন করেন না।
১৬. নারীর আহার (পুরুষের) দ্বিগুণ, বুদ্ধি চতুর্গুণ, কর্মোদ্যোগ ছয়গুণ, এবং ভোগলিপ্সা আটগুণ বেশি।
১৭. নিজের ত্রুটি পরে যেন না জানে, অন্যের ত্রুটি জানতে হবে। নিজের অঙ্গ শামুকের মতো গোপন করে পরের মনোভাব লক্ষ্য করতে হবে।
১৮. নিজের দোষ প্রকাশ করবে না।
১৯. নিজে প্রত্যক্ষ দেখলেও- শিলা জলে ভাসছে, বা বানর গান গাইছে এমন অসম্ভব কিছু বলা ঠিক নয়।
২০. নিজে যে প্রজ্ঞাহীন শাস্ত্র তার কোন্ কাজে লাগবে? যে অন্ধ সে দর্পণ দিয়ে কি করবে?
২১. নিজের শক্তি ভালোভাবে জেনে তবেই কাজ শুরু করবে।
২২. নিজের হাতে গাঁথা মালা, নিজের হাতে ঘষা চন্দন, নিজের হাতে লেখা স্তোস্ত্র ইন্দ্রের শ্রীকেও হার মানায়।
২৩. নির্ধনকে বন্ধু, স্ত্রী, ভৃত্য এবং সুহৃদজনেরাও ত্যাগ করে, কিন্তু সে যদি অর্থলাভ করে তবে তারা তাকেই আশ্রয় করে। অর্থই এজগতে পুরুষের বন্ধু।
২৪. নিশা পোহালেই প্রভাতে সারাদিনের করণীয় চিন্তা করে নেবে।
প
১. পরস্ত্রী, পরদ্রব্য, পরনিন্দা, পরিহাস এবং মান্যজনের সম্মুখে চপলতা ত্যাগ করবে।
২. পরস্ত্রীকে যে মায়ের মতো দেখে, অন্যের জিনিসকে যে মূল্যহীন মনে করে, এবং সকল জীবকে যে নিজের মতো মনে করে সে-ই যথার্থ জ্ঞানী।
৩. পরস্পরের গোপন কথা যে নরাধমেরা প্রকাশ করে, তারা উইঢিবির ভিতরকার সাপের মতো বিনষ্ট হয়।
৪. পরাধীন ভৃত্যের সম্মান কোথায়, কোপন ব্যক্তির সুখ কোথায়, স্ত্রীলোকদের সততা কোথায়, খল ব্যক্তির মিত্রতা কোথায়?
৫. পরের অধীনে জীবিকার্জন, আশ্রয়হীন বাস, ধনহীন ব্যবসায় সবই কষ্টকর, কিন্তু দারিদ্র্য সবচেয়ে কষ্টকর।
৬. পরের উপকারে যে এগিয়ে যায়, সে-ই সৎপুরুষ।
৭. পরের গোপন কথা শোনা উচিত নয়।
৮. পাপীরা বিক্ষোভের ভয় করে না।
৯. পায়ে বেঁধা কাঁটাকে যেমন হাতের কাঁটা দিয়ে তুলে ফেলা হয়, তেমনি করে এক শত্রুকে উপকার করে বশীভূত করবে, তাকে দিয়ে অন্য শত্রুর উচ্ছেদ ঘটাবে।
১০. পাশের রাজ্যের পরের রাজ্যের সঙ্গে মিত্রতা বিধেয় [পড়শীর পাশের বাড়িতে মিত্র করবে]।
১১. পাঁচ বছর বয়স অবধি পুত্রদের লালন করবে, দশ বছর অবধি তাদের চালনা করবে, ষোল বছরে পড়লে তাদের সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করবে।
১২. পুত্র যদি হয় গুণবান, পিতা-মাতার কাছে তা স্বর্গ সমান।
১৩. পুত্র, ভৃত্য ও ভার্যা যার বশে, অভাবেও যে অতি প্রসন্ন, সে এই পৃথিবীতেই স্বর্গবাস করে।
১৪. পুত্রকে যাঁরা পড়ান না, সেই পিতামাতা তার শত্রু, হাঁসেদের মধ্যে বক যেমন শোভা পায় না, সভার মধ্যে সেই মূর্খও তেমনি শোভা পায় না।
১৫. পুত্রের প্রয়োজনেই পত্নী, পিণ্ডের প্রয়োজনেই পুত্র, হিতের প্রয়োজনেই বন্ধু, কিন্তু ধনের প্রয়োজন সকল ক্ষেত্রেই।
১৬. পুরুষকারেই [পৌরুষ, উৎসাহ, চেষ্টা। ঈপ্সিত কাজ সফল হয়।
১৭. পৃথিবীর আবরণ সমুদ্র, গৃহের আবরণ প্রাচীর, দেশের আবরণ রাজা, স্ত্রীলোকের আবরণ চরিত্র।
১৮. প্রজাদের ক্রোধ সমস্ত ক্রোধের চেয়ে গুরুতর।
১৯. প্রজার সুখেই রাজার সুখ, প্রজার মঙ্গলেই রাজার মঙ্গল, নিজের মঙ্গল রাজার প্রিয় নয়, প্রজাদের মঙ্গলই রাজার প্রিয়।
২০. প্রদীপ অন্ধকার ভক্ষণ করে কাজল প্রসব করে, যে যেমন আহার গ্রহণ করে সে তেমনি হয়।
২১. প্রবাসে বিদ্যা বন্ধু, গৃহে ভার্যা বন্ধু, রোগীর বন্ধু ভেষজ, মৃতের বন্ধু ধর্ম।
২২. প্রাজ্ঞজনদের কাছে প্রজ্ঞালাভ হয়।
২৩. প্রাজ্ঞদের মধ্যেও দোষ খুবই দেখা যায়।
২৪. প্রাজ্ঞব্যক্তি যদি দরিদ্র হন তাঁর জন্য দুঃখ করার কিছু নেই, যার বন্ধু পণ্ডিত তার জন্য দুঃখ করার কিছু নেই, তেমনি নারী বিধবা হলেও যদি সে যদি পুত্রপৌত্র দ্বারা পালিত হয়, তাহলে তার জন্য দুঃখ করার কিছু নেই।
২৫. প্রাণ দিয়েও বিশ্বাস রক্ষা করবে।
২৬. প্রার্থীকে অবজ্ঞা করবে না।
ফ
১৪৮. ফল ও ছায়াযুক্ত বড়ো গাছকে আশ্রয় করতে হয়। ফল যদি দৈবাৎ না-ও পাওয়া যায়, ছায়া তো আর কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।
ব
১৪৯. বইয়ে থাকা বিদ্যা, পরের হাতে থাকা ধন একইরকম। প্রয়োজনকালে তা বিদ্যাই নয়, ধনই নয়।
১৫০. বলবানের সঙ্গে যুদ্ধ হল হাতির পায়ের সঙ্গে যুদ্ধের মতো অর্থাৎ দলিত মথিত হয়ে যেতে হবে।
১৫১. বস্ত্রহীন অলংকার, ঘৃতহীন ভোজন, স্তনহীন নারী এবং বিদ্যাহীন জীবন ব্যর্থ।
১৫২. বাঘ আর হাতিতে পূর্ণ বন বরং ভালো, তেমনি ভালো বনের মধ্যে ঘর, সেখানে পাকা ফল আর জল তো খাওয়া চলে, তৃণ শয্যায় শতচ্ছিন্ন কম্বল থাকলেও ক্ষতি নেই, কিন্তু স্বজনদের মধ্যে ধনহীন জীবন বৃথা।
১৫৩. বার্ধক্যে পত্নী বিয়োগ, জ্ঞাতির হাতে ধন, এবং পরাধীন ভোজন- পুরুষের এই তিন বিড়ম্বনা।
১৫৪. বালকও যদি যুক্তিপূর্ণ কিছু বলে তবে তা মন দিয়ে শুনবে।
১৫৫. বিবেকবান ব্যক্তিকে আশ্রয় করে গুণেরা আরও মনোজ্ঞ হয়ে ওঠে, যেমন স্বর্ণখচিত হয়ে রত্ন আরও শোভা পায়।
১৫৬. বিক্রমই রাজাদের সম্পদ।
১৫৭. বিচক্ষণ ব্যক্তি বর্জন করবে- কুদেশ, কুবৃত্তি, কুভার্যা, কুনদী, কুদ্রব্য ও কুভোজন।
১৫৮. বিদ্বান সকল গুণের আধার, আর অজ্ঞজনের কেবলই দোষ। তাই হাজার মূর্খের চেয়ে একজন বিদ্বান অনেক কাম্য।
১৫৯. বিদ্যাকে ধরে থাকে অভ্যাস, কুলকে ধরে থাকে চরিত্র। গুণেই শিষ্টের পরিচয়। ক্রোধের প্রকাশ দৃষ্টিতে।
১৬০. বিদ্যাবত্তা ও রাজপদ এ-দুটি কখনও সমান হয় না। রাজা কেবল নিজদেশেই সমাদৃত, বিদ্বান সর্বত্র সমাদৃত।
১৬১. বিদ্যা ব্যতীত জীবন ব্যর্থ, কুকুরের লেজ যেমন ব্যর্থ- তা দিয়ে সে গুহ্য অঙ্গও গোপন করতে পারে না, মশাও তাড়াতে পারে না।
১৬২. বিদ্যাভূষিত হলেও দুর্জনকে ত্যাগ করবে, মণিভূষিত হলেও সাপ কি ভয়ঙ্কর নয়?
১৬৩. বিদ্যার মতো বন্ধু নাই, ব্যাধির মতো শত্রু নাই। সন্তানের মতো স্নেহপাত্র নাই, দৈবের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বল নাই।
১৬৪. বিদ্যার্থী, সেবক, পথিক, ক্ষুধার্ত, ভয়ার্ত, ভাণ্ডারী ও দ্বারপাল- এই সাতজন ঘুমিয়ে থাকলে তাদের জাগিয়ে দেবে।
১. বিদ্যাহীন জীবন শূন্য, বন্ধুহীন পরিবেশ শূন্য, পুত্রহীন গৃহ শূন্য, কিন্তু দারিদ্র্য থাকলে সবকিছুই শূন্য।
২. বিদ্যাহীন পুরুষ, পুত্রহীন মৈথুন, নিরাহারা প্রজাবর্গ অরাজক রাজ্য দুঃখজনক।
৩. বিদ্যায় সুসংস্কৃত রাজা প্রজাদের সংস্কৃতিসাধনে নিরত থকেন। সমস্ত প্রাণীর কল্যাণে নিরত এমন রাজা অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে পৃথিবী ভোগ করেন।
৪. বিনয়ই সকলের ভূষণ।
৫. বিনয়গুণহীন প্রভু লাভের চেয়ে প্রভুহীন হওয়াই ভালো।
৬. বিনাশ ও বৃদ্ধি মানুষের নিজেরই করায়ত্ত।
৭. বিন্দু বিন্দু জল জমে ঘট ক্রমশ ভরে ওঠে, বিদ্যা ধর্ম ধনও ক্রমে ক্রমে বেড়ে ওঠে।
৮. বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার জন্য ধন রক্ষা করবে, ভার্যাকে রক্ষা করার জন্য ঐ ধনও ত্যাগ করবে। আর নিজেকে রক্ষা করতে ভার্যা ও ধন উভয়ই ত্যাগ করবে।
৯. বিপুল অর্থ যার আছে সে ব্রহ্মঘাতী হলেও পূজ্য হয়, আর চন্দ্রবংশের তূল্য উচ্চবংশজাত নির্ধন হলেও অবজ্ঞাত হয়।
১০. বিষ থেকেও অমৃত আহরণ করা চলে, মলাদি অশুচি বস্তু থেকেও স্বর্ণ আহরণ করা যায়, নীচ জাতি থেকেও উত্তম বিদ্যা আহরণ করা যায়, নীচকূল থেকেও স্ত্রীরত্ন গ্রহণ করা চলে।
১১. বিষয়াসক্ত মন বন্ধনকে বরণ করে, আসক্তিহীন মনই মুক্তির পথে যায়। মনই মানুষের বন্ধন ও মুক্তির কারণ।
১২. বিষহীন সাপেরও ফণা তোলা উচিত। বিষ থাকুক বা না থাকুক ফণাবিস্তারটাই ভয়ংকর।
১৩. বুদ্ধিমান একপায়ে চলেন, একপায়ে দাঁড়ান, পরবর্তী স্থান ভালো করে না দেখে পূর্বস্থান ত্যাগ করেন না।
১৪. বুদ্ধিমান কখনও অর্থনাশ, মনস্তাপ, গৃহের অনাচার, বঞ্চনা ও অপমান বাইরে প্রচার করে না।
১৫. ব্যাধি হল শত্রুর চেয়েও ভয়ংকর।
১৬. বংশের দোষে লোকে কৃপণ, কর্মদোষে দরিদ্র, মায়ের দোষে প্রমত্ত, আর পিতৃদোষে হয় মূর্খ।
১৭. ব্রহ্মজ্ঞানী স্বর্গকে তৃণের মতো মনে করে, বীরের কাছে জীবন তৃণের মতো তুচ্ছ, জিতেন্দ্রিয়ের কাছে রমণী এবং বীতরাগের কাছে জগৎ তৃণের মতোই তুচ্ছ।
১৮. ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈদ্যের গুরু অগ্নি, চারটি বর্ণের গুরু ব্রাহ্মণ, স্ত্রীর গুরু স্বামী, অতিথি সকলের গুরু।
১৯. ব্রাহ্মণেরা ভোজনে খুশি, ময়ূরেরা মেঘের ডাকে, সাধুরা ঈশ্বরের করুণা পেলে, আর খলেরা খুশি পরের দুর্গতি ঘটিয়ে।
ভ
১৮৪. ভবিতব্যতা যেমন বুদ্ধিও ঠিক তেমনি হয়, কর্মধারাও তেমনি, সহায়তাও তেমনি।
১৮৫. ভাতের চেয়ে দশগুণ পিঠে, পিঠের চেয়ে দশগুণ দুধ, দুধের চেয়ে দশগুণ মাংস, মাংসের চেয়ে দশগুণ ঘি (পুষ্টি দেয়)।
১৮৬. ভৃত্যকে পরীক্ষা করবে কাজে নিযুক্ত করে, কোনও অঘটন ঘটলে চিনবে স্বজনকে, বিপদে চিনবে বন্ধুকে, পত্নীকে চিনবে ধনক্ষয় হলে।
১৮৭. ভেবেচিন্তে যে কাজ করে, তার শ্রী চিরস্থায়ী।
১৮৮. ভোগবাসনায় বুদ্ধি আচ্ছন্ন হয়।
১৮৯. ভ্রমণে রাজা, ব্রাহ্মণ, যোগীর সম্মান, কিন্তু এই ভ্রমণেই নারীর বিনাশ।
ম
১৯০. মনের বাসনা কার সবটা পূর্ণ হয়? সমস্তই দৈবের অধীন, তাই সন্তোষকে আশ্রয় করাই শ্রেয়।
১৯১. মনের সংকল্প প্রকাশ করবে না, সংকল্পিত কাজের কথা অন্যে জানতে পারলে সে কাজ সফল হয় না।
১৯২. মাংসাশী, মদ্যপায়ী এবং অরজ্ঞানহীন মূর্খ- এই সব পুরুষাকার পশুর দ্বারা এই পৃথিবী ভারাক্রান্ত।
১৯৩. মিত ভোজনেই স্বাস্থ্যলাভ হয়।
১৯৪. মূর্খ শিষ্যের উপদেশে, দুষ্ট স্ত্রীকে পালনে এবং শত্রুদের কূটচক্রে পণ্ডিত বিনষ্ট হয়।
১৯৫. মূর্খত্ব কষ্টকর, যৌবন কষ্টকর সন্দেহ নেই, কিন্তু পরগৃহে বাস সব চেয়ে কষ্টকর।
১৯৬. মূর্খের কাজ অবাঞ্ছিত হবে, তা নিয়ে বেশি ভেবে লাভ নেই।
১৯৭. মৃগয়ায় যে আসক্ত তার ধর্ম ও অর্থ দুই-ই নষ্ট হয়।
১৯৮. মেঘের মতো জল নাই, আত্মার মতো বল নাই, চোখের মতো তেজ নাই, অন্নের মতো প্রিয় নাই।
১৯৯. মেধাবী এবং বাকপটু, প্রাজ্ঞ, পরের মন বোঝায় যিনি দক্ষ, যিনি ধীর এবং ঠিক যা বলা হয়েছে তা-ই বলেন, তিনিই দূত হবার যোগ্য।
য
১. যশবানের বিনাশ নেই।
২. যা ঘটে গিয়েছে তার জন্য শোক করা উচিত নয়, ভবিষ্যতের জন্যও শোক বিধেয় নয়, বিচক্ষণেরা বর্তমান কালেই যথোচিত কর্ম করে চলেন।
৩. যাদের বুদ্ধি আছে তারা করে খেতে পারে।
৪. যার গুণ আছে সে বেঁচে আছে, যার ধর্ম আছে সেও বেঁচে আছে, গুণ বা ধর্ম যার নেই তার বেঁচে থাকা নিষ্প্রয়োজন।
৫. যার চিত্ত চঞ্চল তার ইহকালও নাই পরকালও নাই।
৬. যার মনে যে বাস করে, দূরে থেকেও সে দূরে নয়। যে যার হৃদয়ে নেই, কাছে থেকেও সে দূরে।
৭. যার স্থৈর্য নাই, তার জীবনধারণই বিঘ্নিত।
৮. যার যার যে ভাব, সেই সেই ভাবে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে প্রাজ্ঞজন তাদের নিজের বশে আনবেন।
৯. যারা নীচ তারা পরযশরূপ অগ্নিতে দগ্ধ হয়, কিন্তু সেই পদে উন্নীত হতে না পেরে তারা যশস্বীর নিন্দা করতে শুরু করে।
১০. যাঁরা রূপযৌবনসম্পন্ন এবং উচ্চকূলজাত হয়েও বিদ্যাহীন তাঁরা সুবাসহীন পলাশ ফুলের মতো বেমানান।
১১. যুগান্তে মেরু কম্পিত হতে পারে, কল্পান্তে সপ্ত সাগর উদ্বেলিত হতে পারে, কিন্তু সাধুরা যা প্রতিজ্ঞা করেন তার থেকে সরে যান না।
১২. যে অলস অলব্ধ লাভ (অর্থাৎ যা পাওয়া হয়নি, তা লাভ) তার হয় না।
১৩. যে কঠোর দণ্ড দেয় তাকে কেউ দেখতে পারে না, যে মৃত্যু দণ্ড দেয় তাকে সবাই অবজ্ঞা করে, যে যথাযথ দণ্ড দেয় সবাই তাকে সম্মান করে।
১৪. যে কাজ সিদ্ধ হলেও কোনও উল্লেখযোগ্য ফল ফলে না, কিন্তু বিফল হলে বড় রকমের অনিষ্টের সম্ভাবনা থাকে, প্রাজ্ঞজন সে কাজ করবেন কেন?
১৫. যে কালজ্ঞ সে-ই কার্যসাধন করতে পারে।
১৬. যে কৃষকের ঘরে সর্বদা প্রচুর অন্ন থাকে, এবং যার রোগ নেই, তার নিত্যই সুখ। যার স্ত্রী অনুগতা তার গৃহে নিত্যই উৎসব।
১৭. যেখানে শাস্ত্রের অনুশাসন নেই, সেখানে শিষ্টাচার অনুসরণীয়।
১৮. যে গাভী দুধও দেয় না, গর্ভ ধারণও করে না, সে গাভী দিয়ে কি হবে? সে পুত্র দিয়ে কী হবে যে বিদ্বান ও ভক্তিমান নয়?
১৯. যে নিজে দুর্বল, তার আশ্রয় নিলে দুঃখই বয়ে আনে।
২০. যে দুর্বল হয়ে পড়েছে তার মিত্রতা করাই ভালো।
২১. যে দেশে সম্মান, কর্মসংস্থান, বন্ধু ও কোনও বিদ্যাচর্চার সুযোগ নেই সে দেশ বর্জন করবে।
২২. যে পিতামাতা ছেলেকে শিক্ষাদান করেন না, তাঁরা তার শত্রু। হাঁসের মধ্যে বক যেমন, তেমনি বিদ্বজ্জন সভার মধ্যে সেই ছেলেও বেমানান।
২৩. যে বন্ধু একবার খারাপ ব্যবহার করে, তার সঙ্গে প্রীতির সম্পর্ক স্থাপন করলে অশ্বতরীর গর্ভ ধারণের মতো তা বিনাশের কারণ হবে।
২৪. যে ব্যসনাসক্ত [নারী, মদ, অপরাধে আসক্ত] তার কার্যসিদ্ধি ঘটে না।
২৫. যে ভীরু তার কাজের চিন্তা নাই, কারণ ভয়ে সে কোনও কাজেই যে হাত দেয় না।
২৬. যে যার গুণের বিষয় জানে না, সে যে সর্বদা তার নিন্দা করেবে এতে আশ্চর্য কিছু নেই, ব্যাধ যেমন গজকুম্ভ থেকে মুক্তা পেয়েও গুঞ্জাফল ধারণ করে তেমনি।
২৭. যে লোহা তপ্ত নয়, তাকে লোহার সঙ্গে জুড়তে যাবে না।
২৮. যে সবল অলব্ধ লাভে (অর্থাৎ যা পাওয়া হয়নি, তা লাভে) তার যত্নবান হওয়া উচিত।
উপন্যাস লেখায় ফকনারের ৭টি টিপস
সাবিদিন ইব্রাহিম
‘যে তরুণ লেখক কোন মতবাদ অনুসরণ করে সে একটা আস্ত বোকা।’ কথাটি বলেছিলেন নোবেল বিজয়ী লেখক উইলিয়াম ফকনার প্যারিস রিভিউর একটি সাক্ষাৎকারে। ‘নিজের ভুল থেকে শেখো, মানুষ ভুল করেই শেখে। একজন ভাল শিল্পী মনে করে তাকে উপদেশ দেয়ার মত তার চেয়ে যোগ্যতর আর কেউ নেই।’
মজার ব্যাপার হল, ফকনার ১৯৫৭-৫৮ সালের দিকে তরুণ লেখকদের মাঝে প্রচুর উপদেশ বিলি করেছেন। তিনি তখন ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আবাসিক লেখক’ (writer in residence) পদে ছিলেন। তার অনেক বক্তৃতা, অভিভাষণ, আলোচনা টেপ রেকর্ড করা হয়েছিল। এগুলো ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফকনার অডিও আর্কাইভ’-এ সংরক্ষিত। আমরা এগুলো থেকে বাছাই করে ফকনারের সাতটি মজার উক্তি বের করেছি। ফিকশনের উপর তার ঐ কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটেছে রেকর্ডগুলোতে। ফকনারের তোতলামির স্বভাব ছিল এবং একই শব্দ একাধিকার উচ্চারণ করত। এখানে আমরা তার পুনরুক্তি বাদ দিয়েছি।
১. অন্য লেখক থেকে যা নেওয়ার নিয়ে নাও
অন্য লেখক থেকে কাজের জিনিস চুরি করা ফকনারের মতে দোষের কিছু নয়। ১৯৫৭ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারিতে লেখালেখির একটি ক্লাসে তিনি বলেছিলেন--
‘‘এটা আগেও বলেছি যে আমি মনে করি লেখকরা চোর-বাটপার। অন্যদের থেকে প্রয়োজনমত সে চুরি করে নেয়। এটা অনেকটা প্রকাশ্যে সততার সাথে করে থাকে। তবে এ চুরির মাহাত্ম্য হলো এই যে, সে ও তার চেয়ে (যার থেকে চুরি করেছে) ভালো কিছু উপহার দিতে চায়। যাতে ভবিষ্যতে অন্য কোন নতুন চোর তার থেকে চুরি করে তাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে।’’
২. স্টাইল নিয়ে দুশ্চিন্তা নয়
একজন খাঁটি লেখক তার লেখা নিয়েই চরম ব্যস্ত। স্টাইল নিয়ে মাথা ঘামানোর এত সময় কই! ১৯৫৮ সালের ২৪ এপ্রিল আন্ডারগ্যাজুয়েটদের লেখালেখি ক্লাসে ফকনার বলেন--
“আমি মনে করি কোন গল্প নিজেই স্টাইল ধরে নেয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। লেখককে এত দুশ্চিন্তা করতে নেই। স্টাইল নিয়ে অতি দুশ্চিন্তার ফলে একটা মহামূল্যবান (!) ‘বাজে সাহিত্য’ জন্ম নিবে। ঐগুলো আসলেই অর্থহীন। হয়তোবা দেখতে সুন্দর, শ্রুতিমধুর মনে হবে কিন্তু ভেতরে মাল (সার) নেই।”
৩. অভিজ্ঞতা থেকে লিখ আর অভিজ্ঞতার দরজা খোলা রেখো
ফকনার এই পুরনো তত্ত্বে বিশ্বাস রেখেছেন। আর যাই হউক অভিজ্ঞতার বাইরে লেখা তো অসম্ভব। তবে অভিজ্ঞতা নিয়ে তার ধারণাটা মজার। ১৯৫৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আমেরিকান ফিকশন এর উপর গ্যাজুয়েটদের ক্লাসে ফকনার বলেছিলেন--
“আমার মতে তুমি যা-ই অনুধাবন করতে পারে তা-ই অভিজ্ঞতা। এটা বই থেকেও আসতে পারে। এটা এমন বই, এমন গল্প এবং এতই জীবন্ত যে, যা তোমাকে নাড়িয়ে দেয়। আমার মতে এটা তোমার অভিজ্ঞতাসমূহের একটি। এটা এমন নয় যে ঐ বইয়ের চরিত্রগুলো যা করে তা নিজে করে অভিজ্ঞতা নিতে হবে। চরিত্রগুলোর কাজ যদি বাস্তবসম্মত মনে হয় এবং মনে হয় মানুষ এমনটিই করে তাহলে এটা একটা অভিজ্ঞতা। তাই আমার অভিজ্ঞতার সংজ্ঞা হচ্ছে এই যে অভিজ্ঞতার বাহিরে লেখা অসম্ভব। কারণ যা তুমি পড়, শুন, অনুভব কর, কল্পনা কর— এ সবই অভিজ্ঞতার অংশ।”
৪. তোমার চরিত্রগুলোকে ভাল করে জানো— তাহলে গল্পটা নিজেই নিজেকে লিখবে
ফকনার বলেন— যখন কোন একটা চরিত্র সম্পর্কে তোমার স্পষ্ট ধারণা থাকবে, গল্পের ঘটনা পরিক্রমা প্রয়োজনের তাগিদেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রবাহিত হবে। চরিত্র রূপায়ন নিয়ে এক ছাত্রের প্রশ্নের জবাবে ফকনার তার ১৯৫৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির আমেরিকান ফিকশনের ঐ ক্লাসটিতে বলেন--
“আমি বলব তোমার মনে বানানো চরিত্রটি নাও। তোমার মনে যেভাবে ধরা দিয়েছে তা-ই সঠিক, তা-ই সত্য। তোমার কাজ শুধু সঙ্গ দেয়া। সে যা করে, যা বলে তা-ই লেখা। এটা হচ্ছে প্রথমে গলাধঃকরণ তারপর গর্ভধারণ। তোমাকে অবশ্যই চরিত্রকে জানতে হবে। তাকে বিশ্বাস করতে হবে। তোমাকে অনুভব করতে হবে যে জীবন্ত। তারপর অবশ্যই তুমি তার কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করবে, সাজাবে। তোমার ইচ্ছে মতো। এরপর তো গল্পটা দাঁড়ানো সময়ের ব্যাপার মাত্র। কাগজ নাও, লিখে ফেলো, ব্যাস।”
৫. আঞ্চলিক শব্দ এড়িয়ে চলো
অনেকগুলো স্থানীয় রেডিও প্রোগ্রামে ফকনার আঞ্চলিক শব্দের ভয়াবহতা নিয়ে কথা বলেছেন। এগুলো ভার্জিনিয়া ইউনিভার্সিটির ওই অডিও আর্কাইভেই সংরক্ষিত।
১৯৫৮ সালে ৬ মে ‘কোনটি ভাল শব্দ’ এই সম্প্রচারে ফকনার লেখকদেরকে সতর্ক করে দেন— লেখকরা যেন স্রোতে ভেসে না যান এবং নিজের হাতে যেন হাল ধরে রাখেন। তিনি বলেন— “আমি মনে করি যত অল্প সংখ্যক আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করা যায় ততই মঙ্গল। আঞ্চলিক শব্দ পাঠককে বিভ্রান্ত করে। কারণ ওগুলো তার কাছে পরিচিত নাও হতে পারে। এজন্য কোন চরিত্রকে সম্পূর্ণভাবে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে দেয়া উচিত নয়। দুয়েকটা সহজ ও পরিচিত শব্দ ব্যবহার করা যেতেই পারে।”
৬. তোমার কল্পনা শক্তি ফুরিয়ে ফেল না
“কোন কাহিনী বা চিন্তার শেষটা লিখে ফেল না।” এ উপদেশটি ফকনার ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক আলোচনাতেই একাধিকবার দিয়েছেন। আর্নেস্ট হোমিংওয়ের সাথে এর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। (আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ৭টি টিপস প্রকাশ করা হবে আগামী সপ্তাহে)।
১৯৫৭ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি লেখালেখির ক্লাসে ফকনার বলেন— “আমি বলব, গরম থাকতে থাকতেই ছেড়ে দাও। শেষটা লিখে ফেল না। ভাল থাকতে থাকতেই ছেড়ে দাও। এরপর নতুন করে ধরা সহজতর। যদি তোমাকে ফুরিয়ে ফেল, তোমার লেখা বন্ধ হয়ে যাবে। অনেক সমস্যায় পড়বে।”
৭. কোনো অজুহাত নয়
ঐ ক্লাসটিতেই (২৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৭,) ফকনার কিছু তেঁতো কথা বলেন, ওই সব হতাশ লেখকদেরকে উদ্দেশ্য করে যারা তাদের ব্যর্থতার জন্য (লেখক হিসেবে) পরিবেশকে দায়ী করে, গালি দেয়।
“আমার রাগ ওঠে যায় ওইসব অকর্মা ‘প্রতিভাধর লেখক-কবিদের’ প্রতি যারা চিৎকার করে বলে বেড়ায় তার এই নেই, সেই নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। এদের অনেকে বলে— আমি যদি এই কাজ না করতাম, তাইলে লেখক হতাম। কেউ বলে— আমি যদি বিয়ে না করতাম, বাচ্চা-কাচ্চা না থাকত, তাইলে লেখক হতাম।
আমার এদের কথায় এক দণ্ডও বিশ্বাস নেই। আমি মনে করি— তুমি যদি লিখতে চাও, তুমি লিখবে। আর কোনো কিছুই তোমাকে থামাতে পারবে না।”
মজার ব্যাপার হল, ফকনার ১৯৫৭-৫৮ সালের দিকে তরুণ লেখকদের মাঝে প্রচুর উপদেশ বিলি করেছেন। তিনি তখন ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আবাসিক লেখক’ (writer in residence) পদে ছিলেন। তার অনেক বক্তৃতা, অভিভাষণ, আলোচনা টেপ রেকর্ড করা হয়েছিল। এগুলো ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফকনার অডিও আর্কাইভ’-এ সংরক্ষিত। আমরা এগুলো থেকে বাছাই করে ফকনারের সাতটি মজার উক্তি বের করেছি। ফিকশনের উপর তার ঐ কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটেছে রেকর্ডগুলোতে। ফকনারের তোতলামির স্বভাব ছিল এবং একই শব্দ একাধিকার উচ্চারণ করত। এখানে আমরা তার পুনরুক্তি বাদ দিয়েছি।
১. অন্য লেখক থেকে যা নেওয়ার নিয়ে নাও
অন্য লেখক থেকে কাজের জিনিস চুরি করা ফকনারের মতে দোষের কিছু নয়। ১৯৫৭ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারিতে লেখালেখির একটি ক্লাসে তিনি বলেছিলেন--
‘‘এটা আগেও বলেছি যে আমি মনে করি লেখকরা চোর-বাটপার। অন্যদের থেকে প্রয়োজনমত সে চুরি করে নেয়। এটা অনেকটা প্রকাশ্যে সততার সাথে করে থাকে। তবে এ চুরির মাহাত্ম্য হলো এই যে, সে ও তার চেয়ে (যার থেকে চুরি করেছে) ভালো কিছু উপহার দিতে চায়। যাতে ভবিষ্যতে অন্য কোন নতুন চোর তার থেকে চুরি করে তাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে।’’
২. স্টাইল নিয়ে দুশ্চিন্তা নয়
একজন খাঁটি লেখক তার লেখা নিয়েই চরম ব্যস্ত। স্টাইল নিয়ে মাথা ঘামানোর এত সময় কই! ১৯৫৮ সালের ২৪ এপ্রিল আন্ডারগ্যাজুয়েটদের লেখালেখি ক্লাসে ফকনার বলেন--
“আমি মনে করি কোন গল্প নিজেই স্টাইল ধরে নেয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। লেখককে এত দুশ্চিন্তা করতে নেই। স্টাইল নিয়ে অতি দুশ্চিন্তার ফলে একটা মহামূল্যবান (!) ‘বাজে সাহিত্য’ জন্ম নিবে। ঐগুলো আসলেই অর্থহীন। হয়তোবা দেখতে সুন্দর, শ্রুতিমধুর মনে হবে কিন্তু ভেতরে মাল (সার) নেই।”
৩. অভিজ্ঞতা থেকে লিখ আর অভিজ্ঞতার দরজা খোলা রেখো
ফকনার এই পুরনো তত্ত্বে বিশ্বাস রেখেছেন। আর যাই হউক অভিজ্ঞতার বাইরে লেখা তো অসম্ভব। তবে অভিজ্ঞতা নিয়ে তার ধারণাটা মজার। ১৯৫৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আমেরিকান ফিকশন এর উপর গ্যাজুয়েটদের ক্লাসে ফকনার বলেছিলেন--
“আমার মতে তুমি যা-ই অনুধাবন করতে পারে তা-ই অভিজ্ঞতা। এটা বই থেকেও আসতে পারে। এটা এমন বই, এমন গল্প এবং এতই জীবন্ত যে, যা তোমাকে নাড়িয়ে দেয়। আমার মতে এটা তোমার অভিজ্ঞতাসমূহের একটি। এটা এমন নয় যে ঐ বইয়ের চরিত্রগুলো যা করে তা নিজে করে অভিজ্ঞতা নিতে হবে। চরিত্রগুলোর কাজ যদি বাস্তবসম্মত মনে হয় এবং মনে হয় মানুষ এমনটিই করে তাহলে এটা একটা অভিজ্ঞতা। তাই আমার অভিজ্ঞতার সংজ্ঞা হচ্ছে এই যে অভিজ্ঞতার বাহিরে লেখা অসম্ভব। কারণ যা তুমি পড়, শুন, অনুভব কর, কল্পনা কর— এ সবই অভিজ্ঞতার অংশ।”
৪. তোমার চরিত্রগুলোকে ভাল করে জানো— তাহলে গল্পটা নিজেই নিজেকে লিখবে
ফকনার বলেন— যখন কোন একটা চরিত্র সম্পর্কে তোমার স্পষ্ট ধারণা থাকবে, গল্পের ঘটনা পরিক্রমা প্রয়োজনের তাগিদেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রবাহিত হবে। চরিত্র রূপায়ন নিয়ে এক ছাত্রের প্রশ্নের জবাবে ফকনার তার ১৯৫৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির আমেরিকান ফিকশনের ঐ ক্লাসটিতে বলেন--
“আমি বলব তোমার মনে বানানো চরিত্রটি নাও। তোমার মনে যেভাবে ধরা দিয়েছে তা-ই সঠিক, তা-ই সত্য। তোমার কাজ শুধু সঙ্গ দেয়া। সে যা করে, যা বলে তা-ই লেখা। এটা হচ্ছে প্রথমে গলাধঃকরণ তারপর গর্ভধারণ। তোমাকে অবশ্যই চরিত্রকে জানতে হবে। তাকে বিশ্বাস করতে হবে। তোমাকে অনুভব করতে হবে যে জীবন্ত। তারপর অবশ্যই তুমি তার কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করবে, সাজাবে। তোমার ইচ্ছে মতো। এরপর তো গল্পটা দাঁড়ানো সময়ের ব্যাপার মাত্র। কাগজ নাও, লিখে ফেলো, ব্যাস।”
৫. আঞ্চলিক শব্দ এড়িয়ে চলো
অনেকগুলো স্থানীয় রেডিও প্রোগ্রামে ফকনার আঞ্চলিক শব্দের ভয়াবহতা নিয়ে কথা বলেছেন। এগুলো ভার্জিনিয়া ইউনিভার্সিটির ওই অডিও আর্কাইভেই সংরক্ষিত।
১৯৫৮ সালে ৬ মে ‘কোনটি ভাল শব্দ’ এই সম্প্রচারে ফকনার লেখকদেরকে সতর্ক করে দেন— লেখকরা যেন স্রোতে ভেসে না যান এবং নিজের হাতে যেন হাল ধরে রাখেন। তিনি বলেন— “আমি মনে করি যত অল্প সংখ্যক আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করা যায় ততই মঙ্গল। আঞ্চলিক শব্দ পাঠককে বিভ্রান্ত করে। কারণ ওগুলো তার কাছে পরিচিত নাও হতে পারে। এজন্য কোন চরিত্রকে সম্পূর্ণভাবে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে দেয়া উচিত নয়। দুয়েকটা সহজ ও পরিচিত শব্দ ব্যবহার করা যেতেই পারে।”
৬. তোমার কল্পনা শক্তি ফুরিয়ে ফেল না
“কোন কাহিনী বা চিন্তার শেষটা লিখে ফেল না।” এ উপদেশটি ফকনার ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক আলোচনাতেই একাধিকবার দিয়েছেন। আর্নেস্ট হোমিংওয়ের সাথে এর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। (আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ৭টি টিপস প্রকাশ করা হবে আগামী সপ্তাহে)।
১৯৫৭ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি লেখালেখির ক্লাসে ফকনার বলেন— “আমি বলব, গরম থাকতে থাকতেই ছেড়ে দাও। শেষটা লিখে ফেল না। ভাল থাকতে থাকতেই ছেড়ে দাও। এরপর নতুন করে ধরা সহজতর। যদি তোমাকে ফুরিয়ে ফেল, তোমার লেখা বন্ধ হয়ে যাবে। অনেক সমস্যায় পড়বে।”
৭. কোনো অজুহাত নয়
ঐ ক্লাসটিতেই (২৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৭,) ফকনার কিছু তেঁতো কথা বলেন, ওই সব হতাশ লেখকদেরকে উদ্দেশ্য করে যারা তাদের ব্যর্থতার জন্য (লেখক হিসেবে) পরিবেশকে দায়ী করে, গালি দেয়।
“আমার রাগ ওঠে যায় ওইসব অকর্মা ‘প্রতিভাধর লেখক-কবিদের’ প্রতি যারা চিৎকার করে বলে বেড়ায় তার এই নেই, সেই নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। এদের অনেকে বলে— আমি যদি এই কাজ না করতাম, তাইলে লেখক হতাম। কেউ বলে— আমি যদি বিয়ে না করতাম, বাচ্চা-কাচ্চা না থাকত, তাইলে লেখক হতাম।
আমার এদের কথায় এক দণ্ডও বিশ্বাস নেই। আমি মনে করি— তুমি যদি লিখতে চাও, তুমি লিখবে। আর কোনো কিছুই তোমাকে থামাতে পারবে না।”
উপন্যাস লেখায় হেমিংওয়ের ৭টি টিপস
সাবিদিন ইব্রাহিম
বড় একজন সৌখিন শিকারী কিংবা গভীর সমুদ্রের জেলে হওয়ার আগে হেমিংওয়ে ছিলেন সুনিপুণ শিল্পী। যিনি সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতেন এবং লিখতেন। তার সেরা গল্পগুলো আধুনিক যুগের মাস্টারপিস হিসেবে গণ্য হয়। আর তার গদ্যশৈলী বিশ শতকের সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারী।
হেমিংওয়ে উপন্যাস লেখার কৌশল নিয়ে কোন গবেষণামূলক গ্রন্থ লিখেননি। তিনি যা করেছেন তা হল, আমাদের জন্য রেখে গেছেন অসংখ্য চিঠি, প্রবন্ধ ও মতামতে ভরপুর বই। ঐগুলোতে লেখনীর উপর তার উপদেশগুলো পাই। এর মধ্য থেকে সেরাগুলো একসাথে করে ১৯৮৪ সালে ল্যারি, ডব্লিউ, ফিলিপস একটি বই লিখেন। বইটির নাম ছিল “আর্নেস্ট হেমিংওয়ে অন রাইটিং”। আমরা ঐ বইটি থেকে সেরা সাতটি উক্তি বাছাই করে এখানে তুলেছি। সঙ্গে রয়েছে ওগুলোর ব্যাখ্যা।
১. একটা সত্য বাক্য দিয়ে লেখা শুরু করা
‘রাইটারস্ ব্লক’ এড়াতে হেমিংওয়ের একটা মজার তরিকা ছিল। “অ্যা মুভেবল ফিস্ট” এর একটি স্মরণীয় অনুচ্ছেদে লিখেন— “মাঝে মাঝে এমন হত— নতুন গল্প শুরু করে আর এগোতে পারতাম না। আগুনের সামনে বসে কমলা ছিলতাম আর কমলার খোসাতে চাপ দিতাম। মৃদু আওয়াজ হতো আর আগুনের আলোতে নীল হয়ে উঠত ছোট ফোটাগুলি। আমি দাঁড়াতাম আর প্যারিসের আকাশে তাকিয়ে ভাবতাম— ‘চিন্তা করো না, তুমি এর আগেও অনেক লিখেছ এবং এখনো লিখবে। তোমার যা করতে হবে তা হচ্ছে শুধু একটা সত্য বাক্য লিখা। তোমার জানা সবচেয়ে সত্য বাক্যটি লিখ।’ এভাবে আমি একটা সত্য বাক্য লিখতাম এবং ঐখান থেকে গল্প এগিয়ে চলত। এটা ছিল খুবই সহজ কারণ সব সময়ই আমার কাছে একটা সত্য বাক্য থাকত, অথবা দেখেছি অথবা কাউকে বলতে শুনেছি।”
২. একদিনের জন্য সবসময় ঐ জায়গাতেই থেমে যাও যখন তুমি জান পরবর্তীতে কি ঘটবে
থেমে যাওয়া ও ভেস্তে যাওয়ার মধ্যে পার্থক্য আছে। গল্প নিয়ে ভালভাবে অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ শব্দ লেখা কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল তার কাছে। কল্পনার ভাণ্ডার ফুরিয়ে ফেলার চেয়ে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সংখ্যক শব্দ লেখা কোনো গুরুত্ববহন করত না। ১৯৩৫ সালের অক্টোবর মাসে “এসকোয়ার” ম্যাগাজিনে “মনোলগ টু দা মায়েস্ট্রো: অ্যা হাই সীস্ লেটার” নামক একটি প্রবন্ধে হেমিংওয়ে তরুণ লেখকদেরকে এই উপদেশটি দেন--
“সবচেয়ে ভাল পদ্ধতি হচ্ছে ভাল থাকতেই থেমে ফেলা। কারণ তুমি জানো পরবর্তীতে কি ঘটবে। উপন্যাস লেখার সময় তুমি যদি প্রত্যেকদিন এ পদ্ধতিটি অনুসরণ কর তাহলে কোনদিন আটকাবে না। তোমাদের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান এ কথাটিই বলতে পারি। সুতরাং মনে রাখতে চেষ্টা করবে।”
৩. যখন তুমি কাজ করছো না গল্প নিয়ে কখনো ভেবো না
আগের উপদেশটির সাথে সঙ্গতি রেখে হেমিংওয়ে বলেন— “পরবর্তী দিন কাজ শুরু করার আগ পর্যন্ত গল্পটি নিয়ে আর ভেবো না। তোমার অবচেতন মন ঐটা নিয়ে সবসময় কাজ করবে। কিন্তু তুমি যদি এটা নিয়ে সচেতনভাবে ভাব অথবা চিন্তা কর তাহলে ওটাকে তুমি মেরে ফেলবে। এবং তোমার মস্তিষ্কে পরবর্তী দিন শুরু করার আগেই ক্লান্ত হয়ে পড়বে।”
“অ্যা মুভঅ্যাবল ফিস্ট” এ আরেকটু বিস্তৃত করতে গিয়ে বলেন— “লেখার সাথে সাথে কিছু পড়াশোনা করা দরকার। তুমি যদি ওটা নিয়ে চিন্তা করতে থাক তাহলে পরবর্তী দিন তোমার লেখার জিনিসটা হারিয়ে ফেলবে। একটু ব্যায়াম করা দরকার। শরীরটাকে ক্লান্ত করা উচিত। সবচেয়ে ভাল প্রিয়তমার সাথে প্রেমে মজে থাকা। এটা যেকোন কিছুর চেয়েই উত্তম। তারপর তুমি যখন নিজেকে খালি করে ফেল তখন তোমার উচিত কিছু পড়ালেখা করা। যাতে পরবর্তী দিন কাজ শুরু করার আগে কোন বিষয়ে চিন্তিত বা উদ্ধিগ্ন না হও। আমি আমার লেখার ভাণ্ডার কখনো শূন্য না করার কলা রপ্ত করে ফেলেছি। কারণ আমি তখনই থেমে ফেলি যখনও ভাণ্ডারের গভীরে কিছু বাকি থাকে। এবং রাতে ভাণ্ডারে জমা হতে থাকে।”
৪. যা ইতোমধ্যে লিখেছ সব সময় তা পরে শুরু করবে
গল্পের চলমানতা ধরে রাখার জন্যে হেমিংওয়ে যা পূর্বে লিখেছেন তা পড়াকে তার অভ্যাসের অন্তর্ভূক্ত করে ফেলেছিলেন। তারপর তিনি সামনে এগুতেন। “এস্কোয়ার” এর ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত ঐ প্রবন্ধটিতেই তিনি লিখেন--
“সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে প্রত্যেকদিন শুরু করার আগে একবারে গল্পের প্রথম থেকে শুরু করা। পড়ার সময় ভুল সংশোধন করা এবং আগের দিন যেখানে থেমে ছিলে ঐখান থেকে শুরু করা। যখন গল্প দীর্ঘতর হতে থাকে প্রথম থেকে পড়া তোমার পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে। এক্ষেত্রে পূর্ববর্তী দু-তিন অধ্যায় পড়া যেতে পারে। এবং প্রত্যেক সপ্তাহে প্রথম থেকে পুরোটা পড়তে হবে। এভাবেই তুমি সমগ্রটিকে এক গ্রন্থে গ্রন্থিত কর।”
৬. আবেগের বর্ণনা দিও না— আবেগটি তৈরি কর
হেমিংওয়ের মতে— জীবনের গভীর পর্যবেক্ষণ ভাল লেখালেখির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাহিরের ঘটনাবলি শুধু দেখা ও শোনাই যথেষ্ট নয়, এগুলো তোমার মনোজগতে কি প্রভাব ফেলে তাও খেয়াল করতে হবে। কি কারণে কি ধরনের প্রভাব ঘটে তা ব্যাখ্যা করার ক্ষমতাও থাকতে হবে। তোমার আবেগের ও অনুভূতির পেছনের সুনির্দিষ্ট কারণ যদি ধরতে পারো এবং তোমার গল্পে যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারো তাহলে পাঠকরাও তোমার আবেগ-অনুভূতিকে অনুভব করতে পারবে। “ইন ডেথ ইন দ্যা আফটারনুন”-এ হেমিংওয়ে তার লেখালেখির প্রথম দিকে এটা নিয়ে সংগ্রামের কথা তুলে ধরেন--
“আমি তখন লেখালেখির চেষ্টা করছিলাম এবং এক্ষেত্রে সবচেয়ে কঠিন সমস্যাটা খুঁজে পেয়েছিলাম। কোন ঘটনায় তুমি কি অনুভব করছ তা সত্যিকার জানার চেয়ে তোমার কি অনুভব করার কথা ছিল অথবা কি অনুভব করতে শেখানো হয়েছিল তাও গুরুত্বপূর্ণ। এর চেয়েও আরও গুরুত্বপূর্ণ হল তুমি যে ভাবাবেগ অনুভব করছ তার সৃষ্টির পেছনে কি কি বিষয় কাজ করেছে। পত্রিকায় লেখালেখির বেলায় ঐদিন যা ঘটেছে তা জানানোর সাথে সাথে কি ভাবাবেগ দিতে হবে তাও বলে দেয়া হয়। এর সাথে যুক্ত হয় নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করার তাগিদ। কিন্তু আসল ব্যাপার হল ঐ ভাবাবেগের ক্ষেত্রে কি ঘটনা কাজ করেছিল তা এক কিংবা দশ বছর পরে বুঝা যেতে পারে। কিন্তু এটা সব সময়ই অত্যন্ত কঠিন কাজ এবং এটার পেছনেই কঠিন শ্রম দিচ্ছিলাম।”
৬. পেন্সিল ব্যবহার কর
চিঠিপত্র ও বিভিন্ন সাময়িকীতে লেখালেখির জন্য হেমিংওয়ে প্রায়ই টাইপরাইটার ব্যবহার করতেন। কিন্তু জটিল বিষয়ে পেন্সিল ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন।
তার এস্কোয়ার (Esquire) এর প্রবন্ধটিতে বলেন— (যেটাতে টাইপরাইটার ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়) “যখন তুমি লেখা শুরু কর— তুমিই সব সুবিধা পাও, যেখানে পাঠকেরা শূন্য। সুতরাং টাইপরাইটার ব্যবহার কর। কারণ তোমার এটা ভাল লাগে এবং অত্যন্ত সুবিধাজনক।
তুমি পুরোপুরি লিখতে পারো মানে হচ্ছে তোমার প্রত্যেকটি অনুভূতি, দৃশ্য, স্পর্শ, স্থান ও আবেগকে পাঠকের কাছে তুলে ধরতে পারো। এটা করতে হলে তোমার লেখার উপরে কাজ করতে হবে। পেন্সিল দিয়ে লিখলে তোমার তিনগুণ সুবিধা। প্রথম সুযোগ— প্রথমবার লেখা শেষে তোমার পাঠক হিসেবে পড়তে পারো।
টাইপ করার পর দ্বিতীয় সুযোগ এবং প্রুফ দেখার সময় তৃতীয়টি। পেন্সিলে লিখলে তোমার লেখার উন্নতি করার এক-তৃতীয়াংশ বেশি সুবিধা বেশি পাওয়া। অর্থাৎ রেটটি হচ্ছে .৩৩৩ যা একজন ভাল লেখকের জন্য যুতসই কারণ পেন্সিলে লেখায় কালিটা অনেকদিন থাকে, নষ্ট হবার সুযোগ নেই। এজন্য দীর্ঘ সময় পরেও উন্নত করতে পারো।
৭. সংক্ষেপ কর
হেমিংওয়ে ঐ লেখকদের পছন্দ করতেন না যারা টাইপরাইটারটিকে না বলতে শেখেনি। ১৯৪৫ সালে তার সম্পাদক ম্যাক্সওয়েল র্পাকিনস এর কাছে লিখেন— “গেটিসবার্গ বক্তৃতা অত্যন্ত ছোট হওয়ার পিছনে কোন দুর্ঘটনা কাজ করেনি। ভাল গদ্যরীতির সূত্র যুগ নিরপেক্ষ। যেমনটা গণিত, পদার্থবিদ্যা ও ওড়ার সূত্র।”
হেমিংওয়ে উপন্যাস লেখার কৌশল নিয়ে কোন গবেষণামূলক গ্রন্থ লিখেননি। তিনি যা করেছেন তা হল, আমাদের জন্য রেখে গেছেন অসংখ্য চিঠি, প্রবন্ধ ও মতামতে ভরপুর বই। ঐগুলোতে লেখনীর উপর তার উপদেশগুলো পাই। এর মধ্য থেকে সেরাগুলো একসাথে করে ১৯৮৪ সালে ল্যারি, ডব্লিউ, ফিলিপস একটি বই লিখেন। বইটির নাম ছিল “আর্নেস্ট হেমিংওয়ে অন রাইটিং”। আমরা ঐ বইটি থেকে সেরা সাতটি উক্তি বাছাই করে এখানে তুলেছি। সঙ্গে রয়েছে ওগুলোর ব্যাখ্যা।
১. একটা সত্য বাক্য দিয়ে লেখা শুরু করা
‘রাইটারস্ ব্লক’ এড়াতে হেমিংওয়ের একটা মজার তরিকা ছিল। “অ্যা মুভেবল ফিস্ট” এর একটি স্মরণীয় অনুচ্ছেদে লিখেন— “মাঝে মাঝে এমন হত— নতুন গল্প শুরু করে আর এগোতে পারতাম না। আগুনের সামনে বসে কমলা ছিলতাম আর কমলার খোসাতে চাপ দিতাম। মৃদু আওয়াজ হতো আর আগুনের আলোতে নীল হয়ে উঠত ছোট ফোটাগুলি। আমি দাঁড়াতাম আর প্যারিসের আকাশে তাকিয়ে ভাবতাম— ‘চিন্তা করো না, তুমি এর আগেও অনেক লিখেছ এবং এখনো লিখবে। তোমার যা করতে হবে তা হচ্ছে শুধু একটা সত্য বাক্য লিখা। তোমার জানা সবচেয়ে সত্য বাক্যটি লিখ।’ এভাবে আমি একটা সত্য বাক্য লিখতাম এবং ঐখান থেকে গল্প এগিয়ে চলত। এটা ছিল খুবই সহজ কারণ সব সময়ই আমার কাছে একটা সত্য বাক্য থাকত, অথবা দেখেছি অথবা কাউকে বলতে শুনেছি।”
২. একদিনের জন্য সবসময় ঐ জায়গাতেই থেমে যাও যখন তুমি জান পরবর্তীতে কি ঘটবে
থেমে যাওয়া ও ভেস্তে যাওয়ার মধ্যে পার্থক্য আছে। গল্প নিয়ে ভালভাবে অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ শব্দ লেখা কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল তার কাছে। কল্পনার ভাণ্ডার ফুরিয়ে ফেলার চেয়ে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সংখ্যক শব্দ লেখা কোনো গুরুত্ববহন করত না। ১৯৩৫ সালের অক্টোবর মাসে “এসকোয়ার” ম্যাগাজিনে “মনোলগ টু দা মায়েস্ট্রো: অ্যা হাই সীস্ লেটার” নামক একটি প্রবন্ধে হেমিংওয়ে তরুণ লেখকদেরকে এই উপদেশটি দেন--
“সবচেয়ে ভাল পদ্ধতি হচ্ছে ভাল থাকতেই থেমে ফেলা। কারণ তুমি জানো পরবর্তীতে কি ঘটবে। উপন্যাস লেখার সময় তুমি যদি প্রত্যেকদিন এ পদ্ধতিটি অনুসরণ কর তাহলে কোনদিন আটকাবে না। তোমাদের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান এ কথাটিই বলতে পারি। সুতরাং মনে রাখতে চেষ্টা করবে।”
৩. যখন তুমি কাজ করছো না গল্প নিয়ে কখনো ভেবো না
আগের উপদেশটির সাথে সঙ্গতি রেখে হেমিংওয়ে বলেন— “পরবর্তী দিন কাজ শুরু করার আগ পর্যন্ত গল্পটি নিয়ে আর ভেবো না। তোমার অবচেতন মন ঐটা নিয়ে সবসময় কাজ করবে। কিন্তু তুমি যদি এটা নিয়ে সচেতনভাবে ভাব অথবা চিন্তা কর তাহলে ওটাকে তুমি মেরে ফেলবে। এবং তোমার মস্তিষ্কে পরবর্তী দিন শুরু করার আগেই ক্লান্ত হয়ে পড়বে।”
“অ্যা মুভঅ্যাবল ফিস্ট” এ আরেকটু বিস্তৃত করতে গিয়ে বলেন— “লেখার সাথে সাথে কিছু পড়াশোনা করা দরকার। তুমি যদি ওটা নিয়ে চিন্তা করতে থাক তাহলে পরবর্তী দিন তোমার লেখার জিনিসটা হারিয়ে ফেলবে। একটু ব্যায়াম করা দরকার। শরীরটাকে ক্লান্ত করা উচিত। সবচেয়ে ভাল প্রিয়তমার সাথে প্রেমে মজে থাকা। এটা যেকোন কিছুর চেয়েই উত্তম। তারপর তুমি যখন নিজেকে খালি করে ফেল তখন তোমার উচিত কিছু পড়ালেখা করা। যাতে পরবর্তী দিন কাজ শুরু করার আগে কোন বিষয়ে চিন্তিত বা উদ্ধিগ্ন না হও। আমি আমার লেখার ভাণ্ডার কখনো শূন্য না করার কলা রপ্ত করে ফেলেছি। কারণ আমি তখনই থেমে ফেলি যখনও ভাণ্ডারের গভীরে কিছু বাকি থাকে। এবং রাতে ভাণ্ডারে জমা হতে থাকে।”
৪. যা ইতোমধ্যে লিখেছ সব সময় তা পরে শুরু করবে
গল্পের চলমানতা ধরে রাখার জন্যে হেমিংওয়ে যা পূর্বে লিখেছেন তা পড়াকে তার অভ্যাসের অন্তর্ভূক্ত করে ফেলেছিলেন। তারপর তিনি সামনে এগুতেন। “এস্কোয়ার” এর ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত ঐ প্রবন্ধটিতেই তিনি লিখেন--
“সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে প্রত্যেকদিন শুরু করার আগে একবারে গল্পের প্রথম থেকে শুরু করা। পড়ার সময় ভুল সংশোধন করা এবং আগের দিন যেখানে থেমে ছিলে ঐখান থেকে শুরু করা। যখন গল্প দীর্ঘতর হতে থাকে প্রথম থেকে পড়া তোমার পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে। এক্ষেত্রে পূর্ববর্তী দু-তিন অধ্যায় পড়া যেতে পারে। এবং প্রত্যেক সপ্তাহে প্রথম থেকে পুরোটা পড়তে হবে। এভাবেই তুমি সমগ্রটিকে এক গ্রন্থে গ্রন্থিত কর।”
৬. আবেগের বর্ণনা দিও না— আবেগটি তৈরি কর
হেমিংওয়ের মতে— জীবনের গভীর পর্যবেক্ষণ ভাল লেখালেখির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাহিরের ঘটনাবলি শুধু দেখা ও শোনাই যথেষ্ট নয়, এগুলো তোমার মনোজগতে কি প্রভাব ফেলে তাও খেয়াল করতে হবে। কি কারণে কি ধরনের প্রভাব ঘটে তা ব্যাখ্যা করার ক্ষমতাও থাকতে হবে। তোমার আবেগের ও অনুভূতির পেছনের সুনির্দিষ্ট কারণ যদি ধরতে পারো এবং তোমার গল্পে যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারো তাহলে পাঠকরাও তোমার আবেগ-অনুভূতিকে অনুভব করতে পারবে। “ইন ডেথ ইন দ্যা আফটারনুন”-এ হেমিংওয়ে তার লেখালেখির প্রথম দিকে এটা নিয়ে সংগ্রামের কথা তুলে ধরেন--
“আমি তখন লেখালেখির চেষ্টা করছিলাম এবং এক্ষেত্রে সবচেয়ে কঠিন সমস্যাটা খুঁজে পেয়েছিলাম। কোন ঘটনায় তুমি কি অনুভব করছ তা সত্যিকার জানার চেয়ে তোমার কি অনুভব করার কথা ছিল অথবা কি অনুভব করতে শেখানো হয়েছিল তাও গুরুত্বপূর্ণ। এর চেয়েও আরও গুরুত্বপূর্ণ হল তুমি যে ভাবাবেগ অনুভব করছ তার সৃষ্টির পেছনে কি কি বিষয় কাজ করেছে। পত্রিকায় লেখালেখির বেলায় ঐদিন যা ঘটেছে তা জানানোর সাথে সাথে কি ভাবাবেগ দিতে হবে তাও বলে দেয়া হয়। এর সাথে যুক্ত হয় নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করার তাগিদ। কিন্তু আসল ব্যাপার হল ঐ ভাবাবেগের ক্ষেত্রে কি ঘটনা কাজ করেছিল তা এক কিংবা দশ বছর পরে বুঝা যেতে পারে। কিন্তু এটা সব সময়ই অত্যন্ত কঠিন কাজ এবং এটার পেছনেই কঠিন শ্রম দিচ্ছিলাম।”
৬. পেন্সিল ব্যবহার কর
চিঠিপত্র ও বিভিন্ন সাময়িকীতে লেখালেখির জন্য হেমিংওয়ে প্রায়ই টাইপরাইটার ব্যবহার করতেন। কিন্তু জটিল বিষয়ে পেন্সিল ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন।
তার এস্কোয়ার (Esquire) এর প্রবন্ধটিতে বলেন— (যেটাতে টাইপরাইটার ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়) “যখন তুমি লেখা শুরু কর— তুমিই সব সুবিধা পাও, যেখানে পাঠকেরা শূন্য। সুতরাং টাইপরাইটার ব্যবহার কর। কারণ তোমার এটা ভাল লাগে এবং অত্যন্ত সুবিধাজনক।
তুমি পুরোপুরি লিখতে পারো মানে হচ্ছে তোমার প্রত্যেকটি অনুভূতি, দৃশ্য, স্পর্শ, স্থান ও আবেগকে পাঠকের কাছে তুলে ধরতে পারো। এটা করতে হলে তোমার লেখার উপরে কাজ করতে হবে। পেন্সিল দিয়ে লিখলে তোমার তিনগুণ সুবিধা। প্রথম সুযোগ— প্রথমবার লেখা শেষে তোমার পাঠক হিসেবে পড়তে পারো।
টাইপ করার পর দ্বিতীয় সুযোগ এবং প্রুফ দেখার সময় তৃতীয়টি। পেন্সিলে লিখলে তোমার লেখার উন্নতি করার এক-তৃতীয়াংশ বেশি সুবিধা বেশি পাওয়া। অর্থাৎ রেটটি হচ্ছে .৩৩৩ যা একজন ভাল লেখকের জন্য যুতসই কারণ পেন্সিলে লেখায় কালিটা অনেকদিন থাকে, নষ্ট হবার সুযোগ নেই। এজন্য দীর্ঘ সময় পরেও উন্নত করতে পারো।
৭. সংক্ষেপ কর
হেমিংওয়ে ঐ লেখকদের পছন্দ করতেন না যারা টাইপরাইটারটিকে না বলতে শেখেনি। ১৯৪৫ সালে তার সম্পাদক ম্যাক্সওয়েল র্পাকিনস এর কাছে লিখেন— “গেটিসবার্গ বক্তৃতা অত্যন্ত ছোট হওয়ার পিছনে কোন দুর্ঘটনা কাজ করেনি। ভাল গদ্যরীতির সূত্র যুগ নিরপেক্ষ। যেমনটা গণিত, পদার্থবিদ্যা ও ওড়ার সূত্র।”
‘ভারতের গণতন্ত্র ভুয়া’ – অরুন্ধতী রায়
ফাস্টপোস্ট ডটকম থেকে অনুবাদ: মোহাম্মদ হাসান শরীফ
ভারতের ছত্তিশগড়ের দান্দেওয়াডায় ২৫ মে কংগ্রেসের ‘পরিবর্তন যাত্রা’য় মাওবাদী হামলায় ২৮ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ৩৬ জন। নিহতদের মধ্যে ছিলেন রাজ্যের কংগ্রেস প্রধান নন্দ কুমার প্যাটেল, সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বিদ্যা চরন শুল্কা,রাজ্যসভায় সাবেক বিরোধী দলীয় নেতা মহেন্দ্র কর্ম নন্দ কুমারের ছেলে দীনেশ কুমার। প্রখ্যাত লেখিকা ও অ্যাক্টিভিস্ট অরুন্ধতী রায় সিএনএন-আইবিএনের সাগরিকা ঘোষকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে এই হামলাকে পাল্টা সহিংসতা হিসেবে অভিহিত করেছেন।
এখানে সাক্ষাতকারটির অংশবিশেষ প্রকাশ করা হচ্ছে।
সাগরিকা ঘোষ: ছত্তিশগড় হামলার আগে আপনি ‘আউটলুক’ পত্রিকায় ‘ওয়াকিং উইথদ্য কমরেডস’ শিরোনামে নিবন্ধ লিখেছেন। এই হামলার পরও কি আপনি মাওবাদী আন্দোলনের প্রতি আপনার সহানুভূতি অব্যাহত থাকবে?
অরুন্ধতী রায়: দেখুন, ছত্তিশগড় হামলার আগে এবং পরে- এভাবে বলাটা ঠিক নয়। কারণ সহিংসতার চক্র বাড়ছে তো বাড়ছেই। আর এবারই প্রথম নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ওপর মাওবাদী হলো না। এ ধরণের হামলা এবং ২০০৫-২০০৭ সময়কালে অন্যান্য হামলা নিয়ে আমি লিখেছি। আমি প্রায়ই দেখি, একদল লোক সিআরপিএফ (Certral Reserve Police Force) জওয়ানদের হত্যায় উল্লাস প্রকাশ করছে, আর একদল বলছে, মাওবাদীদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে। বিষয়টা এমন নয়। আমি মনে করি,প্রতিটি মৃত্যুকেই ভয়াবহ ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। যে ব্যবস্থা, যে যুদ্ধ মানুষের ওপর চেপে বসেছে,দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এটা পরিণত হয়েছে গরিবদের বিরুদ্ধে ধনীদের যুদ্ধ। আর এই যুদ্ধে ধনীরা গরিবদের মধ্যে সবচেয়ে গরিবদের পাঠাচ্ছে গরিবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। সিআরপিএফ মারাত্মক পরিস্থিতির শিকার। তবে কেবল তারা মাওবাদীদেরই শিকার নয়। তারা বিরাজমান কাঠামোগত সহিংস ব্যবস্থার শিকার। এই ফাঁকা নিন্দা শিল্পে ব্যবস্থাটি তলিয়ে যাবে। পুরো প্রক্রিয়াটাই অর্থহীন। কারণ বেশির ভাগ সময়, যেসব লোক নিন্দা জ্ঞাপন করে, আসলে তাদের প্রতি তাদের সত্যিকারের কোনো সহানুভূতি থাকে না। তারা কেবল তাদের ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে।
সাগরিকা ঘোষ: তবে কে সহিংসতার এই চক্র ভাঙবে?
অরুন্ধতী রায়: ছোট্ট একটা লিটমাস টেস্ট আছে। যেসব দরিদ্র এলাকায় হাসপাতাল, স্কুল আছে, অপুষ্টির হার কম, অনেক উন্নয়ন হয়েছে, সেখানে কি কোনো মাওবাদী নেই? বিষয়টা তেমন নয়। বিলাসপুরের মতো স্থানে চিকিৎসকদের প্রস্তুত সমীক্ষাগুলোর দিকে দেখুন। পুষ্টি সহায়তার নামে কী হচ্ছে সে ব্যাপারে বিনায়ক সেনের বক্তব্য দেখুন। আপনি স্কুলগুলোতে গেলে দেখবেন,সেগুলো ব্যারাক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সেগুলো তারা ব্যারাক হিসেবে নির্মাণ করেছে। ফলে মাওবাদীরা যখন স্কুল উড়িয়ে দেয়, তখন সেটাকে উন্নয়নের বিরুদ্ধে কাজ হিসেবে অভিহিত করাটা একটু উ™ভটই।
সাগরিকা ঘোষ: কিন্তু আপনি রাষ্ট্রীয় সহিংসতার নিন্দা করছেন। আর আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, আপনি নক্সালি সহিংসতা,মাওবাদী সহিংসতার নিন্দা করেন না। মনে হচ্ছে, আপনি বলতে চাচ্ছেন, অহিংস আন্দোলন নিঃস্ফল হয়ে গেছে?
অরুন্ধতী রায়: এটা এমন একজনের বিরুদ্ধে অদ্ভুত অভিযোগ, যে ১০ বছর ধরে অহিংস এবং অহিংস আন্দোলন নিজে লেখালেখি করছে। কিন্তু আমি যখন বনে বনে ঘুরি, দেখি, আসলে অহিংস প্রতিরোধে কোনো কাজ হয় না। ‘নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনেও’ কার্যকর হয়নি, এমনকি আরো অনেক অহিংস আন্দোলনে ফলপ্রসূ হয়নি, জঙ্গি আন্দোলনগুলোতেও নয়। আন্দোলনের কিছু অংশে তা কাজে লেগেছে। কিন্তু বন-জঙ্গলে বিষয়টা ভিন্ন ব্যাপার। কারণ অহিংস আন্দোলন, বিশেষ করে গান্ধীবাদী অসহিংস আন্দোলনের জন্য কোনো না কোনো ধরণের শ্রোতার প্রয়োজন হয়। এটা এমন থিয়েটার, যার শ্রোতার প্রয়োজন। কিন্তু বনের ভেতরে কথা শোনার কেউ নেই। রাতের অন্ধকারে হাজার হাজার পুলিশ এসে বনে অবস্থিত গ্রামগুলো ঘিরে ফেললে তারা কি করবে? ক্ষুধার্তরা কিভাবে অনশন ধর্মঘট করবে? যেসব লোকের হাতে কানাকড়িও নেই, তারা কিভাবে কর বা বিদেশি পণ্য বা অন্য কোনো ভোগ্যপণ্য বয়কট করবে?
তাদের কিছুই নেই। আমি বনের ভেতরের এই সহিংসতাকে ‘পাল্টা সহিংসতা,’ ‘প্রতিরোধের সহিংসতা’ হিসেবে দেখি। ক্রমবর্ধমান সহিংসতা চক্রের প্রকৃত বিষয়টির কথা ভেবে আমি আঁতকে উঠি। সরকার পুলিশকে বেশি বেশি অস্ত্র দিচ্ছে, আর ওইসব অস্ত্র শেষ পর্যন্ত মাওবাদী পিএলজিএ’র (The People’s Liberation Guerrilla Army) হাতে পৌঁছাচ্ছে। যেকোনো সমাজের জন্য এটা ভয়ঙ্কর বিষয়। এটা অবিশ্বাস্য বিষয়, এসব গরিব লোক এই শক্তিশালী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, যে রাষ্ট্র হাজার হাজার সৈন্য ও আধা সামরিক সৈন্য পাঠাচ্ছে। এসব লোক ওইসব বনে একে-৪৭ ও গ্রেনেড নিয়ে কী করছে, আমি সেটাই জানতে চাইছি।
সাগরিক ঘোষ: কিন্তু মাওবাদীদের হাতেও একে-৪৭ আছে? তাদের হাতে প্রেসার বোমাও আছে?
অরুন্ধতী রায়: তারা এগুলো সেনাদের হাত থেকে কেড়ে নিয়েছে।
সাগরিকা ঘোষ: আপনার মতো লোকদের কি উচিত হতো না সহিংসতার চক্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া কিংবা আপনি কি সত্যিকার অর্থে এর যৌক্তিকতা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করছেন না? কারণ আপনাকে ‘মাওবাদীদের পক্ষ সমর্থনকারী’ হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। বিজেপি আপনাকে বলছে ‘নক্সালবাদীদের মার্জিত অবয়ব।’
অরুন্ধতী রায়: না, আমি তা নই। কারণ আমি মনে করি, এটা বিদ্যমান অবস্থা বহাল রাখার অনুকূলে ও পক্ষে যারা তারা সবাই বলবে যে বিষয়টা ভয়ঙ্কর এবং ওই পর্যন্তই। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, ওইসব উপজাতীয় এলাকায় ‘গণহত্যার মতো পরিস্থিতি’ সৃষ্টিকারী ভয়ঙ্কর কাঠামোগত সহিংসতার বিষয়টি বিবেচনা না করেই করা হয়। আপনি যদি অপুষ্টির মাত্রার দিকে নজর দেন,দেখবেন সেখানে তা ভয়াবহ অবস্থায় রয়েছে। যেকোনো দায়িত্বশীল লোক বলবেন, এসব লোককে কোণঠাসা করা বন্ধ করুন,সহিংসতাও থেমে যাবে। পুরো দেশের উপজাতীয় লোকদের কথা বিবেচনা করুন। তাদের মোট সংখ্যা বেশির ভাগ দেশের মোট জনসংখ্যার চেয়ে বেশি। এসব লোক অস্তিত্বের সঙ্কটে রয়েছে, তারা বিলীন হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার সংগ্রাম করছে। আমি তাদের প্রতিক্রিয়া, রাষ্ট্রীয় সহিংসতার বিরুদ্ধে তাদের প্রতিরোধকে সমান বিবেচনা করছি না। এই দুটিকে সমান বিবেচনা করা অনৈতিক।
সাগরিকা ঘোষ: যুক্তরাষ্ট্রে গত মার্চে বাম ফোরামের এক বক্তৃতায় আপনি বলেছিলেন, ‘ভারতের গণতন্ত্র ভুয়া’। আপনার ওই মন্তব্য কিছুটা হলেও সহিংসতার সাফাই বা প্রায় সাফাই হিসেবে অভিহিত করা যায়। আপনি কি মনে করেন, ভারতের গণতন্ত্র ‘ভুয়া’ হওয়ার কারণেই ভারতীয় গণতন্ত্রের মাওবাদীদের কাছে টানার কোনো আশা নেই?
অরুন্ধতী রায়: না, আমি নিশ্চিতভাবেই বিশ্বাস করি, ভারতে অভিজাততন্ত্র কায়েম রয়েছে। এখানে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের জন্য গণতন্ত্র কাজ করে।
সাগরিকা ঘোষ: কিন্তু এটা কি ভুয়া গণতন্ত্র?
অরুন্ধতী রায়: হ্যাঁ। এটা গণমানুষের জন্য কাজ না করায় এটা ভুয়া গণতন্ত্র। আপনার প্রতিষ্ঠান ফাঁপা, এই প্রতিষ্ঠানে গরিবদের প্রবেশাধিকার নেই। আপনি প্রতিষ্ঠান, নির্বাচন, আদালত, মিডিয়া, বিচার বিভাগের দিকে তাকালে এমনটাই দেখবেন। আপনারা খুবই বিপজ্জনক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন। আপনি যদি ক্রমবর্ধমান হারে অপেক্ষাকৃত গরিব লোকদের বিপুল অংশকে বাদ রাখেন, তেব আমি বলবো এটা ভুয়া ব্যবস্থা। এটা কারো কারো জন্য কাজ করে, কারো কারো জন্য করে না। আপনার পা কোথায়, আপনার রাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করে এটা কাজ করে। আপনি বৃহত্তর কৈলাশে দাঁড়ালে নিশ্চিতভাবেই সুমহান ও প্রাণবন্ত গণতন্ত্র দেখতে পাবেন, কিন্তু আপনি যদি দান্তেওয়াডায় (ছত্তিশগড়ে) দাঁড়ান, তবে দেখবেন, গণতন্ত্রের কোনো অস্তিত্বই নেই। আপনাদের মুখ্যমন্ত্রী আসলে যা বলেছেন তা হলো, যারা বন থেকে বের হবে না এবং সালওয়া জুদামের ক্যাম্পে বাস করবে না, তারাই সন্ত্রাসী। আপনি আপনার মুরগিগুলোর দেখভাল করবেন, আপনার খেত পাহারা দেবেন, এগুলোও সন্ত্রাসী কাজ? এটাই কি গণতন্ত্র?
সাগরিকা ঘোষ: এ ব্যাপারে আপনার হাতে কি কোনো সমাধান আছে? আপনার সমাধান সূত্র কেমন হতে পারে? এই অচলাবস্থা নিরসনে কোন পন্থা অনুসরণ করা উচিত বলে আপনি মনে করেন?
অরুন্ধতী রায়: ঠিক আছে, দুটি বিষয় আছে। প্রথমত দর্শনগত অবস্থান থেকে আমি বলব, আমি বিশ্বাস করি না যে এই সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে যে চিন্তা থেকে, তা অন্য কোনো বিকল্প নিয়ে আসবে। ফলে আমরা অন্তত যেটুকু করতে পারি তা হলো, আমরা থামতে পারি এবং যারা নিজেদেরকে অতীতের রক্ষক মনে করে এবং যাদের ভবিষ্যতের জন্য বুদ্ধিমত্তা আছে তাদের বুঝাতে পারি।
তবে ‘অপারেশন গ্রিন হান্ট’ প্রশ্নে আমি তিনটি বিষয়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করব। আমি মনে করি, সব সমঝোতা স্বারক,অবকাঠামো প্রকল্পের ব্যাপারে সরকারের স্বচ্ছ থাকা দরকার। সরকারের উচিত গোপন কিছু না রেখে সবকিছু প্রকাশ করা এবং আমাদের বিস্তারিত বলা এবং এখনকার মতো সেগুলো স্থগিত করা। যে লাখ লাখ লোককে উৎখাত করা হয়েছে, তাদেরকে পুনর্বাসন করা। বন্দুক অবশ্যই সরিয়ে নিতে হবে।
সাগরিকা ঘোষ: সব দেশই প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর জন্য খনিজ সম্পদ ব্যবহার করে। আমাদের দেশেও প্রবৃদ্ধি দরকার। আপনি কি ওইসব এলাকার সব প্রকল্প গুটিয়ে নেওয়ার কথা বলছেন?
অরুন্ধতী রায়: খনি শিল্পের বেসরকারিকরণের ফলে কী ঘটছে, সেদিকে লক্ষ্য করুন। প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর ভ্রান্ত ধারণার ওপর সেটা চলছে। এটা এমন এক অদ্ভূত উপায়ে হয় যে এর সঙ্গে প্রকৃত উন্নয়নের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু আপনি রাজস্বের দিকে তাকালে দেখবেন, সরকার বেসরকারি কোম্পানির কাছ থেকে পাঁচ হাজার টন লোহা আকরিকের জন্য ২৭ রুপি করে পাচ্ছে। অন্য লোকদের অর্থনীতির জন্য প্রতিবেশ নষ্ট করছি কিছু না পেয়েই। ফলে এটাকে প্রবৃদ্ধি বলাটা কল্পকথা।
সাগরিকা ঘোষ: আপনি কি মাওবাদী ও সরকারের মধ্যে মধ্যস্ততা করতে ইচ্ছুক? আপনার ভয় কি?
অরুন্ধতী রায়: আমি নিজেকে নিয়ে ভীত। এসব কাজ আমার নয়। আমার নিজের ওপর বিশ্বাস নেই। আপনি যদি বাস্কেটবল খেলোয়াড় হন, তবে আপনি সাঁতারে অংশ নিতে পারেন না। এ কারণে আমি মনে করি, এই কাজ ভালোভাবে করার মতো অনেক লোক আছে। আমার মনে হয় না, ওই কাজটি করতে পারি। তবে একটি প্রশ্ন তুলতে পারি, আমরা যখন মাওবাদী বলি, তখন কাদের বুঝি? ‘অপারেশন গ্রিন হান্ট’ কাদের লক্ষ্য বানাতে চায়? কারণ কারা মাওবাদী আর কারা উপজাতীয় এ নিয়ে কিছুটা মতপার্থক্য আছে। কিছু লোক মনে করে, এরা হলো মাওবাদী আর অন্যরা হলো উপজাতীয়। আর কিছু লোক মনে করে,মাওবাদীরা উপজাতীয়দের প্রতিনিধিত্ব করে। কোনোটাই সত্য নয়। আসল কথা বলো, মাওবাদীদের প্রায় ৯৯ ভাগই উপজাতীয়। তবে সব উপজাতীয়ই মাওবাদী নয়। অবশ্য এটাও সত্য যে লাখ লাখ লোক মাওবাদী হিসেবেই নিজেদের ঘোষণা করে। তাদের প্রায় ৯০ হাজার নারী এখন নারী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত, ১০ হাজার সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত। তবে কি তাদের সবাইকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হবে?
সাগরিকা ঘোষ: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরমের প্রতি আপনার বার্তা কি?
অরুন্ধতী রায়: আমি মনে করি, তিনি হট্টগোলের জন্য লড়াই করছেন, তিনি করপোরেট কোম্পানির প্রতি তার দায়বদ্ধতার জন্য কাজ করছেন; তিনি এনরন, ভেদেন্তা এবং অন্য যেসব কোম্পানির প্রতিনিধিত্ব তিনি করছেন, তাদের সেবায় কাজ করছেন। আমি তাকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলছি না, তবে এই দেশকে অত্যন্ত মারাত্মক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য তাকে অভিযুক্ত করছি এবং এতে আমাদের সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হব।
সাগরিকা ঘোষ: আপনি কি মনে করেন যে সরকার, মিডিয়া, প্রাধান্য সৃষ্টিকারী সংস্কৃতি বুদ্ধিজীবীদের, মানবাধিকার কর্মীদের টার্গেট করছে? এটা কি বিপজ্জনক?
অরুন্ধতী রায়: অবশ্যই এটা খুবই বিপজ্জনক। আমি একটি প্রবন্ধ করেছিলাম। তাতে বলা হয়েছে, দান্তেওয়াডা দিল্লি এসেছে কোবাদ গান্ধীর বিরুদ্ধে নালিশ করতে। গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য জনগণ ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে… সব প্রতিষ্ঠানকে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান বলা হচ্ছে।
যাকেই ভিন্ন মতালম্বী মনে হবে, তাকেই মাওবাদী হিসেবে চিহ্নিত করার একটা মারাত্মক বাতিক দেখা যায়। হাজার হাজার অজ্ঞাতনামা লোককে তুলে নিয়ে কারাগারে রাখা হয়েছে। বনের বাইরে থাকা অহিংস আন্দোলন থেকে শুরু করে বনের ভেতরে সশস্ত্র সংগ্রামে নিয়োজিত বিপুলসংখ্যক লোককে নির্বিচারে করপোরেট হামলার শিকার করা হয়েছে। আমি বলছি, পৃথিবীর অন্য কোথাও এমনটা ঘটেনি।।
জুলিয়ান আস্যাঞ্জের সাম্প্রতিক বক্তৃতা
অনুবাদ : দেবব্রত মুখোপাধ্যায়
আপনারা কী শুনতে পাচ্ছেন?
আজ এখানে দাড়িয়ে আছি কারণ, আপনাদের সঙ্গে আমাকে থাকতে দেওয়া হচ্ছে না। আপনাদের সবাইকে এখানে আসার জন্য ধন্যবাদ। আপনাদের দৃঢ়চেতা মনোভাব ও সহমর্মিতার জন্য অজস্র ধন্যবাদ।
রাতে এই দূতাবাসে হুমকি দেওয়া হয়েছিল এবং এই ভবনে পুলিশ অনুপ্রবেশ করাণোর চেষ্টা হয়েছিল। সেদিন মাঝরাতে আপনারা ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন এবং বিশ্বের দৃষ্টি আপনাদের সঙ্গে এই দূতাবাসের সামনে নিয়ে এসেছিলেন।
ভেতরে অন্ধকার হয়ে যাওয়ার পর আমি পুলিশের পায়ের আওয়াজ পাচ্ছিলাম। তারা অভ্যন্তরীন অগ্নি-দূর্ঘটনার জন্য ব্যবহৃত রাস্তা ধরে ভেতরে ঢোকার চেষ্টায় ছিল। কিন্তু আমি জানতাম, এরকম কিছু হলে ঘটনার স্বাক্ষী থেকে যাবেই; আর সেই স্বাক্ষী আপনারা!
রাতে যুক্তরাজ্য যে ভিয়েনা কনভেনশনকে ছুড়ে ফেলে দেয়নি; তার একমাত্র কারণ, ঘটনার দিকে পুরো বিশ্ব তাকিয়ে ছিল। আর বিশ্ব এখানে তাকিয়ে ছিল, কারণ আপনারা এখানে তাকিয়ে ছিলেন!
আপনাদের যদি কেউ বলে যে, আপনাদের এই রাতজাগার কোনো অর্থ হয় না; প্রিয় বন্ধুরা আমার, তাকে স্রেফ মনে করিয়ে দেবেন কিভাবে আপনারা এই ইকুয়েডর দূতাবাসের সামনে অতন্দ্র প্রহরী হয়ে এইসব ঘটনা ঠেকিয়ে দিয়েছেন!
আরও মনে করিয়ে দেবেন যে, কিভাবে পরেরে দিন নতুন এক সূর্যের আলো ভিন্ন এক দুনিয়ায় প্রবেল করেছিল। মনে করিয়ে দেবেন যে, কিভাবে পরদিন সকালে লাতিন দেশগুলো ন্যায়বিচারের পক্ষে দারুণ সাহসী ভূমিকা নিয়ে রুখে দাড়িয়েছিল।
আজ সেই সাহসী মানুষগুলোর জন্যও আমার পক্ষ থেকে অনেক ধন্যবাদ। প্রেসিডেন্ট কুরিয়া (রাফায়েল ভিসেন্তে কুরিয়া দেলগাদো, ইকুয়েডরের প্রেসিডেন্ট) আমার রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা বিবেচনা করে এবং পরে মঞ্জুর করে যে সাহস দেখিয়েছেন; সে জন্য ধন্যবাদ।
একইরকম ইকুয়েডরের সরকার এবং তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিকার্ডে পিন্টোকে ধন্যবাদ জানাতে হয়। কারণ, তারা আমার ব্যাপারটি বিবেচনা করে ইকুয়েডরের সংবিধান ও বৈশ্বিক মানবতার ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সমুন্নত রেখেছেন।
আমাকে সমর্থন দেওয়া এবং তাদের সংবিধানের পক্ষে কাজ করে যাওয়ার জন্য ইকুয়েডরের জনগনকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ। এই দূতাবাসের প্রত্যেক কর্মীর কাছে আমার কৃতজ্ঞতার ঋন অসীম। এদের অনেকেরই পরিবার-পরিজন লন্ডনে বসবাস করেন। তারা প্রতিনিয়ত নানারকম হুমকি পাওয়ার পরও আমার প্রতি যে মমতা ও আতিথ্য দেখিয়েছেন; তা বলে শেষ করা যাবে না। শুক্রবার এই লন্ডনে লাতিন আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের একটি বিশেষ জরুরী বৈঠক ডাকা হয়েছে। আমি লাতিন আমেরিকার দেশগুলি; আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, নিকারাগুয়া, ব্রাজিল, চিলি, কলম্বিয়া, এল সালভাদর, হন্ডুরাস, মেক্সিকো, পেরু, ভেনেজুয়েলা এবং আরও সব রাষ্ট্রের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি আমার রাজনৈতিক আশ্রয়কে সমর্থন জানানোর জন্য। যুক্তরাজ্য, সুইডেন ও অস্ট্রেলিয়ায় সরকার আমাকে সমর্থন করছে না; কিন্তু দেশগুলির যেসব মানুষ সরকারী মনোভাব উপেক্ষা করে আমাকে সমর্থন জানিয়ে আমাকে শক্তিশালী করছেন; তাদের অনেক ধন্যবাদ। এবং এসব সরকারের মধ্যে এখনও যে গুটিকয় বিবেচনাক্ষম লোক এখনও ন্যায় বিচারের পক্ষে লড়াই করে যাচ্ছেন; তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। আপনাদের দিন একদিন আসবেই।
উইকিলিকসের সব কর্মী, সমর্থক এবং সূত্রকে ধন্যবাদ; যাদের কমিটমেন্ট আর বিশ্বস্ততার কোনো তুলনা হয় না।
আমার পরিবার এবং আমার সন্তানদের প্রতি ভালোবাসা; যে সন্তানদের তাদের বাবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। আমরা খুব দ্রুত আবার একত্রিত হবো!
আজ উইকিলিকস যখন হুমকির মুখে; তার মানে বুঝতে হবে আমাদের এই সমাজের মুক্তবুদ্ধি এবং চিন্তার স্বাধীনতাও হুমকির মুখে। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের বিপক্ষে এই আন্দোলনকে আমাদের ভবিষ্যত নির্ধারণের পথ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।
আমরা কি আবার একত্রিত হতে পারব? আমরা কি যে মতাদর্শ নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম, সেই মতাদর্শ আরও শক্ত করে তুলে ধরতে পারব?
নাকি আমাদের মতাদর্শ পাথরে মাথা টুকে মরবে? নাকি আমাদের সবাইকে ভয়ানক এক রূঢ় দুনিয়ায় টেনে নিয়ে যাবে! যেখানে সব সাংবাদিক মামলার ভয়ে চুপ করে যাবে। যে দুনিয়ায় সব নাগরিককে অন্ধকারে চিৎকার করে ফিরতে হবে! বলছি, আমরা অবশ্যই ঘুরে দাড়াতে পারব।
প্রেসিডেন্ট ওবামাকে বলছি, সঠিক কাজটা করুন। উইকিলিকসের বিপক্ষে এই ডাইনি-হত্যাযজ্ঞ এখনই বন্ধ করুন।
যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই আমাদের বিপক্ষে এফবিআই তদন্ত বন্ধ করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই পরিষ্কার করে বলতে হবে যে, তারা আমাদের কর্মীদের এবং সমর্থকদের দণ্ড দেওয়ার চেষ্টা করবে না।
যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই সারা দুনিয়ার সাংবাদিকদের সামনে কথা দিতে হবে যে, তারা ক্ষমতাধরের গোপন অপরাধ উন্মোচন করতে সাংবাদিকদের আর বাধা দেবে না। কোনো সংবাদ সংস্থার বিপক্ষে এই ধরণের নির্বোধের মতো আইনি ব্যবস্থা আর নেওয়া চলবে না; সে উইকিলিকসই হোক, আর নিউইয়র্ক টাইমস!
সমাজের প্রহরীদের বিপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের এই লড়াই অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।
থমাস ডার্ক, উইলিয়াম বিনে, জন কিরাকৌ সহ যুক্তরাষ্ট্রের যেসব নায়োকোচিত মাজের প্রহরীরা আছেন; তাদেরকে অবশ্যই, অবশ্যই মুক্ত করে দিতে হবে। অবশ্যই তারা জনগনের কর্মচারী হিসেবে যে কঠোর সময় পার করেছেন এবং যে দায়িত্ব পালন করেছেন; সে জন্য যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরন দিতে হবে। এবং সেইসব সামরিক ব্যক্তি যাদের লিভেনওয়র্থ দূর্গ, কানাসে বন্দী রাখা হয়েছে; তাদের ছেড়ে দিতে হবে। কোয়ান্টিকো, ভার্জিনিয়াতে জাতিসংঘের তৈরি করা নির্যাতনের কেন্দ্রগুলোতে যেসব বন্দী আছেন; যারা বন্দীত্বের দু বছর পরও বিচারের মুখ দেখতে পারনি; তাদের অবশ্যই, অবশ্যই ছেড়ে দিতে হবে।
ব্র্যাডলি ম্যানিংকে যে অপরাধে অপরাধী বলা হচ্ছে, তা যদি সে সত্যিই করে তাকে; তাহলে সে একজন নায়ক! সে সত্যিই আজদের দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন রাজনৈতিক বন্দী। এই ব্র্যাডলি ম্যানিংকে অবশ্যই ছেড়ে দিতে হবে।
পর্যন্ত ব্র্যাডলি ম্যানিং বিচার ছাড়াই ৮১৫ দিন জেলে কাটিয়ে ফেলেছে! যেখানে এর সর্বোচ্চ সীমা ১২০ দিন।
বৃহষ্পতিবার, আমার বন্ধু নাবিল রজবকে একটি টুইট করার অপরাধে ৩ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
শুক্রবার রাশিয়ান একটি ব্যান্ডদলকে রাজনৈতিক পারফরম্যান্স করার অপরাধে জেলে পোরা হয়েছে।
আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন এইসব হিংস্রদের মধ্যে একটি একাত্মতা আছে।
এখন আমাদের এই প্রতিবাদে অবশ্যই আরও একাত্ম এবং আরও দৃঢ় হয়ে উঠতে হবে।
আজ এখানে দাড়িয়ে আছি কারণ, আপনাদের সঙ্গে আমাকে থাকতে দেওয়া হচ্ছে না। আপনাদের সবাইকে এখানে আসার জন্য ধন্যবাদ। আপনাদের দৃঢ়চেতা মনোভাব ও সহমর্মিতার জন্য অজস্র ধন্যবাদ।
রাতে এই দূতাবাসে হুমকি দেওয়া হয়েছিল এবং এই ভবনে পুলিশ অনুপ্রবেশ করাণোর চেষ্টা হয়েছিল। সেদিন মাঝরাতে আপনারা ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন এবং বিশ্বের দৃষ্টি আপনাদের সঙ্গে এই দূতাবাসের সামনে নিয়ে এসেছিলেন।
ভেতরে অন্ধকার হয়ে যাওয়ার পর আমি পুলিশের পায়ের আওয়াজ পাচ্ছিলাম। তারা অভ্যন্তরীন অগ্নি-দূর্ঘটনার জন্য ব্যবহৃত রাস্তা ধরে ভেতরে ঢোকার চেষ্টায় ছিল। কিন্তু আমি জানতাম, এরকম কিছু হলে ঘটনার স্বাক্ষী থেকে যাবেই; আর সেই স্বাক্ষী আপনারা!
রাতে যুক্তরাজ্য যে ভিয়েনা কনভেনশনকে ছুড়ে ফেলে দেয়নি; তার একমাত্র কারণ, ঘটনার দিকে পুরো বিশ্ব তাকিয়ে ছিল। আর বিশ্ব এখানে তাকিয়ে ছিল, কারণ আপনারা এখানে তাকিয়ে ছিলেন!
আপনাদের যদি কেউ বলে যে, আপনাদের এই রাতজাগার কোনো অর্থ হয় না; প্রিয় বন্ধুরা আমার, তাকে স্রেফ মনে করিয়ে দেবেন কিভাবে আপনারা এই ইকুয়েডর দূতাবাসের সামনে অতন্দ্র প্রহরী হয়ে এইসব ঘটনা ঠেকিয়ে দিয়েছেন!
আরও মনে করিয়ে দেবেন যে, কিভাবে পরেরে দিন নতুন এক সূর্যের আলো ভিন্ন এক দুনিয়ায় প্রবেল করেছিল। মনে করিয়ে দেবেন যে, কিভাবে পরদিন সকালে লাতিন দেশগুলো ন্যায়বিচারের পক্ষে দারুণ সাহসী ভূমিকা নিয়ে রুখে দাড়িয়েছিল।
আজ সেই সাহসী মানুষগুলোর জন্যও আমার পক্ষ থেকে অনেক ধন্যবাদ। প্রেসিডেন্ট কুরিয়া (রাফায়েল ভিসেন্তে কুরিয়া দেলগাদো, ইকুয়েডরের প্রেসিডেন্ট) আমার রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা বিবেচনা করে এবং পরে মঞ্জুর করে যে সাহস দেখিয়েছেন; সে জন্য ধন্যবাদ।
একইরকম ইকুয়েডরের সরকার এবং তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিকার্ডে পিন্টোকে ধন্যবাদ জানাতে হয়। কারণ, তারা আমার ব্যাপারটি বিবেচনা করে ইকুয়েডরের সংবিধান ও বৈশ্বিক মানবতার ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সমুন্নত রেখেছেন।
আমাকে সমর্থন দেওয়া এবং তাদের সংবিধানের পক্ষে কাজ করে যাওয়ার জন্য ইকুয়েডরের জনগনকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ। এই দূতাবাসের প্রত্যেক কর্মীর কাছে আমার কৃতজ্ঞতার ঋন অসীম। এদের অনেকেরই পরিবার-পরিজন লন্ডনে বসবাস করেন। তারা প্রতিনিয়ত নানারকম হুমকি পাওয়ার পরও আমার প্রতি যে মমতা ও আতিথ্য দেখিয়েছেন; তা বলে শেষ করা যাবে না। শুক্রবার এই লন্ডনে লাতিন আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের একটি বিশেষ জরুরী বৈঠক ডাকা হয়েছে। আমি লাতিন আমেরিকার দেশগুলি; আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, নিকারাগুয়া, ব্রাজিল, চিলি, কলম্বিয়া, এল সালভাদর, হন্ডুরাস, মেক্সিকো, পেরু, ভেনেজুয়েলা এবং আরও সব রাষ্ট্রের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি আমার রাজনৈতিক আশ্রয়কে সমর্থন জানানোর জন্য। যুক্তরাজ্য, সুইডেন ও অস্ট্রেলিয়ায় সরকার আমাকে সমর্থন করছে না; কিন্তু দেশগুলির যেসব মানুষ সরকারী মনোভাব উপেক্ষা করে আমাকে সমর্থন জানিয়ে আমাকে শক্তিশালী করছেন; তাদের অনেক ধন্যবাদ। এবং এসব সরকারের মধ্যে এখনও যে গুটিকয় বিবেচনাক্ষম লোক এখনও ন্যায় বিচারের পক্ষে লড়াই করে যাচ্ছেন; তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। আপনাদের দিন একদিন আসবেই।
উইকিলিকসের সব কর্মী, সমর্থক এবং সূত্রকে ধন্যবাদ; যাদের কমিটমেন্ট আর বিশ্বস্ততার কোনো তুলনা হয় না।
আমার পরিবার এবং আমার সন্তানদের প্রতি ভালোবাসা; যে সন্তানদের তাদের বাবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। আমরা খুব দ্রুত আবার একত্রিত হবো!
আজ উইকিলিকস যখন হুমকির মুখে; তার মানে বুঝতে হবে আমাদের এই সমাজের মুক্তবুদ্ধি এবং চিন্তার স্বাধীনতাও হুমকির মুখে। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের বিপক্ষে এই আন্দোলনকে আমাদের ভবিষ্যত নির্ধারণের পথ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।
আমরা কি আবার একত্রিত হতে পারব? আমরা কি যে মতাদর্শ নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম, সেই মতাদর্শ আরও শক্ত করে তুলে ধরতে পারব?
নাকি আমাদের মতাদর্শ পাথরে মাথা টুকে মরবে? নাকি আমাদের সবাইকে ভয়ানক এক রূঢ় দুনিয়ায় টেনে নিয়ে যাবে! যেখানে সব সাংবাদিক মামলার ভয়ে চুপ করে যাবে। যে দুনিয়ায় সব নাগরিককে অন্ধকারে চিৎকার করে ফিরতে হবে! বলছি, আমরা অবশ্যই ঘুরে দাড়াতে পারব।
প্রেসিডেন্ট ওবামাকে বলছি, সঠিক কাজটা করুন। উইকিলিকসের বিপক্ষে এই ডাইনি-হত্যাযজ্ঞ এখনই বন্ধ করুন।
যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই আমাদের বিপক্ষে এফবিআই তদন্ত বন্ধ করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই পরিষ্কার করে বলতে হবে যে, তারা আমাদের কর্মীদের এবং সমর্থকদের দণ্ড দেওয়ার চেষ্টা করবে না।
যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই সারা দুনিয়ার সাংবাদিকদের সামনে কথা দিতে হবে যে, তারা ক্ষমতাধরের গোপন অপরাধ উন্মোচন করতে সাংবাদিকদের আর বাধা দেবে না। কোনো সংবাদ সংস্থার বিপক্ষে এই ধরণের নির্বোধের মতো আইনি ব্যবস্থা আর নেওয়া চলবে না; সে উইকিলিকসই হোক, আর নিউইয়র্ক টাইমস!
সমাজের প্রহরীদের বিপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের এই লড়াই অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।
থমাস ডার্ক, উইলিয়াম বিনে, জন কিরাকৌ সহ যুক্তরাষ্ট্রের যেসব নায়োকোচিত মাজের প্রহরীরা আছেন; তাদেরকে অবশ্যই, অবশ্যই মুক্ত করে দিতে হবে। অবশ্যই তারা জনগনের কর্মচারী হিসেবে যে কঠোর সময় পার করেছেন এবং যে দায়িত্ব পালন করেছেন; সে জন্য যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরন দিতে হবে। এবং সেইসব সামরিক ব্যক্তি যাদের লিভেনওয়র্থ দূর্গ, কানাসে বন্দী রাখা হয়েছে; তাদের ছেড়ে দিতে হবে। কোয়ান্টিকো, ভার্জিনিয়াতে জাতিসংঘের তৈরি করা নির্যাতনের কেন্দ্রগুলোতে যেসব বন্দী আছেন; যারা বন্দীত্বের দু বছর পরও বিচারের মুখ দেখতে পারনি; তাদের অবশ্যই, অবশ্যই ছেড়ে দিতে হবে।
ব্র্যাডলি ম্যানিংকে যে অপরাধে অপরাধী বলা হচ্ছে, তা যদি সে সত্যিই করে তাকে; তাহলে সে একজন নায়ক! সে সত্যিই আজদের দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন রাজনৈতিক বন্দী। এই ব্র্যাডলি ম্যানিংকে অবশ্যই ছেড়ে দিতে হবে।
পর্যন্ত ব্র্যাডলি ম্যানিং বিচার ছাড়াই ৮১৫ দিন জেলে কাটিয়ে ফেলেছে! যেখানে এর সর্বোচ্চ সীমা ১২০ দিন।
বৃহষ্পতিবার, আমার বন্ধু নাবিল রজবকে একটি টুইট করার অপরাধে ৩ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
শুক্রবার রাশিয়ান একটি ব্যান্ডদলকে রাজনৈতিক পারফরম্যান্স করার অপরাধে জেলে পোরা হয়েছে।
আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন এইসব হিংস্রদের মধ্যে একটি একাত্মতা আছে।
এখন আমাদের এই প্রতিবাদে অবশ্যই আরও একাত্ম এবং আরও দৃঢ় হয়ে উঠতে হবে।
আমরা একটি রাষ্ট্রের বিলোপ সাধন করব- যেটা নৈরাজ্য নয় :: অরুন্ধতি রায়
অনুবাদ: আরিফ ইসলাম
অরুন্ধতি রায়ের মত একক ভাবে ভারতের সমালোচনা এ যাবৎ কাল পর্যন্ত এতটা হয়নি। বলতে গেলে তিনি এমন একটা যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন যার শুরু হয় পোখরান’দের সাথে, যেটা পরবর্তিতে নর্মদা’র দিকে সরে যায় এবং অন্যান্য বিদ্রোহ থেকে শুরু করে গণ-সংগ্রাম ও মাওবাদীদের জনযুদ্ধ পর্যন্ত প্রসার লাভ করে। তিনি তার লেখার মাধ্যমে ভারতের সরকার ও সরকারের পোষ্য অভিজাতশ্রেণী, কর্পোরেট নামক দৈত্যদের এবং সাম্প্রতিক সময়ের আন্তর্জাতিক অর্থসংস্থান ও পুঁজিবাদের সম্পূর্ণ গঠনকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। আদালত অবমাননার দায়ে তাকে ২০০২ সালে একদিনের জন্যে জেলে যেতে হয় এবং ২০১০ সালের নভেম্বর মাসে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত কাশ্মির বিষয়ক ‘আজাদি’ই একমাত্র পথ’ (Azadi—the only way) শিরোনামে একটি সেমিনারে অন্যদের সাথে মিলে ভারত বিরোধী বক্তৃতা দেয়ার অভিযোগে অরুন্ধুতি রায়’কে অভিযুক্ত করে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করা হয়।
পাণিনি আনন্দ’র কাছে দেয়া অরুন্ধুতি রায় এর সাক্ষাতকারের চুম্বক অংশ নিচে তুলে ধরা হলো:
প্রশ্ন: রাষ্ট্রদ্রোহ কিংবা বেআইনী কার্যক্রম (প্রতিরোধ) আইন, অথবা, AFSPA (Armed Forces (Special Powers) Act) এর মত আইন, যা বৃহত্তম গণতন্ত্রের নামে দালালী করে থাকে; এগুলোর সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী?
অরুন্ধতি: আপনি ‘দালাল’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন বলে খুশি হলাম। ভারতের গণতন্ত্র ব্যাখ্যা করতে গেলে এটা একটা উপযুক্ত শব্দ। অবশ্যই এটি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর গণতন্ত্র। কাশ্মির অথবা মণিপুর বা ছত্তিশগড়ের মতো জায়গায় গণতন্ত্রের নাম-গন্ধও নেই। এমনকি কালো বাজারেও এই গণতন্ত্রের ছোঁয়া পাওয়া যায় না। কতগুলো আইন আছে, যেমন ইউএপিএ[UAPA (Unlawful Activities (Prevention) Act)], যা মূলতঃ ইউপিএ [UPA (United Progressive Alliance)] সরকারের পোটা [POTA (Prevention of Terrorist Activities Act)]-এর সরকারি সংস্করণ মাত্র আর আফসপা [AFSPA], এগুলো এমনই হাস্যকর রকমের কর্তৃত্বের দাবীদার যে, আইনগুলো লোকজনকে আটক, এমনকি শাস্তির মেয়াদ উত্তীর্ণ হবার পরেও তাদেরকে হত্যা করতে রাষ্ট্রকে সমর্থন করে। স্বাভাবিক কারণেই এদেরকে গণতন্ত্রের মধ্যে স্থান দেয়া যায় না। কিন্তু যতদিন ধরে তারা [এই গণবিরোধী আইন] মূলধারার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে প্রভাব ফেলছে না; যতদিন ধরে তারা মনিপুর, নাগাল্যান্ড বা কাশ্মিরের মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে, অথবা হতদরিদ্র বিরুদ্ধে কিংবা মূলভূখণ্ডের মুসলমান ‘সন্ত্রাসী’দের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে; ততদিন পর্যন্ত এটাকে কেউ খুব বেশি কিছু মনে করবে বলে মনে হয় না।
প্রশ্ন: জনগণ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পরছে, নাকি রাষ্ট্রই তার জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পরছে? ’৭০-এর জরুরী অবস্থার সময়কাল; অথবা লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়া সংখ্যালঘু, যা পূর্বে ছিল শিখ’রা, এখন মুসলিমরা; এ বিষয়টাকে আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
অরুন্ধতি: কিছু লোক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। আর রাষ্ট্র তার অধিকাংশ নাগরিকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছে। ’৭০-এর জরুরী অবস্থা নিজেই একটি সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছিল; কারণ ইন্দিরা গান্ধি’র সরকার নির্বোধের মতোই মধ্যবিত্তশ্রেণীকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছিল, যথেষ্ট বোকামি করেছে নিম্নবিত্ত আর ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিতদের সাথে মধ্যবিত্তদের মিলিয়ে ফেলে।
বর্তমানে দেশের অধিকাংশ অংশেই ‘জরুরী অবস্থার’ মতোই কঠোর অবস্থা বিরাজ করছে। কিন্তু এই অবস্থা রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মহড়া আর শক্তি প্রদর্শনের ওয়ার্কশপে পরিণত হয়। যা তাদের আরো দক্ষ, আরো আগ্রাসী করে তোলে। আমি আগেও বলেছি: একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের শুরু থেকে ভারত সরকার সৃষ্ট যুদ্ধগুলোর দিকে লক্ষ্য করুন;উদাহরণস্বরূপ দেখুন, যখন সেনাবাহিনী তার ‘নিজস্ব’ জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ডাক দিল, যেমন, নাগাল্যান্ড, আসাম,মিজোরাম, মনিপুর, কাশ্মির, তেলেঙ্গানা, গোয়া, বঙ্গ, পাঞ্জাব এবং (শীঘ্রই আরো সংযুক্তি আসছে) ছত্তিশগড়ে, তাহলে অন্তত এতটুকু বুঝতে পারবেন, এটা একটা ক্রমাগত যুদ্ধরত রাষ্ট্র। এবং সর্বদাই আদিবাসী জনগণ, খ্রিষ্টান, মুসলিম, শিখ প্রভৃতি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে; কখনোই মধ্যবিত্ত, উচ্চ-বর্ণের হিন্দুদের বিরুদ্ধে নয়।
প্রশ্ন: কিভাবে রাষ্ট্র এককভাবে সহিংসতার চক্র সংযত রাখবে যদি না বাম ‘সন্ত্রাসী দলগুলোর’ বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ না নেয়? পদক্ষেপ না নিলে কী অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিপন্ন হবে না?
অরুন্ধতি: আমার মনে হয় না, ‘সন্ত্রাসী দলগুলোর’ বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়া উচিত হবে না- এ নিয়ে কোন ব্যক্তি ওকালতি করছে, এমনকি ‘সন্ত্রাসীরা’ নিজেদের জন্যেও করছে না। সন্ত্রাস বিরোধী আইন কাদের উপর প্রয়োগ করা হবে তারা এই নিয়ে কোন প্রশ্ন তুলেনি। তাদের যা করার তারা তা করছে, তারা এটা ভালোভাবে জানে এর ফলাফল কি হবে,আইনত নাকি অন্যপন্থায়। তারা তাদের আক্ষেপ প্রকাশ করছে এবং এমন একটা সিস্টেমের আমূলে পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম করছে যার আপাদমস্তক অবিচার আর অসাম্য দিয়ে মোড়া। তারা নিজেদেরকে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে দেখে না। যখন আপনি ‘সন্ত্রাসী’ বলেছেন, যদি আপনি সিপিআই (মাওবাদী) [CPI (Maoist)]-কে নির্দেশ করে বলেন, যদিও আমি মাওবাদী আদর্শ সমর্থন করি না, তবুও অবশ্যই আমি তাদেরকে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে দেখি না। আমি স্বীকার করছি, তারা সশস্ত্র, তারা আইন বহির্ভুত। কিন্তু তারপর যখনি কেউ কর্পোরেট রাষ্ট্র ঠুঁটো জগন্নাথদের বিরোধিতা করেছে তাকেই এখন মাওবাদী আখ্যা দেওয়া হয়, যেখানে কিনা তারা মাওবাদীদের অন্তর্ভূক্ত হওয়া তো দূরের কথা, এমন কি মাওবাদী আদর্শকে পর্যন্ত সমর্থন করে না! নিষিদ্ধ সাহিত্যকে পুঁজি করে সীমা আজাদ’এর মত মানুষকেও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। তাহলে এখন ‘সন্ত্রাসীর’ কী ব্যাখ্যা দাঁড় করাবেন আপনি, ২০১২ সালে? মূলতঃ অর্থনৈতিক নীতির কারণে এই বিপুল বৈষম্য, এই ক্ষুধা, এই বাস্তুচ্যুতি, আর এগুলোই অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিপন্ন করছে- যে লোকগুলো এই নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে আর যাই হোক তারা অভ্যন্তরীন নিরাপত্তা বিপন্ন করছে না। আমরা কী রোগের উপসর্গ নাকি রোগ প্রতিরোধ করতে চাই? রোগটা “সন্ত্রাসবাদ” নয়। এটা সমাজের আগাগোড়া মোড়া অবিচার। এমনকি আমরা যদি একটি গ্রহণযোগ্য ন্যায়ের সমাজও গড়ে তুলি, নিশ্চিতভাবে সেখানেও মাওবাদীদের অস্তিত্ব থাকবে। ঠিক তেমনি অন্যান্য ‘চরমপন্থী’ দলগুলোও, যারা সশস্ত্র প্রতিরোধ, অথবা সন্ত্রাসী হামলায় বিশ্বাসী, তারাও টিকে থাকবে। কিন্তু তাদের আজকের মতো সেই জনসমর্থন সমর্থন থাকবে না। একটি দেশ হিসেবে আমাদের নিজেদের প্রতি লজ্জিত হওয়া উচিত এই অশ্লীলতা, এই দৈন্যতা এবং প্রকাশ্যে ও গোপনে জাতিগত ও ধর্মীয় গোড়ামী সহ্য করার জন্যে,যেগুলো আমরা প্রতিনিয়তই চারপাশে দেখছি। (প্রধানমন্ত্রী পদে নরেন্দ্র মোদি! সুস্থ মস্তিস্কে কী কেউ এমনটি কল্পনা করতে পারবে?) আমরা ভান করা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছি যে আমাদের ন্যায়বিচারের বোধটুকু রয়েছে। সমস্ত কাজেই আমরা সবাই কর্পোরেশন আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নতজানু হয়ে করে আছি।
প্রশ্ন: রাষ্ট্র কী ফোনে আড়ি পাতা কিংবা সোশ্যাল নেটওয়ার্কে আক্রমণের মাধ্যমে অরওয়েলীয় বিগ ব্রাদার এর মত আচরণ করছে?
অরুন্ধতি: সরকার এতটাই নির্লজ্জ হয়ে গেছে যে, আমাদের প্রত্যেকের উপর সবসময় গোয়েন্দাগিরি করার জন্য অনুমতি দিয়েছে। যদি এর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত কোন প্রতিবাদ দেখা না যায়, তবে কেন তা (গোয়েন্দাগিরি) করা হবে না? সকল ক্ষমতাসীন প্রতিষ্ঠানের প্রকৃতি হল জনগণকে নিয়ন্ত্রনাধীন রাখা, এটাই নয় কী? যখনি পুরো দেশ আরও ধর্মীয় ও রক্ষণশীলতায় পরিণত হচ্ছে; লক্ষ লক্ষ মঠ ও মন্দির আর মসজিদ ও চার্চ পরিদর্শন করছে লক্ষ লক্ষ মানুষ, প্রার্থনা করছে- ভগবান কিংবা অন্য কেউ তাদের অসুখী জীবনে সুখ দান করবে। ঠিক তেমনি আমরা রোবটের যান্ত্রিক যুগে প্রবেশ করছি, যেখানে কম্পিউটার প্রোগাম করা কোন যন্ত্র আমাদের সবকিছু নির্ধারণ করে দেবে, আমাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করবে সম্পূর্ণরূপে- তারাই নির্ধারণ করে দিবে কোনটা নৈতিক আর কোনটা অনৈতিক, কি কি ক্ষতিপূরণযোগ্য সদৃশ্য ক্ষতি গ্রহণযোগ্য আর কোনটা নয়। ধর্মীয় বাণী ভুলে যান। কম্পিউটারই সিদ্ধান্ত নেবে কোনটা সঠিক আর কোনটা ভুল। বর্তমানে নজরদারীর জন্যে এমন কিছু ক্ষুদ্রাকারের ডিভাইস (যন্ত্রাংশ) তৈরি হয়েছে যেগুলো আমাদের প্রতিটা পদক্ষেপ রেকর্ড করতে পারে। ভারতে এখনও আসেনি, কিন্তু শীঘ্রই আসছে, আমি নিশ্চিত। ইউআইডি [UID (Unique Identification Number)] এমনি একটি নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারীর সম্প্রসারিত মাধ্যম, কিন্তু লোকজন তা পাওয়ার জন্যে একজনের উপর আরেকজন ঝাঁপিয়ে পড়ছে। চ্যালেঞ্জ হলো, কিভাবে তা কাজ করতে হবে; মনস্তাত্ত্বিক খেলা ও নজরদারীর এই পর্যায়ে এসেও কিভাবে এই প্রতিরোধ অব্যবহত রাখা যায়!
প্রশ্ন: আপনি কেন মনে করেন, এখানে কারাগারে থাকা সংকটাপন্ন বিচারাধীনদের নিয়ে রাষ্ট্রের মধ্যে ব্যাপক জনগণের তেমন কোন প্রতিক্রিয়া নেই, মানুষ রাষ্ট্রদ্রোহ কিংবা এনকাউন্টার নিয়ে ব্যতিব্যস্ত? এই নন-ইস্যু কী কতগুলো মানবাধিকার সংগঠন দ্বারা তৈরী করা?
অরুন্ধতি: অবশ্যই সেগুলো নন-ইস্যু নয়। এটা একটা বিশাল সমস্যা। হাজার হাজার মানুষ কারাগারে, হয় তারা রাষ্ট্রদ্রোহ অথবা UAPA এর আইনানুযায়ী অভিযুক্ত, বিস্তৃতভাবে বলতে গেলে তাদের উভয়কেই মাওবাদী কিংবা মুসলিম ‘সন্ত্রাসী’ সন্দেহ করা হয়। অত্যন্ত আপত্তিজনক যে তাদের সেখানে কোন আনুষ্ঠানিক অবস্থানই নেই। আমাদের সবাইকে অন্তত এই বোধটুকু নিয়ে যেতে হবে যেগুলো বিভিন্ন জায়গা পরিদর্শনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে আর ব্যক্তিগত মানবাধিকার কর্মীদের তাদের পৃথক পৃথক অঞ্চলে ক্রমানুসারে সাজানো তথ্য থেকে পেয়েছি। নির্যাতন হয়ে গেছে সরকার আর তার পুলিশ সংস্থা’র কাছে পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য। এনএইচআরসি [NHRC (National Human Rights Commission)] এর একটি রিপোর্টে শুধুমাত্র গত এক বছরে ৩০০০ কারা মৃত্যু’র কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আপনি প্রশ্ন করছেন, কেন এখানে জনগণের তেমন প্রতিক্রিয়া নেই? কারণ, যারা প্রতিক্রিয়া দেখাবে, তাদের সবাইকে হয় কারারুদ্ধ, নয় হুমকি কিংবা সন্ত্রাসী বলে আখ্যা দেয়া হবে। এছাড়াও, এনজিওগুলোর মধ্যকার সহপরিচালনা ও অনৈক্য এবং রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন আর নজরদারীর বাস্তবতায় আমি জানি না এখানে গণ-আন্দোলনের কোন ভবিষ্যৎ আছে কিনা। হ্যাঁ,আমরা আরবের ‘বসন্তকালের’ দিকে চেয়ে থাকি, কিন্তু একটু গভীরভাবে তাকিয়ে দেখুন, সেখানে কিভাবে মানুষগুলো ব্যবহৃত হয়েছে এবং খেলার পুতুলে পরিণত হয়েছে। আমি মনে করি, আসছে বছর বিদ্রোহ, গণ প্রতিরোধের উপরে প্রধান্য পাবে। এবং দুর্ভাগ্যবশত, “সন্ত্রাসবাদ”ই হলো সেই বিদ্রোহের তীব্রতম রূপ।
প্রশ্ন: রাষ্ট্র প্রদত্ত আইন, একটি সক্রিয় পুলিশ বাহিনী, গোয়েন্দা বাহিনী, এমনকি সশস্ত্র বাহিনী ব্যতিত আমরা কী অরাজকতায় পর্যবসিত হব না?
অরুন্ধতি: আমরা একটি রাষ্ট্রের বিলোপ সাধন করব- যেটা নৈরাজ্য নয়, কিন্তু যুদ্ধ চলবে- যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা গণমানুষের ক্রমবর্ধমান প্রকটাকার সংকট মোকাবেলা করতে পারছি। যখন আপনি ধনীদের সেবার জন্যে আইন তৈরি করবেন, যে আইন তাদের সম্পত্তি ধরে রাখতে সাহায্য করবে, আরও এবং আরও সমৃদ্ধ করবে, তখনি ভিন্নমত পোষণ করা এবং বেআইনি কার্যকলাপ হবে সম্মানজনক, তাই না? অবশেষে আমি এই বিষয়ে নিশ্চিত নয় যে, আপনি লক্ষ লক্ষ মানুষকে দীন-দরিদ্র করা চালিয়ে যাবেন, তাদের জমি, জীবিকা চুরি করে শহরের দিকে ঠেলে দেবেন, বস্তি উচ্ছেদ করে তাদেরকে আবার ধাক্কা দেবেন আর এই প্রত্যাশা আপনি করতে পারেন সেনাবাহিনী, পুলিশ আর কারাগারের সাহায্যে খুব সহজেই তাদের ক্রোধ দন্তমূল থেকে অপসারণ করতে পারবেন। কিন্তু সম্ভবতঃ আমি ভুল। হয়তো আপনি তাদেরকে ক্ষুধার্ত রাখতে পারেন, কারাদণ্ড দিতে পারেন, হত্যা করতে পারেন। এবং মানুষের মুখোশে এটাকে বিশ্বায়ন বলে উচ্চারণও করেন।।
(এই সাক্ষাৎকারটি “রেভল্যুশনারি ফ্রন্টলাইন” থেকে নেওয়া হয়েছে)
স্বাধীন দেশের নাগরিক হিশেবে কোলকাতা আর আমাদের কিছু দিতে পারবে না || আহমদ ছফা
প্রশ্ন: ১৯৪৭-এর পর পূর্ব পাকিস্তান এবং ১৯৭১-এর বাংলাদেশ এই পর্ব দুটি আপনার চিন্তার জগতকে কিভাবে প্রভাবিত করেছে?
আহমদ ছফা: পাকিস্তান যখন হয় তখন আমি শিশু। পরবর্তী সময়েও পাকিস্তান আমার মনের ওপর কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমি ক্লাস থ্রি বা ফোরের ছাত্র ছিলাম। সে সময় বাংলা ভাষার দাবিতে আমিও মিছিলে গেছি এবং আমার এক ভাই একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলনে মুসলিম লিগারদের হাতে মার খায়। তার থেকেই পাকিস্তানের কোনও প্রভাব আমার মনে কখনো কাজ করে নি। বরং আমার আকর্ষণ ছিল কোলকাতার প্রতি। ওখানকার পত্রপত্রিকা ও সাহিত্যের প্রতি আমার ছিল প্রবল টান। ‘নবজাতক’ নামে মৈত্রেয়ী দেবী কোলকাতা থেকে একটা পত্রিকা বের করতেন। ১৯৬৫ সালে সেই পত্রিকা তিনি আমার কাছে পাঠাতেন, আমি পত্রিকা বিক্রি করে তাকে টাকাটা পাঠিয়ে দিতাম। পূর্ব বাংলায় আমাদের বাঙালি অবস্থানটা শক্ত করার প্রয়োজনেই সেই সময় আমরা কোলকাতার দিকে অণুপ্রেরণার জন্য তাকাতাম। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম এবং স্বাধীনতার পর, অন্য আর একটা অনুভব আমার মধ্যে এল, তা হচ্ছে-ভবিষ্যতে হয়তো কোলকাতার দিকে আর আমরা তাকাতে পারবো না। কিংবা কোলকাতার প্রতি আমাদের আকর্ষণের প্রেরণাটাও আর হয়তো থাকবে না। কারণ কোলকাতা আমাদের অতীতের প্রেরণা এবং অতীত ঐতিহ্যের উৎস হতে পারে, কিন্তু একাত্তরে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিশেবে কোলকাতা আর আমাদের কিছু দিতে পারবে না এবং আমাদের কক্ষপথ আমাদেরই আবিষ্কার করে নিতে হবে। সেই কক্ষপথ অনুসন্ধানের জন্যে, আমাদের সমস্ত কাজকর্ম ও চিন্তা নিয়োগ করেছি। শুধু আমরা নয়, বাংলাদেশের একটা অংশের মানুষের মধ্যে এ চিন্তাটা এসেছে যে, বাংলাদেশকে তার নিজের মেরুদণ্ডের ওপর দাঁড়াতে হবে, নিজেকে আবিষ্কার করতে হবে।
প্রশ্ন: বাঙালি মুসলমান মানসে পাকিস্তান আন্দোলন কোন প্রক্রিয়া সে সময় সৃষ্টি করেছিল, যার জন্য তারা পাকিস্তান চেয়েছিল?
আহমদ ছফা: এটা খুব জটিল বিষয়। আমার খুব আশঙ্কা হয় সে কারণটা এখনো যায় নি। মুসলিম লীগ এখানেই হয়েছিল। মুসলীম লীগের ভিত্তি এবং শক্তি ছিল বাংলাতেই। ইতিহাসের পাতা উল্টালে আপনি লক্ষ্য করবেন যে, বাংলার অ্যাসেমব্লির মুসলমান সদস্যরা বাংলা ভাগ চান নি এবং তারা স্বাধীন বাংলার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। বাংলার অ্যাসেমব্লির যে সব সদস্য বাংলা ভাগের পক্ষে মত দিয়েছিলেন, তাদের চার ভাগের তিন ভাগ ছিলেন হিন্দু এবং শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি ক্রমাগত এটাই বলেলেন যে ভারতকে এক রাখ কিন্তু বাংলাকে ভাগ করে দাও। হ্যা, বাংলার মুসলমান জনগণ পাকিস্তান চেয়েছিল। কিন্তু সুক্ষ্মভাবে দেখলে বাংলা ভাগ জিন্নাহও চাননি। অনেক সময় বাংলা ভাগের জন্যে বাংলার মুসলমানদের দায়ী করা হয়, এটা সঠিক নয়।
প্রশ্ন: এই পরিপ্রেক্ষিতে আপনি কি বাংলার হিন্দুদেরই বাংলা ভাগের জন্য দায়ী করবেন?
আহমদ ছফা: অচিন্ত বিশ্বস, ‘তপসীলি রাজনীতি’ শীর্ষক একটি লেখায় বলেছেন, তিন থেকে ছ’ভাগ লোকের (বর্ণহিন্দু) স্বার্থে বাংলা ভাগ করা হয়েছে। বক্তব্যটা অমূলক নয়। জয়া চ্যাটার্জ ‘Bengal divided Hindu Communalism and partition’ বইতে এসব তুলে ধরেছে।
প্রশ্ন: ’৪৭-এ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা গঠনে আবুল হাশিম এবং শরৎ বসুদের প্রচেষ্টা সফল না হবার কারণও কিওই তিন থেকে ছ’ভাগ বর্ণহিন্দুর স্বার্থ?
আহমদ ছফা: না, না, ওটাই একমাত্র কারণ নয়। ওই একটি কারণেই ওই রকম একটা বিরাট ঘটনা ঘটে নি। প্রথমত প্রভাব প্রতিপত্তির দিক দিয়ে ১৯৩০-এর পর বাংলা ভাষা চতুর্থ ভাষা হয়ে গেল কোলকাতায়। প্রথম ভাষা ইংরেজী, দ্বিতীয় ভাষা হিন্দি, তৃতীয় ভাষা উর্দু। তারপর মহাযুদ্ধ, ওই যুদ্ধ বাঙালির অর্থনীতিকে সম্পূর্ণ ভেঙ্গে দিল এবং বাঙালির রাজনীতি সম্পূর্ণভাবে নির্ভর হয়ে গেল পশ্চিমী অবাঙালিদের ওপর। বাংলা ভাগের জন্যে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিদের অর্থটা দিয়েছিল টাটা। যে কারণে সুভাষ বোসকে কংগ্রেস ছাড়তে হল, এমনকি শেষ পর্যন্ত দেশও ছাড়তে হল। গান্ধী এবং নেহেরুকে টাকা দিত মাড়ওয়ারি এবং গুজরাটিরা। একজন বাঙালি সভাপতিকে তারা টাকা দিতে রাজি ছিল না এবং গান্ধী নেহেরু কখনই চান নি সুভাষ বসুর মত একজন বাঙালি কংগ্রেস দলের সভাপতি হোন বা থাকুন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ না হলে এবং বাঙালির অর্থনীতিটা ভেঙ্গে না গেলে হয়তো বাঙালির এই পরিণামটা হত না।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের কিছু মানুষ মনে করেন যে পাকিস্তান হয়েছিল বলেই, পর্ব বাংলার মানুষ বাংলাদেশে পেয়েছে। আপনিও কি এই মতের অনুসারী?
আহমদ ছফা: এর মধ্যে সত্যতা আছে, কিন্তু সম্পূর্ণ সত্য নয়। ইতিহাসের আরও পেছনে যাওয়া দরকার। যেমন পশ্চিম বাংলার অর্থনীতিবিদ ও চিন্তাশীল লেখক ড. অশোক মিত্র বলেছেন, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ রদ না হলে, অর্থাৎ তখন যদি বঙ্গ বিভাগ হত তবে বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্তের বিকাশ ঘটতো এবং বিকশিত বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত হিন্দুদের সাথে একটা সমঝোতা করে নিত। ফলে ১৯৪৭ দেশ ভাগের কোন প্রয়োজন ঘটতো না। বাংলা ভাগ না হলে ভারতও ভাগ হতো না। কারণ বাংলার বাইরে পাকিস্তানের অস্তিত্ত্ব কোথাও ছিল না। মুসলিম লীগ এখানেই হয়েছে এবং এখানেই ছিল পাকিস্তানের পক্ষে মুসলিম লীগের জনভিত্তি। এছাড়া চিত্তরঞ্জন দাসের ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ যদি কার্যকার হত, তাহলেও বাংলা ভাগ হতো না। তারপর ধরুন ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান, যাতে বাংলা আসামকে একটা জোন করা হবে বলা হয়েছিল। এটা মেনে নেয়া হলেও বাংলা ভাগ হত না। অর্থাৎ কিছু ঐতিহাসিক অনিবার্যতা দীর্ঘকাল ধরে যা হয়ে আসছিল তার চূড়ান্ত অভিঘাতে বাংলা ভাগ হয়েছে।
প্রশ্ন: পাকিস্তান ভাঙ্গার পেছনে কোন ঐতিহাসিক অনিবার্যতা কাজ করেছিল?
আহমদ ছফা: বাঙালি মুসলমানের জাতীয়তাবোধ। কিন্তু শূন্য থেকে তো জাতীয়তাবোধ জন্মায় না। এখানে (পূর্ব বাংলা) যে মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে উঠল তারাই প্রথম অনুভব করলো রাজনীতি, অর্থনীতি, ভাষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানি আধিপত্য প্রতিরোধ করতে না পারলে, বাঙালি হিশাবে তাদের বিকাশ সম্ভব নয়। মওলানা ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিব এরা ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনের নেতা। পরে পাকিস্তানকেও ভাঙ্গতে হল, কারণ ভাগে মিলছিল না। এটা একটা হিশাব, আর একটা হিশাব আছে। অর্থাৎ একটা জাতি কোন উপলক্ষে জেগে ওঠে, কত গভীরে তার প্রভাব পড়ে, অতি তুচ্ছ কারণেও কোনও ঘটনা ঘটতে পারে- কিন্তু তার প্রভাব অনেক সময় দীর্ঘস্থায়ী হয়। সেই দিক থেকে বাঙালি জাতির ইতিহাসে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে প্রভাব সঞ্চারী বড় কোন ঘটনা নেই।
প্রশ্ন: পূর্ব বাংলার বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের শিকড় অনুসন্ধানে এবং জাতি পরিচয় জেগে ওঠার পেছনে বাংলা ভাষার প্রশ্ন বা প্রভাব কতটা ছিল?
আহমদ ছফা: ভাষা ভিত্তিক জাতি পরিচয়ে ভাষাই প্রধান। ভাষা হল অধিকার উচ্চারণের প্রধান মাধ্যম। এই ভাষার সাথে অর্থনৈতিক বিষয়টাও যুক্ত ছিল যে নিউ মিডল ক্লাস তৈরি হচ্ছিল, তারা চাকরি-বাকরি পেত না যদি বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হতো। পূর্ব বাংলার মানুষ তখন তাদের অধিকার এবং অংশ চাইছিল। পূর্ব বাংলাকে তখন একটা স্বাধীন রাষ্ট্র হিশেবে চাওয়া হয় নি। বাংলা রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করা হয়েছি। বাংলা রাষ্ট্রভাষা হবার পর অন্য ইস্যুগুলো এলো, বৈষম্যগুলো পূর্ব বাংলার মানুষের কাছে স্পষ্ট হতে থাকলো। ওই বৈষম্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভ দানা বাধতে থাকলো চাকরিতে বৈষম্য, সামরিক বাহিনীতে বৈষম্য, অর্থনৈতিক উন্নয়নে বৈষম্য ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে পূর্ব বাংলার বৈষম্য ছিল। এই বৈষম্যগুলোকে রাজনৈতিক বিষয় হিশেবে পূর্ব বাংলার মানুষের কাছে তুলে ধরা হলো এবং তাতে মানুষ ব্যাপকভাবে সাড়া দিলেন এবং শেষ পর্যন্ত অস্ত্র তুলে ধরলেন পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার জন্যে। তবে পূর্ব বাংলার প্রতি নানা বৈষম্যের প্রতিবাদে যারা পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রাম আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন এক সময় এরা ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনের নেতা।
প্রশ্ন: এখানে কি আপনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে উল্লেখ করছেন?
আহমদ ছফা: তা বলতে পারেন। মুসলিম লীগের রাজনীতিতে শেখ মুজিব ছিলেন সোহরাওয়ার্দীর শিষ্য এবং গুরু শিষ্য দু’জনেই ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনের নেতা। বাংলাদেশ যারা স্বাধীন করেছেন এক সময় তাদের বেশির ভাগই ছিলেন মুসলিম লীগে। মুসলিম লীগের Extension or junior partner।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে এবং মুক্তিযুদ্ধে এখানকার বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বামপন্থী, বুর্জোয়া এবং চরম দক্ষিণপন্থী জামাত শিবিরের দৃষ্টিভঙ্গি এবং রাজনৈতিক অবস্থান?
আহমদ ছফা: শেখ মুজিবের প্রতি প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী এবং রাজনীতিকদের একটা সন্দেহ ছিল। শেখ মুজিব গোড়া থেকে ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘেষা এবং আমি আগেই বলছি, তার রাজনৈতিক গুরু ছিলেন সোহরাওয়ার্দী। তিনি ছিলেন পশ্চিমা ব্লকের লোক। এই পরিস্থিতিতে পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে এখনকার বামপন্থী দলগুলো যে বিরাট ভুল করেছে তা প্রায় আত্মহননের শামিল। একটা সময় বামপন্থীরাই ছিলেন পূর্ব বাংলার প্রধান রাজ্যনৈতিক শক্তি। ১৯৬৫ সালের পূর্বে অবিভক্ত ন্যাপ বা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিই ছিল পূর্ব বাংলা প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। ন্যাপের সাথে ছিল কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন সাংস্কৃতিক সংঘ, মহিলা পরিষদ শ্রমিক সংগঠন, কৃষক সমিতি। সব মিলিয়ে একটা বিরটা শক্তি। সে সময়টা ছিল বামপন্থী রাজনীতির স্বর্ণযুগ। বাংলাদেশের বামপন্থী রাজনীতির বর্তমান দৈন্যদশা দেখে পূর্বের অবস্থা কল্পনা করতে পারবেন না। চীন না সোভিয়েত কে সাচ্চা, এই প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায় আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন। যার আঘাত নেমে আসে পূর্ব বাংলার বাম রাজনীতিতে। দু’টুকরা হয়ে যায় ন্যাপ। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব যখন বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রশ্নটি সামনে এনে ছ’দফা ঘোষণা করেন তখন পূর্ব বাংলার বামপন্থী মস্কো এবং পিকিং শিবিরে ভাগ হয়ে পারস্পরিক বাদ-বিসংবাদে মত্ত। এবং দুই শিবির থেকেই ছ’দফার নিন্দা এবং বিরোধিতা করা হয়। অথচ ১৯৫৪ সালে ন্যাপ নেতা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ‘হোয়াট ইজ অটোনমি’ পুস্তকটি লিখে পূর্ব বাংলার জাতিসত্তার বিষয়টি তুলে ধরেছিলেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট আন্দোলন বিভক্ত হবার পর পূর্ব বাংলার বামপন্থীদের কাছে আন্তর্জাতিক ভাবনাই একমাত্র গুরুত্ব পেল।
১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে রাশিয়ার মধ্যস্থতার পর মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি বলল, আমরা অখণ্ড পাকিস্তানে বিপ্লব করবো। অন্যদিকে পাক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পিকিং-এর সাথে ভাল সম্পর্ক তৈরি করেছে। সেই সম্পর্কের ভিত্তিতে মাও সেতুং ভাসানীকে বললেন, ডোন্ট ডিস্টার্ব আইয়ুব, সে (আইয়ুব) সমাজতন্ত্রেকে সমর্থন করবে। ফলে সে সময় চীন পন্থীদের মধ্যে পাক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব বিরোধীতা না করার মানসিকতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং মুজিবের ছয়দফার মধ্যে তারা (চীনপন্থী কমিউনিস্ট) সিআইএ-এর গন্ধ আবিষ্কার করলেন। অন্যদিকে ছ’দফার সমর্থনে শহর, বন্দর, গ্রাম, গঞ্জ সর্বত্র প্রবল গণজোয়ার সৃষ্টি হল। সে সময় পূর্ব বাংলার যে একটা মধ্যবিত্ত শ্রেণী তৈরি হয়েছে, বাঙালির একটা জাতীয়তাবাদী আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয়েছে, সংগ্রামের একটা স্তরে সে উন্নীত হয়েছে- মস্কো বা পিকিং দুই পন্থীরাই তা শনাক্ত করতে পারে নি। বাঙালির জাতিগত আকাঙ্ক্ষার রাজনৈতিক উন্মেষকালে এরা সঠিক কোন অবস্থান নিতে পারে নি। ছয় দফার প্রতি মানুষের সমর্থন এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের অপ্রতিহত জয়যাত্রা দেখে মস্কোপন্থীরা ছ’দফার প্রতি সমর্থন জানাতে গেলে, শেখ মুজিব এক বাক্যে তাদের জানিয়ে দেন –দলের সাইনবোর্ড পাল্টে আওয়ামী লীগে যোগ দিন।
এছাড়া চারু মজুমদারের শ্রেণীশত্রু খতমের রাজনীতি চীনপন্থী কমিউনিস্টদের প্রবলভাবে প্রভাবিত করে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পর আমি পশ্চিম বাংলায় ছিলাম। সে সময় পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন জায়গায় দেওয়ালে দেখেছি সিপিআই(এম-এল)-এর পক্ষে শেখ মুজিব এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে নানা রাজনৈতিক শ্লোগান লেখা রয়েছে। এক সময় আব্দুল হক এবং মোহাম্মদ তোয়াহা ভাসানীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সারা দেশে হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুট, ধর্ষণ ইত্যাদী নির্বচারে চালাচ্ছে, আবদুল হক সাহেব তখন অখণ্ড পাকিস্তানের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। মোহাম্মদ তোয়াহা এবং সুখেন্দু দস্তিদার আবদুল হকের বিরোধীতা করে দেশের অভ্যন্তরে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেন। ভাষা আন্দোলনের নেতা আব্দুল মতিন, আলাউদ্দিন, অধ্যাপক অহিদুর রহমান-রা উত্তরবঙ্গের আত্রাই অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র নেতৃত্ব দেন। চিনপন্থী সিরাজ শিকদার স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা কায়েম করার লক্ষ্যে একাধিক সশস্ত্র সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন। তিনি(সিরাজ শিকাদর) পাকিস্তান এবং ভারত-এই দুই থাবা থেকেই পূর্ব বাংলাকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন।
বামপন্থীদের সংগ্রাম থেকেই বাঙালি জাতীয়তার বোধটি এখানেই অঙ্কুরিত হয়েছিল এবং তাদের নেতা ও কর্মীদের পরিচর্যায় তার বিকাশ। সেই কারণেই নানা অত্যাচার ও নির্যাতন তাদের এক সময় ভোগ করতে হয়েছে। শুনতে হয়েছে পাকিস্তান সংহতির শত্রু, বিদেশী গুপ্তচর, ইসলামের দুশমন ইত্যাদি অভিযোগ। কিন্তু সঠিক সময়ে সঠিক অবস্থান না নিতে পারার কারণে সে সবই ব্যর্থ হয়, সৃষ্টি হয় এক ব্যাপক গণবিচ্ছিন্নতা। আজ সেই গণবিচ্ছিন্নতারই ভিতরে রয়েছে এখনকার বামপন্থীরা। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সমস্ত অপকর্মের দোসর জামায়তের ঘৃণ্য ভূমিকা তো জানেন।
প্রশ্ন: যে লক্ষ্য এবং স্বপ্নকে সামনে রেখে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা প্রাপ্তির ২৬ বছর পর সেই স্বপ্ন কতটা সফল। কিংবা স্বাধীনতা প্রাপ্তির ছাব্বিশ বছরের এই পর্বটিকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
আহমদ ছফা: প্রথম স্বপ্নটা তো বাস্তবায়িত হয়েছে। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিশেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত বাংলার রাজনীতিকে যারা পরিচালনা করতেন তারা ছিলেন উচ্চ বর্গীয় অভিজাত। এখন সন অফ দি সয়েলরা রাজনীতিতে আসছেন। অন্যদিকে আশংকার দিকটি হল এখানে রাতারাতি একটি ইকোনমিক ক্লাস গ্রো করেছে। এই ইকোনমিক ক্লাসটি গড়ে উঠেছে ইকোনমিক প্লানডার(plunder) এবং লুণ্ঠন থেকে। লুণ্ঠনটা হয়েছে ব্যাপকহারে। এমন কয়েকজনকে আমি জানি, মুক্তিযুদ্ধের সময় যাদের ২৫শ’ টাকা ছিল না, এখন তাদের ক্যাপিটাল ২৫শ’ কোটি টাকা। রাজনৈতিক ক্ষমতাকে প্রয়োগ করে তারা এই টাকা আয় করেছে। এর ফলে যে সমস্যার মধ্যে আমরা পড়েছি- যদি পশ্চিম বাংলার সাথে বিষয়টি তুলনা করি বুঝতে সুবিধা হবে। পশ্চিম বাংলার মত (১৯৯৬) বিধানসভা নির্বাচনের আগে (১৯৯১) বর্ধমানে কালু ডোম বলে এক ব্যক্তি কংগ্রেসের এক সর্বভারতীয় ব্যক্তিকে পরাজিত করেছিলেন। এ চিত্র আপনি এখানে পাবেন না। কারণ আওয়ামী লীগ বলুন, বিএনপি বলুন, জাতীয় পার্টি বলুন, জামায়াতের কথা একটু স্বতন্ত্র, সব দল চলছে বাংলাদেশের নব্য ধনীদের অবৈধ উপায়ে আয় করা টাকার ওপর। কাজেই পশ্চিম বাংলার কালু ডোমদের মতো কোন প্রতিনিধি বাংলাদেশের সংসদে যেতে পারবেন না। এখানকার পত্রপত্রিকায় ঋণখেলাপী বলে একটা ব্যাপার দেখে থাকবেন। ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে, ঋণ শোধ করা হচ্ছে না। ব্যাংকগুলো এর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারছে না, কারণ এদের পক্ষে আছে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। বাংলাদেশের সব বুর্জোয়া দল চলে এদের চাদায়। এর ফলে বাংলাদেশে যে সংসদীয় ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে সেই সংসদে জনগণের সত্যিকার চিন্তা-ভাবনা, আশা-আকাঙ্খার কোন প্রতিফলন ঘটছে না। আপনি ঢাকায় এসে দেখলেন বিএনপির দু’জন এমপি আওয়ামী লীগের মন্ত্রী হলেন। ক্ষমতায় থাকার সময় বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি এইভাবে অন্য দলের এমপি ভাগিয়ে এনে মন্ত্রী বানিয়েছেন। এইভাবে বাংলাদেশের ক্ষমতার রাজনীতিটা একটা দুষ্ট চক্রের মিউজিক্যাল চেয়ারে পরিণত হয়েছে।
প্রশ্ন: এর থেকে উত্তরণের কোন পথ কি আপনি দেখছেন?
আহমদ ছফা: ১৯৭২ সালে ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ নামে একটা বই লিখেছিলাম। সাম্প্রতিক তার একটা নতুন সংস্কৃরণ আমার দীর্ঘ ভূমিকাসহ প্রকাশিত হয়েছে। আপনার অনেক প্রশ্নের উত্তর তাতে পাবেন। আমি মনে করি, ১৯৬৫-এর আগে বামপন্থী শক্তির যে ঐতিহ্যটা পূর্ব বাংলায় ছিল তা পুনরুদ্ধার করতে হবে। শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র ‘যুবক এবং সাধারণ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে তারা যে অবস্থান সে সময় তৈরি করেছিল তা পুনরুদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত আমি কোনও ভবিষ্যৎ দেখছি না।
প্রশ্ন: এখনকার বাম দলগুলোর মধ্যে সেরকম কোন উদ্যোগ বা প্রচেষ্টা কি আপনি লক্ষ্য করছেন?
আহমদ ছফা: বাম দলগুলো নিজেদের চরম ক্ষতি করছে জাতিমুক্তির প্রশ্নটিকে অনুধাবন করতে না পারার কারণে। এ প্রসঙ্গে আমাদের দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক বিন্যাসটা একটু বোঝা দরকার। আমাদের এখানে যদি উৎপাদন ভিত্তিক, মানে শিল্পপতিরা যদি কলকারখানা তৈরি করতেন, তবে শ্রমিকরা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের পলিটিক্স তৈরি করতেন। কোন উৎপাদন ভিত্তিক অর্থনীতি এখানে গড়ে ওঠে নি। এখানে যা আছে তা ট্রেডিং। স্বাধীনতার পর শিল্প কারখানা এখানে হয় নি, কিন্তু হওয়া উচিত ছিল। জাতির একটা অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড কোন সরকার তৈরি করতে পারে নি। পরিবর্তে এখানে একটা ট্রেডিং ক্লাস তৈরি হয়েছে এবং এ ট্রেডিং ক্লাসটা টিকে আছে, ট্রেডিং পলিটিক্স-এর কারণে। ট্রেডিং ব্যবসায়ীরা দু’ভাবে জনগণকে শোষণ করে। প্রথমত তারা যখন বাইরে কাচামাল রফতানি করে এবং দ্বিতীয়ত যখন বাইরে থেকে ফিনিসড গুডস আমদানি করে। সমস্ত বামদলগুলোকে একসাথে বসাবার চেষ্টা করেছি, মতবিনিময়ের ব্যবস্থা করতে চাইছি এবং বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে একটা কিছু করাতে চাইছি। কিন্তু একবার যদি সুবিধাবাদের দিকে রাজনীতিটা চলে যায়, তবে সেখান থেকে রাজনীতিকে ফিরিয়ে আনা খুবই মুশকিল। বামপন্থীরা এখন যেটা করছে, তা হল, একটা অংশ হয়তো বিএনপি’র সাথে, অন্য অংশটি আওয়ামী লীগের এ্যালাইজ(allies) হিশেবে কাজ করছে। এগুলো সবই আত্মধ্বংসী।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের রাজনীতিতে বামপন্থীদের নিজস্ব অবস্থান নির্ণয় করার ক্ষমতা অর্জন করতে না পারার কারণ কি? এখানে কি কোন দর্শনগত সমস্যা আছে?
আহমদ ছফা: হ্যা, দর্শনের একটা ক্রাইসিস তো আছেই। কিন্তু আমি মনে করি মার্কসবাদ যদি জগতে ব্যর্থও হয়, শ্রেণী সংগ্রাম তো ব্যর্থ হবার কথা নয়। মার্কসবাদকে যারা সমাজ পরিবর্তনের একমাত্র টুলস হিশেবে মনে করে এবং যারা দেখছেন যে তাদের টুলসটা আর কাজ করছে না, অনিবার্যভাবেই তখন তারা উদ্যম এবং আকাঙ্খা হারিয়ে ফেলবেন। কিন্তু মার্কসবাদ সমাজে কাজ না করলেও নির্যাতিত শ্রেণীর সংগ্রাম কি বসে থাকবে?
প্রশ্ন: সে সংগ্রামে কারা নেতৃত্ব দেবেন?
আহমদ ছফা: আমার মনে হয়, বাংলাদেশের সামনের সময়টা বামপন্থীদের অনুকূলে আসবে, যদি তারা সক্রিয় হয়। যদি তারা মেধা বা আন্তরিকতা দিয়ে সমস্যাগুলো মূল্যায়ন করেন এবং একটা বিকল্প অর্থনৈতিক উন্নয়নের ছক যদি তারা তৈরি করতে পারেন। এখন একটা বুর্জোয়া সরকার আছে, বিশ্বব্যাংক আছে, এনজিও আছে, মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া আছে, এদের বিপরীতে একটা অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড, জাতিকে বাচাবার জন্য একটা উন্নয়নের ছক এবং উপায় আবিষ্কার করা আমার মতে খুব কঠিন কাজ নয়।
প্রশ্ন: ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের মুক্তি সংগ্রাম, সব ক্ষেত্রেই ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ উঠছে-
আহমদ ছফা: হ্যা, এটা একটা মজার প্যারাডকস। যেমন ধরুন বাংলার হিন্দুরা পানিকে জল বলেন, মুসলমানরা জলকে পানি। কিন্তু বাংলার বাইরে সবাই, হিন্দু-মুসলমান উভয়েই পানি বলেন। এই জল-পানি নিয়ে বাংলার হিন্দু-মুসলমানরা একশ বছর লড়াই করছে। যাহা জল তাহাই পানি। যাহা পানি তাহাই জল। এখন আমাদের এখানে কি হচ্ছে। দেশের প্রকৃত সমস্যাগুলো, লড়াইয়ের যে ক্ষেত্রগুলো আছে সেখানে কেউ যেতে চাইছে না বলে কতগুলো প্রতীক তৈরি হয়েছে। যে কোন ইতিহাসকে দলীয়করণ করার এই যে অনুদারতা, অসত্যতা, এর কারণ ইতিহাস বলতে তারা জনগণের ইতিহাস বোঝেন না। বোঝেন দলের ইতিহাস, ব্যক্তির ইতিহাস। ইতিহাস তো জনগণের ইতিহাস হবে। কিন্তু এখানে নেতা এবং দলের ইতিহাস সবাই তুলে আনছেন। এর কারণ হচ্ছে, সংঘাতের আসল ক্ষেত্র থেকে, জনগণকে সংঘাতের প্রতীকে ফেরত নেয়া। যেমন আমরা বাঙালী না বাংলাদেশী, বাঙালি না মুসলমান? এগুলো একটা থেকে আর একটার বিরোধী নয়। আমরা যেমন বাঙালি, তেমনি বেশিরভাগ লোক মুসলমান। আমরা যেমন বাংলাদেশী তেমনি বাঙালিও। কিন্তু এগুলো তৈরি করা হচ্ছে, ক্ষমতার মালিকানা কে নেবে, এখান থেকেই ইতিহাস বিকৃতিটা সৃষ্টি করা হচ্ছে। ফরাসি বিপ্লবের সঠিক ইতিহাস এখনো অনুসন্ধান করা হচ্ছে। রুশ বিল্পবের সময় স্টালিন এবং ট্রটস্কির ভূমিকা নিয়ে লাখ লাখ পাতা লেখা হচ্ছে। বাংলাদেশ সৃষ্টির এতবড় একটা ঘটনা, সেটা নিয়ে মতদ্বৈততা, বিতর্ক এসব থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। একাত্তরের যুদ্ধ বাঙালির জাতীয় জীবনের শ্রেষ্ঠ ঘটনা। কিন্তু এখানে সবাই মিথ্যা বলছেন কেন? মিথ্যেকে পূজো করছেন কেন? এর একমাত্র কারণ মিথ্যে বললে এখানে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া যায়।
প্রশ্ন: ভাষা আন্দোলন থেকে যে অসাম্প্রদায়িক জাতী চেতনার উন্মেষ তার চূড়ান্ত রূপ স্বাধীনতা। এই সুত্রে আশা করা গিয়েছিল বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে বিকশিত হয়ে উঠবে। ওই আশার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান বাংলাদেশকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
আহমদ ছফা: প্রথমত আমি অনেকগুলো পরিচিত চিন্তার বিরোধিতা করব। যারা ভাষা আন্দোলন করেছিলেন, তারা ছিলেন মধ্যবিত্ত ছাত্র, বেশির ভাগ মুসলমান। আওয়ামী মুসলীম লীগের সকল নেতৃবৃন্দ এককালে ছিলেন পাকিস্তানি। আমার শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাক সেদিন কথা প্রসঙ্গে আমাকে বললেন, তার কাছে শেখ মুজিবের কিছু ছবি আছে, সেই ছবিতে জিন্নাহ মারা যাওয়ার পর শেখ মুজিব হাউমাউ করে কাঁদছেন। হিন্দু-মুসলমানদের ভিত্তিতে দেশটা ভাগ হল। তারপর পশ্চিমাদের সাথে লড়াই করতে গিয়ে তারা (বাঙালি মুসলমানরা) পারে না। এল সোহরাওয়ার্দীর যুক্ত নির্বাচন। এইভাবে একটা প্রেক্ষিত তৈরি হল এবং বাঙালি মুসলমান বাঙালি হিন্দুদের টেনে আনলেন। এই ক্ষেত্রে প্রেমের চাইতে যে জিনিসটা বেশি কাজ করেছে, তা হল তাদের বাস্তব প্রয়োজন। অর্থাৎ যে অর্থে অসাম্প্রদায়িক ইত্যাদি বলতে আমরা যা চিন্তা করি, একটা আইডিয়াল সিচুয়্যেশন, সেটা বোধ হয় এ ক্ষেত্রে কল্পনা করা ঠিক হবে না। তবে কোলকাতা থেকে এটা কল্পনা করার বোধ হয় সময় এসেছে এই কারণে যে, ভাষা আন্দোলন তার নিজস্ব প্রেক্ষিত ছাড়িয়ে বাঙালি জাতির ইতিহাসে অন্যরকম একটা তাৎপর্য নিয়ে আসছে। কিন্তু উৎসের(ভাষা আন্দোলনের) দিকে গেলে দেখব লক্ষ্য ছিল চাকরি/বাকরি ইত্যাদি। আগেই বলেছি, একুশে ফেব্রুয়ারি আমি থ্রি ফোরের ছাত্র। ছাত্র বয়সে বাংলা ভাষার দাবিতে মিছিলে গেলে এসব কথা আমরা শুনতাম। উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে, বাংলায় পাস করে আমরা চাকরি পাব না, দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হবো, পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে হেরে যাব। সেই সময় শহিদুল্লাহ সাহেবের(ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ) একটা কথা- পাকিস্তানিরা যখন বলল, ইসলামের ভিত্তিতে যেহেতু পাকিস্তান, তাই ইসলামের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা হবে। শহীদুল্লাহ সাহেব বললেন, ইসলামকেই যদি তোমরা অগ্রাধিকার দিতে চাও তবে আরবিকে রাষ্ট্রভাষা কর, তোমরাও শিখবে, আমরাও শিখবো। পশ্চিম পাকিস্তানিরা তাতে রাজি হয় না। এইভাবে নানা প্রক্রিয়ার মধ্যে ভাষা আন্দোলনে আজকে আমরা যা আবিষ্কার করেছি সেই জিনিসটা প্রথমে ছিলনা।
‘চীন দেখে এলাম’ বইতে মনোজ বসু লিখেছিলেন, শেখ মুজিব পিকিংএ তাকে কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে, আমরা পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করে ছাড়াবো। পাক-ভারত যুদ্ধের সময় মনোজ বসু বইটা প্রত্যাহার করে নেন। পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার চিন্তা শেখ সাহেবের মনে থাকতে পারে। আমার মনে হয় এতে কেচো খুড়তে সাপ বেরিয়ে পড়েছে। বীরেন শাসমলের ছেলে নিমলানন্দ শাসমল, ‘ভারত যখন স্বাধীন হচ্ছে’ নামে একটা বই লিখেছিলেন। সেই বইতে তিনি লিখেছেন, আজকে যে কারণে আমরা শেখ মুজিবকে মালা দেই, সেই একই কারণে শেখ আবদুল্লাহকে জেলে পাঠাই। বাংলাদেশ স্বাধীন হতে পেরেছে প্রথম ভৌগোলিক দুরত্বের কারণে। ভারতের সাথে কাশ্মীরের কন্টিগিউয়াস(contiguous) এরিয়া। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি দেখলে বিষয়টির প্রতি সুবিচার করা হবে। আর এ সমস্ত ইস্যুতে আমি একজন সামান্য মানুষ। চূড়ান্ত মতামত দেবার ক্ষমতা আমার নাই।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের অনেক কবি, সাহিত্যিক দাবি করেন, ঢাকাই হবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের রাজধানী। এই দাবির যৌক্তিকতা কতটা আছে-
আহমদ ছফা: ‘রাজধানী’ করার শব্দটা খুব ভাল শব্দ নয়। তবে এ শব্দটা প্রথম উচ্চারণ করেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। এরা তো ব্যবসায়ী লেখক, যখন যেখানে যেমন বোঝেন কোপ মারেন। আবার ‘দেশ’ পত্রিকার বর্তমান সংখ্যায়(২১ ফ্রেবুয়ারী ১৯৯৮ সংখ্যা) ‘প্রবাসে বাংলা ভাষা’য় বাংলাদেশের ভূমিকাকে তিনি গৌণভাবে দেখিয়েছেন। রাজধানী শব্দটা আমি পছন্দ করি না। কারণ মানুষ যেখানে থাকেন, তার সংস্কৃতিও সেখানে থাকে। এক সময় ব্রজবুলি সাহিত্য তৈরি হয়েছিল, এক সময় মঙ্গলকাব্যও লেখা হয়েছিল, একসময় পুথিসাহিত্যও তৈরি হয়েছিল। সারা বাংলা জুড়ে নানা বাকে নানা সাহিত্য তৈরি হয়েছিল। বাংলাদেশের সাহিত্য এখনকার পরিবেশ, প্রতিবেশ, এখানকার জীবন, সংগ্রাম,রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা এসব নিয়ে লেখা হবে। পশ্চিম বাংলার সাহিত্য সেখানকার মত বিকশিত হবে। তবে বাংলা ভাষার প্রশ্নটা স্বতন্ত্র। বাংলা এখানে রাষ্ট্রভাষা, জাতীয় ভাষা। সেই কারণে বাংলা ভাষা এখানে যে পেট্রোনাইজেশনটা পাচ্ছে সেটা পশ্চিম বাংলায় বাংলা ভাষা পাচ্ছে না। বাংলা ভাষা ওখানে (পশ্চিম বাংলায়) একটি ‘প্রাদেশিক’ ভাষা, এবং হিন্দির দ্বারা চূড়ান্তভাবে কোণঠাসা। পশ্চিম বাংলায় বাংলা ভাষার জন্যে যে প্রেট্রোনাইজেশনটা দরকার আর্থিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক কোন ক্ষেত্রেই বাংলা ভাষা তা পাচ্ছে না। কারণ, জাতিগতভাবে বাঙালি সেখানে স্বাধীন নয়। বাংলাদেশের সাহিত্যের ক্ষেত্রে যারা খুব পরিচিত, একটা সময় পর্যন্ত তারা এখানকার সাহিত্যকে সার্ভ করেছেন তাদের অনেকেই এখন সাহিত্য ক্ষেত্রে একটা সময় যারা জ্বলে উঠেছিলেন, তাদের অনেকেই এখন বর্জ্য পদার্থের কাছাকাছি এসে গেছেন। নতুন প্রজন্মের কাছে পলিটিক্যাল ডেসটিনি না থাকলে, পলিটিক্যাল গোল ক্লিয়ার না থাকলে, শিল্প সাহিত্য তার প্রধান ভিকটিম হয়। এখন বাংলাদেশের চিত্র কোন দিকে যাবে তার দিশা নেই। আপনি দেখবেন হাজার হাজার পাতা পত্র-পত্রিকা ছাপা হচ্ছে। কিন্তু স্পর্শ করার মত পঞ্চাশটি পাতা আপনি সেখানে পাবেন না। কাজেই অতিকথন করে লাভ নেই। তবে বাংলাদেশের একটি সম্ভাবনা আছে, সেই সম্ভাবনাকে যদি একসপ্লয়েট করতে পারি, তাবে বাংলার এই অংশের সাহিত্যে একটা নতুন যুগ আসতে পারে। এবং তা যদি হয় তবে পশ্চিম বাংলার বাংলা ভাষাও সাহিত্যের সামনে চ্যালেঞ্জ আছে। সেসব মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কিছু শক্তি ও প্রেরণা দিতে পারবে। ‘রাজধানী’ শব্দটা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কয়েন করেছিলেন বাংলাদেশে বই বেচার জন্যে।
প্রশ্ন: পশ্চিম বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতিদ্বন্দি না পরিপূরক?
আহমদ ছফা: কোন সাহিত্য বা সংস্কৃতি কারো প্রতিদ্বন্দী হয় না। সাহিত্য-সংস্কৃতি হচ্ছে প্রবাহে প্রবাহে সম্মিলন। ধর্ম প্রতিদ্বন্দী হতে পারে, হয়। কিন্তু সাহিত্য-সংস্কৃতি কখনই হয় না।
প্রশ্ন: পশ্চিম বাংলার বই আমদানির ফলে বাংলাদেশের সাহিত্য এবং প্রকাশনা শিল্প মার খাচ্ছে। এমন অভিযোগ বাংলাদেশের সাহিত্য এবং প্রকাশনার স্বার্থে পশ্চিম বাংলার বই আমদানি বন্ধ করার কথাও শুনেছি এবং পশ্চিম বাংলার কোন বইকে এ বছর(১৯৯৮)ঢাকার একুশের বই মেলায় ঢুকতে দেয়া হয় নি। এ বিষয়ে-
আহমদ ছফা: আগে যেটা হত আমদানি তো হতই, অনেকে কোলকাতার প্রকাশকের কাছ থেকে ট্রেসিং নিয়ে এসে এখানে ছেপে বিক্রি করতেন। এতে আমাদের বইমেলা বা বইয়ের বাজারে আমাদের(বাংলাদেশের) বই বিক্রি হত না। ঐতিহাসিক কারণে দীর্ঘদিন ধরে এখানে কলকাতার বইয়ের একটা বাজার ছিল এবং কোলকাতার সেই বইয়ের বাজারকে চ্যালেঞ্জ করে কোনও বইয়ের বাজার এখানে গড়ে ওঠে নি। বই লেখা তো যথেষ্ট নয়, বই প্রমোট করা, বইয়ের আলোচনা করা, নানা কারণে সেসব এখানে হয় নি। স্বাধীনতার পর নানারকম দুর্বিপাকে পড়ে আমাদের গ্রন্থশিল্পটা বিকশিত হতে পারে নি। কিন্তু কোলকাতার গ্রন্থশিল্প অনেকদিন আগে থেকেই বিকশিত। সেই সুত্রে কোলকাতার বই বাংলাদেশের সমস্ত বইয়ের বাজার দখল করে নিল। এর মধ্যে আনন্দ বাজারের বইই ছিল শীর্ষে। পুলিশ দিয়ে এটা বন্ধ করা যায় না। ১৯৯৪ সালে বুকে পোস্টার দিয়ে এর প্রতিবাদ করলাম। অন্য কোন প্রকাশকের বই নয়। আমার প্রতিবাদ শুধু আনন্দবাজার বইয়ের বিরুদ্ধে। যে বইয়ের জন্যে ইলিয়াসকে(আখতারুজ্জামান ইলিয়াস) আনন্দ পুরস্কার দেয়া হয়েছে, সেই বইতেই(খোয়াবনামা) আনন্দবাজারকে বলা হয়েছে বাঙালির শত্রু। বাংলা ভাগ করার পেছনে এই পত্রিকাটির ভূমিকা অনেক। আমরা যখন ভাষা আন্দোলন করছি, সমর সেনের ‘বাবু বৃত্তান্ত’ পড়ুন, তখন রায়ট লাগাবার জন্যে ইলিশের পেটে হিন্দু রমনীর মস্তক পাওয়া গেছে বলে সংবাদ লিখে আনন্দবাজার সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়েছে এবং তসলিমাকে নিয়ে আনন্দবাজার যা করেছে গোটা দুনিয়ার কাছে আনন্দবাজার বাংলাদেশকে তুলে ধরল একটি সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী দেশ হিশেবে। কিন্তু কে মৌলবাদী, ভারত না বাংলাদেশ? মৌলবাদ উত্থান হচ্ছে ভারতে, বিজেপি এবার দিল্লির ক্ষমতায় আসছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সংসদে এবার জামায়াত পেয়েছে মাত্র তিনটি আসন। এই আনন্দবাজারের দৌরাত্ম্য আমরা বাংলাদেশে চলতে দেব না। বই যেমন সংস্কৃতির বাহন, তেমনি পণ্য। ইকোনমিক্স-এ একটা কথা আছে-Nurse the baby protect the child, Free the adult আমাদের প্রকাশনা শিল্প পরিণত না হওয়া পর্যন্ত বিশেষ কিছু ব্যবস্থা নিতেই হবে।
ভারতের বইয়ের কপিরাইট কিনে এখানকার প্রকাশকরা ছাপুন আপত্তি নেই। সুনীলের(গঙ্গোপাধ্যায়) কোন বই কপি রাইটে কিনে এখানে ছাপা হলে আমাদের কমপোজিটার, ছাপা খানা, দপ্তরি, পাইকার সবাই টাকা পাবে। তবে Medical Science, Technology-এর বইয়ের ক্ষেত্রে আমরা এ কথা বলি না। কারণ এসব বই আমেরিকা থেকে আনলে যদি পাচ’শ ডলার লাগে, ভারত থেকে আনতে লাগে এক’শ ডলার। এবং আনন্দবাজার ছাড়া অন্যান্য প্রকাশনার বইয়ের ব্যাপারে আমরা বিরোধিতা করিনা।
প্রশ্ন: কোলকাতার বই মেলা তো--
আহমদ ছফা: (উত্তেজিতভাবে প্রশ্ন শেষ করতে না দিয়ে) দেখুন, আমরা ভাষার জন্যে রক্ত দিয়েছে, রক্ত দিয়ে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভাষাভিত্তিক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি। আমরা কেন কোলকাতাকে অনুসরণ করতে যাবো। আপনার পত্রিকাতেই পড়েছে- কোলকাতা বই মেলার আমন্ত্রণপত্রে প্রথমে হিন্দি তারপর ইংরেজী এবং শেষ তিন নম্বরে বাংলার স্থান। যদি ভবিষ্যতে পশ্চিম বাংলায় ওই তিন নম্বর স্থান থেকেও বাংলা ভাষা মুছে যায় মোটেই অবাক হবো না। কারণ এটাই ভারত সরকারের পলেসি এবং এতেই ভারতের ‘ঐক্য সংহতি’ দৃঢ় হবে। আমাদের একুশের মেলা বাংলা ভাষার মেলা, বাংলাদেশের বইমেলা। একটি স্বাধীন জাতি হিশেবে, স্বাধীনভাবেই আমাদের চলার পথ আবিস্কার করতে হবে। আপনারা(পশ্চিম বাংলা ও ভারতের বাঙালিরা) জাতি হিশেবে স্বাধীন নন। আপনাদের ভাষাও সেখানে স্বাধীন নয়, আপনারা দিল্লি এবং হিন্দি সমান। সবক্ষেত্রে দিল্লি এবং হিন্দির নির্দেশ মেনেই আপনাদের চলতে হয়। পরাধীন জাতি হিশেবে স্বাধীনভাবে চলার ক্ষমতা আপনাদের নেই। মানসিকভাবেও এই দাসত্বকে আপনারা(ভারতের বাঙালিরা) মেনে নিচ্ছেন। কারণ ‘ভারতের ঐক্য সংহতি রক্ষা’র দায় এখন আপনাদের কাধে। তাই স্বাধীন হবার ইচ্ছেও আর থাকছে না। কিন্তু আমরা ‘পাকিস্তান সংহতি’কে কবরে পাঠিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছি। তাই পশ্চিম বাংলা বা কোলকাতাকে এক্ষেত্রে অনুসরণ করতে যাব না। যদি কোনদিন স্বাধীন হয়ে স্বাধীন চিন্তা এবং পথকে আবিস্কার করতে পারেন, সেদিন নিশ্চয় আমরা পশ্চিম বাংলা ও কোলকাতার দিকে তাকাব।
প্রশ্ন: আপনি আনন্দবাজার প্রকাশনার কথা বললেন, কিন্তু অন্য প্রকাশনার বইও তো একুশের বইমেলায় ছিল না?
আহমদ ছফা: না, একুশে মেলার বিষয়টা আলাদা। একুশের মেলা ছাড়া অন্য যেসব বইমেলা হয় তাতে থাকে। একুশের মেলা হল বাংলাদেশের লেখকরা কতটুকু উঠলেন, কতটুকু বিকশিত হলেন তার মান নির্ণয়ের মেলা। এখানে অন্য বই থাকবে না। আন্দোলন করে একুশের মেলাটিকে আমরা নিজেরে বইয়ের মেলা করতে চাইছি।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানার বাইরে অন্য কোনও স্থানের বই একুশের বইমেলায় থাকবে না। এই দাঁড়াচ্ছে মূল ব্যাপারটা-
আহমদ ছফা: হ্যা, তবে কোন ভারতীয় বই যদি বাংলাদেশে ছাপা হয় তাবে সে বই মেলায় থাকতে পারবে। এইটুকু যদি না করতে পারি, তবে দেশটাকে স্বাধীন করেছিলাম কেন? আমার একটা অভিজ্ঞতার কথা আপনাকে বলি। একবার আনন্দবাজারের বাদল বসু আমার একটা ইন্টারভিউয়ের প্রতিবাদ করে খুব খারাপ কথা বলেছিলেন। তারপর আমাদের দেশের প্রবীণ লেখক শওকত ওসমান বললেন, আমমদ ছফা খুব খারাপ লোক। উনি(শওকত ওসমান) খুব খারাপ শব্দ ব্যবহার করেছিলেন, সেই শব্দটা আমি বলছি না। এরপর একদিন আমি শওকত ওসমানকে সাথে নিয়ে ঢাকার নিউ মার্কেটে গেলাম। নিউ মার্কেটের সব বইয়ের দোকানে শওকত ওসমানের বই চাইলাম, কিন্তু কোন বইয়ের দোকানই শওকত ওসমানের কোনও বই দিতে পারে না। কিন্তু যখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই চাইলাম, দেখা গেল মুদি দোকানও তা দিতে পারে। শেষে আমি শওকত ওসমানকে বললাম, সুনীল আপনার বড় না ছোট? তিনি বললেন, ছোট, অনেক ছোট। ওকে আমি জন্মাতে দেখেছি। আর জানবেন শওকত ওসমান লেখক হিশেবে ছোট লেখক নন, তার অনেক লেখা আছে উৎকর্ষের বিচারে যা বেশ ভাল। এই অবস্থা দেখে শওকত ওসমানকে আমি বললাম, দেশটা আমরা বল ছেড়ার জন্য স্বাধীন করেছি? আনন্দবাজার ‘দেশ’ পত্রিকার ২১ ফেব্রুয়ারি (১৯৯৮) সংখ্যায় বদরুদ্দীন উমরের রচনা নিয়ে যা করল, এসব বদমাইশি আর আমরা হতে দেব না। আপনি তো দীর্ঘদিন ধরে কোলকাতায় একুশে ফেব্রুয়ারি বিষয়ে কাজ করছেন। আর আনন্দবাজার আজকে একুশে ফেব্রুয়ারি বিষয়ে সংখ্যা বের করেছে স্রেফ বাংলাদেশে তাদের মার্কেট রাখার উদ্দেশ্যে।
প্রশ্ন: দিন কয়েক আগেই স্বাধীন বাংলা পত্রিকার জন্যে বদরুদ্দীন উমরের একটি সাক্ষাতকার আমি গ্রহণ করেছি। সেই সাক্ষাতকারে বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বিকৃতি প্রসঙ্গে আমার প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানিয়েছেন যে, এ বিষয়ে দেশ পত্রিকায়(২১ফেব্রুয়ারি ’৯৮ সংখ্যায়) তার (বদরুদ্দীন উমর) একটি লেখা প্রকাশের জন্যে বাংলাদেশ সরকার দেশ পত্রিকার ওই সংখ্যাটি এখানে(বাংলাদেশে) নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। বদরুদ্দীন ওমর আনন্দবাজারের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ কিন্তু জানান নি। বরং আমাকে কোলকাতা গিয়ে তার লেখাটি পড়তে বলতেন। বাংলাদেশ সরকার যদি ‘দেশ’ পত্রিকার কোন সংখ্যা এখানে আসতে না দেয়, তা হলে আনন্দবাজারের কী করার থাকতে পারে? এবং এখানে তাদের ‘বদমাইশিটাই বা কোথায়?
আহমদ ছফা: হ্যা, এ পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু তারপর আরও কিছু ঘটনা ঘটেছে, কিংবা সব ঘটনাটি জেনেছি। ব্যাপারটা হচ্ছে-‘দেশ’ পত্রিকা একুশে ফেব্রুয়ারি সংখ্যার জন্যে ভাষা আন্দোলনের গবেষক লেখক বদরুদ্দীন উমরের কাছে একটি লেখা চাইলে, উমর তাদের জানান যে, তিনি আনন্দবাজার পত্রিকার ঘরানার লেখক নন। এরপর আনন্দবাজার পত্রিকার পক্ষ থেকে বদরুদ্দীন উমরকে জানানো হয় যে, ভাষা আন্দোলনের উপর তিনি যা লিখবেন তাই দেশ পত্রিকায় ছাপা হবে। এবং দেশ পত্রিকায় উমরের ওই লেখাটি ছাপা হলে দেশ পত্রিকার ওই সংখ্যার চালান বর্ডারে আটকে দেয়া হয়। এতে দেশ পত্রিকার সম্পাদক উমরের লেখাটি প্রকাশ করার জন্যে কোলকাতার বাংলাদেশ ডেপুটি হাই কমিশন মারফত বাংলাদেশ সরকারের কাছে দুঃপ্রকাশ করে ক্ষমা চায় এবং উমরের লেখাটি পত্রিকা থেকে বাদ দিয়ে শওকত আলীর একটা লেখা যোগ করে দেয় পত্রিকার ওই সংখ্যাটি বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। শওকত আলীর লেখাটিও ২১ফেব্রুয়ারি সংখ্যার জন্যে দেশ পত্রিকার পক্ষ থেকে লেখকের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। কিন্তু দেশ পত্রিকার মূল সংখ্যায় শওকত আলীর লেখাটা ছিল না। পরে যখন তারা (দেশ পত্রিকা) বদরুদ্দীন উমরের লেখাটি পত্রিকা থেকে বাদ দেন তখন সেই শূন্যস্থান তারা পূরণ করেন শওকত আলীর লেখাটি দিয়ে। এই মিথ্যাচার এবং কপটতা আনন্দবাজারের পক্ষে সম্ভব। লেখা চেয়ে নিয়ে লেখা ছাপার পর তা পত্রিকা থেকে বাদ দেয়া এবং লেখাটি আনন্দবাজার ভুল করে ছেপেছে বলে কোলকাতার ডেপুটি হাইকমিশনারের কাছে ক্ষমা চাওয়া এবং অন্য লেখা যোগ করে তা (দেশ পত্রিকা) এখানে পাঠানো এসব করতে গিয়ে আনন্দবাজার একবারও বদরুদ্দীন কিংবা শওকত আলীকে কিছু জানাবার প্রয়োজন অনুভব করেনি। আপনি বলুন এসব বদমাইশি ছাড়া আর কি?
আমাদের ইতিহাস আমরা লিখবো না, লিখবে আনন্দবাজার। এত রক্তের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা, তার একটা দাম আছে। একবার নীরদ চৌধুরী তথাকথিত বাংলাদেশ লেখার কারণে দেশ পত্রিকা এখানে বন্ধ হয়ে যায়। এত সাপ্তাহিক দেশ পাক্ষিকে পরিণত হয়। এখন যদি ‘দেশ’ আমরা বাংলাদেশে ঢুকতে না দেই তবে তা মাসিক হবে। সেটা আমরা এখনই করতে চাই না, কারণ পশ্চিম বাংলার বাংলা ভাষাটা টিকিয়ে রেখেছেন লেখকরা। আর কোন ক্ষেত্রেই বাংলা ভাষার চর্চা নেই। বাংলা ভাষার ওপর ওখানে(পশ্চিম বাংলায়) যে আক্রমণটা চলছে সেই সময় আমরা যদি পশ্চিম বাংলার বই আমদানি করা বন্ধ করে দেই, তবে তার সুযোগ নেবে এখানকার মৌলবাদীরা, এবং ওখানকার বাংলা ভাষার চর্চা চরম বিপদে পড়বে। দীঘদিন ধরে পশ্চিম বাংলার রাজনীতি এবং অর্থনীতি বাংলা ভাষার অনুকূলে নয়। পশ্চিম বাংলার অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করে মাড়ওয়ারী এবং গুজরাটিরা। আর রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ হয় দিল্লি থেকে। এমনকি বামফ্রন্ট সরকারকে সবার আগে প্রাধান্য দিতে হয় হিন্দি বলয়ের স্বার্থকেই। এই হিন্দি বলয়ই ভারতবর্ষকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই হিন্দি বলয়ই ভারতবর্ষকে নিয়ন্ত্রণ করে। এত প্রতিকূলতার মধ্যেও যে বাংলা ভাষা পশ্চিম বাংলায় টিকে আছে তার কারণ সেখানকার লেখকরা এখনো বাংলা ভাষায় লিখছেন। বাংলা ভাষার প্রতি প্রেমের কারণেই আমরা পশ্চিম বাংলার এই আমদানি বন্ধ করছি না। এমনকি আমরা চাই না ‘দেশ’ পত্রিকার মত একটি কাগজ বন্ধ হয়ে যাক। পশ্চিম বাংলার প্রতি আমাদের এই অনুভবটা আপনি পৌঁছে দিবেন। বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার পর বাংলাদেশে তিন জন মানুষ মারা গেছেন। আর মমতা বন্দোপাধ্যায় এখানকার ‘ভোরের কাগজ’ পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎকারে বলেছে, কোলকাতা শহরতলীতেই মারা গেছেন একশজন। মমতা বন্দোপাধ্যায়ের একশ জনকে আমরা পঞ্চাশ ধরতে পারি। এই তিনজন মানুষের মৃত্যুকে নিয়ে পৃথিবীব্যাপী আনন্দবাজার যে কাণ্ডটা করল এটা কোন দরিদ্র প্রতিবেশীর প্রতি কোন ভদ্রোলোক করে না। মনে বিষ না থাকলে এটা সম্ভব নয়।
প্রশ্ন: যদি বলা হয় প্রতিযোগিতায় না পারার কারণে এই ক্ষোভ?
আহমদ ছফা: হ্যা, একথা বলতে পারেন। তবে আমি রেপড হচ্ছি আপনি ভাববেন না আমি মজা পাচ্ছি। আনন্দবাজারের একটা সাকসেসফুল ব্যাপার আছে। পশ্চিম বাংলার বাঙালির টাকা নেই। কিন্তু আনন্দবাজার টাকা করেছে। সাহিত্যটাকে তারা ব্যবসায়ের পণ্যে পরিণত করেছে এবং সমস্ত লেখককে তারা পূজা সংখ্যার লেখক-এ পরিণত করেছে। তারা তাদের পচাত্তর বছরের ঐতিহ্য দিয়ে বাংলাদেশের গ্রোয়িং প্রসেসে হস্তক্ষেপ করেছে। একজন সাধারণ লেখককে পুরস্কার দিয়ে তুলে ধরে, অন্যদিকে একজন সত্যিকার ভাল লেখককে অপমান করে। যেমন তারা তসলিমা নাসরিনকে পুরস্কার দিয়ে দুই কোটি টাকা আয় করেছে। আপনি যদি চান আমি হিশাব দেব। এখানে তারা পাচটি আনন্দ পুরস্কার দিয়েছে। এর মধ্যদিয়ে ভারতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসনের হস্ত এখানে প্রসারিত হচ্ছে। হিন্দির এত বড় এজেন্ট হচ্ছে আনন্দবাজার। আমি এইভাবে ব্যাখ্যা করবো। জানি না আপনারা পশ্চিম বাংলার লোকেরা কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন। নানাভাবে ভারত ফাদ পেতে রাখছে। সেই ফাদে আমাদের পড়ার অপেক্ষা। আমরা যদি ভারত বর্ষের ফাদে পড়ি, পশ্চিম বাংলার লোকদের কর্তব্য হবে- আমাদের স্বাধীন অবস্থানকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করা। না হলে পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের অবস্থাও গয়া হবে। পশ্চিম বাংলার আপনারা বাঙালির ভাষা সংস্কৃতি ও স্বাধীন অস্তিত্ব রক্ষা করার চেষ্টা করছেন, তবে তার পিছনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার অস্তিত্ব একটি প্রেরণা হিশেবে কাজ করছে। একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র হিশেবে বাংলাদেশ তার নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াক, রাজনৈতিক স্বার্থেই দিল্লির শাসকরা এবং তাদের প্রধান এজেন্ট আনন্দবাজার তা চায় না।
প্রশ্ন: বিষয়টি যদি ব্যাখ্যা করে বলেন-
আহমদ ছফা: পাকিস্তান ভেঙে যদি পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা নিজেদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র তৈরি করতে পারেন তবে বহুজাতিক ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতিগুলোই বা তা পারবেন না কেন? এবং কোন অধিকারে দিল্লি তামিল, তেলেগু, মালায়ালাম, ওড়িয়া, অসমিয়া, বাঙালি, কাশ্মীরী, নাগা ইত্যাদী জাতিগুলোর ওপর রাজনৈতিক শাসন, অর্থনৈতিক শোষণ এবং তাদের নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতির ওপর হিন্দির স্টিমরোলার চালাবে? আনন্দবাজার শুধু বাংলাদেশের নয়, পশ্চিম বাংলার বাঙালিদেরও শত্রু এবং বাঙালির জাতিগত অস্তিত্বের প্রয়োজনে শুধু দিল্লি বা হিন্দির বিরুদ্ধে নয়, আনন্দবাজারের বিরুদ্ধে একদিন আপনাদের (পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের) দাঁড়াতে হবে। ফারাক্কা তৈরি করেছিল বাংলাদেশের ক্ষতি করার জন্যে। কিন্তু ফারাক্কার কারণে পশ্চিম বাংলার কম ক্ষতি হয় নি। ভারতের পানি অবরোধের বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানি যখন ফারাক্কা অভিযান(১৯৭৬) করেছিলেন, আপনি লক্ষ্য করে দেখবেন, আনন্দবাজার কি কুৎসিত এডিটোরিয়াল লিখেছেন। এখন আবার দেখবেন, কিভাবে তারা ভাষা পাল্টালেন। বাংলাদেশের রস পায় বলে পশ্চিম বাংলায় আনন্দবাজার দাঁড়িয়ে আছে। আনন্দবাজারকে কিভাবে টোন ডাউন করতে হয় আমরা জানি। এমনিতে আনন্দবাজার যথেষ্ট ভাল বই ছাপে, দেশ পত্রিকা একটি সুসম্পাদিত পত্রিকা। কিন্তু একটি পত্রিকা একটি জাতির সুসাহিত্যকে সম্পূর্ণ কুক্ষিগত করে রাখে, এটা পৃথিবীর অন্য কোথাও আপনি পাবেন না।
প্রশ্ন: নিজস্ব কোন সাহিত্য ধারা আপনারা কি তৈরি করেছেন?
আহমদ ছফা: এখনো পারিনি। কিন্তু আমরা বসে থাকব, এটা ভাবাও ঠিক নয়।
প্রশ্ন: পশ্চিম বাংলার পাঠকদের সম্পর্কে-
আহমদ ছফা: পশ্চিম বাংলার পাঠকরা এত ভাল। সেখানে গলির মোড়ে মোড়ে বিদগ্ধ লোক পাওয়া যায়। দেশ পত্রিকাতে যে সমস্ত পাঠক চিঠি লেখেন, চিঠিগুলো যেভাবে গুছিয়ে লেখেন, পৃথিবীর কম দেশেই এমন গুছিয়ে লেখেন। অন্য পাঁচটা দেশের সাহিত্য এবং পত্রিকা পড়েই একথা বলছি । পশ্চিম বাংলায় ভাল মানুষের সংখ্যা কম নয়, অনেক Unfortunately তারা অসহায়। অর্থনৈতিকভাবে তারা অসহায় এবং সংস্কৃতিতে যে দুর্বৃত্তায়ন চলছে, তারও অসহায় শিকার তারা।
প্রশ্ন: ঊনবিংশ শতাব্দীতে কলকাতা বা বাংলা নবজাগরণ বিষয়ে-
আহমদ ছফা: হ্যা, ঊনবিংশ শতাব্দীর কোলকাতা আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে। তার রেজাল্ট আমরা সবাই কমবেশি ভোগ করেছি। বাংলা ভাষার বিকাশ হয়েছে, আধুনিক সাহিত্য, আধুনিক সংস্কৃতি, আধুনিক বিজ্ঞান, আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তা এসব আমরা পেয়েছি ঊনবিংশ শতাব্দীর কোলকাতা থেকে। তবে একে রেনেসাস বলা ঠিক নয়। তবে এর মধ্যে রেনেসাসের অঙ্কুর ছিল। পরবর্তীকালে যা হয়েছে, তা হল রিভাইভিলিজম। বঙ্কিম, ভুদেব থেকে এমনকি রামমোহন রায় হিন্দু রিভাইভলিজাম থেকে মুক্ত নন। আমি জানি না, পশ্চিম বাংলার বিদগ্ধ সমাজ আমার কথা গুলোকে কিভাবে নেবেন। আমি মুসলিম সমাজের দিকে তাকিয়েই কথাগুলো বলছি। যেমন বিদ্যাসাগর তার জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করেছেন বিধবা বিবাহ, সমাজ সংস্কারমূলক আন্দোলনে। সাহিত্যের কাজে সময় দিয়েছেন অত্যন্ত কম। একথা রামমোহন রায় এবং তার সহমরণ নিবারণ সম্পর্কেও। এসব মুসলমান সমাজের সমস্যা ছিল না। শুধু মুসলিম নয়, নিম্মবর্গের হিন্দুদেরও সমস্যা ছিল না। এটাকে কেউ সখ করে জাগরণ বললে বলতে পারেন। কিন্তু এটা ছিল অত্যন্ত স্মল গ্রুপের জাগরণ। তার বাইরের এর কোন প্রভাব ছিল না এবং জাগরণ তারা এমনভাবে ঘটিয়েছিলেন যাতে অন্যরা অবহেলিত এবং লাঞ্ছিত থাকেন।
প্রশ্ন: ঊনবিংশ শতাব্দির বিতর্কিত চরিত্র বঙ্কিম, তার সাহিত্য প্রতিভা এবং রাষ্ট্র চিন্তা সম্পর্কে-
আহমদ ছফা: বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কে বাংলার মুসলমান লেখকরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেছেন। বঙ্কিমকে সমর্থন করেন এমন লোক বাংলাদেশে অল্প নয়। কিন্তু সাহিত্যিক বঙ্কিমকে দেখেন। আমি বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কে যে বইটি (শতবর্ষের ফেরারী) লিখেছি তাতে নতুন কথা কিছু লিখিনি। সুশোভন সরকারের ছেলে সুমিত সরকার ইংরেজী ভাষায় বঙ্কিম ও হিন্দুত্ব বিষয়ে দীর্ঘ প্রবন্ধের বই লিখেছেন। লেখক হিশেবে বঙ্কিম নবযুগের উদগাতা। তিনি মানবিক এবং সেকুলার চিন্তার ধারক-বাহক। কিন্তু বঙ্কিম যখন রাষ্ট্র চিন্তা করেন, তখন হিন্দু রাষ্ট্র চান। গিরিলাল জৈন্য ফেনামেনন বলে একটা বই লিখেছেন। এই বইটিকে বিজিপির বাইবেল বলা হয়। এই বইটিতে তিনি বঙ্কিমকে কিভাবে দেখেছেন। আজকে বিজেপির কোন ফোরাম থেকে রবীন্দ্রনাথের নাম উচ্চারিত হয় না, রবীন্দ্রনাথ তাদের কোন কাজে আসবে না। স্বয়ং নীরদ চৌধুরী বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ খ্রীস্টান চিন্তা-চেতনা প্রচার করেছেন। আমি বুঝতে পারি না, পশ্চিম বাংলার লোক বঙ্কিমের প্রতি অন্ধ অনুরাগ কেন রাখবেন। তারা তো অনেক বেশি মুক্তচিন্তা করতে অভ্যস্ত। কিন্তু বঙ্কিমের প্রশ্নে তারা ঢোক গেলেন কেন?
প্রশ্ন: পশ্চিম বাংলার সাহিত্য চর্চায় আপনি কি সাম্প্রদায়িকতার কোন আভাস পান?
আহমদ ছফা: না, এ বিষয়ে আমি কিছু বলবো না।
প্রশ্ন: বিদ্বেষহীন সুস্থ সম্পর্কের জন্যেই প্রয়োজন খোলামেলা মত প্রকাশ-
আহমদ ছফা: এটা অব্শ্য ভাবার বিষয়। হ্যা, কিছু পাইতো বটেই। যেমন পশ্চিম বাংলার এক জনপ্রিয় সাহিত্যিক যিনি বাংলাদেশেও জনপ্রিয় তার একটি উপন্যাসে লিখেছেন, মুসলমানরা কোরআন পড়েন উর্দু ভাষায়।
প্রশ্ন: কেউ যদি সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা সিরিজের জটায়ুর মত লেখেন যে উট তার পাকস্থলিতে জল বোঝাই করে মরুভূমির পথে হেটে চলছে…এটা অজ্ঞতা ছাড়া আর কি? এ ক্ষেত্রেও সাম্প্রদায়িকতা নয়, অজ্ঞতা বলাই কি যুক্তিসঙ্গত নয়?
আহমদ ছফা: হ্যা, তা বলতে পারেন। কিন্তু এত অজ্ঞ হওয়ার তো কথা নয়। আর এত অজ্ঞ হলে উপন্যাস লিখতে এসেছো কেন? এমন-কী ‘প্রেম নেই’ বলে যে উপন্যাসটার তারিফ করা হয়, তাও লেখা হয়েছে মুসলিম লীগের স্ট্যান্ডটাকে ভেরিফাই করার জন্যে। কংগ্রেসের ভূমিকা সম্পর্কে কোন কিছুই বলা হয় নি। যে প্রেক্ষিতটা ওখানে (পশ্চিম বাংলায়) রয়েছে, আমার বিবেচনায় তা দূষিত। অনেকেই লিখবার আগে ধরে নেয় জিন্নাহ একজন ক্রিমিনাল। পশ্চিম বাংলায় প্রচুর সুস্থ লোক রয়েছে, অসাম্প্রদায়িক লেখক আছেন যথেষ্ট কিন্তু এনটায়ার প্রেক্ষিতটাকে কেউ চ্যালেঞ্জ করছেন না।
প্রশ্ন: পশ্চিম বাংলা বা কোলকাতা সম্পর্কে আপনার এই সমালোচনা কি যুক্তিবাদী মননশীল জায়গা থেকে না কোনও ধর্মীয় অনুভূতি থেকে-
আহমদ ছফা: বাইরের লোক যখন দেখেবেন, আমি যখন সাফারার, অন্য লোক এর মধ্যে ধর্মীয় সত্তা খুজে পাবেন। কিন্তু আসল ব্যাপারটা আমার জীবনে। আমি আমার গ্রামে থাকতে পারি না, মোল্লারা আমাকে পিটিয়ে মেরে ফেলবে। কারণ আমি ইসলামের কিছুই করি না, বিশ্বাসও করি না। আমার জীবনের মধ্যে কাজ করে হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, উপজাতি। মুসলমান সমাজকে সকলে কনডেম করেন। বাংলা সাহিত্যের ষাটভাগ সাহিত্য সাম্প্রদায়িক সাহিত্য। সুতরাং আমার জনগোষ্ঠীর ওপর যে সাংস্কৃতিক অত্যাচারগুলো হয়েছে, আমি সেটাকে যদি ডিফেন্ড করি অনেকে সাম্প্রদায়িক মনে করতে পারেন। কিন্তু আমার মনে হয় না পশ্চিম বাংলার মানুষ আমাকে ভুল বুঝবেন। আমি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং যুক্তিসঙ্গত একটা জিনিসকে তুলে ধরছি। আপনি যদি এখানকার (বাংলাদেশের)হিন্দুদের সাথে কথা বলেন, দেখবেন তারা শামসুর রাহমান বা অন্যান্যদের থেকে আমাকে বন্ধু হিশেবে বেশি পছন্দ করবেন, যদি মাঝখানে ভারতের প্রসঙ্গটা না আসে। আমাদের দেশে যদি একজনও হিন্দু না থাকে তবে সাম্প্রদায়িক মোল্লাদের নিয়ে আমি বাচতে পারবো না।
প্রশ্ন: স্বাধীন মত প্রকাশের ক্ষেত্রে ধর্মীয় বা মৌলবাদী বাধা কি এখানে আছে?
আহমদ ছফা: না, সেরকম আমি কিছু মনে করি না।
প্রশ্ন: স্বাধীন চিন্তা প্রকাশ করার অধিকার এখানে আছে?
আহমদ ছফা: এটা একটা কথা, আমি যেমন ইসলামের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারি না, শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারি না, জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারি না। ধর্মীয় বা মৌলবাদের প্রভাব নয়, এটা একটা অবিকশিত সমাজের লক্ষণ। আরো দেখবেন মৌলবাদের যে উপাদান সেটা বাংলাদেশের সোসাইটিতে নেই। বাংলাদেশে পাঁচজন লোক খুঁজে পাবেন না, যে আরবি জানেন। পাঁচজন লোক পাবেন না, যে সংস্কৃত জানেন। কিন্তু আপনাদের দেশে তা ভুরিভুরি পাবেন। মৌলবাদ প্রথম জন্মায় ধর্মগ্রন্থ থেকে। বাংলাদেশে তার কোন অবস্থান নেই। এখানে যা আছে তা মধ্যযুগীয়তা। মধ্যযুগীয়তা আর মৌলবাদকে এক করে দেখা ঠিক হবে না। ভারতবর্ষে মৌলবাদ জন্মাচ্ছে সরাসরি ধর্মগ্রন্থ থেকে। যেমন, রাম মন্দির, রাম মন্দির ছিল কিনা ঐতিহাসিকরা কোন কথা বলতে পারছেন না। সুনীতি চট্টোপাধ্যায় হিন্দু মহাসভার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি বলেছেন, রাম উপন্যাসের নায়ক। এর পর সাম্প্রদায়িক হিন্দুরা তার পুত্রকে হত্যা করার হুমকি দিল। সুকুমার সেন বলেছেন, রাম শব্দের অর্থ হলো পূর্ণতা। এটি এসেছে ইরান থেকে এবং ‘রামরাজ্য’ শব্দটি গান্ধীজী নিয়েছিলেন টলস্টয়ের Kingdom of God এর ভারতীয় শব্দ হিশেবে। কিন্তু এই শব্দগুলোকে ধর্মীয় অভিধায় যুক্ত করে রাজনীতিতে এটা প্রধান শক্তি হওয়া, সে জিনিস বাংলাদেশে নেই।
প্রশ্ন: রাম শব্দের যে প্রভাব উত্তর ভারতে বা হিন্দি বলয়ে আছে বাংলায় তা নেই। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’-এ রামকে এক ক্লীব চরিত্র বা ভিখিরি হিশেবে উপস্থিত করেছেন। এই জন্যে তিনি কারো দ্বারা আক্রান্ত হন নি-
আহমদ ছফা: মাইকেল মধুসূদন দত্তর বই একশ কপির বেশি ছাপা হত না। বঙ্কিমের বই দু’শ আড়াই’শ কপির বেশি ছাপা হত না। একটা বই নিয়ে আজকে যে জনমত তৈরি হয় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হয়, সে যুগে এটা কল্পনা করা যেত না। মাইকেলের আর একটা সুবিধে ছিল তখন শাসকরা ছিলেন ইংরেজ এবং মাইকেল নিজে খ্রীস্টান হয়ে গিয়েছিলেন। খ্রিস্টানরা তখন রাজার আনকূল্য পেতেন। মাইকেলের পক্ষে মেঘনাদ বধ লেখা সম্ভব হয়েছিল দুটো কারণে। প্রথমত তিনি হিন্দু পরিমণ্ডলের বাইরে মাদ্রাজ চলে গিয়েছিলেন। মাদ্রাজ গিয়ে তিনি মহারাষ্ট্র পুরান পড়েছিলেন। আর তামিলরা রামকে নয়, রাবনকেই পূজা করেন। এসব মাইকেলকে প্রভাবিত করে। কিন্তু মাইকেল মধুসূদন যখন রাজিয়াকে নিয়ে নাটক লিখতে গেলেন, তার বন্ধুরা বাধা দিলেন। তিনি যখন কারবালাকে নিয়ে ট্রাজেডি লিখতে চাইলেন, তার বন্ধুরা বাধা দিলেন। কাজেই মাইকেল মধুসূদন দত্তকে আমরা যেভাবে চিন্তা করি, তিনি তার অবস্থার কাছে অনেক বেশি নতি স্বীকার করেছেন।
প্রশ্ন: পরবর্তী পর্যায়েও কিন্তু বাংলার পাঠকরা মাইকেল মধুসূদন দত্তকে বর্জন করেন নি…
আহমদ ছফা: তা করেন নি। কিন্তু এখনো একটা বিতর্ক থেকে গেছে, মাইকেল মধুসূদন দত্ত না শ্রী মধুসূদন। আমি বাংলা সাহিত্যের ছাত্র। মোহিতলাল থেকে প্রমথনাথ বিশী, কত বই লেখা হয়েছে। এখনো লেখা হচ্ছে, এমনকি ক্ষেত্র গুপ্তর সাম্প্রতিক বই। এসব আপনাদের নির্ণয় করতে হবে। আর আমি মনে করি মাইকেল মধুসূদন দত্ত হচ্ছেন বাংলা সাহিত্যের একমাত্র অসাম্প্রদায়িক লেখক।
অন্যদিকে দেখুন বিসর্জন লেখার পর কালীমন্দিরে রবীন্দ্রনাথের নাম উচ্চারিত হয় না। রাজর্ষি লেখার পর রামকৃষ্ণ মিশনে রবীন্দ্রনাথের কোনও কিচ্ছু উচ্চারিত হয় না।
প্রশ্ন: যুক্তিবাদী সহনশীল সমাজ গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে….
আহমদ ছফা: (উত্তেজিতভাবে) যুক্তিবাদী, সহনশীল, মুক্তবুদ্ধি এগুলি খুব খারাপ শব্দ। পরিবেশ বিশেষে এসব হয়ে যান অনেকে। আসল কথাটি হল জনগণকে তার সংস্কৃতি নির্মাণে কোনও সুযোগ দেওয়া হয় নি।
প্রশ্ন: লালন বা হাছন রাজার গান কী এ ক্ষেত্রে--
আহমদ ছফা: সাহিত্যবিলাসী লোকেরা এসব খুব বলাবলি করে। লালনেরও আগে চণ্ডীদাস বলেছেন, ‘শুনহ মানুষ ভাই, সবার ওপর মানুষ সত্য তাহার ওপরে নাই’। হিন্দু সমাজের মানুষ অবশ্য এজন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেন নাই। বাঙালি জাতিসত্তা হিশেবে লালনকে আমরা চিন্তায় লালন করি, কারণ গৌতম বুদ্ধের যে চিন্তা, তা কবীরের কাছে বাহিত হয়ে লালন তা ধারন করেছেন। লালনের গানগুলোর মধ্যে গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা ও চিন্তা এখনো বেচে আছে। অবচেতনে তা আমাদের মধ্যে ভয়ঙ্করভাবে নাড়া দেয়। রবীন্দ্রনাথও সেখানে একবার প্রণত হয়েছে। আর একটা জিনিস, লালনের গানের মধ্যে কবীরের দোহার হুবহু অনুপ্রাণিত গান আছে কয়েকশত। বুদ্ধ দেবের শিষ্যরা বুদ্ধ দেবের শিক্ষাটাকে নানা ছদ্মবেশে বাচিয়ে রেখেছেন। এটা আমাদের খুবই প্রয়োজনীয় ঐতিহ্য। তবে এসব কখনোই সমাজের চালিকা শক্তি হয় নি। থেকে গেছে Sub culture এর স্তরে।
প্রশ্ন: ‘শিক্ষা’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে দুইয়ের দশকের ঢাকায় মুক্তবুদ্ধির যে আন্দোলন হয়েছিল--
আহমদ ছফা: মুক্তবুদ্ধির চর্চা বলে যাকে গৌরবান্বিত করা হচ্ছে, তাকে মুক্তবুদ্ধির চর্চা বলে আমি বিশ্বাস করি না। বিশ্বাস করি না এই কারণে যে, এদের মধ্যে একজন ছিলেন real serious লোক। He died quite earlier। আবুল হুসেন ছাড়া আর যারা ছিলেন, পরবর্তী পর্যায়ে তারা কী কাজ করেছেন? নজরুল একা যে কাজ করেছেন, এরা সকলে মিলে কী কাজ করেছেন? যেমন আবদুল ওদুদ, এর লক্ষ্য ছিল মুসলিম ব্রাক্ষ্ম হওয়া। হুমায়ুন কবীরের রচনার মধ্যে যে যুক্তিবাদিতা, তার মধ্যে আমি বড় কিছুই খুঁজে পাই নি। বেগম রোকেয়া এর থেকে অনেক বড় কাজ করেছেন। আব্দুল ওদুদ-রা কী মুক্তবুদ্ধি করবেন! আবুল ফজল মুক্তবুদ্ধির একজন লোক, যিনি জিয়াউর রহমানের মন্ত্রী হয়েছিলেন। কাজেই এগুলো যেভাবে প্রচার করা হচ্ছে, তার সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই আমার মনের মিল নেই। আবার এ আন্দোলনটার মধ্যে একেবারেই কিছু ছিল না, তাও ঠিক নয়। অশিক্ষা ও সাম্প্রদায়িকতায় আকীর্ণ বাঙালি মুসলমান সমাজের কিছু তরুণের মধ্যে প্রথম একটা হাওয়া লেগেছে, স্পন্দন লেগেছে, আলো পড়েছে। কিন্তু ঐ চর্চা স্থায়ীত্ব পায় নি, সমাজে তারা প্রভাবও পড়ে নি।
প্রশ্ন: বাঙালি জাতির সার্বিক বিকাশের ক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলোকে অন্তরায় মনে করেন--
আহমদ ছফা: হ্যা, একটি বাধা আছে। বাঙালি যখন সর্বভারতের দায়টা কাধে নেন, সর্বভারতীয় চিন্তা চেতনায় আচ্ছন্ন হন, তখন তার জাতীয়তার ভাগে শূন্যতা উপস্থিত হয়। বাংলা হচ্ছে ভারতীয় রাজনীতিতে under Drain, দিয়েছে বেশি পেয়েছে বঞ্চনা। বাংলাতেই প্রথম ব্যাংক, শিপিং কোম্পানি, ইন্সুরেন্স কোম্পানির ব্যবসা শুরু হয়েছিল। বাংলাতে প্রথম বুর্জোয়া অর্থনীতি বিকাশের সুত্রপাত ঘটেছিল। বাঙালিরা সেসব কিছুই ধরে রাখতে পারে নি। কর্নওয়ালিস বাঙালিকে নকল ভূস্বামী বানিয়ে দিল। তখন বাঙালির ব্যবসা বাণিজ্য সব চলে গেল। এবং বাঙালি একদিকে হল বাবু অন্যদিকে কেরানি। তারপর সবক্ষেত্রে বাঙালি দিয়েছে অনেক, পেয়েছে কম। দেশ ভাগের সময় আবুল হাশিম একটা চমৎকার কথা বলেছিলেন, পশ্চিম বাংলার হিন্দুদের হলটা কী? ১৯০৫ সালে যারা মাতৃঅঙ্গ ব্যবচ্ছেদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন, অবাঙালির অর্থে, অবাঙালির চিন্তা ও মতামতের বাহক হয়ে, তারাই আজকে বাংলাকে ভাগ করছেন। যে জাতি জন্ম দিয়েছে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, প্রফুল্ল চন্দ্র, সুভাষ বসুর মতো মানুষদের, তারাই আজকে বাংলার বাইরের চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বাংলাকে ভাগ করছেন। এদের আজকে কী হল! What happened to the Bengali Hindus?
এক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটা বড় কাজ করছে। এখানে সাম্প্রদায়িকতা থাকুক, না থাকুক, মুক্তচিন্তার অবকাশ থাকুক, না থাকুক, অন্যন্য মুসলিম অঞ্চল থেকে বাংলাদেশ নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের বাঙালিকে বাঙালি পরিচয়েই বাচতে হবে সে আরবীয় হতে পারবে না, সে চাইনিজ হতে পারবে না। মাঝে মাঝে এদিক ওদিক হয়তো যাবে, কিন্তু বাঙালি পরিচয়েই আমাদের বাচতে হবে। অন্যদিকে পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের শেকড়টা কোথায়, কিংবা তাদের জাতি পরিচয়ের চেতটনাটা কতটুকু স্পষ্ট আছে। এ বিষয়ে আমাদের ঘোর সংশয় আছে। ভারতীয় পরিচয়ের ভার বহন করতে গিয়ে পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের জাতি পরিচয়টা মুছে যাচ্ছে। এসব বুঝতে পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের একটু সময় লাগবে। দিল্লি-হিন্দির আধিপত্যের গুণগান কোলকাতার শিল্পী-সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবীদরা যত করে থাকেন, ভারতের অন্য কোন শহরে এ চিত্র আপনি পাবেন না। কারণ অন্য শহরের মানুষের নিজস্ব ভাষা সংস্কৃতির সঙ্গে যে শিকড়ের সম্পর্ক আছে কোলকাতায় তা নেই। তাই হিন্দির সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য কোলকাতাতেই বেশি মেনে নিচ্ছে। আবার কোলকাতার সাহিত্যিক বা রাজনৈতিক নেতারা ঢাকায় এলে, তাদের বাংলা ভাষা প্রেম আকাশ স্পর্শ করে। এই দ্বিচারিতা কোলকাতার মজ্জাগত। কারণ কোলকাতা শহরটা হচ্ছে কলোনাইজেশনের প্রথম ডিচ। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের গোড়াপত্তন হয় ঐ শহরে। সেই কারণে সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব কলকাতা শহরে যতোটা কাজ করে ভারতবর্ষের অন্য কোনও শহরে তা করে না। কোলকাতার লোক ভারত প্রেমিক, বিশ্বপ্রেমিক হতে পারেন, ভারতকে, বিশ্বকে বুকে মাথায় নিতে পারেন। কিন্তু বাংলার সমগ্র অন্তজ জনগোষ্ঠীকে নিয়ে বাংলা ও বাঙালির জন্যে কতটা কি করতে পারবেন, এ বিষয়ে আমার গভীর সংশয় আছে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের বাঙালির সামনে কোন বাধা?
আহমদ ছফা: Absolute নয়, একমাত্র ভারত যদি আমাদের কুজো করে না রাখে। কারণ আমাদের উন্মেষের মধ্য দিয়ে দুটো জিনিস প্রমাণিত হয়েছে। ভারত যখন ভাগ হয় জিন্নাহ বলেছিলেন, ভারতের হিন্দু মুসলমান দুই জাতি। গান্ধী, নেহরু বলেছিলেন ভারত এক জাতি। পাকিস্তান হয়ে গেল ঠেকানো গেল না। হিন্দু-মুসলমান দুই জাতি এই পরিচয়েই ভাল হল। এরপর বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হল তখন আর একটি ঐতিহাসিক সত্য উঠে এল। ভারত এক জাতি নয়। দ্বিজাতি নয়। ভারত বহুজাতি। একটু আগেই আপনি প্রশ্নটা করেছিলেন, পাকিস্তান হয়েছিল বলেই বাংলাদেশ হয়েছে ইত্যাদী। কথাটা সত্য আবার সত্য নয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হয়ত কথা সত্য, কিন্তু সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে কথাটা সত্য নয়। বহুজাতিক ভারত রাষ্ট্রের বিভিন্ন জাতিগুলোর জাতি পরিচয় এবং ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এক বড় প্রেরণা এবং দৃষ্টান্ত। নানা অপূর্ণতা এবং সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও রাষ্ট্র বিজ্ঞানের সংজ্ঞা হিশেবে বাংলাদেশের উত্থান ভারত উপমহাদেশের আধুনিক ইতিহাসে সবচাইতে অভিনব ঘটনা।
ভারতের জাতীয় কংগ্রেস এবং ‘সর্বভারতীয়’ দক্ষিণপন্থী দলগুলো মনে করে বাংলাদেশ হল দ্বিজাতি তত্ত্বের ভুল সংশোধন। কিন্তু এখানে একটা শুভঙ্করের ফাকি আছে। কারণ এটা শুধু দ্বিজাতি তত্ত্ব নয়, ভারতীয় এক জাতি তত্ত্বেরও ভুল সংশোধন। এই সত্যকে ভারতের বাম-দক্ষিণ কোনও ‘সর্বভারতীয়’ দলই স্বীকার করতে চায় না। কারণ এই সত্যকে স্বীকার করলে ‘ভারতীয় ঐক্য সংহতি’ রক্ষার নামে বহুজাতিক ভারতবর্ষের জাতিগুলোর ওপর দিল্লি-হিন্দির সাম্রাজ্যবাদী ঐক্যনীতি চালানো সম্ভব নয়।
প্রশ্ন: বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ছাব্বিশ বছর পরও এখানে যে রাজনৈতিক অস্থিরত, দারিদ্র, শোষণ, অশিক্ষা এবং জাতি পরিচয় নিয়ে যে বিতর্ক চলছে, তাতে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে উপমহাদেশের জাতিগুলোর সামনে যে দৃষ্টান্ত এবং প্রেরণা স্থাপিত হয়েছে, তা কি অনেকটাই ম্লান হয়ে যাচ্ছে না?
আহমদ ছফা: হ্যা, এটা খুব ঠিক কথা। প্রথমত এখানে বুর্জোয়া সমাজ গঠিত হয় নি বলে, বুর্জোয়া চিন্তার যে বিকাশ, তা এখানে হয় নি। বাঙালি বনাম বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ নিয়ে বিতর্ক চলছে। কারণ বাংলাদেশের নির্যাতিত জনগণ ইতিহাসের চালিকা শক্তি হতে পারি নি। বাঙালি বা বাংলাদেশী এই দুই রাজনৈতিক শিবিরে বাংলাদেশের মানুষ বিভক্ত হয়ে যায়। আসলে একটা আর একটার বিরোধী নয়। এই পলিটিক্যাল ক্যাটগরিগুলো কৃত্রিমভাবে তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের নির্যাতিত জনগণ ইতিহাসের চালিকাশক্তির ভার পায় নি। এই ভার যখন সে পাবে, শোষিত জনগণের হাতে যখন ক্ষমতা আসবে তখন এই কৃত্রিম ক্যাটগরিগুলো থাকবে না। অন্য ক্যাটগরি তৈরি হবে। সেদিন বাঙালি জনগোষ্ঠীর প্রকৃত রাষ্ট্র তৈরি হবে। প্রতিবেশি ভারতের বৃহৎ রাষ্ট্রশক্তি এটা কখনোই হতে দিতে চায় না। ভারত বাংলাদেশে একটি প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী রাষ্ট্রই পছন্দ করে। এখানে একটি প্রকৃত সেকুলার সরকারের পরিবর্তে একটি মৌলবাদী রাষ্ট্র সরকারকেই পছন্দ করে। কারণ তাতে ভারত রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক অবস্থানটা যেমন অটুট থাকে। অন্যদিকে ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্রের প্রেরণটাও এতে ভোতা হয়ে যায়। কাজেই এখানে সাম্প্রদায়িক না থাকলে ভারত তা সৃষ্টি করবে এবং তথাকথিত সেকুলারিজম-এর নামে তাদের যে কলোনিয়াল কালচার পকেট আছে, একটু আগে আনন্দবাজারের ভূমিকা সম্পর্কে যা বলেছি, এরাও এখানে সক্রিয়। বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে যে সন্ত্রাস এবং অস্থিরত তার পিছনে ‘র’- এর(R.A.W) ভূমিকা কম নয়।
এই সুত্রে আপনাকে বলি, পশ্চিম বাংলার জনগণের সহযোগিতা ছাড়া আমরা স্বাধীনতা পেতাম না। এত তাড়াতাড়ি পেতাম না। ইতিহাসের ঋণ শোধের একটা ব্যাপার আছে, পশ্চিম বাংলা যদি কোনও দিন স্বাধীনতার জন্যে আন্দোলন করে আমাদের কর্তব্য হবে আপনাদের আন্দোলন সাহায্য সহযোগিতা করা তবে পশ্চিম বাংলা একা পারবে না। ভারতবর্ষের সকল নিপীড়িত জাতিগুলো মুক্তির লক্ষ্যে আলাদা আলাদা ক্ষেত্রে লড়াই চালালেও সকলের মধ্যে একটা যোগাযোগ থাকা উচিত এবং আধুনিক রাষ্ট্রের যে সংজ্ঞা তা আজ অনেক পাল্টে যাচ্ছে। একসময় ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র হত। তারপর ভাষাভিত্তিক। এখন ইকোলজিক্যাল বা পরিবেশভিত্তিক রাষ্ট্রের ধারণাটা চলে আসছে, বেঙ্গল, আসাম, উড়িষ্যা এ সমস্ত অঞ্চল মিলে একটা আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণা অনেকেই উড়িয়ে দেননি।
প্রশ্ন: এনজিও’রা বাংলাদেশে একটা প্যারালাল গভর্নমেন্ট চালাচ্ছে। এমন অভিযোগ বাংলাদেশে প্রায়ই শোনা যায়। এই অভিযোগ সম্পর্কে এবং বাংলাদেশ এনজিওদের ভূমিকা বিষয়ে--
আহমদ ছফা: এনালিটিক্যালি জিনিসটা আমি দেখতে চাই। এনজিও ওরা শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারতেও বেশ বড় ভূমিকা পালন করে। যেমন ধরুন ভারতের নর্মদা বাচাও আন্দোলন, পরিবেশ আন্দোলন, নারী আন্দোলন এগুলো সবাই এনজিও সঙ্গে যুক্ত। বতর্মান পৃথিবীতে যে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তাতে যেখানে বিশ্বব্যাংক যাবে, সেখানে এনজিও যাবে। বিশ্ব ব্যাংককে যদি আপনি এয়ারফোর্স ভাবেন, তবে এনজিও-কে ভাবতে হবে ইনফেন্ট্রি হিশেবে। এরা হচ্ছে একে অপরের পরিপূরক। বাংলাদেশে এনজিওরা একটা প্যারালাল অবস্থান নিয়েছে। এবং সেটা আশঙ্কাজনক মনে করি। আমি নিজে একটি এনজিওর সঙ্গে ছিলাম। সিভিল লিবার্টির নামে তারা রাষ্ট্র ক্ষমতার একটা অংশ দাবি করছে। সেটা আতঙ্কের কারণ এবং প্রগতিশীল রাজনীতির প্রধানতম অন্তরায় এনজিওগুলো। এটাকে কিভাবে মোকাবেলা করা হবে, তার পলিসি, স্ট্রাটেজি, তার ফিলসফি এগুলো এখনো স্পষ্টভাবে বেরিয়ে আসি নি। বিশ্বব্যাংককে কেউ ঠেকাতে পারবে না। চীনেও এনজিও গেছে। পশ্চিম বাংলায়ও এনজিও কাজ করছে। কিন্তু পলিটিক্যাল কর্তৃত্বের ভিতরে রাখার জন্যে যে সংগঠিত চিন্তাভাবনা ও পদ্ধতি নির্মাণ প্রয়োজন তা এখনো দেখা যাচ্ছে না।
প্রথম দিকে ওনজিওরা যে কাজগুলো করেছে নারী জাগরণ গ্রামের জনগোষ্ঠীকে সংগঠিত করা, নতুন টেকনিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি নিয়ে কাজ করা-এসব হল ইতিবাচক দিক। আর নেতিবাচক দিক হলো এনজিওরা ম্যানুফ্যাকচারিং-এ চলে যাচ্ছে। যেমন অধ্যাপক ইউনুস, তিনি নিজে একজন শিল্পপতিও বটে। আমাদের রেজিস্টার্ড এনজিও আছে ঊনিশ হাজার। ঊনিশ হাজারের মধ্যে যেটাকে এ্যডাব বলা হয়, এনজিওদের শিক্ষিত প্রতিষ্ঠান তার সদস্য সংখ্যা আটাত্তর। কিন্তু মাত্র ছয়টি এনজিও কন্ট্রোল করে ৮২ শতাংশ রিসোর্স। এবং এই ছয়টি এনজিওই একটা প্যারালাল গভর্নমেন্ট তৈরি করছে। এরা ব্যবসা বাণিজ্য করছে কিন্তু কোন ট্যাক্স দেয় না। হিউম্যান রাইটসের কথা বলে, কিন্তু তাদের কর্মীরা কোন রাইট পায় না। এ ব্যাপারে আপনি আমাদের বন্ধু ফরহাদ মজহারকে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারবেন। বড় বড় এনজিওগুলোতে কর্মীদের ইউনিয়ন করার অধিকার নেই।
প্রশ্ন: ভারতীয় সংবিধানের কাঠামোর মধ্যে একুশ বছর ধরে পশ্চিম বাংলায় একটি বামপন্থী সরকার চলছে। বামপন্থীদের দ্বারা পরিচালিত পশ্চিমবঙ্গ সরকারটি সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন--
আহমদ ছফা: ১৯৭১ সালে আমি ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্য দরখাস্ত করেছিলাম। আমি কমরেড মোজাফফর আহমদের পিএ হিশেবে কাজ করতে চেয়েছিলাম, করেছিও। আমি নিজে মার্কবাদী ঘরানা থেকে তৈরি হয়েছিলাম। পশ্চিম বাংলার গ্রামীণ জীবন এবং অর্থনীতিতে বামফ্রন্ট কিছু কাজ করতে পেরেছে। এসব কোন বৈপ্লবিক কাজ নয়। সে ক্ষমতাও তাদের নেই। শহরে বামফ্রন্ট কিছুই করতে পারে নি। শহরগুলোতে যে capital accumulated হয়েছে সেগুলো সব অবাঙালীদের capital। বামফ্রন্ট সরকারকে এদের ওপর নির্ভর করে থাকতে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত পশ্চিম বাংলাতে চিন্তা চেতনার যে চর্চা, তাতে সিপিএম-এর মধ্যে এক ধরনের সংস্কৃতিহীনতা কাজ করে। রাজনীতিকভাবে (পশ্চিম বাংলায় ক্ষমতায় থাকার প্রশ্ন) যে সাফল্য তারা অর্জন করেছেন, চিন্তা চেতনা উজ্জীবনে তাদের অবদান খুবই দুর্বল। ফলে সৃষ্টি হয়েছে এক ধরনের শূন্যতা। চিন্তার ক্ষেত্রে নতুন কোন লোক সিপিএম-এ আসছে না। এর ফলে তৈরি হচ্ছে বিশাল বিশাল কৃষ্ণ গহ্বর। যার প্রথম আউট বাস্ট দেখলেন মমতা বন্দোপাধ্যয়ের আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে এবং শ্রীমতি বন্দোপাধ্যায় বিজিপেকে সঙ্গে নিয়ে লোকসভা নির্বাচনে বেশ কিছু সাফল্যও পেয়ে গেলেন। হয়ত এরকম আরো আউট বাস্ট দেখার জন্য আমাদের তৈরি থাকতে হবে। যে পশ্চিম বাংলাকে আমরা দেখতাম সেকিউলারিজমের একটা আদর্শ, আপনারা কতদিন সে আদর্শকে ধরে রাখতে পারবেন, এ বিষয়ে সন্দেহ জাগছে। হয়তো আর একটা নির্বাচনে বামফ্রন্ট বিজয়ী হবে। কিন্তু তারপর? বিশ বছর ক্ষমতায় থাকার ফলে তাদের মধ্যে যে ক্লান্তি, যে মন্থরতা, স্টেগনেন্সি তাকে কাটিয়ে তোলার জন্য সিপিএমএ বামফ্রন্ট কিছু করে উঠতে পারে নি। আর পশ্চিম বাংলার বাঙালির যে সার্বিক অবক্ষয়, তাও তো বাম শাসকরা আটকাতে পারেন নি। পশ্চিম বাংলায় হিন্দির যে চাপ এবং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির কোণঠাসা অবস্থা, সে সম্পর্কেই বা বামফ্রন্টের দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভুমিকা কী? আজকে হয়তো বামফ্রন্ট বা সিপিএমকে এসব প্রশ্নের মুখোমুখি সেভাবে হতে হচ্ছে না। কিন্তু আগামি দিনে বাঙালি জাতির অস্তিত্ত্বের প্রশ্নটা পশ্চিম বাংলার প্রধান রাজনৈতিক বিষয় হিশেবে উঠে আসবে, সেদিন কোন বক্তব্য নিয়ে সিপিএম বাঙালি জাতির সামনে দাঁড়াবে?
প্রশ্ন: বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বাংলাদেশের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক চরিত্রের কাঠামোগত পরিবতর্ন ঘটেছে। ইসলামকে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। গত একুশে ফেব্রুয়ারি(১৯৯৮) সকালে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের কাছে একটা ব্যানার চোখে পড়লো। যেখানে লেখা ছিল একুশের চেতনা রাষ্ট্রধর্ম মানে না। এ বিষয়ে-
আহমদ ছফা: আমি স্পষ্ট ভাষায় এ বিষয়ে লিখেছি। ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করে, ইসলামের কোন সহায়তা করা হয়নি। বিশেষ বিশেষ শ্রেণী এবং বিশেষ বিশেষ গ্রুপের স্বার্থেই এসব করা হয়েছে। এতে বাংলাদেশের কোন উপকার করা হয় নি। আর রাষ্ট্রের যে চারিত্রের কথা বললেন, শেখ মুজিব যে সংবিধান তৈরি করলেন তা তিনি নিজেই অমান্য করলেন। ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান তৈরি করে ইসলামি কনফারেন্সে তিনি নিজেই গেলেন। সংবিধান পাল্টে তিনি প্রেসিডেন্ট হলেন। শেখ মুজিব বেচে থাকতেন, তাহলেও এক সময় না এক সময় বাংলাদেশের সংবিধানের পরিবর্তনগুলো হয়েছে, তা তিনি নিজেই করতেন বলে আমার ধারণা। আজকে বাংলাদেশের যে পরিবর্তনগুলো এসেছে, সব পরিবর্তনগুলো কি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে নৈরাজ্যগুলো তৈরি হয়েছে, শেখ মুজিবের সময় থেকেই এর সূচনা। তিনি গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ করে একনায়কতন্ত্রের পথ ধরলেন। পরবর্তীকালে অন্যরা সেই প্রক্রিয়ার সুযোগ নিয়েছে। আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায়। রুচিশীল নাগরিক যারা আছেন, তারা সকলেই রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিরোধীতা করেছেন, প্রচণ্ড বিরোধীতা করেছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার রাষ্ট্রধর্মকে বাতিল করছে না।
প্রশ্ন: কয়েকদিন আগে চট্টগ্রাম শহরের রেল স্কুলের দেওয়ালে একটি দেওয়াল লিখন চোখে পড়ল। সেই দেওয়াল লিখনে একটি ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে –‘বাধ্যতামূলক ধর্মশিক্ষা বাতিল করা’--
আহমদ ছফা: ধর্মশিক্ষাকে আমি সমর্থন করি না। তবে ধর্মশিক্ষা বাতিল করার যে পদ্ধতিটা বলা হচ্ছে, সেই পদ্ধতির বিরুদ্ধে আমি কথা বলছি। সরকার বলছেন, মাদ্রাসা শিক্ষাগুলো চেঞ্জ করবেন। কিন্তু স্কুল কলেজে ছাত্র যত মাদ্রাসার ছাত্র সংখ্যা তার চেয়ে বেশি। তাদের ওপর জোর করে যদি কিছু চাপিয়ে দেওয়া হয়, তারা বিরোধীতা করবে। এবং এতে পরিবর্তনটা আটাকে যাবে। আমার বক্তব্য মাদ্রাসা শিক্ষার লোকাদের সঙ্গে বসো, কনভিন্স করো যুগের প্রয়োজন। অর্থাৎ যাদের জন্য পরিবর্তন করবেন তাদেরও যদি আপনি অংশীদার না করেন, তবে সেটা কার্যকর হবে না। সুতরাং যেভাবে কাজ করলে পরিবর্তনটা সম্ভব, সেই প্রক্রিয়াটা কেউ গ্রহণ করছেন না।
অক্সফোর্ড কেমব্রিজ একসময় মাদ্রাসা ছিল। সেখানে ধর্ম শিক্ষাই দেওয়া হত। যুগের প্রয়োজনে সেখানে কি পরিবর্তন হয় নি? এই মাদরাসাগুলোকে কারিগরি শিক্ষা এবং আরো আধুনিক শিক্ষার কেন্দ্র হিশেবে গড়ে তুলতে পারি। মাদ্রাসার লোকজনদের বুঝিয়ে নতুন যুগের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আসা, তাদেরকে মানসিকভাবে, নৈতিকভাবে তৈরি না করে, তাদের ওপর কতগুলো পরিবর্তন চাপিয়ে দিলে তা আর পরিবর্তন হবে না। শেখ মুজিব সমাজতন্ত্র করতে চেয়েছিলেন, হয়েছে কী? উল্টোটা হয়েছে। ধনতন্ত্র হয় নি, সমাজতন্ত্র হয় নি , পরে হয়েছে একটা লুটপাটতন্ত্র।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে নারী মুক্তি প্রসঙ্গে কারো কারো মন্তব্য ধর্মীয় অনুশাসনই নারী মুক্তির প্রধান বাধা--
আহমদ ছফা: ধর্ম তো এখানে আছেই। ধর্ম তো সবার ব্যাপারে কথা বলছে, তবুও নারীর অধিকার অর্জনের ক্ষেত্রে ধর্ম একটা বাধা হয়ে আছে, একথা আমি মনে করি না। আপনাকে একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমাদের গ্রামে একটা সৈয়দ বাড়ি আছে, ছোট বেলায় সেই বাড়ির মেয়েদের আমরা কখনো চোখে দেখতাম না। সেই বাড়ির মেয়েরা ছিল অসূর্যস্পশ্যা। শুনতাম সৈয়দ বাড়ির অমুকের একটা মেয়ে আছে, সে বড় হচ্ছে। ওই মেয়ের কি রকম রং, কী রকম চেহারা নিয়ে সে বড় হচ্ছে এ বিষয়ে আমাদের কৌতুহল ছিল। কিন্তু কখনোই তাকে চোখে দেখার সুযোগ ঘটে নি। প্রায় বিশ বছর বাদে গ্রামে গিয়ে দেখি, সেই সৈয়দবাড়ির মেয়েরা বাসে চড়ে শহরের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে যাচ্ছে। বিশ বছর আগে এটা কল্পনারও অতীত ছিল। আপনি তো নিশ্চয়ই দেখেছেন ঢাকা শহরের হাজার হাজার মেয়ে প্রতিদিন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে যাচ্ছে। এ দৃশ্য আগে কল্পনা করা যেত না। কাজেই ক্ষেত্র প্রস্তুত হলে ধর্ম কোন বাধা থাকে না। শিল্প স্থাপন হলে নারী জাগরণের পথকে কোন অনুশাসনই আটকে রাখতে পারে না।
প্রশ্ন: সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর যে শান্তিচুক্তি হয়েছে, তার পক্ষে বিপক্ষে নানা বিতর্ক শুনছি--
আহমদ ছফা: আইয়ুব খার আমলে রেল লাইন উপড়ে ফেলেছিলাম, ফলে সে সময়ে আমার ওপর হুলিয়া জারি হয়। আড়াই বছর আমি পার্বত্য চট্টগ্রামে পালিয়ে ছিলাম। আমার হিন্দু বন্ধুরা ভারতে চলে গেল, আর আমি পার্বত্য চট্টগ্রামে। পাহাড়ী মানুষের সরলতা, আতিথেয়তা, বিশ্বাসপরায়ণতা ইত্যাদি আমি যেভাবে অনুভব করেছি খুব কমই লোকই তা করেছেন এবং ১৯৬৪ সালে পাহাড়ি জনগণের রাইটের সপক্ষে আমি লেখালেখি করছি। আপনি তো লক্ষ্য করে থাকবেন কিছু দিন আগেও আমাদের এখানে একটি চাকমা মেয়ে স্কুলের মাস্টার ছিল। আমি শান্তি চেয়েছি, চাকমাদের অধিকারও চেয়েছি। কিন্তু যে চুক্তিটা হয়েছে, আমি মনে করি না, তা শান্তি আনার পক্ষে অনুকুল হবে। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর যে সংগ্রাম, তার পাশাপাশি এটা হচ্ছে উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্য জাতিগুলোর যে সংকট ও সংগ্রাম তার সঙ্গে যুক্ত। পাশে ভারত না থাকলে এই সংকট এত তীব্র হতো না। সুতরাং এত তাড়িঘড়ি কিছু না করে আমার প্রস্তাব ছিল আস্তে আস্তে মনোরঞ্জন করে তাদের মূল ধারায় ফিরিয়ে এনে শান্তিতে পৌছানো যেত। এখন তড়িঘড়ি কতগুলো শর্ত ও দফা দিয়ে চুক্তি হয়েছে। কিন্তু পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রধান সমস্যা যেটা আমি বলেছিলাম, যা বিবিসি, ভয়েস অফ আমেরিকা ইত্যাদিরা প্রচার করেছে, তা হলো পার্বত্য চট্টগ্রামে যে মূলধন খাটে, তার পাঁচভাগও পার্বত্য জনগোষ্ঠীর নয়। সমতল অঞ্চলের মূলধন ওখানে গিয়ে তাদের শোষণ করে। এই প্রক্রিয়াটা শুরু হয়েছে প্রায় দুশো বছর আগে । তাই প্রথম কর্তব্য ছিল পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে capital accumulate করার জন্য কিছু ব্যবস্থা করা। সেটা হচ্ছে, যেমন তাদের লঞ্চের ব্যবসা, কাঠের ব্যবসা এসব ওদের ছেড়ে দেওয়া হোক। কিন্তু সেসব কিছু না করে একটা চুক্তি করা হল। এতে কী পাহাড়ে শান্তি আসবে। আমার মনে হয় না।
কলকাতা বইমেলা ’৯৯ সংখ্যার জন্য কলকাতার স্বাধীন বাংলা সাময়িকীর পক্ষে আহমদ ছফার এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করা হয়েছিল। এই সাক্ষাৎকারটি বাংলাবাজার পত্রিকা তাদের পাঠক-পাঠিকাদের জন্য সেখান থেকে নিয়ে তিন কিস্তিতে (১৮ মাঘ ১৪০৫/ ৩১ জানুয়ারি ১৯৯৯, ১৯ মাঘ ১৪০৫/১ ফেব্রুয়ারী ১৯৯৯, ২০ মাঘ ১৪০৫/২ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯) আবার ছাপে।
আহমদ ছফা: পাকিস্তান যখন হয় তখন আমি শিশু। পরবর্তী সময়েও পাকিস্তান আমার মনের ওপর কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমি ক্লাস থ্রি বা ফোরের ছাত্র ছিলাম। সে সময় বাংলা ভাষার দাবিতে আমিও মিছিলে গেছি এবং আমার এক ভাই একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলনে মুসলিম লিগারদের হাতে মার খায়। তার থেকেই পাকিস্তানের কোনও প্রভাব আমার মনে কখনো কাজ করে নি। বরং আমার আকর্ষণ ছিল কোলকাতার প্রতি। ওখানকার পত্রপত্রিকা ও সাহিত্যের প্রতি আমার ছিল প্রবল টান। ‘নবজাতক’ নামে মৈত্রেয়ী দেবী কোলকাতা থেকে একটা পত্রিকা বের করতেন। ১৯৬৫ সালে সেই পত্রিকা তিনি আমার কাছে পাঠাতেন, আমি পত্রিকা বিক্রি করে তাকে টাকাটা পাঠিয়ে দিতাম। পূর্ব বাংলায় আমাদের বাঙালি অবস্থানটা শক্ত করার প্রয়োজনেই সেই সময় আমরা কোলকাতার দিকে অণুপ্রেরণার জন্য তাকাতাম। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম এবং স্বাধীনতার পর, অন্য আর একটা অনুভব আমার মধ্যে এল, তা হচ্ছে-ভবিষ্যতে হয়তো কোলকাতার দিকে আর আমরা তাকাতে পারবো না। কিংবা কোলকাতার প্রতি আমাদের আকর্ষণের প্রেরণাটাও আর হয়তো থাকবে না। কারণ কোলকাতা আমাদের অতীতের প্রেরণা এবং অতীত ঐতিহ্যের উৎস হতে পারে, কিন্তু একাত্তরে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিশেবে কোলকাতা আর আমাদের কিছু দিতে পারবে না এবং আমাদের কক্ষপথ আমাদেরই আবিষ্কার করে নিতে হবে। সেই কক্ষপথ অনুসন্ধানের জন্যে, আমাদের সমস্ত কাজকর্ম ও চিন্তা নিয়োগ করেছি। শুধু আমরা নয়, বাংলাদেশের একটা অংশের মানুষের মধ্যে এ চিন্তাটা এসেছে যে, বাংলাদেশকে তার নিজের মেরুদণ্ডের ওপর দাঁড়াতে হবে, নিজেকে আবিষ্কার করতে হবে।
প্রশ্ন: বাঙালি মুসলমান মানসে পাকিস্তান আন্দোলন কোন প্রক্রিয়া সে সময় সৃষ্টি করেছিল, যার জন্য তারা পাকিস্তান চেয়েছিল?
আহমদ ছফা: এটা খুব জটিল বিষয়। আমার খুব আশঙ্কা হয় সে কারণটা এখনো যায় নি। মুসলিম লীগ এখানেই হয়েছিল। মুসলীম লীগের ভিত্তি এবং শক্তি ছিল বাংলাতেই। ইতিহাসের পাতা উল্টালে আপনি লক্ষ্য করবেন যে, বাংলার অ্যাসেমব্লির মুসলমান সদস্যরা বাংলা ভাগ চান নি এবং তারা স্বাধীন বাংলার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। বাংলার অ্যাসেমব্লির যে সব সদস্য বাংলা ভাগের পক্ষে মত দিয়েছিলেন, তাদের চার ভাগের তিন ভাগ ছিলেন হিন্দু এবং শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি ক্রমাগত এটাই বলেলেন যে ভারতকে এক রাখ কিন্তু বাংলাকে ভাগ করে দাও। হ্যা, বাংলার মুসলমান জনগণ পাকিস্তান চেয়েছিল। কিন্তু সুক্ষ্মভাবে দেখলে বাংলা ভাগ জিন্নাহও চাননি। অনেক সময় বাংলা ভাগের জন্যে বাংলার মুসলমানদের দায়ী করা হয়, এটা সঠিক নয়।
প্রশ্ন: এই পরিপ্রেক্ষিতে আপনি কি বাংলার হিন্দুদেরই বাংলা ভাগের জন্য দায়ী করবেন?
আহমদ ছফা: অচিন্ত বিশ্বস, ‘তপসীলি রাজনীতি’ শীর্ষক একটি লেখায় বলেছেন, তিন থেকে ছ’ভাগ লোকের (বর্ণহিন্দু) স্বার্থে বাংলা ভাগ করা হয়েছে। বক্তব্যটা অমূলক নয়। জয়া চ্যাটার্জ ‘Bengal divided Hindu Communalism and partition’ বইতে এসব তুলে ধরেছে।
প্রশ্ন: ’৪৭-এ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা গঠনে আবুল হাশিম এবং শরৎ বসুদের প্রচেষ্টা সফল না হবার কারণও কিওই তিন থেকে ছ’ভাগ বর্ণহিন্দুর স্বার্থ?
আহমদ ছফা: না, না, ওটাই একমাত্র কারণ নয়। ওই একটি কারণেই ওই রকম একটা বিরাট ঘটনা ঘটে নি। প্রথমত প্রভাব প্রতিপত্তির দিক দিয়ে ১৯৩০-এর পর বাংলা ভাষা চতুর্থ ভাষা হয়ে গেল কোলকাতায়। প্রথম ভাষা ইংরেজী, দ্বিতীয় ভাষা হিন্দি, তৃতীয় ভাষা উর্দু। তারপর মহাযুদ্ধ, ওই যুদ্ধ বাঙালির অর্থনীতিকে সম্পূর্ণ ভেঙ্গে দিল এবং বাঙালির রাজনীতি সম্পূর্ণভাবে নির্ভর হয়ে গেল পশ্চিমী অবাঙালিদের ওপর। বাংলা ভাগের জন্যে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিদের অর্থটা দিয়েছিল টাটা। যে কারণে সুভাষ বোসকে কংগ্রেস ছাড়তে হল, এমনকি শেষ পর্যন্ত দেশও ছাড়তে হল। গান্ধী এবং নেহেরুকে টাকা দিত মাড়ওয়ারি এবং গুজরাটিরা। একজন বাঙালি সভাপতিকে তারা টাকা দিতে রাজি ছিল না এবং গান্ধী নেহেরু কখনই চান নি সুভাষ বসুর মত একজন বাঙালি কংগ্রেস দলের সভাপতি হোন বা থাকুন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ না হলে এবং বাঙালির অর্থনীতিটা ভেঙ্গে না গেলে হয়তো বাঙালির এই পরিণামটা হত না।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের কিছু মানুষ মনে করেন যে পাকিস্তান হয়েছিল বলেই, পর্ব বাংলার মানুষ বাংলাদেশে পেয়েছে। আপনিও কি এই মতের অনুসারী?
আহমদ ছফা: এর মধ্যে সত্যতা আছে, কিন্তু সম্পূর্ণ সত্য নয়। ইতিহাসের আরও পেছনে যাওয়া দরকার। যেমন পশ্চিম বাংলার অর্থনীতিবিদ ও চিন্তাশীল লেখক ড. অশোক মিত্র বলেছেন, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ রদ না হলে, অর্থাৎ তখন যদি বঙ্গ বিভাগ হত তবে বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্তের বিকাশ ঘটতো এবং বিকশিত বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত হিন্দুদের সাথে একটা সমঝোতা করে নিত। ফলে ১৯৪৭ দেশ ভাগের কোন প্রয়োজন ঘটতো না। বাংলা ভাগ না হলে ভারতও ভাগ হতো না। কারণ বাংলার বাইরে পাকিস্তানের অস্তিত্ত্ব কোথাও ছিল না। মুসলিম লীগ এখানেই হয়েছে এবং এখানেই ছিল পাকিস্তানের পক্ষে মুসলিম লীগের জনভিত্তি। এছাড়া চিত্তরঞ্জন দাসের ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ যদি কার্যকার হত, তাহলেও বাংলা ভাগ হতো না। তারপর ধরুন ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান, যাতে বাংলা আসামকে একটা জোন করা হবে বলা হয়েছিল। এটা মেনে নেয়া হলেও বাংলা ভাগ হত না। অর্থাৎ কিছু ঐতিহাসিক অনিবার্যতা দীর্ঘকাল ধরে যা হয়ে আসছিল তার চূড়ান্ত অভিঘাতে বাংলা ভাগ হয়েছে।
প্রশ্ন: পাকিস্তান ভাঙ্গার পেছনে কোন ঐতিহাসিক অনিবার্যতা কাজ করেছিল?
আহমদ ছফা: বাঙালি মুসলমানের জাতীয়তাবোধ। কিন্তু শূন্য থেকে তো জাতীয়তাবোধ জন্মায় না। এখানে (পূর্ব বাংলা) যে মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে উঠল তারাই প্রথম অনুভব করলো রাজনীতি, অর্থনীতি, ভাষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানি আধিপত্য প্রতিরোধ করতে না পারলে, বাঙালি হিশাবে তাদের বিকাশ সম্ভব নয়। মওলানা ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিব এরা ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনের নেতা। পরে পাকিস্তানকেও ভাঙ্গতে হল, কারণ ভাগে মিলছিল না। এটা একটা হিশাব, আর একটা হিশাব আছে। অর্থাৎ একটা জাতি কোন উপলক্ষে জেগে ওঠে, কত গভীরে তার প্রভাব পড়ে, অতি তুচ্ছ কারণেও কোনও ঘটনা ঘটতে পারে- কিন্তু তার প্রভাব অনেক সময় দীর্ঘস্থায়ী হয়। সেই দিক থেকে বাঙালি জাতির ইতিহাসে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে প্রভাব সঞ্চারী বড় কোন ঘটনা নেই।
প্রশ্ন: পূর্ব বাংলার বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের শিকড় অনুসন্ধানে এবং জাতি পরিচয় জেগে ওঠার পেছনে বাংলা ভাষার প্রশ্ন বা প্রভাব কতটা ছিল?
আহমদ ছফা: ভাষা ভিত্তিক জাতি পরিচয়ে ভাষাই প্রধান। ভাষা হল অধিকার উচ্চারণের প্রধান মাধ্যম। এই ভাষার সাথে অর্থনৈতিক বিষয়টাও যুক্ত ছিল যে নিউ মিডল ক্লাস তৈরি হচ্ছিল, তারা চাকরি-বাকরি পেত না যদি বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হতো। পূর্ব বাংলার মানুষ তখন তাদের অধিকার এবং অংশ চাইছিল। পূর্ব বাংলাকে তখন একটা স্বাধীন রাষ্ট্র হিশেবে চাওয়া হয় নি। বাংলা রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করা হয়েছি। বাংলা রাষ্ট্রভাষা হবার পর অন্য ইস্যুগুলো এলো, বৈষম্যগুলো পূর্ব বাংলার মানুষের কাছে স্পষ্ট হতে থাকলো। ওই বৈষম্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভ দানা বাধতে থাকলো চাকরিতে বৈষম্য, সামরিক বাহিনীতে বৈষম্য, অর্থনৈতিক উন্নয়নে বৈষম্য ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে পূর্ব বাংলার বৈষম্য ছিল। এই বৈষম্যগুলোকে রাজনৈতিক বিষয় হিশেবে পূর্ব বাংলার মানুষের কাছে তুলে ধরা হলো এবং তাতে মানুষ ব্যাপকভাবে সাড়া দিলেন এবং শেষ পর্যন্ত অস্ত্র তুলে ধরলেন পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার জন্যে। তবে পূর্ব বাংলার প্রতি নানা বৈষম্যের প্রতিবাদে যারা পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রাম আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন এক সময় এরা ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনের নেতা।
প্রশ্ন: এখানে কি আপনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে উল্লেখ করছেন?
আহমদ ছফা: তা বলতে পারেন। মুসলিম লীগের রাজনীতিতে শেখ মুজিব ছিলেন সোহরাওয়ার্দীর শিষ্য এবং গুরু শিষ্য দু’জনেই ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনের নেতা। বাংলাদেশ যারা স্বাধীন করেছেন এক সময় তাদের বেশির ভাগই ছিলেন মুসলিম লীগে। মুসলিম লীগের Extension or junior partner।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে এবং মুক্তিযুদ্ধে এখানকার বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বামপন্থী, বুর্জোয়া এবং চরম দক্ষিণপন্থী জামাত শিবিরের দৃষ্টিভঙ্গি এবং রাজনৈতিক অবস্থান?
আহমদ ছফা: শেখ মুজিবের প্রতি প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী এবং রাজনীতিকদের একটা সন্দেহ ছিল। শেখ মুজিব গোড়া থেকে ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘেষা এবং আমি আগেই বলছি, তার রাজনৈতিক গুরু ছিলেন সোহরাওয়ার্দী। তিনি ছিলেন পশ্চিমা ব্লকের লোক। এই পরিস্থিতিতে পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে এখনকার বামপন্থী দলগুলো যে বিরাট ভুল করেছে তা প্রায় আত্মহননের শামিল। একটা সময় বামপন্থীরাই ছিলেন পূর্ব বাংলার প্রধান রাজ্যনৈতিক শক্তি। ১৯৬৫ সালের পূর্বে অবিভক্ত ন্যাপ বা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিই ছিল পূর্ব বাংলা প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। ন্যাপের সাথে ছিল কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন সাংস্কৃতিক সংঘ, মহিলা পরিষদ শ্রমিক সংগঠন, কৃষক সমিতি। সব মিলিয়ে একটা বিরটা শক্তি। সে সময়টা ছিল বামপন্থী রাজনীতির স্বর্ণযুগ। বাংলাদেশের বামপন্থী রাজনীতির বর্তমান দৈন্যদশা দেখে পূর্বের অবস্থা কল্পনা করতে পারবেন না। চীন না সোভিয়েত কে সাচ্চা, এই প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায় আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন। যার আঘাত নেমে আসে পূর্ব বাংলার বাম রাজনীতিতে। দু’টুকরা হয়ে যায় ন্যাপ। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব যখন বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রশ্নটি সামনে এনে ছ’দফা ঘোষণা করেন তখন পূর্ব বাংলার বামপন্থী মস্কো এবং পিকিং শিবিরে ভাগ হয়ে পারস্পরিক বাদ-বিসংবাদে মত্ত। এবং দুই শিবির থেকেই ছ’দফার নিন্দা এবং বিরোধিতা করা হয়। অথচ ১৯৫৪ সালে ন্যাপ নেতা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ‘হোয়াট ইজ অটোনমি’ পুস্তকটি লিখে পূর্ব বাংলার জাতিসত্তার বিষয়টি তুলে ধরেছিলেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট আন্দোলন বিভক্ত হবার পর পূর্ব বাংলার বামপন্থীদের কাছে আন্তর্জাতিক ভাবনাই একমাত্র গুরুত্ব পেল।
১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে রাশিয়ার মধ্যস্থতার পর মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি বলল, আমরা অখণ্ড পাকিস্তানে বিপ্লব করবো। অন্যদিকে পাক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পিকিং-এর সাথে ভাল সম্পর্ক তৈরি করেছে। সেই সম্পর্কের ভিত্তিতে মাও সেতুং ভাসানীকে বললেন, ডোন্ট ডিস্টার্ব আইয়ুব, সে (আইয়ুব) সমাজতন্ত্রেকে সমর্থন করবে। ফলে সে সময় চীন পন্থীদের মধ্যে পাক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব বিরোধীতা না করার মানসিকতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং মুজিবের ছয়দফার মধ্যে তারা (চীনপন্থী কমিউনিস্ট) সিআইএ-এর গন্ধ আবিষ্কার করলেন। অন্যদিকে ছ’দফার সমর্থনে শহর, বন্দর, গ্রাম, গঞ্জ সর্বত্র প্রবল গণজোয়ার সৃষ্টি হল। সে সময় পূর্ব বাংলার যে একটা মধ্যবিত্ত শ্রেণী তৈরি হয়েছে, বাঙালির একটা জাতীয়তাবাদী আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয়েছে, সংগ্রামের একটা স্তরে সে উন্নীত হয়েছে- মস্কো বা পিকিং দুই পন্থীরাই তা শনাক্ত করতে পারে নি। বাঙালির জাতিগত আকাঙ্ক্ষার রাজনৈতিক উন্মেষকালে এরা সঠিক কোন অবস্থান নিতে পারে নি। ছয় দফার প্রতি মানুষের সমর্থন এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের অপ্রতিহত জয়যাত্রা দেখে মস্কোপন্থীরা ছ’দফার প্রতি সমর্থন জানাতে গেলে, শেখ মুজিব এক বাক্যে তাদের জানিয়ে দেন –দলের সাইনবোর্ড পাল্টে আওয়ামী লীগে যোগ দিন।
এছাড়া চারু মজুমদারের শ্রেণীশত্রু খতমের রাজনীতি চীনপন্থী কমিউনিস্টদের প্রবলভাবে প্রভাবিত করে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পর আমি পশ্চিম বাংলায় ছিলাম। সে সময় পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন জায়গায় দেওয়ালে দেখেছি সিপিআই(এম-এল)-এর পক্ষে শেখ মুজিব এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে নানা রাজনৈতিক শ্লোগান লেখা রয়েছে। এক সময় আব্দুল হক এবং মোহাম্মদ তোয়াহা ভাসানীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সারা দেশে হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুট, ধর্ষণ ইত্যাদী নির্বচারে চালাচ্ছে, আবদুল হক সাহেব তখন অখণ্ড পাকিস্তানের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। মোহাম্মদ তোয়াহা এবং সুখেন্দু দস্তিদার আবদুল হকের বিরোধীতা করে দেশের অভ্যন্তরে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেন। ভাষা আন্দোলনের নেতা আব্দুল মতিন, আলাউদ্দিন, অধ্যাপক অহিদুর রহমান-রা উত্তরবঙ্গের আত্রাই অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র নেতৃত্ব দেন। চিনপন্থী সিরাজ শিকদার স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা কায়েম করার লক্ষ্যে একাধিক সশস্ত্র সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন। তিনি(সিরাজ শিকাদর) পাকিস্তান এবং ভারত-এই দুই থাবা থেকেই পূর্ব বাংলাকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন।
বামপন্থীদের সংগ্রাম থেকেই বাঙালি জাতীয়তার বোধটি এখানেই অঙ্কুরিত হয়েছিল এবং তাদের নেতা ও কর্মীদের পরিচর্যায় তার বিকাশ। সেই কারণেই নানা অত্যাচার ও নির্যাতন তাদের এক সময় ভোগ করতে হয়েছে। শুনতে হয়েছে পাকিস্তান সংহতির শত্রু, বিদেশী গুপ্তচর, ইসলামের দুশমন ইত্যাদি অভিযোগ। কিন্তু সঠিক সময়ে সঠিক অবস্থান না নিতে পারার কারণে সে সবই ব্যর্থ হয়, সৃষ্টি হয় এক ব্যাপক গণবিচ্ছিন্নতা। আজ সেই গণবিচ্ছিন্নতারই ভিতরে রয়েছে এখনকার বামপন্থীরা। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সমস্ত অপকর্মের দোসর জামায়তের ঘৃণ্য ভূমিকা তো জানেন।
প্রশ্ন: যে লক্ষ্য এবং স্বপ্নকে সামনে রেখে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা প্রাপ্তির ২৬ বছর পর সেই স্বপ্ন কতটা সফল। কিংবা স্বাধীনতা প্রাপ্তির ছাব্বিশ বছরের এই পর্বটিকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
আহমদ ছফা: প্রথম স্বপ্নটা তো বাস্তবায়িত হয়েছে। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিশেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত বাংলার রাজনীতিকে যারা পরিচালনা করতেন তারা ছিলেন উচ্চ বর্গীয় অভিজাত। এখন সন অফ দি সয়েলরা রাজনীতিতে আসছেন। অন্যদিকে আশংকার দিকটি হল এখানে রাতারাতি একটি ইকোনমিক ক্লাস গ্রো করেছে। এই ইকোনমিক ক্লাসটি গড়ে উঠেছে ইকোনমিক প্লানডার(plunder) এবং লুণ্ঠন থেকে। লুণ্ঠনটা হয়েছে ব্যাপকহারে। এমন কয়েকজনকে আমি জানি, মুক্তিযুদ্ধের সময় যাদের ২৫শ’ টাকা ছিল না, এখন তাদের ক্যাপিটাল ২৫শ’ কোটি টাকা। রাজনৈতিক ক্ষমতাকে প্রয়োগ করে তারা এই টাকা আয় করেছে। এর ফলে যে সমস্যার মধ্যে আমরা পড়েছি- যদি পশ্চিম বাংলার সাথে বিষয়টি তুলনা করি বুঝতে সুবিধা হবে। পশ্চিম বাংলার মত (১৯৯৬) বিধানসভা নির্বাচনের আগে (১৯৯১) বর্ধমানে কালু ডোম বলে এক ব্যক্তি কংগ্রেসের এক সর্বভারতীয় ব্যক্তিকে পরাজিত করেছিলেন। এ চিত্র আপনি এখানে পাবেন না। কারণ আওয়ামী লীগ বলুন, বিএনপি বলুন, জাতীয় পার্টি বলুন, জামায়াতের কথা একটু স্বতন্ত্র, সব দল চলছে বাংলাদেশের নব্য ধনীদের অবৈধ উপায়ে আয় করা টাকার ওপর। কাজেই পশ্চিম বাংলার কালু ডোমদের মতো কোন প্রতিনিধি বাংলাদেশের সংসদে যেতে পারবেন না। এখানকার পত্রপত্রিকায় ঋণখেলাপী বলে একটা ব্যাপার দেখে থাকবেন। ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে, ঋণ শোধ করা হচ্ছে না। ব্যাংকগুলো এর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারছে না, কারণ এদের পক্ষে আছে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। বাংলাদেশের সব বুর্জোয়া দল চলে এদের চাদায়। এর ফলে বাংলাদেশে যে সংসদীয় ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে সেই সংসদে জনগণের সত্যিকার চিন্তা-ভাবনা, আশা-আকাঙ্খার কোন প্রতিফলন ঘটছে না। আপনি ঢাকায় এসে দেখলেন বিএনপির দু’জন এমপি আওয়ামী লীগের মন্ত্রী হলেন। ক্ষমতায় থাকার সময় বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি এইভাবে অন্য দলের এমপি ভাগিয়ে এনে মন্ত্রী বানিয়েছেন। এইভাবে বাংলাদেশের ক্ষমতার রাজনীতিটা একটা দুষ্ট চক্রের মিউজিক্যাল চেয়ারে পরিণত হয়েছে।
প্রশ্ন: এর থেকে উত্তরণের কোন পথ কি আপনি দেখছেন?
আহমদ ছফা: ১৯৭২ সালে ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ নামে একটা বই লিখেছিলাম। সাম্প্রতিক তার একটা নতুন সংস্কৃরণ আমার দীর্ঘ ভূমিকাসহ প্রকাশিত হয়েছে। আপনার অনেক প্রশ্নের উত্তর তাতে পাবেন। আমি মনে করি, ১৯৬৫-এর আগে বামপন্থী শক্তির যে ঐতিহ্যটা পূর্ব বাংলায় ছিল তা পুনরুদ্ধার করতে হবে। শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র ‘যুবক এবং সাধারণ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে তারা যে অবস্থান সে সময় তৈরি করেছিল তা পুনরুদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত আমি কোনও ভবিষ্যৎ দেখছি না।
প্রশ্ন: এখনকার বাম দলগুলোর মধ্যে সেরকম কোন উদ্যোগ বা প্রচেষ্টা কি আপনি লক্ষ্য করছেন?
আহমদ ছফা: বাম দলগুলো নিজেদের চরম ক্ষতি করছে জাতিমুক্তির প্রশ্নটিকে অনুধাবন করতে না পারার কারণে। এ প্রসঙ্গে আমাদের দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক বিন্যাসটা একটু বোঝা দরকার। আমাদের এখানে যদি উৎপাদন ভিত্তিক, মানে শিল্পপতিরা যদি কলকারখানা তৈরি করতেন, তবে শ্রমিকরা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের পলিটিক্স তৈরি করতেন। কোন উৎপাদন ভিত্তিক অর্থনীতি এখানে গড়ে ওঠে নি। এখানে যা আছে তা ট্রেডিং। স্বাধীনতার পর শিল্প কারখানা এখানে হয় নি, কিন্তু হওয়া উচিত ছিল। জাতির একটা অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড কোন সরকার তৈরি করতে পারে নি। পরিবর্তে এখানে একটা ট্রেডিং ক্লাস তৈরি হয়েছে এবং এ ট্রেডিং ক্লাসটা টিকে আছে, ট্রেডিং পলিটিক্স-এর কারণে। ট্রেডিং ব্যবসায়ীরা দু’ভাবে জনগণকে শোষণ করে। প্রথমত তারা যখন বাইরে কাচামাল রফতানি করে এবং দ্বিতীয়ত যখন বাইরে থেকে ফিনিসড গুডস আমদানি করে। সমস্ত বামদলগুলোকে একসাথে বসাবার চেষ্টা করেছি, মতবিনিময়ের ব্যবস্থা করতে চাইছি এবং বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে একটা কিছু করাতে চাইছি। কিন্তু একবার যদি সুবিধাবাদের দিকে রাজনীতিটা চলে যায়, তবে সেখান থেকে রাজনীতিকে ফিরিয়ে আনা খুবই মুশকিল। বামপন্থীরা এখন যেটা করছে, তা হল, একটা অংশ হয়তো বিএনপি’র সাথে, অন্য অংশটি আওয়ামী লীগের এ্যালাইজ(allies) হিশেবে কাজ করছে। এগুলো সবই আত্মধ্বংসী।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের রাজনীতিতে বামপন্থীদের নিজস্ব অবস্থান নির্ণয় করার ক্ষমতা অর্জন করতে না পারার কারণ কি? এখানে কি কোন দর্শনগত সমস্যা আছে?
আহমদ ছফা: হ্যা, দর্শনের একটা ক্রাইসিস তো আছেই। কিন্তু আমি মনে করি মার্কসবাদ যদি জগতে ব্যর্থও হয়, শ্রেণী সংগ্রাম তো ব্যর্থ হবার কথা নয়। মার্কসবাদকে যারা সমাজ পরিবর্তনের একমাত্র টুলস হিশেবে মনে করে এবং যারা দেখছেন যে তাদের টুলসটা আর কাজ করছে না, অনিবার্যভাবেই তখন তারা উদ্যম এবং আকাঙ্খা হারিয়ে ফেলবেন। কিন্তু মার্কসবাদ সমাজে কাজ না করলেও নির্যাতিত শ্রেণীর সংগ্রাম কি বসে থাকবে?
প্রশ্ন: সে সংগ্রামে কারা নেতৃত্ব দেবেন?
আহমদ ছফা: আমার মনে হয়, বাংলাদেশের সামনের সময়টা বামপন্থীদের অনুকূলে আসবে, যদি তারা সক্রিয় হয়। যদি তারা মেধা বা আন্তরিকতা দিয়ে সমস্যাগুলো মূল্যায়ন করেন এবং একটা বিকল্প অর্থনৈতিক উন্নয়নের ছক যদি তারা তৈরি করতে পারেন। এখন একটা বুর্জোয়া সরকার আছে, বিশ্বব্যাংক আছে, এনজিও আছে, মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া আছে, এদের বিপরীতে একটা অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড, জাতিকে বাচাবার জন্য একটা উন্নয়নের ছক এবং উপায় আবিষ্কার করা আমার মতে খুব কঠিন কাজ নয়।
প্রশ্ন: ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের মুক্তি সংগ্রাম, সব ক্ষেত্রেই ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ উঠছে-
আহমদ ছফা: হ্যা, এটা একটা মজার প্যারাডকস। যেমন ধরুন বাংলার হিন্দুরা পানিকে জল বলেন, মুসলমানরা জলকে পানি। কিন্তু বাংলার বাইরে সবাই, হিন্দু-মুসলমান উভয়েই পানি বলেন। এই জল-পানি নিয়ে বাংলার হিন্দু-মুসলমানরা একশ বছর লড়াই করছে। যাহা জল তাহাই পানি। যাহা পানি তাহাই জল। এখন আমাদের এখানে কি হচ্ছে। দেশের প্রকৃত সমস্যাগুলো, লড়াইয়ের যে ক্ষেত্রগুলো আছে সেখানে কেউ যেতে চাইছে না বলে কতগুলো প্রতীক তৈরি হয়েছে। যে কোন ইতিহাসকে দলীয়করণ করার এই যে অনুদারতা, অসত্যতা, এর কারণ ইতিহাস বলতে তারা জনগণের ইতিহাস বোঝেন না। বোঝেন দলের ইতিহাস, ব্যক্তির ইতিহাস। ইতিহাস তো জনগণের ইতিহাস হবে। কিন্তু এখানে নেতা এবং দলের ইতিহাস সবাই তুলে আনছেন। এর কারণ হচ্ছে, সংঘাতের আসল ক্ষেত্র থেকে, জনগণকে সংঘাতের প্রতীকে ফেরত নেয়া। যেমন আমরা বাঙালী না বাংলাদেশী, বাঙালি না মুসলমান? এগুলো একটা থেকে আর একটার বিরোধী নয়। আমরা যেমন বাঙালি, তেমনি বেশিরভাগ লোক মুসলমান। আমরা যেমন বাংলাদেশী তেমনি বাঙালিও। কিন্তু এগুলো তৈরি করা হচ্ছে, ক্ষমতার মালিকানা কে নেবে, এখান থেকেই ইতিহাস বিকৃতিটা সৃষ্টি করা হচ্ছে। ফরাসি বিপ্লবের সঠিক ইতিহাস এখনো অনুসন্ধান করা হচ্ছে। রুশ বিল্পবের সময় স্টালিন এবং ট্রটস্কির ভূমিকা নিয়ে লাখ লাখ পাতা লেখা হচ্ছে। বাংলাদেশ সৃষ্টির এতবড় একটা ঘটনা, সেটা নিয়ে মতদ্বৈততা, বিতর্ক এসব থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। একাত্তরের যুদ্ধ বাঙালির জাতীয় জীবনের শ্রেষ্ঠ ঘটনা। কিন্তু এখানে সবাই মিথ্যা বলছেন কেন? মিথ্যেকে পূজো করছেন কেন? এর একমাত্র কারণ মিথ্যে বললে এখানে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া যায়।
প্রশ্ন: ভাষা আন্দোলন থেকে যে অসাম্প্রদায়িক জাতী চেতনার উন্মেষ তার চূড়ান্ত রূপ স্বাধীনতা। এই সুত্রে আশা করা গিয়েছিল বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে বিকশিত হয়ে উঠবে। ওই আশার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান বাংলাদেশকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
আহমদ ছফা: প্রথমত আমি অনেকগুলো পরিচিত চিন্তার বিরোধিতা করব। যারা ভাষা আন্দোলন করেছিলেন, তারা ছিলেন মধ্যবিত্ত ছাত্র, বেশির ভাগ মুসলমান। আওয়ামী মুসলীম লীগের সকল নেতৃবৃন্দ এককালে ছিলেন পাকিস্তানি। আমার শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাক সেদিন কথা প্রসঙ্গে আমাকে বললেন, তার কাছে শেখ মুজিবের কিছু ছবি আছে, সেই ছবিতে জিন্নাহ মারা যাওয়ার পর শেখ মুজিব হাউমাউ করে কাঁদছেন। হিন্দু-মুসলমানদের ভিত্তিতে দেশটা ভাগ হল। তারপর পশ্চিমাদের সাথে লড়াই করতে গিয়ে তারা (বাঙালি মুসলমানরা) পারে না। এল সোহরাওয়ার্দীর যুক্ত নির্বাচন। এইভাবে একটা প্রেক্ষিত তৈরি হল এবং বাঙালি মুসলমান বাঙালি হিন্দুদের টেনে আনলেন। এই ক্ষেত্রে প্রেমের চাইতে যে জিনিসটা বেশি কাজ করেছে, তা হল তাদের বাস্তব প্রয়োজন। অর্থাৎ যে অর্থে অসাম্প্রদায়িক ইত্যাদি বলতে আমরা যা চিন্তা করি, একটা আইডিয়াল সিচুয়্যেশন, সেটা বোধ হয় এ ক্ষেত্রে কল্পনা করা ঠিক হবে না। তবে কোলকাতা থেকে এটা কল্পনা করার বোধ হয় সময় এসেছে এই কারণে যে, ভাষা আন্দোলন তার নিজস্ব প্রেক্ষিত ছাড়িয়ে বাঙালি জাতির ইতিহাসে অন্যরকম একটা তাৎপর্য নিয়ে আসছে। কিন্তু উৎসের(ভাষা আন্দোলনের) দিকে গেলে দেখব লক্ষ্য ছিল চাকরি/বাকরি ইত্যাদি। আগেই বলেছি, একুশে ফেব্রুয়ারি আমি থ্রি ফোরের ছাত্র। ছাত্র বয়সে বাংলা ভাষার দাবিতে মিছিলে গেলে এসব কথা আমরা শুনতাম। উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে, বাংলায় পাস করে আমরা চাকরি পাব না, দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হবো, পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে হেরে যাব। সেই সময় শহিদুল্লাহ সাহেবের(ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ) একটা কথা- পাকিস্তানিরা যখন বলল, ইসলামের ভিত্তিতে যেহেতু পাকিস্তান, তাই ইসলামের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা হবে। শহীদুল্লাহ সাহেব বললেন, ইসলামকেই যদি তোমরা অগ্রাধিকার দিতে চাও তবে আরবিকে রাষ্ট্রভাষা কর, তোমরাও শিখবে, আমরাও শিখবো। পশ্চিম পাকিস্তানিরা তাতে রাজি হয় না। এইভাবে নানা প্রক্রিয়ার মধ্যে ভাষা আন্দোলনে আজকে আমরা যা আবিষ্কার করেছি সেই জিনিসটা প্রথমে ছিলনা।
‘চীন দেখে এলাম’ বইতে মনোজ বসু লিখেছিলেন, শেখ মুজিব পিকিংএ তাকে কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে, আমরা পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করে ছাড়াবো। পাক-ভারত যুদ্ধের সময় মনোজ বসু বইটা প্রত্যাহার করে নেন। পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার চিন্তা শেখ সাহেবের মনে থাকতে পারে। আমার মনে হয় এতে কেচো খুড়তে সাপ বেরিয়ে পড়েছে। বীরেন শাসমলের ছেলে নিমলানন্দ শাসমল, ‘ভারত যখন স্বাধীন হচ্ছে’ নামে একটা বই লিখেছিলেন। সেই বইতে তিনি লিখেছেন, আজকে যে কারণে আমরা শেখ মুজিবকে মালা দেই, সেই একই কারণে শেখ আবদুল্লাহকে জেলে পাঠাই। বাংলাদেশ স্বাধীন হতে পেরেছে প্রথম ভৌগোলিক দুরত্বের কারণে। ভারতের সাথে কাশ্মীরের কন্টিগিউয়াস(contiguous) এরিয়া। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি দেখলে বিষয়টির প্রতি সুবিচার করা হবে। আর এ সমস্ত ইস্যুতে আমি একজন সামান্য মানুষ। চূড়ান্ত মতামত দেবার ক্ষমতা আমার নাই।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের অনেক কবি, সাহিত্যিক দাবি করেন, ঢাকাই হবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের রাজধানী। এই দাবির যৌক্তিকতা কতটা আছে-
আহমদ ছফা: ‘রাজধানী’ করার শব্দটা খুব ভাল শব্দ নয়। তবে এ শব্দটা প্রথম উচ্চারণ করেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। এরা তো ব্যবসায়ী লেখক, যখন যেখানে যেমন বোঝেন কোপ মারেন। আবার ‘দেশ’ পত্রিকার বর্তমান সংখ্যায়(২১ ফ্রেবুয়ারী ১৯৯৮ সংখ্যা) ‘প্রবাসে বাংলা ভাষা’য় বাংলাদেশের ভূমিকাকে তিনি গৌণভাবে দেখিয়েছেন। রাজধানী শব্দটা আমি পছন্দ করি না। কারণ মানুষ যেখানে থাকেন, তার সংস্কৃতিও সেখানে থাকে। এক সময় ব্রজবুলি সাহিত্য তৈরি হয়েছিল, এক সময় মঙ্গলকাব্যও লেখা হয়েছিল, একসময় পুথিসাহিত্যও তৈরি হয়েছিল। সারা বাংলা জুড়ে নানা বাকে নানা সাহিত্য তৈরি হয়েছিল। বাংলাদেশের সাহিত্য এখনকার পরিবেশ, প্রতিবেশ, এখানকার জীবন, সংগ্রাম,রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা এসব নিয়ে লেখা হবে। পশ্চিম বাংলার সাহিত্য সেখানকার মত বিকশিত হবে। তবে বাংলা ভাষার প্রশ্নটা স্বতন্ত্র। বাংলা এখানে রাষ্ট্রভাষা, জাতীয় ভাষা। সেই কারণে বাংলা ভাষা এখানে যে পেট্রোনাইজেশনটা পাচ্ছে সেটা পশ্চিম বাংলায় বাংলা ভাষা পাচ্ছে না। বাংলা ভাষা ওখানে (পশ্চিম বাংলায়) একটি ‘প্রাদেশিক’ ভাষা, এবং হিন্দির দ্বারা চূড়ান্তভাবে কোণঠাসা। পশ্চিম বাংলায় বাংলা ভাষার জন্যে যে প্রেট্রোনাইজেশনটা দরকার আর্থিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক কোন ক্ষেত্রেই বাংলা ভাষা তা পাচ্ছে না। কারণ, জাতিগতভাবে বাঙালি সেখানে স্বাধীন নয়। বাংলাদেশের সাহিত্যের ক্ষেত্রে যারা খুব পরিচিত, একটা সময় পর্যন্ত তারা এখানকার সাহিত্যকে সার্ভ করেছেন তাদের অনেকেই এখন সাহিত্য ক্ষেত্রে একটা সময় যারা জ্বলে উঠেছিলেন, তাদের অনেকেই এখন বর্জ্য পদার্থের কাছাকাছি এসে গেছেন। নতুন প্রজন্মের কাছে পলিটিক্যাল ডেসটিনি না থাকলে, পলিটিক্যাল গোল ক্লিয়ার না থাকলে, শিল্প সাহিত্য তার প্রধান ভিকটিম হয়। এখন বাংলাদেশের চিত্র কোন দিকে যাবে তার দিশা নেই। আপনি দেখবেন হাজার হাজার পাতা পত্র-পত্রিকা ছাপা হচ্ছে। কিন্তু স্পর্শ করার মত পঞ্চাশটি পাতা আপনি সেখানে পাবেন না। কাজেই অতিকথন করে লাভ নেই। তবে বাংলাদেশের একটি সম্ভাবনা আছে, সেই সম্ভাবনাকে যদি একসপ্লয়েট করতে পারি, তাবে বাংলার এই অংশের সাহিত্যে একটা নতুন যুগ আসতে পারে। এবং তা যদি হয় তবে পশ্চিম বাংলার বাংলা ভাষাও সাহিত্যের সামনে চ্যালেঞ্জ আছে। সেসব মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কিছু শক্তি ও প্রেরণা দিতে পারবে। ‘রাজধানী’ শব্দটা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কয়েন করেছিলেন বাংলাদেশে বই বেচার জন্যে।
প্রশ্ন: পশ্চিম বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতিদ্বন্দি না পরিপূরক?
আহমদ ছফা: কোন সাহিত্য বা সংস্কৃতি কারো প্রতিদ্বন্দী হয় না। সাহিত্য-সংস্কৃতি হচ্ছে প্রবাহে প্রবাহে সম্মিলন। ধর্ম প্রতিদ্বন্দী হতে পারে, হয়। কিন্তু সাহিত্য-সংস্কৃতি কখনই হয় না।
প্রশ্ন: পশ্চিম বাংলার বই আমদানির ফলে বাংলাদেশের সাহিত্য এবং প্রকাশনা শিল্প মার খাচ্ছে। এমন অভিযোগ বাংলাদেশের সাহিত্য এবং প্রকাশনার স্বার্থে পশ্চিম বাংলার বই আমদানি বন্ধ করার কথাও শুনেছি এবং পশ্চিম বাংলার কোন বইকে এ বছর(১৯৯৮)ঢাকার একুশের বই মেলায় ঢুকতে দেয়া হয় নি। এ বিষয়ে-
আহমদ ছফা: আগে যেটা হত আমদানি তো হতই, অনেকে কোলকাতার প্রকাশকের কাছ থেকে ট্রেসিং নিয়ে এসে এখানে ছেপে বিক্রি করতেন। এতে আমাদের বইমেলা বা বইয়ের বাজারে আমাদের(বাংলাদেশের) বই বিক্রি হত না। ঐতিহাসিক কারণে দীর্ঘদিন ধরে এখানে কলকাতার বইয়ের একটা বাজার ছিল এবং কোলকাতার সেই বইয়ের বাজারকে চ্যালেঞ্জ করে কোনও বইয়ের বাজার এখানে গড়ে ওঠে নি। বই লেখা তো যথেষ্ট নয়, বই প্রমোট করা, বইয়ের আলোচনা করা, নানা কারণে সেসব এখানে হয় নি। স্বাধীনতার পর নানারকম দুর্বিপাকে পড়ে আমাদের গ্রন্থশিল্পটা বিকশিত হতে পারে নি। কিন্তু কোলকাতার গ্রন্থশিল্প অনেকদিন আগে থেকেই বিকশিত। সেই সুত্রে কোলকাতার বই বাংলাদেশের সমস্ত বইয়ের বাজার দখল করে নিল। এর মধ্যে আনন্দ বাজারের বইই ছিল শীর্ষে। পুলিশ দিয়ে এটা বন্ধ করা যায় না। ১৯৯৪ সালে বুকে পোস্টার দিয়ে এর প্রতিবাদ করলাম। অন্য কোন প্রকাশকের বই নয়। আমার প্রতিবাদ শুধু আনন্দবাজার বইয়ের বিরুদ্ধে। যে বইয়ের জন্যে ইলিয়াসকে(আখতারুজ্জামান ইলিয়াস) আনন্দ পুরস্কার দেয়া হয়েছে, সেই বইতেই(খোয়াবনামা) আনন্দবাজারকে বলা হয়েছে বাঙালির শত্রু। বাংলা ভাগ করার পেছনে এই পত্রিকাটির ভূমিকা অনেক। আমরা যখন ভাষা আন্দোলন করছি, সমর সেনের ‘বাবু বৃত্তান্ত’ পড়ুন, তখন রায়ট লাগাবার জন্যে ইলিশের পেটে হিন্দু রমনীর মস্তক পাওয়া গেছে বলে সংবাদ লিখে আনন্দবাজার সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়েছে এবং তসলিমাকে নিয়ে আনন্দবাজার যা করেছে গোটা দুনিয়ার কাছে আনন্দবাজার বাংলাদেশকে তুলে ধরল একটি সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী দেশ হিশেবে। কিন্তু কে মৌলবাদী, ভারত না বাংলাদেশ? মৌলবাদ উত্থান হচ্ছে ভারতে, বিজেপি এবার দিল্লির ক্ষমতায় আসছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সংসদে এবার জামায়াত পেয়েছে মাত্র তিনটি আসন। এই আনন্দবাজারের দৌরাত্ম্য আমরা বাংলাদেশে চলতে দেব না। বই যেমন সংস্কৃতির বাহন, তেমনি পণ্য। ইকোনমিক্স-এ একটা কথা আছে-Nurse the baby protect the child, Free the adult আমাদের প্রকাশনা শিল্প পরিণত না হওয়া পর্যন্ত বিশেষ কিছু ব্যবস্থা নিতেই হবে।
ভারতের বইয়ের কপিরাইট কিনে এখানকার প্রকাশকরা ছাপুন আপত্তি নেই। সুনীলের(গঙ্গোপাধ্যায়) কোন বই কপি রাইটে কিনে এখানে ছাপা হলে আমাদের কমপোজিটার, ছাপা খানা, দপ্তরি, পাইকার সবাই টাকা পাবে। তবে Medical Science, Technology-এর বইয়ের ক্ষেত্রে আমরা এ কথা বলি না। কারণ এসব বই আমেরিকা থেকে আনলে যদি পাচ’শ ডলার লাগে, ভারত থেকে আনতে লাগে এক’শ ডলার। এবং আনন্দবাজার ছাড়া অন্যান্য প্রকাশনার বইয়ের ব্যাপারে আমরা বিরোধিতা করিনা।
প্রশ্ন: কোলকাতার বই মেলা তো--
আহমদ ছফা: (উত্তেজিতভাবে প্রশ্ন শেষ করতে না দিয়ে) দেখুন, আমরা ভাষার জন্যে রক্ত দিয়েছে, রক্ত দিয়ে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভাষাভিত্তিক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি। আমরা কেন কোলকাতাকে অনুসরণ করতে যাবো। আপনার পত্রিকাতেই পড়েছে- কোলকাতা বই মেলার আমন্ত্রণপত্রে প্রথমে হিন্দি তারপর ইংরেজী এবং শেষ তিন নম্বরে বাংলার স্থান। যদি ভবিষ্যতে পশ্চিম বাংলায় ওই তিন নম্বর স্থান থেকেও বাংলা ভাষা মুছে যায় মোটেই অবাক হবো না। কারণ এটাই ভারত সরকারের পলেসি এবং এতেই ভারতের ‘ঐক্য সংহতি’ দৃঢ় হবে। আমাদের একুশের মেলা বাংলা ভাষার মেলা, বাংলাদেশের বইমেলা। একটি স্বাধীন জাতি হিশেবে, স্বাধীনভাবেই আমাদের চলার পথ আবিস্কার করতে হবে। আপনারা(পশ্চিম বাংলা ও ভারতের বাঙালিরা) জাতি হিশেবে স্বাধীন নন। আপনাদের ভাষাও সেখানে স্বাধীন নয়, আপনারা দিল্লি এবং হিন্দি সমান। সবক্ষেত্রে দিল্লি এবং হিন্দির নির্দেশ মেনেই আপনাদের চলতে হয়। পরাধীন জাতি হিশেবে স্বাধীনভাবে চলার ক্ষমতা আপনাদের নেই। মানসিকভাবেও এই দাসত্বকে আপনারা(ভারতের বাঙালিরা) মেনে নিচ্ছেন। কারণ ‘ভারতের ঐক্য সংহতি রক্ষা’র দায় এখন আপনাদের কাধে। তাই স্বাধীন হবার ইচ্ছেও আর থাকছে না। কিন্তু আমরা ‘পাকিস্তান সংহতি’কে কবরে পাঠিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছি। তাই পশ্চিম বাংলা বা কোলকাতাকে এক্ষেত্রে অনুসরণ করতে যাব না। যদি কোনদিন স্বাধীন হয়ে স্বাধীন চিন্তা এবং পথকে আবিস্কার করতে পারেন, সেদিন নিশ্চয় আমরা পশ্চিম বাংলা ও কোলকাতার দিকে তাকাব।
প্রশ্ন: আপনি আনন্দবাজার প্রকাশনার কথা বললেন, কিন্তু অন্য প্রকাশনার বইও তো একুশের বইমেলায় ছিল না?
আহমদ ছফা: না, একুশে মেলার বিষয়টা আলাদা। একুশের মেলা ছাড়া অন্য যেসব বইমেলা হয় তাতে থাকে। একুশের মেলা হল বাংলাদেশের লেখকরা কতটুকু উঠলেন, কতটুকু বিকশিত হলেন তার মান নির্ণয়ের মেলা। এখানে অন্য বই থাকবে না। আন্দোলন করে একুশের মেলাটিকে আমরা নিজেরে বইয়ের মেলা করতে চাইছি।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানার বাইরে অন্য কোনও স্থানের বই একুশের বইমেলায় থাকবে না। এই দাঁড়াচ্ছে মূল ব্যাপারটা-
আহমদ ছফা: হ্যা, তবে কোন ভারতীয় বই যদি বাংলাদেশে ছাপা হয় তাবে সে বই মেলায় থাকতে পারবে। এইটুকু যদি না করতে পারি, তবে দেশটাকে স্বাধীন করেছিলাম কেন? আমার একটা অভিজ্ঞতার কথা আপনাকে বলি। একবার আনন্দবাজারের বাদল বসু আমার একটা ইন্টারভিউয়ের প্রতিবাদ করে খুব খারাপ কথা বলেছিলেন। তারপর আমাদের দেশের প্রবীণ লেখক শওকত ওসমান বললেন, আমমদ ছফা খুব খারাপ লোক। উনি(শওকত ওসমান) খুব খারাপ শব্দ ব্যবহার করেছিলেন, সেই শব্দটা আমি বলছি না। এরপর একদিন আমি শওকত ওসমানকে সাথে নিয়ে ঢাকার নিউ মার্কেটে গেলাম। নিউ মার্কেটের সব বইয়ের দোকানে শওকত ওসমানের বই চাইলাম, কিন্তু কোন বইয়ের দোকানই শওকত ওসমানের কোনও বই দিতে পারে না। কিন্তু যখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই চাইলাম, দেখা গেল মুদি দোকানও তা দিতে পারে। শেষে আমি শওকত ওসমানকে বললাম, সুনীল আপনার বড় না ছোট? তিনি বললেন, ছোট, অনেক ছোট। ওকে আমি জন্মাতে দেখেছি। আর জানবেন শওকত ওসমান লেখক হিশেবে ছোট লেখক নন, তার অনেক লেখা আছে উৎকর্ষের বিচারে যা বেশ ভাল। এই অবস্থা দেখে শওকত ওসমানকে আমি বললাম, দেশটা আমরা বল ছেড়ার জন্য স্বাধীন করেছি? আনন্দবাজার ‘দেশ’ পত্রিকার ২১ ফেব্রুয়ারি (১৯৯৮) সংখ্যায় বদরুদ্দীন উমরের রচনা নিয়ে যা করল, এসব বদমাইশি আর আমরা হতে দেব না। আপনি তো দীর্ঘদিন ধরে কোলকাতায় একুশে ফেব্রুয়ারি বিষয়ে কাজ করছেন। আর আনন্দবাজার আজকে একুশে ফেব্রুয়ারি বিষয়ে সংখ্যা বের করেছে স্রেফ বাংলাদেশে তাদের মার্কেট রাখার উদ্দেশ্যে।
প্রশ্ন: দিন কয়েক আগেই স্বাধীন বাংলা পত্রিকার জন্যে বদরুদ্দীন উমরের একটি সাক্ষাতকার আমি গ্রহণ করেছি। সেই সাক্ষাতকারে বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বিকৃতি প্রসঙ্গে আমার প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানিয়েছেন যে, এ বিষয়ে দেশ পত্রিকায়(২১ফেব্রুয়ারি ’৯৮ সংখ্যায়) তার (বদরুদ্দীন উমর) একটি লেখা প্রকাশের জন্যে বাংলাদেশ সরকার দেশ পত্রিকার ওই সংখ্যাটি এখানে(বাংলাদেশে) নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। বদরুদ্দীন ওমর আনন্দবাজারের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ কিন্তু জানান নি। বরং আমাকে কোলকাতা গিয়ে তার লেখাটি পড়তে বলতেন। বাংলাদেশ সরকার যদি ‘দেশ’ পত্রিকার কোন সংখ্যা এখানে আসতে না দেয়, তা হলে আনন্দবাজারের কী করার থাকতে পারে? এবং এখানে তাদের ‘বদমাইশিটাই বা কোথায়?
আহমদ ছফা: হ্যা, এ পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু তারপর আরও কিছু ঘটনা ঘটেছে, কিংবা সব ঘটনাটি জেনেছি। ব্যাপারটা হচ্ছে-‘দেশ’ পত্রিকা একুশে ফেব্রুয়ারি সংখ্যার জন্যে ভাষা আন্দোলনের গবেষক লেখক বদরুদ্দীন উমরের কাছে একটি লেখা চাইলে, উমর তাদের জানান যে, তিনি আনন্দবাজার পত্রিকার ঘরানার লেখক নন। এরপর আনন্দবাজার পত্রিকার পক্ষ থেকে বদরুদ্দীন উমরকে জানানো হয় যে, ভাষা আন্দোলনের উপর তিনি যা লিখবেন তাই দেশ পত্রিকায় ছাপা হবে। এবং দেশ পত্রিকায় উমরের ওই লেখাটি ছাপা হলে দেশ পত্রিকার ওই সংখ্যার চালান বর্ডারে আটকে দেয়া হয়। এতে দেশ পত্রিকার সম্পাদক উমরের লেখাটি প্রকাশ করার জন্যে কোলকাতার বাংলাদেশ ডেপুটি হাই কমিশন মারফত বাংলাদেশ সরকারের কাছে দুঃপ্রকাশ করে ক্ষমা চায় এবং উমরের লেখাটি পত্রিকা থেকে বাদ দিয়ে শওকত আলীর একটা লেখা যোগ করে দেয় পত্রিকার ওই সংখ্যাটি বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। শওকত আলীর লেখাটিও ২১ফেব্রুয়ারি সংখ্যার জন্যে দেশ পত্রিকার পক্ষ থেকে লেখকের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। কিন্তু দেশ পত্রিকার মূল সংখ্যায় শওকত আলীর লেখাটা ছিল না। পরে যখন তারা (দেশ পত্রিকা) বদরুদ্দীন উমরের লেখাটি পত্রিকা থেকে বাদ দেন তখন সেই শূন্যস্থান তারা পূরণ করেন শওকত আলীর লেখাটি দিয়ে। এই মিথ্যাচার এবং কপটতা আনন্দবাজারের পক্ষে সম্ভব। লেখা চেয়ে নিয়ে লেখা ছাপার পর তা পত্রিকা থেকে বাদ দেয়া এবং লেখাটি আনন্দবাজার ভুল করে ছেপেছে বলে কোলকাতার ডেপুটি হাইকমিশনারের কাছে ক্ষমা চাওয়া এবং অন্য লেখা যোগ করে তা (দেশ পত্রিকা) এখানে পাঠানো এসব করতে গিয়ে আনন্দবাজার একবারও বদরুদ্দীন কিংবা শওকত আলীকে কিছু জানাবার প্রয়োজন অনুভব করেনি। আপনি বলুন এসব বদমাইশি ছাড়া আর কি?
আমাদের ইতিহাস আমরা লিখবো না, লিখবে আনন্দবাজার। এত রক্তের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা, তার একটা দাম আছে। একবার নীরদ চৌধুরী তথাকথিত বাংলাদেশ লেখার কারণে দেশ পত্রিকা এখানে বন্ধ হয়ে যায়। এত সাপ্তাহিক দেশ পাক্ষিকে পরিণত হয়। এখন যদি ‘দেশ’ আমরা বাংলাদেশে ঢুকতে না দেই তবে তা মাসিক হবে। সেটা আমরা এখনই করতে চাই না, কারণ পশ্চিম বাংলার বাংলা ভাষাটা টিকিয়ে রেখেছেন লেখকরা। আর কোন ক্ষেত্রেই বাংলা ভাষার চর্চা নেই। বাংলা ভাষার ওপর ওখানে(পশ্চিম বাংলায়) যে আক্রমণটা চলছে সেই সময় আমরা যদি পশ্চিম বাংলার বই আমদানি করা বন্ধ করে দেই, তবে তার সুযোগ নেবে এখানকার মৌলবাদীরা, এবং ওখানকার বাংলা ভাষার চর্চা চরম বিপদে পড়বে। দীঘদিন ধরে পশ্চিম বাংলার রাজনীতি এবং অর্থনীতি বাংলা ভাষার অনুকূলে নয়। পশ্চিম বাংলার অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করে মাড়ওয়ারী এবং গুজরাটিরা। আর রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ হয় দিল্লি থেকে। এমনকি বামফ্রন্ট সরকারকে সবার আগে প্রাধান্য দিতে হয় হিন্দি বলয়ের স্বার্থকেই। এই হিন্দি বলয়ই ভারতবর্ষকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই হিন্দি বলয়ই ভারতবর্ষকে নিয়ন্ত্রণ করে। এত প্রতিকূলতার মধ্যেও যে বাংলা ভাষা পশ্চিম বাংলায় টিকে আছে তার কারণ সেখানকার লেখকরা এখনো বাংলা ভাষায় লিখছেন। বাংলা ভাষার প্রতি প্রেমের কারণেই আমরা পশ্চিম বাংলার এই আমদানি বন্ধ করছি না। এমনকি আমরা চাই না ‘দেশ’ পত্রিকার মত একটি কাগজ বন্ধ হয়ে যাক। পশ্চিম বাংলার প্রতি আমাদের এই অনুভবটা আপনি পৌঁছে দিবেন। বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার পর বাংলাদেশে তিন জন মানুষ মারা গেছেন। আর মমতা বন্দোপাধ্যায় এখানকার ‘ভোরের কাগজ’ পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎকারে বলেছে, কোলকাতা শহরতলীতেই মারা গেছেন একশজন। মমতা বন্দোপাধ্যায়ের একশ জনকে আমরা পঞ্চাশ ধরতে পারি। এই তিনজন মানুষের মৃত্যুকে নিয়ে পৃথিবীব্যাপী আনন্দবাজার যে কাণ্ডটা করল এটা কোন দরিদ্র প্রতিবেশীর প্রতি কোন ভদ্রোলোক করে না। মনে বিষ না থাকলে এটা সম্ভব নয়।
প্রশ্ন: যদি বলা হয় প্রতিযোগিতায় না পারার কারণে এই ক্ষোভ?
আহমদ ছফা: হ্যা, একথা বলতে পারেন। তবে আমি রেপড হচ্ছি আপনি ভাববেন না আমি মজা পাচ্ছি। আনন্দবাজারের একটা সাকসেসফুল ব্যাপার আছে। পশ্চিম বাংলার বাঙালির টাকা নেই। কিন্তু আনন্দবাজার টাকা করেছে। সাহিত্যটাকে তারা ব্যবসায়ের পণ্যে পরিণত করেছে এবং সমস্ত লেখককে তারা পূজা সংখ্যার লেখক-এ পরিণত করেছে। তারা তাদের পচাত্তর বছরের ঐতিহ্য দিয়ে বাংলাদেশের গ্রোয়িং প্রসেসে হস্তক্ষেপ করেছে। একজন সাধারণ লেখককে পুরস্কার দিয়ে তুলে ধরে, অন্যদিকে একজন সত্যিকার ভাল লেখককে অপমান করে। যেমন তারা তসলিমা নাসরিনকে পুরস্কার দিয়ে দুই কোটি টাকা আয় করেছে। আপনি যদি চান আমি হিশাব দেব। এখানে তারা পাচটি আনন্দ পুরস্কার দিয়েছে। এর মধ্যদিয়ে ভারতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসনের হস্ত এখানে প্রসারিত হচ্ছে। হিন্দির এত বড় এজেন্ট হচ্ছে আনন্দবাজার। আমি এইভাবে ব্যাখ্যা করবো। জানি না আপনারা পশ্চিম বাংলার লোকেরা কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন। নানাভাবে ভারত ফাদ পেতে রাখছে। সেই ফাদে আমাদের পড়ার অপেক্ষা। আমরা যদি ভারত বর্ষের ফাদে পড়ি, পশ্চিম বাংলার লোকদের কর্তব্য হবে- আমাদের স্বাধীন অবস্থানকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করা। না হলে পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের অবস্থাও গয়া হবে। পশ্চিম বাংলার আপনারা বাঙালির ভাষা সংস্কৃতি ও স্বাধীন অস্তিত্ব রক্ষা করার চেষ্টা করছেন, তবে তার পিছনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার অস্তিত্ব একটি প্রেরণা হিশেবে কাজ করছে। একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র হিশেবে বাংলাদেশ তার নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াক, রাজনৈতিক স্বার্থেই দিল্লির শাসকরা এবং তাদের প্রধান এজেন্ট আনন্দবাজার তা চায় না।
প্রশ্ন: বিষয়টি যদি ব্যাখ্যা করে বলেন-
আহমদ ছফা: পাকিস্তান ভেঙে যদি পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা নিজেদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র তৈরি করতে পারেন তবে বহুজাতিক ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতিগুলোই বা তা পারবেন না কেন? এবং কোন অধিকারে দিল্লি তামিল, তেলেগু, মালায়ালাম, ওড়িয়া, অসমিয়া, বাঙালি, কাশ্মীরী, নাগা ইত্যাদী জাতিগুলোর ওপর রাজনৈতিক শাসন, অর্থনৈতিক শোষণ এবং তাদের নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতির ওপর হিন্দির স্টিমরোলার চালাবে? আনন্দবাজার শুধু বাংলাদেশের নয়, পশ্চিম বাংলার বাঙালিদেরও শত্রু এবং বাঙালির জাতিগত অস্তিত্বের প্রয়োজনে শুধু দিল্লি বা হিন্দির বিরুদ্ধে নয়, আনন্দবাজারের বিরুদ্ধে একদিন আপনাদের (পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের) দাঁড়াতে হবে। ফারাক্কা তৈরি করেছিল বাংলাদেশের ক্ষতি করার জন্যে। কিন্তু ফারাক্কার কারণে পশ্চিম বাংলার কম ক্ষতি হয় নি। ভারতের পানি অবরোধের বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানি যখন ফারাক্কা অভিযান(১৯৭৬) করেছিলেন, আপনি লক্ষ্য করে দেখবেন, আনন্দবাজার কি কুৎসিত এডিটোরিয়াল লিখেছেন। এখন আবার দেখবেন, কিভাবে তারা ভাষা পাল্টালেন। বাংলাদেশের রস পায় বলে পশ্চিম বাংলায় আনন্দবাজার দাঁড়িয়ে আছে। আনন্দবাজারকে কিভাবে টোন ডাউন করতে হয় আমরা জানি। এমনিতে আনন্দবাজার যথেষ্ট ভাল বই ছাপে, দেশ পত্রিকা একটি সুসম্পাদিত পত্রিকা। কিন্তু একটি পত্রিকা একটি জাতির সুসাহিত্যকে সম্পূর্ণ কুক্ষিগত করে রাখে, এটা পৃথিবীর অন্য কোথাও আপনি পাবেন না।
প্রশ্ন: নিজস্ব কোন সাহিত্য ধারা আপনারা কি তৈরি করেছেন?
আহমদ ছফা: এখনো পারিনি। কিন্তু আমরা বসে থাকব, এটা ভাবাও ঠিক নয়।
প্রশ্ন: পশ্চিম বাংলার পাঠকদের সম্পর্কে-
আহমদ ছফা: পশ্চিম বাংলার পাঠকরা এত ভাল। সেখানে গলির মোড়ে মোড়ে বিদগ্ধ লোক পাওয়া যায়। দেশ পত্রিকাতে যে সমস্ত পাঠক চিঠি লেখেন, চিঠিগুলো যেভাবে গুছিয়ে লেখেন, পৃথিবীর কম দেশেই এমন গুছিয়ে লেখেন। অন্য পাঁচটা দেশের সাহিত্য এবং পত্রিকা পড়েই একথা বলছি । পশ্চিম বাংলায় ভাল মানুষের সংখ্যা কম নয়, অনেক Unfortunately তারা অসহায়। অর্থনৈতিকভাবে তারা অসহায় এবং সংস্কৃতিতে যে দুর্বৃত্তায়ন চলছে, তারও অসহায় শিকার তারা।
প্রশ্ন: ঊনবিংশ শতাব্দীতে কলকাতা বা বাংলা নবজাগরণ বিষয়ে-
আহমদ ছফা: হ্যা, ঊনবিংশ শতাব্দীর কোলকাতা আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে। তার রেজাল্ট আমরা সবাই কমবেশি ভোগ করেছি। বাংলা ভাষার বিকাশ হয়েছে, আধুনিক সাহিত্য, আধুনিক সংস্কৃতি, আধুনিক বিজ্ঞান, আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তা এসব আমরা পেয়েছি ঊনবিংশ শতাব্দীর কোলকাতা থেকে। তবে একে রেনেসাস বলা ঠিক নয়। তবে এর মধ্যে রেনেসাসের অঙ্কুর ছিল। পরবর্তীকালে যা হয়েছে, তা হল রিভাইভিলিজম। বঙ্কিম, ভুদেব থেকে এমনকি রামমোহন রায় হিন্দু রিভাইভলিজাম থেকে মুক্ত নন। আমি জানি না, পশ্চিম বাংলার বিদগ্ধ সমাজ আমার কথা গুলোকে কিভাবে নেবেন। আমি মুসলিম সমাজের দিকে তাকিয়েই কথাগুলো বলছি। যেমন বিদ্যাসাগর তার জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করেছেন বিধবা বিবাহ, সমাজ সংস্কারমূলক আন্দোলনে। সাহিত্যের কাজে সময় দিয়েছেন অত্যন্ত কম। একথা রামমোহন রায় এবং তার সহমরণ নিবারণ সম্পর্কেও। এসব মুসলমান সমাজের সমস্যা ছিল না। শুধু মুসলিম নয়, নিম্মবর্গের হিন্দুদেরও সমস্যা ছিল না। এটাকে কেউ সখ করে জাগরণ বললে বলতে পারেন। কিন্তু এটা ছিল অত্যন্ত স্মল গ্রুপের জাগরণ। তার বাইরের এর কোন প্রভাব ছিল না এবং জাগরণ তারা এমনভাবে ঘটিয়েছিলেন যাতে অন্যরা অবহেলিত এবং লাঞ্ছিত থাকেন।
প্রশ্ন: ঊনবিংশ শতাব্দির বিতর্কিত চরিত্র বঙ্কিম, তার সাহিত্য প্রতিভা এবং রাষ্ট্র চিন্তা সম্পর্কে-
আহমদ ছফা: বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কে বাংলার মুসলমান লেখকরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেছেন। বঙ্কিমকে সমর্থন করেন এমন লোক বাংলাদেশে অল্প নয়। কিন্তু সাহিত্যিক বঙ্কিমকে দেখেন। আমি বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কে যে বইটি (শতবর্ষের ফেরারী) লিখেছি তাতে নতুন কথা কিছু লিখিনি। সুশোভন সরকারের ছেলে সুমিত সরকার ইংরেজী ভাষায় বঙ্কিম ও হিন্দুত্ব বিষয়ে দীর্ঘ প্রবন্ধের বই লিখেছেন। লেখক হিশেবে বঙ্কিম নবযুগের উদগাতা। তিনি মানবিক এবং সেকুলার চিন্তার ধারক-বাহক। কিন্তু বঙ্কিম যখন রাষ্ট্র চিন্তা করেন, তখন হিন্দু রাষ্ট্র চান। গিরিলাল জৈন্য ফেনামেনন বলে একটা বই লিখেছেন। এই বইটিকে বিজিপির বাইবেল বলা হয়। এই বইটিতে তিনি বঙ্কিমকে কিভাবে দেখেছেন। আজকে বিজেপির কোন ফোরাম থেকে রবীন্দ্রনাথের নাম উচ্চারিত হয় না, রবীন্দ্রনাথ তাদের কোন কাজে আসবে না। স্বয়ং নীরদ চৌধুরী বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ খ্রীস্টান চিন্তা-চেতনা প্রচার করেছেন। আমি বুঝতে পারি না, পশ্চিম বাংলার লোক বঙ্কিমের প্রতি অন্ধ অনুরাগ কেন রাখবেন। তারা তো অনেক বেশি মুক্তচিন্তা করতে অভ্যস্ত। কিন্তু বঙ্কিমের প্রশ্নে তারা ঢোক গেলেন কেন?
প্রশ্ন: পশ্চিম বাংলার সাহিত্য চর্চায় আপনি কি সাম্প্রদায়িকতার কোন আভাস পান?
আহমদ ছফা: না, এ বিষয়ে আমি কিছু বলবো না।
প্রশ্ন: বিদ্বেষহীন সুস্থ সম্পর্কের জন্যেই প্রয়োজন খোলামেলা মত প্রকাশ-
আহমদ ছফা: এটা অব্শ্য ভাবার বিষয়। হ্যা, কিছু পাইতো বটেই। যেমন পশ্চিম বাংলার এক জনপ্রিয় সাহিত্যিক যিনি বাংলাদেশেও জনপ্রিয় তার একটি উপন্যাসে লিখেছেন, মুসলমানরা কোরআন পড়েন উর্দু ভাষায়।
প্রশ্ন: কেউ যদি সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা সিরিজের জটায়ুর মত লেখেন যে উট তার পাকস্থলিতে জল বোঝাই করে মরুভূমির পথে হেটে চলছে…এটা অজ্ঞতা ছাড়া আর কি? এ ক্ষেত্রেও সাম্প্রদায়িকতা নয়, অজ্ঞতা বলাই কি যুক্তিসঙ্গত নয়?
আহমদ ছফা: হ্যা, তা বলতে পারেন। কিন্তু এত অজ্ঞ হওয়ার তো কথা নয়। আর এত অজ্ঞ হলে উপন্যাস লিখতে এসেছো কেন? এমন-কী ‘প্রেম নেই’ বলে যে উপন্যাসটার তারিফ করা হয়, তাও লেখা হয়েছে মুসলিম লীগের স্ট্যান্ডটাকে ভেরিফাই করার জন্যে। কংগ্রেসের ভূমিকা সম্পর্কে কোন কিছুই বলা হয় নি। যে প্রেক্ষিতটা ওখানে (পশ্চিম বাংলায়) রয়েছে, আমার বিবেচনায় তা দূষিত। অনেকেই লিখবার আগে ধরে নেয় জিন্নাহ একজন ক্রিমিনাল। পশ্চিম বাংলায় প্রচুর সুস্থ লোক রয়েছে, অসাম্প্রদায়িক লেখক আছেন যথেষ্ট কিন্তু এনটায়ার প্রেক্ষিতটাকে কেউ চ্যালেঞ্জ করছেন না।
প্রশ্ন: পশ্চিম বাংলা বা কোলকাতা সম্পর্কে আপনার এই সমালোচনা কি যুক্তিবাদী মননশীল জায়গা থেকে না কোনও ধর্মীয় অনুভূতি থেকে-
আহমদ ছফা: বাইরের লোক যখন দেখেবেন, আমি যখন সাফারার, অন্য লোক এর মধ্যে ধর্মীয় সত্তা খুজে পাবেন। কিন্তু আসল ব্যাপারটা আমার জীবনে। আমি আমার গ্রামে থাকতে পারি না, মোল্লারা আমাকে পিটিয়ে মেরে ফেলবে। কারণ আমি ইসলামের কিছুই করি না, বিশ্বাসও করি না। আমার জীবনের মধ্যে কাজ করে হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, উপজাতি। মুসলমান সমাজকে সকলে কনডেম করেন। বাংলা সাহিত্যের ষাটভাগ সাহিত্য সাম্প্রদায়িক সাহিত্য। সুতরাং আমার জনগোষ্ঠীর ওপর যে সাংস্কৃতিক অত্যাচারগুলো হয়েছে, আমি সেটাকে যদি ডিফেন্ড করি অনেকে সাম্প্রদায়িক মনে করতে পারেন। কিন্তু আমার মনে হয় না পশ্চিম বাংলার মানুষ আমাকে ভুল বুঝবেন। আমি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং যুক্তিসঙ্গত একটা জিনিসকে তুলে ধরছি। আপনি যদি এখানকার (বাংলাদেশের)হিন্দুদের সাথে কথা বলেন, দেখবেন তারা শামসুর রাহমান বা অন্যান্যদের থেকে আমাকে বন্ধু হিশেবে বেশি পছন্দ করবেন, যদি মাঝখানে ভারতের প্রসঙ্গটা না আসে। আমাদের দেশে যদি একজনও হিন্দু না থাকে তবে সাম্প্রদায়িক মোল্লাদের নিয়ে আমি বাচতে পারবো না।
প্রশ্ন: স্বাধীন মত প্রকাশের ক্ষেত্রে ধর্মীয় বা মৌলবাদী বাধা কি এখানে আছে?
আহমদ ছফা: না, সেরকম আমি কিছু মনে করি না।
প্রশ্ন: স্বাধীন চিন্তা প্রকাশ করার অধিকার এখানে আছে?
আহমদ ছফা: এটা একটা কথা, আমি যেমন ইসলামের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারি না, শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারি না, জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারি না। ধর্মীয় বা মৌলবাদের প্রভাব নয়, এটা একটা অবিকশিত সমাজের লক্ষণ। আরো দেখবেন মৌলবাদের যে উপাদান সেটা বাংলাদেশের সোসাইটিতে নেই। বাংলাদেশে পাঁচজন লোক খুঁজে পাবেন না, যে আরবি জানেন। পাঁচজন লোক পাবেন না, যে সংস্কৃত জানেন। কিন্তু আপনাদের দেশে তা ভুরিভুরি পাবেন। মৌলবাদ প্রথম জন্মায় ধর্মগ্রন্থ থেকে। বাংলাদেশে তার কোন অবস্থান নেই। এখানে যা আছে তা মধ্যযুগীয়তা। মধ্যযুগীয়তা আর মৌলবাদকে এক করে দেখা ঠিক হবে না। ভারতবর্ষে মৌলবাদ জন্মাচ্ছে সরাসরি ধর্মগ্রন্থ থেকে। যেমন, রাম মন্দির, রাম মন্দির ছিল কিনা ঐতিহাসিকরা কোন কথা বলতে পারছেন না। সুনীতি চট্টোপাধ্যায় হিন্দু মহাসভার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি বলেছেন, রাম উপন্যাসের নায়ক। এর পর সাম্প্রদায়িক হিন্দুরা তার পুত্রকে হত্যা করার হুমকি দিল। সুকুমার সেন বলেছেন, রাম শব্দের অর্থ হলো পূর্ণতা। এটি এসেছে ইরান থেকে এবং ‘রামরাজ্য’ শব্দটি গান্ধীজী নিয়েছিলেন টলস্টয়ের Kingdom of God এর ভারতীয় শব্দ হিশেবে। কিন্তু এই শব্দগুলোকে ধর্মীয় অভিধায় যুক্ত করে রাজনীতিতে এটা প্রধান শক্তি হওয়া, সে জিনিস বাংলাদেশে নেই।
প্রশ্ন: রাম শব্দের যে প্রভাব উত্তর ভারতে বা হিন্দি বলয়ে আছে বাংলায় তা নেই। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’-এ রামকে এক ক্লীব চরিত্র বা ভিখিরি হিশেবে উপস্থিত করেছেন। এই জন্যে তিনি কারো দ্বারা আক্রান্ত হন নি-
আহমদ ছফা: মাইকেল মধুসূদন দত্তর বই একশ কপির বেশি ছাপা হত না। বঙ্কিমের বই দু’শ আড়াই’শ কপির বেশি ছাপা হত না। একটা বই নিয়ে আজকে যে জনমত তৈরি হয় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হয়, সে যুগে এটা কল্পনা করা যেত না। মাইকেলের আর একটা সুবিধে ছিল তখন শাসকরা ছিলেন ইংরেজ এবং মাইকেল নিজে খ্রীস্টান হয়ে গিয়েছিলেন। খ্রিস্টানরা তখন রাজার আনকূল্য পেতেন। মাইকেলের পক্ষে মেঘনাদ বধ লেখা সম্ভব হয়েছিল দুটো কারণে। প্রথমত তিনি হিন্দু পরিমণ্ডলের বাইরে মাদ্রাজ চলে গিয়েছিলেন। মাদ্রাজ গিয়ে তিনি মহারাষ্ট্র পুরান পড়েছিলেন। আর তামিলরা রামকে নয়, রাবনকেই পূজা করেন। এসব মাইকেলকে প্রভাবিত করে। কিন্তু মাইকেল মধুসূদন যখন রাজিয়াকে নিয়ে নাটক লিখতে গেলেন, তার বন্ধুরা বাধা দিলেন। তিনি যখন কারবালাকে নিয়ে ট্রাজেডি লিখতে চাইলেন, তার বন্ধুরা বাধা দিলেন। কাজেই মাইকেল মধুসূদন দত্তকে আমরা যেভাবে চিন্তা করি, তিনি তার অবস্থার কাছে অনেক বেশি নতি স্বীকার করেছেন।
প্রশ্ন: পরবর্তী পর্যায়েও কিন্তু বাংলার পাঠকরা মাইকেল মধুসূদন দত্তকে বর্জন করেন নি…
আহমদ ছফা: তা করেন নি। কিন্তু এখনো একটা বিতর্ক থেকে গেছে, মাইকেল মধুসূদন দত্ত না শ্রী মধুসূদন। আমি বাংলা সাহিত্যের ছাত্র। মোহিতলাল থেকে প্রমথনাথ বিশী, কত বই লেখা হয়েছে। এখনো লেখা হচ্ছে, এমনকি ক্ষেত্র গুপ্তর সাম্প্রতিক বই। এসব আপনাদের নির্ণয় করতে হবে। আর আমি মনে করি মাইকেল মধুসূদন দত্ত হচ্ছেন বাংলা সাহিত্যের একমাত্র অসাম্প্রদায়িক লেখক।
অন্যদিকে দেখুন বিসর্জন লেখার পর কালীমন্দিরে রবীন্দ্রনাথের নাম উচ্চারিত হয় না। রাজর্ষি লেখার পর রামকৃষ্ণ মিশনে রবীন্দ্রনাথের কোনও কিচ্ছু উচ্চারিত হয় না।
প্রশ্ন: যুক্তিবাদী সহনশীল সমাজ গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে….
আহমদ ছফা: (উত্তেজিতভাবে) যুক্তিবাদী, সহনশীল, মুক্তবুদ্ধি এগুলি খুব খারাপ শব্দ। পরিবেশ বিশেষে এসব হয়ে যান অনেকে। আসল কথাটি হল জনগণকে তার সংস্কৃতি নির্মাণে কোনও সুযোগ দেওয়া হয় নি।
প্রশ্ন: লালন বা হাছন রাজার গান কী এ ক্ষেত্রে--
আহমদ ছফা: সাহিত্যবিলাসী লোকেরা এসব খুব বলাবলি করে। লালনেরও আগে চণ্ডীদাস বলেছেন, ‘শুনহ মানুষ ভাই, সবার ওপর মানুষ সত্য তাহার ওপরে নাই’। হিন্দু সমাজের মানুষ অবশ্য এজন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেন নাই। বাঙালি জাতিসত্তা হিশেবে লালনকে আমরা চিন্তায় লালন করি, কারণ গৌতম বুদ্ধের যে চিন্তা, তা কবীরের কাছে বাহিত হয়ে লালন তা ধারন করেছেন। লালনের গানগুলোর মধ্যে গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা ও চিন্তা এখনো বেচে আছে। অবচেতনে তা আমাদের মধ্যে ভয়ঙ্করভাবে নাড়া দেয়। রবীন্দ্রনাথও সেখানে একবার প্রণত হয়েছে। আর একটা জিনিস, লালনের গানের মধ্যে কবীরের দোহার হুবহু অনুপ্রাণিত গান আছে কয়েকশত। বুদ্ধ দেবের শিষ্যরা বুদ্ধ দেবের শিক্ষাটাকে নানা ছদ্মবেশে বাচিয়ে রেখেছেন। এটা আমাদের খুবই প্রয়োজনীয় ঐতিহ্য। তবে এসব কখনোই সমাজের চালিকা শক্তি হয় নি। থেকে গেছে Sub culture এর স্তরে।
প্রশ্ন: ‘শিক্ষা’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে দুইয়ের দশকের ঢাকায় মুক্তবুদ্ধির যে আন্দোলন হয়েছিল--
আহমদ ছফা: মুক্তবুদ্ধির চর্চা বলে যাকে গৌরবান্বিত করা হচ্ছে, তাকে মুক্তবুদ্ধির চর্চা বলে আমি বিশ্বাস করি না। বিশ্বাস করি না এই কারণে যে, এদের মধ্যে একজন ছিলেন real serious লোক। He died quite earlier। আবুল হুসেন ছাড়া আর যারা ছিলেন, পরবর্তী পর্যায়ে তারা কী কাজ করেছেন? নজরুল একা যে কাজ করেছেন, এরা সকলে মিলে কী কাজ করেছেন? যেমন আবদুল ওদুদ, এর লক্ষ্য ছিল মুসলিম ব্রাক্ষ্ম হওয়া। হুমায়ুন কবীরের রচনার মধ্যে যে যুক্তিবাদিতা, তার মধ্যে আমি বড় কিছুই খুঁজে পাই নি। বেগম রোকেয়া এর থেকে অনেক বড় কাজ করেছেন। আব্দুল ওদুদ-রা কী মুক্তবুদ্ধি করবেন! আবুল ফজল মুক্তবুদ্ধির একজন লোক, যিনি জিয়াউর রহমানের মন্ত্রী হয়েছিলেন। কাজেই এগুলো যেভাবে প্রচার করা হচ্ছে, তার সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই আমার মনের মিল নেই। আবার এ আন্দোলনটার মধ্যে একেবারেই কিছু ছিল না, তাও ঠিক নয়। অশিক্ষা ও সাম্প্রদায়িকতায় আকীর্ণ বাঙালি মুসলমান সমাজের কিছু তরুণের মধ্যে প্রথম একটা হাওয়া লেগেছে, স্পন্দন লেগেছে, আলো পড়েছে। কিন্তু ঐ চর্চা স্থায়ীত্ব পায় নি, সমাজে তারা প্রভাবও পড়ে নি।
প্রশ্ন: বাঙালি জাতির সার্বিক বিকাশের ক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলোকে অন্তরায় মনে করেন--
আহমদ ছফা: হ্যা, একটি বাধা আছে। বাঙালি যখন সর্বভারতের দায়টা কাধে নেন, সর্বভারতীয় চিন্তা চেতনায় আচ্ছন্ন হন, তখন তার জাতীয়তার ভাগে শূন্যতা উপস্থিত হয়। বাংলা হচ্ছে ভারতীয় রাজনীতিতে under Drain, দিয়েছে বেশি পেয়েছে বঞ্চনা। বাংলাতেই প্রথম ব্যাংক, শিপিং কোম্পানি, ইন্সুরেন্স কোম্পানির ব্যবসা শুরু হয়েছিল। বাংলাতে প্রথম বুর্জোয়া অর্থনীতি বিকাশের সুত্রপাত ঘটেছিল। বাঙালিরা সেসব কিছুই ধরে রাখতে পারে নি। কর্নওয়ালিস বাঙালিকে নকল ভূস্বামী বানিয়ে দিল। তখন বাঙালির ব্যবসা বাণিজ্য সব চলে গেল। এবং বাঙালি একদিকে হল বাবু অন্যদিকে কেরানি। তারপর সবক্ষেত্রে বাঙালি দিয়েছে অনেক, পেয়েছে কম। দেশ ভাগের সময় আবুল হাশিম একটা চমৎকার কথা বলেছিলেন, পশ্চিম বাংলার হিন্দুদের হলটা কী? ১৯০৫ সালে যারা মাতৃঅঙ্গ ব্যবচ্ছেদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন, অবাঙালির অর্থে, অবাঙালির চিন্তা ও মতামতের বাহক হয়ে, তারাই আজকে বাংলাকে ভাগ করছেন। যে জাতি জন্ম দিয়েছে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, প্রফুল্ল চন্দ্র, সুভাষ বসুর মতো মানুষদের, তারাই আজকে বাংলার বাইরের চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বাংলাকে ভাগ করছেন। এদের আজকে কী হল! What happened to the Bengali Hindus?
এক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটা বড় কাজ করছে। এখানে সাম্প্রদায়িকতা থাকুক, না থাকুক, মুক্তচিন্তার অবকাশ থাকুক, না থাকুক, অন্যন্য মুসলিম অঞ্চল থেকে বাংলাদেশ নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের বাঙালিকে বাঙালি পরিচয়েই বাচতে হবে সে আরবীয় হতে পারবে না, সে চাইনিজ হতে পারবে না। মাঝে মাঝে এদিক ওদিক হয়তো যাবে, কিন্তু বাঙালি পরিচয়েই আমাদের বাচতে হবে। অন্যদিকে পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের শেকড়টা কোথায়, কিংবা তাদের জাতি পরিচয়ের চেতটনাটা কতটুকু স্পষ্ট আছে। এ বিষয়ে আমাদের ঘোর সংশয় আছে। ভারতীয় পরিচয়ের ভার বহন করতে গিয়ে পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের জাতি পরিচয়টা মুছে যাচ্ছে। এসব বুঝতে পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের একটু সময় লাগবে। দিল্লি-হিন্দির আধিপত্যের গুণগান কোলকাতার শিল্পী-সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবীদরা যত করে থাকেন, ভারতের অন্য কোন শহরে এ চিত্র আপনি পাবেন না। কারণ অন্য শহরের মানুষের নিজস্ব ভাষা সংস্কৃতির সঙ্গে যে শিকড়ের সম্পর্ক আছে কোলকাতায় তা নেই। তাই হিন্দির সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য কোলকাতাতেই বেশি মেনে নিচ্ছে। আবার কোলকাতার সাহিত্যিক বা রাজনৈতিক নেতারা ঢাকায় এলে, তাদের বাংলা ভাষা প্রেম আকাশ স্পর্শ করে। এই দ্বিচারিতা কোলকাতার মজ্জাগত। কারণ কোলকাতা শহরটা হচ্ছে কলোনাইজেশনের প্রথম ডিচ। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের গোড়াপত্তন হয় ঐ শহরে। সেই কারণে সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব কলকাতা শহরে যতোটা কাজ করে ভারতবর্ষের অন্য কোনও শহরে তা করে না। কোলকাতার লোক ভারত প্রেমিক, বিশ্বপ্রেমিক হতে পারেন, ভারতকে, বিশ্বকে বুকে মাথায় নিতে পারেন। কিন্তু বাংলার সমগ্র অন্তজ জনগোষ্ঠীকে নিয়ে বাংলা ও বাঙালির জন্যে কতটা কি করতে পারবেন, এ বিষয়ে আমার গভীর সংশয় আছে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের বাঙালির সামনে কোন বাধা?
আহমদ ছফা: Absolute নয়, একমাত্র ভারত যদি আমাদের কুজো করে না রাখে। কারণ আমাদের উন্মেষের মধ্য দিয়ে দুটো জিনিস প্রমাণিত হয়েছে। ভারত যখন ভাগ হয় জিন্নাহ বলেছিলেন, ভারতের হিন্দু মুসলমান দুই জাতি। গান্ধী, নেহরু বলেছিলেন ভারত এক জাতি। পাকিস্তান হয়ে গেল ঠেকানো গেল না। হিন্দু-মুসলমান দুই জাতি এই পরিচয়েই ভাল হল। এরপর বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হল তখন আর একটি ঐতিহাসিক সত্য উঠে এল। ভারত এক জাতি নয়। দ্বিজাতি নয়। ভারত বহুজাতি। একটু আগেই আপনি প্রশ্নটা করেছিলেন, পাকিস্তান হয়েছিল বলেই বাংলাদেশ হয়েছে ইত্যাদী। কথাটা সত্য আবার সত্য নয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হয়ত কথা সত্য, কিন্তু সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে কথাটা সত্য নয়। বহুজাতিক ভারত রাষ্ট্রের বিভিন্ন জাতিগুলোর জাতি পরিচয় এবং ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এক বড় প্রেরণা এবং দৃষ্টান্ত। নানা অপূর্ণতা এবং সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও রাষ্ট্র বিজ্ঞানের সংজ্ঞা হিশেবে বাংলাদেশের উত্থান ভারত উপমহাদেশের আধুনিক ইতিহাসে সবচাইতে অভিনব ঘটনা।
ভারতের জাতীয় কংগ্রেস এবং ‘সর্বভারতীয়’ দক্ষিণপন্থী দলগুলো মনে করে বাংলাদেশ হল দ্বিজাতি তত্ত্বের ভুল সংশোধন। কিন্তু এখানে একটা শুভঙ্করের ফাকি আছে। কারণ এটা শুধু দ্বিজাতি তত্ত্ব নয়, ভারতীয় এক জাতি তত্ত্বেরও ভুল সংশোধন। এই সত্যকে ভারতের বাম-দক্ষিণ কোনও ‘সর্বভারতীয়’ দলই স্বীকার করতে চায় না। কারণ এই সত্যকে স্বীকার করলে ‘ভারতীয় ঐক্য সংহতি’ রক্ষার নামে বহুজাতিক ভারতবর্ষের জাতিগুলোর ওপর দিল্লি-হিন্দির সাম্রাজ্যবাদী ঐক্যনীতি চালানো সম্ভব নয়।
প্রশ্ন: বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ছাব্বিশ বছর পরও এখানে যে রাজনৈতিক অস্থিরত, দারিদ্র, শোষণ, অশিক্ষা এবং জাতি পরিচয় নিয়ে যে বিতর্ক চলছে, তাতে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে উপমহাদেশের জাতিগুলোর সামনে যে দৃষ্টান্ত এবং প্রেরণা স্থাপিত হয়েছে, তা কি অনেকটাই ম্লান হয়ে যাচ্ছে না?
আহমদ ছফা: হ্যা, এটা খুব ঠিক কথা। প্রথমত এখানে বুর্জোয়া সমাজ গঠিত হয় নি বলে, বুর্জোয়া চিন্তার যে বিকাশ, তা এখানে হয় নি। বাঙালি বনাম বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ নিয়ে বিতর্ক চলছে। কারণ বাংলাদেশের নির্যাতিত জনগণ ইতিহাসের চালিকা শক্তি হতে পারি নি। বাঙালি বা বাংলাদেশী এই দুই রাজনৈতিক শিবিরে বাংলাদেশের মানুষ বিভক্ত হয়ে যায়। আসলে একটা আর একটার বিরোধী নয়। এই পলিটিক্যাল ক্যাটগরিগুলো কৃত্রিমভাবে তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের নির্যাতিত জনগণ ইতিহাসের চালিকাশক্তির ভার পায় নি। এই ভার যখন সে পাবে, শোষিত জনগণের হাতে যখন ক্ষমতা আসবে তখন এই কৃত্রিম ক্যাটগরিগুলো থাকবে না। অন্য ক্যাটগরি তৈরি হবে। সেদিন বাঙালি জনগোষ্ঠীর প্রকৃত রাষ্ট্র তৈরি হবে। প্রতিবেশি ভারতের বৃহৎ রাষ্ট্রশক্তি এটা কখনোই হতে দিতে চায় না। ভারত বাংলাদেশে একটি প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী রাষ্ট্রই পছন্দ করে। এখানে একটি প্রকৃত সেকুলার সরকারের পরিবর্তে একটি মৌলবাদী রাষ্ট্র সরকারকেই পছন্দ করে। কারণ তাতে ভারত রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক অবস্থানটা যেমন অটুট থাকে। অন্যদিকে ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্রের প্রেরণটাও এতে ভোতা হয়ে যায়। কাজেই এখানে সাম্প্রদায়িক না থাকলে ভারত তা সৃষ্টি করবে এবং তথাকথিত সেকুলারিজম-এর নামে তাদের যে কলোনিয়াল কালচার পকেট আছে, একটু আগে আনন্দবাজারের ভূমিকা সম্পর্কে যা বলেছি, এরাও এখানে সক্রিয়। বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে যে সন্ত্রাস এবং অস্থিরত তার পিছনে ‘র’- এর(R.A.W) ভূমিকা কম নয়।
এই সুত্রে আপনাকে বলি, পশ্চিম বাংলার জনগণের সহযোগিতা ছাড়া আমরা স্বাধীনতা পেতাম না। এত তাড়াতাড়ি পেতাম না। ইতিহাসের ঋণ শোধের একটা ব্যাপার আছে, পশ্চিম বাংলা যদি কোনও দিন স্বাধীনতার জন্যে আন্দোলন করে আমাদের কর্তব্য হবে আপনাদের আন্দোলন সাহায্য সহযোগিতা করা তবে পশ্চিম বাংলা একা পারবে না। ভারতবর্ষের সকল নিপীড়িত জাতিগুলো মুক্তির লক্ষ্যে আলাদা আলাদা ক্ষেত্রে লড়াই চালালেও সকলের মধ্যে একটা যোগাযোগ থাকা উচিত এবং আধুনিক রাষ্ট্রের যে সংজ্ঞা তা আজ অনেক পাল্টে যাচ্ছে। একসময় ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র হত। তারপর ভাষাভিত্তিক। এখন ইকোলজিক্যাল বা পরিবেশভিত্তিক রাষ্ট্রের ধারণাটা চলে আসছে, বেঙ্গল, আসাম, উড়িষ্যা এ সমস্ত অঞ্চল মিলে একটা আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণা অনেকেই উড়িয়ে দেননি।
প্রশ্ন: এনজিও’রা বাংলাদেশে একটা প্যারালাল গভর্নমেন্ট চালাচ্ছে। এমন অভিযোগ বাংলাদেশে প্রায়ই শোনা যায়। এই অভিযোগ সম্পর্কে এবং বাংলাদেশ এনজিওদের ভূমিকা বিষয়ে--
আহমদ ছফা: এনালিটিক্যালি জিনিসটা আমি দেখতে চাই। এনজিও ওরা শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারতেও বেশ বড় ভূমিকা পালন করে। যেমন ধরুন ভারতের নর্মদা বাচাও আন্দোলন, পরিবেশ আন্দোলন, নারী আন্দোলন এগুলো সবাই এনজিও সঙ্গে যুক্ত। বতর্মান পৃথিবীতে যে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তাতে যেখানে বিশ্বব্যাংক যাবে, সেখানে এনজিও যাবে। বিশ্ব ব্যাংককে যদি আপনি এয়ারফোর্স ভাবেন, তবে এনজিও-কে ভাবতে হবে ইনফেন্ট্রি হিশেবে। এরা হচ্ছে একে অপরের পরিপূরক। বাংলাদেশে এনজিওরা একটা প্যারালাল অবস্থান নিয়েছে। এবং সেটা আশঙ্কাজনক মনে করি। আমি নিজে একটি এনজিওর সঙ্গে ছিলাম। সিভিল লিবার্টির নামে তারা রাষ্ট্র ক্ষমতার একটা অংশ দাবি করছে। সেটা আতঙ্কের কারণ এবং প্রগতিশীল রাজনীতির প্রধানতম অন্তরায় এনজিওগুলো। এটাকে কিভাবে মোকাবেলা করা হবে, তার পলিসি, স্ট্রাটেজি, তার ফিলসফি এগুলো এখনো স্পষ্টভাবে বেরিয়ে আসি নি। বিশ্বব্যাংককে কেউ ঠেকাতে পারবে না। চীনেও এনজিও গেছে। পশ্চিম বাংলায়ও এনজিও কাজ করছে। কিন্তু পলিটিক্যাল কর্তৃত্বের ভিতরে রাখার জন্যে যে সংগঠিত চিন্তাভাবনা ও পদ্ধতি নির্মাণ প্রয়োজন তা এখনো দেখা যাচ্ছে না।
প্রথম দিকে ওনজিওরা যে কাজগুলো করেছে নারী জাগরণ গ্রামের জনগোষ্ঠীকে সংগঠিত করা, নতুন টেকনিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি নিয়ে কাজ করা-এসব হল ইতিবাচক দিক। আর নেতিবাচক দিক হলো এনজিওরা ম্যানুফ্যাকচারিং-এ চলে যাচ্ছে। যেমন অধ্যাপক ইউনুস, তিনি নিজে একজন শিল্পপতিও বটে। আমাদের রেজিস্টার্ড এনজিও আছে ঊনিশ হাজার। ঊনিশ হাজারের মধ্যে যেটাকে এ্যডাব বলা হয়, এনজিওদের শিক্ষিত প্রতিষ্ঠান তার সদস্য সংখ্যা আটাত্তর। কিন্তু মাত্র ছয়টি এনজিও কন্ট্রোল করে ৮২ শতাংশ রিসোর্স। এবং এই ছয়টি এনজিওই একটা প্যারালাল গভর্নমেন্ট তৈরি করছে। এরা ব্যবসা বাণিজ্য করছে কিন্তু কোন ট্যাক্স দেয় না। হিউম্যান রাইটসের কথা বলে, কিন্তু তাদের কর্মীরা কোন রাইট পায় না। এ ব্যাপারে আপনি আমাদের বন্ধু ফরহাদ মজহারকে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারবেন। বড় বড় এনজিওগুলোতে কর্মীদের ইউনিয়ন করার অধিকার নেই।
প্রশ্ন: ভারতীয় সংবিধানের কাঠামোর মধ্যে একুশ বছর ধরে পশ্চিম বাংলায় একটি বামপন্থী সরকার চলছে। বামপন্থীদের দ্বারা পরিচালিত পশ্চিমবঙ্গ সরকারটি সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন--
আহমদ ছফা: ১৯৭১ সালে আমি ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্য দরখাস্ত করেছিলাম। আমি কমরেড মোজাফফর আহমদের পিএ হিশেবে কাজ করতে চেয়েছিলাম, করেছিও। আমি নিজে মার্কবাদী ঘরানা থেকে তৈরি হয়েছিলাম। পশ্চিম বাংলার গ্রামীণ জীবন এবং অর্থনীতিতে বামফ্রন্ট কিছু কাজ করতে পেরেছে। এসব কোন বৈপ্লবিক কাজ নয়। সে ক্ষমতাও তাদের নেই। শহরে বামফ্রন্ট কিছুই করতে পারে নি। শহরগুলোতে যে capital accumulated হয়েছে সেগুলো সব অবাঙালীদের capital। বামফ্রন্ট সরকারকে এদের ওপর নির্ভর করে থাকতে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত পশ্চিম বাংলাতে চিন্তা চেতনার যে চর্চা, তাতে সিপিএম-এর মধ্যে এক ধরনের সংস্কৃতিহীনতা কাজ করে। রাজনীতিকভাবে (পশ্চিম বাংলায় ক্ষমতায় থাকার প্রশ্ন) যে সাফল্য তারা অর্জন করেছেন, চিন্তা চেতনা উজ্জীবনে তাদের অবদান খুবই দুর্বল। ফলে সৃষ্টি হয়েছে এক ধরনের শূন্যতা। চিন্তার ক্ষেত্রে নতুন কোন লোক সিপিএম-এ আসছে না। এর ফলে তৈরি হচ্ছে বিশাল বিশাল কৃষ্ণ গহ্বর। যার প্রথম আউট বাস্ট দেখলেন মমতা বন্দোপাধ্যয়ের আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে এবং শ্রীমতি বন্দোপাধ্যায় বিজিপেকে সঙ্গে নিয়ে লোকসভা নির্বাচনে বেশ কিছু সাফল্যও পেয়ে গেলেন। হয়ত এরকম আরো আউট বাস্ট দেখার জন্য আমাদের তৈরি থাকতে হবে। যে পশ্চিম বাংলাকে আমরা দেখতাম সেকিউলারিজমের একটা আদর্শ, আপনারা কতদিন সে আদর্শকে ধরে রাখতে পারবেন, এ বিষয়ে সন্দেহ জাগছে। হয়তো আর একটা নির্বাচনে বামফ্রন্ট বিজয়ী হবে। কিন্তু তারপর? বিশ বছর ক্ষমতায় থাকার ফলে তাদের মধ্যে যে ক্লান্তি, যে মন্থরতা, স্টেগনেন্সি তাকে কাটিয়ে তোলার জন্য সিপিএমএ বামফ্রন্ট কিছু করে উঠতে পারে নি। আর পশ্চিম বাংলার বাঙালির যে সার্বিক অবক্ষয়, তাও তো বাম শাসকরা আটকাতে পারেন নি। পশ্চিম বাংলায় হিন্দির যে চাপ এবং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির কোণঠাসা অবস্থা, সে সম্পর্কেই বা বামফ্রন্টের দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভুমিকা কী? আজকে হয়তো বামফ্রন্ট বা সিপিএমকে এসব প্রশ্নের মুখোমুখি সেভাবে হতে হচ্ছে না। কিন্তু আগামি দিনে বাঙালি জাতির অস্তিত্ত্বের প্রশ্নটা পশ্চিম বাংলার প্রধান রাজনৈতিক বিষয় হিশেবে উঠে আসবে, সেদিন কোন বক্তব্য নিয়ে সিপিএম বাঙালি জাতির সামনে দাঁড়াবে?
প্রশ্ন: বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বাংলাদেশের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক চরিত্রের কাঠামোগত পরিবতর্ন ঘটেছে। ইসলামকে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। গত একুশে ফেব্রুয়ারি(১৯৯৮) সকালে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের কাছে একটা ব্যানার চোখে পড়লো। যেখানে লেখা ছিল একুশের চেতনা রাষ্ট্রধর্ম মানে না। এ বিষয়ে-
আহমদ ছফা: আমি স্পষ্ট ভাষায় এ বিষয়ে লিখেছি। ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করে, ইসলামের কোন সহায়তা করা হয়নি। বিশেষ বিশেষ শ্রেণী এবং বিশেষ বিশেষ গ্রুপের স্বার্থেই এসব করা হয়েছে। এতে বাংলাদেশের কোন উপকার করা হয় নি। আর রাষ্ট্রের যে চারিত্রের কথা বললেন, শেখ মুজিব যে সংবিধান তৈরি করলেন তা তিনি নিজেই অমান্য করলেন। ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান তৈরি করে ইসলামি কনফারেন্সে তিনি নিজেই গেলেন। সংবিধান পাল্টে তিনি প্রেসিডেন্ট হলেন। শেখ মুজিব বেচে থাকতেন, তাহলেও এক সময় না এক সময় বাংলাদেশের সংবিধানের পরিবর্তনগুলো হয়েছে, তা তিনি নিজেই করতেন বলে আমার ধারণা। আজকে বাংলাদেশের যে পরিবর্তনগুলো এসেছে, সব পরিবর্তনগুলো কি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে নৈরাজ্যগুলো তৈরি হয়েছে, শেখ মুজিবের সময় থেকেই এর সূচনা। তিনি গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ করে একনায়কতন্ত্রের পথ ধরলেন। পরবর্তীকালে অন্যরা সেই প্রক্রিয়ার সুযোগ নিয়েছে। আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায়। রুচিশীল নাগরিক যারা আছেন, তারা সকলেই রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিরোধীতা করেছেন, প্রচণ্ড বিরোধীতা করেছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার রাষ্ট্রধর্মকে বাতিল করছে না।
প্রশ্ন: কয়েকদিন আগে চট্টগ্রাম শহরের রেল স্কুলের দেওয়ালে একটি দেওয়াল লিখন চোখে পড়ল। সেই দেওয়াল লিখনে একটি ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে –‘বাধ্যতামূলক ধর্মশিক্ষা বাতিল করা’--
আহমদ ছফা: ধর্মশিক্ষাকে আমি সমর্থন করি না। তবে ধর্মশিক্ষা বাতিল করার যে পদ্ধতিটা বলা হচ্ছে, সেই পদ্ধতির বিরুদ্ধে আমি কথা বলছি। সরকার বলছেন, মাদ্রাসা শিক্ষাগুলো চেঞ্জ করবেন। কিন্তু স্কুল কলেজে ছাত্র যত মাদ্রাসার ছাত্র সংখ্যা তার চেয়ে বেশি। তাদের ওপর জোর করে যদি কিছু চাপিয়ে দেওয়া হয়, তারা বিরোধীতা করবে। এবং এতে পরিবর্তনটা আটাকে যাবে। আমার বক্তব্য মাদ্রাসা শিক্ষার লোকাদের সঙ্গে বসো, কনভিন্স করো যুগের প্রয়োজন। অর্থাৎ যাদের জন্য পরিবর্তন করবেন তাদেরও যদি আপনি অংশীদার না করেন, তবে সেটা কার্যকর হবে না। সুতরাং যেভাবে কাজ করলে পরিবর্তনটা সম্ভব, সেই প্রক্রিয়াটা কেউ গ্রহণ করছেন না।
অক্সফোর্ড কেমব্রিজ একসময় মাদ্রাসা ছিল। সেখানে ধর্ম শিক্ষাই দেওয়া হত। যুগের প্রয়োজনে সেখানে কি পরিবর্তন হয় নি? এই মাদরাসাগুলোকে কারিগরি শিক্ষা এবং আরো আধুনিক শিক্ষার কেন্দ্র হিশেবে গড়ে তুলতে পারি। মাদ্রাসার লোকজনদের বুঝিয়ে নতুন যুগের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আসা, তাদেরকে মানসিকভাবে, নৈতিকভাবে তৈরি না করে, তাদের ওপর কতগুলো পরিবর্তন চাপিয়ে দিলে তা আর পরিবর্তন হবে না। শেখ মুজিব সমাজতন্ত্র করতে চেয়েছিলেন, হয়েছে কী? উল্টোটা হয়েছে। ধনতন্ত্র হয় নি, সমাজতন্ত্র হয় নি , পরে হয়েছে একটা লুটপাটতন্ত্র।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে নারী মুক্তি প্রসঙ্গে কারো কারো মন্তব্য ধর্মীয় অনুশাসনই নারী মুক্তির প্রধান বাধা--
আহমদ ছফা: ধর্ম তো এখানে আছেই। ধর্ম তো সবার ব্যাপারে কথা বলছে, তবুও নারীর অধিকার অর্জনের ক্ষেত্রে ধর্ম একটা বাধা হয়ে আছে, একথা আমি মনে করি না। আপনাকে একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমাদের গ্রামে একটা সৈয়দ বাড়ি আছে, ছোট বেলায় সেই বাড়ির মেয়েদের আমরা কখনো চোখে দেখতাম না। সেই বাড়ির মেয়েরা ছিল অসূর্যস্পশ্যা। শুনতাম সৈয়দ বাড়ির অমুকের একটা মেয়ে আছে, সে বড় হচ্ছে। ওই মেয়ের কি রকম রং, কী রকম চেহারা নিয়ে সে বড় হচ্ছে এ বিষয়ে আমাদের কৌতুহল ছিল। কিন্তু কখনোই তাকে চোখে দেখার সুযোগ ঘটে নি। প্রায় বিশ বছর বাদে গ্রামে গিয়ে দেখি, সেই সৈয়দবাড়ির মেয়েরা বাসে চড়ে শহরের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে যাচ্ছে। বিশ বছর আগে এটা কল্পনারও অতীত ছিল। আপনি তো নিশ্চয়ই দেখেছেন ঢাকা শহরের হাজার হাজার মেয়ে প্রতিদিন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে যাচ্ছে। এ দৃশ্য আগে কল্পনা করা যেত না। কাজেই ক্ষেত্র প্রস্তুত হলে ধর্ম কোন বাধা থাকে না। শিল্প স্থাপন হলে নারী জাগরণের পথকে কোন অনুশাসনই আটকে রাখতে পারে না।
প্রশ্ন: সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর যে শান্তিচুক্তি হয়েছে, তার পক্ষে বিপক্ষে নানা বিতর্ক শুনছি--
আহমদ ছফা: আইয়ুব খার আমলে রেল লাইন উপড়ে ফেলেছিলাম, ফলে সে সময়ে আমার ওপর হুলিয়া জারি হয়। আড়াই বছর আমি পার্বত্য চট্টগ্রামে পালিয়ে ছিলাম। আমার হিন্দু বন্ধুরা ভারতে চলে গেল, আর আমি পার্বত্য চট্টগ্রামে। পাহাড়ী মানুষের সরলতা, আতিথেয়তা, বিশ্বাসপরায়ণতা ইত্যাদি আমি যেভাবে অনুভব করেছি খুব কমই লোকই তা করেছেন এবং ১৯৬৪ সালে পাহাড়ি জনগণের রাইটের সপক্ষে আমি লেখালেখি করছি। আপনি তো লক্ষ্য করে থাকবেন কিছু দিন আগেও আমাদের এখানে একটি চাকমা মেয়ে স্কুলের মাস্টার ছিল। আমি শান্তি চেয়েছি, চাকমাদের অধিকারও চেয়েছি। কিন্তু যে চুক্তিটা হয়েছে, আমি মনে করি না, তা শান্তি আনার পক্ষে অনুকুল হবে। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর যে সংগ্রাম, তার পাশাপাশি এটা হচ্ছে উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্য জাতিগুলোর যে সংকট ও সংগ্রাম তার সঙ্গে যুক্ত। পাশে ভারত না থাকলে এই সংকট এত তীব্র হতো না। সুতরাং এত তাড়িঘড়ি কিছু না করে আমার প্রস্তাব ছিল আস্তে আস্তে মনোরঞ্জন করে তাদের মূল ধারায় ফিরিয়ে এনে শান্তিতে পৌছানো যেত। এখন তড়িঘড়ি কতগুলো শর্ত ও দফা দিয়ে চুক্তি হয়েছে। কিন্তু পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রধান সমস্যা যেটা আমি বলেছিলাম, যা বিবিসি, ভয়েস অফ আমেরিকা ইত্যাদিরা প্রচার করেছে, তা হলো পার্বত্য চট্টগ্রামে যে মূলধন খাটে, তার পাঁচভাগও পার্বত্য জনগোষ্ঠীর নয়। সমতল অঞ্চলের মূলধন ওখানে গিয়ে তাদের শোষণ করে। এই প্রক্রিয়াটা শুরু হয়েছে প্রায় দুশো বছর আগে । তাই প্রথম কর্তব্য ছিল পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে capital accumulate করার জন্য কিছু ব্যবস্থা করা। সেটা হচ্ছে, যেমন তাদের লঞ্চের ব্যবসা, কাঠের ব্যবসা এসব ওদের ছেড়ে দেওয়া হোক। কিন্তু সেসব কিছু না করে একটা চুক্তি করা হল। এতে কী পাহাড়ে শান্তি আসবে। আমার মনে হয় না।
কলকাতা বইমেলা ’৯৯ সংখ্যার জন্য কলকাতার স্বাধীন বাংলা সাময়িকীর পক্ষে আহমদ ছফার এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করা হয়েছিল। এই সাক্ষাৎকারটি বাংলাবাজার পত্রিকা তাদের পাঠক-পাঠিকাদের জন্য সেখান থেকে নিয়ে তিন কিস্তিতে (১৮ মাঘ ১৪০৫/ ৩১ জানুয়ারি ১৯৯৯, ১৯ মাঘ ১৪০৫/১ ফেব্রুয়ারী ১৯৯৯, ২০ মাঘ ১৪০৫/২ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯) আবার ছাপে।
সত্যজিৎ রায়ের সাক্ষাৎকার
সিনিঅ্যাস্ট সাময়িকীর সাথে সত্যজিৎ রায়ের সাক্ষাৎকার, ১৯৮১
সিনিঅ্যাস্ট: “পথের পাঁচালী” আপনাকে কিভাবে পরিবর্তন করেছে। এটা কি বাংলা আবিষ্কারে আপনাকে সাহায্য করেছে?
সত্যজিৎ রায়: পথের পাঁচালী নির্মাণের সময়ই আমি গ্রামীণ জীবন আবিষ্কার করেছি। এতে কোন সন্দেহ নেই। আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা সবই শহরে, তাই গ্রাম সম্পর্কে সম্যক ধারণা এর আগে ছিল না। গ্রামে গ্রামে ঘুরে লোকেশন শিকার এবং খুঁজে পাওয়ার পর সেখানে কিছুদিন থাকা, এগুলোই আমাকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। মানুষের সাথে কথা বলা, ভাবগতি, প্রাকৃতিক পরিবেশ, দৃশ্য ও শব্দ সবকিছুর প্রতি আমার প্রতিক্রিয়া এক্ষেত্রে কাজে দিয়েছে। কিন্তু যারা গ্রামে বড় হয়েছে তারাই কেবল গ্রাম নিয়ে সিনেমা করতে পারে এটা ঠিক না। বহিরাগতদের পক্ষেও গ্রামের সংস্কৃতি ও পরিবেশ ফুটিয়ে তোলা সম্ভব।
সিনিঅ্যাস্ট: সিনেমা করতে গিয়ে কাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন?
রায়: আমার উপর বিভূতিভূষণের (“অপু ত্রয়ী” ও “অশনী সংকেত” এর লেখক) প্রভাব অনেক। সত্যি বলতে পথের পাঁচালী পড়েই আমি গ্রাম চিনেছিলাম। তার সাথে আমি এক ধরণের বন্ধুত্ব অনুভব করতাম। গ্রাম এবং গ্রামের প্রতি বিভূতিভূষণের দৃষ্টিভঙ্গিই আমাকে পথের পাঁচালী করতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। এ উপন্যাস আমাকে প্রচণ্ড প্রভাবিত করেছিল।
আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দ্বারাও বেশ প্রভাবিত, তার সাহিত্য অনেক সময় গ্রামকেন্দ্রিক না। আমাদের সাংস্কৃতিক পটভূমি ও অবকাঠামো অবশ্যই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিশ্রণে গঠিত হয়েছে। ভারতের কোন শহরে যে বড় হয়েছে এবং ইংরেজি সাহিত্যের ধ্রুপদী রচনার সাথে যার ছোটবেলায়ই পরিচয় হয়েছে তাদের সবার সম্পর্কেই এ কথা খাটে। তাছাড়া, পশ্চিমারা আমাদের দেশ সম্পর্কে যতটা জানে আমরা পশ্চিম সম্পর্কে তার থেকে অনেক বেশি জানি। আমরা পাশ্চাত্যের শিক্ষাকেই গ্রহণ করেছি। পশ্চিমা সঙ্গীত, পশ্চিমা শিল্প, পশ্চিমা সাহিত্য সবকিছুই ভারতে অনেক প্রভাব বিস্তার করেছে।
ভাব প্রকাশের সম্পূর্ণ প্রাযুক্তিক মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্রের জন্ম পশ্চিমেই হয়েছে। সময়ের মধ্যেই কোন একটি শিল্প অস্তিত্বশীল থাকতে পারে- এই ধারণা পাশ্চাত্যের, ভারতের না। তাই একটি মাধ্যম হিসেবে সিনেমাকে বোঝার জন্য পাশ্চাত্য এবং পাশ্চাত্যের শিল্পের সাথে পরিচয় থাকা জরুরী। বাংলার লোক শিল্পী বা আদিম শিল্পীদের পক্ষে শিল্প মাধ্যম হিসেবে সিনেমাকে বোঝা সম্ভব না। তাই যার পশ্চিমা শিক্ষা আছে তার পক্ষে সিনেমা বোঝা অনেক সহজ।
সিনিঅ্যাস্ট: ভারতীয় সমালোচকরা প্রায়শই বলেন, পথের পাঁচালী যুগ পরিবর্তনকারী সিনেমা কারণ এটা ভারতের অর্থনীতিতে বিশাল পরিবর্তন এনেছে। এটা প্রমাণ করেছে যে স্টুডিওর পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াও লাভজনক সিনেমা তৈরি সম্ভব। এই সিনেমার কি আসলেই তাৎক্ষণিক প্রভাব ছিল?
রায়: আমার মনে হয় না। দর্শক ও সমালোচকরা মুক্তি পাওয়ার পরপরই এটাকে যুগান্তকারী সিনেমা হিসেবে অভিহিত করেছে, কিন্তু চলচ্চিত্র নির্মাতারা এত তাড়াতাড়ি প্রভাবিত হয়নি। সে সময় অন্য কোন পরিচালকের কাজে পথের পাঁচালীর প্রভাব দেখা যায়নি। প্রভাবটা কাজে দিয়েছে আরও পরে। গত ৫-৬ বছর ধরে পুনার ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে যেসব শিক্ষার্থী পাশ করে বেরিয়ে আসছে তারা বলছে, পথের পাঁচালী তাদেরকে প্রভাবিত করেছে।
সিনিঅ্যাস্ট: ভারতের বাইরে আপনার সিনেমার এত গ্রহণযোগ্যতা দেখে কি বিস্মিত হয়েছেন?
রায়: আমি কখনোই ভাবিনি আমার সিনেমা, অন্তত পথের পাঁচালী, পুরো দেশজুড়ে বা দেশের বাইরেও প্রদর্শিত হবে। কিন্তু বাস্তবে এমনটা হয়েছে। এটা প্রমাণ করে যে, সর্বজনীন অনুভূতি, সর্বজনীন সম্পর্ক, আবেগ এবং চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে পারলে সিনেমা কিছু বাঁধা অতিক্রম করে সবার কাছে পৌঁছে যেতে পারে, এমনকি অবাঙালিদের কাছেও।
সিনিঅ্যাস্ট: কোন সিনেমা করে সবচেয়ে অসন্তুষ্ট হয়েছেন?
রায়: চিড়িয়াখানা। এটা অবশ্য এখন দেখানোও হচ্ছে না। একটা কারণ হল, এর বিষয়বস্তু আমি পছন্দ করতাম না। পরিবেশ-পরিস্থিতির চাপেই এটা করতে বাধ্য হয়েছিলাম। আমার কিছু সহযোগীর এটা করার কথা ছিল, কিন্তু তারা হঠাৎই সাহস হারিয়ে ফেলে এবং আমাকেই কাজ শেষ করতে বলে।
চিড়িয়াখানা একটা “হুডানইট” (whodunit) এবং হুডানইট থেকে কখনও ভাল সিনেমা হয় না। আমি এমন থ্রিলার পছন্দ করি যেখানে ভিলেন কে, তা প্রথম থকেই বোঝা যায়। আর হুডানইট সিনেমায় তো শেষে একটা প্রথাগত দৃশ্য থাকতেই হয় যেখানে গোয়েন্দা তার রহস্যভেদের জটিল কাহিনী সবাইকে বুঝিয়ে দেয়। অপরাধীদের সম্পর্কে পাওয়া বিভিন্ন ক্লু এই দৃশ্যেই জোড়া লাগে। এ ধরণের কাঠামোতে আমি খুব একটা আগ্রহী নই।
সিনিঅ্যাস্ট: কোন সিনেমা করে সবচেয়ে সন্তুষ্ট হয়েছেন?
রায়: যে সিনেমাটা আমাকে আবার বানাতে বললে ঠিক আগের মত করেই বানাবো সেটা হল “চারুলতা”। এছাড়া আরও কিছু সিনেমাকে আমি প্রশংসা করি, যেমন “অরণ্যের দিনরাত্রি”। ছোটদের সিনেমার মধ্যে “জয় বাবা ফেলুনাথ”। এই সিনেমায় সবকিছু খুব ভালভাবে ফুটে উঠেছে। এতে সরস বুদ্ধির ছাপ আছে। চমৎকার কিছু মুখ ও দৃশ্য আছে, অভিনয়ও চমৎকার হয়েছে। মিউজিক্যাল সিনেমা বানানোটাও খুব উপভোগ করি কারণ এক্ষেত্রে সুর করার একটা সুযোগ আসে। তাছাড়া এসব সিনেমা বানিজ্যিকভাবে সফল হওয়ায় একটা ভিন্ন ধাঁচের সন্তুষ্টি এনে দেয়। কাঞ্চনজঙ্ঘাও পছন্দ করি, সম্ভবত আমার প্রথম মৌলিক চিত্রনাট্য ও খুব ব্যক্তিগত সিনেমা হওয়ার কারণে। এটা সময়ের থেকেও ১০-১৫ বছর এগিয়ে ছিল।
সিনিঅ্যাস্ট: এটাতে এক ধরণের খণ্ডিত ন্যারেটিভ দেখা আছে।
রায়: হ্যা। আমাদের দর্শকরা একটি কেন্দ্রীয় চরিত্র পছন্দ করে, কিংবা এমন কয়েকটি কেন্দ্রীয় চরিত্র চায় যাদেরকে তারা দেখেই চিনতে পারবে। এর পাশাপাশি সরলরৈখিক ন্যারেটিভ তাদের খুব পছন্দ। কাঞ্চনজঙ্ঘা অনেকগুলো চরিত্র নিয়ে কথা বলেছে এবং এখানকার ন্যারেটিভটাও নন-লিনিয়ার, পরের ঘটনা আগে বা আগের ঘটনা পরে দেখিয়েছি। ১ নম্বর গ্রুপ, তারপর যথাক্রমে ২, ৩ ও ৪ নম্বর গ্রুপকে ফোকাস করা হয়েছে, এরপর আবার ১ নম্বর থেকে শুরু করা হয়েছে। সিনেমার এই গড়ন খুব মিউজিক্যাল, কিন্তু দর্শকরা তা পছন্দ করেনি। প্রতিক্রিয়া ছিল খুবই বাজে। এমনকি সমালোচকরাও সন্তুষ্ট হয়নি। কিন্তু এখন পেছন ফিরে তাকালে বুঝতে পারি, সিনেমাটা খুব কৌতুহলোদ্দীপক।
সিনিঅ্যাস্ট: আপনার সিনেমার নারী চরিত্রগুলোকে পুরুষ চরিত্রের চেয়ে বেশি শক্তিশালী ও প্রত্যয়ী দেখা যায়, তারা পুরুষদের চেয়ে দ্রুত মানিয়ে নিতে পারে এবং প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠতে পারে। এটা কি বাংলার সংস্কৃতিক ইতিহাসের প্রতিফলন?
রায়: এটা অধিকাংশ সময়ই লেখকদের চিন্তাধারার প্রতিফলন। মূল বইয়ে লেখক কি বোঝাতে চেয়েছেন সেটা প্রকাশ করতে গিয়েই এমনটি হয়েছে। রবী ঠাকুর ও বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যে অনেক শক্তিশালী নারী চরিত্র দেখা যায়। অবশ্য নারীদের সাথে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও তাদের প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলনও ঘটেছে।
সিনিঅ্যাস্ট: আপনার দৃষ্টিভঙ্গিটা কী রকম?
রায়: দৈহিক দিক দিয়ে পুরুষদের মত শক্তিশালী না হলেও প্রকৃতি নারীদের এমন কিছু বৈশিষ্ট্য দিয়েছে যার মাধ্যমে তারা এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারে। তারা অপেক্ষাকৃত বেশি সৎ, অকপট এবং অনেক দিক দিয়েই বেশি শক্তিশালী। আমি সব নারীর কথা বলছি না, যেসব নারী চরিত্র আমাকে মুগ্ধ করে তাদের কথাই বলছি। সিনেমায় এমন নারী চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে চাই যারা পরিস্থিতির সাথে পুরুষদের চেয়ে ভাল মানিয়ে নিতে পারে।
সিনিঅ্যাস্ট: চারুলতা কি তেমনি একটি চরিত্র?
রায়: হ্যা, অবশ্যই।
সিনিঅ্যাস্ট: জলসাঘর থেকে শুরু করে শতরঞ্জ কি খিলাড়ি পর্যন্ত আপনি কখনও প্রাচীন সংস্কৃতি কখনও নবীন সংস্কৃতি, কখনও প্রথা কখনও প্রগতি নিয়ে কাজ করেছেন। মাঝেমাঝে আমার মনে হয় আপনি প্রথা ও প্রাচীন সংস্কৃতির দিকে বেশি ঝুঁকে যাচ্ছেন এবং নবীন সংস্কৃতিকে খুব একটা গ্রহণ করছেন না।
রায়: শতরঞ্জ কি খিলাড়িতে আমি নবীনকে গ্রহণ করিনি এটা ঠিক না। একটা বিষয় খুব পরিষ্কারভাবে প্রকাশ করেছি, সামন্ত প্রভুরা তাদের চারপাশে যা ঘটছে তার সাথে খুব একটা সম্পৃক্ত না। চরিত্রগুলোর প্রতি অনেক সময়ই সহানুভূতি দেখিয়েছি, এসব চরিত্র দিয়ে যে কোন কাজ হবে না এই মনোভাবও প্রকাশ করেছি। কিন্তু আমি বয়ে চলা জীবনটার দিকেই বেশি আগ্রহী, জীবন চালনার স্বাভাবিক পন্থাকেই আমি প্রতিনিধিত্ব করতে দেই। চেকভের “দ্য চেরি অর্কার্ড” এ আপনি একই জিনিস দেখবেন যা আমাকে মুগ্ধ করে।
সামন্ত প্রথা ভুল এবং নির্বুদ্ধিতা এটা বললে অবশ্যই বিভিন্ন পক্ষ থেকে আক্রমণের ঝুঁকি থাকে। কিন্তু এ ধরণের সিনেমার চরিত্রগুলো সম্পর্কে এক ধরণের সহানুভূতি অগ্রাহ্য করা যায় না। তাদের অবস্থা খুব করুণ, অনেকটা ডাইনোসরের মত যারা নিজেদের ধ্বংস হওয়ার কারণটাও জানতে পারেনি। এসব চরিত্রের প্রতি যে করুণা করতে হয় তাতে আমি বেশ আগ্রহী।
সিনিঅ্যাস্ট: পাশ্চাত্যের অধিকাংশ শহরেই মনে করা হয় ভারত সম্পর্ক আপনার দৃষ্টিভঙ্গি বেশ শীতল ও নৈরাশ্যজনক।
রায়: একমাত্র “জন অরণ্য” সম্পর্কেই এ ধরণের কথা বলা যায়।
সিনিঅ্যাস্ট: কিন্তু অনেকে তো “অরণ্যের দিনরাত্রি” কেও নৈরাশ্যজনক হিসেবে দেখেছেন।
রায়: আমি এটাকে এতোটা হতাশাব্যঞ্জক বলব না। বেশ কিছু অপ্রিয় সত্য এখানে বলা হয়েছে কিন্তু সেগুলো নাটকেরই অংশ, সব সিনেমা সম্পর্কেই এ কথা প্রযোজ্য। পশ্চিমা অনেক সিনেমাতেও মাঝেমাঝে পশ্চিমা মূল্যবোধ সম্পর্কে খুব হতাশাব্যঞ্জক মনোভাব পাওয়া যায়। সবসময় আসলে খুশীর সিনেমা বানানো সম্ভব না।
সমস্যা নিয়ে যদি সিনেমা করেন, কিন্তু আপনার কাছে সেই সমস্যা সমাধানের কোন উপায় না থাকে, তাহলে সেটা নৈরাশ্যজনক হতে বাধ্য। মহানগর এ স্বামী-স্ত্রী দুজনেই তাদের চাকরি হারায়। আশেপাশে কোন চাকরিও নেই। তাদের মধ্যে মনোমালিন্য হয়, ভুল বোঝাবোঝির সৃষ্টি হয়, কিন্তু একসময় তারা আবার একত্রিত হয়। একত্রিত হয়েছে, কিন্তু তাদের কিন্তু এখনও কোন চাকরি নেই। বেশ কিছু দিন চাকরি ছাড়াই হয়ত থাকতে হবে তাদের, কিন্তু এই সমাপ্তি সিনেমাকে নৈরাশ্যজনক করে না।
আমার করা একমাত্র নৈরাশ্যজনক সিনেমা হচ্ছে জন অরণ্য। এ নিয়ে কোন সংশয় নেই। চারদিকে দুর্নীতির সমারোহ দেখে এটা করার তাড়া অনুভব করেছিলাম। কলকাতায় সবাই দুর্নীতি নিয়ে কথা বলে। সবাই জানে। যেমন রাস্তা ও পাতাল রেল করার জন্য যে সিমেন্ট বরাদ্দ দেয়া হয় তার পুরোটা যে কনট্রাক্টরদের হাতে যাবে এবং তা দিয়ে যে তারা নিজেদের বাড়িঘর বানাবে এটা সবারই জানা। জন অরণ্য এরকম দুর্নীতি নিয়ে কাজ করে, এবং আমার মনে হয় না এর কোন সমাধান আছে।
সিনিঅ্যাস্ট: আপনি অনেক সময় বলেছেন যে, আপনার মনে হয় না একজন শিল্পীর জন্য কোন প্রশ্নের উত্তর দেয়া, পরিস্থিতির বিচার করা বা ভাল-মন্দ সম্পর্ক মনোভাব ব্যক্ত করা আবশ্যক। এমনকি শিল্পীর এমনটা করা উচিত না বা এটা তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ না- এমনটিও বলেছেন। মূলধারার রাজনৈতিক বক্তব্য থেকে আপনি সবসময়ই দূরে থেকেছেন।
রায়: মৃণাল সেন সহ অন্য যে কারও চেয়ে স্পষ্টভাবে আমি রাজনৈতিক বক্তব্য প্রকাশ করেছি। জন অরণ্য তে একটা লম্বা কথোপকথন দেখিয়েছি যেখানে কংগ্রেস সদস্য তার ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করে। সে বেকুবের মত কথা বলে, মিথ্যা বলে, কিন্তু তার উপস্থিতি খুব তাৎপর্যপূর্ণ। অন্য কোন পরিচালক সিনেমা করলে এই দৃশ্যকে ছাড় দেয়া হতো না। কিন্তু পরিচালক কতটা বলবে তার একটা সীমা থাকা উচিত। আপনি জানেনই যে, কিছু বক্তব্য বা দৃশ্যায়ন সেন্সর বোর্ডে ছাড় পাবে না, তাহলে সেগুলো বানিয়ে লাভ কী?
সিনিঅ্যাস্ট: ভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে চলচ্চিত্র পরিচালকের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত- গৌণ পর্যবেক্ষক নাকি সক্রিয় কর্মী?
রায়: আপনি হীরক রাজার দেশে দেখেছেন? এতে বাড়িঘর উচ্ছেদের একটা দৃশ্য আছে- রাজার আদেশে বস্তিবাসী গরিবদের বাড়িঘর উচ্ছেদ করা হয়। ইন্দিরা গান্ধির জরুরী শাসনের সময় দিল্লী ও ভারতের অন্যান্য শহরে ঠিক এমন ঘটনাই ঘটেছিল। হীরক রাজার দেশের মত রূপকথার সিনেমায় অনেক কিছু সরাসরি বলে ফেলা যায়, কিন্তু বাস্তব চরিত্র নিয়ে কাজ করার সময় সেন্সরশিপের কথা মাথায় রেখে সীমা নির্ধারণ করতে হয়। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলকে আক্রমণ করে কিছু বলা অসম্ভব। “দ্য স্টোরি অফ আ চেয়ার” সিনেমায় এটা করতে চেয়েছিলাম বলেই শেষ করতে পারিনি, সিনেমাটা ধ্বংস হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে কিই বা করার আছে? সমস্যাগুলো সম্পর্কে আপনি সচেতন থাকতে পারেন, সেগুলো সমাধানের চেষ্টাও করতে পারেন, কিন্তু সবকিছু করতে হবে সীমার মধ্যে। আমাদের জন্য বেঁধে দেয়া এই সীমার বাইরে যাওয়া একেবারেই সম্ভব না।
সিনিঅ্যাস্ট: অনেকে তো মনে করে, এর মাধ্যমে আপনি চলচ্চিত্রকার হিসেবে নিজের সামাজিক দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছেন। বেশ কয়েকজন সমালোচক, বিশেষত বাংলার সমালোচকরা বলছেন, আপনি যথেষ্ট রাজনীতি সচেতন নন, আপনি চাইলে আরও কিছুদূর এগোতে পারতেন। তাদের মতে, আপনি নিজের সীমা কতদূর তা চেখে দেখেননি।
রায়: না, আমি মনে করি না আমার পক্ষে এর চেয়ে বেশি দূর যাওয়া সম্ভব। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মত লক্ষ্যবস্তুগুলোকে আঘাত করা খুব কঠিন কিছু না। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান কোনকিছুর পরোয়া করে না। আপনি যাই বলেন না কেন, এরা নিজেদের কোন পরিবর্তনই করবে না। তাহলে এতকিছু বলার অর্থ কী? চলচ্চিত্র সমাজ পরিবর্তন করতে পারে না। কখনও পারেনি। আমাকে এমন একটা সিনেমা দেখান যা সমাজ পরিবর্তন করেছে, কিছুটা হলেও।
সিনিঅ্যাস্ট: লেনি রিফেনস্টাল এর মত চলচ্চিত্রকারদের কি বলবেন? রিফেনস্টাল তো আর্য পুরাণের নাৎসি সংস্করণ তৈরি করেছিলেন। কিংবা সের্গেই আইজেনস্টাইন যিনি চলচ্চিত্রকে বিপ্লবের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন।
রায়: আইজেনস্টাইন এমন এক বিপ্লবকে সাহায্য করেছেন যা ইতিমধ্যে চলছিল। বিপ্লব চলাকালীন সময়ে চলচ্চিত্রকারের ইতিবাচক ভূমিকা থাকতে পারে, সে বিপ্লবের পক্ষে কিছু করতে পারে। কিন্তু কোন বিপ্লব না থাকলে চলচ্চিত্রকারের কিছুই করার নেই।
রিফেনস্টাল একটি পুরাণকে সাহায্য করছিলেন, সেটা হল নাৎসি আদর্শ, আর নাৎসিরা সে সময় খুব শক্তিশালী ছিল। ফ্যাসিবাদের প্রথম যুগে এমনকি বুদ্ধিজীবীরাও দ্বিধান্বিত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সে সময় ভেবে বসেছিলেন, মুসোলিনি চমৎকার কাজ করছে এবং সমাজে তার ভূমিকা খুবই ইতিবাচক। রোমাঁ রোলাঁই তার এ ভুল ভাঙিয়েছিলেন, ঠাকুরকে বলেছিলেন যে, তিনি ফ্যাসিবাদের প্রভাবটা পুরো বুঝতে পারেননি।
সিনিঅ্যাস্ট: চলচ্চিত্রকার হিসেবে নিজের সামাজিক ভূমিকা সম্পর্কে আপনার কি মত?
রায়: “প্রতিদ্বন্দ্বি” তে আমার মনোভাবটা বুঝতে পারবেন। সিনেমাটিতে দুই ভাই থাকে- ছোট ভাই নকশালপন্থী, বড় ভাই যে ছোট ভাইয়ের সাহস ও দৃঢ় বিশ্বাসের প্রশংসা করে এতে কোন সন্দেহ নেই। এখানে সিনেমার অবস্থান খুব পরিষ্কার। কিন্তু চলচ্চিত্রকার হিসেবে আমি বড় ভাইয়ের প্রতি বেশি আগ্রহী ছিলাম কারণ সে দোদুল্যমান, নিজের বিশ্বাস স্থির করতে পারেনি। মনস্তাত্ত্বিক স্বত্ত্বা হিসেবে তার মধ্যে সংশয় ছিল বলেই কিন্তু চরিত্র হিসেবে সে আমার কাছে বেশি আকর্ষণীয়। ছোট ভাই ইতিমধ্যেই নিজের লক্ষ্য স্থির করে নিয়েছে, এতে তার স্বভাব-প্রকৃতি হয়ে গেছে বৈচিত্র্যহীন, চরিত্র হিসেবে হয়ে পড়েছে অপ্রয়োজনীয়। নকশাল আন্দোলন তার সবকিছু অধিগ্রহণ করে, ব্যক্তি হিসেবে সে হয়ে পড়ে গুরুত্বহীন।
সিনিঅ্যাস্ট: কিন্তু আদর্শিক অভিব্যক্তি ও আবেগময় অভিব্যক্তির মধ্যে কোন পার্থক্য করা কি সম্ভব? আইডিওলগ কি বুদ্ধিমান সত্ত্বা নয়? এ ধরণের ডাইকোটমি তৈরি করেন কিভাবে?
রায়: করা যাবে না কেন? আমি তো কোন কারণ দেখি না। যে বৃহত্তর আন্দোলনে যোগ দেয় সে তো নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের আদেশ-নিষেধের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, নেতারাই তো তাদের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। এই নেতৃস্থানীয়দের নিয়ে করা চরিত্রগুলো অবশ্যই কৌতুহলোদ্দীপক হবে। কোন বিপ্লবের প্রভাবশালী চরিত্র নিয়ে সিনেমা করা যায়। নকশাল আন্দোলন নিয়েও এমন সিনেমা করা সম্ভব, আইজেনস্টাইনীয় সিনেমা যাতে বিপ্লবের কাজকর্ম দেখানো হবে। কিন্তু ভারতের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এমন সিনেমা বানানো সম্ভব না।
সিনিঅ্যাস্ট: শুধু আমি না, আরও অনেকে মনে করে আপনি আবেগকে বেশি গুরুত্ব দেন। রবিন উড লিখেছেন, আপনি আদর্শ প্রকাশের থেকে মানুষের আবেগময় যোগাযোগ রূপায়নে বেশি আগ্রহী।
রায়: এটা একেবারেই ঠিক না। একটু গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখবেন, আমার সব সিনেমায়ই শক্তিশালী নৈতিক মানদণ্ড থাকে।
সিনিঅ্যাস্ট: এটা কি ধর্মীয় পরিবেশে বেড়ে ওঠার কারণে, অর্থাৎ ব্রাহ্ম হওয়ার কারণে?
রায়: আমার মনে হয় না। ব্রাহ্ম হওয়ার অর্থ কি তাই তো জানি না। চৌদ্দ-পনের বছর বয়সেই আমি ব্রাহ্ম সমাজের আচারানুষ্ঠানে অংশ নেয়া বন্ধ করেছিলাম। তাছাড়া আমি তো কোন সংগঠিত ধর্মে বিশ্বাসই করি না। ধর্ম শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়ে থাকতে পারে। সিনেমায় রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি রূপানের তুলনায় নৈতিক স্বভাব-চরিত্র প্রকাশে আমার আগ্রহ অনেক বেশি।
সিনিঅ্যাস্ট: নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিগুলো কি মাঝেমাঝে বেশি সরল হয়ে যায় না? যেমন “পিকু” তে সম্ভবত আপনি বোঝাতে চেয়েছেন, দাম্পত্য জীবনে অবিশ্বস্ততা বিভিন্ন রকম সমস্যার জন্ম দিতে পারে; কখনও মনে হয়েছে আপনি বলতে চাচ্ছেন, সামাজিক ও যৌন মূল্যবোধের পরিবর্তন সমাজ ও পরিবারের কাঠামোকে আহত করছে।
রায়: পিকু খুবই জটিল সিনেমা। এখানে বক্তব্যগুলো কাব্যিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে, তাই নির্দিষ্ট কোন উপসংহার টানা সম্ভব না। একটা বক্তব্য ছিল, কোন নারী যদি বিশ্বস্ত না হয়, যদি পরকীয়া প্রেমে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে নিজ সন্তানদের প্রতি তার আবেগ কমে আসবে। এক্ষেত্রে পিকুর মাধ্যমেই সেটা ফুটে উঠেছে। মা-ছেলে কখনও একসাথে বেরোয় না। এহেন পরিস্থিতিতে মা নির্দয় হয়ে যায়। পিকু সিনেমায় মা হয়ত যতটা না নির্দয় তার চেয়ে বেশি বাঙালি। পাশ্চাত্যের সাথে এখানে বাংলার পার্থক্য আছে। একই পরিস্থিতিতে কোন পশ্চিমা নারী এমন আচরণ করতো না।
সিনিঅ্যাস্ট: চারুলতা ইনফিডেলিটির (দাম্পত্য জীবনে অবিশ্বস্ততা) সমস্যা কিভাবে সমাধান করেছে? সিনেমা দেখে আমাদের মনে হয়েছে, সে স্বামীর কাছে ফিরে গেছে। সে কি আসলেই অবিশ্বস্ত ছিল নাকি কেবলই পরিবেশের শিকার।
রায়: সে অবিশ্বস্ত ছিল, কিন্তু একই সাথে দ্বিধায় ভুগছিল, কারণ তার স্বামী খুব ভালো। সে দুশ্চরিত্র ছিল না। চারুলতা সম্ভবত স্বামীর জন্য সহানুভূতি অনুভব করছিল এবং যেকোন উপায় পরিস্থিতি সামাল দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এই ঘটনার জন্য যে সে নিজেই দায়ী তা বুঝতে স্বামীর অনেক দেরি হয়ে গেছে। এজন্যই সিনেমার শেষটা সমাধানহীন, তারা একসাথে হবে এমনটা বলা হয়নি, কারণ কোন মীমাংসায় পৌঁছানোর সময় তখনও আসেনি।
সিনিঅ্যাস্ট: সিনেমার চরিত্রগুলোতে আপনার নিজের আবেগ কতটা জড়িত? অশনি সংকেত আবার দেখার পর পলিন কেল মন্তব্য করেছেন, “গঙ্গাচরণ চরিত্রে রায়ের নিজস্ব ব্যক্তিত্বের কিছু ছাপ আছে, যেমন: তার খানিকটা অপরাধবোধ, দুর্বলতা এবং প্রত্যয়।” এটা কি ঠিক?
রায়: সমালোচকরা এটা ভুলে যান যে, আমি অন্য একজন সাহিত্যিকের উপন্যাস থেকে সিনেমা করেছি এবং উপন্যাসটা অনেক আগেই লেখা হয়েছিল। অশনি সংকেত এর গঙ্গাচরণ বিভূতিভূষণের লেখায় যেমন ছিল সিনেমাতেও প্রায় তেমনভাবেই এসেছে। তাই আসল প্রশ্ন হওয়া উচিত, লেখকের নিজের মধ্যে অপরাধবোধ বা দুর্বলতার অনুভূতি ছিল কি-না। আমি গল্পের স্রষ্টা নই, তাই আমাকে কেন শুধু শুধু এর মধ্যে টেনে আনা?
এটা সত্য যে, সিনেমার চরিত্রটি আমি একটি নির্দিষ্ট উপায়ে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছি বলে চরিত্রটির পরিচয় ও সে সম্পর্কে আমার বোধ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আমি গঙ্গাচরণের চালিকাশক্তি, স্বভাব ও প্রতিক্রিয়া বুঝি। আমার কাছে সে বিশ্বাস্য, একটি পরিপূর্ণ চরিত্র এবং সিনেমার শেষে তার রূপান্তর খুব মর্মস্পর্শী। তাই বলে সে আমার প্রতিফলন নয়।
সিনিঅ্যাস্ট: আপনি কি বলতে চাচ্ছেন, যারা মূল বই পড়েনি তাদের পক্ষে আপনার সিনেমা বোঝা বা ব্যাখ্যা করা কঠিন হতে পারে?
রায়: হ্যা, যদি তারা মূল লেখককে একেবারে অগ্রাহ্য করে তাহলে কঠিন হবে। তারা পুরো ন্যারেটিভকে চলচ্চিত্রকারের মৌলিক সৃষ্টি হিসেবে দেখবে যা সবসময় ঠিক না। গল্প বা উপন্যাসের কোন উপাদান পছন্দ হলেই কেবল আমি তা থেকে সিনেমা করার সিদ্ধান্ত নেই। চিত্রনাট্য লেখার সময় কিছু অংশ পরিবর্তন করতে পারি কিন্তু মৌলিক ধারণা বা উপাদানগুলো একই থাকে। মাঝেমধ্যে চিত্রনাট্যটি মৌলিক গল্প বা উপন্যাসের সমালোচনা হিসেবে লিখি। গল্পটি অনেকবার পড়ার পর কখনও কখনও মনে হয়, অমুক চরিত্রটির লেখক যেমন দেখিয়েছেন তেমন আচরণ করার কথা না। তখন চরিত্রের কার্যক্রম কিছুটা পরিবর্তন করি। গল্পটা অনেকবার পড়ার যখন আমার মনে হয় পুরো বুঝেছি তখন সেটা সরিয়ে রেখে একেবারে শূন্য থেকে চিত্রনাট্য লেখা শুরু করি। লেখার সময় যেসব পরিবর্তন আসে সেগুলো সঠিক মনে হলে রেখে দেই। সিনেমাটা হয় পুরোপুরি চিত্রনাট্য অবলম্বনে।
সিনিঅ্যাস্ট: কিছু সমালোচক মনে করেন আপনি দারিদ্র্যকে ভাবের জগতে নিয়ে গেছেন। তারা বলেন, আপনার সিনেমায় দারিদ্র্য ও দুর্দশার কুৎসিত রূপটা দেখা যায় না।
রায়: আমি মনে করি, পথের পাঁচালী দারিদ্র্য প্রকাশের ব্যাপারে একেবারে নির্দয় ছিল। চরিত্রগুলোর ব্যবহার, ইন্দির ঠাকুরণের প্রতি সর্বজয়ার ব্যবহার প্রচণ্ড নির্মম। পরিবারের কোন সদস্যের প্রতি এমন নিষ্ঠুরতা আর কেউ দেখিয়েছে বলে আমার মনে হয় না। অশনি সংকেত এর গ্রামটি খুব সুন্দরভাবে দেখানো হয়েছে, পলিন কেল এদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন, ববিতা এই সিনেমায় অনেকটা পুতুলের মত। কিন্তু পলিন কেল জানেন না যে, গ্রামের অনেক ব্রাহ্মণের স্ত্রীই খুব সুন্দর ছিল, এটা বাস্তবতা।
সিনিঅ্যাস্ট: অশনি সংকেত এর মূল বক্তব্য কী এমন ছিল না যে- এটা এমন এক দুর্ভিক্ষ যা খরার প্রকোপে শুকনো হয়ে যাওয়া শস্যক্ষেত বা ক্ষুধায় ক্লিষ্ট মুখের মাধ্যমে কোন আগমনী সংকেত দেয়নি, হঠাৎ করে শুরু হয়েছে?
রায়: হ্যা, সে দুর্ভিক্ষটা এমনই ছিল। সবাই যখন দলে দলে শহরে আসতে শুরু করে তখনই সবাই প্রথম বুঝতে পেরেছিল, শস্যের ফলন ভাল হওয়ার পরও মানুষ ক্ষুধায় মারা যেতে পারে। আমার রঙের ব্যবহার এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। লেখকের বর্ণনা থেকেই আমি রঙের ধারণা পেয়েছি- প্রকৃতিতে তখন রসের প্রাচুর্য ছিল, সবকিছু ছিল অনিন্দ্য সুন্দর, তারপরও মানুষ ক্ষুধায় মারা যাচ্ছিল।
সিনিঅ্যাস্ট: আপনি, ফেলিনি, কুরোসাওয়া এবং বার্গম্যান একই সময়ে সিনেমা বানানো শুরু করেছিলেন। অনেক সমালোচক অনুভব করেন যে, আপনি অন্যদের তুলনায় কিছুটা পিছিয়ে গেছেন, ফেলিনি বা বার্গম্যান যেসব নৈসর্গ্যিক ও ন্যারেটিভ ঝুঁকি নিয়েছেন তা আপনি নেননি। প্রায় ত্রিশ বছরের চলচ্চিত্র জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে অন্যদের তুলনায় আপনি নিজেকে কিভাবে মূল্যায়ন করেন?
রায়: আমি মনে করি, আমি অনেক আগেই পরিপক্কতা অর্জন করেছি। আমার লক্ষ্য ছিল, খুব সরল ও সাধারণ ন্যারেটিভ কাঠামোর মধ্যে থেকে কত বেশি সিনেমা বানানো যায়, কত গভীরে প্রবেশ করা যায়। সিনেমা বানানোর সময় আমি পশ্চিমা দর্শকদের কথা মাথায় রাখি না, কেবল বাংলায় আমার নিজস্ব দর্শকদের কথা চিন্তা করি। তাদেরকে সাথে নিয়ে এগোতে চাই এবং আমি মনে করি এদিক থেকে আমি সফল। শুরুতে এই দর্শকদের সংবেদনশীলতা ছিল খুবই কম। হঠাৎ লাফ দিলে কি পরিণতি হয় তা “কাঞ্চনজঙ্ঘা” বা “অরণ্যের দিনরাত্রি” র যুগে ফিরে গেলেই বোঝা যায়। এসব সিনেমায় আমি দর্শক হারিয়ে ফেলেছিলাম।
দর্শকদের সাথে নিবিঢ়ভাবে সম্পর্কিত এমন ঝুঁকি ফেলিনি বা বার্গম্যান নেননি। বার্গম্যান সরলতা বজায় রেখেছেন, যদিও কখনও কখনও তাকে বিমর্ষ ও কর্কশ হতে দেখা গেছে; অনেক সময় চমৎকার চিত্রগ্রহণ তার সিনেমাকে সাহায্য করেছে। ফেলিনি বোধহয় একই সিনেমা বারবার বানিয়ে গেছেন, তার সিনেমায় প্রচুর শৈল্পিক অভিনবত্ব আছে। গল্প নিয়ে ফেলিনির তেমন আগ্রহ না থাকা সত্ত্বেও দর্শকরা তার অনন্য শৈল্পিক মাধুর্য দেখার জন্য হলে গিয়েছে।
বার্গম্যান ও ফেলিনি যা করেছেন তার সবকিছু আমার পক্ষে করা সম্ভব না। আমার তাদের মত দর্শক নেই, তাছাড়া আমি সেই কনটেক্সট এও কাজ করি না। আমার অধিকাংশ দর্শকই মূল্য বিচারে অক্ষম। ভারতের দর্শক নিয়ে আমাকে ত্রিশ বছর কাজ করতে হয়েছে, কিন্তু দর্শকদের সার্বিক রুচিতে এর মধ্যে বড় কোন পরিবর্তন আসেনি। বাংলায় তো নয়ই। সেখানকার অনেক পরিচালকের মূর্খতা ও অজ্ঞতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে তাদের সিনেমাকে আবর্জনা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। আপনার বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে যে এসব সিনেমার সাথেই আমার সিনেমা দেখানো হয়। পরিবেশের চাপেই আমার সিনেমার গল্পকে বেশ সরল রাখতে হয়, দর্শকদের ধাক্কা দেয়া বা তাদেরকে আক্রমণ করার ঝুঁকি নেয়া যায় না। আমার পক্ষে সর্বোচ্চ যেটা করা সম্ভব তা হল, সিনেমাগুলোকে অর্থবোধকতা এবং মনস্তাত্ত্বিক মোড়ক পরিয়ে দেয়া। আমার সিনেমার নিগূঢ় অর্থ তাই ছায়ার মত থাকে, সরল-সহজ কথাগুলোই ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখার অবকাশ থাকে, দর্শকদের কেউ চাইলে সে ছায়ার মাধ্যমে আমার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে।
---
সূত্র: Copyright 1982 by Dan Georgakas. Reprinted by permission from The Cineaste Interviews: On the Art and Politics of the Cinema. Georgakas, Dan and Lenny Rubenstein, eds. Chicago: Lake View Press, 1982. (মাইক্রোসফট এনকার্টা)
মূল ইংরেজি সাক্ষাৎকার: Cineaste magazine interview with Satyajit Ray
Help · About · Blog · Pricing · Privacy · Terms · Support · Upgrade
Contributions to http://cinecitta.wikispaces.com/ are licensed under a Custom License. Portions not contributed by visitors are Copyright 2013 Tangient LLC.
`নিও-রিয়ালিজম’ আসলে হয়েছিল অর্থের অভাব থেকে –-- সুশো সেশি দামিকো
অনুবাদ: ফ্লোরা সরকার
সুশো সেশি দামিকো, একজন নারী চিত্রনাট্যকার, যিনি তার কাজের জন্যে আজও স্মরণযোগ্য। সুশো দামিকোর জন্ম ১৯১৪ সালের ২১ জুলাই, ইতালির রোমে। মূলত ইতালির ছবির সঙ্গেই তার সংশ্লিষ্টতা ছিল। টু লিভ ইন পিস, দ্যা গার্ল ফ্রেন্ড, দ্যা স্কাই উইল ফল ছাড়াও প্রায় ১০০টি ছবির চিত্রনাট্য তিনি লিখেছেন। তবে যে ছবি দুটির জন্যে তিনি আজও বিখ্যাত হয়ে আছেন তা হলো ভিক্টোরিও ডি সিকা’র ‘বাইসাইকেল থিভস’ (১৯৪৮) এবং লুচিনো ভিসকন্টি পরিচালিত ‘দ্যা লিওপাড’ (১৯৬৩)। ভিক্টোরিও ডি সিকা ছাড়াও ইতালির বিখ্যাত চিত্রনির্মাতা আ্যন্টোনিওনি, ফেদ্রিকো ফেলিনি ও অন্যান্য দিকপালের সঙ্গে কাজ করেছেন। ১৯৯৪ সালে ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভালে তাকে পূর্ণ কর্মময় জীবন বা লাইফ টাইম এচিভমেন্টের জন্যে গোল্ডেন গ্লোব এ ভূষিত করা হয়। ৯৬ বছর বয়সে ২০১০ এর ৩১ জুলাই মহিয়সী এই চিত্রনাট্যকারের মৃত্যু ঘটে। ১৯৯৫ সালে মাইকেল কলভিল এন্ডারসান তার পঁচাশি বছর বয়সে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন।
এন্ডারসান: আমরা যতদূর জানি ইতালির বিখ্যাত সব চিত্রনির্মাতাদের চিত্রনাট্য লেখার একটি বিশাল ব্যপ্তি আপনার রয়েছে। আপনি কি বলবেন কিভাবে শুরু হলো এই কাজটা ?
দামিকো: আসলে এটা ছিল অন্য একজনের পরামর্শ। ঠিক আমার পরিকল্পনা না। আমার বাবা যখন লিখতেন তখন থেকে রোমের সিনেমা জগতের প্রায় অনেকের সঙ্গে পরিচয় ছিল। ভালো লিখিয়ে হিসেবে বাবার খুব সুনাম ছিল। আমার মনে পড়ে আমাকে একবার একটি চিত্রনাট্য পড়ার জন্যে দেয়া হয়েছিল, কারণ তারা তরুণদের মতামত শুনতে আগ্রহী ছিলেন। আমিও ঠিক এই কাজটি সারা বছর ধরে আমার সন্তানদের সঙ্গে করেছি। কোন কমেডি লিখে তাদের হাতে দিতাম এবং জানতে চাইতাম সেটা পড়ে তাদের হাসি পায় নাকি পায় না। তারপর একদিন একজন আমাকে বললেন আমি চিত্রনাট্য লিখিনা কেন। আমি জানালাম এটা নিয়ে কখনো বিশেষ ভাবে ভাবিনি, তবে চেষ্টা করে দেখতে পারি। এরপর বেশকিছু চিত্রনাট্যের অনুবাদ করি এবং সবগুলো বেশ সানন্দে গৃহীত হয়।
এন্ডারসান: আপনার প্রথম প্রচেষ্টার পান্ডলিপি কি সিনেমা হিসেবে নির্মিত হয়েছিল ?
দামিকো: না, কিন্তু সেটা মন্দ বলে যে হয়নি তা নয়। বিশেষ একটা ঘটনার কারণে হয়নি। বিষয়টা খুলে বলি। প্রডিউসার পন্টি তখন একটা ছবি নির্মাণ করতে চাচ্ছিলেন ‘মি.জেকেল অ্যান্ড মি.হাইড’ নিয়ে। আমরা উপন্যাস নির্ভর গল্প নিয়ে কাজ করতে চাচ্ছিলাম। আমাদের বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি দল ছিল : পরিচালক ক্যাস্টেলানি এবং আরও দুজন সহকারি লেখক - অ্যালবার্টো মোরাভিও ও এনিও ফ্লাইয়ানো।
একদিন টেবিলে গোল করে বসে সবাই মিলে গল্পটা নিয়ে গভীর আলোচনায় মগ্ন ছিলাম, এই সময় রেডিওতে খবর এলো হিরোশিমায় বোমা ফেটেছে। আমরা সবাই স্তম্ভিত হয়ে পড়লাম। সবাই মুখ চাওয়াচায়ি করলাম এবং বললাম “ পৃথিবীতে বসে আমরা কি করছি ? আমরা লেখা বন্ধ করে দিলাম তারপর পন্টিকে গিয়ে বললাম, “ দেখো, আমরা এই গল্পে আগ্রহী নই। আমরা প্রাণবন্ত কিছু করতে চাই। এমনকিছু যেখানে জীবন আছে”। তারপর আমাদের সেই ‘মি জেকেল অ্যান্ড হাইড’ নিয়ে আর কিছু করা হয়নি।
এন্ডারসান: কাজেই অ্যাটম বোমা পড়লো এবং --
দামিকো: হ্যা। সেই গল্পটা আমরা লিখলাম যেখানে একজন অধ্যাপক এবং একটি মেয়ের হঠাৎ দেখা হলো — যাক, আমরা এটাই ভাবছিলাম আমাদের কিছু একটা করতে হবে যা ব্যতিক্রম।
এন্ডারসান: সেই অভিজ্ঞতা থেকে কোন্ ছবিটি বের হয়ে এলো ?
দামিকো: ‘টু লিভ ইন পিস’ ( ১৯৪৭)। আমার একটি ছোট গল্প থেকে তা নেয়া হয়েছিল, পরিচালনায় ছিলেন লুইগি জাম্পা।
এন্ডারসান: সেটাই আপনার প্রথম ছবি ?
দামিকো: হ্যা এবং এখনো আমি চিত্রনাট্য লেখাকে আমার পেশা হিসেবে মনে করি। চিত্রনাট্য আমার কাছে একটি কারিগরি কাজের মতো, কবির কাজের মতো নয়। আরও পরিস্কার করে বলতে হলে বলতে হয় আমি একজন কারিগর, কবি না।
এন্ডারসান: চিত্রনাট্য তাহলে সৃজনশীল নয় এটা শিল্পকৌশল ?
দামিকো: আমি তাই মনে করি। অন্তত সিনেমা কখনোই সৃজনশীল নয়।
এন্ডারসান: কখনো তা ছিল না ?
দামিকো: সিনেমা তোমাকে হয়তো ঐরকম কোন ধারণা দেয় কিন্তু এটাই বাস্তব। সৃজনশীল কাজ শুধু একজনের হাতে নির্মিত হয়। সিনেমা অনেকের দ্বারা নির্মিত, যেখানে অপ্রত্যাশিত অনেককিছু থাকতে পারে। সূর্য মেঘের আড়ালে চলে যাচ্ছে, অভিনেতা শীতে কাঁপতে কাঁপতে প্রবেশ করছে। কিন্তু সত্যিকার সৃষ্টি, সত্যিকার সৃজনশীলতা শুধু একজনের হাতে গড়ে ওঠে। আমি খুব দুঃখিত এভাবে একজন চিত্রনাট্যকারকে উপস্থাপন করার জন্যে। এটা খুব কাজের একটা কাজ হতে পারে, খুব চমৎকার কাজ। লিখিত কোন গল্পের মতো তার ওজন আছে, কিন্তু সে তার নিজের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনা।
এন্ডারসান: অনেক চিত্রনাট্যকারের কথা জানি যারা তাদের লেখার প্রেরণা পেয়েছেন সাহিত্য থেকে, যেমন ফ্লোবেয়ার, দস্তভস্কি প্রমুখের কাছ থেকে। কাজেই অনেক চিত্রনাট্যকার নিজেদের লেখক হিসেবে মনে করেন এবং তা বিশ্বাস করতে ভালোবাসেন। চিত্রনাট্য, চরিত্র, সংলাপ ইত্যাদি নির্মাণ - এসব কি তাহলে লেখা নয় ?
দামিকো: হ্যা, কিন্তু একজন চিত্রনাট্যকার লেখেন তার চোখ বা দৃষ্টি দিয়ে। এটাই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। একজন লেখককে বিষয় বর্ণনার জন্যে শব্দ খুঁজতে হয়। একজন চিত্রনাট্যকার খোঁজেন প্রতিমা। এটা অবশ্যই কিছুটা ভিন্ন। দুটোর তুলনা করা ঠিক না। দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। ভিন্ন আঙ্গিকের উপস্থাপন। তুমি কোন একটি শব্দের সঙ্গে প্রতিমার তুলনা করতে পারো না।
এন্ডারসান: সিনেমার ওপর সাহিত্যের প্রভাব অনস্বীকার্য। কিন্তু সিনেমাও কি সাহিত্যের ওপর কোনভাবে প্রভাব ফেলে ?
দামিকো: ও হ্যা, অবশ্যই। বিশাল প্রভাব। বিশেষ করে যুদ্ধের সময়। এখনকার তরুণরা সেসব সাহিত্যের সঙ্গে অধিকতর অভ্যস্ত যেগুলি একসময় সিনেমা ছিল। কাজেই যখনই তুমি নতুন কোন উপন্যাস পড়ছো সেটা বিখ্যাত না হলেও তুমি সেখানে সিনেমা সদৃশ বর্ণনা খুঁজে নাও। ইংল্যান্ড বা আমেরিকার মতো ইতালিতে কখনোই বর্ণনাধর্মী উপন্যাস ছিল না। আমাদের দীর্ঘ উপন্যাসের মধ্যে যেমন - আলেসান্দ্রো ম্যাজনির ‘প্রমেসি স্পসি’ র নাম করা যেতে পারে। আমাদের দীর্ঘ উপন্যাসের ঐতিহ্যের ধারাটি ছিল খুবই শীর্ণ। কিন্তু এখন প্রচুর আছে। খুব গুরুত্বপূর্ণ বা প্রতিভাবান নয়, তবে সবাই তরুণ। এই বিষয়ে সন্দেহ নেই তারা সবাই সিনেমা থেকে অবরোহণ করেছে।
এন্ডারসান: সাহিত্যের ঐতিহ্যের ধারাটি হারিয়ে গেছে তাহলে ?
দামিকো: নিঃসন্দেহে।
এন্ডারসান: কিন্তু আপনি সাহিত্য দ্বারা খুব প্রভাবিত ছিলেন।
দামিকো: হ্যা। আমি প্রচুর চুরি করেছি।
এন্ডারসান: চুরি ?
দামিকো: হ্যা। আমি সব সময় বলি সাহিত্য থেকে চুরি করাটা খুব জরুরি। দস্তভস্কির কথাই ধরো। আমরা তার থেকে প্রচুর চুরি করেছি। তার চরিত্র, পরিবেশ আর যা যা আছে। যেমন ‘রচো অ্যান্ড হিজ ব্রাদার্স’ (১৯৬০) ছবির কথাই ধরো, সেখানে রচো রাজপুত্র, যদিও চরিত্রটি ভিন্ন রকম, কিন্তু তা এসেছে দস্তভস্কি থেকে।
এন্ডারসান: ভবিষ্যতের সিনেমা কি সংকটাপূর্ণ ?
দামিকো: হ্যা, ভবিষ্যতের সিনেমা সংকটাপূণ। কারণ এখন থেকেই আমরা মাঝারি মাপের ছবি দেখতে পাচ্ছি।
এন্ডারসান: তাহলে কি পুরনো শিক্ষাগুরুদের কাছে ফিরে যেতে হবে ?
দামিকো: প্রেরণা লাভের জন্যে এখনও যেতে পারো। এখনও সেখান থেকে অনেক কিছু পাওয়া যাবে। কিন্তু তরুণরা এখন ক্লাসিক্স পড়তে চায়না। টলস্টয়ের চরিত্রদের কথা ভাবো তো একবার, কি সুবিশাল, কি তার প্রাচুর্য।
এন্ডারসান: আপনার প্রেরণা কারা ছিল ?
দামিকো: টলস্টয়, দস্তভস্কি।
এন্ডারসান: এতগুলো বছর চিত্রনাট্যকার হিসেবে কি করে কাটালেন ? যেহেতু শুরুটা হয়েছিল কিছুটা বাধ্য হয়ে ?
দামিকো: কিন্তু আমি বেশ উপভোগ করি এবং এখনও কাজ করে যাচ্ছি। দুঃখজনক হলেও সত্য এই যে আমরা ছায়াছবির খুব ভালো সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিনা। প্রকৃত সমস্যা হলো এর ব্যয়বহুলতা। খুব সর্তকভাবে কাজ করতে হয়। তাছাড়া খুব বেশি প্রডিউসার নেই। বিশাল বাজেটের প্রডিউসার পাওয়া যায় না। সিনেমা এখন একটি ব্যবসা, একটি শিল্পপণ্য। অংশত মন্দরুচির একটি শিল্পপণ্য, কারণ টেলিভিশান মানুষের বুদ্ধিগত মানকে নামিয়ে দিয়েছে, ক্রমেই তা আরো নামছে। আমরা এখন মাথা খাটিয়ে কিছু বুঝতে চাইনা।
মানুষ এখন টেলিভিশানের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। আমি কখনো টিভি দেখি না - কিন্তু ইতালিতে প্রচুর মানুষ টিভি দেখে। টিভি-প্রডিউসারদের খুব মাথা খাটাতে হয়না কারণ তার অভ্যস্ত দর্শক আছে। যার ফলে এর গুণগত মান ক্রমান্বয়ে বিলিন হয়ে যাচ্ছে। যা খুব খারাপ।
আমরা যখন ছবি নির্মাণ করতাম তখন স্বল্পব্যয়ে নির্মিত হতো। অতীতে ইতালি ছবি যখন উচ্চ সীমায় পৌঁছেছিল তখন কোন কোন ছবি সর্বনিম্ন আঠার দিন ধরে সিনেমা হলে চলতো। ছবির ব্যবসা পড়ে যাবার জন্যে আমরা নিজেরাই দায়ি। আমাদের সময়ে খুব বেশি অর্থ উপার্জন না হলেও সর্বোচ্চ ক্ষতি হতো না। ফলে প্রডিউসার এবং পরিচালক ছবি নির্মাণে সাহস করতেন। কারণ আমাদের কাছে এটাই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, তুমি ছবি বানাবে শুধু তোমার জন্যে, লাভের জন্যে না। তুমি যদি মনে করো তুমি যা নির্মাণ করতে চেয়েছো তাই নির্মিত হয়েছে সেটাই ছিল যথেষ্ঠ। কিন্তু এখন কোন ছবির জন্যে লিখতে বসলে আগে ভাবতে হয় জাপানিরা এই ছবি বুঝতে পারবে কিনা। কিন্তু জাপানিরা কি পছন্দ করে সে সম্পর্কে আমার তো কোন ধারণা নেই। তোমাকে এমন ছবি বানাতে হবে যা পৃথিবীময় ঘুরতে পারে। শুধু তোমার আর তোমার কিছু বন্ধুবান্ধবের জন্যে ছবি বানাবে সেইদিন আর এখন নেই।।
এন্ডারসান: ভিসকন্টির অনেক প্রভাব আছে আপনার কর্মক্ষেত্রের উন্নতিতে। অন্যান্য নির্মাতার বিষয়ে এই প্রভাব কেমন ছিল?
দামিকো: প্রথম আমি যার সঙ্গে কাজ করি লুই জাম্পা, অত্যন্ত আধুনিক একজন মানুষ ছিলেন। খুব ধৈর্য নিয়ে কাজ করতেন এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি পরিতৃপ্ত হতেন ততক্ষণ পর্যন্ত কাজ করে যেতেন। খুবই জনপ্রিয় নির্মাতা ছিলেন এবং তার সঙ্গে কাজ করা একটি বিশাল অভিজ্ঞতা। তার কাছে আমি খুবই কৃতজ্ঞ। এখনকার চেয়ে খুব সহজ ছিল তার সময়টি। শুধু তার কারণেই আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্য লিখতে পেরেছিলাম। আমার মতে সেটা ছিল শ্রেষ্ঠ ছবি, ‘দ্য সিটি স্ট্যান্ডস ট্রায়াল’ যা ১৯৫২ তে নির্মিত হয়েছিল।
এন্ডারসান: ডি সিকা সম্পর্কে কিছু বলুন।
দামিকো: ডি সিকার সঙ্গে কাজ করা আরেকটি বিশাল অভিজ্ঞতা। উনি একজন অভিনেতা হওয়ায় বেশ ভিন্ন একটা স্বাদ পাওয়া যেত, মনে হতো যেন কোন মঞ্চে কাজ করছি। একজন চিত্রনাট্যকারকে, চিত্রপরিচালকের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে কাজ করতে হয়। বুঝতে হয় তিনি কি পছন্দ করছেন, কি অনুভব করছেন, কি চাচ্ছেন। আমার মনে হয় নির্মাতা যেটা চাননা সেটা নিয়ে লেখা একদম খামোখা। যেমন কমেডি সম্পর্কে বলা যায়। কমেডি কাউকে শেখানো যায় না। নির্মাতার বোধগম্য না হলে তা অন্তঃসারশূন্যে পর্যবসিত হয়।
আন্তনিওনির জন্যে প্রথম যে চিত্রনাট্য লিখি সেটা হলো ‘ক্যামেলি উইদাউট ক্যামেলিয়া’ ১৯৫৩ তে। এটা একটা কমেডি ছিল। আমরা একসঙ্গে লিখেছি। বিশ্বাস করো বা না-ই করো আন্তনিওনি খুব মজাদার একজন মানুষ ছিলেন। খুব রসিক মানুষ। ছবিটি আমরা কমেডি হিসেবেই লিখেছিলাম। প্রথম দিকে শুটিং এ গিয়েই বুঝেছিলাম ছবিটা বিপর্যয় ডেকে আনবে এবং ঠিক তা-ই হয়েছিল। আসলে ওনার জন্যে কমেডি করা সম্ভব ছিল না। কমেডির ছন্দ তার ভেতর ছিল না। তুমি যদি তার পরের ছবিগুলো দেখো তাহলেই বুঝবে তার পক্ষে কমেডি করাটা কতটা অসম্ভব ছিল। আরেকজন তরুণ পরিচালকের কাজ করেছিলাম, সে ছিল মনিসেলির সহকারি এবং সে তখন তার প্রথম ছবি নির্মাণ করছিল। সেটাও ঠিক একইভাবে বিপর্যয়ের সম্মুখিন হয়েছিল। তার মেধা, বুদ্ধি সব ছিল, কিন্তু কমেডির ছন্দটা ধরতে পারতো না।
এন্ডারসান: তারমানে নির্মাতাদের সঙ্গে সহযোগিতার কাজটা বেশ কঠিন?
দামিকো: মাঝে মাঝে। তোমাকে সবার আগে বুঝে নিতে হবে নির্মাতা কি চাচ্ছেন। তুমি তোমার মতামত তার ওপর চাপিয়ে দিতে পারো কিন্তু সে নিতে অপারগ হলে তা না চাপানোই ভালো।
এন্ডারসান: আপনি তো অনেক কমেডি লিখেছেন?
দামিকো: অনেক লিখেছি এবং লিখে আনন্দ পেয়েছি। এটা ছিল আমার প্রিয় ক্ষেত্র। কমেডি লেখার সব থেকে চমৎকার পরিবেশ হচ্ছে দলগত ভাবে লেখা। কিন্তু নাটকের ক্ষেত্রে না। নাটক একেবারে একা বসে লিখতে হয়। কিন্তু কমেডি দলগত ভাবে লিখতেই হবে, কেননা যখন লিখছো তখন হাসতে হবে এবং কোন সংলাপ যখন লিখছো তখন তা শুনতে পাচ্ছো, তখন হাসি পেলো কিনা - সেটা সবাই মিলে অনুধাবন করা যায়।
এন্ডারসান: চিত্রনাট্যকারদের ‘নামহীনতা’ সম্পর্কে আপনার মতামত কি? একজন নারী হিসেবে এটা অনেক সম্মানের বিষয় যিনি ভিসকন্টি বা রোমান পোলনস্কির জন্যে চিত্রনাট্য লিখেছেন। এই প্রক্রিয়ার ভেতর একজন লেখকের ভূমিকা কতটুকু? একজন চিত্রনাট্যকারের নামহীন বা বেনামা হয়ে যাওয়া কি কোন ভালো বিষয়?
দামিকো: একজন লেখক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। একটি ছবি নির্মাণের পেছনে চিত্রনাট্য হচ্ছে তার কারণ। একটি সিনেমার পুরো প্রক্রিয়ায় ভেতর তিনি সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এবং একমাত্র তিনি সৃষ্টিশীল হবার উপযুক্ত। তারপরেও বলতে হবে নির্মাতা যেমন লেখক ছাড়া কিছু করতে পারেন না, তেমনি লেখকও নির্মাতা ছাড়া অচল। এই কারণেই ছায়াছবি হচ্ছে সেই জায়গা যেখানে অপরিহার্যভাবে অনেক মানুষের সমাবেশের প্রয়োজন পড়ে।
এন্ডারসান: তা সত্ত্বেও সাফল্যের সবটা অংশ নির্মাতার ওপর বর্তায়।
দামিকো: হ্যা, তবে এটা অর্থহীন। আমি যখন কাজ শুরু করি তখন নির্মাতারা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন না। যাদের নাম তোমরা শোন তারা হলেন মূলত অভিনেতা-অভিনেত্রী। তিরিশের দশকে যখন আমেরিকান কমেডিগুলো দেখতাম, তখন শুধু অভিনয় শিল্পীদের নাম শুনতাম, নির্মাতাদের না।
এন্ডারসান: আপনি বলেছেন প্রথম দিকের জনপ্রিয় ছবিগুলির সময়ে অনেকে মিলে আপনারা লিখতেন?
দামিকো: আমি যখন তরুণ তখন বেশকিছু বন্ধুবান্ধব মিলে ঠিক করলাম ছবি নির্মাণ করবো। আমরা সব সময় একত্রে বসতাম এবং লিখতাম। সেই সময় যে ছবিগুলোতে কাজ করেছি যাকে তোমরা ‘নিও-রিয়ালিজম’ বা ‘নয়া-বাস্তববাদ’- বলো, সেটা আসলে হয়েছিল অর্থের অভাব থেকে। যুদ্ধবিধস্ত দেশে টাকাপয়সার অভাব, কাজেই আমরা রাস্তা বা কারোর বাড়িতে এবং অপেশাদার শিল্পী নিয়ে ছবি নির্মাণ শুরু করলাম। আমরা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে মানুষ যোগাড় করতাম এবং যাকে অভিনয়ের উপযুক্ত মনে হতো তাকে দিয়ে ছবি বানাতাম।
এন্ডারসান: ‘নয়া-বাস্তবাদ’ বলতে আপিন কি বোঝান?
দামিকো: এটা অনেক পরে কেউ এই ‘নিও-রিয়ালিজম’ নামটা দিয়েছিল এবং তা নিয়ে অনেক বই-পত্র, তত্ত্ব ইত্যাদি লেখালেখি হয়েছিল। এটা ছিল মূলত, কিছু বন্ধু-বান্ধব মিলে একটি ছবি নির্মাণের উদ্দেশ্যে রাস্তায় নেমে যাওয়া এবং শুটিং করা। বর্তমানের মতো সেই সময় যদি এতো পত্রিকা এবং ম্যাগাজিন থাকতো, তাহলে আমাদের অনেকে হয়তো ছবি নির্মাণ না করে পত্রিকায় সাংবাদিকতা করতো। কিন্তু সেই সময় এতো পত্রিকা ছিল না এবং ছবি নির্মাণ এখনকার মতো অতটা ব্যয়বহুল ছিল না, তাই আমরা আমাদের জীবন অভিজ্ঞতা ছবিতে রূপায়িত করতাম। যেমন ১৯৪৬ এ রসেলিনি পরিচালিত নির্মিত ‘রোমা’, ‘ওপেন সিটি’ কোন প্রডিউসার ছাড়া নির্মিত হয়েছিল। তবে ডি সিকা তার ‘বাইসাইকেল থিভস’ নির্মাণের সময় প্রডিউসার পেয়েছিলেন, তাছাড়া তিনি সেই সময়ে ইতালির নামকরা অভিনেতা ছিলেন এবং সেই সঙ্গে বুদ্ধিমান, কেননা তিনি আঁচ করেছিলেন চলচ্চিত্র থেকে ভবিষ্যতে কিছু একটা সফলতা আসবে। ছবিটির চিত্রনাট্যের জন্যে মাসের পর মাস আমরা গল্প সংগ্রহের জন্যে রোমে হেঁটে বেড়িয়েছি। একদম শুরুতে একজন চিত্রকরের বাইসাকেলের ওপর লেখা একটা ছোট গল্প আমাদের উৎসাহিত করে তোলে। রোম ব্যাপি ঘোরার আরেকটা কারণ ছিল যুদ্ধ পরবর্তী রোমের চিত্রটা তুলে ধরা।
এন্ডারসান: ভাবতে অবাক লাগে বাইসাইকেল থিভস্ সাত থেকে আটজন চিত্রনাট্যকার ছিলেন। আর এখন শুধু একজন চিত্রনাট্যকারের ওপর কৃতিত্ব বর্তায়।
দামিকো: হ্যা, কারণ সেটা আমাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলনা। আমরা চাইতাম যেভাবেই হোক একটা ছবি নির্মিত হোক। এমনও হয়েছে কোন বন্ধু হয়তো আমাদের লেখার সময় সঙ্গ দিয়েছে, চিত্রনাট্যে আমরা তার নাম জুড়ে দিতাম, তারপর প্রডিউসারের কাছ থেকে তার জন্যে টাকা নিতাম। যেটা ফেলিনির ক্ষেত্রে ঘটেছিল, কারণ তার তখন টাকার অভাব ছিল।
এন্ডারসান: আপনার নামের সঙ্গে লুচিনো ভিসকন্টির নাম অঙ্গাঙ্গিভাবে জুড়ে আছে। এই সহযোগিতা আপনার কর্মজীবনে পেছনে কোন প্রভাব রেখেছিল?
দামিকো: লুচিনোর সঙ্গে কাজ করার আগে অনেক ছবির কাজ ইতিমধ্যে আমি করে ফেলেছিলাম। আমরা দুজন খুব ভালো বন্ধু ছিলাম। উনি খুব বিশুদ্ধবাদী ছিলেন। ছবির প্রক্রিয়াকালীন সময়ে প্রতিটি খুঁটিনাটির প্রতি অত্যন্ত মনোযোগী থাকতেন এবং ছবির সেট-ডিজাইন থেকে শুরু করে লাইট, ক্যামেরা এসব সম্পর্কে তার স্পষ্ট ধারণা ছিল।
এন্ডারসান: আপনি তো ভিসকন্টিকে প্রথমে গল্পটা বলতে বলতেন, তারপর চিত্রনাট্যে যেতেন?
দামিকো: হ্যা। কারণ উনি কি চাচ্ছেন সেটা খুব জরুরি ছিল। এমনকি আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতাম। ওর বাড়ি আমার বাড়ি থেকে খুব দূরে ছিল না, কিন্তু আমরা দুজন দুজনকে প্রচুর চিঠি দিয়েছি। যেসব চিঠিতে সিনেমার চরিত্রের সমাবেশ এতো বেশি যে কেউ যদি আজ সেই চিঠিগুলো পড়ে, তাহলে মনে করবে কোন কোড ব্যবহার করে আমরা সেই পত্রবিনিময় করেছি। সাহিত্যের প্রতি আমাদের দুজনেরই একই রকম জ্ঞান এবং প্রচন্ড আবেগ কাজ করতো।
এন্ডারসান: আপনি বলেছেন আপনি এখনও লেখেন?
দামিকো: হ্যা। বিভিন্ন বিষয়ের ওপর লেখা ছাড়াও চিত্রনাট্যের কাজ এখনো করে যাচ্ছি।
এন্ডারসান: আপনি প্রায়ই শুটিং এ যেয়ে বসে থাকতেন, যা খুব বিরল।
দামিকো: হ্যা, অতীতে এর খুব প্রয়োজন ছিল। বিশেষ করে নিও-রিয়ালিজম যুগে। সব সময়ে সংলাপ পরিবর্তন করতে হতো। চিত্রনাট্যে রোদের কথা থাকলেও বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলে আমাদের স্থান-সংলাপ সব পরিবর্তন করতে হতো।
এন্ডারসান: সেই যুগটা ছিল খুব আকর্ষণীয়। আপনি কি সেই সোনালি সময়ের অভাব বোধ করেন?
দামিকো: খুব এবং খুবই। কারণ প্রচন্ড আবেগ দিয়ে সময়টা নির্মিত হয়েছিল। আমরা ছবি নির্মাণ করছিলাম কারণ আমরা তা করতে চাইছিলাম।
এন্ডারসান:পরিচালনায় কখনো যেতে ইচ্ছে করেনি?
দামিকো: না। আমাকে বহুবার বলা হয়েছিল। কিন্তু আমি সেই চরিত্রের ছিলাম না। যেমন ছবিতে যদি ৩০টা ঘোড়ার প্রয়োজন পড়ে তাহলে প্রডিউসার সেই সংখ্যক ঘোড়া না দেয়া পর্যন্ত ফেলিনি বা ভিকন্টি শুটিংই করবে না। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ৫০টা ঘোড়ার প্রয়োজন পড়লেও প্রডিউসার ৫টি যোগাঢ় করলে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারবো না। একজন নির্মাতা হতে হলে তোমাকে অত্যন্ত দৃঢ় চরিত্রের অধিকারী হতে হবে।
এন্ডারসান: হলিউড সম্পর্কে আপনার ধারণা কি?
দামিকো: সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয় আমার কাছে। আমার নিজস্ব কিছু ধারা আছে। আমি মনে করি না ছবি শুরু প্রথম বার মিনিটের মাথায় এমন কোন ঘটনার ঘনঘটা দেখাতে হবে যা প্রায়শই তারা করে থাকে। মানুষ লিখবে তার বোধ দিয়ে, মনন দিয়ে। যখন কোন লেখার অনুরোধ আসে তখন প্রায়ই আমি প্রেরণা পাবার জন্যে আমার বন্ধুদের লেখা সিনেমা সংক্রান্ত বই পড়ি। যেমন জঁ ক্লোদ কাগিয়ে’র বই, ‘দ্যা সিক্রেট ল্যাঙ্গুয়েজ অফ ফিল্ম’, আমার জীবনের অন্যতম একটি শ্রেষ্ঠ পড়া বই।
এন্ডারসান: সবশেষে জিজ্ঞেস করি - সিনেমার ইতিহাসে এমন কোন ছবি আছে যেটা আপনার মনে হয়েছে যে শুধু আপনি লিখেছেন?
দামিকো: (একটু চিন্তা করে) হ্যা - নিকিতা মিখিলভ এর ‘স্লেভ অফ লাভ’।
এন্ডারসান: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ
এন্ডারসান: আমরা যতদূর জানি ইতালির বিখ্যাত সব চিত্রনির্মাতাদের চিত্রনাট্য লেখার একটি বিশাল ব্যপ্তি আপনার রয়েছে। আপনি কি বলবেন কিভাবে শুরু হলো এই কাজটা ?
দামিকো: আসলে এটা ছিল অন্য একজনের পরামর্শ। ঠিক আমার পরিকল্পনা না। আমার বাবা যখন লিখতেন তখন থেকে রোমের সিনেমা জগতের প্রায় অনেকের সঙ্গে পরিচয় ছিল। ভালো লিখিয়ে হিসেবে বাবার খুব সুনাম ছিল। আমার মনে পড়ে আমাকে একবার একটি চিত্রনাট্য পড়ার জন্যে দেয়া হয়েছিল, কারণ তারা তরুণদের মতামত শুনতে আগ্রহী ছিলেন। আমিও ঠিক এই কাজটি সারা বছর ধরে আমার সন্তানদের সঙ্গে করেছি। কোন কমেডি লিখে তাদের হাতে দিতাম এবং জানতে চাইতাম সেটা পড়ে তাদের হাসি পায় নাকি পায় না। তারপর একদিন একজন আমাকে বললেন আমি চিত্রনাট্য লিখিনা কেন। আমি জানালাম এটা নিয়ে কখনো বিশেষ ভাবে ভাবিনি, তবে চেষ্টা করে দেখতে পারি। এরপর বেশকিছু চিত্রনাট্যের অনুবাদ করি এবং সবগুলো বেশ সানন্দে গৃহীত হয়।
এন্ডারসান: আপনার প্রথম প্রচেষ্টার পান্ডলিপি কি সিনেমা হিসেবে নির্মিত হয়েছিল ?
দামিকো: না, কিন্তু সেটা মন্দ বলে যে হয়নি তা নয়। বিশেষ একটা ঘটনার কারণে হয়নি। বিষয়টা খুলে বলি। প্রডিউসার পন্টি তখন একটা ছবি নির্মাণ করতে চাচ্ছিলেন ‘মি.জেকেল অ্যান্ড মি.হাইড’ নিয়ে। আমরা উপন্যাস নির্ভর গল্প নিয়ে কাজ করতে চাচ্ছিলাম। আমাদের বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি দল ছিল : পরিচালক ক্যাস্টেলানি এবং আরও দুজন সহকারি লেখক - অ্যালবার্টো মোরাভিও ও এনিও ফ্লাইয়ানো।
একদিন টেবিলে গোল করে বসে সবাই মিলে গল্পটা নিয়ে গভীর আলোচনায় মগ্ন ছিলাম, এই সময় রেডিওতে খবর এলো হিরোশিমায় বোমা ফেটেছে। আমরা সবাই স্তম্ভিত হয়ে পড়লাম। সবাই মুখ চাওয়াচায়ি করলাম এবং বললাম “ পৃথিবীতে বসে আমরা কি করছি ? আমরা লেখা বন্ধ করে দিলাম তারপর পন্টিকে গিয়ে বললাম, “ দেখো, আমরা এই গল্পে আগ্রহী নই। আমরা প্রাণবন্ত কিছু করতে চাই। এমনকিছু যেখানে জীবন আছে”। তারপর আমাদের সেই ‘মি জেকেল অ্যান্ড হাইড’ নিয়ে আর কিছু করা হয়নি।
এন্ডারসান: কাজেই অ্যাটম বোমা পড়লো এবং --
দামিকো: হ্যা। সেই গল্পটা আমরা লিখলাম যেখানে একজন অধ্যাপক এবং একটি মেয়ের হঠাৎ দেখা হলো — যাক, আমরা এটাই ভাবছিলাম আমাদের কিছু একটা করতে হবে যা ব্যতিক্রম।
এন্ডারসান: সেই অভিজ্ঞতা থেকে কোন্ ছবিটি বের হয়ে এলো ?
দামিকো: ‘টু লিভ ইন পিস’ ( ১৯৪৭)। আমার একটি ছোট গল্প থেকে তা নেয়া হয়েছিল, পরিচালনায় ছিলেন লুইগি জাম্পা।
এন্ডারসান: সেটাই আপনার প্রথম ছবি ?
দামিকো: হ্যা এবং এখনো আমি চিত্রনাট্য লেখাকে আমার পেশা হিসেবে মনে করি। চিত্রনাট্য আমার কাছে একটি কারিগরি কাজের মতো, কবির কাজের মতো নয়। আরও পরিস্কার করে বলতে হলে বলতে হয় আমি একজন কারিগর, কবি না।
এন্ডারসান: চিত্রনাট্য তাহলে সৃজনশীল নয় এটা শিল্পকৌশল ?
দামিকো: আমি তাই মনে করি। অন্তত সিনেমা কখনোই সৃজনশীল নয়।
এন্ডারসান: কখনো তা ছিল না ?
দামিকো: সিনেমা তোমাকে হয়তো ঐরকম কোন ধারণা দেয় কিন্তু এটাই বাস্তব। সৃজনশীল কাজ শুধু একজনের হাতে নির্মিত হয়। সিনেমা অনেকের দ্বারা নির্মিত, যেখানে অপ্রত্যাশিত অনেককিছু থাকতে পারে। সূর্য মেঘের আড়ালে চলে যাচ্ছে, অভিনেতা শীতে কাঁপতে কাঁপতে প্রবেশ করছে। কিন্তু সত্যিকার সৃষ্টি, সত্যিকার সৃজনশীলতা শুধু একজনের হাতে গড়ে ওঠে। আমি খুব দুঃখিত এভাবে একজন চিত্রনাট্যকারকে উপস্থাপন করার জন্যে। এটা খুব কাজের একটা কাজ হতে পারে, খুব চমৎকার কাজ। লিখিত কোন গল্পের মতো তার ওজন আছে, কিন্তু সে তার নিজের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনা।
এন্ডারসান: অনেক চিত্রনাট্যকারের কথা জানি যারা তাদের লেখার প্রেরণা পেয়েছেন সাহিত্য থেকে, যেমন ফ্লোবেয়ার, দস্তভস্কি প্রমুখের কাছ থেকে। কাজেই অনেক চিত্রনাট্যকার নিজেদের লেখক হিসেবে মনে করেন এবং তা বিশ্বাস করতে ভালোবাসেন। চিত্রনাট্য, চরিত্র, সংলাপ ইত্যাদি নির্মাণ - এসব কি তাহলে লেখা নয় ?
দামিকো: হ্যা, কিন্তু একজন চিত্রনাট্যকার লেখেন তার চোখ বা দৃষ্টি দিয়ে। এটাই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। একজন লেখককে বিষয় বর্ণনার জন্যে শব্দ খুঁজতে হয়। একজন চিত্রনাট্যকার খোঁজেন প্রতিমা। এটা অবশ্যই কিছুটা ভিন্ন। দুটোর তুলনা করা ঠিক না। দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। ভিন্ন আঙ্গিকের উপস্থাপন। তুমি কোন একটি শব্দের সঙ্গে প্রতিমার তুলনা করতে পারো না।
এন্ডারসান: সিনেমার ওপর সাহিত্যের প্রভাব অনস্বীকার্য। কিন্তু সিনেমাও কি সাহিত্যের ওপর কোনভাবে প্রভাব ফেলে ?
দামিকো: ও হ্যা, অবশ্যই। বিশাল প্রভাব। বিশেষ করে যুদ্ধের সময়। এখনকার তরুণরা সেসব সাহিত্যের সঙ্গে অধিকতর অভ্যস্ত যেগুলি একসময় সিনেমা ছিল। কাজেই যখনই তুমি নতুন কোন উপন্যাস পড়ছো সেটা বিখ্যাত না হলেও তুমি সেখানে সিনেমা সদৃশ বর্ণনা খুঁজে নাও। ইংল্যান্ড বা আমেরিকার মতো ইতালিতে কখনোই বর্ণনাধর্মী উপন্যাস ছিল না। আমাদের দীর্ঘ উপন্যাসের মধ্যে যেমন - আলেসান্দ্রো ম্যাজনির ‘প্রমেসি স্পসি’ র নাম করা যেতে পারে। আমাদের দীর্ঘ উপন্যাসের ঐতিহ্যের ধারাটি ছিল খুবই শীর্ণ। কিন্তু এখন প্রচুর আছে। খুব গুরুত্বপূর্ণ বা প্রতিভাবান নয়, তবে সবাই তরুণ। এই বিষয়ে সন্দেহ নেই তারা সবাই সিনেমা থেকে অবরোহণ করেছে।
এন্ডারসান: সাহিত্যের ঐতিহ্যের ধারাটি হারিয়ে গেছে তাহলে ?
দামিকো: নিঃসন্দেহে।
এন্ডারসান: কিন্তু আপনি সাহিত্য দ্বারা খুব প্রভাবিত ছিলেন।
দামিকো: হ্যা। আমি প্রচুর চুরি করেছি।
এন্ডারসান: চুরি ?
দামিকো: হ্যা। আমি সব সময় বলি সাহিত্য থেকে চুরি করাটা খুব জরুরি। দস্তভস্কির কথাই ধরো। আমরা তার থেকে প্রচুর চুরি করেছি। তার চরিত্র, পরিবেশ আর যা যা আছে। যেমন ‘রচো অ্যান্ড হিজ ব্রাদার্স’ (১৯৬০) ছবির কথাই ধরো, সেখানে রচো রাজপুত্র, যদিও চরিত্রটি ভিন্ন রকম, কিন্তু তা এসেছে দস্তভস্কি থেকে।
এন্ডারসান: ভবিষ্যতের সিনেমা কি সংকটাপূর্ণ ?
দামিকো: হ্যা, ভবিষ্যতের সিনেমা সংকটাপূণ। কারণ এখন থেকেই আমরা মাঝারি মাপের ছবি দেখতে পাচ্ছি।
এন্ডারসান: তাহলে কি পুরনো শিক্ষাগুরুদের কাছে ফিরে যেতে হবে ?
দামিকো: প্রেরণা লাভের জন্যে এখনও যেতে পারো। এখনও সেখান থেকে অনেক কিছু পাওয়া যাবে। কিন্তু তরুণরা এখন ক্লাসিক্স পড়তে চায়না। টলস্টয়ের চরিত্রদের কথা ভাবো তো একবার, কি সুবিশাল, কি তার প্রাচুর্য।
এন্ডারসান: আপনার প্রেরণা কারা ছিল ?
দামিকো: টলস্টয়, দস্তভস্কি।
এন্ডারসান: এতগুলো বছর চিত্রনাট্যকার হিসেবে কি করে কাটালেন ? যেহেতু শুরুটা হয়েছিল কিছুটা বাধ্য হয়ে ?
দামিকো: কিন্তু আমি বেশ উপভোগ করি এবং এখনও কাজ করে যাচ্ছি। দুঃখজনক হলেও সত্য এই যে আমরা ছায়াছবির খুব ভালো সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিনা। প্রকৃত সমস্যা হলো এর ব্যয়বহুলতা। খুব সর্তকভাবে কাজ করতে হয়। তাছাড়া খুব বেশি প্রডিউসার নেই। বিশাল বাজেটের প্রডিউসার পাওয়া যায় না। সিনেমা এখন একটি ব্যবসা, একটি শিল্পপণ্য। অংশত মন্দরুচির একটি শিল্পপণ্য, কারণ টেলিভিশান মানুষের বুদ্ধিগত মানকে নামিয়ে দিয়েছে, ক্রমেই তা আরো নামছে। আমরা এখন মাথা খাটিয়ে কিছু বুঝতে চাইনা।
মানুষ এখন টেলিভিশানের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। আমি কখনো টিভি দেখি না - কিন্তু ইতালিতে প্রচুর মানুষ টিভি দেখে। টিভি-প্রডিউসারদের খুব মাথা খাটাতে হয়না কারণ তার অভ্যস্ত দর্শক আছে। যার ফলে এর গুণগত মান ক্রমান্বয়ে বিলিন হয়ে যাচ্ছে। যা খুব খারাপ।
আমরা যখন ছবি নির্মাণ করতাম তখন স্বল্পব্যয়ে নির্মিত হতো। অতীতে ইতালি ছবি যখন উচ্চ সীমায় পৌঁছেছিল তখন কোন কোন ছবি সর্বনিম্ন আঠার দিন ধরে সিনেমা হলে চলতো। ছবির ব্যবসা পড়ে যাবার জন্যে আমরা নিজেরাই দায়ি। আমাদের সময়ে খুব বেশি অর্থ উপার্জন না হলেও সর্বোচ্চ ক্ষতি হতো না। ফলে প্রডিউসার এবং পরিচালক ছবি নির্মাণে সাহস করতেন। কারণ আমাদের কাছে এটাই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, তুমি ছবি বানাবে শুধু তোমার জন্যে, লাভের জন্যে না। তুমি যদি মনে করো তুমি যা নির্মাণ করতে চেয়েছো তাই নির্মিত হয়েছে সেটাই ছিল যথেষ্ঠ। কিন্তু এখন কোন ছবির জন্যে লিখতে বসলে আগে ভাবতে হয় জাপানিরা এই ছবি বুঝতে পারবে কিনা। কিন্তু জাপানিরা কি পছন্দ করে সে সম্পর্কে আমার তো কোন ধারণা নেই। তোমাকে এমন ছবি বানাতে হবে যা পৃথিবীময় ঘুরতে পারে। শুধু তোমার আর তোমার কিছু বন্ধুবান্ধবের জন্যে ছবি বানাবে সেইদিন আর এখন নেই।।
এন্ডারসান: ভিসকন্টির অনেক প্রভাব আছে আপনার কর্মক্ষেত্রের উন্নতিতে। অন্যান্য নির্মাতার বিষয়ে এই প্রভাব কেমন ছিল?
দামিকো: প্রথম আমি যার সঙ্গে কাজ করি লুই জাম্পা, অত্যন্ত আধুনিক একজন মানুষ ছিলেন। খুব ধৈর্য নিয়ে কাজ করতেন এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি পরিতৃপ্ত হতেন ততক্ষণ পর্যন্ত কাজ করে যেতেন। খুবই জনপ্রিয় নির্মাতা ছিলেন এবং তার সঙ্গে কাজ করা একটি বিশাল অভিজ্ঞতা। তার কাছে আমি খুবই কৃতজ্ঞ। এখনকার চেয়ে খুব সহজ ছিল তার সময়টি। শুধু তার কারণেই আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্য লিখতে পেরেছিলাম। আমার মতে সেটা ছিল শ্রেষ্ঠ ছবি, ‘দ্য সিটি স্ট্যান্ডস ট্রায়াল’ যা ১৯৫২ তে নির্মিত হয়েছিল।
এন্ডারসান: ডি সিকা সম্পর্কে কিছু বলুন।
দামিকো: ডি সিকার সঙ্গে কাজ করা আরেকটি বিশাল অভিজ্ঞতা। উনি একজন অভিনেতা হওয়ায় বেশ ভিন্ন একটা স্বাদ পাওয়া যেত, মনে হতো যেন কোন মঞ্চে কাজ করছি। একজন চিত্রনাট্যকারকে, চিত্রপরিচালকের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে কাজ করতে হয়। বুঝতে হয় তিনি কি পছন্দ করছেন, কি অনুভব করছেন, কি চাচ্ছেন। আমার মনে হয় নির্মাতা যেটা চাননা সেটা নিয়ে লেখা একদম খামোখা। যেমন কমেডি সম্পর্কে বলা যায়। কমেডি কাউকে শেখানো যায় না। নির্মাতার বোধগম্য না হলে তা অন্তঃসারশূন্যে পর্যবসিত হয়।
আন্তনিওনির জন্যে প্রথম যে চিত্রনাট্য লিখি সেটা হলো ‘ক্যামেলি উইদাউট ক্যামেলিয়া’ ১৯৫৩ তে। এটা একটা কমেডি ছিল। আমরা একসঙ্গে লিখেছি। বিশ্বাস করো বা না-ই করো আন্তনিওনি খুব মজাদার একজন মানুষ ছিলেন। খুব রসিক মানুষ। ছবিটি আমরা কমেডি হিসেবেই লিখেছিলাম। প্রথম দিকে শুটিং এ গিয়েই বুঝেছিলাম ছবিটা বিপর্যয় ডেকে আনবে এবং ঠিক তা-ই হয়েছিল। আসলে ওনার জন্যে কমেডি করা সম্ভব ছিল না। কমেডির ছন্দ তার ভেতর ছিল না। তুমি যদি তার পরের ছবিগুলো দেখো তাহলেই বুঝবে তার পক্ষে কমেডি করাটা কতটা অসম্ভব ছিল। আরেকজন তরুণ পরিচালকের কাজ করেছিলাম, সে ছিল মনিসেলির সহকারি এবং সে তখন তার প্রথম ছবি নির্মাণ করছিল। সেটাও ঠিক একইভাবে বিপর্যয়ের সম্মুখিন হয়েছিল। তার মেধা, বুদ্ধি সব ছিল, কিন্তু কমেডির ছন্দটা ধরতে পারতো না।
এন্ডারসান: তারমানে নির্মাতাদের সঙ্গে সহযোগিতার কাজটা বেশ কঠিন?
দামিকো: মাঝে মাঝে। তোমাকে সবার আগে বুঝে নিতে হবে নির্মাতা কি চাচ্ছেন। তুমি তোমার মতামত তার ওপর চাপিয়ে দিতে পারো কিন্তু সে নিতে অপারগ হলে তা না চাপানোই ভালো।
এন্ডারসান: আপনি তো অনেক কমেডি লিখেছেন?
দামিকো: অনেক লিখেছি এবং লিখে আনন্দ পেয়েছি। এটা ছিল আমার প্রিয় ক্ষেত্র। কমেডি লেখার সব থেকে চমৎকার পরিবেশ হচ্ছে দলগত ভাবে লেখা। কিন্তু নাটকের ক্ষেত্রে না। নাটক একেবারে একা বসে লিখতে হয়। কিন্তু কমেডি দলগত ভাবে লিখতেই হবে, কেননা যখন লিখছো তখন হাসতে হবে এবং কোন সংলাপ যখন লিখছো তখন তা শুনতে পাচ্ছো, তখন হাসি পেলো কিনা - সেটা সবাই মিলে অনুধাবন করা যায়।
এন্ডারসান: চিত্রনাট্যকারদের ‘নামহীনতা’ সম্পর্কে আপনার মতামত কি? একজন নারী হিসেবে এটা অনেক সম্মানের বিষয় যিনি ভিসকন্টি বা রোমান পোলনস্কির জন্যে চিত্রনাট্য লিখেছেন। এই প্রক্রিয়ার ভেতর একজন লেখকের ভূমিকা কতটুকু? একজন চিত্রনাট্যকারের নামহীন বা বেনামা হয়ে যাওয়া কি কোন ভালো বিষয়?
দামিকো: একজন লেখক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। একটি ছবি নির্মাণের পেছনে চিত্রনাট্য হচ্ছে তার কারণ। একটি সিনেমার পুরো প্রক্রিয়ায় ভেতর তিনি সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এবং একমাত্র তিনি সৃষ্টিশীল হবার উপযুক্ত। তারপরেও বলতে হবে নির্মাতা যেমন লেখক ছাড়া কিছু করতে পারেন না, তেমনি লেখকও নির্মাতা ছাড়া অচল। এই কারণেই ছায়াছবি হচ্ছে সেই জায়গা যেখানে অপরিহার্যভাবে অনেক মানুষের সমাবেশের প্রয়োজন পড়ে।
এন্ডারসান: তা সত্ত্বেও সাফল্যের সবটা অংশ নির্মাতার ওপর বর্তায়।
দামিকো: হ্যা, তবে এটা অর্থহীন। আমি যখন কাজ শুরু করি তখন নির্মাতারা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন না। যাদের নাম তোমরা শোন তারা হলেন মূলত অভিনেতা-অভিনেত্রী। তিরিশের দশকে যখন আমেরিকান কমেডিগুলো দেখতাম, তখন শুধু অভিনয় শিল্পীদের নাম শুনতাম, নির্মাতাদের না।
এন্ডারসান: আপনি বলেছেন প্রথম দিকের জনপ্রিয় ছবিগুলির সময়ে অনেকে মিলে আপনারা লিখতেন?
দামিকো: আমি যখন তরুণ তখন বেশকিছু বন্ধুবান্ধব মিলে ঠিক করলাম ছবি নির্মাণ করবো। আমরা সব সময় একত্রে বসতাম এবং লিখতাম। সেই সময় যে ছবিগুলোতে কাজ করেছি যাকে তোমরা ‘নিও-রিয়ালিজম’ বা ‘নয়া-বাস্তববাদ’- বলো, সেটা আসলে হয়েছিল অর্থের অভাব থেকে। যুদ্ধবিধস্ত দেশে টাকাপয়সার অভাব, কাজেই আমরা রাস্তা বা কারোর বাড়িতে এবং অপেশাদার শিল্পী নিয়ে ছবি নির্মাণ শুরু করলাম। আমরা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে মানুষ যোগাড় করতাম এবং যাকে অভিনয়ের উপযুক্ত মনে হতো তাকে দিয়ে ছবি বানাতাম।
এন্ডারসান: ‘নয়া-বাস্তবাদ’ বলতে আপিন কি বোঝান?
দামিকো: এটা অনেক পরে কেউ এই ‘নিও-রিয়ালিজম’ নামটা দিয়েছিল এবং তা নিয়ে অনেক বই-পত্র, তত্ত্ব ইত্যাদি লেখালেখি হয়েছিল। এটা ছিল মূলত, কিছু বন্ধু-বান্ধব মিলে একটি ছবি নির্মাণের উদ্দেশ্যে রাস্তায় নেমে যাওয়া এবং শুটিং করা। বর্তমানের মতো সেই সময় যদি এতো পত্রিকা এবং ম্যাগাজিন থাকতো, তাহলে আমাদের অনেকে হয়তো ছবি নির্মাণ না করে পত্রিকায় সাংবাদিকতা করতো। কিন্তু সেই সময় এতো পত্রিকা ছিল না এবং ছবি নির্মাণ এখনকার মতো অতটা ব্যয়বহুল ছিল না, তাই আমরা আমাদের জীবন অভিজ্ঞতা ছবিতে রূপায়িত করতাম। যেমন ১৯৪৬ এ রসেলিনি পরিচালিত নির্মিত ‘রোমা’, ‘ওপেন সিটি’ কোন প্রডিউসার ছাড়া নির্মিত হয়েছিল। তবে ডি সিকা তার ‘বাইসাইকেল থিভস’ নির্মাণের সময় প্রডিউসার পেয়েছিলেন, তাছাড়া তিনি সেই সময়ে ইতালির নামকরা অভিনেতা ছিলেন এবং সেই সঙ্গে বুদ্ধিমান, কেননা তিনি আঁচ করেছিলেন চলচ্চিত্র থেকে ভবিষ্যতে কিছু একটা সফলতা আসবে। ছবিটির চিত্রনাট্যের জন্যে মাসের পর মাস আমরা গল্প সংগ্রহের জন্যে রোমে হেঁটে বেড়িয়েছি। একদম শুরুতে একজন চিত্রকরের বাইসাকেলের ওপর লেখা একটা ছোট গল্প আমাদের উৎসাহিত করে তোলে। রোম ব্যাপি ঘোরার আরেকটা কারণ ছিল যুদ্ধ পরবর্তী রোমের চিত্রটা তুলে ধরা।
এন্ডারসান: ভাবতে অবাক লাগে বাইসাইকেল থিভস্ সাত থেকে আটজন চিত্রনাট্যকার ছিলেন। আর এখন শুধু একজন চিত্রনাট্যকারের ওপর কৃতিত্ব বর্তায়।
দামিকো: হ্যা, কারণ সেটা আমাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলনা। আমরা চাইতাম যেভাবেই হোক একটা ছবি নির্মিত হোক। এমনও হয়েছে কোন বন্ধু হয়তো আমাদের লেখার সময় সঙ্গ দিয়েছে, চিত্রনাট্যে আমরা তার নাম জুড়ে দিতাম, তারপর প্রডিউসারের কাছ থেকে তার জন্যে টাকা নিতাম। যেটা ফেলিনির ক্ষেত্রে ঘটেছিল, কারণ তার তখন টাকার অভাব ছিল।
এন্ডারসান: আপনার নামের সঙ্গে লুচিনো ভিসকন্টির নাম অঙ্গাঙ্গিভাবে জুড়ে আছে। এই সহযোগিতা আপনার কর্মজীবনে পেছনে কোন প্রভাব রেখেছিল?
দামিকো: লুচিনোর সঙ্গে কাজ করার আগে অনেক ছবির কাজ ইতিমধ্যে আমি করে ফেলেছিলাম। আমরা দুজন খুব ভালো বন্ধু ছিলাম। উনি খুব বিশুদ্ধবাদী ছিলেন। ছবির প্রক্রিয়াকালীন সময়ে প্রতিটি খুঁটিনাটির প্রতি অত্যন্ত মনোযোগী থাকতেন এবং ছবির সেট-ডিজাইন থেকে শুরু করে লাইট, ক্যামেরা এসব সম্পর্কে তার স্পষ্ট ধারণা ছিল।
এন্ডারসান: আপনি তো ভিসকন্টিকে প্রথমে গল্পটা বলতে বলতেন, তারপর চিত্রনাট্যে যেতেন?
দামিকো: হ্যা। কারণ উনি কি চাচ্ছেন সেটা খুব জরুরি ছিল। এমনকি আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতাম। ওর বাড়ি আমার বাড়ি থেকে খুব দূরে ছিল না, কিন্তু আমরা দুজন দুজনকে প্রচুর চিঠি দিয়েছি। যেসব চিঠিতে সিনেমার চরিত্রের সমাবেশ এতো বেশি যে কেউ যদি আজ সেই চিঠিগুলো পড়ে, তাহলে মনে করবে কোন কোড ব্যবহার করে আমরা সেই পত্রবিনিময় করেছি। সাহিত্যের প্রতি আমাদের দুজনেরই একই রকম জ্ঞান এবং প্রচন্ড আবেগ কাজ করতো।
এন্ডারসান: আপনি বলেছেন আপনি এখনও লেখেন?
দামিকো: হ্যা। বিভিন্ন বিষয়ের ওপর লেখা ছাড়াও চিত্রনাট্যের কাজ এখনো করে যাচ্ছি।
এন্ডারসান: আপনি প্রায়ই শুটিং এ যেয়ে বসে থাকতেন, যা খুব বিরল।
দামিকো: হ্যা, অতীতে এর খুব প্রয়োজন ছিল। বিশেষ করে নিও-রিয়ালিজম যুগে। সব সময়ে সংলাপ পরিবর্তন করতে হতো। চিত্রনাট্যে রোদের কথা থাকলেও বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলে আমাদের স্থান-সংলাপ সব পরিবর্তন করতে হতো।
এন্ডারসান: সেই যুগটা ছিল খুব আকর্ষণীয়। আপনি কি সেই সোনালি সময়ের অভাব বোধ করেন?
দামিকো: খুব এবং খুবই। কারণ প্রচন্ড আবেগ দিয়ে সময়টা নির্মিত হয়েছিল। আমরা ছবি নির্মাণ করছিলাম কারণ আমরা তা করতে চাইছিলাম।
এন্ডারসান:পরিচালনায় কখনো যেতে ইচ্ছে করেনি?
দামিকো: না। আমাকে বহুবার বলা হয়েছিল। কিন্তু আমি সেই চরিত্রের ছিলাম না। যেমন ছবিতে যদি ৩০টা ঘোড়ার প্রয়োজন পড়ে তাহলে প্রডিউসার সেই সংখ্যক ঘোড়া না দেয়া পর্যন্ত ফেলিনি বা ভিকন্টি শুটিংই করবে না। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ৫০টা ঘোড়ার প্রয়োজন পড়লেও প্রডিউসার ৫টি যোগাঢ় করলে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারবো না। একজন নির্মাতা হতে হলে তোমাকে অত্যন্ত দৃঢ় চরিত্রের অধিকারী হতে হবে।
এন্ডারসান: হলিউড সম্পর্কে আপনার ধারণা কি?
দামিকো: সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয় আমার কাছে। আমার নিজস্ব কিছু ধারা আছে। আমি মনে করি না ছবি শুরু প্রথম বার মিনিটের মাথায় এমন কোন ঘটনার ঘনঘটা দেখাতে হবে যা প্রায়শই তারা করে থাকে। মানুষ লিখবে তার বোধ দিয়ে, মনন দিয়ে। যখন কোন লেখার অনুরোধ আসে তখন প্রায়ই আমি প্রেরণা পাবার জন্যে আমার বন্ধুদের লেখা সিনেমা সংক্রান্ত বই পড়ি। যেমন জঁ ক্লোদ কাগিয়ে’র বই, ‘দ্যা সিক্রেট ল্যাঙ্গুয়েজ অফ ফিল্ম’, আমার জীবনের অন্যতম একটি শ্রেষ্ঠ পড়া বই।
এন্ডারসান: সবশেষে জিজ্ঞেস করি - সিনেমার ইতিহাসে এমন কোন ছবি আছে যেটা আপনার মনে হয়েছে যে শুধু আপনি লিখেছেন?
দামিকো: (একটু চিন্তা করে) হ্যা - নিকিতা মিখিলভ এর ‘স্লেভ অফ লাভ’।
এন্ডারসান: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ
কিয়রোস্তামির সাক্ষাৎকার - ব্রাইট লাইটস
অনুবাদ - খান মুহাম্মদ
বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে সক্রিয় চলচ্চিত্র আন্দোলন বোধহয় ইরানী নিউ ওয়েভ বা ইরানী নবতরঙ্গ। এই মহান আন্দোলনের রূপকার হলেন আব্বাস কিয়ারোস্তামি। আমরা জাপান সম্পর্কে জেনেছি আকিরা কুরোসাওয়ার মাধ্যমে, বাংলাকে চিনেছি সত্যজিৎ রায়ের মাধ্যমে আর ইরানকে বুঝেছি আব্বাস কিয়ারোস্তামির মাধ্যমে। ব্রাইট লাইটস ফিল্ম জার্নালে কিয়ারোস্তামির একটা সাক্ষাৎকার পেয়ে অনুবাদ শুরু করে দিলাম। এর একটা বাংলা অনুবাদ হয়ে ইতিমধ্যে বই হিসেবে প্রকাশিতও হয়ে গেছে। তারপরও আমি আবার অনুবাদ করলাম। বেশ কয়েক পর্ব লাগবে। মূল ইংরেজি অনুবাদের নাম “The Accidental Auteur”। শিরোনামটা স্বয়ং কিয়ারোস্তামিকেই নির্দেশ করছে। যে চলচ্চিত্র পরিচালক একেবারে অনন্য পদ্ধতিতে সিনেমা বানান এবং তার শিল্পকর্মের প্রতিটি দিক নিজের মত করে সাজান তাকেই ওটার বলা হয়।
২০০৫ সালের মে মাসে আব্বাস কিয়ারোস্তামি তুরস্কের ইস্তাম্বুলে গিয়েছিলেন “ইস্তাম্বুল চলচ্চিত্র উৎসব”-এ অতিথি হিসেবে যোগদানের জন্য। এই সাক্ষাৎকারটি সে সময়ই নেয়া। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তুরস্কে অধ্যাপনায় রত ইতালীয়-মার্কিন চলচ্চিত্র সমালোচক বার্ট কার্ডুলো (Bert Cardullo)।
জঁ লুক গোদারের একটি বিখ্যাত উক্তি আছে, “সিনেমা শুরু হয়েছে ডি ডব্লিউ গ্রিফিথের মাধ্যমে আর শেষ হয়েছে আব্বাস কিয়ারোস্তামির মাধ্যমে”। এ সম্পর্কে আপনার মত কি?
আসলে স্বয়ং গোদারও এখন আর এটাতে বিশ্বাস করে না- বিশেষত “টেন” তৈরীর পর। কারণ টেন বানানোর সময় আমি আগের পথ অনুসরণ করিনি, বরং তাতে বেশ খানিকটা পরিবর্তন এনেছি।
আরেকটি বিখ্যাত উক্তি বলছি। অ্যান্টনি মিংগেলা বলেছিলেন, “স্যামুয়েল বেকেট সিনেমা বানালে তার সিনেমাগুলো আব্বাস কিয়ারোস্তামির মত হতো”। এটার সাথে কি আপনি একমত?
হয়তোবা। বেকেট কিন্তু একটি সিনেমা করেছিলেন। সেটার পরিচালক ছিল অ্যালান স্নাইডার, মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছিল বাস্টার কিটন। সিনেমার নাম “ফিল্ম“। সুতরাং কেউ চাইলে সিনেমাটা দেখে মিংগেলার কথার সত্যতা যাচাই করে নিতে পারেন।
আপনি চলচ্চিত্র নির্মাতা হলেন কিভাবে?
আমার চলচ্চিত্র নির্মাতা হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে আমার বন্ধু আব্বাস কোহেন্দারির জুতো। কাহিনীটা এরকম: তখন সবে baccalaureate (উচ্চ মাধ্যমিক) পাশ করেছি। আমার ইচ্ছে ছিল স্কুল অফ ফাইন আর্টসে চিত্রকলায় পড়ব। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষায় পাশ করতে পারলাম না। অগত্যা ট্রাফিক পুলিশ হতে হল। সে সময়ই একদিন বন্ধু কোহেন্দারির দোকানে গেলে সে আমাকে নিয়ে তাজরিশ ব্রিজের দিকে যেতে চাইল। আমি রাজি হইনি, কারণ পরনে ছিল স্যান্ডেল। সে সাথে সাথেই ঠিক আমার মাপের এক জোড়া নতুন জুতো বের করে দিলে। সেটা পরেই রওনা হলাম তাজরিশ ব্রিজের দিকে। এরপর গেলাম ফরহাদ আশতারির বাসায়। সেখানেই আমার সাথে মোহাকেকের দেখা হয়। সে চিত্রকলার উপর একটা ওয়ার্কশপ চালাতো। তার ওয়ার্কশপে কিছুদিন ক্লাস করার পর আবার স্কুল অফ ফাইন আর্টসে ভর্তির জন্য পরীক্ষা দিলাম এবং পাশ করলাম। সেখান থেকেই আমার পেইন্টিং জীবনের সূচনা, প্রথমে বিজ্ঞাপনের কাজ করতাম। বাসা ছেড়েছিলাম ১৮ বছর বয়সে, স্বভাবতই জীবন চালানোর জন্য একটা চাকরির প্রয়োজন ছিল। কয়েকটা স্টুডিওতে চিত্রশিল্পী ও গ্রাফিক আর্টিস্ট হিসেবেই কাজ শুরু করি। এছাড়া বইয়ের প্রচ্ছদ, পোস্টার- এসবও আঁকতাম।
এরপর গিয়ে ভিড়ি তাবলি ফিল্মে। সে সময় এটা ছিল কমার্শিয়াল নির্মাণের কেন্দ্রবিন্দু। আমি তাদেরকে বলেছিলাম, পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করতে চাই। তারা প্রথমেই আইসোথার্মাল ওয়াটার-হিটারের ওপর একটা স্কেচ তৈরী করতে বললাম। পুরো রাত কাবার করে ওয়াটার হিটারের ওপর একটা কবিতা লিখে ফেললাম। তিন দিন পর টিভিতে দেখি, ওয়াটার হিটারের বিজ্ঞাপনে আমার কবিতা; খুব অবাক হয়েছিলাম। এভাবেই টিভি কমার্শিয়ালের জগতে প্রবেশ করি। ধীরে ধীরে আমার উন্নতি হয়। আরও কিছু স্কেচ লেখার পর বিজ্ঞাপন পরিচালনা শুরু করি। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৯ সালের মধ্যে বোধহয় ১৫০ টিরও বেশী বিজ্ঞাপন বানিয়েছিলাম। সেগুলো খুব উপভোগ করতাম। কাজটা আসলেই বেশ মজার: মাত্র এক মিনিটের মধ্যে ভূমিকা, পুরো গল্প এবং আপনি দর্শকদেরকে যা জানাতে চান তা তুলে ধরতে হয়। এর জন্য প্রথমেই একটা ভাল গল্প বানাতে হয়, এরপর খুব দ্রুত সেটা দর্শকদেরকে বোঝাতে হয়, এবং অবশ্যই এমনভাবে বোঝাতে হয় যাতে বিজ্ঞাপন দেখার পর তারা পণ্যটা কিনতে আগ্রহী হয়ে উঠে। কমার্শিয়াল আর গ্রাফিক আর্ট থেকেই আমি সিনেমা সম্পর্কে জেনেছি। গ্রাফিক প্রকল্পগুলোতে একটা পৃষ্ঠা, কলাম বা ইনসার্ট থাকে; এই ছোট্ট পরিসরেই এমন কিছু আঁকতে হয় যাতে দেখামাত্রই সবাই আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। আমার তো মনে হয়, গ্রাফিক্সই সব শিল্পের জনক। সীমাবদ্ধ পরিসর এবং বানিজ্যিক চাপের কারণে এখানে শিল্পীরা তাদের কল্পনাশক্তি প্রয়োগ করতে বাধ্য হয়। বিজ্ঞাপনে কাজ করার শেষ কয় বছরে আমি বেশ কিছু ইরানী সিনেমার ক্রেডিট সিকোয়েন্সও ডিজাইন করেছিলাম। সে সময়ই আমার কর্মজীবনের মোড় ঘুরে যায়, বানিজ্যিক গ্রাফিক শিল্প থেকে অবানিজ্যিক চলচ্চিত্রের দিকে ঝুঁকে পড়ি। আসলে ক্রেডিট সিকোয়েন্স ডিজাইন করার সময়ই আমি আমার ক্যামেরা খুঁজে পেয়েছিলাম।
জীবনের এই পর্যায়ে এসে আপনি কি নিজেকে প্রধানত চলচ্চিত্র নির্মাতাই মনে করেন- নাকি এখনও সে অবস্থা আসেনি?
আমার অনেক পেশা আছে এবং কোন একটাই আমাকে খুব বেশী তুষ্ট করতে পারে না। অনেক চলচ্চিত্র নির্মাতা আছে যারা একটা সিনেমা বানানোর সময় পরের সিনেমা নিয়ে চিন্তা শুরু করে। এরা আসলে শিল্পী হওয়ার প্রতি খুব একটা মনোযোগী নয়। আমি সেরকম না, আমি ভবঘুরে। ভবঘুরে হওয়ার কারণে আমি সব ধরণের জায়গায় যেতে পারি, সব ধরণের কাজও করতে পারি। যেমন, আমি ছুতারের কাজ করেও অনেকটা সময় ব্যয় করি। মাঝেমাঝে এক টুকরো কাঠ কাটতে গিয়ে যে তৃপ্তি পাই, অন্য কোনকিছুর সাথেই তার তুলনা চলে না। নিভৃতে কাজ করলে আমার অন্তর শান্ত হয়।
আপনি তো চলচ্চিত্রের জন্য যতটা পরিচিত স্থিরচিত্রের জন্যও প্রায় ততটাই পরিচিত।
আমার কাছে স্থিরচিত্র, ভিডিও এবং চলচ্চিত্র- সব একই বর্ণালির বিভিন্ন উপাদান। প্রশ্ন হল, কিভাবে বিষয়ের সবচেয়ে কাছে পৌঁছানো যায়। এই প্রশ্ন সামনে রেখে বলা যায়, ভবিষ্যৎটা পুরোপুরিই ডিজিটাল ভিডিওর। আমি যে ধরণের অনভিজ্ঞ ও অপেশাদার অভিনেতাদের নিয়ে কাজ করেছি, তারা ডিজিটাল ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে বেশী স্বাচ্ছ্যন্দ বোধ করে। কারণ এক্ষেত্রে কোন আলোকসজ্জা থাকে না, খুব বেশী ক্রুও থাকে না- ফলে আমরা অভিনেতাদের খুব কাছে যেতে পারি, অনেক অন্তরঙ্গ মুহূর্তগুলোও ক্যামেরায় ধারণ করতে পারি। তাছাড়া ৩৫ মিমি ক্যামেরার জন্য আনুষঙ্গিক অনেক কিছু লাগে, এতে নির্মাণ পদ্ধতিও বেশ জটিল- অনেকের পক্ষেই এর ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব হয় না। এজন্য একসময় যে কেউ চাইলেই সিনেমা বানাতে পারতো না। কিন্তু এখন ডিজিটাল ক্যামেরা সবকিছু সহজ করে দিয়েছে, এটা জোগাড় করা কলম জোগাড় করার মতই সোজা। সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকলে এবং নিজের স্বজ্ঞাকে গুরুত্ব দিলে এখন যে কারও পক্ষেই চলচ্চিত্র নির্মাতা হওয়া সম্ভব। লেখক যেমন কলম হাতে তুলে নেয়, এখন ঠিক তেমনিভাবে ক্যামেরা হাতে কাজ শুরু করে দেয়ার সময় এসেছে।
আমি “টেন” এবং “ফাইভ” ডিজিটাল ক্যামেরা দিয়ে করেছি। কিন্তু তিন পর্বের ইতালীয় অ্যান্থলজি সিনেমা “টিকেটস” এর একটি পর্ব (অন্য পর্ব দুটি করেছেন Ken Loach ও Ermanno Olmi) করার জন্য আবার ৩৫ মিলিমিটারে ফিরে এসেছি। ডিজিটালের সব সুবিধা নিতে না চাইলে আমি বলব, ৩৫ মিলিমিটারই অপেক্ষাকৃত ভাল মাধ্যম- বিশেষ করে নাট্য চলচ্চিত্র শ্যুট করার জন্য।
এখনও যেসব ছবি আঁকছেন সেগুলো সম্পর্ক কি কিছু বলবেন?
প্রথমেই বলে নিতে চাই, আমি ছবি আঁকলেও নিজেকে চিত্রশিল্পী মনে করি না। নিজেকে চিত্রশিল্পী হিসেবে আখ্যা দেয়ার চেয়ে চিত্রশিল্পে জড়িয়ে থাকাটা অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ছবি আঁকতে আমার কেবলই ভাল লাগে। অনেকে যখন আমাকে তাদের ছবি বিচার করতে বলে তখন আমি তাদেরকে মনে করিয়ে দেই, চিত্রকলার সাথে নিজেকে জড়িয়ে রাখাটাই মুখ্য। এই মহান শিল্পের সাথে জড়িয়ে থাকাটাই যথেষ্ট, এর বেশী কিছু চাওয়ার নেই- এজন্যই আমি ছবি আঁকি।
আপনি নিজেকে চিত্রশিল্পী মনে করেন না- কিন্তু আপনার সিনেমার সবচেয়ে অসাধারণ দিকগুলোর একটি হচ্ছে, ফ্রেমে বন্দি প্রাকৃতিক দৃশ্য যা একেবারে অনন্য। শিল্প দুটির মধ্যে বিশাল বৈপরিত্য আছে, সামাজিক ও শৈল্পিক উভয় দিক দিয়ে দুটো শিল্পের মধ্যে এত পার্থক্য আর নেই: চিত্রকলা নিভৃতে একা একা চর্চার বিষয়। আর সিনেমা বানাতে অনেক লোক লাগে, অনেকের মাঝে থাকতে হয়। চিত্রকলার ক্যানভাস খুব ছোট, কিন্তু রূপকার্থে সিনেমার ক্যানভাস বিশাল, সীমাহীন।
আমি বাস্তবতার দিকে শৈল্পিকভাবে তাকাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, আমি প্রধানত চিত্রকরের চোখ দিয়ে দেখি। প্রকৃতির দিকে তাকালে একটা ছবির ফ্রেম দেখতে পাই। সবকিছুকেই নৈসর্গ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে পছন্দ করি। এমনকি ট্যাক্সিতে বসে যখন বাইরের দিকে তাকাই, তখনও সবকিছুকে ফ্রেমে বন্দি করে ফেলি। চিত্রশিল্প, আলোকচিত্র এবং সিনেমা- এই তিন শিল্প সম্পর্কেই আমি এই ধারণা পোষণ করি। কারণ এরা সবাই বাস্তবতাকে ফ্রেমে বন্দি করে। এরা পরস্পরের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত, কারণ প্রত্যেকেই ভুল, দুর্ঘটনা, সুযোগ ইত্যাদির সদ্ব্যবহার করে। আমি চিত্রকর রনোয়ারের কাছ থেকে উৎসাহ পাই যিনি বলতেন, ক্যানভাসে ভুলক্রমে কয়েক ফোঁটা রং পড়ে গেলেও খুব বেশী দুশ্চিন্তা করো না, বরং সেই ফোঁটা ব্যবহার করেই নতুন কিছু সৃষ্টির চেষ্টা কর।
এবার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় তুলে ধরতে চাই। শিল্পীর স্বাধীনতার জন্য যত ধরণের সৌভাগ্য দরকার তার অনেকগুলোই যে কারণে অসম্ভব হয়ে পড়ে। ইরানে চলচ্চিত্র নির্মাণের সাথে সেই সেন্সরশিপের সম্পর্কটা কেমন?
গত দশ বছর ধরে সরকার আমার কোন সিনেমাই দেখাতে দিচ্ছে না। আমার মনে হয়, তারা আমার সিনেমা বোঝেই না। কি সেন্সর করতে হবে আর কি করতে হবে না এটা না বোঝার কারণে তারা সবকিছুই আটকে দেয়, যাতে তারা চায় না এমন কোন তথ্যই সাধারণ মানুষের কাছে যেতে না পারে। সব সিনেমা আটকে দেয়াই তো সবচেয়ে নিরাপদ। সরকার এমন সব সিনেমাকে সমর্থন জোগায় যেগুলোর ধরণ-ধারণ আমার সিনেমা থেকে অনেক আলাদা, সেগুলোকে বলা যায় মেলোড্রামা। সরকার যে শুধু সিনেমার মালিকই তা না, সিনেমা বানানোর উপকরণও সব তাদের হাতে। এজন্য আমাকে তাদের আশেপাশে থেকেই কাজ করতে হয়। তারা আমার কাজে কোন বাঁধা দিচ্ছে না, কিন্তু কোন ধরণের সহযোগিতাও করছে না। আমরা একেবারে ভিন্ন জগতে বাস করি। দুটি বিষয় মনে রাখতে হবে: ইরানী কর্মকর্তরা খুব বেশী দিন এক দপ্তরে থাকে না, সিনেমা বিষয়ক দপ্তরগুলোতে যখন এক কর্মকর্তা গিয়ে আরেকজন আসে তখনই আমরা পূর্বের নিষিদ্ধ প্রকল্পের কাজ আবার শুরু করার কথা ভাবতে পারি। আমার দুটি সিনেমা সেন্সরশিপের কবল থেকে রেহাই পেয়েছিল, কারণ সম্ভবত কি সেন্সর করতে হবে সেটা তারা একেবারেই বুঝতে পারেনি। আমার মনে হয়, একটি সিনেমাকে তখনই ভাল বলা যায় যখন সেন্সর বোর্ড তাতে কি সেন্সর করতে হবে সেটা বুঝে উঠতে পারে না। সিনেমা বানানোর পর যদি সেন্সর বোর্ড কিছু অংশ কেটে দেয়, তাহলে বুঝতে হবে, সে অংশটা কেটে ফেলাই উচিত ছিল। কারণ সেন্সর বোর্ড সেই অংশটা বুঝে ফেলেছে।
এ প্রসঙ্গে আরেকটা কথা না বললেই নয়। শুধু অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিষয়বস্তুর কারণেই ইরানী সিনেমা অন্য সব সিনেমা থেকে আলাদা নয়। এই অনন্যতার আরেকটি বড় কারণ, ইরানী সিনেমা দেখলে বোঝা যায়, এখানকার পরিচালকরা বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেই কিভাবে নিজেকে প্রকাশ করার উপায় বের করেছেন। অনেকে সেন্সরকে উৎপীড়ন হিসেবে দেখেন, কিন্তু আমি একে দেখি বাস্তব অবস্থা হিসেবে, যে অবস্থার মধ্যে আমাকে কাজ করতে হচ্ছে। আমি অবশ্যই জানি, বিভিন্ন পরিস্থিতি বিচারে উৎপীড়নের বিভিন্ন অর্থ হতে পারে। কিন্তু চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে মনে করি, এই সীমাবদ্ধ গণ্ডিটাই আমার বাস্তবতা, যে বাস্তবতা থেকে মুক্তির কোন উপায় নেই। শুধু সিনেমা না, পুরো জীবনের প্রেক্ষিতেই সীমাবদ্ধতা মেনে নেয়াটা জরুরী। এটা সবসময়ই ছিল এবং আছে। সীমাবদ্ধতা ছাড়া প্রাচ্যের জীবন কল্পনাও করা যায় না। আমাদেরকে সবসময়ই নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে বাস করতে হয়েছে। সীমাবদ্ধতা এবং মুক্তি- এ দুয়ের সমন্বয় ও লেনদেনই জীবন। কাজকর্ম ও ক্ষমতার ক্ষেত্র বড়ই সসীম। ছোটবেলায় আমাদেরকে সবসময় বলা হতো, এটা করতে পারবে, এটা করতে পারবে না। এমনকি যা করতে পারব সেটা করে আমরা সর্বোচ্চ কতদূর পর্যন্ত যেতে পারি সেটাও বলে দেয়া হতো।
এর সবচেয়ে ভাল উদাহরণ আমাদের ক্লাসরুম। রচনা লেখার সময় শিক্ষক যখন কোন নির্দিষ্ট বিষয় দিয়ে দিতেন তখন আমরা বেশ দ্রুতই মানসম্পন্ন কিছু একটা লিখে দেখাতে পারতাম। কিন্তু যখন কোন বিষয় দিতেন না, আমাদের উপর ছেড়ে দিতেন, তখন লেখার মত কিছুই খুঁজে পেতাম না। সীমা এবং সীমাবদ্ধতা কতটুকু- এটা না বলে দিলে আমরা কিছু করতে পারি না। এটাই আমাদের সংস্কৃতির প্রকৃতি এবং চলচ্চিত্র শিল্পেও এর প্রভাব পড়েছে। উদাহরণ হিসেবে ইরানী বিপ্লবের পরবর্তী চার বছরের উল্লেখ করা যায়। সে সময় সিনেমা শিল্পে খুব হট্টগোল হচ্ছিল, কারণ কোন নিয়ম-নীতিই তখন পর্যন্ত তৈরী করা হয়নি। কোন নিয়ম না থাকায় সে সময় অনেক কিছুই করা যেতো। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে ইরানী প্রযোজক ও পরিচালকরা সে সময় খুব বেশী সিনেমা করেননি। কেউ সুযোগটা কাজে লাগায়নি, কারণ সবাই সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানার জন্য অপেক্ষা করছিল।
আমি বলছি না, এই সীমাবদ্ধতা ভাল এবং এটা থাকা উচিত। আমার কথা হচ্ছে, আমরা এই বাস্তবতা মেনেই বেড়ে উঠেছি, আমাদের মানসিকতা সেভাবেই তৈরী হয়েছে। শুধু আমার পেশা না, সব পেশার জন্যই এই কথাটা সত্য যে, সীমাবদ্ধতা মানুষকে আরও সৃজনশীল করে। আমার এক স্থপতি বন্ধু আছে। সে বলে, অড লট এর জন্য স্ট্রাকচার ডিজাইন করার সময়টা তার সবচেয়ে ভাল যায়। কারণ এই টুকরো টুকরো জমিগুলো সাধারণ গড়নের মধ্যে পড়ে না, এবং এক্ষেত্রে তাকে অনেক সীমাবদ্ধতা মেনে কাজ করতে হয়। এজন্যই তাকে সৃজনশীল হতে হয় এবং সে এটা উপভোগও করে। এ ধরণের সীমাবদ্ধতাগুলোই আসলে মানুষকে সৃজনশীল হওয়ার সুযোগ করে দেয়।
কান চলচ্চিত্র উৎসবে “আ টেস্ট অফ চেরি” দেখানোর আগে আগে ধারণা করা হচ্ছিল যে, ইরানী কর্তৃপক্ষ এটা আটকে দিতে পারে, কারণ এতে আত্মহত্যা নিয়ে কাজ করা হয়েছে। কিন্তু পরবর্তী অনেক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিষয়বস্তুর কারণে কোন সমস্যা হয়নি। বিষয়বস্তুর কারণেই কি এই সিনেমার সেন্সর নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল?
এ নিয়ে অনেক বিতর্ক হচ্ছিল। কিন্তু পরে আমি যখন কর্তৃপক্ষের সাথে নিজে কথা বলি তখন তারা মেনে নেয়ে যে, সিনেমার বিষয়বস্তু আসলে আত্মহত্যা না। এর বিষয়বস্তু জীবনের পছন্দ নিয়ে। জীবন আমাদের জন্য আবশ্যক না, আমরা চাইলে যে কোন সময় জীবন শেষ করে দিতে পারি। একটি দরজা সবসময়ই আছে, চাইলেই তা খুলতে পারি। কিন্তু আমরা বেঁচে থাকাই পছন্দ করি, চলে যেতে চাই না। এই পছন্দই আমার মতে স্রষ্টার দয়া। এই বেছে নেয়ার ক্ষমতা দিয়েছেন বলেই স্রষ্টা দয়ালু। এই ব্যাখ্যা কর্তৃপক্ষ মেনে নিয়েছিল। রুমানীয়-ফরাসি দার্শনিক E. M. Cioran এর একটি উক্তি সে সময় আমাদে অনেক সাহায্য করেছিল: “আত্মহত্যার সম্ভাব্যতা না থাকলে, আমি হয়ত অনেক আগেই নিজেকে মেরে ফেলতাম।” “আ টেস্ট অফ চেরি” সিনেমার বিষয় হল বেঁচে থাকার সম্ভাব্যতা এবং বেঁচে থাকাকে পছন্দ করা। জীবন আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়নি: এটাই সিনেমার মূল থিম।
আমি কি জানতে পারি, ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পরও আপনি কেন ইরানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন? আপনার প্রজন্মের অনেক চলচ্চিত্রকারই তো চলে গিয়েছিলেন।
একটি গাছকে তার মূল থেকে উপড়ে ফেলে অন্য কোথাও নিয়ে গেলে সে আর ফল দেবে না। আর দিলেও তার ফল আগের মত ভাল হবে না। এটা প্রকৃতির নিয়ম। আমার মনে হয়, মাতৃভূমি ত্যাগ করলে আমার অবস্থা এই গাছের মতই হতো।
আপনার সিনেমা বিপ্লবের পর ইরানের বাস্তবতা সঠিকভাবে তুলে ধরতে পেরেছে বলে মনে করেন কি?
না, এ সম্পর্কে একেবারেই নিশ্চিত না। আমার সিনেমা ইরানে জীবনের বাস্তবতা দেখাতে পারে কিনা এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই; আমি জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরি। ইরান অনেক বড় দেশ, তাছাড়া দিন দিন এর ব্যাপ্তি আরও বাড়ছে। মাঝেমধ্যে আমরা যারা ইরানে থাকি তাদের পক্ষেও অনেক বাস্তবতা উপলব্ধি করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
আপনি নিজে কি ধর্ম পালন করেন?
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না। আমি মনে করি ধর্ম খুব ব্যক্তিগত বিষয়, এবং দুঃখের বিষয় হচ্ছে আমাদের দেশে ধর্মের ব্যক্তিগত দিকটাই ধ্বংস হয়ে গেছে। ধর্ম পালন করি- আমার জন্য এটা বলার মত সোজা কাজ আর কিছু নেই, কিন্তু আমি বলব না। আমাদের জীবনের সবচেয়ে ব্যক্তিগত এই বিষয়টাই এখন সরকারকে শক্তি যোগান দেয়ার যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। এখানে কে কতটা ধার্মিক তার মাধ্যমেই মানুষের মূল্য নির্ধারিত হয়।
আপনার প্রায় সব সিনেমাতেই মুখ্য চরিত্রটি থাকে পুরুষ। কড়া ধর্মীয় অনুশাসনকে কি এর একটি কারণ বলা যায়?
ধর্মীয় সীমাবদ্ধতা বাদ দিলেও বলতে হয়, আমি আসলে মা বা প্রেমিকা হিসেবে নারীর ভূমিকা একেবারেই পছন্দ করি না। এছাড়া সহিংসতা বা দীর্ঘমেয়াদী ভোগান্তির শিকার হিসেবেও নারীর ভূমিকা ভাল লাগে না। আমার অভিজ্ঞতাও সেরকম না। নারীকে ব্যতিক্রমী হিসেবে দেখাতে পছন্দ করি না। আমি আসলে কখনোই ব্যতিক্রমী কিছু দেখাই না। বিশেষ করে নায়কোচিত চরিত্রে নারীর ভূমিকা বাজে লাগে, কারণ এটা বাস্তবতা বিবর্জিত। সিনেমায় নারীকে আরেকটি ভূমিকায় দেখা যায়, সেটা হল সাজানোর বস্তু- শুধু ইরান না বিশ্ব চলচ্চিত্রেও এর ব্যাপক প্রভাব আছে। এ ধরণের কোন ভূমিকাই আমার ভাল লাগছে না, তাহলে আর বাকি থাকল কি? আমি অবশ্য “টেন” এর মুখ্য চরিত্রে একজন নারীকে উপস্থাপন করেছিলাম।
এই সিনেমার কাহিনী কি আপনার বৈবাহিক জীবন থেকে অনুপ্রাণিত?
অবশ্যই। আমি নিজে যার অভিজ্ঞতা অর্জন করিনি তা কখনও দেখাই না, বা তার প্রতিফলনও ঘটাতে চাই না। আমি ডিভোর্স করেছিলাম ২২ বছর আগে। নারী নির্যাতন বা মাদকাসক্তির অভিযোগেই কেবল ইরানী মেয়েরা স্বামীর বিরুদ্ধে ডিভোর্সের মামলা করতে পারে। কিন্তু ডিভোর্সের পর সন্তানদের দেখাশোনা করার মত আর্থিক অবস্থা তাদের থাকে না। তাই ছেলেমেয়েদের সাথে তখন তাদের খুব কমই দেখা হয়। ডিভোর্সের পর তারা স্বাধীনতা হারায়, এবং দিন দিন সন্তানদের ভরণপোষণের ক্ষমতা আরও কমতে থাকে। এর ফলে সংশ্লিষ্ট সবাই ভোগান্তির শিকার হয়। “টেন”-এ আমি এই বিষয়টাই তুলে ধরতে চাচ্ছিলাম।
স্বামীকে ডিভোর্স করা একজন মহিলা গাড়িতে করে তেহরানের রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন যাত্রী নিয়ে: তার ছেলে, বন্ধু, একটি পতিতা এবং এক বৃদ্ধ মহিলা। তার ছোট্ট ছেলের মাধ্যমেই আমি ডিভোর্সের ফলাফলগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। ছেলেটির ব্যবহার বেশ উগ্র এবং প্যাসেঞ্জার সিটে বসে সে তার মা’র সাথে খারাপ ব্যবহার করে। মাত্র সাত বছর বয়সেই এই ছেলেটি আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ম্যাসকুলিন লাইসেন্স পেয়ে গেছে। অনেকে একে “সেক্সিস্ট”-ও বলে থাকেন।
আপনি অনেক সিনেমাতেই সাধারণ মানুষদের দিয়ে অভিনয় করান যারা আগে কখনোই অভিনয় করেনি। এরা প্রত্যেকে আবার নিজেদের বাস্তব জীবনের চরিত্রেই অভিনয় করে। এর কারণ কী?
অপেশাদারদের সাথে কাজ করার একটি বিশেষ সুবিধা আছে, তারা আমার চিত্রনাট্য ঠিক করে দিতে পারে। এ কারণেই তাদের ব্যবহার করি। আমি কিছু লেখার পর তাদের দিয়ে বলাই, যদি দেখি তারা স্বাভাবিকভাবে বলতে পারছে না তখনই বুঝে যাই লেখায় সমস্যা আছে। সিনেমা শ্যুট করার পুরো সময়টাতেই অপেশাদার অভিনেতারা “হস্তক্ষেপ” করে। এবং সবশেষে তারাই আমাকে অপেক্ষাকৃত ভাল একটা সিনেমা বানাতে সাহায্য করে। আমি এটা বোঝাতে চাচ্ছি না যে, পেশাদারদের দিয়ে অভিনয় করানোটা নেতিবাচক। আমার কথা হচ্ছে, আমি চরিত্রটির ব্যক্তিত্ব এভাবেই তৈরী করি, এটা আমার পদ্ধতি। সাধারণত পরিচালকরা সাধারণ মানুষের চরিত্রে অভিনয় করার জন্য তারকা নিয়ে আসে, কিন্তু আমি সাধারণ মানুষদের নিয়ে আসি যারা নিজেদের চরিত্রেই অভিনয় করে। তারা কেউই নিজেরটা ছাড়া অন্য কারও চরিত্রে অভিনয় করতে পারবে না। একটা প্রচলিত কথা আছে, নিজের প্রেম নিয়ে লিখলে যে কারও পক্ষেই রোমান্টিক লেখক হওয়া সম্ভব। এজন্যই এই অপেশাদার অভিনেতারা বেশ ভাল করছে, কারণ তাদেরকে নিজের চরিত্রেই অভিনয় করতে হয়, অন্য কারও না। দৃশ্যটা বুঝিয়ে দেয়ার পর পরই তারা কথা বলা শুরু করে, অনেক সময় আমার কল্পনাকেও হার মানায়। অনেকটা চক্রের মত, কোথায় এর শুরু আর কোথায়ই বা শেষ তা জানি না: আমি তাদেরকে কি বলতে হবে শেখাচ্ছি নাকি তারাই আমাকে কি গ্রহণ করতে হবে তা শেখাচ্ছে, তাও জানি না।
সিনেমার দর্শকদের সাথে এই অভিনেতাদের সম্পর্ক কী?
অপেশাদাররা বেশী কিছু করে না এবং এটাই আমার চিত্রনাট্যের সাথে খাপ খায়। আমার চিত্রনাট্যও সবকিছু বানান করে বুঝিয়ে দেয় না। অপেশাদার অভিনেতা ব্যবহার করা এবং তাদের উপর ভিত্তি করে ধীরে ধীরে চিত্রনাট্য লেখা- এই দুটো কাজ দর্শকদেরকে সিনেমার নির্মাণ প্রক্রিয়ায় আরও বেশী অংশ নেয়ার সুযোগ করে দেয়। আমি “অর্ধ-নির্মিত সিনেমার” পক্ষে, যে ধরণের সিনেমার বাকিটা দর্শকরা তাদের মন দিয়ে পূর্ণ করে। ভবিষ্যতের সিনেমা হচ্ছে পরিচালক ও দর্শকের সিনেমা। আমি চলচ্চিত্রকার হিসেবে একটি সিনেমা বানাই, কিন্তু দর্শকরা সেটার উপর ভিত্তি করে নিজেদের মনে ১০০ টি সিনেমা বানায়। প্রতিটি দর্শকই নিজের সিনেমা বানাতে পারে। আমি ঠিক এটাই চাই। মাঝেমাঝে আমার সিনেমার দর্শকরা যখন আমাকে তাদের মানসিক সিনেমার কথা শোনায় তখন আমি বিস্মিত হই। তারা যখন বর্ণনা করে, তখন আমিই তাদের সিনেমার শ্রোতা হয়ে যাই। আমার সিনেমা তখনই কাজ করবে যখন একে দর্শকদের সিনেমা বানানোর ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করা হবে। পারস্যের একটি বচনের সাথে এটা খুব মিলে যায়: “ধার করা চোখ দিয়ে দেখা”। এর মাধ্যমে আমার উদ্দেশ্যটা ব্যাখ্যা করা যায়: আমি চাই দর্শকরা পর্দায় ইতিমধ্যেই ভেসে ওঠা ছবিগুলো দেখুক এবং তাদের ধার করা চোখের মাধ্যমে এমন কিছু কল্পনা করুক যা দৃশ্যের বাইরে রয়েছে। বিষয়টা আরেকভাবে বলি: চলচ্চিত্রের সাধারণ পদ্ধতি হচ্ছে- কিছু দেখানো এবং কিছু বলা। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে এমন সিনেমা তৈরী করা যা দেখলে বোঝা যাবে- কোনকিছু দেখানো বা বলা ছাড়াই আমরা সে সম্পর্কে কতদূর অগ্রসর হতে পারি, দর্শকদের কল্পনাশক্তি কতটুকু ব্যবহার করতে পারি। আপনাকে অবশ্যই ভৌতভাবে যতটুকু দেখানো হচ্ছে তার বাইরেও কল্পনা করতে হবে, কারণ আমরা কেবল এক চিলতে বাস্তবতা দেখাই, বাকিটা থাকে দৃশ্যের বাইরে। চিন্তাধারাটা ভাল- ছবি এবং ক্রিয়ার মাধ্যমে দেখানো হয়নি এমন বিষয়গুলো দেখতে সাহায্য করা। আমি ব্রেসোঁর নীতিতে বিশ্বাসী: সংযোজন নয় বরং বর্জনের মাধ্যমে সৃষ্টি।
এ কারণেই কি আপনার সিনেমা অনেক সময় ইচ্ছে করেই অসমাপ্ত রাখা হয়? যেমন আ টেস্ট অফ চেরি।
হ্যাঁ। কোন একটা উপসংহারের মাধ্যমে সিনেমা শেষ না করার চিন্তাটা আমার মাথায় কয়েক বছর আগে এসেছিল। অধিকাংশ সময়ই দর্শকরা এ আশা নিয়ে সিনেমা দেখতে যায় যে, একটা গল্প বলা হবে। গল্পের বক্তা হিসেবে আমি এবং সিটে বসে সেই গল্প উপভোগ করতে থাকা দর্শকের মধ্যে এই বিভাজন আমি পছন্দ করি না। বরং এটা ভাবতে ভালবাসি যে, দর্শকরা আরও বেশী বুদ্ধিমান। এ কারণেই আমি দুই ঘণ্টা তাদেরকে বন্দি করে রেখে গল্প শোনানো এবং আমি যেভাবে চাই ঠিক সেভাবেই গল্পটা শেষ করে দেয়ার পক্ষপাতি নই। সুতরাং আমি আসলে তাদেরকে বেশী ক্রেডিট দিতে চাই, সিনেমার সাথে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে তাদের মধ্যে সৃষ্টি বা সৃষ্টির সাথে মিশে যাওয়ার উপলব্ধিটা জাগিয়ে তুলতে চাই। অনেক শিল্পী তাদের সিনেমা একেবারে নিখুঁত করতে চান, কিন্তু আমি সেরকম পূর্ণতা খুঁজি না। আমার কাছে পূর্ণতার সংজ্ঞা হচ্ছে, দর্শক সিনেমায় কতটুকু অংশ নিতে পারল সেটা। সুতরাং ভাল সিনেমা সেটাই যেটা দর্শককে বন্দি করে রাখে না বরং তাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিতে পারে।
যারা আগে কখনও অভিনয় করেনি তাদের দিয়ে এত স্বাভাবিক অভিনয় কিভাবে করান? আর আপনার সিনেমাগুলোর জন্য চিত্রনাট্য কিভাবে লেখেন?
আগেই বলেছি, আমার সিনেমার পুরো চিত্রনাট্য আগে থেকে প্রস্তুত করা থাকে না। প্রথমে একটি সাধারণ ধারণা এবং একটি চরিত্র মাথায় থাকে। সেই চরিত্রটি বাস্তবে খুঁজে পাওয়ার আগে চিত্রনাট্য নিয়ে খুব বেশী এগোই না। চরিত্রটি বাস্তবে খুঁজে পাওয়ার পর তার সাথে বেশ কিছু সময় কাটাই, তাকে বোঝার চেষ্টা করি। প্রথমে মনে মনে যে চরিত্রটি ঠিক করেছিলাম তার উপর ভিত্তি করে নয়, বরং বাস্তবে যার সাথে পরিচিত হয়েছি তার উপর ভিত্তি করেই বিভিন্ন নোট লিখি। এটা অনেক দীর্ঘ প্রক্রিয়া, অনেক সময় ছয় মাসও লেগে যেতে পারে। আর শ্যুটিং শুরু করার আগে আমি শুধু নোটই লিখি, সম্পূর্ণ ডায়লগ লিখি না। বাস্তবের চরিত্র সম্পর্কে যা যা জানতে পেরেছি সে অনুযায়ীই নোটগুলো তৈরী করি। শ্যুটিং শুরু করার আগে চরিত্রের অভিনেতাকে নিয়ে কোন রিহার্সালও করি না। অর্থাৎ, তাদেরকে নিজের কাছে টেনে আনার পরিবর্তে আমি নিজেই তাদের খুব কাছে যাওয়ার চেষ্টা করি। তারা বাস্তবতার যত কাছে থাকে আমার পক্ষে কখনই সে পরিমাণ বাস্তবতা সৃষ্টি করা সম্ভব না। আমি অবশ্যই তাদেরকে কিছু দেই, কিন্তু তাদের কাছ থেকেও অনেক কিছু নেই।
রুমির একটি কবিতার সাহায্যে এই পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা যায়। কবিতাটি প্রায় ১,০০০ বছর আগে লেখা হয়েছিল। অনেকটা এরকম: You are like the ball subject to my polo stick; I set you in motion, but once you’re off and running, I am the one in pursuit. তুমিও আমাকে দৌঁড়াতে বাধ্য করছ। তাই সবশেষে ফলাফল দেখার পর ঠিক বোঝা যায় না, আমি পরিচালক না তারাই পরিচালক। প্রকৃতপক্ষে সবকিছুই অভিনেতাদের, আমার দায়িত্ব কেবল পরিস্থিতির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা। এ ধরণের পরিচালনা আমার মতে অনেকটা ফুটবল কোচের মত। কোচ তার খেলোয়াড়দের প্রস্তুত করে যার যার জায়গায় দাড় করিয়ে দেয়। কিন্তু খেলা শুরু হয়ে যাওয়ার পর তার তেমন কিছু করার থাকে না, সে সিগারেট ধরিয়ে সময় পার করতে পারে, মাঝেমধ্যে উদ্বিগ্নও হতে পারে, এর বেশী কিছু না। “টেন”-এ দশটি দৃশ্য আছে, সবগুলোই গাড়ির সামনে রাখা ক্যামেরায় ধারণ করা। এগুলো শ্যুট করার সময় আমি পেছনের সিটে বসে ছিলাম, কিন্তু একটুও হস্তক্ষেপ করিনি। মাঝেমাঝে আমি আরেকটি গাড়িতে করে অভিনেত্রীর গাড়িকে অনুসরণ করেছিলাম, অর্থাৎ শ্যুটিং এর সেটে উপস্থিতও ছিলাম না। কারণ, আমার মনে হয়েছিল অভিনেতারা আমার অনুপস্থিতিতেই ভাল কাজ করতে পারবে। পরিচালকরা সবসময় সৃষ্টি করে না, মাঝেমাঝে অভিনেতাদের কাছ থেকে অনেক কিছু চাইতে গিয়ে সিনেমাটা ধ্বংসও করে ফেলে। অপেশাদার অভিনেতাদের নিয়ে কাজ করার আলাদা নিয়ম আছে। আর এজন্য তাদেরকে অবশ্যই নিজের মত করে কাজ করতে দিতে হবে।
কানুন-এ (ইরানের Institute for the Intellectual Development of Children and Young Adults) কাজ করেছেন বলেই কি আপনি সিনেমা বানানোর এই পদ্ধতি পছন্দ করেন? কানুনে বাচ্চাদের নিয়ে অনেক কাজ করেছেন, তখন তো এই পদ্ধতিই ব্যবহার করতেন।
এই পদ্ধতির মূল খুঁজতে হলে অবশ্যই আমার কানুন (Kanoon) জীবনে ফিরে যেতে হবে। ছোটদের নিয়ে কাজ না করলে কখনই সিনেমা বানানোর এই স্টাইল তৈরী করতে পারতাম না। বাচ্চারা খুব শক্তিশালী ও স্বাধীন চরিত্র, তারা মাঝেমাঝে এমন কিছু করে বসে যা এমনকি মার্লন ব্র্যান্ডোর কাছ থেকেও পাওয়া সম্ভব না। অনেক সময় নির্দিষ্ট কিছু পাওয়ার জন্য তাদেরকে পরিচালনা করা খুব কষ্টকর হয়ে পড়ে। জাপানে যখন আকিরা কুরোসাওয়ার সাথে দেখা হয়েছিল, তখন তিনি আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন: “আপনি ছোটদের দিয়ে এমন অভিনয় করান কিভাবে? আমার সিনেমায়ও মাঝেমাঝে ছোটদের ব্যবহার করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা হচ্ছে, যত শ্যুটিং হতে থাকে ততই তাদের উপস্থিতি কমাতে হয়। কমাতে কমাতে একসময় বাদই দিয়ে দিতে হয়, কারণ তাদেরকে পরিচালনা করার কোন উপায়ই খুঁজে পাই না।” আমার কথা হচ্ছে, কেউ যদি ঘোড়ায় বসা মহারাজার মত থাকে তাহলে ছোটরা তার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে না। তাদের সাথে যোগাযোগ করতে হলে আপনাকে অবশ্যই নিচে নেমে এসে তাদের পাশে বসতে হবে। অভিনেতারাও আসলে বাচ্চাদের মত।
গাড়ির সাথে আপনার সম্পর্ক নিয়ে কি কিছু বলবেন? আপনার সিনেমায় গাড়ির বহুল ব্যবহার দেখা যায়।
আমার গাড়িই আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। সে-ই আমার অফিস, আমার বাড়ি, আমার লোকেশন। যখন গাড়িতে বসে থাকি আর আমার পাশের সিটেও কেউ থাকে, তখন খুব অন্তরঙ্গ একটা অনুভূতি চেপে বসে। আমরা দুজন সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে আছি, মুখোমুখি নয়, পাশাপাশি। আমাদেরকে সবসময় পরষ্পরের দিকে তাকাতে হচ্ছে না, যখন চাচ্ছি কেবল তখনই তাকাচ্ছি। চারপাশটাও দেখতে পাচ্ছি, পাশে কাউকে বসিয়ে রেখে আশপাশে তাকানোটা সাধারণত অসভ্যতা হলেও, এক্ষেত্রে তেমন কোন সম্ভাবনা থাকছে না। আমাদের সামনে একটা বড় স্ক্রিন আছে, পাশের স্ক্রিনে সাইড ভিউও পাওয়া যাচ্ছে। নিরবতাও এখানে ভারী বা কষ্টকর মনে হয় না। একে অপরকে সার্ভ করারও প্রয়োজন পড়ে না। আসলে এই অভিজ্ঞতার আরও অনেক দিক আছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হচ্ছে, গাড়ি আমাদেরকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বয়ে নিয়ে যায়।
আমি অ্যামেরিকান, অ্যামেরিকান মিডিয়ায় ইরান-বিরোধী প্রচারণা দেখে অনেক সময় খুব ভয় হয়। আমার মনে হয়, আপনার সিনেমা অ্যামেরিকান ও ইরানীদের সম্পর্কোন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষত অটোমোবাইলের সাথে আপনার যে সিনেমাটিক প্রেম তার সাথে অ্যামেরিকানদের গাড়ি-প্রীতির খুব একটা পার্থক্য নেই। কিন্তু মিডিয়ার কারণে ভীতিটা থেকেই যায়। কারণ অ্যামেরিকান মিডিয়া দেশের মানুষকে ইরান সম্পর্কে এক ধরণের সাধারণীকৃত ধারণা দিয়ে রাখে এবং তাদেরকে সেভাবেই সবকিছু চিন্তা করতে বলে। এ ব্যাপারে আপনার চিন্তা কেমন?
এই ইস্যুতে আপনার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য ধন্যবাদ। দুর্ভাগ্যবশত, আপনার মত চলচ্চিত্র সমালোচক অ্যামেরিকায় খুব কম, কিন্তু সেখানে ইরান সমালোচকের কোন অভাব নেই। আমাদের, অর্থাৎ চলচ্চিত্রের লোকদের জন্য বিভিন্ন সংস্কৃতির মিলগুলো খুঁজে বের করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে অভিন্ন ভিত্তির সন্ধান করি। কিন্তু রাজনীতিবিদরা সম্ভবত উল্টোটা করে। কারণ বিভিন্ন মানুষের মধ্যে পার্থক্য ও দ্বন্দ্বের মাধ্যমেই তারা লাভবান হয়। আপনি হয়ত জেনে থাকবেন, আর্ট সিনেমার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে, প্রাত্যহিক যে ঘটনাগুলো পত্রিকার প্রধান শিরোনামে উঠে আসে সেগুলোর পেছনে লুকিয়ে থাকা সর্বজনীন বাস্তবতা তুলে ধরা।
অ্যামেরিকায় ইরান ও ইরানী সিনেমার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আরও কিছু কথা বলি। অ্যামেরিকার প্রধান শহরগুলোতে আপনার সিনেমা বানিজ্যকভাবে মুক্তি পাওয়ার পর চোখের নিমিষেই চলে যায়। এটা আমাদের ধাঁধায় ফেলে দেয়। কারণ একটা সময় ছিল যখন বারিমান, ফেলিনি, গোদার-র মত মহান চলচ্চিত্রকারদের সিনেমা এখানে বেশ চলত, তাদের সিনেমার আন্তর্জাতিক ডিস্ট্রিবিউশন খুব ভাল ছিল। এসব সিনেমা দেখার জন্য হলগুলোতে মানুষের লম্বা লাইনও হয়ে যেতো। আপনি বোধহয় তাদের সমান মেধাবী চলচ্চিত্রকারদের একটি সম্পূর্ণ প্রজন্মের প্রথম সদস্য যার সিনেমা চলচ্চিত্র উৎসবের সীমাবদ্ধ গণ্ডিতেই রয়ে যাবে।
এই তিন চলচ্চিত্রকারের সাথে আমাকে তুলনা করার জন্য ধন্যবাদ। আমিও মনে করি, তারা অসাধারণ সিনেমা বানাতেন। কিন্তু সে সময় হলিউডের সিনেমার এত প্রভাব ছিল না। এখন হলিউডের প্রভাব অনেক বেশী, আর এ কারণেই আমাদের সিনেমার দর্শক নেই। বিষয়টা হল, সিনেমা দর্শকদের চোখকে প্রশিক্ষণ দেয়। হলিউড দর্শকদেরকে তাদের সিনেমার জন্য প্রশিক্ষণ দেয়, সেই দর্শকদেরকে আমাদের সিনেমায় কনভার্ট করা তাই খুব কষ্টকর হয়ে পড়ে। কিন্তু নিজের অজান্তেই হলিউড এমন দিকে এগোচ্ছে যে একসময় সেটা আমাদের জন্যই সুফল বয়ে আনবে। এক দিক দিয়ে তারা আমাদের সিনেমাকেই সাহায্য করছে। হলিউডের সিনেমা দেখে দর্শকরা এখন আর পুরো সন্তুষ্ট হতে পারছে না। হল থেকে তারা ক্ষুধা, অতৃপ্তি ও অনিশ্চয়তা নিয়ে বের হয়। এতক্ষণ ধরে কি দেখানো হল বুঝে উঠতে পারে না। এই জায়গাতেই প্রকৃত পরিচালকদের সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। এর মাধ্যমেই তারা দর্শকদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং একসময় তাদের মন জয় করে নিতে পারে।
আমার অনুভূতি হচ্ছে, দর্শকরা এখন আর বেশী কিছু আশা করে না। তারা চূড়ান্ত সুখ চায় না বরং অ্যাকশন এবং এ ধরণের অন্যান্য বিষয়গুলোই পছন্দ করে।
এর কারণ, সিনেমাগুলোই তাদেরকে অ্যাকশনের প্রতি অভ্যস্ত করে ফেলে এবং সুখের সন্ধান করতে দেয় না। চলচ্চিত্রকার নয় বরং টেকনিশিয়ানরা সিনেমা বানানোর কারণেই এমনটি হচ্ছে। এমন একটা সময় আসবে যখন দর্শকরা এটা বুঝে যাবে এবং পরিস্থিতির পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়বে।
সিরিয়াস শিল্প কি সবসময়ই দর্শকদের মাঝে একটি ভিন্ন অস্তিত্বের আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলে?
হ্যাঁ, আমি তা-ই বিশ্বাস করি। কারণ, অন্যথা হলে শিল্পের কোন উদ্দেশ্যই থাকে না। এই উদ্দেশ্য সাধনে যদি ধর্মের ব্যর্থতা প্রমাণিত হয় তাহলে শিল্প চেষ্টা করে দেখতে পারে। ধর্ম ও শিল্প- তারা মানুষকে একই দিকে চালিত করে। ধর্ম অন্য এক জগৎকে নির্দেশ করে, যেখানে শিল্প নির্দেশ করে একটি উন্নততর অস্তিত্বকে। ধর্ম অনেক দূরে অবস্থিত একটি জায়গায় যাওয়ার নিমন্ত্রণ করে, আর শিল্প এমন একটি স্থানের কথা বলে যার দূরত্ব কম হলেও সেখানে পৌঁছানো কঠিন।
অন্য কোন চলচ্চিত্রকারের স্টাইলের সাথে আপনার স্টাইলের মিল আছে বলে মনে করেন?
Hou Hsiao-hsien একজন। তারকভ্স্কির সিনেমা আমাকে ভৌত জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলে, এগুলোই আমার দেখা সবচেয়ে আধ্যাত্মিক সিনেমা। ফেলিনি কিছু কিছু জায়গায় স্বপ্নের জীবনকে সিনেমায় নিয়ে এসেছিলেন, তারকভ্স্কিও এমনটি করেছেন। থেও আগ্গেলোপৌলোসের সিনেমাও কিছু কিছু মূহুর্তে এরকম আধ্যাত্মিকতা অর্জন করে।
আপনি অতীতেও এক ধরণের “কাব্যিক চলচ্চিত্র” নির্মাণের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করেছেন- যে সিনেমাগুলো উপন্যাস বা মঞ্চনাটকের চেয়ে কবিতার প্রতি বেশী কৃতজ্ঞ থাকবে। আর “দ্য উইন্ড উইল ক্যারি আস” নামটি তো Forough Farrokhzad নামক একজন মহিলা কবির কবিতা থেকে নেয়া। সিনেমার একটি দৃশ্যে প্রকৌশলী কবিতাটি আবৃত্তিও করেন। এতে ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াত-ও আছে।
সিনেমাকে বলা হয়েছে “সপ্তম শিল্প”। এই কথাটি দুইভাবে ব্যাখ্যা করা যায়: এটা অন্যান্য শিল্পকে অন্তর্ভুক্ত করে, সে হিসেবে একে অন্যান্য সব শিল্পের যোগফল বলা যায়। অথবা বলা যায়, সবচেয়ে পরিপূর্ণ শিল্প মাধ্যম। আর সিনেমা যদি সপ্তম শিল্পও হয়, তারপরও এটা বেশ আয়রনিক যে, চিত্রকলা, সঙ্গীত ইত্যাদি সব শিল্পেরই বিবর্তন ঘটেছে অর্থাৎ তারা পরিবর্তিত হয়েছে, কিন্তু সিনেমার ক্ষেত্রে এমন কিছু হয়নি। সিনেমা আগে যেমন ছিল এখনও ঠিক তেমন আছে: এটা এখনও গল্প বলার উপর খুব বেশী নির্ভর করে। “কাব্যিক চলচ্চিত্র” বলার মাধ্যমে আমি কোন মানবিক মেসেজ দিতে চাচ্ছি না। আমি বলছি, সিনেমা কবিতার মত হয়ে উঠতে পারে, কবিতার জটিল গুণগুলো অর্জন করতে পারে, এবং এমনকি কবিতার বিশাল বিত্ত-বৈভবের অংশীদার হতে পারে। কবিতার মত সিনেমাও প্রিজমের ক্ষমতা অর্জন করতে পারে।
এ ধরণের অর্থাৎ প্রিজমের মত সিনেমার ক্ষমতা চিরন্তন- নির্দিষ্ট কোন পরিস্থিতি এবং সময়ে আপনি এর সাথে বিভিন্ন উপায়ে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবেন এবং মানুষ নিজেকেও এর মধ্যে খুঁজে পাবে। আমি মনে করি, সিনেমারও অন্যান্য শিল্পের পথ অনুসরণ করা উচিত, একই ধরণের উন্নয়ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়া উচিত, এবং একই ধরণের আউটলুক অর্জন করা উচিত। কিন্তু সেক্ষেত্রে দর্শকদেরকে একটু ছাড় দিতে হবে, চলচ্চিত্রের কাছ থেকে শুধু বিনোদন আশা করলে হবে না। কবিতা না বুঝলে কেউ সেটাকে বাজে কবিতা বলে সাব্যস্ত করে না। বরং সেটার সাথেই বাস করতে শুরু করে। যখন কেউ গান শুনতে যায় তখন তার কাছ থেকে কোন গল্প শোনার আশা করে না। বিমূর্ত চিত্রের দিকে তাকালে কোন ন্যারেটিভ মনে আসে না। তাৎক্ষণিক বা সরল বাস্তবতা নয়, ছবির কারুকার্য ও সংগঠনের মাধ্যমেই সেটার অর্থ বুঝতে চেষ্টা করে। আমি আশাকরি সিনেমা স্ক্রিনের সামনে বসে তারা সে কাজটাই করবে।
“ফাইভ” এর মাধ্যমে আপনি দর্শকদেরকে সে সুযোগটাই দিয়েছেন। গল্প বলার পরিবর্তে কাস্পিয়ান সাগরের তীরে নেয়া পাঁচটি সিংগল-টেক দৃশ্য তুলে ধরেছেন।
হ্যাঁ, “ফাইভ” এর অবস্থান কবিতা, আলোকচিত্র ও চলচ্চিত্রের রাস্তাগুলোর ছেদবিন্দুতে। এটা পরীক্ষণমূলক শিল্প। পরীক্ষণমূলক হতেই হবে, কারণ এখানে একের পর এক দেখানো হয়েছে: ঢেউ ভেঙে পড়ছে, হাঁস হেলে-দুলে সাঁতরে চলছে, পথচারী ব্যয়াম করছে, কতগুলো কুকুর, এবং সবশেষে ঢেউয়ের উপর চাঁদের আলো।
কবিতা ও চলচ্চিত্রের মধ্যে একটি পার্থক্য হচ্ছে: মানুষ মনে করে এক বা দুইবার দেখেই যেকোন সিনেমা বোঝা সম্ভব, কিন্তু কবিতার প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অন্যরকম। আমরা সাধারণত একই কবিতা অসংখ্য বার পড়ি। মানুষ যেহেতু একই সিনেমা বারবার দেখতে অভ্যস্ত না, সেহেতু কাব্যিক চলচ্চিত্র দিয়ে দর্শকদের মন জয় করা কি কোনদিন সম্ভব হবে? আপনার সিনেমা দর্শকরা অনেক বার দেখুক- এটা কি চান, কিংবা অন্তত এই আশা কি করেন?
আমার সিনেমা সবাইকেই একাধিকবার দেখতে হবে এমনটা বলব না। কারণ সেক্ষেত্রে নিজেকে খুব স্বার্থপর মনে হবে। কিন্তু একটা বিষয়ে আমি নিশ্চিত: অনেক দর্শক হল থেকে অসন্তুষ্ট অবস্থায় বেরিয়ে এলেও সিনেমাটা কখনও ভুলতে পারবে না। আমি জানি, সে রাত্রে খাবার টেবিলে বসেও তারা এটা নিয়ে আলাপ করবে। আমি চাই দর্শকরা আমার সিনেমার জন্য আরেকটু বেশী সময় ব্যয় করে এর মধ্য থেকে কিছু একটা বের করে আনার চেষ্টা করুক। সেদিক থেকে চিন্তা করলে, তাদেরকে সিনেমাটা একাধিকবার দেখতেই হবে।
“কাব্যিক” ও “বিমূর্ত” ফাইভ-এর মত আপনার প্রমাণ্য চিত্র “এ.বি.সি আফ্রিকা”-ও তো ডিজিটাল ভিডিওতে করেছিলেন, তাই না?
হ্যাঁ, এ.বি.সি আফ্রিকাতেই প্রথমবারের মত এই আধুনিক ফরম্যাট ব্যবহার করেছি। আসলে ডিজিটাল ক্যামেরা দিয়ে সিনেমা করার ব্যাপারে প্রথমটায় সিরিয়াস ছিলাম না। মানুষ যেমন কোথাও গেলে ছবি তোলার জন্য সাথে ক্যামেরা নিয়ে যায়, আমিও তেমনি কিছু নোট তৈরীর জন্য ডিজিটাল ক্যামেরা সাথে নিয়েছিলাম। কিন্তু কাজ শুরুর পর বুঝেছিলাম এই ক্যামেরা দিয়ে কতকিছু করা সম্ভব। এটা আমাকে বিস্মিত করেছিল, আমার সামনে এক বিশাল সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছিল। তখন মনে হচ্ছিল, ৩৫মিমি দিয়ে কাজ করে জীবনের ৩০টা বছর নষ্ট করেছি। কারণ, আগেই বলেছি আমি যে ধরণের অন্তরঙ্গ ও তাৎক্ষণিক শ্যুটিং করি তার জন্য ৩৫মিমি এক ধরণের বাঁধা হিসেবে কাজ করে। অথচ ক্যামেরার কাজ করা উচিত যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে।
দ্য উইন্ড উইল ক্যারি আসে আমরা দেখেছি, প্রকৌশলী অনেক ক্রু নিয়ে সিনেমা করা বাদ দিয়ে এক বিচ্ছিন্ন গ্রামে চলে যায়। গ্রামে গিয়ে নিভৃতে স্থির ছবি তুলতে থাকে। আপনি যখন দ্য উইন্ড উইল ক্যারি আস শেষ করে এ.বি.সি. আফ্রিকা শ্যুট করতে গেলেন তখনকার অভিযানের সাথে তো এই প্রকৌশলীর অভিযানের তুলনা করা যায়। এই দুই ভ্রমণের মধ্যে মিলটা আসলে কোথায়?
হ্যাঁ, আসলেই অভিযান দুটোর মধ্যে মিল আছে। আমার ভাগ্য ভাল, ঐ সিনেমা দুটি করার মাঝেই ডিজিটাল প্রযুক্তির সাথে পরিচয় হয়েছিল। দ্য উইন্ড উইল ক্যারি আসের প্রকৌশলীর মধ্যে যে ক্লান্তির ছাপ দেখা যায় আমার মধ্যেও সেটা কাজ করছিল; ঠিক তখনই এই নতুন ক্যামেরা দেবদূতের মত এসে আমার শিল্পী জীবন রক্ষা করে। সিনেমা বানানোর জন্য আমি যে ধরণের মানসিক প্রস্তুতি নেই তাতে হয়ত খুব বেশী পরিবর্তন আসেনি, কিন্তু ডিজিটাল ক্যামেরা নির্মাণ প্রক্রিয়া অনেক সহজ করে দিয়েছে।
এ.বি.সি. আফ্রিকা প্রকল্পের শুরুটা কিভাবে হয়েছিল?
আমি ছোটদের নিয়ে অনেক সিনেমা করেছি। এজন্যই জাতিসংঘ উগান্ডায় এইডসের কারণে এতিম হয়ে যাওয়া শিশুদের উপর সিনেমা বানানোর জন্য আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। তারা এমন একটি সিনেমা চেয়েছিল যা এই সমস্যাকে আক্রমণ করতে পারবে। আসলে এ.বি.সি আফ্রিকা এই এতিম শিশুদের সাহায্য করার জন্য সমগ্র বিশ্বের প্রতি উন্মুক্ত নিমন্ত্রণ হিসেবে কাজ করেছে।
উগান্ডায় আপনার অভিজ্ঞতা নিয়ে আরেকটু বিস্তারিত বলতে পারবেন? অন্যান্য আফ্রিকান দেশে না গিয়ে উগান্ডায়ই কেন গেলেন?
উগান্ডায় গিয়েছিলাম কারণ সেখানে অভ্যন্তরীন দাঙ্গা (সিভিল স্ট্রাইফ) তুলনামূলক কম। মাঝেমাঝে আমরা গাড়িতে করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুরে বেড়াতাম, কোথাও এক চিলতে আলো থাকত না। সাদা পোশাক পরা মানুষেরা রাস্তার দুপাশে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকতো। কোন আলোই ছিল না, বিদ্যুৎ, মোমবাতি, কিচ্ছু না। দিনের বেলায় সেখানকার দৃশ্য খুব সুন্দর লাগত, সবকিছু সবুজে ছাওয়া। এমন মানুষও দেখেছিলাম যারা দারিদ্র্যে জর্জরিত হলেও অন্তরের দিক দিয়ে খুব ধনী। তারা খুব সুখী- যা আমি অন্য কোথাও দেখিনি। এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তারা এত সুখী কেন। সে উত্তর দিয়েছিল, কারণ এদের তিনটি জিনিস নেই: দূষণ, দুশ্চিন্তা এবং প্রতিযোগিতা। তাদের অবশ্য একটি প্রতিযোগিতা আছে যা অনেক বড়: জীবন এবং মৃত্যুর মধ্যে প্রতিযোগিতা। এ কারণেই তাদের জীবন খুব অর্থবহ, এইডসের মধ্য দিয়ে আসা মরণ তাদের হাতের খুব কাছে থাকে। তারা কেবল বেঁচে থাকতে পারলেই খুশী।
এইডসের প্রতি কি ইরানী দর্শকদের কোন আগ্রহ আছে, এ নিয়ে কি তারা যথেষ্ট চিন্তিত?
ইরানে এইডস বিষয়ক সব প্রশ্নই অন্ধকারে রেখে দেয়া হয়েছে; এটা যেন এক গোপন রোগ। ২০০১ সালে একবার বিষয়টা সবার সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু প্রকল্পটা ভেস্তে যায়। আমি মনে করি, এইডস একটি আন্তর্জাতিক দুর্যোগ এবং যেকোন দেশই এর দ্বারা ভয়ানকভাবে আক্রান্ত হতে পারে। সুতরাং, এ নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচনা হওয়া উচিত। দুর্ভাগ্যবশত, এইডসের কোন ভিসা লাগে না।
আপনি কি জাতিসংঘের প্রস্তাব আগ্রহভরে গ্রহণ করেছিলেন, আর শুরুতেই কি সিনেমাটা করার ব্যাপারে মনস্থির করে ফেলেছিলেন?
আমি আসলে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাবটা গ্রহণ করিনি। কিন্তু এলাকাটা ঘুরে দেখতে রাজি হয়েছিলাম। সুতরাং উগান্ডা সফরকে আসলে এক ধরণের লোকেশন বাছাই বলা যায়। তবে আমাদের হাতে ক্যামেরা ছিল এবং আমরা শ্যুটিং শুরু করে দিয়েছিলাম- সিনেমার জন্য না, শুধু খসড়া হিসেবে। কিন্তু প্রাথমিক শ্যুটিং শেষ করার পর ফুটেজগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখলাম, এগুলো দিয়েই একটা পূর্ণাঙ্গ সিনেমা বানানো সম্ভব।
এই পদ্ধতির সাথে তো আপনি বেশ পরিচিত, এর আগেও এ ধরণের তাৎক্ষণিক সিনেমা বানিয়েছেন। যেমন “হোমওয়ার্ক” এবং “ক্লোজ-আপ”। কিন্তু সাধারণ সিনেমার ক্ষেত্রে, নির্মাণের পূর্বেও একটা বিশাল প্রস্তুতির ব্যাপার থাকে। সিনেমার মধ্যে শুধু পরিচ্ছন্নতা ও উদ্দেশ্য-বোধ তৈরীর জন্যই এটা লাগে। অথচ আপনার উপস্থিত-সিনেমায় প্রি-প্রোডাকশনের ধারণাটাই লোপ পেয়েছে।
এ ধারার কাজ সম্পর্কে আপনার সাথে আমি একমত। ভাল সিনেমার জন্য একটা উপযুক্ত পূর্ব প্রস্তুতি আবশ্যক। কারণ এটা সিনেমার মানোন্নয়নে সাহায্য করে। অনেক তরুণ চলচ্চিত্রকারের সাথে কলা বলে বুঝেছি, তারা নিজেদের সিনেমা নিয়ে এত চিন্তিত থাকে যে, মূল সিনেমাতে সেই দুশ্চিন্তার ছাপ পড়ে। এই দুশ্চিন্তা সিনেমার জন্য সহায়ক। অপর দিকে যেসব সিনেমার পূর্ব প্রস্তুতি একেবারে নির্ভুল সেগুলোর মধ্যে এক ধরণের শূন্যতা লক্ষ্য করা যায়। কারণ সিনেমা বানানোর সময় নির্মাতাকে কোন দুশ্চিন্তাই করতে হয়নি।
চলচ্চিত্র শিল্পে অনেক দুর্নীতি আছে- সবকিছুই অর্থ নিয়ে। আর এ কারণেই সিনেমার শৈল্পিক ফলাফল ভাল হয় না। এটা থামানোর জন্য আমরা কি করতে পারি?
এদিক দিয়ে আপনি বেশ ভাল একটা কাজ করছেন- কারণ আপনি আপনার সমালোচনায় স্বল্প বাজেটের দিকটা ধরিয়ে দেন এবং এমন সিনেমা সম্পর্কেও আলোচনা করেন যেগুলো কেবল নামেই ছোট। হঠাৎ করে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন করা সম্ভব না, কারণ বর্তমানে সিনেমার চালিকাশক্তি হল ব্যবসা। এই ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অনেক মানুষ কাজ করে, এবং অনেক মানুষ সিনেমা দেখতে যায় কেবলই বিনোদনের জন্য। এ ধরণের সিনেমা অনেক আছে, এবং থাকাটাও বেশ স্বাভাবিক। আর ঠিক এ কারণেই আমাদের সিনেমা মুক্তি পেতে পারে। কারণ ব্যবসায়িক সিনেমা না থাকলে আমাদের সিনেমা প্রদর্শনের কোন প্রয়োজনই পড়তো না। এখন আসলে তেমন কিছু করার নেই। আমরা শুধু ব্যতিক্রমী সিনেমাগুলো ধরিয়ে দিতে পারি, যে কাজটা আপনি করছেন।
আপনি কি স্বপ্ন দেখেন যে, ভবিষ্যতে শিল্পীরা একটি বিকল্প প্রোডাকশন ও ডিস্ট্রিবিউশন ব্যবস্থা গড়ে তুলবে?
আমি মনে করি এটা ধীরে ধীরে তৈরী হবে। সিনেমাকে আরও অন্তর্মুখী, অন্তরঙ্গ ও গভীর হতেই হবে- এছাড়া তার কোন বিকল্প নেই। শুরুতে বলা যায়, ফিল্ম ইন্ড্রাস্ট্রি যে নির্মাণ কৌশল ও সুযোগ-সুবিধা তৈরী করেছে তা নিজে নিজেই ধ্বংস হতে বাধ্য। বম্বাস্টিক সিনেমা ধ্বংস হবেই, কারণ এসব সিনেমার মধ্যে সে ছাড়া আর কিছু নেই। এটা পূর্ণ হতে হতে একসময় ধ্বংস হবে। সুতরাং সেই বিন্দুতে গিয়ে মানুষ আবার অতীত সিনেমায় ফিরে আসবে।
গতকাল আমার হোটেল রুমে বসে এক চ্যানেল থেকে আরেক চ্যানেলে ঘুরছিলাম। মাঝে যে দুই বার চ্যানেল পাল্টানো বন্ধ করেছি সে দুই বারই সাদাকালো সিনেমা চলছিল। একটা ছিল জনি ওয়াইসমুলারের টারজান। এটা তাও দেখার মত, কারণ কেবল বিনোদনের জন্য তৈরী হলেও এটা অপেক্ষাকৃত স্বাস্থ্যকর। এ যুগের রঙিন বিনোদনমুখী সিনেমা তো আমি দেখতেই পারি না। গতকাল টিভিতে এমন একটা সিনেমা অনেক কষ্ট করেও দেখতে পারলাম না। কারণ সেখানে এত কিছু ঘটছিল এবং সবকিছু এত দ্রুত চলছিল যে আমি ভিশনই ঠিক রাখতে পারছিলাম না। বলা যায় খুব বিরক্ত হয়েছি। এজন্যই মনে করি, ভবিষ্যতে বানিজ্যিক সিনেমাতেও একটু শান্তি ও স্থৈর্য্যের প্রয়োজন পড়বে। আর এভাবেই স্বাধীন চলচ্চিত্রের চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। আর আপনি বারবার যেসব হৃদয়হীন অ্যাকশন সিনেমার কথা বলছেন সেগুলোরও একই দশা হবে।
একালের অনেক শিল্পীর পক্ষেই ব্যক্তিগত মনস্তাত্ত্বিক সত্য, সমাজ-রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং শৈল্পিক গড়নের প্রতি সমান একনিষ্ঠ থাকা কষ্টকর হয়ে পড়ে। এই কথাটা কি যৌক্তিক?
আমি পুরোপুরি একমত। আগেই বলেছি, চলচ্চিত্রকাররা দর্শকদের উত্তেজনা ও চাহিদার প্রতি বেশী নজর দিতে বাধ্য হচ্ছে। তাদের মূল উদ্দেশ্য হয়ে পড়ছে দর্শকদের এমনভাবে চালিত করা যাতে নিজেদের লাভ হয়। দর্শকরা আসলেই এভাবে চালিত হতে চায় কি-না, সে প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। আমি কাউকে এখন পর্যন্ত বলতে শুনিনি, “বাস্তবতা দেখানোর পরিবর্তে আমাকে তোমার ইচ্ছা মত ঘোরাও, আমি এটাই পছন্দ করি।” এটা এক ধরণের রোগ যা সমাজের কোন এক জায়গা থেকে আসে, হয়তোবা escapist সিনেমাগুলো থেকেই।
আপনি সাধারণ মানুষ ও দরিদ্রদের নিয়ে সিনেমা বানাতে পছন্দ করেন যা এ যুগে বেশ দুর্লভ।
আমি আমার চারপাশ থেকেই সব উপাদান পাই। সকালে বাড়ি ছেড়ে বেড়োনর পর আমার সাথে যেসব সাধারণ মানুষের দেখা হয় তারাই আমার উপাদান। এখন পর্যন্ত আমার সাথে কোন তারকার দেখা হয়নি, সিনেমার স্ক্রিনে দেখেছি এমন কারও সাথেই না। আমি বিশ্বাস করি সব শিল্পীই তার প্রতিবেশ থেকে শিল্পের উপকরণ পায়। মানুষ এবং তাদের সমস্যাই সিনেমার জন্য সবচেয়ে উপযোগী কাঁচামাল।
চলচ্চিত্র শিল্প কিভাবে সাধারণ মানুষের জীবনে অবদান রাখতে পারে?
দর্শকদের উপর সিনেমার সবচেয়ে বড় প্রভাব হচ্ছে, এটা তাদের কল্পনার লাগাম খুলে দেয়। সিনেমা দেখলে মানুষ ইচ্ছামত কল্পনা করতে শেখে। এর সম্ভাব্য দুটি পরিণতি হতে পারে: হয়ত এটা তার সাধারণ দৈনন্দিন জীবনকে আরও সহনীয় করে তুলবে। অথবা হয়ত এটা দেখার পর সে নিজের দৈনন্দিন জীবনকে খারাপ ভাবতে শুরু করবে, আর এই নতুন সচেতনতা থেকেই নিজের জীবন পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেবে।
এর সাথে সম্পর্কিত আরেকটি প্রশ্ন করি। মানবতাকে অতীতে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। অদৃষ্টবাদী বা নৈরাশ্যবাদী না হয়েও শিল্পীরা কিভাবে সততার সাথে এই পরিস্থিতির মোকাবেলা করে?
প্রশ্নটি খুব কঠিন। শিল্পীরা কিভাবে এটা করে আমি বলতে পারব না। তবে যারা করতে পারে তারাই শিল্পী, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। তারাই মানবতার এই বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতাকে শিল্পে পরিণত করতে পারে। তারা সবাইকে বেদনা থেকে আনন্দ লাভের সুযোগ করে দেয়, বীভৎসতা থেকে সৌন্দর্য্য তৈরী করে। আর ইরান, আফ্রিকা, যুক্তরাষ্ট্র- যে স্থানই বলি কোথাও মানবতার দুর্ভোগ অদূর ভবিষ্যতে দূর হবে না। এই ছোট্ট জীবনে কোথাও অবিচার কমতে দেখিনি, আমার দেশ তো দূরের কথা। আর অবিচার কমানোর জন্য যে সমাধানগুলো দেয়া হচ্ছে সেগুলোও খুব একটা কার্যকর না। ইদানিং “গ্লোবাল ভিলেজ” কথাটি খুব শোনা যায়। কিন্তু আফ্রিকায়, বিশেষ করে উগান্ডায় আমি দেখেছি, বাবা-মা তাদের সন্তানের লাশ বাক্সে ভরে সাইকেলের পিছনে বাঁধছে, খালি পায়ে প্যাডেল মেরে চলেছে গোরস্থানের উদ্দেশ্যে। একজন লেখকের উক্তি শোনাই, লেখকটি কে তা ঠিক করে বলতে পারব না। তবে উক্তিটা এরকম: একবিংশ শতকে মানবতার বয়স হবে মাত্র চার বছর। আমি এটা বিশ্বাস করি। ২০০৫ সালের মানবতাকে চার বছর বয়সের বাচ্চার সাথে তুলনা করা যায়। সুতরাং মানবতার যৌবন দেখার জন্যও আমাদের অনেক অপেক্ষা করতে হবে।
সিনেমার ভবিষ্যৎ কি একই সাথে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশের উন্নয়নের উপর নির্ভর করে না?
আমার মনে হয় না। মাঝেমাঝে তো মনে হয়, আমার দেশে যখন সামাজিক পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ ছিল তখনই শিল্প সবচেয়ে বেশী এগিয়েছে। শিল্প বোধহয় সমাজের ক্ষতিপূরণ হিসেবে কাজ করে। শিল্পীরাই পরিবেশের প্রতিকূলতাকে প্রতিহত করে।
ইরানী সিনেমায় একটি প্রচলিত ধারণা হচ্ছে: শিল্প সবার জন্য; আমি মনে করি এটা অবশ্যই স্বাস্থ্যকর ও গণতান্ত্রিক। কিন্তু আমার মতে, মাঝেমাঝে কিছু পরিচালক সবকিছু এত সাধারণভাবে তুলে ধরেন যে, মনে হয় শিল্প জীবনের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিফলন।
হ্যাঁ, জীবনের হুবহু অনুকরণকে শিল্প বলা যাবে না। গোদারের একটা উক্তি আছে, জীবন একটা সিনেমা যা সুনির্মীত নয়। সিনেমা বানাতে হলে আপনাকে অবশ্যই সবকিছু ভালোভাবে করতে হবে, সেটা সম্পাদনা করতে হবে, কিছু বিষয় পছন্দ করতে হবে, আর কিছু বিষয় ছেঁটে ফেলতে হবে। আপনাকে অবশ্যই সিনেমার অত্যাবশ্যক সত্যটা সৃষ্টি করতে হবে, বাস্তবেই যা আছে তা হুবহু দেখিয়ে দিলে চলবে না।
ওয়েস্টার্ন সংস্কৃতিতে প্রচুর আবহ সঙ্গীত ব্যবহার করা হয় যা আপনার সিনেমায় অনুপস্থিত। এ সম্পর্কে কিছু বলবেন?
সঙ্গীত নিজেই একটি পরিপূর্ণ শিল্প। এটা খুব শক্তিশালী ও চিত্তাকর্ষক। আমার সিনেমায় কখনোই সঙ্গীতের সাথে প্রতিযোগিতা করার সাহস করিনি। সে ধরণের কাজ আমার পক্ষে করা সম্ভবও না। কারণ সঙ্গীত আবেগকে উস্কে দেয়, আর আমি আমার দর্শকদের উপর এই নৈসর্গ্যিক বোঝা চাপিয়ে দিতে চাই না। সঙ্গীত দর্শকের আবেগের উপর কাজ করে, তাদেরকে উত্তেজিত বা বিষণ্ণ করে, এবং তাদেরকে নিয়ে এক আবেগী রোলার-কোস্টারে চেপে বসে। সঙ্গীতের উত্থান-পতনগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে দর্শকরাও রোলার-কোস্টারে ভ্রমণ করতে থাকে। আমি আমার দর্শকদের এতটাই শ্রদ্ধা করি যে, তাদের সাথে এহেন আচরণ করার কথা ভাবতে পারি না।
আবহ সঙ্গীতের ব্যবহারে সাধারণ ওয়েস্টার্ন চলচ্চিত্রকারদের সাথে আপনার এই পার্থক্য প্রসঙ্গে কি জাতীয় চলচ্চিত্রের নাম করা যায়? নাকি সিনেমা এতই আন্তর্জাতিক হয়ে গেছে যে এ যুগে জাতীয় চলচ্চিত্রের ধারণা অবান্তর?
এর উত্তর হ্যাঁ এবং না। প্রতিটি সিনেমারই নিজস্ব জাতীয় পরিচয় ও জন্মের সার্টিফিকেট আছে। তারপরও সবশেষে সিনেমার বিষয়বস্তু হচ্ছে মানুষ এবং মানবতা। একেক দেশের মানুষ একেক রকম, তাদের স্বভাব, ধর্ম, ভাষা এবং জীবনযাত্রার পদ্ধতিতে অনেক পার্থক্য আছে। কিন্তু ভেতরে আমরা সবাই সমান। কোন মানুষের এক্স-রে করে বলা সম্ভব না সে কোন ভাষায় কথা বলে, কোন সমাজ থেকে এসেছে বা তার বর্ণ কী। আমাদের রক্ত একই পদ্ধতিতে সঞ্চালিত হয়, আমাদের চোখ বা স্নায়ুতন্ত্র একই ভাবে কাজ করে, আমরা একই ভাবে কাঁদি বা হাসি, আমাদের কষ্ট পাওয়ার ধরণও এক। যে জাতি বা সমাজেরই হই না কেন, আমাদের সবার দাঁত একইভাবে ব্যথা করে। আমরা যদি সিনেমা এবং সিনেমার বিষয়বস্তু ভেঙে পরীক্ষা করি তাহলে দেখব, সবগুলোই হয় বেদনা নয়তো আনন্দ নিয়ে কথা বলছে। এদিক থেকে তাই সব দেশ সমান।
এবার একটু “ক্লোজ-আপ” এর বার্থ সার্টিফিকেট তথা জাতীয় পরিচয় নিয়ে কথা বলি। সিনেমাটি এমন এক সামাজিক পরিবেশে তৈরী করা যেখানে ইরানীরা আত্ম-পরিচয় সংকটে ভুগছিল। র্যাডিকেল পরিবর্তন এবং এর বিশাল রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবে মানুষ নিজের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন করতে বাধ্য হয়েছিল। ক্লোজ-আপ জাতির সামষ্টিক পরিচয় নিয়ে এ ধরণের কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করেছে।
বুদ্ধিমান দর্শক বা চলচ্চিত্র সমালোচকরা এ ধরণের ব্যাখ্যা দিতে পারে। কিন্তু সিনেমাটা তৈরী করার সময় এমন কোন চিন্তা আমার মাথায় থাকার কথা না, আসলে ছিলও না। তবে সিনেমা নিয়ে আরও চিন্তা করার পর মনে হচ্ছে এটাকে বিভিন্ন দিক থেকে দেখার সুযোগ আছে, একটি দিক হচ্ছে আত্ম-পরিচয়। এছাড়া আরেকটি দিক হতে পারে বড় ধরণের বিপ্লবের পর সৃষ্টি হওয়া সামষ্টিক হতাশা। সিনেমায় সাবজিয়ান নামের এক সিনেমা পাগল নিজেকে চলচ্চিত্রকার মোহসেন মাখমালবফ হিসেবে পরিচয় দেয়। আসলে হতাশার যুগে সে যা চেয়েছে তার কিছুই পায়নি, আর আহানখাহ পরিবার বেশ কিছু জিনিস হারিয়েছে। কিন্তু কোন না কোন উপায়ে তারা একত্রিত হয়েছে। একজন অ-ইরানী দর্শক আমাকে এদিকটা সম্পর্কে বলেছিল এবং তার কথা খুব সত্য মনে হয়েছে। এই দর্শক ভেবে নিয়েছিল, সিনেমার মানুষগুলো সম্পূর্ণ বিপরীত জগৎ থেকে এসে একটি নির্দিষ্ট ঘটনার প্রেক্ষিতে একত্রিত হয়েছে; ভূমিকম্প বা কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর যেমন হয় আর কি। একটি সাধারণ সমস্যা তাদেরকে কাছে আসার সুযোগ করে দিয়েছে।
আপনার অধিকাংশ চরিত্রকেই বাস্তব ও ভ্রমের মধ্যবর্তী নো ম্যান্স ল্যান্ডে বাস করতে দেখা যায়। এজন্যই হয়তোবা নিজেদের জন্য ঠিক করা লক্ষ্যগুলোতে পৌঁছুনো তাদের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ে: “ট্র্যাভেলার” এর ছেলেটা, “দ্য রিপোর্ট” এর মিস্টার ফিরোজ কুহি, “ক্লোজ-আপ” এর হোসেইন সাবজিয়ান, “থ্রু দি অলিভ ট্রিস” এর হোসেইন, “দি এক্সপেরিয়েন্স” এর হোসেইন, “দি ওয়েডিং স্যুট” এর ছেলেটা- ইত্যাদি সবার জন্যই এটা সত্য।
কেউ একজন আমাকে বলেছিল, আমি এই চরিত্রগুলো পছন্দ করি কারণ এরা সবাই অপ্রকৃতস্থ। আমি মনে করি, যেসব অপ্রকৃতস্থ মানুষ নির্ধারিত সীমানা অতিক্রম করে অনেক দূরে যেতে পেরেছে তারাই আমাদের সাহায্য করছে। তারা যেন বলছে, “তোমরা আমাদের জন্য যে সীমানা ঠিক করেছ তা খুব সংকীর্ণ, আমাদের আরও জায়গা দরকার।” আমাদের উচিত শিল্পীর চোখ দিয়ে অপ্রকৃতস্থদের দেখা। বিচারক শেষে তাদেরকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো একেবারেই উচিত না। তাদের দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা দেখিয়ে বেড়ানোও উচিত না। বরং তাদেরকে এমন মানুষ হিসেবে তুলে ধরা উচিত যারা সঠিক সময়ে সঠিক যত্ন পায়নি। সুবিধাবঞ্চিত এবং অপ্রকৃতস্থদের সাহায্য করার জন্য অনেক আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, কিন্তু সবকিছুর পরেও তারা কেমন যেন অবহেলিত রয়ে গেছে। অবস্থা খারাপ হতে হতে যখন এমন হয়েছে যে, কল্পনা করাও সম্ভব হচ্ছে না তখনই কিভাবে যেন তারা কল্পনা করতে শুরু করেছে- তাদের এই কল্পনা একদিন ডালপালা মেলবেই।
সুতরাং আপনার সিনেমার বাচ্চাদেরকেও “অপ্রকৃতস্থ” বলছেন?
হ্যাঁ, ক্লোজ-আপের ত্রিশোর্ধ হোসেইন সাবজিয়ান যে সমাজ এবং শিক্ষার ফলাফল এই বাচ্চারা সেই একই সমাজ এবং শিক্ষার ফল। সিনেমায় হোসেইনের বলা একটা কথা মনে করিয়ে দিচ্ছি। সে বলেছিল, “আমি ট্র্যাভেলার সিনেমার সেই বাচ্চা যাকে ফেলে সবাই চলে গিয়েছিল।” আর ট্র্যাভেলারের এই বাচ্চা কিন্তু অনেকটা “হোমওয়ার্ক” এর বাচ্চাদের মতই। আর এই সব বাচ্চারাই “হোয়ার ইজ দ্য ফ্রেন্ড্স হোম” এর বাচ্চাদের মত। আমি মনে করি, এরা সবাই একরকম, এরা হয়ত হঠাৎ করে বড় হয়ে গেছে, কিংবা কখনই বেড়ে উঠেনি।
আমি এই বলে শেষ করছি যে, আপনার মত সত্যিকারের মেধাবীরাই সাক্ষাৎকারের ব্যাপারে কোন ঝামেলা করে না; যাদের মেধা এবং যোগ্যতায় খাদ আছে তারাই বরং বিচ্ছিন্নতার দেয়াল তুলে দেয়। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
এ প্রসঙ্গে ইরানে একটি প্রবাদ বাক্য আছে, “ফলন্ত বৃক্ষটিই নুয়ে পড়ে।” ধন্যবাদ।
আইনস্টাইনের সাক্ষাৎকার
জার্মানিতে ১৮৭৯ সালে আলবার্ট আইনস্টাইনের জন্ম । খুব অল্প বয়সেই তার প্রতিভার বিকাশ ঘটে। মাত্র ১২ বছর বয়সে, যখন তার সহপাঠীরা তাদের প্রাত্যহিক স্কুলের কাজ নিয়ে ব্যস্ত তখনই আইনস্টাইন শিক্ষকের কাছ থেকে ধার করে আনা উচ্চতর গণিতের বই সমাধান করতেন। মাত্র আঠারো বছর বয়সে তিনি তার সূত্রের পরিলেখ ধারণা করেন এবং দশ বছর পর তা বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপনের উপযোগী করে তোলেন।
আইনস্টাইনকে একজন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ ছাড়াও দার্শনিক এবং রাষ্ট্রনায়ক হিসেবেও দেখা হতো। তার মেধা এবং গভীর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা এবং সমাজের নানা দিকে ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়। একুশ শতকেও তিনি সর্বকালের সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং সর্বশ্রেষ্ট চিন্তাবিদ হিসেবে অভিহিত হন।
প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেসের সিনিয়র এডিটর অ্যালিস ক্যালাপ্রাইস আইনস্টাইনের কাগজপত্র নিয়ে প্রায় ত্রিশ বছর কাজ করেছেন। ১৯৯৬ সালে তিনি আইনস্টাইনের উদ্ধৃতিগুলো নিয়ে একটি বই বের করেন। আইনস্টাইনের প্রায় ১৬০০ উদ্ধৃতি নিয়ে ৬০০ পাতার বই প্রকাশ হয় ২০১১ সালে। অ্যালিসের যত্নে বইটিতে আবারো প্রকাশিত হয় আইনস্টাইনের নানান দিক। সেই বইটি থেকে আইনস্টাইনের সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ অনুবাদ করে দেওয়া হলো।
প্রশ্নঃ পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে সুদীর্ঘ কর্মজীবনের পর আপনি কিভাবে বিজ্ঞানকে সংজ্ঞায়িত করবেন?
আইনস্টাইনঃ বিজ্ঞান হচ্ছে আমাদের বিচিত্র ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার সঙ্গে চিন্তা ভাবনার মিলন। এ মিলনের একক অভিজ্ঞতাকে অবশ্যই তাত্ত্বিক কাঠামোর সাথে এমনভাবে মেলাতে হবে যার ফল অবশ্যই অদ্বিতীয় এবং বিশ্ব্বাসযোগ্য হয়ে উঠবে।
ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা হচ্ছে সেই জিনিস যা আমরা অনুভব করি। কিন্তু তত্ব বা থিওরি অনুবাদ করা হয় বিজ্ঞানের ভাষায়। এটি অবশ্যই কাল্পনিক। এগুলো সবসময়ই প্রশ্নের এবং সন্দেহের তৈরি করে।
প্রশ্নঃ যেসব তরুণরা বিজ্ঞানকে নিজেদের ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে চায়; তাদের প্রতি আপনার কোনো উপদেশ আছে?
আইনস্টাইনঃ খুব প্রতিভাধরদের জন্যেও বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করে কিছু অর্জন করা কষ্টকর। কিছু অর্জন থাকলেও তার মূল্য খুবই সামান্য। কিছু অর্জন করতে হলে মাত্র একটা উপায়ই আছে। সেটি হচ্ছে ব্যবহারিক প্রয়োগের উপরে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া। এর ফলাফল অবশ্যই বাস্তবসম্মত হবে। এছাড়া পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে হবে।
প্রশ্নঃ বৈজ্ঞানিক ক্যারিয়ারের অর্থনৈতিক বাধা কেমন?
আইনস্টাইনঃ যদি কাউকে একদমই আয়-রোজগারের কথা চিন্তা করতে না হয় তাহলে তার জন্য বিজ্ঞান অবশ্যই আশীর্বাদস্বরুপ।
আমি মনে করি, আপনি যে বিষয়ে পারদর্শী সে বিষয়েই কাজ করা উচিত। যখনই কোন দায়বদ্ধতা থাকবে তখন কেউই আর বিজ্ঞান চর্চার আসল মজা পাবে না।
প্রশ্নঃ একজন বিজ্ঞানী সারাজীবনের সাধনায় কি পেলে অথবা আবিষ্কার করলে নিজের পেশাটি তার কাছে উপযুক্ত মনে হবে?
আইনস্টাইনঃ বিজ্ঞান কখনোই একজন মানুষকে উন্নত শ্রেণীতে পরিণত করে না। কিংবা ধনীও করে না। কিন্তু সৃষ্টিশীল কাজ করার সংগ্রাম কিছু সফলতা এনে দেয়। আমি মনে করি, প্রতিটি মানুষের ভেতরে বিজ্ঞানের জন্য প্রত্যাশী মন রয়েছে। যে মন সবসময় সন্তুষ্ট হতে চায়।
প্রশ্নঃ কিন্তু আমার মনে হয় নতুন একটি জ্ঞান যেমন আলো আনে তেমনি একটি আবিষ্কারই পারে একজন বিজ্ঞানীর পেশা জীবনকে লাভবান বা উপভোগ্য করে তুলতে। আপনি কি মনে করেন?
আইনস্টাইনঃ এই ‘আবিষ্কার’ নিজেই একটা শোচনীয় শব্দ। আবিষ্কার হচ্ছে সেই জিনিস যা ইতোমধ্যেই তৈরি হয়ে যাওয়া একটা বিষয়কে তুলে ধরা। যদিও এর সাথে প্রমাণ দেওয়া থাকে কিন্তু তারপরেও তা আবিষ্কারের চরিত্রের সঙ্গে যায় না। কিন্তু চুড়ান্ত ফলাফলের সময় যদিও তা শেষ পর্যন্ত আবিষ্কারের দিকেই এগোয়। যদিও আবিষ্কার বিষয়টি শেষ পর্যন্ত কোন সৃজনশীলতার পরিচয় দেয় না ।
প্রশ্নঃ বিজ্ঞান বিষয়ক প্রশিক্ষণের জন্য আপনি কোন ধরনের স্কুলের পড়ার উপদেশ দেবেন?
আইনস্টাইনঃ একটি স্কুল সবসময় একজন শিক্ষার্থীকে মিষ্টভাষী করে গড়ে তুলতে চায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কখনোই শিক্ষার্থীদের বিশেষজ্ঞ করে গড়ে তোলার চেষ্টা করে না। এসব মিষ্টভাষীদের আমার প্রশিক্ষিত কুকুর মনে হয়। সবাই বিশেষজ্ঞ হতে হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর চেষ্টা জরুরী।
প্রশ্নঃ একজন শিক্ষকের মধ্যে আপনি কি কি গুণাবলী দেখতে চান?
আইনস্টাইনঃ শিক্ষকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে জ্ঞান বিতরণ না করে তাদের মধ্যে জ্ঞান অন্বেষণের চাহিদা জোগানো। একজন ছাত্রের মধ্যে সৃজনশীল অথবা বৈজ্ঞানীক যে মেধাই থাকুক না কেন; তার প্রশংসা করতে হবে। শিক্ষকদের জন্যেও এটা একটা শিল্প যার মাধ্যমে সে একজন ছাত্রের মধ্যে সৃষ্টিশীল ভাব বা জ্ঞান অর্জনের আনন্দ জাগিয়ে তুলতে পারে। বেশীরভাগ শিক্ষকই মুল্যবান সময় নষ্ট করে শিক্ষাথীরা কি জানে না সে বিষয়ে প্রশ্ন করে। শিক্ষকের দায়িত্ব হচ্ছে, শিক্ষার্থীর মন কি জানতে চায়, সে বিষয়টি খুঁজে বের করা।
প্রশ্নঃ একজন ছাত্রের মধ্যে কি কি বৈশিষ্ট থাকা উচিত?
আইনস্টাইনঃ কোন বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করাই শিক্ষার উদ্দেশ্য নয়। জ্ঞান অর্জন খুব সহজ। বই পড়লেই জ্ঞান পাওয়া যায়। শিক্ষার অর্থ হচ্ছে কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তার করার প্রশিক্ষণ। এই প্রশিক্ষণ কোনো বইয়ে পাওয়া যায় না। এটি অর্জন করে নিতে হয়।
প্রশ্নঃ শিক্ষা ব্যবস্থায় পরীক্ষা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
আইনস্টাইনঃ আমি সবসময়ই পরীক্ষার বিরোধীতা করি। পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের জানার আগ্রহকে মেরে ফেলে। শিক্ষার্থীর জীবনে কোনভাবেই দুইটির বেশি পরীক্ষা দেওয়া উচিত নয়। আমি হলে শিক্ষার্থীদের জন্য সেমিনার আয়োজন করতাম। শিক্ষার্থীরা যদি মনোযোগ দিয়ে শুনতো তাহলেই আমি তাদের ডিপ্লোমা দিয়ে দিতাম।
প্রশ্নঃ একজন বিজ্ঞানীকে গবেষণার জন্য আপনি কী উপদেশ দেবেন?
আইনস্টাইনঃ সহজেই যে গবেষণার ফলাফল অর্জন সম্ভব; এমন বিষয়ে গবেষণা করা উচিত নয়।
প্রশ্নঃ বিজ্ঞানকে কিভাবে শিল্পের সঙ্গে যুক্ত করবেন?
আইনস্টাইনঃ দক্ষতার নির্দিষ্ট সীমা পার হয়ে গেলেই বিজ্ঞান ও শিল্প যুক্ত হবে। আমি বলতে চাই, প্রত্যেক বিজ্ঞানীই একজন বড় মাপের শিল্পী।
সূত্রঃ
আইনস্টাইনকে একজন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ ছাড়াও দার্শনিক এবং রাষ্ট্রনায়ক হিসেবেও দেখা হতো। তার মেধা এবং গভীর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা এবং সমাজের নানা দিকে ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়। একুশ শতকেও তিনি সর্বকালের সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং সর্বশ্রেষ্ট চিন্তাবিদ হিসেবে অভিহিত হন।
প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেসের সিনিয়র এডিটর অ্যালিস ক্যালাপ্রাইস আইনস্টাইনের কাগজপত্র নিয়ে প্রায় ত্রিশ বছর কাজ করেছেন। ১৯৯৬ সালে তিনি আইনস্টাইনের উদ্ধৃতিগুলো নিয়ে একটি বই বের করেন। আইনস্টাইনের প্রায় ১৬০০ উদ্ধৃতি নিয়ে ৬০০ পাতার বই প্রকাশ হয় ২০১১ সালে। অ্যালিসের যত্নে বইটিতে আবারো প্রকাশিত হয় আইনস্টাইনের নানান দিক। সেই বইটি থেকে আইনস্টাইনের সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ অনুবাদ করে দেওয়া হলো।
প্রশ্নঃ পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে সুদীর্ঘ কর্মজীবনের পর আপনি কিভাবে বিজ্ঞানকে সংজ্ঞায়িত করবেন?
আইনস্টাইনঃ বিজ্ঞান হচ্ছে আমাদের বিচিত্র ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার সঙ্গে চিন্তা ভাবনার মিলন। এ মিলনের একক অভিজ্ঞতাকে অবশ্যই তাত্ত্বিক কাঠামোর সাথে এমনভাবে মেলাতে হবে যার ফল অবশ্যই অদ্বিতীয় এবং বিশ্ব্বাসযোগ্য হয়ে উঠবে।
ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা হচ্ছে সেই জিনিস যা আমরা অনুভব করি। কিন্তু তত্ব বা থিওরি অনুবাদ করা হয় বিজ্ঞানের ভাষায়। এটি অবশ্যই কাল্পনিক। এগুলো সবসময়ই প্রশ্নের এবং সন্দেহের তৈরি করে।
প্রশ্নঃ যেসব তরুণরা বিজ্ঞানকে নিজেদের ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে চায়; তাদের প্রতি আপনার কোনো উপদেশ আছে?
আইনস্টাইনঃ খুব প্রতিভাধরদের জন্যেও বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করে কিছু অর্জন করা কষ্টকর। কিছু অর্জন থাকলেও তার মূল্য খুবই সামান্য। কিছু অর্জন করতে হলে মাত্র একটা উপায়ই আছে। সেটি হচ্ছে ব্যবহারিক প্রয়োগের উপরে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া। এর ফলাফল অবশ্যই বাস্তবসম্মত হবে। এছাড়া পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে হবে।
প্রশ্নঃ বৈজ্ঞানিক ক্যারিয়ারের অর্থনৈতিক বাধা কেমন?
আইনস্টাইনঃ যদি কাউকে একদমই আয়-রোজগারের কথা চিন্তা করতে না হয় তাহলে তার জন্য বিজ্ঞান অবশ্যই আশীর্বাদস্বরুপ।
আমি মনে করি, আপনি যে বিষয়ে পারদর্শী সে বিষয়েই কাজ করা উচিত। যখনই কোন দায়বদ্ধতা থাকবে তখন কেউই আর বিজ্ঞান চর্চার আসল মজা পাবে না।
প্রশ্নঃ একজন বিজ্ঞানী সারাজীবনের সাধনায় কি পেলে অথবা আবিষ্কার করলে নিজের পেশাটি তার কাছে উপযুক্ত মনে হবে?
আইনস্টাইনঃ বিজ্ঞান কখনোই একজন মানুষকে উন্নত শ্রেণীতে পরিণত করে না। কিংবা ধনীও করে না। কিন্তু সৃষ্টিশীল কাজ করার সংগ্রাম কিছু সফলতা এনে দেয়। আমি মনে করি, প্রতিটি মানুষের ভেতরে বিজ্ঞানের জন্য প্রত্যাশী মন রয়েছে। যে মন সবসময় সন্তুষ্ট হতে চায়।
প্রশ্নঃ কিন্তু আমার মনে হয় নতুন একটি জ্ঞান যেমন আলো আনে তেমনি একটি আবিষ্কারই পারে একজন বিজ্ঞানীর পেশা জীবনকে লাভবান বা উপভোগ্য করে তুলতে। আপনি কি মনে করেন?
আইনস্টাইনঃ এই ‘আবিষ্কার’ নিজেই একটা শোচনীয় শব্দ। আবিষ্কার হচ্ছে সেই জিনিস যা ইতোমধ্যেই তৈরি হয়ে যাওয়া একটা বিষয়কে তুলে ধরা। যদিও এর সাথে প্রমাণ দেওয়া থাকে কিন্তু তারপরেও তা আবিষ্কারের চরিত্রের সঙ্গে যায় না। কিন্তু চুড়ান্ত ফলাফলের সময় যদিও তা শেষ পর্যন্ত আবিষ্কারের দিকেই এগোয়। যদিও আবিষ্কার বিষয়টি শেষ পর্যন্ত কোন সৃজনশীলতার পরিচয় দেয় না ।
প্রশ্নঃ বিজ্ঞান বিষয়ক প্রশিক্ষণের জন্য আপনি কোন ধরনের স্কুলের পড়ার উপদেশ দেবেন?
আইনস্টাইনঃ একটি স্কুল সবসময় একজন শিক্ষার্থীকে মিষ্টভাষী করে গড়ে তুলতে চায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কখনোই শিক্ষার্থীদের বিশেষজ্ঞ করে গড়ে তোলার চেষ্টা করে না। এসব মিষ্টভাষীদের আমার প্রশিক্ষিত কুকুর মনে হয়। সবাই বিশেষজ্ঞ হতে হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর চেষ্টা জরুরী।
প্রশ্নঃ একজন শিক্ষকের মধ্যে আপনি কি কি গুণাবলী দেখতে চান?
আইনস্টাইনঃ শিক্ষকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে জ্ঞান বিতরণ না করে তাদের মধ্যে জ্ঞান অন্বেষণের চাহিদা জোগানো। একজন ছাত্রের মধ্যে সৃজনশীল অথবা বৈজ্ঞানীক যে মেধাই থাকুক না কেন; তার প্রশংসা করতে হবে। শিক্ষকদের জন্যেও এটা একটা শিল্প যার মাধ্যমে সে একজন ছাত্রের মধ্যে সৃষ্টিশীল ভাব বা জ্ঞান অর্জনের আনন্দ জাগিয়ে তুলতে পারে। বেশীরভাগ শিক্ষকই মুল্যবান সময় নষ্ট করে শিক্ষাথীরা কি জানে না সে বিষয়ে প্রশ্ন করে। শিক্ষকের দায়িত্ব হচ্ছে, শিক্ষার্থীর মন কি জানতে চায়, সে বিষয়টি খুঁজে বের করা।
প্রশ্নঃ একজন ছাত্রের মধ্যে কি কি বৈশিষ্ট থাকা উচিত?
আইনস্টাইনঃ কোন বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করাই শিক্ষার উদ্দেশ্য নয়। জ্ঞান অর্জন খুব সহজ। বই পড়লেই জ্ঞান পাওয়া যায়। শিক্ষার অর্থ হচ্ছে কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তার করার প্রশিক্ষণ। এই প্রশিক্ষণ কোনো বইয়ে পাওয়া যায় না। এটি অর্জন করে নিতে হয়।
প্রশ্নঃ শিক্ষা ব্যবস্থায় পরীক্ষা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
আইনস্টাইনঃ আমি সবসময়ই পরীক্ষার বিরোধীতা করি। পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের জানার আগ্রহকে মেরে ফেলে। শিক্ষার্থীর জীবনে কোনভাবেই দুইটির বেশি পরীক্ষা দেওয়া উচিত নয়। আমি হলে শিক্ষার্থীদের জন্য সেমিনার আয়োজন করতাম। শিক্ষার্থীরা যদি মনোযোগ দিয়ে শুনতো তাহলেই আমি তাদের ডিপ্লোমা দিয়ে দিতাম।
প্রশ্নঃ একজন বিজ্ঞানীকে গবেষণার জন্য আপনি কী উপদেশ দেবেন?
আইনস্টাইনঃ সহজেই যে গবেষণার ফলাফল অর্জন সম্ভব; এমন বিষয়ে গবেষণা করা উচিত নয়।
প্রশ্নঃ বিজ্ঞানকে কিভাবে শিল্পের সঙ্গে যুক্ত করবেন?
আইনস্টাইনঃ দক্ষতার নির্দিষ্ট সীমা পার হয়ে গেলেই বিজ্ঞান ও শিল্প যুক্ত হবে। আমি বলতে চাই, প্রত্যেক বিজ্ঞানীই একজন বড় মাপের শিল্পী।
সূত্রঃ
স্টিফেন হকিংয়ের সাক্ষাৎকার
টাইমস ম্যাগাজিনের দশটি প্রশ্নের আলোকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং এর মতামত নিচে তুলে ধরা হলো:স্টিফেন হকিং১. যদি ঈশ্বরের অস্তিত্ব নাই থাকে তবে কেন বিশ্বজুড়ে তার অস্তিত্বের কথা স্বীকার করা হয়?
- আমি বলছি না যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই। আমরা পৃথিবীতে আছি বলেই মানুষেরা ঈশ্বরকে স্মরণ করে। কিন্তু আমি মনে করি ব্যক্তিগত সম্পর্কের চেয়ে পদার্থবিদ্যার সূত্রমতে ঈশ্বর অস্তিত্বহীন।
২. মহাবিশ্বের কি পরিসমাপ্তি ঘটবে? যদি ঘটে তবে নেপথ্যের কারণ কি?
- পর্যবেক্ষণ নির্দেশ করে যে মহাবিশ্ব ক্রমাগত সম্প্রসারণশীল। এটা বেড়েই চলবে শূণ্যতা ও অন্ধকার বাড়ার সাথে সাথেই। যদিও মহাবিশ্বের পরিসমাপ্তি নেই, কিন্তু মহাবিস্ফোরণের একটা শুরু ছিল। কেউ অবশ্য প্রশ্ন করতেই পারেন এর পূর্বে কি ছিল? উত্তর হচ্ছে এর আগে কিছুই ছিল না, যেমন দক্ষিন মেরুর দক্ষিনে কিছুই নেই।
৩. আপনি কি মনে করেন যে দূরবর্তী মহাকাশে যাওয়া পর্যন্ত দীর্ঘকাল আমাদের সভ্যতা টিকে থাকতে পারবে?
- আমি মনে করি সৌরজগতে বসতি স্থাপনের জন্য টিকে থাকার মত আমাদের ভাল সুযোগ রয়েছে। যদিও সৌরজগতের অন্য কোথাও পৃথিবীর মত উপযুক্ত জায়গা নেই। তাই এটি পরিষ্কার নয় যদি পৃথিবী বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে তখন আমরা কিভাবে টিকে থাকব? আমাদের দীর্ঘকাল টিকে থাকা নিশ্চিত করতে আমাদের অন্য নক্ষত্রে পৌঁছতে হবে। এজন্য অনেক সময় প্রয়োজন, সে পর্যন্ত আশা করতে পারি।
৪ যদি আইনস্টাইনের সাথে কথা বলার সুযোগ পেতেন তবে তাকে কি বলতেন?
- আমি তাকে জিজ্ঞেস করতাম কেন তিনি কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কে বিশ্বাস করতেন না। তার আপেক্ষিক তত্ত্বের ফিল্ড সমীকরণ নির্দেশ করে একটি বৃহৎ নক্ষত্র কিংবা গ্যাসীয় মেঘ নিজে নিজেই সংকুচিত হয়ে কৃষ্ণগহ্বর সৃষ্টি করে। আইনস্টাইন এ সম্পর্কে জানতেন কিন্তু কোনভাবে তাকে প্রলুব্ধ করা হয়েছিল যে মহাবিশ্বে বিস্ফোরণের মত কিছু সর্বদাই ঘটতো এবং কৃষ্ণগহ্বরের সৃস্টি হত। কিন্তু যদি বিস্ফোরণ না ঘটতো তবে কি হত?
৫. আপনার জীবদ্দশায় বিজ্ঞানের কোন আবিষ্কার বা অগ্রগতি আপনি দেখতে চান?
- সত্যিকার জ্বালানীর উৎস হিসেবে পারমানবিক ফিউশন বিক্রিয়া। যা দূষণ বা বৈশ্বিক উষ্ণতা ছাড়াই শক্তির অফুরন্ত সরবরাহ নিশ্চিত করবে।
৬. মৃত্যুর পরে বোধ সম্পর্কে আপনার বিশ্বস কি?
- আমি মনে করি মস্তিস্ক হলো একটি কম্পিউটার এবং বোধ কম্পিউটার প্রোগ্রাম। কম্পিউটার বন্ধের সাথে এটিও থেমে যায়। তাত্ত্বিকভাবে নিউরাল নেটওয়ার্কে এটি আবার সৃষ্টি হতে পারে, বিষয়টি অত্যন্ত কঠিন যেহেতু এটি একক স্মৃতিশক্তির সাথে জড়িত।
৭. একজন মেধাবী পদার্থবিজ্ঞানী হয়েও আপনার মধ্যে এমন কোন সাধারণ বিষয় রয়েছে যা মানুষকে বিস্মিত করতে পারে?
- আমি সব ধরনের সঙ্গীত পছন্দ করি- পপ, ধ্রুপদী বা অপেরা। আমার ছেলে টিম এর সাথে ফর্মুলা ওয়ান রেসিং-ও উপভোগ করি।
৮. আপনার শারীরিক অক্ষমতা আপনার কাজে কিভাবে সাহায্য বা বাধার সৃষ্টি করে?
- যদিও দুর্ভাগ্যক্রমে আমি মোটর নিউরন রোগে আক্রান্ত কিন্তু সবকিছুর জন্য আমি ভাগ্যবান। তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায় কাজ করতে পেরে আমি সৌভাগ্যবান, কারণ কিছু ক্ষেত্রে এই অক্ষমতা বড় কোন বাধাই নয় এবং আমার বইগুলোও জনপ্রিয়।
৯. জীবনের রহস্য সন্ধানে মানুষ সকল উত্তর আপনার কাছে জানতে চায় আপনি কি এটাকে গুরুদায়িত্ব বলে মনে করেন?
- জীবনের সকল সমস্যার সমাধান অবশ্যই আমার কাছে নেই। পদার্থবিদ্যা এবং গণিতের মাধ্যমে আমরা মহাবিশ্বের শুরু সম্পর্কে জানতে পারি, কিন্তু এর মাধ্যমে মানবীয় আচরণের ধারণা দেয়া সম্ভব নয় কারণ বহু সমীকরণের সমাধান করা এখনো বাকি। মানুষকে, বিশেষ করে নারীদের বোঝার ক্ষেত্রে আমি মোটেও অন্যদের থেকে আলাদা নই।
১০. আপনি কি মনে করেন এমন কোন দিন আসবে যখন মানুষ পদার্থবিদ্যা বোঝার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু বুঝে ফেলবে?
- আমি আশা করি না, তবে তো আমার কোন কাজই থাকবে না।
টাইমস অনলাইন থেকে অনুবাদ
- আমি বলছি না যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই। আমরা পৃথিবীতে আছি বলেই মানুষেরা ঈশ্বরকে স্মরণ করে। কিন্তু আমি মনে করি ব্যক্তিগত সম্পর্কের চেয়ে পদার্থবিদ্যার সূত্রমতে ঈশ্বর অস্তিত্বহীন।
২. মহাবিশ্বের কি পরিসমাপ্তি ঘটবে? যদি ঘটে তবে নেপথ্যের কারণ কি?
- পর্যবেক্ষণ নির্দেশ করে যে মহাবিশ্ব ক্রমাগত সম্প্রসারণশীল। এটা বেড়েই চলবে শূণ্যতা ও অন্ধকার বাড়ার সাথে সাথেই। যদিও মহাবিশ্বের পরিসমাপ্তি নেই, কিন্তু মহাবিস্ফোরণের একটা শুরু ছিল। কেউ অবশ্য প্রশ্ন করতেই পারেন এর পূর্বে কি ছিল? উত্তর হচ্ছে এর আগে কিছুই ছিল না, যেমন দক্ষিন মেরুর দক্ষিনে কিছুই নেই।
৩. আপনি কি মনে করেন যে দূরবর্তী মহাকাশে যাওয়া পর্যন্ত দীর্ঘকাল আমাদের সভ্যতা টিকে থাকতে পারবে?
- আমি মনে করি সৌরজগতে বসতি স্থাপনের জন্য টিকে থাকার মত আমাদের ভাল সুযোগ রয়েছে। যদিও সৌরজগতের অন্য কোথাও পৃথিবীর মত উপযুক্ত জায়গা নেই। তাই এটি পরিষ্কার নয় যদি পৃথিবী বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে তখন আমরা কিভাবে টিকে থাকব? আমাদের দীর্ঘকাল টিকে থাকা নিশ্চিত করতে আমাদের অন্য নক্ষত্রে পৌঁছতে হবে। এজন্য অনেক সময় প্রয়োজন, সে পর্যন্ত আশা করতে পারি।
৪ যদি আইনস্টাইনের সাথে কথা বলার সুযোগ পেতেন তবে তাকে কি বলতেন?
- আমি তাকে জিজ্ঞেস করতাম কেন তিনি কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কে বিশ্বাস করতেন না। তার আপেক্ষিক তত্ত্বের ফিল্ড সমীকরণ নির্দেশ করে একটি বৃহৎ নক্ষত্র কিংবা গ্যাসীয় মেঘ নিজে নিজেই সংকুচিত হয়ে কৃষ্ণগহ্বর সৃষ্টি করে। আইনস্টাইন এ সম্পর্কে জানতেন কিন্তু কোনভাবে তাকে প্রলুব্ধ করা হয়েছিল যে মহাবিশ্বে বিস্ফোরণের মত কিছু সর্বদাই ঘটতো এবং কৃষ্ণগহ্বরের সৃস্টি হত। কিন্তু যদি বিস্ফোরণ না ঘটতো তবে কি হত?
৫. আপনার জীবদ্দশায় বিজ্ঞানের কোন আবিষ্কার বা অগ্রগতি আপনি দেখতে চান?
- সত্যিকার জ্বালানীর উৎস হিসেবে পারমানবিক ফিউশন বিক্রিয়া। যা দূষণ বা বৈশ্বিক উষ্ণতা ছাড়াই শক্তির অফুরন্ত সরবরাহ নিশ্চিত করবে।
৬. মৃত্যুর পরে বোধ সম্পর্কে আপনার বিশ্বস কি?
- আমি মনে করি মস্তিস্ক হলো একটি কম্পিউটার এবং বোধ কম্পিউটার প্রোগ্রাম। কম্পিউটার বন্ধের সাথে এটিও থেমে যায়। তাত্ত্বিকভাবে নিউরাল নেটওয়ার্কে এটি আবার সৃষ্টি হতে পারে, বিষয়টি অত্যন্ত কঠিন যেহেতু এটি একক স্মৃতিশক্তির সাথে জড়িত।
৭. একজন মেধাবী পদার্থবিজ্ঞানী হয়েও আপনার মধ্যে এমন কোন সাধারণ বিষয় রয়েছে যা মানুষকে বিস্মিত করতে পারে?
- আমি সব ধরনের সঙ্গীত পছন্দ করি- পপ, ধ্রুপদী বা অপেরা। আমার ছেলে টিম এর সাথে ফর্মুলা ওয়ান রেসিং-ও উপভোগ করি।
৮. আপনার শারীরিক অক্ষমতা আপনার কাজে কিভাবে সাহায্য বা বাধার সৃষ্টি করে?
- যদিও দুর্ভাগ্যক্রমে আমি মোটর নিউরন রোগে আক্রান্ত কিন্তু সবকিছুর জন্য আমি ভাগ্যবান। তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায় কাজ করতে পেরে আমি সৌভাগ্যবান, কারণ কিছু ক্ষেত্রে এই অক্ষমতা বড় কোন বাধাই নয় এবং আমার বইগুলোও জনপ্রিয়।
৯. জীবনের রহস্য সন্ধানে মানুষ সকল উত্তর আপনার কাছে জানতে চায় আপনি কি এটাকে গুরুদায়িত্ব বলে মনে করেন?
- জীবনের সকল সমস্যার সমাধান অবশ্যই আমার কাছে নেই। পদার্থবিদ্যা এবং গণিতের মাধ্যমে আমরা মহাবিশ্বের শুরু সম্পর্কে জানতে পারি, কিন্তু এর মাধ্যমে মানবীয় আচরণের ধারণা দেয়া সম্ভব নয় কারণ বহু সমীকরণের সমাধান করা এখনো বাকি। মানুষকে, বিশেষ করে নারীদের বোঝার ক্ষেত্রে আমি মোটেও অন্যদের থেকে আলাদা নই।
১০. আপনি কি মনে করেন এমন কোন দিন আসবে যখন মানুষ পদার্থবিদ্যা বোঝার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু বুঝে ফেলবে?
- আমি আশা করি না, তবে তো আমার কোন কাজই থাকবে না।
টাইমস অনলাইন থেকে অনুবাদ
কার্ল সাগানের সাক্ষাৎকার
১৯৯১ সালের শেষের দিকে বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল সাগান ‘নেহেরু স্মারক বক্তৃতা’ দিতে ভারত এসেছিলেন। এইসময় তিনি মানব অস্তিত্ব বিষয়ে আধ্যাত্মিক ও সংসদীয় নেতাদের এক বিশ্ব সম্মেলনেও ভাষণ দিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে ভারতের বিজ্ঞান জগতের বিভিন্ন বিষয়ে মত বিনিময় করেছিলেন। সাগান তাঁর আলোচনায় একদিকে যেমন মহাকাশ গবেষণার অগ্রগতি সম্পর্কে অবহিত করেন, অন্যদিকে তেমনি বিশ্ব পরিবেশের উদ্বেগজনক অবস্থা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন। তিনি তাঁর ভাষণে, ওজোন স্তরের অবক্ষয়, গ্রীন হাউজ গ্যাস তৈরি ও দ্রুত অরণ্য নির্মূল হওয়া প্রতিরোধে বিশ্বব্যাপী সহযোগিতার আহ্বান জানান। তাঁর মতে, কোন একটি দেশ এইসব সমস্যার জন্য এককভাবে দায়ী নয় এবং এককভাবে কোন দেশের পক্ষে তার মোকাবিলা করাও সম্ভব নয়। আমাদের কাজ করতে হবে একসাথে।
কার্ল সাগানের সাক্ষাৎকার নেবার জন্য ‘স্প্যান’ (ভারতস্থ মার্কিন দূতাবাসের মুখপত্র) পত্রিকার পক্ষ থেকে পুনের ইন্টার ইউনিভার্সিটি সেন্টার যার অ্যাস্ট্রোনমি এন্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের ডিরেক্টর ড. বিষ্ণু নারলিকারকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। দুই বিশ্বখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী মুখোমুখি বসে আলোচনা করেন তাঁদের প্রিয় বিষয়গুলো নিয়ে। এই আলোচনায় স্থান পেয়েছিল মহাকাশ গবেষণার বর্তমান পর্যায়, পৃথিবীতে জীবনের উদ্ভব, বহির্বিশ্বে জীবনের সন্ধান ও অন্যান্য বহু বিষয়।
জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকার : আপনার মনে আছে হয়তো আজ থেকে কুড়ি বছর আগে, আপনি আমাকে নিউইয়র্কের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রহ সম্পর্কিত বিভাগের ড. বিষ্ণু খারে-র গবেষণাগারে নিয়ে গিয়েছিলেন।
কার্ল সাগান : হ্যাঁ, মনে আছে, ড. খারেবেং আমি আজও একইসঙ্গে কাজ করে চলেছি।
নারলিকার : আপনি সেইসময় যে সব গবেষণা করছিলেন, তার কয়েকটি আমাকে দেখিয়েছিলেন। সুতরাং শুরুতেই আমি জানতে চাই, বর্তমানে সেখানে কি ধরনের কাজ চলছে?
সাগান : শনির সবচেয়ে বড় যে চাঁদ বা উপগ্রহ, সেই ‘টাইটান’ এর আবহমন্ডলের অনুরূপ পরিবেশে গবেষণাগারে সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে দারুণ সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। কোন উপগ্রহের বিশেষ বৈশিষ্ট্যই হল, এর আবহমন্ডল খুব ঘন এবং কুয়াশাপূর্ণ। ফলে পৃষ্ঠদেশকে দেখাই যায় না। ১৯৮০-৮১ সালের ভয়েজার-২ মহাকাশযানটি যখন টাইটানের পাশ দিয়ে গিয়েছিল তখনই জানা যায় যে, টাইটানের পৃষ্ঠদেশকে ভালোভাবে দেখা সম্ভব নয়। তবে আমরা সেই অভিযান থেকে জানতে পেরেছি, টাইটানের অবহমন্ডলে রয়েছে অসংখ্য জৈব গ্যাস। আর টাইটানের পৃষ্ঠদেশের অস্পষ্টতার কারণ যে হালকা লাল রঙের কণাগুলি রয়েছে সেগুলির ধর্মও আমরা খুঁজে বের করেছি।
আমরা অতি সম্প্রতি গবেষণাগারে টাইটানের আবহমন্ডলের প্রধান উপাদান - মিথেন ও নাইট্রোজেনকে খুব কম চাপে একসঙ্গে মিশ্রিত করেছি। তারপর শনির চৌম্বক ক্ষেত্রের মধ্যে আটকে থাকা ইলেকট্রনের অনুরূপ আহিত কনা দিয়ে সেই মিশ্রিত গ্যাসকে বিকিরিত করা হয়েছে। এটা করা হয়েছে কারণ, টাইটান শনির পাশ দিয়ে ঘোরার সময় টাইটানের আবহমন্ডলে এসে প্রবেশ করে ইলেকট্রনসমূহ।
টাইটানের আবহমন্ডলের অনুরূপ পরিবেশ তৈরি করতে গিয়ে আমরা পেয়েছি গ্যাস পর্যায়ে বিভিন্ন পদার্থ, আসলে সগুলি জৈব অনু। মিশ্রিত উপাদানের কার্বন, নাইট্রোজেন ও হাইড্রোজেনের পরমানু নিয়েই তৈরি এই জৈব অনুগুলি। সেইসঙ্গে যে পাত্রের মধ্যে এই গ্যাস মিশ্রিত করা হয়েছে তার গায়ে দেখা গেছে হালকা লাল-বাদামী রঙের লবনের গুড়া। আমরা মিলিয়ে দেখেছি, টাইটানের আবহমন্ডলের যে জৈব গ্যাসগুলির কথা জানা গেছে, সেটাই সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এই প্রথম গবেষনাগারে কোন গ্রহ বা উপগ্রহের আবহমন্ডলকে হুবহু তৈরি করা সম্ভব হয়েছে।
এদিকে গবেষণাগারে সেই পরীক্ষা পাত্রের মধ্যেকার কঠিন পদার্থটি নিয়ে তার অপটিক্যাল প্রপার্টি পরিমাপ করে দেখা হয়। তারপর ভয়েজার থেকে পাওয়া টাইটানের মেঘ সম্পর্কিত তথ্যকে গবেষণাগারে পাওয়া তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা গেছে, এদের মধ্যে সুন্দর সাদৃশ্য রয়েছে।
নারলিকার : কি ধরনের তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের বিস্তৃতি আপনি পরিমাপ করেছেন?
সাগান : আমরা এখন পর্যন্ত সফট্ এক্সরে থেকে মাইক্রোওয়েভ পর্যন্ত, পর্যবেক্ষণজাত ধ্রুবকগুলিকে পরিমাপ করেছি। তবে টাইটারকে ঐ পর্যায়ে মাপা হয়নি। অবশ্য এর দৃশ্যমান, অতিবেগুনি ও অবলোহিত রশ্মির কাছাকাছি রশ্মিগুলিকে মাপা হয়েছে। গবেষণাগারে পাওয়া তথ্যের সঙ্গে এর সুন্দর সাদৃশ্য আমরা লক্ষ্য করেছি।
সুতরাং এখন প্রশ্ন হওয়া উচিত : কি সেই কঠিন পদার্থ? লবনের গুড়োই বা কি দিয়ে তৈরি? আমরা অবশ্য এই লবনের গুড়োতে এক ফোঁটা জল ফেলে পেয়েছি নানা ধরনের অ্যামিনো এসিড। সেটি পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এতে রয়েছে নানা ধরনের জৈব অনু। কিছু প্রাণের সৃষ্টি হয়েছে যে ধরনের জৈব অনু দিয়ে তার মতো কিছু ভিন্ন গোত্রের। সুতরাং আমরা রীতিমত উত্তেজিত এটা জেনে যে প্রাণ সৃষ্টির মুহুর্তে পৃথিবীতে যে অবস্থা বিরাজ করেছিল, টাইটানের বুকেও অনুরূপ অবস্থা বিরাজ করার সম্ভাবনা খুবই প্রবল।
অবশ্য এই দুইয়ের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। প্রথমত টাইটানে প্রবল ঠান্ডা বিরাজ করছে। সুতরাং ঐ তাপমাত্রায় তরল জলের দেখা পাওয়ার কথা নয়। তবে বিভিন্ন গ্রহের প্রভাবে যে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ঘটে, তাতে মাঝে মাঝে তরল জলের দেখা যে পাওয়া যায় না,তা নয়। টাইটানেরও প্রায় সর্বত্র তরল জলের দেখা পাওয়া গেছে। সুতরাং এটাকেই আমরা ইঙ্গিতবহ সাফল্য হিসাবে মনে করছি।
প্রকৃতপক্ষে গ্রহ-উপগ্রহের আবহমন্ডলে সংগঠিত রাসায়নিক অবস্থাকে এই প্রথম গবেষণাগারে সঠিকভাবে তৈরি করতে সফল হওয়ায় আমাদের মধ্যে আস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে, অন্য গ্রহের আবহমন্ডলের অনুরূপ আবহাওয়া কিংবা পৃথিবীতে জীবন সৃষ্টির লগ্নে অবস্থা কেমন ছিল তা গবেষণাগারে যখন তৈরি করতে চেয়েছি তা প্রকৃত অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া স্বাভাবিক।
নারলিকার : সৌরজগতের অন্য কোথাও কি আপনি প্রাণের উপস্থিতি অনুমান করেন?
সাগান : প্রাণ সম্পর্কে আমরা কোন কথাই বলিনি। আমরা শুধু বলেছি, জৈব রসায়নের কথা। আমাদের কাছে প্রথম প্রশ্নই করা দরকার, টাইটানের বুকে কি প্রাণের উপসি’তি রয়েছে? এর উত্তরে আমি অনায়াসেই বলতে পারি, জানি না। তাই বলে সেখানকার জটিল জৈব রাসায়নিক অবস্থার প্রেক্ষিতে প্রাণের সম্ভাবনার বিষয়টিকে পুরোপুরি বাদ দেওয়া মোটেই উচিত নয়। কিন্তু আমি যে বিষয়ে জোর দিতে চাই তা হল, দু’টি কথার মধ্যে বিস-র ফারাক রয়েছে। আমি প্রাণের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিতে চাই না মানেই সেখানে প্রাণের উপসি’তি রয়েছে তা কিন’ মোটেই নয়। সৌরজগতের কোথাও প্রাণের কোনরকম অসস্তত্বেরই প্রমান এখন পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুনের মত বড় গ্রহগুলির আবহমন্ডলে তো কার্বন সমৃদ্ধ জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটেই চলছে। তবে টাইটানের আবহমন্ডলের অনুরূপ অবস্থা তৈরির সাফল্যকে একমাত্র সম্বল করে আমরা অন্য গ্রহের আবহমন্ডলের অনুরূপ অবস্থা গবেষণাগারে সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছি। এমনকি, নেপচুনের সবচেয়ে বড় চাঁদ বা উপগ্রহ ‘টাইটান’ সম্পর্কে ১৯৮৯ সালে ভয়েজার-২ মহাকাশযানের পরিভ্রমনের আগে কিছুই জানা ছিল না। সেখানকার আবহমন্ডল নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে জানা গেছে, টাইটানের আবহমন্ডল খুবই পাতলা ধরনের। তার তুলনায় পৃথিবীর আবহমন্ডল লক্ষগুণ বেশি ঘন।
সুতরাং পাতলা আবহাওয়া মানে সব কিছু প্রায় শূণ্য। ফলে সেখানে যা কিছু জৈব পদার্থ তৈরি হচ্ছে তা সঙ্গে সঙ্গে টাইটানের পৃষ্ঠদেশে জমা হচ্ছে। আর সেখানকার জৈব রাসায়নিক অবস্থা সম্পূর্ণ অন্য ধরনের - সবই বরফ পর্যায়ে - নাইট্রোজেন, মিথেন সবই জমাট অবস্থায় রয়েছে।
টাইটানের বুকে একটা সুন্দর জিনিস দেখা গেছে। টাইটানের বুকে জমা হওয়া কালো পদার্থ তুবড়ির মতো আকাশের দিকে ছিটকে বেরিয়ে যাচ্ছে এবং সামান্য চাপে সেখানকার হাওয়ায় সেগুলি উড়ে যাচ্ছে। এই ঘটনার ফলে টাইটানের বুকে দেখতে পাওয়া যায় দারুণ সুন্দর ডোরা ডোরা দাগ। এদিকে গত পাঁচ-ছয় বছরে আমরা আবিস্কার করেছি যে, ধূমকেতুতে বেশ ভালোরকম জৈব পদার্থ রয়েছে এবং এর প্রায় ২০-২৫ শতাংশই জৈব অনু।
সুতরাং প্রশ্ন হল, প্রাণ সৃষ্টিতে কি ধূমকেতুর উল্লেখযোগ্য কোন অবদান রয়েছে? এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, নানা সময়ে ধূমকেতু এসে আছড়ে পড়েছে পৃথিবীর বুকে। আর আজকের তুলনায় কয়েক হাজার বছর আগে ধূমকেতুর পৃথিবীর আছড়ে পড়ার ঘটনা ঘটেছে অনেক বেশি।
নারলিকার : আপনি কি প্রাণ সৃষ্টিতে সূচনার কথা বলছেন?
সাগান : ঠিক তাই। আমি যখন প্রাণ সৃষ্টিতে অবদানের কথা বলছি তখন বুঝতে হবে প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে যে ধরনের জৈব অনু থেকে তার কথা বলছি। জীবন- জীবকোষের কথা মোটেই বলছি না। ২০ শতাংশ জৈব পদার্থ সম্পন্ন বহু সংখ্যক ধূমকেতু পৃথিবীতে আছড়ে পড়েছে। স্বাভাবিকভাবেই পৃথিবীর বুকে সঞ্চিত হয়েছে, বেশ ভালো পরিমান জৈব পদার্থ। অবশ্য ধূমকেতু যেহেতু অসম্ভব দ্রুতগতিতে ছুটে আসে, তাই আমরা হিসেব করে দেখেছি যে, জৈব পদার্থসমূহ সবই পৃথিবীর আবহমন্ডলে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে উচ্চ তাপমাত্রায় শুকিয়ে যায়।
কিন্তু পুরানো দিনের আবহাওয়ায় আজকের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি চাপ ছিল বলে যদি ধরে নেওয়া যায়, তাহলে আবার কম্পিউটার মডেলে সেই অবস্থা পুনঃস্থাপন করে এক অদ্ভূত মজার জিনিস দেখতে পেয়েছি। এইক্ষেত্রে ধূমকেতুগুলির পেছনে দেখা গেছে এক ধরনের ছিপির মত জিনিস। যেগুলি বেশি উত্তপ্ত হয়না। সুতরাং সামনের এবং ভিতরের দিকের জৈব পদার্থ উচ্চতাপে শুকিয়ে গেলেও, দেখা গেছে, পেছনে ছিপির মত জিনিস থাকায় সেখানে জৈব পদার্থ সংরক্ষিত হয়। সুতরাং এইভাবে মহাজাগতিক জৈব পদার্থ পৃথিবীতে জীবন সৃষ্টিতে কোন না কোন ভাবে ভূমিকা নিয়ে থাকতে পারে।
আরেকভাবেও ধূমকেতুর জৈব পদার্থ পৃথিবীতে অবিকৃত অবস্থায় এসে থাকতে পারে। ধূমকেতুর সূক্ষ্ম ভগ্নাবশেষ পৃথিবীর আবহমন্ডলে আসছে অনেক বেশি বেশি পরিমানে। এবং সেগুলি যেহেতু পড়ছে অপেক্ষাকৃত ধীর গতিতে, তাই সেগুলি শুকিয়ে যাবার বা পুড়ে যাবার সম্ভাবনা নেই। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হিসাবে ধরা যেতে পারে ধূমকেতুর পৃথিবীতে আছড়ে পড়ার ফলে যে প্রতিঘাত তরঙ্গের সৃষ্টি হয়েছে তা পুরানো দিনের আবহাওয়ায় যদি কার্বন সমৃদ্ধ থেকে থাকে, তাতে কোন বিক্রিয়া ঘটলেও ঘটে থাকতে পারে।
আসলে আমরা এখন পর্যন্ত বাইরে থেকে এবং ভিতর থেকে যতভাবে জৈব পদার্থের উৎস খুঁজে পাওয়া সম্ভব তার একটা সুসংহত তালিকা তৈরি করেছি। ভিতর থেকে বলতে আমি বোঝাতে চেয়েছি, বজ্রপাতের ফলে সৃষ্ট বৈদ্যুতিক ক্রিয়া বা সূর্য থেকে আসা অতিবেগুনি রশ্মি - কোন উৎস কি ধরনের ভূমিকা পালন করেছে।
তবে সিদ্ধান্ত অবশ্যই মডেল নির্ভর। যদি আগেকার আবহমন্ডল হাইড্রোজেন সমৃদ্ধ ছিল বলে ধরা হয়, তাহলে অনেক জৈব পদার্থের সৃষ্টি সম্ভব। কিন্তু তা না হয়ে যদি ভূবিজ্ঞানীদের অনুমান অনুযায়ী ধরা হয়, আবহমন্ডল প্রধানত কার্বন-ডাই-অক্সাইড সমৃদ্ধ ছিল তাহলে জীবনের উৎস সন্ধান খুব সহজ কাজ নয়। তবে, সেইক্ষেত্রে কি ঘটেছিল সেটা জানা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি।
এই হল মোটামুটি জীবনের উৎস সন্ধানে মহাজাগতিক জৈব পদার্থের কতটা যোগ থাকতে পারে তা নিয়ে গবেষণার কথা।
নারলিকার : মহাকাশে বুদ্ধিমান জীবের সন্ধানে কর্মসূচি (SETI - Search Extraterritorial Intelligence) বিষয়ে আপনার লেখা ‘দি কসমিক কানেকশন’ বইটি আমার আগ্রহকে বাড়িয়ে দিয়েছে। আমেরিকায় এখন সেই অনুসন্ধানের কাজ কোন পর্যায়ে?
সাগান : আশ্চর্যজনকভাবে ভাল অবস্থায় রয়েছে। আশ্চর্যজনকভাবে ভাল বলছি এই কারণে যে, ভিনগ্রহে জীবের সন্ধান নিয়ে মজা বা বিদ্রুপ করা খুবই সোজা। প্রশ্ন উঠতেই পারে, আমাদের যেখানে হাজারো জরুরী সামাজিক সমস্যা রয়েছে সেখানে ভিন গ্রহের ছোট্ সবুজ মানুষের খোঁজ করতে জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ ব্যয় করা কি উচিত? এ কেমন অর্থের অপচয়! আপনি কি এসব ভেবেছেন কখনো?
আমার মতে বিজ্ঞানীরা যদি এই ধরনের প্রকল্পের সদুত্তর দিতে না পারেন, তাহলে তাদের জনগণের অর্থ নেয়া উচিত নয়। আসলে এইসব প্রশ্ন খুবই যুক্তিসঙ্গত।
এই মুহুর্তে আধুনিকতম এক অনুসন্ধান কর্মসূচি নিয়ে কাজ চলছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে মেটা (META - Mega channel Extraterritorial Array)। উত্তর গোলার্ধে ম্যাসচুসেটস্ এর কেমব্রিজে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস্ আয়ারস এর ঠিক বাইরে একসঙ্গে লক্ষ লক্ষ আলাদা আলাদা বেতার তরঙ্গের উপর নজর রাখা হচ্ছে। আর এই কাজ চলছে কোন সরকারি অর্থে নয়। সম্পূর্ণভাবে বেসরকারি একটি সংস্থার সদস্যদের অর্থে পরিচালিত হচ্ছে এই কর্মসূচিটি। সংস্থার নাম দেওয়া হয়েছে ‘দ্য প্ল্যানেটরি সোসাইটি’। আর আমিই এর সভাপতি। এই কর্মসূচির জন্য শুধু আমেরিকা নয় গোটা বিশ্ব থেকে পাঁচ, দশ ও পনের ডলার দান হিসাবে নিয়ে গঠন করা হয়েছে অর্থ ভান্ডার। ঐ থেকেই নিশ্চয় বোঝা যাচ্ছে যে, এখনও ভিনগ্রহে বুদ্ধিমান জীবের খোঁজে আগ্রহ কত ব্যাপক এবং দ্বিতীয়ত এজন্য খরচ হচ্ছে কত সামান্য।
এই বছর নাসা (NASA - National Aeronautics and Space Administration) আরও আধুনিকতম এক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এখনও এর যুতসই কোন নাম দেয়া হয়নি। তবে আমি মনে করি আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে আমরা যদি ভিনগ্রহের অনুমিত সভ্যতা থেকে যদি কোন বেতার সংকেত না পাই, তাহলেও বুঝতে হবে যে, আমরা গুরুত্বপূর্ণ একটা কিছু জানলাম।
নারলিকার : এই ধরনের গবেষণায় বিভিন্ন তত্ত্ব ও অনুমানের ক্ষেত্রে কোন সীমা নির্ধারণ করা কি উচিত?
সাগান : সেটা অবশ্য ঠিক কথা। তবে আমরা যদি সফল হই, তাহলে তো সেটা হবে বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বৈপ্লবিক আবিষ্কার।
নারলিকার : এই সূত্রে আমি জানতে চাই যে, ভারতেও আমরা একটা বিশাল বেতার দূরবীন বসানোর কাজ চালাচ্ছি। পুনে থেকে ৯৫ কিলোমিটার দূরে এটি বসানো হচ্ছে। এটির কাঠামোটি হবে Y আকৃতির। এর প্রতিটি লম্বা রেখায় ছ’টি করে অ্যান্টেনা বা গ্রাহক যন্ত্র থাকবে। প্রতিটি রেখা হবে কয়েক কিলোমিটার দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। আর প্রতিটি ডিস অ্যান্টেনার ব্যাস হবে ৪৫ মিটার। এই প্রকল্পটিতে আমি আমার সহকর্মী ড. গোবিন্দ স্বরূপের সঙ্গে কাজ করছি। তিনিই অবশ্য এর প্রধান মাথা। আপনাদের SETI কর্মসূচির জন্যও এটিকে ব্যবহার করতে পারবেন। আমার মনে হয় এই দারুন যন্ত্রটিকে মহাজাগতিক সংকেত ধরার কাজে আংশিক সময়ের জন্য ব্যবহার করা যাবে।
সাগান : ভিন গ্রহের কোন সভ্যতা থেকে আসতে পারে এমন কোন সংকেত অনুসন্ধানের কাজে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া মোটেই সম্ভব নয়। ভিনগ্রহ থেকে যদি সত্যিই কোন সভ্যতা সংকেত পাঠিয়ে থাকে তবে তা তো আর বিশেষ কোন দেশকে লক্ষ্য করে পাঠাবে না।
নারলিকার : সেটাই তো আসল কথা। আর জানা কোন বিশেষ ভাষাতেও নিশ্চয়ই পাঠাবে না।
সাগান : আমরা আপনাদের প্রকল্পের জন্য কোনভাবে সাহায্য করতে পারি কিনা তা জানাবেন। আমাদের সম্পদ যদিও সীমিত, তবুও আমরা কিভাবে কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে কিংবা কোন ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হচ্ছে সে ব্যাপারে নিশ্চয়ই প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা করতে পারি।
নারলিকার : নিশ্চিতভাবেই এটাও আমাদের কাছে বিশেষ কাজের হবে আমাদের কর্মসূচিটি (GMRT) যেহেতু ১৯৯৪ সাল নাগাদ শুরু হবে সুতরাং হাতে দু’বছর সময়ও রয়েছে।
আমি এখন অন্য বিষয় যেতে চাই। আপনি তো নানাভাবে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার কাজ করে চলেছেন। ভারতে তো ‘কসমস’ টিভি সিরিয়ালটি খুবই জনপ্রিয় হয়েছে। আমি বহু তরুণ ছাত্র/ছাত্রীদের কাছ থেকে এ ব্যাপারে নানা ধরনের প্রশ্ন পেয়েছি। নিঃসন্দেহে এই প্রোগ্রামটি জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে সচেতনতা যথেষ্ট বৃদ্ধি করেছে। বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি?
সাগান : আমরা সমপ্রতি কসমস সিরিয়ালটিও প্রাপ্ত নতুন তথ্যেও আলোকে নতুন করে সাজিয়েছি। যখন এটি প্রথম তৈরি করেছিলাম, তখন শনি, ইউরেনাস, নেপচুন বা হ্যালির ধূমকেতুর মতো কোন ধূমকেতুর কাছাকাছি মহাকাশযান যেতে পারেনি। এখন অনেক তথ্য জানা গেছে, শনি, ইউরেনাস, নেপচুনের বলয় ও চাঁদ সম্পর্কে। এইসব তথ্য যুক্ত করতে হয়েছে কসমস সিরিয়ালে। কসমস এর এই নতুন সংস্করণটি ভারতে যাতে দেখানো যায় সেজন্য কথাবার্তা চলছে। যদিও আমি এখনও এ ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত নই, তবে আশা করি শেষ পর্যন- এটি দেখানো যাবে।
মূল কসমস ধারাবাহিকটি তৈরি করতে প্রায় আড়াই বছর সময় লেগেছিল। আর শুধুমাত্র এই কাজেই লেগে থাকতে হয়েছিল। কিন্তু আমার পক্ষে এই ধরনের কাজ আর নতুন করে করা সম্ভব নয়। তবে বিজ্ঞানের বিভিন্ন দিককে জনপ্রিয় করার জন্য আমি লিখে চলেছি। আমার সর্বশেষ বইটি আমার স্ত্রী অ্যান্ড্রুয়ানের সঙ্গে যৌথভাবে লিখেছি। নাম দিয়েছি ‘বিস্মৃত পূর্বসূরীদের ছায়া’। এই বইয়ে দেখানো হয়েছে, মানুষ কেন আজকের অবস্থায় এসেছে? কোথা থেকেই বা নিজেকে উন্নততর ভাবা, অন্য জীব সম্পর্কে ঘৃণা ও খবরদারি করার মানসিকতা এসেছে? কোথা থেকেই বা মহিলাদের উপর নির্যাতনের মানসিকতা এসেছে? ভারতীয় জীবনেও এমন ঘটনার অজস্র নিদর্শন রয়েছে। রয়েছে মার্কিনী জীবনেও। প্রত্যেকেই এই সব ঘটনার নিন্দা করেন, তবুও এগুলি টিকে রয়েছে। তাই আমরা মনে করেছি, এই ধরনের মানসিকতার সূত্রে অনুসন্ধান অনেক বেশি জরুরী ও প্রয়োজনীয়। এই বিষয়গুলি জ্যোতির্বিজ্ঞানের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত নয় ঠিকই, তবে এগুলি যে গুরুত্বপূর্ণ সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
নারলিকার : জ্যোতির্বিজ্ঞানের কোন বিষয় নিয়ে আমি যখন বক্তৃতা দেই, তখন দেখেছি শ্রোতারা সাধারণভাবে শেষেই প্রশ্ন করেন। অনেকে সরাসরি যে বিষয়ে বক্তৃতা দেই, সে বিষয়ে প্রশ্ন করেন, যেমন, মহাবিস্ফোরণ কিংবা কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কে। তার অনেকেই বিষয় যাই হোক না কেন উড়ন্ত চাকতি বা UFO কিংবা বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল সম্পর্কে, আমার ধারণা আপনিও নিশ্চয়ই এই ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি হন। কিন্তু এই সব প্রশ্নের উত্তর দেন কিভাবে?
সাগান : হ্যাঁ। এখানেই আমি একজনের ফোন পেয়েছি, যিনি আমাকে তাঁর সংগ্রহে নাকি উড়ন্ত চাকতির নিদর্শন রয়েছে, সেটি দেখাতে চান।
আমি এই ধরনের তাৎক্ষণিক উত্তর দিতে অভ্যস-। বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল বলতে দাবি করা হয়, বারমুডা দ্বীপের কাছে আটলান্টিক মহাসাগরে এমন একটি জায়গা রয়েছে, যেখানে নাকি বিমান ও জাহাজ রহস্যজনকভাবে লাপাত্তা হয়ে যায়। এখন, প্রথম প্রসঙ্গিক তথ্যটি হল, জলে কোন বস’র ডুবে যাওয়া ভৌত ঘটনা বলে জানি। ধরা যাক এর সঙ্গে ট্রেনের লাপাত্তা হয়ে যাওয়া তুলনা করা যায়। যদি দেখা যায়, পুনে ট্র্যাঙ্গেলে ভারতের গাড়িগুলি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে, তাহলে বলতে হবে এটা সত্যিই রহস্যজনক ঘটনা। কেননা, ট্রেন কিন্তু নিশ্চিহ্ন হতে পারে না অথচ বিমান বা জাহাজের নিশ্চিহ্ন হওয়ার ঘটনা আমাদের জানা। এগুলি যেমন ডুবে বা ভেঙ্গে পড়ে তেমনি সাগরতলে বা মাটিতে জমাও হয়, সুতরাং এগুলির ক্ষেত্রে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া কোন রহস্য নয়।
সুতরাং বারমুডা ট্র্যাঙ্গেল সম্পর্কে আমার প্রশ্ন হল জাহাজ ও বিমান কি বারমুডা ট্র্যাঙ্গেলে পৃথিবীর অন্য জায়গা থেকে বেশি হারিয়ে যাচ্ছে? এবং এর উত্তর নিশ্চিতভাবেই - না। আসলে বারমুডা ট্র্যাঙ্গেল কোন রহস্য নয়। সবটাই অজ্ঞতা। এক অর্থে বুজরুকি। মানুষকে ভুল বুঝিয়ে বিভ্রানি- সৃষ্টি করে অর্থ উপার্জনের চেষ্টা।
আর UFO প্রসঙ্গে একটা কথা বলি। আপনি তো জানেন, ভিন গ্রহে জীব সম্পর্কে আমার চেয় বেশি কেউ আগ্রহী নিশ্চয়ই নয়। প্রাণের সঞ্চালনে গ্রহ-গ্রহান্তরে মাহাকাশযান পাঠানোর সব কর্মসূচিতেই আমি গভীরভাবে জড়িত। বহির্বিশ্ব থেকে কেউ কোন বেতার সংকেত পাঠালোকি না তার সন্ধানেও আমি যুক্ত। সুতরাং ভিনগ্রহে সভ্যতার কোন সন্ধান পেলে আমিই সবচেয়ে বেশি খুশি হব। কিন্তু অসাধারণ একটা দাবির জন্য তো অসাধারণ প্রমানের দরকার। আর UFO এর ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত পাওয়া কোন প্রমানই তেমন ভাল নয়। এমন অনেক বিষয় আছে যেগুলি সম্পর্কে সাধারণ মানুষ ভাবতে পারেন কিছূ ঘটেছে, কিন্তু তা আদৌ না-ও হতে পারে। মানুষের আচার ব্যবহারে এই মনস-াত্ত্বিক ব্যাপারটি অস্বাভাবিক কিছু নয় আর মানুষ অনেক সময় মিথ্যেও বলে। যেমনি মানুষ মদ্যপও হয়, তেমনি আকাশকুসুম কল্পনাতেও অভ্যস্ত।
এ পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ UFO এর কথা শোনা গেছে। কিন্তু এর কোন ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষদর্শীরা মহাবিশ্ব থেকে পাওয়া কোন বস্তু দেখাতে পেরেছেন? যেমন ধরা যাক, অদ্ভূত লিপির কোন বই রয়েছে পৃথিবীতে? অজানা এমন কোন সংকর ধাতু কিংবা এমন কোন পদার্থ, যার অভিকর্ষ বিরোধী ধর্ম রয়েছে? তাছাড়া যা দেখা যায় তাই কি বাস্তব? উত্তর অবশ্যই, না একটি ভাল ছবিও জাল হতে পারে। অনেক ঘটনাই নির্ভরযোগ্যভাবে প্রকাশ করা হতে পারে - যেমন শ’য়ে শ’য়ে শত্রুর বিভিন্ন জায়গা থেকে আকাশে আলোক রশ্মি দেখতে পেলেন। কিন’ আকাশে তো বহু কিছুর জন্যই আলো দেখা যেতে পারে। কক্ষপথে স’াপিত হওয়ার আগ মুহুর্তে রাশিয়ার বা আমেরিকার কোন বুস্টার থেকেও মোহময় আলোর দ্যুতি দেখা যেতে পারে। সুতরাং আবারও আমি বলতে চাই, অসাধারণ কোন কোন দাবির জন্য তেমনই অসাধারণ কোন প্রমান হাতে থাকা চাই। আর শুধু প্রমানই যথেষ্ট নয়। হাতে যদি সত্যিই ভালো প্রমান থাকে তো সে ব্যাপারে আমি খুবই খোলামেলা। তবে, আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছি যে, একজন বা দু’জন মানুষের কাছ থেকে তাদের দাবি মত অসাধারণ অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে যাওয়াটা আসলে সময়ের অপচয় মাত্র। এদের অনেকেই হয়তো আন্তরিক, কিন্তু তাদের কোন দাবিই বৈজ্ঞানিক প্রমানে প্রয়োজনীয় মানের ধারে কাছে নয়। তাই যারা মহাকাশে যান তাদের প্রত্যেককেই আমি বলি, দয়া করে আসবার সময় সঙ্গে করে নিয়ে আসবেন মহাজাগতিক কোন জীবকে।
নারলিকার : আথবা কোন মহাজাগতিক বস্তু ………।
সাগান : মহাজাগতিক জীবই সবচেয়ে ভাল। তবে কোন বস্তু, নিদর্শন বা যে কোন ধরনের পোষ্য কিছু হলেও ভাল।
নারলিকার : ধরা যাক, আপনি ভিনগ্রহে কোন বুদ্ধিমান জীবের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারলেন, তখন আপনি তাদের কি প্রশ্ন করবেন? আর এটাতো নিশ্চয়ই ধরে নেবেন যে, তারা আমাদের থেকে অনেক বেশি জ্ঞানী হবে।
সাগান : তাদের সঙ্গে যোগাযোগটাই হবে আসল ব্যাপার। তবে আমার মনে হয়, পদার্থবিজ্ঞান, অংক কিংবা জৈব বিজ্ঞান সংক্রান্ত প্রশ্নে চেয়ে অনেক বেশি জরুরি সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় বিষয়ে প্রশ্নও আকর্ষণীয় হতে পারে। হয়তো জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে, ফরম্যাটের শেষ উপপাদ্যগুলি ঘনককে দু’টি ঘনকে পরিণত করা সম্ভব অথবা একটি চতুর্থ ঘাতকে দু’টি চতুর্থ ঘাতে অথবা যেকোন ঘাতকে (সসীম বা অসীম) দু’টি সম ঘাতসম্পন্ন রাশিতে পরিণত করা সম্ভব। এই উপপাদ্যটির প্রমান এখনও পাওয়া যায়নি।
নারলিকার : এ ব্যাপারে আমার প্রশ্ন হতে পারে: রেম্যান প্রকল্প কি সঠিক? (এই প্রকল্পটিও প্রমাণ করা যায়নি। জটিল রাশির আপেক্ষিতা সম্পর্কিত রেম্যান প্রকল্পের মৌলিক রাশির সংঘাতের প্রত্যক্ষ প্রয়োগ রয়েছে)
সাগান : হ্যাঁ, এই ধরনের প্রশ্ন এবং এর চেয়েও কঠিন কঠিন বিষয়ে প্রশ্ন করা যেতে পারে।
নারলিকার : আমি অংক বা পদার্থবিজ্ঞানকে বাছাই করার পক্ষপাতী, কারণ, উভয়ের ক্ষেত্রে সমস্যা হবে একটা। আর সামাজিক সমস্যা বা অর্থনৈতিক সমস্যা .. .. ..
সাগান : ঠিক তাই। কে জানে তারা কেমন দেখতে? কেমনই বা তাদের সমস্যা? যাই হোক, কোনটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সেটা ঠিক করাই আমার পক্ষে কঠিন। তবে আমি সেই দিনের দিকে তাকিয়ে রয়েছি। খুব মজা হবে সে সময়।
নারলিকার : আপনি তো পারমাণবিক বিপর্যয়, পারমাণবিক শৈত্য এবং এই ধরনের বিষয়ে অনেক লেখাই লিখেছেন। কিন্তু অবস্থার কি কোন পরিবর্তন দেখছেন?
সাগান : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ওসাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে উত্তেজনা যে অনেকটাই প্রশমিত হয়েছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। দুই দেশের এই অবদানের জন্য সকলেই কৃতজ্ঞ। তবে, আমার বিচারে প্রধান অবদান মিখাইল গর্বাচেভের। ইতিহাসের দিকে বস্তুগতভাবে যদি দৃষ্টি ফেরাই তাহলে দেখি গর্বাচেভ এমন এক ব্যক্তিত্ব, যার কোন কিছু করার মত দৃঢ়তা ও বলিষ্ঠতা ছিল। ওয়ারশ’ জোট আজবেঙ্গে গেছে। পাঁচ-ছয় বছর আগেও এটা কি কেউ ভাবতে পেরেছিল? নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ ঘটনা। অবশ্য কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি সোভিয়েত ইউনিয়ন, কোন দেশই একটিও পরমানু অস্ত্র ধ্বংস করেনি। অনুামানিক প্রায় ৫৫ হাজার পরমানু অস্ত্র তো যে কোন মুহুর্তে প্রয়োগ করার জন্য তৈরি রাখা হয়েছে। সুতরাং এই অবস্থাকে মোটেই নিরাপদ বলা যায় না। তবে, পুরোপুরি নিরাপদ না হলেও নিরাপত্তার আভাস মিলেছে।
নারলিকার : তাছাড়া তথ্য পাচার ও ছোট ছোট দেশ বা গোষ্ঠীর হাতে পরমানু অস্ত্র আসার ফলে বিপদ বাড়ছে।
সাগান : আমি শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা বলছি। এ ক্ষেত্রেও বড় রকমের বিপদের ঝুকি রয়েছে। যেমন সোভিয়েত ইউনিয়নে পরমানু অস্ত্র ভান্ডারের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে সেটা একটা বড় ব্যাপার। মনে রাখা দরকার, তাদের হাতে ২৫ হাজার পরমানু অস্ত্র রয়েছে। এবং এর শ’ খানেকেই কোন দেশকে ধ্বংস করা কিংবা কোন শহরকে লক্ষ্য করে পারমাণবিক শৈত্য সৃষ্টি করার পক্ষে যথেষ্ট।
আর অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে তো উদ্বেগজনক। আর আমি বলি কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, বৃটেন, ফ্রান্স, চীন ও ইস্রায়েলের হাতে পরমানু অস্ত্র থাকা খুবই বিপজ্জনক। যদি মেনে নেওয়ায় যায় যে ঐ সবদেশের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতারা সম্পূর্ণভাবে স্বাভাবিক ও নমনীয় এবং গোটা পরিসি’তি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, কিন্তু এটা যে সব সময় বজায় থাকবে তার কি নিশ্চয়তা আছে? আর এখন অনেক দেশেরই পরমাণু অস্ত্র থাকার ফলে উম্মাদ নেতাদের নিয়ন্ত্রণে তা আমাদের বিপদও বাড়িয়ে দিয়েছে। এই শতাব্দীতেই আমরা হিটলার ও স্টালিনের মত উম্মাদ নেতাদের পেয়েছি। পরমাণু অস্ত্র সম্পর্কে সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হল, এটা যার হাতে থাকবে তাকে কোনঠাসা করতে পারবে না।
পরমাণূ অস্ত্রকে যদি বেশি গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করা হয় তাহলে সেটা খুবই বিপজ্জনক। সুতরাং আমার মনে হয়, বিভিন্ন দেমের উচিত তাদের হাতে পরমাণু অস্ত্র রাখা ঠিক, কি টিক নয়, তা গভীরভাবে বিবেচনা করা। আর এ ব্যাপারে প্রাথমিকভাবে দায়িত্ব কাঁধে নিতে হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং পশ্চিম ইউরোপকে।
নারলিকার : জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে আমরা আলোচনা শুরু করেছিলাম। সুতরাং শেষও করতে চাই ঐ বিষয় নিয়েই। ভারতে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিঃর্পদার্থ বিজ্ঞান বিশেষ গুরুত্ব পেতে চলেছে। দেশজুড়ে এ ব্যাপারে আমরা বিশেষ সুবিধা দেবার উদ্যোগ নিয়েছি। বিভিন্ন জায়গায় বেতার দূরবীক্ষণ যন্ত্র বসানো হচ্ছে, তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন কেন্দ্র সুতরাং আবার আপনি ভারতে আসবেন এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান কেন্দ্রগুলি পরিদর্শন করবেন এই আশা পোষণ করছি।
সাগান : ধন্যবাদ, ড. নারলিকার। আপনারা যেভাবে কাজ করে চলেছেন তাকে প্রশংসা করছি। আর জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণার উন্নতি ঘটানোই নয়, ভারতে জ্যোতির্বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার কাজটিও আপনারা ভালভাবেই করেছেন।
নারলিকার : আপনার এই সফর আমাদের বিশেষ প্রেরণা যুগিয়েছে।
সাগান : ধন্যবাদ। আমি আপনাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।
সূত্র: জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকারের ’মহাবিশ্বে মহাকাশে’ বই থেকে সংকলিত।
কার্ল সাগানের সাক্ষাৎকার নেবার জন্য ‘স্প্যান’ (ভারতস্থ মার্কিন দূতাবাসের মুখপত্র) পত্রিকার পক্ষ থেকে পুনের ইন্টার ইউনিভার্সিটি সেন্টার যার অ্যাস্ট্রোনমি এন্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের ডিরেক্টর ড. বিষ্ণু নারলিকারকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। দুই বিশ্বখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী মুখোমুখি বসে আলোচনা করেন তাঁদের প্রিয় বিষয়গুলো নিয়ে। এই আলোচনায় স্থান পেয়েছিল মহাকাশ গবেষণার বর্তমান পর্যায়, পৃথিবীতে জীবনের উদ্ভব, বহির্বিশ্বে জীবনের সন্ধান ও অন্যান্য বহু বিষয়।
জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকার : আপনার মনে আছে হয়তো আজ থেকে কুড়ি বছর আগে, আপনি আমাকে নিউইয়র্কের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রহ সম্পর্কিত বিভাগের ড. বিষ্ণু খারে-র গবেষণাগারে নিয়ে গিয়েছিলেন।
কার্ল সাগান : হ্যাঁ, মনে আছে, ড. খারেবেং আমি আজও একইসঙ্গে কাজ করে চলেছি।
নারলিকার : আপনি সেইসময় যে সব গবেষণা করছিলেন, তার কয়েকটি আমাকে দেখিয়েছিলেন। সুতরাং শুরুতেই আমি জানতে চাই, বর্তমানে সেখানে কি ধরনের কাজ চলছে?
সাগান : শনির সবচেয়ে বড় যে চাঁদ বা উপগ্রহ, সেই ‘টাইটান’ এর আবহমন্ডলের অনুরূপ পরিবেশে গবেষণাগারে সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে দারুণ সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। কোন উপগ্রহের বিশেষ বৈশিষ্ট্যই হল, এর আবহমন্ডল খুব ঘন এবং কুয়াশাপূর্ণ। ফলে পৃষ্ঠদেশকে দেখাই যায় না। ১৯৮০-৮১ সালের ভয়েজার-২ মহাকাশযানটি যখন টাইটানের পাশ দিয়ে গিয়েছিল তখনই জানা যায় যে, টাইটানের পৃষ্ঠদেশকে ভালোভাবে দেখা সম্ভব নয়। তবে আমরা সেই অভিযান থেকে জানতে পেরেছি, টাইটানের অবহমন্ডলে রয়েছে অসংখ্য জৈব গ্যাস। আর টাইটানের পৃষ্ঠদেশের অস্পষ্টতার কারণ যে হালকা লাল রঙের কণাগুলি রয়েছে সেগুলির ধর্মও আমরা খুঁজে বের করেছি।
আমরা অতি সম্প্রতি গবেষণাগারে টাইটানের আবহমন্ডলের প্রধান উপাদান - মিথেন ও নাইট্রোজেনকে খুব কম চাপে একসঙ্গে মিশ্রিত করেছি। তারপর শনির চৌম্বক ক্ষেত্রের মধ্যে আটকে থাকা ইলেকট্রনের অনুরূপ আহিত কনা দিয়ে সেই মিশ্রিত গ্যাসকে বিকিরিত করা হয়েছে। এটা করা হয়েছে কারণ, টাইটান শনির পাশ দিয়ে ঘোরার সময় টাইটানের আবহমন্ডলে এসে প্রবেশ করে ইলেকট্রনসমূহ।
টাইটানের আবহমন্ডলের অনুরূপ পরিবেশ তৈরি করতে গিয়ে আমরা পেয়েছি গ্যাস পর্যায়ে বিভিন্ন পদার্থ, আসলে সগুলি জৈব অনু। মিশ্রিত উপাদানের কার্বন, নাইট্রোজেন ও হাইড্রোজেনের পরমানু নিয়েই তৈরি এই জৈব অনুগুলি। সেইসঙ্গে যে পাত্রের মধ্যে এই গ্যাস মিশ্রিত করা হয়েছে তার গায়ে দেখা গেছে হালকা লাল-বাদামী রঙের লবনের গুড়া। আমরা মিলিয়ে দেখেছি, টাইটানের আবহমন্ডলের যে জৈব গ্যাসগুলির কথা জানা গেছে, সেটাই সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এই প্রথম গবেষনাগারে কোন গ্রহ বা উপগ্রহের আবহমন্ডলকে হুবহু তৈরি করা সম্ভব হয়েছে।
এদিকে গবেষণাগারে সেই পরীক্ষা পাত্রের মধ্যেকার কঠিন পদার্থটি নিয়ে তার অপটিক্যাল প্রপার্টি পরিমাপ করে দেখা হয়। তারপর ভয়েজার থেকে পাওয়া টাইটানের মেঘ সম্পর্কিত তথ্যকে গবেষণাগারে পাওয়া তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা গেছে, এদের মধ্যে সুন্দর সাদৃশ্য রয়েছে।
নারলিকার : কি ধরনের তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের বিস্তৃতি আপনি পরিমাপ করেছেন?
সাগান : আমরা এখন পর্যন্ত সফট্ এক্সরে থেকে মাইক্রোওয়েভ পর্যন্ত, পর্যবেক্ষণজাত ধ্রুবকগুলিকে পরিমাপ করেছি। তবে টাইটারকে ঐ পর্যায়ে মাপা হয়নি। অবশ্য এর দৃশ্যমান, অতিবেগুনি ও অবলোহিত রশ্মির কাছাকাছি রশ্মিগুলিকে মাপা হয়েছে। গবেষণাগারে পাওয়া তথ্যের সঙ্গে এর সুন্দর সাদৃশ্য আমরা লক্ষ্য করেছি।
সুতরাং এখন প্রশ্ন হওয়া উচিত : কি সেই কঠিন পদার্থ? লবনের গুড়োই বা কি দিয়ে তৈরি? আমরা অবশ্য এই লবনের গুড়োতে এক ফোঁটা জল ফেলে পেয়েছি নানা ধরনের অ্যামিনো এসিড। সেটি পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এতে রয়েছে নানা ধরনের জৈব অনু। কিছু প্রাণের সৃষ্টি হয়েছে যে ধরনের জৈব অনু দিয়ে তার মতো কিছু ভিন্ন গোত্রের। সুতরাং আমরা রীতিমত উত্তেজিত এটা জেনে যে প্রাণ সৃষ্টির মুহুর্তে পৃথিবীতে যে অবস্থা বিরাজ করেছিল, টাইটানের বুকেও অনুরূপ অবস্থা বিরাজ করার সম্ভাবনা খুবই প্রবল।
অবশ্য এই দুইয়ের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। প্রথমত টাইটানে প্রবল ঠান্ডা বিরাজ করছে। সুতরাং ঐ তাপমাত্রায় তরল জলের দেখা পাওয়ার কথা নয়। তবে বিভিন্ন গ্রহের প্রভাবে যে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ঘটে, তাতে মাঝে মাঝে তরল জলের দেখা যে পাওয়া যায় না,তা নয়। টাইটানেরও প্রায় সর্বত্র তরল জলের দেখা পাওয়া গেছে। সুতরাং এটাকেই আমরা ইঙ্গিতবহ সাফল্য হিসাবে মনে করছি।
প্রকৃতপক্ষে গ্রহ-উপগ্রহের আবহমন্ডলে সংগঠিত রাসায়নিক অবস্থাকে এই প্রথম গবেষণাগারে সঠিকভাবে তৈরি করতে সফল হওয়ায় আমাদের মধ্যে আস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে, অন্য গ্রহের আবহমন্ডলের অনুরূপ আবহাওয়া কিংবা পৃথিবীতে জীবন সৃষ্টির লগ্নে অবস্থা কেমন ছিল তা গবেষণাগারে যখন তৈরি করতে চেয়েছি তা প্রকৃত অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া স্বাভাবিক।
নারলিকার : সৌরজগতের অন্য কোথাও কি আপনি প্রাণের উপস্থিতি অনুমান করেন?
সাগান : প্রাণ সম্পর্কে আমরা কোন কথাই বলিনি। আমরা শুধু বলেছি, জৈব রসায়নের কথা। আমাদের কাছে প্রথম প্রশ্নই করা দরকার, টাইটানের বুকে কি প্রাণের উপসি’তি রয়েছে? এর উত্তরে আমি অনায়াসেই বলতে পারি, জানি না। তাই বলে সেখানকার জটিল জৈব রাসায়নিক অবস্থার প্রেক্ষিতে প্রাণের সম্ভাবনার বিষয়টিকে পুরোপুরি বাদ দেওয়া মোটেই উচিত নয়। কিন্তু আমি যে বিষয়ে জোর দিতে চাই তা হল, দু’টি কথার মধ্যে বিস-র ফারাক রয়েছে। আমি প্রাণের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিতে চাই না মানেই সেখানে প্রাণের উপসি’তি রয়েছে তা কিন’ মোটেই নয়। সৌরজগতের কোথাও প্রাণের কোনরকম অসস্তত্বেরই প্রমান এখন পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুনের মত বড় গ্রহগুলির আবহমন্ডলে তো কার্বন সমৃদ্ধ জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটেই চলছে। তবে টাইটানের আবহমন্ডলের অনুরূপ অবস্থা তৈরির সাফল্যকে একমাত্র সম্বল করে আমরা অন্য গ্রহের আবহমন্ডলের অনুরূপ অবস্থা গবেষণাগারে সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছি। এমনকি, নেপচুনের সবচেয়ে বড় চাঁদ বা উপগ্রহ ‘টাইটান’ সম্পর্কে ১৯৮৯ সালে ভয়েজার-২ মহাকাশযানের পরিভ্রমনের আগে কিছুই জানা ছিল না। সেখানকার আবহমন্ডল নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে জানা গেছে, টাইটানের আবহমন্ডল খুবই পাতলা ধরনের। তার তুলনায় পৃথিবীর আবহমন্ডল লক্ষগুণ বেশি ঘন।
সুতরাং পাতলা আবহাওয়া মানে সব কিছু প্রায় শূণ্য। ফলে সেখানে যা কিছু জৈব পদার্থ তৈরি হচ্ছে তা সঙ্গে সঙ্গে টাইটানের পৃষ্ঠদেশে জমা হচ্ছে। আর সেখানকার জৈব রাসায়নিক অবস্থা সম্পূর্ণ অন্য ধরনের - সবই বরফ পর্যায়ে - নাইট্রোজেন, মিথেন সবই জমাট অবস্থায় রয়েছে।
টাইটানের বুকে একটা সুন্দর জিনিস দেখা গেছে। টাইটানের বুকে জমা হওয়া কালো পদার্থ তুবড়ির মতো আকাশের দিকে ছিটকে বেরিয়ে যাচ্ছে এবং সামান্য চাপে সেখানকার হাওয়ায় সেগুলি উড়ে যাচ্ছে। এই ঘটনার ফলে টাইটানের বুকে দেখতে পাওয়া যায় দারুণ সুন্দর ডোরা ডোরা দাগ। এদিকে গত পাঁচ-ছয় বছরে আমরা আবিস্কার করেছি যে, ধূমকেতুতে বেশ ভালোরকম জৈব পদার্থ রয়েছে এবং এর প্রায় ২০-২৫ শতাংশই জৈব অনু।
সুতরাং প্রশ্ন হল, প্রাণ সৃষ্টিতে কি ধূমকেতুর উল্লেখযোগ্য কোন অবদান রয়েছে? এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, নানা সময়ে ধূমকেতু এসে আছড়ে পড়েছে পৃথিবীর বুকে। আর আজকের তুলনায় কয়েক হাজার বছর আগে ধূমকেতুর পৃথিবীর আছড়ে পড়ার ঘটনা ঘটেছে অনেক বেশি।
নারলিকার : আপনি কি প্রাণ সৃষ্টিতে সূচনার কথা বলছেন?
সাগান : ঠিক তাই। আমি যখন প্রাণ সৃষ্টিতে অবদানের কথা বলছি তখন বুঝতে হবে প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে যে ধরনের জৈব অনু থেকে তার কথা বলছি। জীবন- জীবকোষের কথা মোটেই বলছি না। ২০ শতাংশ জৈব পদার্থ সম্পন্ন বহু সংখ্যক ধূমকেতু পৃথিবীতে আছড়ে পড়েছে। স্বাভাবিকভাবেই পৃথিবীর বুকে সঞ্চিত হয়েছে, বেশ ভালো পরিমান জৈব পদার্থ। অবশ্য ধূমকেতু যেহেতু অসম্ভব দ্রুতগতিতে ছুটে আসে, তাই আমরা হিসেব করে দেখেছি যে, জৈব পদার্থসমূহ সবই পৃথিবীর আবহমন্ডলে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে উচ্চ তাপমাত্রায় শুকিয়ে যায়।
কিন্তু পুরানো দিনের আবহাওয়ায় আজকের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি চাপ ছিল বলে যদি ধরে নেওয়া যায়, তাহলে আবার কম্পিউটার মডেলে সেই অবস্থা পুনঃস্থাপন করে এক অদ্ভূত মজার জিনিস দেখতে পেয়েছি। এইক্ষেত্রে ধূমকেতুগুলির পেছনে দেখা গেছে এক ধরনের ছিপির মত জিনিস। যেগুলি বেশি উত্তপ্ত হয়না। সুতরাং সামনের এবং ভিতরের দিকের জৈব পদার্থ উচ্চতাপে শুকিয়ে গেলেও, দেখা গেছে, পেছনে ছিপির মত জিনিস থাকায় সেখানে জৈব পদার্থ সংরক্ষিত হয়। সুতরাং এইভাবে মহাজাগতিক জৈব পদার্থ পৃথিবীতে জীবন সৃষ্টিতে কোন না কোন ভাবে ভূমিকা নিয়ে থাকতে পারে।
আরেকভাবেও ধূমকেতুর জৈব পদার্থ পৃথিবীতে অবিকৃত অবস্থায় এসে থাকতে পারে। ধূমকেতুর সূক্ষ্ম ভগ্নাবশেষ পৃথিবীর আবহমন্ডলে আসছে অনেক বেশি বেশি পরিমানে। এবং সেগুলি যেহেতু পড়ছে অপেক্ষাকৃত ধীর গতিতে, তাই সেগুলি শুকিয়ে যাবার বা পুড়ে যাবার সম্ভাবনা নেই। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হিসাবে ধরা যেতে পারে ধূমকেতুর পৃথিবীতে আছড়ে পড়ার ফলে যে প্রতিঘাত তরঙ্গের সৃষ্টি হয়েছে তা পুরানো দিনের আবহাওয়ায় যদি কার্বন সমৃদ্ধ থেকে থাকে, তাতে কোন বিক্রিয়া ঘটলেও ঘটে থাকতে পারে।
আসলে আমরা এখন পর্যন্ত বাইরে থেকে এবং ভিতর থেকে যতভাবে জৈব পদার্থের উৎস খুঁজে পাওয়া সম্ভব তার একটা সুসংহত তালিকা তৈরি করেছি। ভিতর থেকে বলতে আমি বোঝাতে চেয়েছি, বজ্রপাতের ফলে সৃষ্ট বৈদ্যুতিক ক্রিয়া বা সূর্য থেকে আসা অতিবেগুনি রশ্মি - কোন উৎস কি ধরনের ভূমিকা পালন করেছে।
তবে সিদ্ধান্ত অবশ্যই মডেল নির্ভর। যদি আগেকার আবহমন্ডল হাইড্রোজেন সমৃদ্ধ ছিল বলে ধরা হয়, তাহলে অনেক জৈব পদার্থের সৃষ্টি সম্ভব। কিন্তু তা না হয়ে যদি ভূবিজ্ঞানীদের অনুমান অনুযায়ী ধরা হয়, আবহমন্ডল প্রধানত কার্বন-ডাই-অক্সাইড সমৃদ্ধ ছিল তাহলে জীবনের উৎস সন্ধান খুব সহজ কাজ নয়। তবে, সেইক্ষেত্রে কি ঘটেছিল সেটা জানা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি।
এই হল মোটামুটি জীবনের উৎস সন্ধানে মহাজাগতিক জৈব পদার্থের কতটা যোগ থাকতে পারে তা নিয়ে গবেষণার কথা।
নারলিকার : মহাকাশে বুদ্ধিমান জীবের সন্ধানে কর্মসূচি (SETI - Search Extraterritorial Intelligence) বিষয়ে আপনার লেখা ‘দি কসমিক কানেকশন’ বইটি আমার আগ্রহকে বাড়িয়ে দিয়েছে। আমেরিকায় এখন সেই অনুসন্ধানের কাজ কোন পর্যায়ে?
সাগান : আশ্চর্যজনকভাবে ভাল অবস্থায় রয়েছে। আশ্চর্যজনকভাবে ভাল বলছি এই কারণে যে, ভিনগ্রহে জীবের সন্ধান নিয়ে মজা বা বিদ্রুপ করা খুবই সোজা। প্রশ্ন উঠতেই পারে, আমাদের যেখানে হাজারো জরুরী সামাজিক সমস্যা রয়েছে সেখানে ভিন গ্রহের ছোট্ সবুজ মানুষের খোঁজ করতে জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ ব্যয় করা কি উচিত? এ কেমন অর্থের অপচয়! আপনি কি এসব ভেবেছেন কখনো?
আমার মতে বিজ্ঞানীরা যদি এই ধরনের প্রকল্পের সদুত্তর দিতে না পারেন, তাহলে তাদের জনগণের অর্থ নেয়া উচিত নয়। আসলে এইসব প্রশ্ন খুবই যুক্তিসঙ্গত।
এই মুহুর্তে আধুনিকতম এক অনুসন্ধান কর্মসূচি নিয়ে কাজ চলছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে মেটা (META - Mega channel Extraterritorial Array)। উত্তর গোলার্ধে ম্যাসচুসেটস্ এর কেমব্রিজে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস্ আয়ারস এর ঠিক বাইরে একসঙ্গে লক্ষ লক্ষ আলাদা আলাদা বেতার তরঙ্গের উপর নজর রাখা হচ্ছে। আর এই কাজ চলছে কোন সরকারি অর্থে নয়। সম্পূর্ণভাবে বেসরকারি একটি সংস্থার সদস্যদের অর্থে পরিচালিত হচ্ছে এই কর্মসূচিটি। সংস্থার নাম দেওয়া হয়েছে ‘দ্য প্ল্যানেটরি সোসাইটি’। আর আমিই এর সভাপতি। এই কর্মসূচির জন্য শুধু আমেরিকা নয় গোটা বিশ্ব থেকে পাঁচ, দশ ও পনের ডলার দান হিসাবে নিয়ে গঠন করা হয়েছে অর্থ ভান্ডার। ঐ থেকেই নিশ্চয় বোঝা যাচ্ছে যে, এখনও ভিনগ্রহে বুদ্ধিমান জীবের খোঁজে আগ্রহ কত ব্যাপক এবং দ্বিতীয়ত এজন্য খরচ হচ্ছে কত সামান্য।
এই বছর নাসা (NASA - National Aeronautics and Space Administration) আরও আধুনিকতম এক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এখনও এর যুতসই কোন নাম দেয়া হয়নি। তবে আমি মনে করি আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে আমরা যদি ভিনগ্রহের অনুমিত সভ্যতা থেকে যদি কোন বেতার সংকেত না পাই, তাহলেও বুঝতে হবে যে, আমরা গুরুত্বপূর্ণ একটা কিছু জানলাম।
নারলিকার : এই ধরনের গবেষণায় বিভিন্ন তত্ত্ব ও অনুমানের ক্ষেত্রে কোন সীমা নির্ধারণ করা কি উচিত?
সাগান : সেটা অবশ্য ঠিক কথা। তবে আমরা যদি সফল হই, তাহলে তো সেটা হবে বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বৈপ্লবিক আবিষ্কার।
নারলিকার : এই সূত্রে আমি জানতে চাই যে, ভারতেও আমরা একটা বিশাল বেতার দূরবীন বসানোর কাজ চালাচ্ছি। পুনে থেকে ৯৫ কিলোমিটার দূরে এটি বসানো হচ্ছে। এটির কাঠামোটি হবে Y আকৃতির। এর প্রতিটি লম্বা রেখায় ছ’টি করে অ্যান্টেনা বা গ্রাহক যন্ত্র থাকবে। প্রতিটি রেখা হবে কয়েক কিলোমিটার দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। আর প্রতিটি ডিস অ্যান্টেনার ব্যাস হবে ৪৫ মিটার। এই প্রকল্পটিতে আমি আমার সহকর্মী ড. গোবিন্দ স্বরূপের সঙ্গে কাজ করছি। তিনিই অবশ্য এর প্রধান মাথা। আপনাদের SETI কর্মসূচির জন্যও এটিকে ব্যবহার করতে পারবেন। আমার মনে হয় এই দারুন যন্ত্রটিকে মহাজাগতিক সংকেত ধরার কাজে আংশিক সময়ের জন্য ব্যবহার করা যাবে।
সাগান : ভিন গ্রহের কোন সভ্যতা থেকে আসতে পারে এমন কোন সংকেত অনুসন্ধানের কাজে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া মোটেই সম্ভব নয়। ভিনগ্রহ থেকে যদি সত্যিই কোন সভ্যতা সংকেত পাঠিয়ে থাকে তবে তা তো আর বিশেষ কোন দেশকে লক্ষ্য করে পাঠাবে না।
নারলিকার : সেটাই তো আসল কথা। আর জানা কোন বিশেষ ভাষাতেও নিশ্চয়ই পাঠাবে না।
সাগান : আমরা আপনাদের প্রকল্পের জন্য কোনভাবে সাহায্য করতে পারি কিনা তা জানাবেন। আমাদের সম্পদ যদিও সীমিত, তবুও আমরা কিভাবে কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে কিংবা কোন ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হচ্ছে সে ব্যাপারে নিশ্চয়ই প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা করতে পারি।
নারলিকার : নিশ্চিতভাবেই এটাও আমাদের কাছে বিশেষ কাজের হবে আমাদের কর্মসূচিটি (GMRT) যেহেতু ১৯৯৪ সাল নাগাদ শুরু হবে সুতরাং হাতে দু’বছর সময়ও রয়েছে।
আমি এখন অন্য বিষয় যেতে চাই। আপনি তো নানাভাবে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার কাজ করে চলেছেন। ভারতে তো ‘কসমস’ টিভি সিরিয়ালটি খুবই জনপ্রিয় হয়েছে। আমি বহু তরুণ ছাত্র/ছাত্রীদের কাছ থেকে এ ব্যাপারে নানা ধরনের প্রশ্ন পেয়েছি। নিঃসন্দেহে এই প্রোগ্রামটি জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে সচেতনতা যথেষ্ট বৃদ্ধি করেছে। বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি?
সাগান : আমরা সমপ্রতি কসমস সিরিয়ালটিও প্রাপ্ত নতুন তথ্যেও আলোকে নতুন করে সাজিয়েছি। যখন এটি প্রথম তৈরি করেছিলাম, তখন শনি, ইউরেনাস, নেপচুন বা হ্যালির ধূমকেতুর মতো কোন ধূমকেতুর কাছাকাছি মহাকাশযান যেতে পারেনি। এখন অনেক তথ্য জানা গেছে, শনি, ইউরেনাস, নেপচুনের বলয় ও চাঁদ সম্পর্কে। এইসব তথ্য যুক্ত করতে হয়েছে কসমস সিরিয়ালে। কসমস এর এই নতুন সংস্করণটি ভারতে যাতে দেখানো যায় সেজন্য কথাবার্তা চলছে। যদিও আমি এখনও এ ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত নই, তবে আশা করি শেষ পর্যন- এটি দেখানো যাবে।
মূল কসমস ধারাবাহিকটি তৈরি করতে প্রায় আড়াই বছর সময় লেগেছিল। আর শুধুমাত্র এই কাজেই লেগে থাকতে হয়েছিল। কিন্তু আমার পক্ষে এই ধরনের কাজ আর নতুন করে করা সম্ভব নয়। তবে বিজ্ঞানের বিভিন্ন দিককে জনপ্রিয় করার জন্য আমি লিখে চলেছি। আমার সর্বশেষ বইটি আমার স্ত্রী অ্যান্ড্রুয়ানের সঙ্গে যৌথভাবে লিখেছি। নাম দিয়েছি ‘বিস্মৃত পূর্বসূরীদের ছায়া’। এই বইয়ে দেখানো হয়েছে, মানুষ কেন আজকের অবস্থায় এসেছে? কোথা থেকেই বা নিজেকে উন্নততর ভাবা, অন্য জীব সম্পর্কে ঘৃণা ও খবরদারি করার মানসিকতা এসেছে? কোথা থেকেই বা মহিলাদের উপর নির্যাতনের মানসিকতা এসেছে? ভারতীয় জীবনেও এমন ঘটনার অজস্র নিদর্শন রয়েছে। রয়েছে মার্কিনী জীবনেও। প্রত্যেকেই এই সব ঘটনার নিন্দা করেন, তবুও এগুলি টিকে রয়েছে। তাই আমরা মনে করেছি, এই ধরনের মানসিকতার সূত্রে অনুসন্ধান অনেক বেশি জরুরী ও প্রয়োজনীয়। এই বিষয়গুলি জ্যোতির্বিজ্ঞানের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত নয় ঠিকই, তবে এগুলি যে গুরুত্বপূর্ণ সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
নারলিকার : জ্যোতির্বিজ্ঞানের কোন বিষয় নিয়ে আমি যখন বক্তৃতা দেই, তখন দেখেছি শ্রোতারা সাধারণভাবে শেষেই প্রশ্ন করেন। অনেকে সরাসরি যে বিষয়ে বক্তৃতা দেই, সে বিষয়ে প্রশ্ন করেন, যেমন, মহাবিস্ফোরণ কিংবা কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কে। তার অনেকেই বিষয় যাই হোক না কেন উড়ন্ত চাকতি বা UFO কিংবা বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল সম্পর্কে, আমার ধারণা আপনিও নিশ্চয়ই এই ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি হন। কিন্তু এই সব প্রশ্নের উত্তর দেন কিভাবে?
সাগান : হ্যাঁ। এখানেই আমি একজনের ফোন পেয়েছি, যিনি আমাকে তাঁর সংগ্রহে নাকি উড়ন্ত চাকতির নিদর্শন রয়েছে, সেটি দেখাতে চান।
আমি এই ধরনের তাৎক্ষণিক উত্তর দিতে অভ্যস-। বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল বলতে দাবি করা হয়, বারমুডা দ্বীপের কাছে আটলান্টিক মহাসাগরে এমন একটি জায়গা রয়েছে, যেখানে নাকি বিমান ও জাহাজ রহস্যজনকভাবে লাপাত্তা হয়ে যায়। এখন, প্রথম প্রসঙ্গিক তথ্যটি হল, জলে কোন বস’র ডুবে যাওয়া ভৌত ঘটনা বলে জানি। ধরা যাক এর সঙ্গে ট্রেনের লাপাত্তা হয়ে যাওয়া তুলনা করা যায়। যদি দেখা যায়, পুনে ট্র্যাঙ্গেলে ভারতের গাড়িগুলি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে, তাহলে বলতে হবে এটা সত্যিই রহস্যজনক ঘটনা। কেননা, ট্রেন কিন্তু নিশ্চিহ্ন হতে পারে না অথচ বিমান বা জাহাজের নিশ্চিহ্ন হওয়ার ঘটনা আমাদের জানা। এগুলি যেমন ডুবে বা ভেঙ্গে পড়ে তেমনি সাগরতলে বা মাটিতে জমাও হয়, সুতরাং এগুলির ক্ষেত্রে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া কোন রহস্য নয়।
সুতরাং বারমুডা ট্র্যাঙ্গেল সম্পর্কে আমার প্রশ্ন হল জাহাজ ও বিমান কি বারমুডা ট্র্যাঙ্গেলে পৃথিবীর অন্য জায়গা থেকে বেশি হারিয়ে যাচ্ছে? এবং এর উত্তর নিশ্চিতভাবেই - না। আসলে বারমুডা ট্র্যাঙ্গেল কোন রহস্য নয়। সবটাই অজ্ঞতা। এক অর্থে বুজরুকি। মানুষকে ভুল বুঝিয়ে বিভ্রানি- সৃষ্টি করে অর্থ উপার্জনের চেষ্টা।
আর UFO প্রসঙ্গে একটা কথা বলি। আপনি তো জানেন, ভিন গ্রহে জীব সম্পর্কে আমার চেয় বেশি কেউ আগ্রহী নিশ্চয়ই নয়। প্রাণের সঞ্চালনে গ্রহ-গ্রহান্তরে মাহাকাশযান পাঠানোর সব কর্মসূচিতেই আমি গভীরভাবে জড়িত। বহির্বিশ্ব থেকে কেউ কোন বেতার সংকেত পাঠালোকি না তার সন্ধানেও আমি যুক্ত। সুতরাং ভিনগ্রহে সভ্যতার কোন সন্ধান পেলে আমিই সবচেয়ে বেশি খুশি হব। কিন্তু অসাধারণ একটা দাবির জন্য তো অসাধারণ প্রমানের দরকার। আর UFO এর ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত পাওয়া কোন প্রমানই তেমন ভাল নয়। এমন অনেক বিষয় আছে যেগুলি সম্পর্কে সাধারণ মানুষ ভাবতে পারেন কিছূ ঘটেছে, কিন্তু তা আদৌ না-ও হতে পারে। মানুষের আচার ব্যবহারে এই মনস-াত্ত্বিক ব্যাপারটি অস্বাভাবিক কিছু নয় আর মানুষ অনেক সময় মিথ্যেও বলে। যেমনি মানুষ মদ্যপও হয়, তেমনি আকাশকুসুম কল্পনাতেও অভ্যস্ত।
এ পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ UFO এর কথা শোনা গেছে। কিন্তু এর কোন ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষদর্শীরা মহাবিশ্ব থেকে পাওয়া কোন বস্তু দেখাতে পেরেছেন? যেমন ধরা যাক, অদ্ভূত লিপির কোন বই রয়েছে পৃথিবীতে? অজানা এমন কোন সংকর ধাতু কিংবা এমন কোন পদার্থ, যার অভিকর্ষ বিরোধী ধর্ম রয়েছে? তাছাড়া যা দেখা যায় তাই কি বাস্তব? উত্তর অবশ্যই, না একটি ভাল ছবিও জাল হতে পারে। অনেক ঘটনাই নির্ভরযোগ্যভাবে প্রকাশ করা হতে পারে - যেমন শ’য়ে শ’য়ে শত্রুর বিভিন্ন জায়গা থেকে আকাশে আলোক রশ্মি দেখতে পেলেন। কিন’ আকাশে তো বহু কিছুর জন্যই আলো দেখা যেতে পারে। কক্ষপথে স’াপিত হওয়ার আগ মুহুর্তে রাশিয়ার বা আমেরিকার কোন বুস্টার থেকেও মোহময় আলোর দ্যুতি দেখা যেতে পারে। সুতরাং আবারও আমি বলতে চাই, অসাধারণ কোন কোন দাবির জন্য তেমনই অসাধারণ কোন প্রমান হাতে থাকা চাই। আর শুধু প্রমানই যথেষ্ট নয়। হাতে যদি সত্যিই ভালো প্রমান থাকে তো সে ব্যাপারে আমি খুবই খোলামেলা। তবে, আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছি যে, একজন বা দু’জন মানুষের কাছ থেকে তাদের দাবি মত অসাধারণ অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে যাওয়াটা আসলে সময়ের অপচয় মাত্র। এদের অনেকেই হয়তো আন্তরিক, কিন্তু তাদের কোন দাবিই বৈজ্ঞানিক প্রমানে প্রয়োজনীয় মানের ধারে কাছে নয়। তাই যারা মহাকাশে যান তাদের প্রত্যেককেই আমি বলি, দয়া করে আসবার সময় সঙ্গে করে নিয়ে আসবেন মহাজাগতিক কোন জীবকে।
নারলিকার : আথবা কোন মহাজাগতিক বস্তু ………।
সাগান : মহাজাগতিক জীবই সবচেয়ে ভাল। তবে কোন বস্তু, নিদর্শন বা যে কোন ধরনের পোষ্য কিছু হলেও ভাল।
নারলিকার : ধরা যাক, আপনি ভিনগ্রহে কোন বুদ্ধিমান জীবের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারলেন, তখন আপনি তাদের কি প্রশ্ন করবেন? আর এটাতো নিশ্চয়ই ধরে নেবেন যে, তারা আমাদের থেকে অনেক বেশি জ্ঞানী হবে।
সাগান : তাদের সঙ্গে যোগাযোগটাই হবে আসল ব্যাপার। তবে আমার মনে হয়, পদার্থবিজ্ঞান, অংক কিংবা জৈব বিজ্ঞান সংক্রান্ত প্রশ্নে চেয়ে অনেক বেশি জরুরি সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় বিষয়ে প্রশ্নও আকর্ষণীয় হতে পারে। হয়তো জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে, ফরম্যাটের শেষ উপপাদ্যগুলি ঘনককে দু’টি ঘনকে পরিণত করা সম্ভব অথবা একটি চতুর্থ ঘাতকে দু’টি চতুর্থ ঘাতে অথবা যেকোন ঘাতকে (সসীম বা অসীম) দু’টি সম ঘাতসম্পন্ন রাশিতে পরিণত করা সম্ভব। এই উপপাদ্যটির প্রমান এখনও পাওয়া যায়নি।
নারলিকার : এ ব্যাপারে আমার প্রশ্ন হতে পারে: রেম্যান প্রকল্প কি সঠিক? (এই প্রকল্পটিও প্রমাণ করা যায়নি। জটিল রাশির আপেক্ষিতা সম্পর্কিত রেম্যান প্রকল্পের মৌলিক রাশির সংঘাতের প্রত্যক্ষ প্রয়োগ রয়েছে)
সাগান : হ্যাঁ, এই ধরনের প্রশ্ন এবং এর চেয়েও কঠিন কঠিন বিষয়ে প্রশ্ন করা যেতে পারে।
নারলিকার : আমি অংক বা পদার্থবিজ্ঞানকে বাছাই করার পক্ষপাতী, কারণ, উভয়ের ক্ষেত্রে সমস্যা হবে একটা। আর সামাজিক সমস্যা বা অর্থনৈতিক সমস্যা .. .. ..
সাগান : ঠিক তাই। কে জানে তারা কেমন দেখতে? কেমনই বা তাদের সমস্যা? যাই হোক, কোনটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সেটা ঠিক করাই আমার পক্ষে কঠিন। তবে আমি সেই দিনের দিকে তাকিয়ে রয়েছি। খুব মজা হবে সে সময়।
নারলিকার : আপনি তো পারমাণবিক বিপর্যয়, পারমাণবিক শৈত্য এবং এই ধরনের বিষয়ে অনেক লেখাই লিখেছেন। কিন্তু অবস্থার কি কোন পরিবর্তন দেখছেন?
সাগান : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ওসাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে উত্তেজনা যে অনেকটাই প্রশমিত হয়েছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। দুই দেশের এই অবদানের জন্য সকলেই কৃতজ্ঞ। তবে, আমার বিচারে প্রধান অবদান মিখাইল গর্বাচেভের। ইতিহাসের দিকে বস্তুগতভাবে যদি দৃষ্টি ফেরাই তাহলে দেখি গর্বাচেভ এমন এক ব্যক্তিত্ব, যার কোন কিছু করার মত দৃঢ়তা ও বলিষ্ঠতা ছিল। ওয়ারশ’ জোট আজবেঙ্গে গেছে। পাঁচ-ছয় বছর আগেও এটা কি কেউ ভাবতে পেরেছিল? নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ ঘটনা। অবশ্য কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি সোভিয়েত ইউনিয়ন, কোন দেশই একটিও পরমানু অস্ত্র ধ্বংস করেনি। অনুামানিক প্রায় ৫৫ হাজার পরমানু অস্ত্র তো যে কোন মুহুর্তে প্রয়োগ করার জন্য তৈরি রাখা হয়েছে। সুতরাং এই অবস্থাকে মোটেই নিরাপদ বলা যায় না। তবে, পুরোপুরি নিরাপদ না হলেও নিরাপত্তার আভাস মিলেছে।
নারলিকার : তাছাড়া তথ্য পাচার ও ছোট ছোট দেশ বা গোষ্ঠীর হাতে পরমানু অস্ত্র আসার ফলে বিপদ বাড়ছে।
সাগান : আমি শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা বলছি। এ ক্ষেত্রেও বড় রকমের বিপদের ঝুকি রয়েছে। যেমন সোভিয়েত ইউনিয়নে পরমানু অস্ত্র ভান্ডারের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে সেটা একটা বড় ব্যাপার। মনে রাখা দরকার, তাদের হাতে ২৫ হাজার পরমানু অস্ত্র রয়েছে। এবং এর শ’ খানেকেই কোন দেশকে ধ্বংস করা কিংবা কোন শহরকে লক্ষ্য করে পারমাণবিক শৈত্য সৃষ্টি করার পক্ষে যথেষ্ট।
আর অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে তো উদ্বেগজনক। আর আমি বলি কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, বৃটেন, ফ্রান্স, চীন ও ইস্রায়েলের হাতে পরমানু অস্ত্র থাকা খুবই বিপজ্জনক। যদি মেনে নেওয়ায় যায় যে ঐ সবদেশের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতারা সম্পূর্ণভাবে স্বাভাবিক ও নমনীয় এবং গোটা পরিসি’তি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, কিন্তু এটা যে সব সময় বজায় থাকবে তার কি নিশ্চয়তা আছে? আর এখন অনেক দেশেরই পরমাণু অস্ত্র থাকার ফলে উম্মাদ নেতাদের নিয়ন্ত্রণে তা আমাদের বিপদও বাড়িয়ে দিয়েছে। এই শতাব্দীতেই আমরা হিটলার ও স্টালিনের মত উম্মাদ নেতাদের পেয়েছি। পরমাণু অস্ত্র সম্পর্কে সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হল, এটা যার হাতে থাকবে তাকে কোনঠাসা করতে পারবে না।
পরমাণূ অস্ত্রকে যদি বেশি গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করা হয় তাহলে সেটা খুবই বিপজ্জনক। সুতরাং আমার মনে হয়, বিভিন্ন দেমের উচিত তাদের হাতে পরমাণু অস্ত্র রাখা ঠিক, কি টিক নয়, তা গভীরভাবে বিবেচনা করা। আর এ ব্যাপারে প্রাথমিকভাবে দায়িত্ব কাঁধে নিতে হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং পশ্চিম ইউরোপকে।
নারলিকার : জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে আমরা আলোচনা শুরু করেছিলাম। সুতরাং শেষও করতে চাই ঐ বিষয় নিয়েই। ভারতে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিঃর্পদার্থ বিজ্ঞান বিশেষ গুরুত্ব পেতে চলেছে। দেশজুড়ে এ ব্যাপারে আমরা বিশেষ সুবিধা দেবার উদ্যোগ নিয়েছি। বিভিন্ন জায়গায় বেতার দূরবীক্ষণ যন্ত্র বসানো হচ্ছে, তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন কেন্দ্র সুতরাং আবার আপনি ভারতে আসবেন এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান কেন্দ্রগুলি পরিদর্শন করবেন এই আশা পোষণ করছি।
সাগান : ধন্যবাদ, ড. নারলিকার। আপনারা যেভাবে কাজ করে চলেছেন তাকে প্রশংসা করছি। আর জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণার উন্নতি ঘটানোই নয়, ভারতে জ্যোতির্বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার কাজটিও আপনারা ভালভাবেই করেছেন।
নারলিকার : আপনার এই সফর আমাদের বিশেষ প্রেরণা যুগিয়েছে।
সাগান : ধন্যবাদ। আমি আপনাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।
সূত্র: জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকারের ’মহাবিশ্বে মহাকাশে’ বই থেকে সংকলিত।
সত্যেন্দ্রনাথ বসুর পৌত্র ফাল্গুনী সরকারের সাক্ষাৎকার
২০০৭ সালের ২৯শে জুন থেকে ১লা জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান অঙ্গরাজ্যের ডেট্রয়েটে অনুষ্ঠিত ২৭তম “নর্থ অ্যামেরিকান বেঙ্গলি কনফারেন্স” উপলক্ষে প্রকাশিত ব্রোশারে এই সাক্ষাৎকারটি ছাপা হয়েছিল। (পৃষ্ঠা: ৭৭-৭৯)
সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নাম যেন বিজ্ঞানের জগতে একটি সৌধ হয়ে আছে, বিশেষত কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের জগতে। মৌলিক কণা “বোসন”, বোসনের ক্রিয়াকর্ম ব্যাখ্যায় সক্ষম “বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান” এবং “বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট”- সবগুলো নামই এই মহান বিজ্ঞানীর নামে রাখা হয়েছে। উল্লেখ্য বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট গবেষণাগারে তৈরী করে দেখানোর জন্যই ২০০১ সালে এরিক কর্নেল ও কার্ল ওয়াইম্যানকে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে। আলবার্ট আইনস্টাইন বসুর গবেষণাপত্রকে বলেছিলেন, “প্রগতির দিকে একটি অনিন্দ্য সুন্দর পদক্ষেপ”।
বাংলায় সত্যেন বসু যেন এক পৌরাণিক কিংবদন্তি। একটি বিখ্যাত বাংলা সাময়িকী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যজিৎ রায়, রবি শংকরের মত বিশ্বনন্দিত বাঙালি থাকা সত্ত্বেও সত্যেন বসুকে “শতাব্দীর বাঙালি” হিসেবে স্বীকৃত দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তার লেখা একমাত্র বিজ্ঞান গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে। বসু সম্পর্ক তিনি লিখেছিলেন, “a man of genius with a taste for literature and who is a scientist as well.”
তারপরও সত্যেন্দ্রনাথ বসুর প্রকৃত ব্যক্তিসত্ত্বা সম্পর্কে খুব কম মানুষই জানে। বাংলা এবং ইংরেজিতে অনেক লেখা এবং জীবনীগ্রন্থ থাকা সত্ত্বেও তার জীবনের উপর সুগভীর আলোকপাতের অভাব প্রকট। এই অভাববোধ থেকেই সত্যেন্দ্রনাথ বসুর এক পৌত্র শুরু করেছিলেন বসু জীবন চরিত অনুসন্ধান। বসুর জীবন, কর্ম এবং তার শিল্পপ্রীতিকে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে আসাই তার লক্ষ্য।
ফাল্গুনী সরকার অধ্যাপক বসুর ছোট মেয়ের ছেলে। তিনি তার বিখ্যাত পিতামহকে নিয়ে একটি বই লিখছেন। ফাল্গুনী বেড়ে উঠেছেন যুক্তরাষ্ট্রে, এ সম্পর্কে তাকে বলতে শোনা যায়, “আমার এই প্রখ্যাত পূর্বপুরুষের ছায়া থেকে আমি অনেক দূরেই ছিলাম”। এ কারণেই বসু সম্পর্কে প্রথম জীবনে খুব বেশি কিছু জানার সৌভাগ্য তার হয়নি, বাবা-মা ও পরিবারের অন্যদের কাছ থেকে টুকিটাকি যা শুনেছিলেন তা-ই ছিল সম্বল। এখন তিনি ভারতে ফিরে এসেছেন, সেই পিতামহের সন্ধানে যাকে তিনি খুব কমই চিনেন। তার মুখ থেকেই শোনা যাক এই অভিনব অভিযান ও তার অনুভূতির কথা…
আপনি কিভাবে সত্যেন বসুর প্রতি উৎসাহী হয়ে উঠলেন?
ফাল্গুনী: আসলে সান ফ্রান্সিসকোর বে এরিয়াতে বড় হওয়ায় আমার বিখ্যাত দাদুর কথা সবসময়ই শুনেছি। কিন্তু আমার কোন বন্ধুর বাবা-মা-ই তার নাম শুনেননি, এমনকি বোসন কাকে বলে সেটাও তারা জানতেন না। তাই ভেবেছিলাম, দাদু হয়ত অতো বিখ্যাত না। কিন্তু ১৯৯৫ সালের জুলাই মাসের একদিনে একটি ফোন কল আমার চিন্তাভাবনা পাল্টে দেয়, সেদিন আমার এক বন্ধু ফোন করে বলে, আমার দাদুর ছবি নাকি নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রচ্ছদে এসেছিল। ৭০ বছর আগেই বিজ্ঞানীরা বোস পরিসংখ্যান ব্যবহার করে আইনস্টাইনের করা একটি ভবিষ্যদ্বাণী প্রমাণ করেছিলেন। আইনস্টাইন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, কিছু কণাকে (বোসন) ঠাণ্ডা করে অনেক কম তাপমাত্রায় নিয়ে আসলে নতুন ধরণের একটি বিদঘুটে পদার্থ তৈরী হতে পারে। এই নতুন পদার্থেরই নাম “বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট” (Bose-Einstein Condensates – BEC)। এরা ফোটন তথা আলোর সম্ভাব্যতা সূত্র মেনে চলে যা আমার দাদু আবিষ্কার করেছিলেন। আইনস্টাইন সেই আবিষ্কারকে আরও পরিবর্ধন করেন এবং বিইসি-র বিস্তারিত ভবিষ্যদ্বাণী করেন। বর্তমানে এটি নিম্ন তাপমাত্রার আণবিক পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাক্ষেত্র। কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, অতিপরিবাহিতা এবং আণবিক লেজারের মত সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রগুলোতে বিইসি গবেষণার বিশেষ গুরুত্ব আছে। গবেষণাগারে বিইসি তৈরীর জন্য ২০০১ সালে দুজন পদার্থবিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। এসব তথ্যের প্রেক্ষিতেই আমি ১২ বছর আগে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, সত্যেন বসু সম্পর্কে আরও জানবো।
আপনি তো ভারতে চলে গেছেন। এর মধ্যে নতুন কি কি জানতে পেরেছেন? হাতে কি পরিমাণ তথ্য-উপাত্ত ও মিডিয়া এসেছে?
ফাল্গুনী: হ্যাঁ, আমি এর আগে কখনোই কয়েক মাসের বেশি একটানা ভারতে থাকিনি। থাকার অভিজ্ঞতা বেশ মজার, নতুন নতুন অনেক ঘটনা ঘটে সেখানে। আমার গবেষণা কাজ প্রসঙ্গে প্রথমেই বসুর অগোছালো প্রকৃতির কথা বলতে হয়। তিনি গবেষণাপত্রের ব্যাপারে কখনও তেমন গোছালো ছিলেন না। অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির মধ্যেই নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবার যে প্রবণতা দেখা যায় সেটা তার মধ্যে ছিল না। ব্যাপারটা যেন এমন যে, তিনি নিজের খ্যাতি নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। তবে, আমি প্রচুর পরিমাণ ছবি ও চিঠি জোগাড় করেছি। তাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন এমন মানুষদের সাক্ষাৎকারও নিয়েছি। যেমন, আমার চাচা, চাচী, তার ছাত্ররা এবং অবশ্যই আমার মা, অপর্ণা।
উনাদের সাথে কথা বলে নতুন কি জানলেন?
ফাল্গুনী: আমার নেয়া সবচেয়ে চমৎকার সাক্ষাৎকারগুলো এমন লোকদের যারা বসুকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন। তাদের সাথে কথা বলা, তাদের কণ্ঠস্বর কান পেতে শোনা, বসুকে স্মরণ করতে গিয়ে তাদের চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া পানি দেখে আমি প্রচণ্ড আবেগী হয়ে পড়েছি। এছাড়া আমার পরলোকগত বাবা বিমল সরকারের লেখা কিছু চিঠি ও নোটও কাজে দিয়েছে। এখানে এসে জানতে পেরেছি, আমার বাবাও বসুকে নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং লিখেছেন। তাই আমার প্রচেষ্টাকে বলা যায় এক ধরণের বংশানুক্রমিক গবেষণা।
সত্যেন বসু কেবল মেধাবী বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদই ছিলেন না, ছিলেন ভারতের জাতীয় অধ্যাপক, শান্তনিকেতনের উপাচার্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জওহরলাল নেহেরু এবং জামিনী রায় ও বিষ্ণু দের মত শিল্পীদের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। এছাড়া স্বাধীনতা-পূর্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার প্রাক্তন ছাত্রদের সাথেও সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার লেকচার শোনার জন্য এত ছাত্র জড়ো হতো যে পুরো ফ্লোরটাই ভরে যেতো, যদিও তারা লেকচারের খুব কম অংশই বুঝতো। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় তিনি বিপ্লবীদের সমর্থন জুগিয়েছেন। সংস্কৃতসহ বেশ কিছু ভাষা তার জানা ছিল, ফরাসি সাহিত্য ভালবাসতেন, গৌতম বুদ্ধের দর্শনের সাথে পরিচিত ছিলেন এবং চমৎকার এস্রাজ বাজাতে পারতেন। এমনকি নিজে একটি রাগও রচনা করেছিলেন! এসব দেখে খুব সহজেই বোঝা যায় তিনি জীবদ্দশায়ই কিভাবে মানুষের কাছে কিংবদন্তী হয়ে উঠেছিলেন।
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী: কি কি ধরণের চিঠি পেয়েছেন?
ফাল্গুনী: আমার মা’র কাছে লেখা কিছু চিঠি আছে, তখন আমি ছোট ছিলাম। এছাড়া ব্যক্তিগত এবং পেশাগত ক্ষেত্রে বিভিন্ন জনের সাথে যোগাযোগ রক্ষার জন্য লেখা চিঠি পেয়েছি। যেমন, এই চিঠিটি লিখেছিলেন ১৯২৬ সালে। তখন বার্লিনে আইনস্টাইনের সাথে গবেষণা করছিলেন। এখানে তাকে ইতিহাসের খুব উত্তেজনাকর একটি সময় নিয়ে লিখতে দেখা যাচ্ছে:
“পদার্থবিজ্ঞানের জগতে যেসব ঘটনা ঘটছে সে সম্পর্কে বার্লিনের সবাইকে (সব পদার্থবিজ্ঞানীকে) খুব উত্তেজিত মনে হচ্ছে। কয়েকদিন আগে কলোকুইয়াম থেকে ফেরার পথে আইনস্টাইন আমাদের সাথে এক কম্পার্টমেন্টে উঠলেন। এইমাত্র আমরা যেসব কথা শুনে এসেছি সেগুলো নিয়েই তিনি কথা বলতে শুরু করলেন। তিনিও নতুন নতুন চিন্তাধারার বিশালত্ব স্বীকার করতে বাধ্য হলেন, বললেন এসব তত্ত্ব পরস্পরের সহায়তায় কত কি যে ব্যাখ্যা করতে পারবে তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু এই সবকিছুর মধ্যে যে অযৌক্তিকতা নিহিত আছে সে সম্পর্কে তাকে উদ্বিগ্ন মনে হল। আমরা সবাই চুপ করে থাকলেও তিনি প্রায় পুরো সময় কথা বলে গেছেন, অন্যান্য যাত্রীদের মনে সে কথার কি রকম ছাপ পড়ছে সেদিকে ভ্রুক্ষেপও করেননি।”
এখন আমরা সবাই জানি, আইনস্টাইন বিশ্বের পরিসাংখ্যিক ব্যাখ্যা গ্রহণ করতে পারেননি, আমৃত্যু তিনি এ ব্যাপারে অবিচল ছিলেন। এ নিয়ে তো তার একটি বিখ্যাত উক্তিই আছে: “ঈশ্বর মহাবিশ্ব নিয়ে পাশা খেলেন না”। কিন্তু তার প্রকৃত সাংঘর্ষিক অবস্থা এবং কোয়ান্টাম তত্ত্বের সেই স্বর্ণযুগে সবাই যে পরিমাণ উত্তেজিত ছিল তা সম্পর্কে সরাসরি জানতে পেরে বিস্মিত হয়েছি। হাইজেনবার্গ, শ্রোডিঙার, আইনস্টাইন, বোর, দিরাক, প্লাংক সবাই এই গল্পে উপস্থিত। ভারতবর্ষের বিজ্ঞান আচার্যরাও অনুপস্থিত নেই- মেঘনাদ সাহা, স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, প্রশান্ত মহালনবীশ, স্যার প্রফুল্লচন্দ্র রায়, স্যার জগদীশচন্দ্র বসু সবাই আছেন।
সবাই ভাবতে ভালোবাসে যে, পশ্চিমা বিজ্ঞানের ইতিহাস সবচেয়ে মহান। কিন্তু আমাদের তথা বাঙালিদের বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাসও কোন অংশে কম নয়। এক দিক দিয়ে চিন্তা করলে বাঙালিদের অর্জন আরও বেশি। কারণ আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে কেবল স্বাধীনভাবে জ্ঞানার্জনের অধিকার অর্জনের জন্যই দীর্ঘকাল সংগ্রাম করতে হয়েছে।
বাঙালিদের কাছে সত্যেন বসুর গুরুত্ব কিভাবে গড়ে উঠেছে?
ফাল্গুনী: বসু এক অনন্য বাঙালি চরিত্র। তিনি ২৫ বছর কাটিয়েছেন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। আমি ঢাকা গিয়ে দেখেছি সেখানে বসু সবার কাছে নায়ক, অনেক দিক দিয়ে কলকাতার চেয়েও বেশি। ঢাকার মানুষেরা বুদ্ধিজীবীদেরকে এখনও খুব শ্রদ্ধা করে, তাছাড়া বসুই তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান করে দিয়েছিলেন। সত্যেন বসু এমন একটি চরিত্র যে আমাদেরকে দুই বাংলার সীমা ভুলিয়ে দেয়, আমাদেরকে সেই সময়ে নিয়ে যায় যখন সংগ্রাম হতো পুরো বাংলার জন্য।
এসব উপাত্ত নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
ফাল্গুনী: আসলে আমরা চাই, সকল স্তরের মানুষ বিশেষত তরুণরা সত্যেন বসু সম্পর্কে আরও জানুক। এটা তাদের নিজেদেরই ইতিহাস এবং হতে পারে তাদের আত্মপরিচয়ের একটি বড় উৎস। তাছাড়া যেসব বর্ষীয়ান বাঙালি পশ্চিমা দেশগুলোতে গিয়ে সফলতা অর্জন করেছেন তাদের কাছেও এসব তথ্য পৌঁছে দিতে চাই যাতে তারা তাদের পূর্বপুরুষদের অর্জন সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে, এ সচেতনতা যেন তাদের বংশধরদের মাঝেও প্রবাহিত হয়। আমরা চাই তারা যেন নিজেদের সন্তানদের সাথে এসব অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করতে পারে। আর পশ্চিমারাও যেন এ অঞ্চলের বিজ্ঞানীদের অবদান জানতে পারে এবং তাদের বন্ধুবান্ধবের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারে।
এ নিয়ে আরও তথ্য কোথা থেকে জানা যাবে?
ফাল্গুনী: আন্তর্জালেই অনেক তথ্য আছে। আর আমরা এস এন বোস প্রজেক্টের ওয়েবসাইটে অনেক কিছু প্রকাশ করেছি। সেখানে আছে: বসুর জীবনের একটি ঘটনাপঞ্জি, আন্তর্জালে সংশ্লিষ্ট লিংক, নোবেল পুরস্কার বিষয়ক তথ্য এবং একটি সুদীর্ঘ জীবনী। এছাড়া আমরা একটি বই প্রকাশ করছি যার নাম হবে “Satyendra Nath Bose in His Own Words and Pictures”, আগামী বছরের মধ্যে এটি প্রকাশিত হওয়ার কথা। বইটি খুব সুন্দরভাবে সাজানো থাকবে, এতে বসুর নিজের লেখা, বক্তৃতা, সাক্ষাৎকার এবং ছবির মাধ্যমেই তার জীবন তুলে ধরা হবে। এছাড়া এস এন বোস জীবনী প্রকল্পের ভূমিকা তুলে ধরার জন্য আমরা একটি ব্রোশারও তৈরী করেছি। ব্রোশারটিতে প্রকাশিতব্য বই সম্পর্কেও কিছু তথ্য আছে।
কলকাতা বইমেলাতেই বইটি প্রকাশের ইচ্ছা আছে। ২০০৮ সালের বসন্তের মধ্যে সব বড় বড় বইয়ের দোকানে যাতে বইটি পাওয়া যায় সে চেষ্টাও করা হচ্ছে কারণ ঠিক তখনই এনএবিসি ২০০৮ শুরু হচ্ছে।
দেখে মনে হচ্ছে এ কাজটি একেবারে হৃদয় দিয়ে করছেন।
ফাল্গুনী: হ্যা, অবশ্যই। বসুকে বলা হয়ে থাকে “সমন্বিত ব্যক্তিত্ব”, “বহুবিষয়ে পণ্ডিত” এবং সর্বোপরী একজন “পরিপূর্ণ মানুষ”। একালের খুব কম ব্যক্তি সম্পর্কেই এমন উক্তি করা চলে। কিন্তু বসুকে নিয়ে লিখতে বা বলতে গেলে এই উপমাগুলোই বেরিয়ে আসে। বসু গবেষণার ব্যাপারে নৈর্ব্যক্তিক থাকতে চাইলেও আবেগ এড়ানো অসম্ভব হয়ে পড়ছে। কিন্তু এটাকে ইতিবাচক হিসেবে নিচ্ছি। কারণ নৈর্ব্যক্তিক তথ্যের জন্য আমি অভিধান পড়তে বলবো (বিজ্ঞান অভিধান আর কি!)। কিন্তু বসু সম্পর্কে অভিধান ধরণের লেখার চেয়ে মানুষ ব্যক্তিগত গল্পই বেশি পছন্দ করবে। বাস্তবের মানুষ সম্পর্কে বাস্তব গল্পেই মানুষের আগ্রহ বেশি দেখা যায়। আর বাঙালিদের ক্ষেত্রে এটা আরও প্রকট, কারণ এই বাস্তবতা তাদের ইতিহাসেরই অংশ।
ফাল্গুনী সরকারের পেশা “তথ্যপ্রযুক্তি মার্কেটিং”। সর্বশেষ কাজ করেছেন ক্যালিফোর্নিয়ার “সান মাইক্রোসিস্টেমস”-এ। দাদু সম্পর্কে গবেষণা এবং লেখার জন্যই চাকরি ছেড়ে ভারতে চলে গেছেন। তার গবেষণা সম্পর্কে আরও জানার জন্য তিনি সবাইকে “এস এন বোস বায়োগ্রাফি প্রজেক্ট” এর ওয়েবসাইটে যেতে উৎসাহিত করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বা পরামর্শ দিয়ে করা মেইলগুলো তিনি গুরুত্বের সাথে পড়েন। এছাড়া বসু এবং তার বাঙালি জীবন নিয়ে কারও কাছে কোন ছবি বা কাহিনী থাকলেও মেইলের মাধ্যমে তা পাঠাতে উৎসাহিত করেছেন।
উৎসাহীদের জন্য ওয়েবসাইটটির ঠিকানা দেয়া হল:
- www.snbose.org
সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নাম যেন বিজ্ঞানের জগতে একটি সৌধ হয়ে আছে, বিশেষত কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের জগতে। মৌলিক কণা “বোসন”, বোসনের ক্রিয়াকর্ম ব্যাখ্যায় সক্ষম “বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান” এবং “বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট”- সবগুলো নামই এই মহান বিজ্ঞানীর নামে রাখা হয়েছে। উল্লেখ্য বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট গবেষণাগারে তৈরী করে দেখানোর জন্যই ২০০১ সালে এরিক কর্নেল ও কার্ল ওয়াইম্যানকে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে। আলবার্ট আইনস্টাইন বসুর গবেষণাপত্রকে বলেছিলেন, “প্রগতির দিকে একটি অনিন্দ্য সুন্দর পদক্ষেপ”।
বাংলায় সত্যেন বসু যেন এক পৌরাণিক কিংবদন্তি। একটি বিখ্যাত বাংলা সাময়িকী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যজিৎ রায়, রবি শংকরের মত বিশ্বনন্দিত বাঙালি থাকা সত্ত্বেও সত্যেন বসুকে “শতাব্দীর বাঙালি” হিসেবে স্বীকৃত দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তার লেখা একমাত্র বিজ্ঞান গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে। বসু সম্পর্ক তিনি লিখেছিলেন, “a man of genius with a taste for literature and who is a scientist as well.”
তারপরও সত্যেন্দ্রনাথ বসুর প্রকৃত ব্যক্তিসত্ত্বা সম্পর্কে খুব কম মানুষই জানে। বাংলা এবং ইংরেজিতে অনেক লেখা এবং জীবনীগ্রন্থ থাকা সত্ত্বেও তার জীবনের উপর সুগভীর আলোকপাতের অভাব প্রকট। এই অভাববোধ থেকেই সত্যেন্দ্রনাথ বসুর এক পৌত্র শুরু করেছিলেন বসু জীবন চরিত অনুসন্ধান। বসুর জীবন, কর্ম এবং তার শিল্পপ্রীতিকে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে আসাই তার লক্ষ্য।
ফাল্গুনী সরকার অধ্যাপক বসুর ছোট মেয়ের ছেলে। তিনি তার বিখ্যাত পিতামহকে নিয়ে একটি বই লিখছেন। ফাল্গুনী বেড়ে উঠেছেন যুক্তরাষ্ট্রে, এ সম্পর্কে তাকে বলতে শোনা যায়, “আমার এই প্রখ্যাত পূর্বপুরুষের ছায়া থেকে আমি অনেক দূরেই ছিলাম”। এ কারণেই বসু সম্পর্কে প্রথম জীবনে খুব বেশি কিছু জানার সৌভাগ্য তার হয়নি, বাবা-মা ও পরিবারের অন্যদের কাছ থেকে টুকিটাকি যা শুনেছিলেন তা-ই ছিল সম্বল। এখন তিনি ভারতে ফিরে এসেছেন, সেই পিতামহের সন্ধানে যাকে তিনি খুব কমই চিনেন। তার মুখ থেকেই শোনা যাক এই অভিনব অভিযান ও তার অনুভূতির কথা…
আপনি কিভাবে সত্যেন বসুর প্রতি উৎসাহী হয়ে উঠলেন?
ফাল্গুনী: আসলে সান ফ্রান্সিসকোর বে এরিয়াতে বড় হওয়ায় আমার বিখ্যাত দাদুর কথা সবসময়ই শুনেছি। কিন্তু আমার কোন বন্ধুর বাবা-মা-ই তার নাম শুনেননি, এমনকি বোসন কাকে বলে সেটাও তারা জানতেন না। তাই ভেবেছিলাম, দাদু হয়ত অতো বিখ্যাত না। কিন্তু ১৯৯৫ সালের জুলাই মাসের একদিনে একটি ফোন কল আমার চিন্তাভাবনা পাল্টে দেয়, সেদিন আমার এক বন্ধু ফোন করে বলে, আমার দাদুর ছবি নাকি নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রচ্ছদে এসেছিল। ৭০ বছর আগেই বিজ্ঞানীরা বোস পরিসংখ্যান ব্যবহার করে আইনস্টাইনের করা একটি ভবিষ্যদ্বাণী প্রমাণ করেছিলেন। আইনস্টাইন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, কিছু কণাকে (বোসন) ঠাণ্ডা করে অনেক কম তাপমাত্রায় নিয়ে আসলে নতুন ধরণের একটি বিদঘুটে পদার্থ তৈরী হতে পারে। এই নতুন পদার্থেরই নাম “বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট” (Bose-Einstein Condensates – BEC)। এরা ফোটন তথা আলোর সম্ভাব্যতা সূত্র মেনে চলে যা আমার দাদু আবিষ্কার করেছিলেন। আইনস্টাইন সেই আবিষ্কারকে আরও পরিবর্ধন করেন এবং বিইসি-র বিস্তারিত ভবিষ্যদ্বাণী করেন। বর্তমানে এটি নিম্ন তাপমাত্রার আণবিক পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাক্ষেত্র। কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, অতিপরিবাহিতা এবং আণবিক লেজারের মত সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রগুলোতে বিইসি গবেষণার বিশেষ গুরুত্ব আছে। গবেষণাগারে বিইসি তৈরীর জন্য ২০০১ সালে দুজন পদার্থবিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। এসব তথ্যের প্রেক্ষিতেই আমি ১২ বছর আগে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, সত্যেন বসু সম্পর্কে আরও জানবো।
আপনি তো ভারতে চলে গেছেন। এর মধ্যে নতুন কি কি জানতে পেরেছেন? হাতে কি পরিমাণ তথ্য-উপাত্ত ও মিডিয়া এসেছে?
ফাল্গুনী: হ্যাঁ, আমি এর আগে কখনোই কয়েক মাসের বেশি একটানা ভারতে থাকিনি। থাকার অভিজ্ঞতা বেশ মজার, নতুন নতুন অনেক ঘটনা ঘটে সেখানে। আমার গবেষণা কাজ প্রসঙ্গে প্রথমেই বসুর অগোছালো প্রকৃতির কথা বলতে হয়। তিনি গবেষণাপত্রের ব্যাপারে কখনও তেমন গোছালো ছিলেন না। অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির মধ্যেই নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবার যে প্রবণতা দেখা যায় সেটা তার মধ্যে ছিল না। ব্যাপারটা যেন এমন যে, তিনি নিজের খ্যাতি নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। তবে, আমি প্রচুর পরিমাণ ছবি ও চিঠি জোগাড় করেছি। তাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন এমন মানুষদের সাক্ষাৎকারও নিয়েছি। যেমন, আমার চাচা, চাচী, তার ছাত্ররা এবং অবশ্যই আমার মা, অপর্ণা।
উনাদের সাথে কথা বলে নতুন কি জানলেন?
ফাল্গুনী: আমার নেয়া সবচেয়ে চমৎকার সাক্ষাৎকারগুলো এমন লোকদের যারা বসুকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন। তাদের সাথে কথা বলা, তাদের কণ্ঠস্বর কান পেতে শোনা, বসুকে স্মরণ করতে গিয়ে তাদের চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া পানি দেখে আমি প্রচণ্ড আবেগী হয়ে পড়েছি। এছাড়া আমার পরলোকগত বাবা বিমল সরকারের লেখা কিছু চিঠি ও নোটও কাজে দিয়েছে। এখানে এসে জানতে পেরেছি, আমার বাবাও বসুকে নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং লিখেছেন। তাই আমার প্রচেষ্টাকে বলা যায় এক ধরণের বংশানুক্রমিক গবেষণা।
সত্যেন বসু কেবল মেধাবী বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদই ছিলেন না, ছিলেন ভারতের জাতীয় অধ্যাপক, শান্তনিকেতনের উপাচার্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জওহরলাল নেহেরু এবং জামিনী রায় ও বিষ্ণু দের মত শিল্পীদের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। এছাড়া স্বাধীনতা-পূর্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার প্রাক্তন ছাত্রদের সাথেও সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার লেকচার শোনার জন্য এত ছাত্র জড়ো হতো যে পুরো ফ্লোরটাই ভরে যেতো, যদিও তারা লেকচারের খুব কম অংশই বুঝতো। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় তিনি বিপ্লবীদের সমর্থন জুগিয়েছেন। সংস্কৃতসহ বেশ কিছু ভাষা তার জানা ছিল, ফরাসি সাহিত্য ভালবাসতেন, গৌতম বুদ্ধের দর্শনের সাথে পরিচিত ছিলেন এবং চমৎকার এস্রাজ বাজাতে পারতেন। এমনকি নিজে একটি রাগও রচনা করেছিলেন! এসব দেখে খুব সহজেই বোঝা যায় তিনি জীবদ্দশায়ই কিভাবে মানুষের কাছে কিংবদন্তী হয়ে উঠেছিলেন।
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী: কি কি ধরণের চিঠি পেয়েছেন?
ফাল্গুনী: আমার মা’র কাছে লেখা কিছু চিঠি আছে, তখন আমি ছোট ছিলাম। এছাড়া ব্যক্তিগত এবং পেশাগত ক্ষেত্রে বিভিন্ন জনের সাথে যোগাযোগ রক্ষার জন্য লেখা চিঠি পেয়েছি। যেমন, এই চিঠিটি লিখেছিলেন ১৯২৬ সালে। তখন বার্লিনে আইনস্টাইনের সাথে গবেষণা করছিলেন। এখানে তাকে ইতিহাসের খুব উত্তেজনাকর একটি সময় নিয়ে লিখতে দেখা যাচ্ছে:
“পদার্থবিজ্ঞানের জগতে যেসব ঘটনা ঘটছে সে সম্পর্কে বার্লিনের সবাইকে (সব পদার্থবিজ্ঞানীকে) খুব উত্তেজিত মনে হচ্ছে। কয়েকদিন আগে কলোকুইয়াম থেকে ফেরার পথে আইনস্টাইন আমাদের সাথে এক কম্পার্টমেন্টে উঠলেন। এইমাত্র আমরা যেসব কথা শুনে এসেছি সেগুলো নিয়েই তিনি কথা বলতে শুরু করলেন। তিনিও নতুন নতুন চিন্তাধারার বিশালত্ব স্বীকার করতে বাধ্য হলেন, বললেন এসব তত্ত্ব পরস্পরের সহায়তায় কত কি যে ব্যাখ্যা করতে পারবে তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু এই সবকিছুর মধ্যে যে অযৌক্তিকতা নিহিত আছে সে সম্পর্কে তাকে উদ্বিগ্ন মনে হল। আমরা সবাই চুপ করে থাকলেও তিনি প্রায় পুরো সময় কথা বলে গেছেন, অন্যান্য যাত্রীদের মনে সে কথার কি রকম ছাপ পড়ছে সেদিকে ভ্রুক্ষেপও করেননি।”
এখন আমরা সবাই জানি, আইনস্টাইন বিশ্বের পরিসাংখ্যিক ব্যাখ্যা গ্রহণ করতে পারেননি, আমৃত্যু তিনি এ ব্যাপারে অবিচল ছিলেন। এ নিয়ে তো তার একটি বিখ্যাত উক্তিই আছে: “ঈশ্বর মহাবিশ্ব নিয়ে পাশা খেলেন না”। কিন্তু তার প্রকৃত সাংঘর্ষিক অবস্থা এবং কোয়ান্টাম তত্ত্বের সেই স্বর্ণযুগে সবাই যে পরিমাণ উত্তেজিত ছিল তা সম্পর্কে সরাসরি জানতে পেরে বিস্মিত হয়েছি। হাইজেনবার্গ, শ্রোডিঙার, আইনস্টাইন, বোর, দিরাক, প্লাংক সবাই এই গল্পে উপস্থিত। ভারতবর্ষের বিজ্ঞান আচার্যরাও অনুপস্থিত নেই- মেঘনাদ সাহা, স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, প্রশান্ত মহালনবীশ, স্যার প্রফুল্লচন্দ্র রায়, স্যার জগদীশচন্দ্র বসু সবাই আছেন।
সবাই ভাবতে ভালোবাসে যে, পশ্চিমা বিজ্ঞানের ইতিহাস সবচেয়ে মহান। কিন্তু আমাদের তথা বাঙালিদের বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাসও কোন অংশে কম নয়। এক দিক দিয়ে চিন্তা করলে বাঙালিদের অর্জন আরও বেশি। কারণ আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে কেবল স্বাধীনভাবে জ্ঞানার্জনের অধিকার অর্জনের জন্যই দীর্ঘকাল সংগ্রাম করতে হয়েছে।
বাঙালিদের কাছে সত্যেন বসুর গুরুত্ব কিভাবে গড়ে উঠেছে?
ফাল্গুনী: বসু এক অনন্য বাঙালি চরিত্র। তিনি ২৫ বছর কাটিয়েছেন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। আমি ঢাকা গিয়ে দেখেছি সেখানে বসু সবার কাছে নায়ক, অনেক দিক দিয়ে কলকাতার চেয়েও বেশি। ঢাকার মানুষেরা বুদ্ধিজীবীদেরকে এখনও খুব শ্রদ্ধা করে, তাছাড়া বসুই তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান করে দিয়েছিলেন। সত্যেন বসু এমন একটি চরিত্র যে আমাদেরকে দুই বাংলার সীমা ভুলিয়ে দেয়, আমাদেরকে সেই সময়ে নিয়ে যায় যখন সংগ্রাম হতো পুরো বাংলার জন্য।
এসব উপাত্ত নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
ফাল্গুনী: আসলে আমরা চাই, সকল স্তরের মানুষ বিশেষত তরুণরা সত্যেন বসু সম্পর্কে আরও জানুক। এটা তাদের নিজেদেরই ইতিহাস এবং হতে পারে তাদের আত্মপরিচয়ের একটি বড় উৎস। তাছাড়া যেসব বর্ষীয়ান বাঙালি পশ্চিমা দেশগুলোতে গিয়ে সফলতা অর্জন করেছেন তাদের কাছেও এসব তথ্য পৌঁছে দিতে চাই যাতে তারা তাদের পূর্বপুরুষদের অর্জন সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে, এ সচেতনতা যেন তাদের বংশধরদের মাঝেও প্রবাহিত হয়। আমরা চাই তারা যেন নিজেদের সন্তানদের সাথে এসব অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করতে পারে। আর পশ্চিমারাও যেন এ অঞ্চলের বিজ্ঞানীদের অবদান জানতে পারে এবং তাদের বন্ধুবান্ধবের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারে।
এ নিয়ে আরও তথ্য কোথা থেকে জানা যাবে?
ফাল্গুনী: আন্তর্জালেই অনেক তথ্য আছে। আর আমরা এস এন বোস প্রজেক্টের ওয়েবসাইটে অনেক কিছু প্রকাশ করেছি। সেখানে আছে: বসুর জীবনের একটি ঘটনাপঞ্জি, আন্তর্জালে সংশ্লিষ্ট লিংক, নোবেল পুরস্কার বিষয়ক তথ্য এবং একটি সুদীর্ঘ জীবনী। এছাড়া আমরা একটি বই প্রকাশ করছি যার নাম হবে “Satyendra Nath Bose in His Own Words and Pictures”, আগামী বছরের মধ্যে এটি প্রকাশিত হওয়ার কথা। বইটি খুব সুন্দরভাবে সাজানো থাকবে, এতে বসুর নিজের লেখা, বক্তৃতা, সাক্ষাৎকার এবং ছবির মাধ্যমেই তার জীবন তুলে ধরা হবে। এছাড়া এস এন বোস জীবনী প্রকল্পের ভূমিকা তুলে ধরার জন্য আমরা একটি ব্রোশারও তৈরী করেছি। ব্রোশারটিতে প্রকাশিতব্য বই সম্পর্কেও কিছু তথ্য আছে।
কলকাতা বইমেলাতেই বইটি প্রকাশের ইচ্ছা আছে। ২০০৮ সালের বসন্তের মধ্যে সব বড় বড় বইয়ের দোকানে যাতে বইটি পাওয়া যায় সে চেষ্টাও করা হচ্ছে কারণ ঠিক তখনই এনএবিসি ২০০৮ শুরু হচ্ছে।
দেখে মনে হচ্ছে এ কাজটি একেবারে হৃদয় দিয়ে করছেন।
ফাল্গুনী: হ্যা, অবশ্যই। বসুকে বলা হয়ে থাকে “সমন্বিত ব্যক্তিত্ব”, “বহুবিষয়ে পণ্ডিত” এবং সর্বোপরী একজন “পরিপূর্ণ মানুষ”। একালের খুব কম ব্যক্তি সম্পর্কেই এমন উক্তি করা চলে। কিন্তু বসুকে নিয়ে লিখতে বা বলতে গেলে এই উপমাগুলোই বেরিয়ে আসে। বসু গবেষণার ব্যাপারে নৈর্ব্যক্তিক থাকতে চাইলেও আবেগ এড়ানো অসম্ভব হয়ে পড়ছে। কিন্তু এটাকে ইতিবাচক হিসেবে নিচ্ছি। কারণ নৈর্ব্যক্তিক তথ্যের জন্য আমি অভিধান পড়তে বলবো (বিজ্ঞান অভিধান আর কি!)। কিন্তু বসু সম্পর্কে অভিধান ধরণের লেখার চেয়ে মানুষ ব্যক্তিগত গল্পই বেশি পছন্দ করবে। বাস্তবের মানুষ সম্পর্কে বাস্তব গল্পেই মানুষের আগ্রহ বেশি দেখা যায়। আর বাঙালিদের ক্ষেত্রে এটা আরও প্রকট, কারণ এই বাস্তবতা তাদের ইতিহাসেরই অংশ।
ফাল্গুনী সরকারের পেশা “তথ্যপ্রযুক্তি মার্কেটিং”। সর্বশেষ কাজ করেছেন ক্যালিফোর্নিয়ার “সান মাইক্রোসিস্টেমস”-এ। দাদু সম্পর্কে গবেষণা এবং লেখার জন্যই চাকরি ছেড়ে ভারতে চলে গেছেন। তার গবেষণা সম্পর্কে আরও জানার জন্য তিনি সবাইকে “এস এন বোস বায়োগ্রাফি প্রজেক্ট” এর ওয়েবসাইটে যেতে উৎসাহিত করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বা পরামর্শ দিয়ে করা মেইলগুলো তিনি গুরুত্বের সাথে পড়েন। এছাড়া বসু এবং তার বাঙালি জীবন নিয়ে কারও কাছে কোন ছবি বা কাহিনী থাকলেও মেইলের মাধ্যমে তা পাঠাতে উৎসাহিত করেছেন।
উৎসাহীদের জন্য ওয়েবসাইটটির ঠিকানা দেয়া হল:
- www.snbose.org
ঋতুপর্ণ ঘোষের সাক্ষাৎকার
বাংলা সংস্কৃতিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরই যার নাম উচ্চারিত হওয়া উচিত তিনি হলেন দ্য গ্রেট সত্যজিৎ রায়। আমার কাছে সত্যজিৎ যেন রবীন্দ্রনাথের চেয়েও বড়। কারণ খুব স্বাভাবিক, আমি এখনও রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত পৌঁছুতে পারিনি। চেষ্টাও করিনি অবশ্য, তার বদলে সত্যজিৎকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত যাওয়ার শর্টকাট রাস্তা হিসেবে ব্যবহার করেছি। রাস্তাটা চমৎকার, কারণ এপার-ওপার দুই বাংলা মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথকে সত্যজিতের চেয়ে ভাল আর কেউ বুঝেনি।
তো এই গ্রেট সত্যজিৎ রায়ের একটা সাক্ষাৎকার অনুবাদ করব করব করেও করতে পারছিলাম না। কারণ, সেটা অনেক বড়। এরই মধ্যে ঋতুপর্ণ ঘোষের অনেকগুলো সিনেমা দেখা হয়ে গেল। বুঝলাম, কাউকে সত্যজিতের রায়ের উত্তরসূরি বলতে হলে এই ঋতুপর্ণকেই বলতে হবে। সত্যজিতের উত্তরসূরির পাশাপাশি তার আরেকটা বড় পরিচয় হচ্ছে, তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের সাথে মাস্টার অফ সিনেমা ইংমার বারিমানের সিনেমার সফল সমন্বয় ঘটিয়েছেন। নেটে খুঁজতে খুঁজতে ঋতুপর্ণ ঘোষের একটা সাক্ষাৎকার পেয়ে গেলাম। আশার কথা হল, এটার দৈর্ঘ্য সত্যজিতের সাক্ষাৎকারের তুলনায় অনেক কম। আর ঋতুপর্ণ ঘোষের কথায় কলকাতার সংস্কৃতি এবং বাংলা চলচ্চিত্রের বেশ কিছু বিষয় উঠে এসেছে। তাই অনুবাদে হাত দিয়ে দিলাম। পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, এটা ভাবানুবাদ। সাক্ষাৎকারের ভাবানুবাদ করা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত জানি না। আমার কাছে এটাকেই সঠিক মনে হয়েছে। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন: AsiaSource এর Nermeen Shaikh
স্থান-কাল: ঋতুপর্ণের “চোখের বালি” ২০০৩ সালের Locarno International Film Festival এ Golden Leopard পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়। ২০০৫ সালের ৯ই এপ্রিল ৩য় বার্ষিক South Asia Human Rights Film Festival উপলক্ষ্যে এশিয়া সোসাইটি সিনেমাটি প্রদর্শনের আয়োজন করে। প্রদর্শন উপলক্ষ্যে ঋতুপর্ণ নিউ ইয়র্কে গিয়েছিলেন। সে সময়ই এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করা হয়।
আপনি যে ধরণের সিনেমা করেন তার পেছনে কলকাতার সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবেশে আপনার বেড়ে ওঠার প্রভাব কতটুকু বলে মনে করেন?
আমার চলচ্চিত্র জীবন শুধু নয় ব্যক্তি হিসেবে আমার বর্তমান অবস্থানের উপর কলকাতার বিশাল প্রভাব আছে। আমি কিন্তু এখানে প্রভাব হিসেবে কলকাতার নাম করছি, বাংলার নয়; আর এই দুয়ের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য আছে। কলকাতার কথা আসলেই আমাদের মুখে দুটো নাম চলে আসে: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সত্যজিৎ রায়। কিন্তু বাংলা মানে কেবল রবীন্দ্রনাথ আর সত্যজিৎ না, আরও অনেক কিছু। বাংলা এমন এক প্রদেশ যা দেশভঙ্গের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছে। ভারতের অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ অনেক প্রগতিশীল, তাই সেখানে থাকতে পেরে আমি গর্বিত। দেশজুড়ে যে মৌলবাদের উত্থান ঘটেছে মুম্বাই তার দ্বারা আক্রান্ত হলেও কলকাতায় তার কোন প্রভাব পড়েনি।
অনেক আগে কলকাতা ছিল ভারতের রাজধানী। এ কারণে প্রয়োজনীয় সব ধরণের অবকাঠামোই এখানে আছে। জ্ঞানের বিচরণ ক্ষেত্র হিসেবেও কলকাতার জুড়ি নেই। এখানে আছে: National Library যা এশিয়ার বৃহত্তম। আছে এশিয়াটিক সোসাইটি। এছাড়া প্রচুর বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্থা আছে এখানে। আপনি যদি গুরুতর কোন বিষয়ে গবেষণা করতে চান এবং এর জন্য বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টি আকর্ষণের প্রয়জন পড়ে তাহলে আপনার জন্য কলকাতার চেয়ে ভাল কোন স্থান বাংলায় নেই।
এর পাশাপাশি আবার কলকাতা বর্ধিষ্ণু শহর না। এটা খুব সাধারণ, এখানে আপনি সব ধরণের লোকের সাথেই মেশার সুযোগ পাবেন। একে আমলাতান্ত্রিক শহর বলা যায় না, আবার ক্লিনিক্যাল সিটিও বলা যায় না। এখানে থাকলে এক ধরণের উষ্ণতা ও স্পন্দন অনুভব করা যায়, অনেকটা নিউ ইয়র্কের মত। লন্ডনের কিছু জায়গাও আমাকে কলকাতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তবে এটা অবশ্যই ব্যস্ত শহর। রাস্তায় সব সময়ই পথচারীদের ভীড় লেগে আছে, একে অন্যের উপর আছড়ে পড়ছে, কেউ কেউ রাগান্বিত হ� ��ে ওভার-রিঅ্যাক্ট করে ফেলছে। এখানে সবাই একটু উত্তেজিত। কলকাতার মানুষেরা যখন সুখে থাকে তখনও উন্মাদের মত আচরণ করে আবার যখন রাগান্বিত থাকে তখনও উন্মাদের মত আচরণ করে। বাংলায় যা আছে তার সবই কলকাতায় দেখতে পাওয়া যায়, তবে সবকিছুই এখানে একটু পরিশোধিত এবং ফিল্টার করা। এজন্যই শহরটা এত মজাদার।
বেড়ে ওঠার সময় কলকাতার সাংস্কৃতিক জীবনের সাথে আপনি নিজেকে কিভাবে এবং কতটা জড়িয়েছেন?
আমি বেড়ে উঠেছি কলকাতার বামপন্থী সংস্কৃতির মাঝে। আর ভারতের বাকি অংশের নেতৃত্বের আসনে ছিল ডানপন্থীরা। আমার যখন বোঝার বয়স হয়েছে (৭০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে শেষ পর্যন্ত) তখন থেকেই দেখে আসছি, কলকাতা বামপন্থী শহর। আমি ৩০ বছর আগের কথা বলছি। সে সময় আমরা বেশী কিছু জানতাম না। এখন তো মানুষ সবকিছুর সাথে খুব দ্রুত পরিচিত হয়ে পড়ে, অল্প বয়সেই তার চোখে অনেক কিছু ধরা পড়ে। আমি যখন স্কুল শেষ করছি, তখন কলকাতায় মাত্র টেলিভিশন এসেছে। সুতরাং রাজনীতি নিয়ে যখন থেকে ভাবতে শুরু করেছি তখন থেকেই কলকাতায় বামপন্থীদের রাজত্ব। এখানে বাম রাজনীতি অনেক ফ্যাশনের মত। জটিলতাগুলো চিন্তা না করেই এখানকার মানুষ বামপন্থী হয়ে যায়। ভার্সিটিতে অর্থনীতি পড়ার সময় আমি কার্ল মার্ক্স পড়েছি এবং এ নিয়ে আমার একটা বিশেষ গবেষণাপত্রও তৈরী করতে হয়েছিল।
তারপরও ঘুরেফিরে আবার সে কথায় আসতে হয়, কলকাতা অবশ্যই সত্যজিতের শহর। আমি যে ভার্সিটিতে পড়েছি সেখানে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কোন শেষ ছিল না। আমার দুঃখ হয়, কেন অর্থনীতি নিয়ে পড়েছিলাম। এটা আমার কোনই কাজে আসেনি। এর সাথে সংশ্লিষ্ট কোন পেশায়ও আমি যোগ দেইনি। এর চেয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বা ইতিহাস বা এ ধরণের কিছু পড়লে অনেক ভাল হতো। তারপরও আজ যখন পেছন ফিরে তাকাই তখন সামগ্রিকভাবে আমার ভার্সিটি জীবন নিয়ে কোন দুঃখ হয় না। কারণ সে জীবনে অনেক কিছুর সাথে পরিচয় হয়েছিল। জাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি ৫ বছর কাটিয়েছি, এই বিশ্ববিদ্যালয়টা ছিল বিপ্লবী, সেখানে সবকিছুই ছিল সংস্কৃতি কেন্দ্রিক। এই ভার্সিটিতে থাকার সময় আমি প্রথম ঋত্বিক ঘটকের ছবি দেখেছি, সত্যজিতের ছবি দেখেছি। এখান থেকেই আমার চলচ্চিত্রপ্রেমের সূচনা। জাদবপুরের নিজস্ব চলচ্চিত্র ও মঞ্চ সোসাইটি আছে। আমার প্রথম হাবিব তানভীর দর্শনও সেখানে। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ৫ বছরে অনেক কিছু ঘটেছিল, সেই ঘটনাগুলোই আমার জীবন গড়ে দিয়েছিল।
আমার বাবা ছিলেন প্রামান্য চিত্র নির্মাতা। মূলত তিনি ছিলেন চিত্রকর, পরে প্রামান্য চিত্র বানানো শুরু করেন। আমার মাও চিত্রকর ছিলেন। বাবা তার প্রথম প্রামান্য চিত্র করেছিলেন এক ভাস্করের ওপর যিনি আবার তার শিক্ষক ছিলেন। তখন আমার বয়স ১৪ বছর, বাবার সাথে শ্যুটিং এ যেতাম। তিনি ১৬মিমি হ্যান্ড-ক্র্যাক ক্যামেরা দিয়ে শ্যুটিং এর কাজ চালাতেন। ছবির এডিটিং হতো আমাদের বাসার ডাইনিং টেবিলে, সেদিন আমাদেরকে অন্য কোথাও খেতে হতো। বাবার সাথে বসে শট বাছাই করার কথা এখনও মনে পড়ে। এসবই সিনেমার জগৎটাকে আমার সামনে তুলে ধরে। ছোটবেলায়ই জানতাম, চলচ্চিত্র নির্মাতা হওয়ার জন্য কোন বিশেষ প্রশিক্ষণ লাগে না, বিশেষ কোন যোগ্যতাও লাগে না। ১৪ বছর বয়সেই সিনেমার অনেক কিছু জানতাম। রাশ প্রিন্ট কাকে বলে? সিনেমার সম্পাদনা কিভাবে হয়? ফাইনাল প্রিন্ট কি জিনিস? মিক্সিং কখন করতে হয়? সাউন্ডের লেয়ারগুলো কি কি? কিভাবে সেগুলো মিক্স করতে হয়, কতগুলো ট্র্যাক করা সম্ভব? টেকনিক্যাল সব বিষয় আমার জানা ছিল, কারণ আমাদের বাসায়ই এসব হতো। সিংক সাউন্ড কি? ফোলি সাউন্ড কি? নন-সিংক সাউন্ডই বা কি? এর সবকিছু আমি জানতাম।
একসময় আমি চলচ্চিত্র নির্মাতা হওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু বাবার প্রামান্য চিত্রের বদলে গল্প বলাকে বেছে নেই। প্রামান্য চিত্রটা আমার সাথে ঠিক যেতো না। অনেক সময় বাবাকে সাহায্য
করেছি, স্ক্রিপ্ট নিয়ে একসাথে আলোচনা করেছি। এটা একটা পারিবারিক বিষয়ের মত ছিল। সবাই স্ক্রিপ্ট নিয়ে আলোচনা করতো। আমার মা চিত্রকর ছিলেন, যে ভাস্করের উপর প্রামান্য চিত্র হচ্ছে তাঁকে তিনি চিনতেন। তাই সবাই মিলে ভাল আলোচনা হতো। আমি কিছু পরামর্শ দিতাম, কিন্তু বাবা সেগুলো অধিকাংশ সময়ই গ্রহণ করতেন না। কারণ বাবা চাইতেন হার্ড-কোর ডকুমেন্টারি বানাতে। তার কথা ছিল, what has not happened has not happened. সত্যকে একটুও এদিক-ওদিক করতে চাইতেন না, সত্যের ব্যাঘাতও তিনি সহ্য করতেন না। পরে আমি বুঝেছিলাম, আমার পরামর্শগুলো সত্যকে ইন্টারাপ্ট করার মত, কিন্তু সেগুলো বাবা সত্যের বিকৃতি হিসেবে নিতেন।
বাংলায় “book” এবং “film” এই দুটোর প্রতিশব্দই নাকি এক? আপনার অনেকগুলো সিনেমাও তো উপন্যাস আর ছোটগল্প থেকে করা।
হ্যা, এটা ঠিক। দুটোর প্রতিশব্দই “বই”। কিন্তু আমার যদ্দুর মনে হয়, আমার সবগুলো ছবিই মৌলিক। এটা সত্য যে, রেইনকোট ও’হেনরি থেকে করা আর চোখের বালি তো সরাসরি রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প থেকে করা। কিন্তু যদি দেখে থাকেন তাহলে বুঝবেন, সেগুলোতে আমি অনেক পরিবর্তন এনেছি। রেইনকোট দেখলেই বুঝবেন যে এর সাথে ও’হেনরির “দ্য গিফ্ট অফ ম্যাজাই” এর খুব বেশী মিল নেই। ও’হেনরির গল্প ছিল তিন পৃষ্ঠার, আমার রেইনকোটের সাথে এর তেমন কোন মিল নেই। গল্পের কাহিনী ছিল এরকম: জিম ও ডেলা স্বামী-স্ত্রী। তারা ক্রিসমাস উপলক্ষ্য একে অপরের জন্য উপহার কিনে। ডেলা তার চুলের জন্য সবসময় tortoise-shell চিরুনী চাইতো, তার চুল ছিল অনেক লম্বা ও সুন্দর। জিম সবসময় তার ঘড়ির জন্য একটি সুন্দর চেইন চাইতো। জিম তার ঘড়ি বিক্রি করে চিরুনী কিনে বাসায় এসে দেখে, ডেলা তার চুল বিক্রি করে চেইন কিনে বসে আছে।
আমার প্রথম ছবি একটা উপন্যাস থেকে করা। সেটা ছিল শিশুতোষ। আমার তৃতীয় ছবিও উপন্যাস থেকে করা যে উপন্যাসটা আবার সত্য কাহিনী অবলম্বনে লেখা হয়েছিল। মোট ১১টি ছবি করেছি। রেইনকোট ছিল ১০ম, আর এটা ১১তম। এখন অন্তরমহল ছবির কাজ চলছে। এর মধ্যে আমার মাত্র চারটি ছবি উপন্যাস বা গল্প থেকে করা।
যদ্দুর জানি আপনার প্রায় সব ছবির পরিচালক ও চিত্রনাট্য লেখক আপনি নিজেই। এটা কি সত্যি?
হ্যা, একইসাথে গল্পের লেখকও আমি। সব ছবিতেই আমি নিজে চিত্রনাট্য লিখি। সত্যজিৎ এমনটিই করেছেন, ঋত্বিক অধিকাংশ সময় করতেন, মৃণালও করেন। আমার মনে হয়, চিত্রনাট্যের ভাবগুলো আমার মধ্যে খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসে। অভিনয় করার জন্য যে ধরণের কথোপকথন দরকার সেগুলো খুব দ্রুত মাথায় এসে যায়। আর যখন চিত্রনাট্য লেখার সময়ই আসলে আমি মনে মনে সিনেমার পরিকল্পনা করে ফেলি, তাই সবকিছু খুব সহজ হয়ে যায়।
আপনার অধিকাংশ সিনেমাই তো বাংলায়?
হ্যা, আসলে রেইনকোট ছাড়া আমার বাকি সব সিনেমাই বাংলা। ১১টির মধ্যে ১০ টিই। রেইনকোট আমার একমাত্র হিন্দি ছবি।
কেন? অন্য ভাষায় বেশী সিনেমা বানান না কেন?
কারণ বাংলা আমার মাতৃভাষা এবং কলকাতা অতোটা কসমোপলিটান না। ভারতের শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কসমোপলিটান হল বোম্বে। বোম্বের লোকেরা হিন্দি বলতে পারে না, কারণ তাদের এক শহরে অনেকগুলো সম্প্রদায়ের মানুষ থাকে এবং পারষ্পরিক যোগাযোগের জন্য তারা খুব মিশ্র ধরণের একটি হিন্দিকে বেছে নিয়েছে। তাই বোম্বেতে মাতৃভাষার ধারণাটা পাকপোক্ত না। কিন্তু কলকাতায় বাংলার প্রভাব অনেক বেশী, মাতৃভাষা হিসেবে এর গুরুত্ব অনেক বেশী। এখানে বাংলা সিনেমা সবাই দেখে, এ শহরের সবগুলো লাইব্রেরিতে বাংলা সিনেমা পাওয়া যায়। এর থেকে আমরা আরও একটা বিষয় খুব ভালভাবে বুঝতে পারি: মাতৃভাষায় সিনেমা নির্মাণ করেও আন্তর্জাতিক পরিচালক হওয়া সম্ভব।
তাছাড়া আমি বাংলায় খুব সাচ্ছ্যন্দ বোধ করি। নতুন প্রজন্মের অনেকেই তাদের মাতৃভাষার মূল হারিয়ে ফেলতে বসেছে। কিন্ত��� আমার অবস্থা সেরকম নয়, আমার বাংলার মূল খুব শক্ত। আমি বড়ও হয়েছি পারিবারিক পরিবেশে যেখানে সবার মধ্যে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল। বর্ধিত পরিবারের মধ্যেই আমার বাস। আমার শৈশব খুব উষ্ণ ছিল, সেখানেই আমার মূল, সেখানেই বাংলার সাথে আমার সম্পর্ক।
ভারতে প্যারালাল বা আর্ট সিনেমার যে ট্রেডিশন চলছে আপনি কি নিজেকে তার অংশ মনে করেন?
এই বিষয়ে অনেক বিতর্ক আছে: প্যারালাল সিনেমা বলতে কি বোঝায়? আর্ট সিনেমাই বা কি? এক সময় মানুষ মনে করতো, এ ধরণের বিভাজন থাকা দরকার। সব সিনেমাই মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য তৈরী করা হয় না। এটা সত্যি কথা। কিন্তু মনি কাউল ও কুমার সাহানিরা এসে এতই দুর্বোধ্য সিনেমা বানানো শুরু করলেন যে সেগুলো দেখার মত কোন দর্শকই আর রইল না। তখন নন-ন্যারেটিভ পদ্ধতি সিনেমায় আসতে শুরু করেছে। ভারতের গল্পভাণ্ডারের কোন শেষ নেই। এদেশের নিজস্ব গল্প, উপকথা, রূপকথা আছে। এর নিজস্ব ন্যারেটিভ ট্রেডিশন আছে। তাই হঠাৎ করে নন-ন্যারেটিভ পদ্ধতি কেউ গ্রহণ করেনি। তাই সেই নন-ন্যারেটিভ সিনেমাগুলোকে “আর্ট” সিনেমা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। আগে সবাই সে ধরণের সিনেমা দেখতে যেত। সত্যজিতের ছবি দেখতে কারোই কোন সমস্যা ছিল না। তারা মনে করতো, এগুলোকে “বুদ্ধিবৃত্তিক চলচ্চিত্র” (intellectual film) ডাকা যায়। যে সিনেমায় বুদ্ধিবৃত্তির (intellect) ব্যবহার আছে তাকেই বুদ্ধিবৃত্তিক সিনেমা বলা যেতে পারে। কলকাতায় কিন্তু আমরা কখনোই “আর্ট” বা “প্যারালাল” শব্দটি ব্যবহার করিনি। এ ধরণের সব সিনেমাকে আমরা ইন্টেলেকচুয়াল ছবি বলতাম, এটা কেবল বলার জন্য বলা নয়, সবাই সংজ্ঞা বুঝে তারপরই সেগুলোকে ইন্টেলেকচুয়াল সিনেমা ডাকতো। সুতরাং যে ছবি করতে গিয়ে আপনাকে বুদ্ধিবৃত্তির ব্যবহার করতে হবে, যেটা কেবল মনোরঞ্জনের জন্য নির্মীত হবে না সেটাকেই বুদ্ধিবৃত্তিক ছবির শ্রেণীতে ফেলে দেয়া যায়।
তার মানে এই প্রেক্ষিতে আপনি নিজেকে ভারতের ইন্টেলেকচুয়াল চলচ্চিত্র ধারার অন্তর্ভুক্ত মনে করেন?
হ্যাঁ।
অনেক সমালোচক আপনার চোখের বালির সাথে সত্যজিৎ রায়ের চারুলতার (এটাও রবীন্দ্রনাথের গল্প থেকে করা) মিল দেখিয়েছেন। আপনি কি আপনার এই ছবিকে সত্যজিতের প্রতি ট্রিবিউট হিসেবে আখ্যায়িত করতে চান?
না, আমি তেমনটি বলব না। তবে কিছু অংশ অবশ্যই সত্যজিতের প্রতি ট্রিবিউট ছিল। সবাই চারুলতার থিয়েটার বাইনোকুলার আর দোলনায় দোল খাওয়া মনে রেখেছে এবং তার সাথে আমারটা মিলিয়েছে। কিন্তু চারুলতায় বাইনোকুলার একেবারে ভিন্ন কারণে ব্যবহার করা হয়েছিল। চারুলতায় বাইনোকুলার ব্যবহার করা হয়েছিল উন্মুক্ত বিশ্বের দিকে একটি জানালা হিসেবে, আর চোখের বালিতে ব্যবহার করা হয়েছে ইক্ষণকামের (voyeuristically) জন্য। সেই সময় এবং এই সময়ের মধ্যে বেশ কিছু জিনিস সাধারণ আছে। যেমন ফোর-পোস্টার বিছানা, সব বাংলা সিনেমাতেই এটা ব্যবহার করা হয়েছে। থিয়েটার বাইনোকুলার পরে এসেছে বলে খুব কম সিনেমাতে এর ব্যবহার আছে। কিন্তু আমি সেটা আবার ব্যবহার করেছি।
আমি অবশ্যই এমন কেউ যে সত্যজিৎ ধারায় সিনেমা বানায়। কিন্তু এটাকে আমি অস্বীকার করার চেষ্টা করি না, বরং এতে আমি খুব খুশী; আমি মনে করি বাচ্চা-কাচ্চাদের দেখতে বাবা-মার মতোই হওয়া উচিত [হাসি]। আমি অবশ্যই সত্যজিতের উত্তরসূরি, তাঁর সিনেমার মধ্যেই আমরা বেড়ে উঠেছি।
সত্যজিতের সাথে আমার পার্থক্যগুলো এরকম: প্রথমত, চোখের বালি রঙিন, চারুলতা রঙিন না। চারুলতার জন্য সত্যজিৎ কোন ধরণের রং বেছে নিতেন আমি জানি না। তবে চোখের বালিতে রং এর বিষয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। the whole copperish tint with the red- এর ভূমিকা এখানে খুব বেশী। চারুলতায় কোন ধরণের রং ব্যবহার করা হতো তা আমরা জানি না। রবীন্দ্রনাথের একটি উপন্যাস থেকে সত্যজিৎ সিনেমা করেছেন যার নাম “ঘরে-বাইরে”। সিনেমা বা অ্যাসথেটিক পিস হিসেবে ঘরে-বাইরে একটি কমপ্লিট ডিজাস্টার। দেখা যায়, সমালোচকরা সব সময়ই চারুলতার সাথে তুলনা দেন, ঘরে-বাইরের কথা উল্লেখই করেন না। ঘরে-বাইরে উপন্যাসটি খুব গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এ থেকে সত্যজিৎ যে সিনেমা বানিয়েছেন তা তার ভাল কাজগুলোর মধ্যে পড়ে না। আর চারুলতা আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে ত্রুটিহীন সিনেমাগুলোর একটি।
আবেগের দিক দিয়ে চারুলতায় যে নিয়ন্ত্রণ দেখানো হয়েছে তার কোন তুলনা হয় না। শুধু আবেগ না, যেকোন দিক দিয়েই এর নিয়ন্ত্রণটা অনন্যসাধারণ। এখানে বাঙালি সংস্কৃতির অ-হিন্দু অংশকে দেখানো হয়েছে। ব্রাহ্ম ধর্ম নামে একটি ধর্ম ছিল যাতে মূর্তিপূজা ছিল না। চারুলতার কনটেক্সট এবং সমসাময়িকতা এই ব্রাহ্ম যুগের। সে যুগে সব আলোকিত ব্যক্তিই ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, বুদ্ধিজীবী এবং সাধারণভাবে সব অজ্ঞেয়বাদীরাও এই ধর্মে যোগ দিয়েছিলেন। অপরদিকে চোখের বালির প্রেক্ষিত হল অভিজাত গোঁড়া হিন্দু পরিবার। এ ধরণের পরিবারের সব দোষত্রুটি আর একঘেয়ে জীবনাচার এতে ফুটে উঠেছে। যেমন, ব্রাহ্ম সমাজে বিধবাদের অবস্থা এত খারাপ ছিল না। কিন্তু গোঁড়া হিন্দুদের মধ্যে সেটা প্রকট ছিল। এটাকে আমি চারুলতার সাথে চোখের বালির আরেকটা পার্থক্য বলব।
আপনার চোখের বালি শুরু হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি উক্তি দিয়ে যেখানে তিনি উপন্যাসের শেষটা সম্পর্কে নিজের অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন: “Ever since Chokher Bali was published, I have always regretted the ending. I ought to be censured for it” আপনি রবীন্দ্রনাথের এই উক্তিকে কিভাবে দেখেন, আর আপনার সিনেমায় কি কোনভাবে এই বিষয়টা নিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন?
হ্যাঁ, কারণ সিনেমার শেষটা উপন্যাস থেকে একেবারেই আলাদা। উপন্যাসে সমাপ্তিটা বেশ হাস্যকর: হঠাৎ করেই সবাই সুখী-সুখী হয়ে যায়, পরিবারটাকে খুব ভাল মনে হতে থাকে এবং তারা দুজনেই বিনোদিনীর পা ছুঁয়ে প্রণাম করে। দুই পুরুষ মহেন্দ্র ও বিহারী বলে, “ভাবী, আমাকে ক্ষমা করে দাও, আমার ভুল হয়েছে।” সেও তাদের ক্ষমা করে দেয়। এরপর সে বেনারসে গিয়ে তপস্বীর মত জীবনযাপন শুরু করে। সব সাধ-আহ্লাদ ত্যাগ করে, কারণ বিধবাদের সেভাবেই থাকা উচিত।
দেখুন, এটা এক ধরণের serialized উপন্যাস। ঠাকুর শুরু করেছিলেন বিধবার নিষিদ্ধ আবেগ দিয়ে। এর কারণ হিসেবে পাঠকপ্রিয়তা বাড়ানোর কথা আসতে পারে, কারণ ঠাকুর নিজে সাময়িকীটি সম্পাদনা করছিলেন, তার পাঠকের প্রয়োজন ছিল। উপন্যাসটা অর্ধেকের মত লেখার পরই খানিকটা প্রকাশিত হয়ে পড়ে এবং সব ব্রাহ্মরা মিলে তাকে রীতিমত ভর্তসনা করতে শুরু করে। ঠাকুর নিজে হিন্দু ছিলেন না, ছিলেন ব্রাহ্ম যা নিয়ে আমি একটু আগেই বলেছি। তো ঠাকুর হিন্দুদের আবেগকে খুব বেশী নাড়াতে চাননি। এজন্যই বিনোদিনীকে সমাজের চিরন্তন নিয়মের কাছে আত্মসমর্পণ করান। কিন্তু মৃত্যুর দুই মাস আগে যখন হারাবার কিছুই ছিল না তখন তিনি আক্ষেপ করেছিলেন এই বলে যে, “আমি এটা কেন করেছিলাম? আমার পাঠকদেরও সন্তুষ্ট করতে পারিনি নিজেকেও সন্তুষ্ট করতে পারেনি, তাহলে কেন করেছিলাম?” এ নিয়ে একটা ভাল সমালোচনাও হয়েছিল: বিনোদিনীকে যদি শেষে আজীবন নির্বাসনেই পাঠাবেন তবে তাকে দিয়ে কেন নিষিদ্ধ কাজ করালেন, কেন তার মধ্যে এত কামনার জন্ম দিলেন? এই সমালোচনা রবীন্দ্রনাথকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। রবীন্দ্রনাথ হয়ত বিনোদিনীকে এমনই করতে চেয়েছিলেন: তার মধ্যে আরও জীবনীশক্তি দিতে চেয়েছিলেন, আরও কামনা ও জীবনের প্রতি আরও ভালবাসা ভরে দিতে চেয়েছিলেন। হয়ত তার জীবনের পুরো চাহিদাটাকে পরিতৃপ্ত করতে চেয়েছিলেন। মৃত্যুর মাত্র দুই মাস আগে ঠাকুর এটা প্রকাশ করেছেন। তিনি লিখেছিলেন: “I need to be seriously criticized for it, I deserve this criticism. I should be punished for it.”
আজকেও উপন্যাস পড়লে বোঝা যায়, এই উপন্যাসের এমন সমাপ্তি হতে পারে না। অনেক পাঠক চেয়েছিলেন বিনোদিনীর সাথে বিহারীর বিয়ে হোক। আমি মনে করি, আজ থেকে ৩০ বছর আগে হলে বি
নোদিনীর সাথে বিহারীর বিয়ের মাধ্যমে সমাপ্তি দেয়া যেতো। কারণ তখন বিধবা বিয়েকে উৎসাহিত করা হচ্ছিল, এ নিয়ে রীতিমত প্রচার চলছিল। সবাই তখন মনে করতো, আরেকটি বিয়ে হলে সে আবার জীবন শুরু করতে পারবে। কিন্তু আজকের অবস্থা ভিন্ন। এখন নারীর জীবন চালানোর জন্য কোন পুরুষের শেষ নাম, উপাধি বা কোন ধরণের সাহায্যের প্রয়োজন হয় না। বিনোদিনী আগে বিয়ে করেছে এবং বিয়ে তাকে কিছুই দেয়নি, এতে তার কোন সাহায্য হয়নি। একা থাকাটাই তাকে সবচেয়ে বেশী সাহায্য করেছে। তার অর্জন, তার শক্তি, তার হেঁয়ালিই তার সবচেয়ে বড় সহায়। সুতরাং তার পক্ষে একা থাকার শক্তি অর্জন করা সম্ভব।
পরবর্তীতে চলে যাওয়ার সময় সে তার নিজের “দেশ” এর কথা লিখে। এখানে দেশ বলতে স্থায়ী ঠিকানা বোঝায় না, দেশ বলতে “স্থান” বা ডোমেইন বোঝানো হয়েছে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলন আর বিনোদিনীর জীবনের ঘটনাগুলো একসাথে ঘটছে, কিন্তু সেই স্বাধীনতা আন্দোলনে আবার নারীর কোন স্থান নেই। সুতরাং নারীর কোন নিজস্ব দেশ নেই, সে যেমন তার স্বামীর নাম বহন করে তেমনি স্বামীর দেশই তার দেশ, স্বামী যে দেশের সেও সেই দেশের। কিন্তু একজন নারীর নিজস্ব দেশ থাকতে পারে। নারীর কোন নির্দিষ্ট দেশ বা কোন নির্দিষ্ট পরিচয়ে আবদ্ধ হয়ে যাওয়া উচিত না। পুরুষ কখনও তার পরিচয় পরিবর্তন করতে পারে না, কিন্তু নারী পারে। একজন স্বাধীন নারীর জন্য আমি তাই একে “দেশ” হিসেবে আখ্যায়িত করব। সিনেমার শেষে গিয়ে বিনোদিনী এই “দেশ” এর কথাই বলে।
তার মানে আপনার সমাপ্তিটা মুক্তি এনে দিয়েছে, মুক্তির ভাব জাগ্রত করেছে?
হ্যাঁ, আমি তাই ভেবেছিলাম। আমি অবশ্যই কোন সুনির্দিষ্ট সমাপ্তি দিতে চাইনি। ন্যারেটিভ দিক দিয়ে সবকিছুর সমাধান দিয়ে দেইনি। রেইনকোট আর চোখের বালি দুটো সিনেমার সঙ্গীতই চমৎকার। গুলজারকে দিয়ে গানের লিরিক লিখিয়েছেন।
না, রেইনকোটের সব গানের লিরিক আমিই লিখেছি, শুধু বিয়ের দুটো গান বাদে। Mathura nagarpati kahay tum gokoli jao, Piya tora kaisa abhiman এবং Akele hum nadiya kinare- এই তিনটি গানের লিরিকই আমার নিজের। এই গানগুলো কিন্তু হিন্দি না, আমি হিন্দি জানি না। এগুলো মৈথিলী, যা একটা মিশ্র ভাষা। সংস্কৃত, খানিকটা হিন্দি এবং ব্রজভাষা মিলে মৈথিলী হয়েছে।
সঙ্গীত ও কবিতার কোন ধারাটির সাথে আপনার পরিচয় হয়েছে?
আমি অনেক কবিতা পড়েছি। অবশ্য, বাঙালিদের জন্য কবিতা পড়া একটা ফ্যাশনের মতো, সবাই পড়ে। সেখানে কবিতা পড়া শুরু হয় Lorca দিয়ে, এরপর আসে বামপন্থী কবিদের কবিতা। অ্যালেন গিন্সবার্গের নাম করতে হয়। তিনি কলকাতায় ছিলেন, ইংরেজিতে লিখলেও তার কবিতা দিয়ে অনেকে প্রভাবিত হয়। তারপর অবশ্যই ইলিয়াডের নাম করতে হয়। বাংলা ভাষায়ও আমাদের অনেক প্রখ্যাত কবি আছেন, তাদের কারও কবিতাই বাদ যায় না। মাও সেতুং এর কবিতাও সবাই পছন্দ করে। সুতরাং কলকাতায় কাব্য রুচির কোন নির্দিষ্ট ধারা নেই, মিশ্র।
সঙ্গীতের কথা বললে প্রথমেই আসবে পশ্চিমা ধ্রুপদী সঙ্গীতের কথা। কারণ ব্রিটিশ রাজত্বের প্রথম রাজধানী হওয়ার সুবাদে কলকাতায় সঙ্গীতের এই ধারাটি খুব প্রভাব বিস্তার করেছে। কলকাতার পুরাতন অভিজাত এলাকায় গেলে আপনি long-playing রেকর্ড, high-brow সঙ্গীত শুনতে পাবেন। এটাই সেখানকার ট্রেডিশন। বিখ্যাত পশ্চিমা ধারার সঙ্গীতজ্ঞরা সবাই কলকাতার, প্রথম দিককার চেলো ও বেহালা বাদকরা সবাই কলকাতার। কলকাতা থেকেই ধীরে ধীরে তা বোম্বেতে গেছে। রবীন্দ্রনাথ নিজেও পশ্চিমা সঙ্গীতের ট্রেডিশনে বড় হয়েছেন, পরবর্তীতে এই সঙ্গীতকেই নিজের স্বতন্ত্র ট্রেডিশনে রূপান্তরিত করেছেন। তার গানের গভীরে গেলে পশ্চিমা ধ্রুপদী সঙ্গীতের অনেক উপাদান পাওয়া যায়। চোখের বালির সব গানই রবীন্দ্রনাথ থেকে নেয়া হয়েছে; এগুলো প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথের ইন্টারল্যড। চোখের বালিতেই সেই ধারার সঙ্গীতের বিশালত্ব বোঝা যা���, এর কথা ও গভীরতা স্পষ্ট হয়ে পড়ে, আর গভীরে গেলে পশ্চিমা ধ্রুপদী সঙ্গীতের প্রভাবটাও ধরা পড়ে।
আর আমি মনে করি, চোখের বালির ধ্রুপদী মান তার সঙ্গীতের কারণেই প্রকট হয়ে উঠেছে। যারা রবীন্দ্রনাথ পড়েননি তারা এই বিষয়টা ধরতে পারেন না: তিনি চোখের বালির এই চারটি চরিত্র নিয়েই একটা অপেরা লিখেছিলেন যা প্রায় একই রকম। এই অপেরাই সিনেমাটির মিউজিক্যাল টেক্সট গঠন করেছে। যেমন টাইটেল মিউজিকটা হুবহু সেই অপেরা থেকে নেয়া হয়েছে। এতে চারটি নারী-পুরুষ প্রায় উচ্চমার্গীয় একদল সঙ্গীতজ্ঞের সাথে মিলে এক ভালবাসার খেলায় মেতে উঠেছে, অনেকটা Midsummer Night’s Dream এর মত। কিংবা ওরাকলের মত, গ্রিক কোরাসের মত, যেখানে সবাই আবেগকে গানে রূপান্তরিত করছে এবং এর মাধ্যমেই নিজেদের কাজগুলো সচক্ষে দেখতে পাচ্ছে। এই গ্রিক ট্রেডিশনে কিন্তু চরিত্রগুলো মঞ্চে এসে প্রথমেই পুরো কাহিনীটা বলে দেয়, এরপর কি কি ঘটবে তাও বলে দেয়।
চোখের বালিতে আসলে আমি সঙ্গীতের সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছি, কারণ এতে তার প্রয়োজন ছিল। আমার অন্য ছবিগুলোতে কিন্তু সঙ্গীতের এত ব্যবহার নেই। যেমন রেইনকোটে ভারতের স্বদেশী খেদসূচক সঙ্গীত ব্যবহার করা হয়েছে। সেই ছবি করতে গিয়ে আমরা ইচ্ছে করেই তেমন গান বেছে নিয়েছি, কারণ তার গল্প ছিল সাধারণ এবং সঙ্গীতেও তার প্রতিফলন থাকা উচিত ছিল।
আপনি রায় এবং ঘটকের কথা বলেছেন। কিন্তু আর কোন কোন চলচ্চিত্র নির্মাতা দ্বারা আপনি প্রভাবিত হয়েছেন?
নিঃসন্দেহে বারিমান (Ingmar Bergman)। এরপরেই আসবে কিয়েশলফস্কি। Bille August (Pelle the Conqueror, The Best Intentions), তার ছবি আমার খুবই ভাল লাগে। কোয়েন্টিন ট্যারান্টিনো, আমি তার মত সিনেমা বানাতে চাই না, কিন্তু সে আমাকে মুগ্ধ করে। গডফাদারকে সর্বকালের অন্যতম সেরা সিনেমা মনে করি। আব্বাস কিয়ারোস্তামি, আমি কিয়ারোস্তামির পরেই জাফর পানাহি ও মোহসেন মাখমালবফের সিনেমা পছন্দ করি। অনেক সময় ওং কার-ওয়াই ও পেদ্রো আলমোদোবার আমার ফেভারিট হয়ে উঠে, তাদের ছবি অনেক সময়ই আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে দেয়। বিশ্ব চলচ্চিত্রের আরেকটি সেরা ছবির নাম “লাইক ওয়াটার ফর চকোলেট”, আলফোনসো আরাউ এর। কিন্তু আরাউ এর পর আর কোন উল্লেখযোগ্য সিনেমা করেননি।
এখন কি নিয়ে কাজ করছেন?
অনেক কিছু নিয়েই। কিন্তু আমি বিশেষ করে মহাভারত নিয়ে কিছু করার চেষ্টা করছি। আর আমি মনে করি এখনই এ নিয়ে করা প্রয়োজন, কারণ অনেক সময়ই একে ধর্মীয় গ্রন্থ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে যা সত্যি নয়। এটা মহাকাব্য। এর দিকেই আমার ঝোঁক সবচেয়ে বেশী।
তো এই গ্রেট সত্যজিৎ রায়ের একটা সাক্ষাৎকার অনুবাদ করব করব করেও করতে পারছিলাম না। কারণ, সেটা অনেক বড়। এরই মধ্যে ঋতুপর্ণ ঘোষের অনেকগুলো সিনেমা দেখা হয়ে গেল। বুঝলাম, কাউকে সত্যজিতের রায়ের উত্তরসূরি বলতে হলে এই ঋতুপর্ণকেই বলতে হবে। সত্যজিতের উত্তরসূরির পাশাপাশি তার আরেকটা বড় পরিচয় হচ্ছে, তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের সাথে মাস্টার অফ সিনেমা ইংমার বারিমানের সিনেমার সফল সমন্বয় ঘটিয়েছেন। নেটে খুঁজতে খুঁজতে ঋতুপর্ণ ঘোষের একটা সাক্ষাৎকার পেয়ে গেলাম। আশার কথা হল, এটার দৈর্ঘ্য সত্যজিতের সাক্ষাৎকারের তুলনায় অনেক কম। আর ঋতুপর্ণ ঘোষের কথায় কলকাতার সংস্কৃতি এবং বাংলা চলচ্চিত্রের বেশ কিছু বিষয় উঠে এসেছে। তাই অনুবাদে হাত দিয়ে দিলাম। পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, এটা ভাবানুবাদ। সাক্ষাৎকারের ভাবানুবাদ করা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত জানি না। আমার কাছে এটাকেই সঠিক মনে হয়েছে। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন: AsiaSource এর Nermeen Shaikh
স্থান-কাল: ঋতুপর্ণের “চোখের বালি” ২০০৩ সালের Locarno International Film Festival এ Golden Leopard পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়। ২০০৫ সালের ৯ই এপ্রিল ৩য় বার্ষিক South Asia Human Rights Film Festival উপলক্ষ্যে এশিয়া সোসাইটি সিনেমাটি প্রদর্শনের আয়োজন করে। প্রদর্শন উপলক্ষ্যে ঋতুপর্ণ নিউ ইয়র্কে গিয়েছিলেন। সে সময়ই এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করা হয়।
আপনি যে ধরণের সিনেমা করেন তার পেছনে কলকাতার সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবেশে আপনার বেড়ে ওঠার প্রভাব কতটুকু বলে মনে করেন?
আমার চলচ্চিত্র জীবন শুধু নয় ব্যক্তি হিসেবে আমার বর্তমান অবস্থানের উপর কলকাতার বিশাল প্রভাব আছে। আমি কিন্তু এখানে প্রভাব হিসেবে কলকাতার নাম করছি, বাংলার নয়; আর এই দুয়ের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য আছে। কলকাতার কথা আসলেই আমাদের মুখে দুটো নাম চলে আসে: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সত্যজিৎ রায়। কিন্তু বাংলা মানে কেবল রবীন্দ্রনাথ আর সত্যজিৎ না, আরও অনেক কিছু। বাংলা এমন এক প্রদেশ যা দেশভঙ্গের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছে। ভারতের অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ অনেক প্রগতিশীল, তাই সেখানে থাকতে পেরে আমি গর্বিত। দেশজুড়ে যে মৌলবাদের উত্থান ঘটেছে মুম্বাই তার দ্বারা আক্রান্ত হলেও কলকাতায় তার কোন প্রভাব পড়েনি।
অনেক আগে কলকাতা ছিল ভারতের রাজধানী। এ কারণে প্রয়োজনীয় সব ধরণের অবকাঠামোই এখানে আছে। জ্ঞানের বিচরণ ক্ষেত্র হিসেবেও কলকাতার জুড়ি নেই। এখানে আছে: National Library যা এশিয়ার বৃহত্তম। আছে এশিয়াটিক সোসাইটি। এছাড়া প্রচুর বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্থা আছে এখানে। আপনি যদি গুরুতর কোন বিষয়ে গবেষণা করতে চান এবং এর জন্য বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টি আকর্ষণের প্রয়জন পড়ে তাহলে আপনার জন্য কলকাতার চেয়ে ভাল কোন স্থান বাংলায় নেই।
এর পাশাপাশি আবার কলকাতা বর্ধিষ্ণু শহর না। এটা খুব সাধারণ, এখানে আপনি সব ধরণের লোকের সাথেই মেশার সুযোগ পাবেন। একে আমলাতান্ত্রিক শহর বলা যায় না, আবার ক্লিনিক্যাল সিটিও বলা যায় না। এখানে থাকলে এক ধরণের উষ্ণতা ও স্পন্দন অনুভব করা যায়, অনেকটা নিউ ইয়র্কের মত। লন্ডনের কিছু জায়গাও আমাকে কলকাতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তবে এটা অবশ্যই ব্যস্ত শহর। রাস্তায় সব সময়ই পথচারীদের ভীড় লেগে আছে, একে অন্যের উপর আছড়ে পড়ছে, কেউ কেউ রাগান্বিত হ� ��ে ওভার-রিঅ্যাক্ট করে ফেলছে। এখানে সবাই একটু উত্তেজিত। কলকাতার মানুষেরা যখন সুখে থাকে তখনও উন্মাদের মত আচরণ করে আবার যখন রাগান্বিত থাকে তখনও উন্মাদের মত আচরণ করে। বাংলায় যা আছে তার সবই কলকাতায় দেখতে পাওয়া যায়, তবে সবকিছুই এখানে একটু পরিশোধিত এবং ফিল্টার করা। এজন্যই শহরটা এত মজাদার।
বেড়ে ওঠার সময় কলকাতার সাংস্কৃতিক জীবনের সাথে আপনি নিজেকে কিভাবে এবং কতটা জড়িয়েছেন?
আমি বেড়ে উঠেছি কলকাতার বামপন্থী সংস্কৃতির মাঝে। আর ভারতের বাকি অংশের নেতৃত্বের আসনে ছিল ডানপন্থীরা। আমার যখন বোঝার বয়স হয়েছে (৭০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে শেষ পর্যন্ত) তখন থেকেই দেখে আসছি, কলকাতা বামপন্থী শহর। আমি ৩০ বছর আগের কথা বলছি। সে সময় আমরা বেশী কিছু জানতাম না। এখন তো মানুষ সবকিছুর সাথে খুব দ্রুত পরিচিত হয়ে পড়ে, অল্প বয়সেই তার চোখে অনেক কিছু ধরা পড়ে। আমি যখন স্কুল শেষ করছি, তখন কলকাতায় মাত্র টেলিভিশন এসেছে। সুতরাং রাজনীতি নিয়ে যখন থেকে ভাবতে শুরু করেছি তখন থেকেই কলকাতায় বামপন্থীদের রাজত্ব। এখানে বাম রাজনীতি অনেক ফ্যাশনের মত। জটিলতাগুলো চিন্তা না করেই এখানকার মানুষ বামপন্থী হয়ে যায়। ভার্সিটিতে অর্থনীতি পড়ার সময় আমি কার্ল মার্ক্স পড়েছি এবং এ নিয়ে আমার একটা বিশেষ গবেষণাপত্রও তৈরী করতে হয়েছিল।
তারপরও ঘুরেফিরে আবার সে কথায় আসতে হয়, কলকাতা অবশ্যই সত্যজিতের শহর। আমি যে ভার্সিটিতে পড়েছি সেখানে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কোন শেষ ছিল না। আমার দুঃখ হয়, কেন অর্থনীতি নিয়ে পড়েছিলাম। এটা আমার কোনই কাজে আসেনি। এর সাথে সংশ্লিষ্ট কোন পেশায়ও আমি যোগ দেইনি। এর চেয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বা ইতিহাস বা এ ধরণের কিছু পড়লে অনেক ভাল হতো। তারপরও আজ যখন পেছন ফিরে তাকাই তখন সামগ্রিকভাবে আমার ভার্সিটি জীবন নিয়ে কোন দুঃখ হয় না। কারণ সে জীবনে অনেক কিছুর সাথে পরিচয় হয়েছিল। জাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি ৫ বছর কাটিয়েছি, এই বিশ্ববিদ্যালয়টা ছিল বিপ্লবী, সেখানে সবকিছুই ছিল সংস্কৃতি কেন্দ্রিক। এই ভার্সিটিতে থাকার সময় আমি প্রথম ঋত্বিক ঘটকের ছবি দেখেছি, সত্যজিতের ছবি দেখেছি। এখান থেকেই আমার চলচ্চিত্রপ্রেমের সূচনা। জাদবপুরের নিজস্ব চলচ্চিত্র ও মঞ্চ সোসাইটি আছে। আমার প্রথম হাবিব তানভীর দর্শনও সেখানে। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ৫ বছরে অনেক কিছু ঘটেছিল, সেই ঘটনাগুলোই আমার জীবন গড়ে দিয়েছিল।
আমার বাবা ছিলেন প্রামান্য চিত্র নির্মাতা। মূলত তিনি ছিলেন চিত্রকর, পরে প্রামান্য চিত্র বানানো শুরু করেন। আমার মাও চিত্রকর ছিলেন। বাবা তার প্রথম প্রামান্য চিত্র করেছিলেন এক ভাস্করের ওপর যিনি আবার তার শিক্ষক ছিলেন। তখন আমার বয়স ১৪ বছর, বাবার সাথে শ্যুটিং এ যেতাম। তিনি ১৬মিমি হ্যান্ড-ক্র্যাক ক্যামেরা দিয়ে শ্যুটিং এর কাজ চালাতেন। ছবির এডিটিং হতো আমাদের বাসার ডাইনিং টেবিলে, সেদিন আমাদেরকে অন্য কোথাও খেতে হতো। বাবার সাথে বসে শট বাছাই করার কথা এখনও মনে পড়ে। এসবই সিনেমার জগৎটাকে আমার সামনে তুলে ধরে। ছোটবেলায়ই জানতাম, চলচ্চিত্র নির্মাতা হওয়ার জন্য কোন বিশেষ প্রশিক্ষণ লাগে না, বিশেষ কোন যোগ্যতাও লাগে না। ১৪ বছর বয়সেই সিনেমার অনেক কিছু জানতাম। রাশ প্রিন্ট কাকে বলে? সিনেমার সম্পাদনা কিভাবে হয়? ফাইনাল প্রিন্ট কি জিনিস? মিক্সিং কখন করতে হয়? সাউন্ডের লেয়ারগুলো কি কি? কিভাবে সেগুলো মিক্স করতে হয়, কতগুলো ট্র্যাক করা সম্ভব? টেকনিক্যাল সব বিষয় আমার জানা ছিল, কারণ আমাদের বাসায়ই এসব হতো। সিংক সাউন্ড কি? ফোলি সাউন্ড কি? নন-সিংক সাউন্ডই বা কি? এর সবকিছু আমি জানতাম।
একসময় আমি চলচ্চিত্র নির্মাতা হওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু বাবার প্রামান্য চিত্রের বদলে গল্প বলাকে বেছে নেই। প্রামান্য চিত্রটা আমার সাথে ঠিক যেতো না। অনেক সময় বাবাকে সাহায্য
করেছি, স্ক্রিপ্ট নিয়ে একসাথে আলোচনা করেছি। এটা একটা পারিবারিক বিষয়ের মত ছিল। সবাই স্ক্রিপ্ট নিয়ে আলোচনা করতো। আমার মা চিত্রকর ছিলেন, যে ভাস্করের উপর প্রামান্য চিত্র হচ্ছে তাঁকে তিনি চিনতেন। তাই সবাই মিলে ভাল আলোচনা হতো। আমি কিছু পরামর্শ দিতাম, কিন্তু বাবা সেগুলো অধিকাংশ সময়ই গ্রহণ করতেন না। কারণ বাবা চাইতেন হার্ড-কোর ডকুমেন্টারি বানাতে। তার কথা ছিল, what has not happened has not happened. সত্যকে একটুও এদিক-ওদিক করতে চাইতেন না, সত্যের ব্যাঘাতও তিনি সহ্য করতেন না। পরে আমি বুঝেছিলাম, আমার পরামর্শগুলো সত্যকে ইন্টারাপ্ট করার মত, কিন্তু সেগুলো বাবা সত্যের বিকৃতি হিসেবে নিতেন।
বাংলায় “book” এবং “film” এই দুটোর প্রতিশব্দই নাকি এক? আপনার অনেকগুলো সিনেমাও তো উপন্যাস আর ছোটগল্প থেকে করা।
হ্যা, এটা ঠিক। দুটোর প্রতিশব্দই “বই”। কিন্তু আমার যদ্দুর মনে হয়, আমার সবগুলো ছবিই মৌলিক। এটা সত্য যে, রেইনকোট ও’হেনরি থেকে করা আর চোখের বালি তো সরাসরি রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প থেকে করা। কিন্তু যদি দেখে থাকেন তাহলে বুঝবেন, সেগুলোতে আমি অনেক পরিবর্তন এনেছি। রেইনকোট দেখলেই বুঝবেন যে এর সাথে ও’হেনরির “দ্য গিফ্ট অফ ম্যাজাই” এর খুব বেশী মিল নেই। ও’হেনরির গল্প ছিল তিন পৃষ্ঠার, আমার রেইনকোটের সাথে এর তেমন কোন মিল নেই। গল্পের কাহিনী ছিল এরকম: জিম ও ডেলা স্বামী-স্ত্রী। তারা ক্রিসমাস উপলক্ষ্য একে অপরের জন্য উপহার কিনে। ডেলা তার চুলের জন্য সবসময় tortoise-shell চিরুনী চাইতো, তার চুল ছিল অনেক লম্বা ও সুন্দর। জিম সবসময় তার ঘড়ির জন্য একটি সুন্দর চেইন চাইতো। জিম তার ঘড়ি বিক্রি করে চিরুনী কিনে বাসায় এসে দেখে, ডেলা তার চুল বিক্রি করে চেইন কিনে বসে আছে।
আমার প্রথম ছবি একটা উপন্যাস থেকে করা। সেটা ছিল শিশুতোষ। আমার তৃতীয় ছবিও উপন্যাস থেকে করা যে উপন্যাসটা আবার সত্য কাহিনী অবলম্বনে লেখা হয়েছিল। মোট ১১টি ছবি করেছি। রেইনকোট ছিল ১০ম, আর এটা ১১তম। এখন অন্তরমহল ছবির কাজ চলছে। এর মধ্যে আমার মাত্র চারটি ছবি উপন্যাস বা গল্প থেকে করা।
যদ্দুর জানি আপনার প্রায় সব ছবির পরিচালক ও চিত্রনাট্য লেখক আপনি নিজেই। এটা কি সত্যি?
হ্যা, একইসাথে গল্পের লেখকও আমি। সব ছবিতেই আমি নিজে চিত্রনাট্য লিখি। সত্যজিৎ এমনটিই করেছেন, ঋত্বিক অধিকাংশ সময় করতেন, মৃণালও করেন। আমার মনে হয়, চিত্রনাট্যের ভাবগুলো আমার মধ্যে খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসে। অভিনয় করার জন্য যে ধরণের কথোপকথন দরকার সেগুলো খুব দ্রুত মাথায় এসে যায়। আর যখন চিত্রনাট্য লেখার সময়ই আসলে আমি মনে মনে সিনেমার পরিকল্পনা করে ফেলি, তাই সবকিছু খুব সহজ হয়ে যায়।
আপনার অধিকাংশ সিনেমাই তো বাংলায়?
হ্যা, আসলে রেইনকোট ছাড়া আমার বাকি সব সিনেমাই বাংলা। ১১টির মধ্যে ১০ টিই। রেইনকোট আমার একমাত্র হিন্দি ছবি।
কেন? অন্য ভাষায় বেশী সিনেমা বানান না কেন?
কারণ বাংলা আমার মাতৃভাষা এবং কলকাতা অতোটা কসমোপলিটান না। ভারতের শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কসমোপলিটান হল বোম্বে। বোম্বের লোকেরা হিন্দি বলতে পারে না, কারণ তাদের এক শহরে অনেকগুলো সম্প্রদায়ের মানুষ থাকে এবং পারষ্পরিক যোগাযোগের জন্য তারা খুব মিশ্র ধরণের একটি হিন্দিকে বেছে নিয়েছে। তাই বোম্বেতে মাতৃভাষার ধারণাটা পাকপোক্ত না। কিন্তু কলকাতায় বাংলার প্রভাব অনেক বেশী, মাতৃভাষা হিসেবে এর গুরুত্ব অনেক বেশী। এখানে বাংলা সিনেমা সবাই দেখে, এ শহরের সবগুলো লাইব্রেরিতে বাংলা সিনেমা পাওয়া যায়। এর থেকে আমরা আরও একটা বিষয় খুব ভালভাবে বুঝতে পারি: মাতৃভাষায় সিনেমা নির্মাণ করেও আন্তর্জাতিক পরিচালক হওয়া সম্ভব।
তাছাড়া আমি বাংলায় খুব সাচ্ছ্যন্দ বোধ করি। নতুন প্রজন্মের অনেকেই তাদের মাতৃভাষার মূল হারিয়ে ফেলতে বসেছে। কিন্ত��� আমার অবস্থা সেরকম নয়, আমার বাংলার মূল খুব শক্ত। আমি বড়ও হয়েছি পারিবারিক পরিবেশে যেখানে সবার মধ্যে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল। বর্ধিত পরিবারের মধ্যেই আমার বাস। আমার শৈশব খুব উষ্ণ ছিল, সেখানেই আমার মূল, সেখানেই বাংলার সাথে আমার সম্পর্ক।
ভারতে প্যারালাল বা আর্ট সিনেমার যে ট্রেডিশন চলছে আপনি কি নিজেকে তার অংশ মনে করেন?
এই বিষয়ে অনেক বিতর্ক আছে: প্যারালাল সিনেমা বলতে কি বোঝায়? আর্ট সিনেমাই বা কি? এক সময় মানুষ মনে করতো, এ ধরণের বিভাজন থাকা দরকার। সব সিনেমাই মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য তৈরী করা হয় না। এটা সত্যি কথা। কিন্তু মনি কাউল ও কুমার সাহানিরা এসে এতই দুর্বোধ্য সিনেমা বানানো শুরু করলেন যে সেগুলো দেখার মত কোন দর্শকই আর রইল না। তখন নন-ন্যারেটিভ পদ্ধতি সিনেমায় আসতে শুরু করেছে। ভারতের গল্পভাণ্ডারের কোন শেষ নেই। এদেশের নিজস্ব গল্প, উপকথা, রূপকথা আছে। এর নিজস্ব ন্যারেটিভ ট্রেডিশন আছে। তাই হঠাৎ করে নন-ন্যারেটিভ পদ্ধতি কেউ গ্রহণ করেনি। তাই সেই নন-ন্যারেটিভ সিনেমাগুলোকে “আর্ট” সিনেমা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। আগে সবাই সে ধরণের সিনেমা দেখতে যেত। সত্যজিতের ছবি দেখতে কারোই কোন সমস্যা ছিল না। তারা মনে করতো, এগুলোকে “বুদ্ধিবৃত্তিক চলচ্চিত্র” (intellectual film) ডাকা যায়। যে সিনেমায় বুদ্ধিবৃত্তির (intellect) ব্যবহার আছে তাকেই বুদ্ধিবৃত্তিক সিনেমা বলা যেতে পারে। কলকাতায় কিন্তু আমরা কখনোই “আর্ট” বা “প্যারালাল” শব্দটি ব্যবহার করিনি। এ ধরণের সব সিনেমাকে আমরা ইন্টেলেকচুয়াল ছবি বলতাম, এটা কেবল বলার জন্য বলা নয়, সবাই সংজ্ঞা বুঝে তারপরই সেগুলোকে ইন্টেলেকচুয়াল সিনেমা ডাকতো। সুতরাং যে ছবি করতে গিয়ে আপনাকে বুদ্ধিবৃত্তির ব্যবহার করতে হবে, যেটা কেবল মনোরঞ্জনের জন্য নির্মীত হবে না সেটাকেই বুদ্ধিবৃত্তিক ছবির শ্রেণীতে ফেলে দেয়া যায়।
তার মানে এই প্রেক্ষিতে আপনি নিজেকে ভারতের ইন্টেলেকচুয়াল চলচ্চিত্র ধারার অন্তর্ভুক্ত মনে করেন?
হ্যাঁ।
অনেক সমালোচক আপনার চোখের বালির সাথে সত্যজিৎ রায়ের চারুলতার (এটাও রবীন্দ্রনাথের গল্প থেকে করা) মিল দেখিয়েছেন। আপনি কি আপনার এই ছবিকে সত্যজিতের প্রতি ট্রিবিউট হিসেবে আখ্যায়িত করতে চান?
না, আমি তেমনটি বলব না। তবে কিছু অংশ অবশ্যই সত্যজিতের প্রতি ট্রিবিউট ছিল। সবাই চারুলতার থিয়েটার বাইনোকুলার আর দোলনায় দোল খাওয়া মনে রেখেছে এবং তার সাথে আমারটা মিলিয়েছে। কিন্তু চারুলতায় বাইনোকুলার একেবারে ভিন্ন কারণে ব্যবহার করা হয়েছিল। চারুলতায় বাইনোকুলার ব্যবহার করা হয়েছিল উন্মুক্ত বিশ্বের দিকে একটি জানালা হিসেবে, আর চোখের বালিতে ব্যবহার করা হয়েছে ইক্ষণকামের (voyeuristically) জন্য। সেই সময় এবং এই সময়ের মধ্যে বেশ কিছু জিনিস সাধারণ আছে। যেমন ফোর-পোস্টার বিছানা, সব বাংলা সিনেমাতেই এটা ব্যবহার করা হয়েছে। থিয়েটার বাইনোকুলার পরে এসেছে বলে খুব কম সিনেমাতে এর ব্যবহার আছে। কিন্তু আমি সেটা আবার ব্যবহার করেছি।
আমি অবশ্যই এমন কেউ যে সত্যজিৎ ধারায় সিনেমা বানায়। কিন্তু এটাকে আমি অস্বীকার করার চেষ্টা করি না, বরং এতে আমি খুব খুশী; আমি মনে করি বাচ্চা-কাচ্চাদের দেখতে বাবা-মার মতোই হওয়া উচিত [হাসি]। আমি অবশ্যই সত্যজিতের উত্তরসূরি, তাঁর সিনেমার মধ্যেই আমরা বেড়ে উঠেছি।
সত্যজিতের সাথে আমার পার্থক্যগুলো এরকম: প্রথমত, চোখের বালি রঙিন, চারুলতা রঙিন না। চারুলতার জন্য সত্যজিৎ কোন ধরণের রং বেছে নিতেন আমি জানি না। তবে চোখের বালিতে রং এর বিষয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। the whole copperish tint with the red- এর ভূমিকা এখানে খুব বেশী। চারুলতায় কোন ধরণের রং ব্যবহার করা হতো তা আমরা জানি না। রবীন্দ্রনাথের একটি উপন্যাস থেকে সত্যজিৎ সিনেমা করেছেন যার নাম “ঘরে-বাইরে”। সিনেমা বা অ্যাসথেটিক পিস হিসেবে ঘরে-বাইরে একটি কমপ্লিট ডিজাস্টার। দেখা যায়, সমালোচকরা সব সময়ই চারুলতার সাথে তুলনা দেন, ঘরে-বাইরের কথা উল্লেখই করেন না। ঘরে-বাইরে উপন্যাসটি খুব গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এ থেকে সত্যজিৎ যে সিনেমা বানিয়েছেন তা তার ভাল কাজগুলোর মধ্যে পড়ে না। আর চারুলতা আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে ত্রুটিহীন সিনেমাগুলোর একটি।
আবেগের দিক দিয়ে চারুলতায় যে নিয়ন্ত্রণ দেখানো হয়েছে তার কোন তুলনা হয় না। শুধু আবেগ না, যেকোন দিক দিয়েই এর নিয়ন্ত্রণটা অনন্যসাধারণ। এখানে বাঙালি সংস্কৃতির অ-হিন্দু অংশকে দেখানো হয়েছে। ব্রাহ্ম ধর্ম নামে একটি ধর্ম ছিল যাতে মূর্তিপূজা ছিল না। চারুলতার কনটেক্সট এবং সমসাময়িকতা এই ব্রাহ্ম যুগের। সে যুগে সব আলোকিত ব্যক্তিই ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, বুদ্ধিজীবী এবং সাধারণভাবে সব অজ্ঞেয়বাদীরাও এই ধর্মে যোগ দিয়েছিলেন। অপরদিকে চোখের বালির প্রেক্ষিত হল অভিজাত গোঁড়া হিন্দু পরিবার। এ ধরণের পরিবারের সব দোষত্রুটি আর একঘেয়ে জীবনাচার এতে ফুটে উঠেছে। যেমন, ব্রাহ্ম সমাজে বিধবাদের অবস্থা এত খারাপ ছিল না। কিন্তু গোঁড়া হিন্দুদের মধ্যে সেটা প্রকট ছিল। এটাকে আমি চারুলতার সাথে চোখের বালির আরেকটা পার্থক্য বলব।
আপনার চোখের বালি শুরু হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি উক্তি দিয়ে যেখানে তিনি উপন্যাসের শেষটা সম্পর্কে নিজের অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন: “Ever since Chokher Bali was published, I have always regretted the ending. I ought to be censured for it” আপনি রবীন্দ্রনাথের এই উক্তিকে কিভাবে দেখেন, আর আপনার সিনেমায় কি কোনভাবে এই বিষয়টা নিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন?
হ্যাঁ, কারণ সিনেমার শেষটা উপন্যাস থেকে একেবারেই আলাদা। উপন্যাসে সমাপ্তিটা বেশ হাস্যকর: হঠাৎ করেই সবাই সুখী-সুখী হয়ে যায়, পরিবারটাকে খুব ভাল মনে হতে থাকে এবং তারা দুজনেই বিনোদিনীর পা ছুঁয়ে প্রণাম করে। দুই পুরুষ মহেন্দ্র ও বিহারী বলে, “ভাবী, আমাকে ক্ষমা করে দাও, আমার ভুল হয়েছে।” সেও তাদের ক্ষমা করে দেয়। এরপর সে বেনারসে গিয়ে তপস্বীর মত জীবনযাপন শুরু করে। সব সাধ-আহ্লাদ ত্যাগ করে, কারণ বিধবাদের সেভাবেই থাকা উচিত।
দেখুন, এটা এক ধরণের serialized উপন্যাস। ঠাকুর শুরু করেছিলেন বিধবার নিষিদ্ধ আবেগ দিয়ে। এর কারণ হিসেবে পাঠকপ্রিয়তা বাড়ানোর কথা আসতে পারে, কারণ ঠাকুর নিজে সাময়িকীটি সম্পাদনা করছিলেন, তার পাঠকের প্রয়োজন ছিল। উপন্যাসটা অর্ধেকের মত লেখার পরই খানিকটা প্রকাশিত হয়ে পড়ে এবং সব ব্রাহ্মরা মিলে তাকে রীতিমত ভর্তসনা করতে শুরু করে। ঠাকুর নিজে হিন্দু ছিলেন না, ছিলেন ব্রাহ্ম যা নিয়ে আমি একটু আগেই বলেছি। তো ঠাকুর হিন্দুদের আবেগকে খুব বেশী নাড়াতে চাননি। এজন্যই বিনোদিনীকে সমাজের চিরন্তন নিয়মের কাছে আত্মসমর্পণ করান। কিন্তু মৃত্যুর দুই মাস আগে যখন হারাবার কিছুই ছিল না তখন তিনি আক্ষেপ করেছিলেন এই বলে যে, “আমি এটা কেন করেছিলাম? আমার পাঠকদেরও সন্তুষ্ট করতে পারিনি নিজেকেও সন্তুষ্ট করতে পারেনি, তাহলে কেন করেছিলাম?” এ নিয়ে একটা ভাল সমালোচনাও হয়েছিল: বিনোদিনীকে যদি শেষে আজীবন নির্বাসনেই পাঠাবেন তবে তাকে দিয়ে কেন নিষিদ্ধ কাজ করালেন, কেন তার মধ্যে এত কামনার জন্ম দিলেন? এই সমালোচনা রবীন্দ্রনাথকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। রবীন্দ্রনাথ হয়ত বিনোদিনীকে এমনই করতে চেয়েছিলেন: তার মধ্যে আরও জীবনীশক্তি দিতে চেয়েছিলেন, আরও কামনা ও জীবনের প্রতি আরও ভালবাসা ভরে দিতে চেয়েছিলেন। হয়ত তার জীবনের পুরো চাহিদাটাকে পরিতৃপ্ত করতে চেয়েছিলেন। মৃত্যুর মাত্র দুই মাস আগে ঠাকুর এটা প্রকাশ করেছেন। তিনি লিখেছিলেন: “I need to be seriously criticized for it, I deserve this criticism. I should be punished for it.”
আজকেও উপন্যাস পড়লে বোঝা যায়, এই উপন্যাসের এমন সমাপ্তি হতে পারে না। অনেক পাঠক চেয়েছিলেন বিনোদিনীর সাথে বিহারীর বিয়ে হোক। আমি মনে করি, আজ থেকে ৩০ বছর আগে হলে বি
নোদিনীর সাথে বিহারীর বিয়ের মাধ্যমে সমাপ্তি দেয়া যেতো। কারণ তখন বিধবা বিয়েকে উৎসাহিত করা হচ্ছিল, এ নিয়ে রীতিমত প্রচার চলছিল। সবাই তখন মনে করতো, আরেকটি বিয়ে হলে সে আবার জীবন শুরু করতে পারবে। কিন্তু আজকের অবস্থা ভিন্ন। এখন নারীর জীবন চালানোর জন্য কোন পুরুষের শেষ নাম, উপাধি বা কোন ধরণের সাহায্যের প্রয়োজন হয় না। বিনোদিনী আগে বিয়ে করেছে এবং বিয়ে তাকে কিছুই দেয়নি, এতে তার কোন সাহায্য হয়নি। একা থাকাটাই তাকে সবচেয়ে বেশী সাহায্য করেছে। তার অর্জন, তার শক্তি, তার হেঁয়ালিই তার সবচেয়ে বড় সহায়। সুতরাং তার পক্ষে একা থাকার শক্তি অর্জন করা সম্ভব।
পরবর্তীতে চলে যাওয়ার সময় সে তার নিজের “দেশ” এর কথা লিখে। এখানে দেশ বলতে স্থায়ী ঠিকানা বোঝায় না, দেশ বলতে “স্থান” বা ডোমেইন বোঝানো হয়েছে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলন আর বিনোদিনীর জীবনের ঘটনাগুলো একসাথে ঘটছে, কিন্তু সেই স্বাধীনতা আন্দোলনে আবার নারীর কোন স্থান নেই। সুতরাং নারীর কোন নিজস্ব দেশ নেই, সে যেমন তার স্বামীর নাম বহন করে তেমনি স্বামীর দেশই তার দেশ, স্বামী যে দেশের সেও সেই দেশের। কিন্তু একজন নারীর নিজস্ব দেশ থাকতে পারে। নারীর কোন নির্দিষ্ট দেশ বা কোন নির্দিষ্ট পরিচয়ে আবদ্ধ হয়ে যাওয়া উচিত না। পুরুষ কখনও তার পরিচয় পরিবর্তন করতে পারে না, কিন্তু নারী পারে। একজন স্বাধীন নারীর জন্য আমি তাই একে “দেশ” হিসেবে আখ্যায়িত করব। সিনেমার শেষে গিয়ে বিনোদিনী এই “দেশ” এর কথাই বলে।
তার মানে আপনার সমাপ্তিটা মুক্তি এনে দিয়েছে, মুক্তির ভাব জাগ্রত করেছে?
হ্যাঁ, আমি তাই ভেবেছিলাম। আমি অবশ্যই কোন সুনির্দিষ্ট সমাপ্তি দিতে চাইনি। ন্যারেটিভ দিক দিয়ে সবকিছুর সমাধান দিয়ে দেইনি। রেইনকোট আর চোখের বালি দুটো সিনেমার সঙ্গীতই চমৎকার। গুলজারকে দিয়ে গানের লিরিক লিখিয়েছেন।
না, রেইনকোটের সব গানের লিরিক আমিই লিখেছি, শুধু বিয়ের দুটো গান বাদে। Mathura nagarpati kahay tum gokoli jao, Piya tora kaisa abhiman এবং Akele hum nadiya kinare- এই তিনটি গানের লিরিকই আমার নিজের। এই গানগুলো কিন্তু হিন্দি না, আমি হিন্দি জানি না। এগুলো মৈথিলী, যা একটা মিশ্র ভাষা। সংস্কৃত, খানিকটা হিন্দি এবং ব্রজভাষা মিলে মৈথিলী হয়েছে।
সঙ্গীত ও কবিতার কোন ধারাটির সাথে আপনার পরিচয় হয়েছে?
আমি অনেক কবিতা পড়েছি। অবশ্য, বাঙালিদের জন্য কবিতা পড়া একটা ফ্যাশনের মতো, সবাই পড়ে। সেখানে কবিতা পড়া শুরু হয় Lorca দিয়ে, এরপর আসে বামপন্থী কবিদের কবিতা। অ্যালেন গিন্সবার্গের নাম করতে হয়। তিনি কলকাতায় ছিলেন, ইংরেজিতে লিখলেও তার কবিতা দিয়ে অনেকে প্রভাবিত হয়। তারপর অবশ্যই ইলিয়াডের নাম করতে হয়। বাংলা ভাষায়ও আমাদের অনেক প্রখ্যাত কবি আছেন, তাদের কারও কবিতাই বাদ যায় না। মাও সেতুং এর কবিতাও সবাই পছন্দ করে। সুতরাং কলকাতায় কাব্য রুচির কোন নির্দিষ্ট ধারা নেই, মিশ্র।
সঙ্গীতের কথা বললে প্রথমেই আসবে পশ্চিমা ধ্রুপদী সঙ্গীতের কথা। কারণ ব্রিটিশ রাজত্বের প্রথম রাজধানী হওয়ার সুবাদে কলকাতায় সঙ্গীতের এই ধারাটি খুব প্রভাব বিস্তার করেছে। কলকাতার পুরাতন অভিজাত এলাকায় গেলে আপনি long-playing রেকর্ড, high-brow সঙ্গীত শুনতে পাবেন। এটাই সেখানকার ট্রেডিশন। বিখ্যাত পশ্চিমা ধারার সঙ্গীতজ্ঞরা সবাই কলকাতার, প্রথম দিককার চেলো ও বেহালা বাদকরা সবাই কলকাতার। কলকাতা থেকেই ধীরে ধীরে তা বোম্বেতে গেছে। রবীন্দ্রনাথ নিজেও পশ্চিমা সঙ্গীতের ট্রেডিশনে বড় হয়েছেন, পরবর্তীতে এই সঙ্গীতকেই নিজের স্বতন্ত্র ট্রেডিশনে রূপান্তরিত করেছেন। তার গানের গভীরে গেলে পশ্চিমা ধ্রুপদী সঙ্গীতের অনেক উপাদান পাওয়া যায়। চোখের বালির সব গানই রবীন্দ্রনাথ থেকে নেয়া হয়েছে; এগুলো প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথের ইন্টারল্যড। চোখের বালিতেই সেই ধারার সঙ্গীতের বিশালত্ব বোঝা যা���, এর কথা ও গভীরতা স্পষ্ট হয়ে পড়ে, আর গভীরে গেলে পশ্চিমা ধ্রুপদী সঙ্গীতের প্রভাবটাও ধরা পড়ে।
আর আমি মনে করি, চোখের বালির ধ্রুপদী মান তার সঙ্গীতের কারণেই প্রকট হয়ে উঠেছে। যারা রবীন্দ্রনাথ পড়েননি তারা এই বিষয়টা ধরতে পারেন না: তিনি চোখের বালির এই চারটি চরিত্র নিয়েই একটা অপেরা লিখেছিলেন যা প্রায় একই রকম। এই অপেরাই সিনেমাটির মিউজিক্যাল টেক্সট গঠন করেছে। যেমন টাইটেল মিউজিকটা হুবহু সেই অপেরা থেকে নেয়া হয়েছে। এতে চারটি নারী-পুরুষ প্রায় উচ্চমার্গীয় একদল সঙ্গীতজ্ঞের সাথে মিলে এক ভালবাসার খেলায় মেতে উঠেছে, অনেকটা Midsummer Night’s Dream এর মত। কিংবা ওরাকলের মত, গ্রিক কোরাসের মত, যেখানে সবাই আবেগকে গানে রূপান্তরিত করছে এবং এর মাধ্যমেই নিজেদের কাজগুলো সচক্ষে দেখতে পাচ্ছে। এই গ্রিক ট্রেডিশনে কিন্তু চরিত্রগুলো মঞ্চে এসে প্রথমেই পুরো কাহিনীটা বলে দেয়, এরপর কি কি ঘটবে তাও বলে দেয়।
চোখের বালিতে আসলে আমি সঙ্গীতের সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছি, কারণ এতে তার প্রয়োজন ছিল। আমার অন্য ছবিগুলোতে কিন্তু সঙ্গীতের এত ব্যবহার নেই। যেমন রেইনকোটে ভারতের স্বদেশী খেদসূচক সঙ্গীত ব্যবহার করা হয়েছে। সেই ছবি করতে গিয়ে আমরা ইচ্ছে করেই তেমন গান বেছে নিয়েছি, কারণ তার গল্প ছিল সাধারণ এবং সঙ্গীতেও তার প্রতিফলন থাকা উচিত ছিল।
আপনি রায় এবং ঘটকের কথা বলেছেন। কিন্তু আর কোন কোন চলচ্চিত্র নির্মাতা দ্বারা আপনি প্রভাবিত হয়েছেন?
নিঃসন্দেহে বারিমান (Ingmar Bergman)। এরপরেই আসবে কিয়েশলফস্কি। Bille August (Pelle the Conqueror, The Best Intentions), তার ছবি আমার খুবই ভাল লাগে। কোয়েন্টিন ট্যারান্টিনো, আমি তার মত সিনেমা বানাতে চাই না, কিন্তু সে আমাকে মুগ্ধ করে। গডফাদারকে সর্বকালের অন্যতম সেরা সিনেমা মনে করি। আব্বাস কিয়ারোস্তামি, আমি কিয়ারোস্তামির পরেই জাফর পানাহি ও মোহসেন মাখমালবফের সিনেমা পছন্দ করি। অনেক সময় ওং কার-ওয়াই ও পেদ্রো আলমোদোবার আমার ফেভারিট হয়ে উঠে, তাদের ছবি অনেক সময়ই আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে দেয়। বিশ্ব চলচ্চিত্রের আরেকটি সেরা ছবির নাম “লাইক ওয়াটার ফর চকোলেট”, আলফোনসো আরাউ এর। কিন্তু আরাউ এর পর আর কোন উল্লেখযোগ্য সিনেমা করেননি।
এখন কি নিয়ে কাজ করছেন?
অনেক কিছু নিয়েই। কিন্তু আমি বিশেষ করে মহাভারত নিয়ে কিছু করার চেষ্টা করছি। আর আমি মনে করি এখনই এ নিয়ে করা প্রয়োজন, কারণ অনেক সময়ই একে ধর্মীয় গ্রন্থ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে যা সত্যি নয়। এটা মহাকাব্য। এর দিকেই আমার ঝোঁক সবচেয়ে বেশী।
সময় নিয়ে সাক্ষাৎকার
প্রকৃতি আর আগের মত রহস্যময় নেই। কারণ, অধিকাংশ রহস্যই উন্মোচিত হয়ে গেছে। কেউ চাইলে “অধিকাংশ” শব্দটি গ্রহণ নাও করতে পারেন। কারণ যত দিন যাচ্ছে ততই নতুন নতুন রহস্যের উদ্ভব ঘটছে। উদ্ভবের দুই রকম অর্থ হতে পারে: এক, রহস্যের বিষয়টিই নতুন, আর দুই, রহস্য পুরাতন, কিন্তু রহস্য সমাধানের সম্ভাবনা নতুন করে জাগ্রত হয়েছে। সময়কে এ ধরণের একটি সমস্যা হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। কারণ সময় নিয়ে মানুষ অনেক আগে থেকেই চিন্তা করে আসছে। কিন্তু, বিজ্ঞানের সূত্রের মাধ্যমে যে সময়ের ব্যাখ্যা করা সম্ভব তা মানুষ এইমাত্র জেনেছে। আধুনিক বিজ্ঞানের জন্য সময় এক বিশাল চ্যালেঞ্জ।
সময় নিয়ে মূলত বিশ্বতত্ত্ববিদেরাই গবেষণা করেন। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির অধ্যাপক শন ক্যারল। তিনি এনট্রপির মাধ্যমে সময়ের ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করছেন। তার মূল উদ্দেশ্য এনট্রপি ও সময়ের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে বের করা। এ নিয়ে জুন মাসের “সায়েন্টিফিক অ্যামেরিকান” পত্রিকায় এক দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তার পর থেকে বিজ্ঞানী মহলে এ নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। এই আলোচনার সূত্র ধরেই “লস এঞ্জেলেস টাইম্স” সম্প্রতি শন ক্যারলের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন টাইম্সের স্টাফ রাইটার জন জনসন জুনিয়র। এই সাক্ষাৎকারের প্রধান দিক হল, সহজবোধ্যতা। সাংবাদিক মহোদয় ক্যারলকে খুব সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করেছেন। ক্যারলও সেগুলোর সরল উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছেন। পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারের বঙ্গানুবাদ তুলে দিচ্ছি:
*****
সময় নিয়ে মূল সমস্যাটা কি?
সময় অপ্রত্যাবর্তী, অর্থাৎ তাকে ফিরিয়ে আনা যায় না, গেল তো গেলই। এটা বিশ্বতত্ত্বের সর্বপ্রধান সমাধানহীন সমস্যাগুলোর একটি।
অনেক দিন ধরেই বিশ্বতত্ত্বে সময় নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। কিন্তু, এখন আমাদের কাছে এমন কিছু তত্ত্ব আর যন্ত্র আছে যা আগে ছিল না।
সাধারণ আপেক্ষিকতা, স্ট্রিং তত্ত্ব, কণা পদার্থবিজ্ঞানের অভিনব আবিষ্কার এই সবই বিশ্বতত্ত্বের জন্য নতুন সম্ভাবনার দার খুলে দিয়েছে। এগুলোর সহায়তায় সঠিক উত্তরে পৌঁছানো খুবই সম্ভব।
এই সবকিছুর সাথে এনট্রপির সম্পর্কটা কোথায়?
মহাবিশ্বের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এনট্রপির বৃদ্ধি। মহাবিশ্বের আদিতে এনট্রপির পরিমাণ ছিল খুবই কম, সে যতই শেষের দিকে যাচ্ছে এনট্রপি ততই বেড়ে চলেছে।
আমরা সবাই জানি, ডিমকে ওমলেটে পরিণত করা সম্ভব কিন্তু ওমলেটকে আস্ত ডিমে ফিরিয়ে আনা সম্ভব না। এই সহজ বিষয়টি আবিষ্কারের জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করে দুরবিন বানানোর প্রয়োজন পড়ে না।
আর এখানেই সম্পর্কটা নিহিত।
এনট্রপির খুব সহজ কোন উদাহরণ দিতে পারেন কি?
এনট্রপির ব্যাখ্যা অনেকটা এরকম: পরিবর্তন বুঝতে না দিয়ে, কোন ব্যবস্থার সকল উপাদানকে যতগুলো উপায়ে বিন্যস্ত করা যায় তাকেই এনট্রপি বলে। স্থূল পর্যবেক্ষনে এই পরিবর্তন কখনই ধরা পরবে না। অর্থাৎ বিভিন্ন এনট্রপি দিয়ে পরিবর্তন ঘটছে কিন্তু তা ধরা যাচ্ছে না।
উদাহরণ হিসেবে এক কাফ কফির মধ্যে দুধ মেশানোর কথা বলা যেতে পারে। যত বেশি মেশানো হবে, দুধের অণুগুলো ততই বিশৃঙ্খল হয়ে পড়বে, আর ততই এনট্রপি গঠিত হবে। অর্থাৎ এনট্রপির পরিমাণ বাড়তে থাকবে।
কোনভাবে যদি দুধের সব অণুকে কফি থেকে আলাদা করা যায় তাহলে এনট্রপির পরিমাণ হবে সবচেয়ে কম।
তো, সমস্যাটা কোথায়?
আপনি যদি বিশ্বাস করে নেন যে, মহা বিস্ফোরণের মাধ্যমে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে এবং এর আগে কিছুই ছিল না, তাহলে সমস্যাটা ব্যাখ্যা করা খুব কঠিন হয়ে পড়বে।
পদার্থবিজ্ঞানে এমন কোন সূত্র নেই যাতে বলা হয়েছে, মহাবিশ্বকে নিম্ন এনট্রপি থেকে শুরু হতে হবে এবং ধীরে ধীরে এনট্রপির পরিমাণ বাড়তে থাকবে। কিন্তু বাস্তবে মহাবিশ্ব এমন আচরণই করেছে।
একেবারে সরাসরি চিন্তায় দেখা যায়, জিনিসপত্র ছোট থেকে শুরু হবে এবং ধীরে ধীরে বাড়তে থাকবে, এটাই সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত। কিন্তু আপনি বলছেন, এই ধারণা ভুল।
আমার অনেক স্মার্ট কলিগ ঠিক এ কথাটাই বলেন। তারা বলেন, “তুমি কেন এটা নিয়ে চিন্তা করছ? আদি মহাবিশ্ব ছোট ছিল এবং তার এনট্রপিও ছিল খুব কম, এটাই তো সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত”।
কিন্তু আমি মনে করি, এটা এক ধরণের প্রেজুডিস। আমাদের মহাবিশ্বে বিষয়টা এরকম, এ কারণে আমরা মনে করি এটাই প্রাকৃতিক তথা স্বাভাবিক, অন্য কথায় এটাই প্রকৃতির নিয়ম।
হ্যা, পদার্থবিজ্ঞানের বর্তমান সূত্রগুলো দিয়ে এর ব্যাখ্যা করা সম্ভব না। কিন্তু আমি বলতে চাচ্ছি, বিষয়টা ধ্রুব সত্য বলে মেনে নেয়াও উচিত না।
তার মানে আপনি মনে করেন, মহাবিশ্বের শুরুটা ছিল অপ্রাকৃতিক?
নিম্ন-এনট্রপির গড়ন বেশ বিরল।
এক প্যাকেট কার্ড নিয়ে প্যাকেট থেকে সেগুলো বের করলে হয়ত দেখা যাবে, সবগুলো ক্রমান্বয়ে সাজানো আছে। কিন্তু, এক প্যাকেট কার্ড থেকে দৈবভাবে কিছু কার্ড নিলে এটাই স্বাভাবিক যে, সেগুলো অগোছালো হবে।
নিম্ন-এনট্রপির সাথে উচ্চ-এনট্রপির সংঘর্ষটাও এখানে।
তার মানে, মহাবিশ্ব, আমরা যা দেখি তার চেয়েও বেশি কিছু?
কার্ডের প্যাকেটে খুললে সবগুলো কার্ড সাজানো অবস্থায় দেখা যায়। এটা দেখে আপনি আশ্চার্যান্বিত হন না। কারণ এটা নয় যে, সাজানো অবস্থায় থাকাই স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক। বরং মূল কারণ হচ্ছে, কার্ডের প্যাকেট কোন বদ্ধ ব্যবস্থা নয়। প্যাকেটটা এর থেকেও বড় কোন ব্যবস্থা থেকে এসেছে যে ব্যবস্থায় একটা কারখানা ছিল। আর সে কারখানাতেই কার্ডগুলো সাজানো হয়েছে। তাই আমি মনে করি, এর আগে আরেকটি মহাবিশ্ব ছিল যা আমাদের তৈরী করেছে। এক কথা, আমরা সেই বৃহৎ মহাবিশ্ব থেকে বেরিয়েছি।
আমরা অপেক্ষাকৃত বড় কোন ব্যবস্থার অংশ।
আপনি কি বলতে চাচ্ছেন, আমাদের মহাবিশ্ব অন্য একটি মহাবিশ্ব থেকে এসেছে?
ঠিক। এটা বৃহত্তর কোন স্থান-কাল থেকে এসেছে যাকে আমরা পর্যবেক্ষণ করতে পারি না। উচ্চ-এনট্রপির কোন বৃহত্তর স্থানের অতি সামান্য এক অংশ থেকে আমাদের মহাবিশ্ব এসেছে।
আমি বলছি না, এটা সত্য। আমি কেবল বলছি, এটা এমন এক বিষয় যা নিয়ে চিন্তা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
আপনি বলছেন, অন্য কোন মহাবিশ্বে আপনার মতই কোন ব্যক্তি থাকতে পারে যে যে আপনার মতই এখন কফি পান করছে; কিন্তু আপনার মত লাল কাপ থেকে না, হয়তোবা নীল কাপ থেকে।
আমাদের স্থানীয় পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্ব যদি বৃহত্তর কোন কাঠামো তথা বহুবিশ্বের মধ্যে গেঁথে থাকে, তাহলে এই বৃহত্তর কাঠামোতে আরও অনেক স্থান আছে যেগুলোর প্রতিটিতে আবার এমন জাতক স্থান আছে যারা তাদের স্থানীয় প্রতিবেশকে মহাবিশ্ব বলে। সেই অন্যান্য স্থানগুলোর সূত্র একেবারে ভিন্ন হতে পারে, আবার আমাদের মতও হতে পারে।
এরকম অন্যান্য স্থান কতগুলো থাকতে পারে? সত্য বলতে অসীম সংখ্যক থাকতে পারে। সতুরাং এটা খুবই সম্ভব যে বহুবিশ্ব নামের এই বৃহত্তর কাঠামোর অন্য কোন স্থানে আমাদের মতই মানুষ আছে, তারা হয়তো আমাদের মতই এলএ টাইম্সের জন্য রিপোর্ট লিখছে বা একই ধরণের প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে।
তো, সময়ের তীর এই ধারণার সাথে কিভাবে খাপ খায়?
সময় সম্পর্কে আমাদের অভিজ্ঞতা এনট্রপি বৃদ্ধির উপর নির্ভর করে। আপনি কাউকে বলতে শুনবেন না যে, সময় ভুল দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। কারণ সময় সম্পর্কে আমাদের চেতনাটাই এনট্রপি বৃদ্ধির উপর নির্ভর করে। সময়ের স্রোতে আমরা ভেসে বেড়াচ্ছি, এই চেতনার সাথে এনট্রপি খেয়ে আমরা বেঁচে আছি, এই চেতনার বেশ মিল আছে। এনট্রপি ছাড়াও সময়ের অস্তিত্ব থাকে। কিন্তু এনট্রপিই সময়কে তার বিশেষ চরিত্র প্রদান করে।
এনট্রপি সময়কে সামনের দিকে চলার স্বভাব প্রদান করে?
হ্যা, তার দিক প্রদান করে, অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে। আপনি যদি বহির্বিশ্বে স্পেসস্যুট পরে ভাসতে থাকেন, তাহলে আপনার কাছে এক দিকের সাথে অন্য দিকের কোন পার্থক্য থাকবে না। কিন্তু, মহাবিশ্বের সকল স্থানেই গতকাল এবং আজকের মধ্যে পার্থক্য থাকবে। এর মূল কারণ এনট্রপি এবং এটাই সময়ের তীর।
বহুবিশ্বে কি ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে?
আমি কাউকে তার ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাপারে উপদেশ দিতে চাই না। কিন্তু আমি মনে করি, প্রাকৃতিক বিশ্বকে বোঝার জন্য বিজ্ঞানের শক্তির বিরুদ্ধে যাওয়া উচিত না। আজ থেকে হাজার বছর আগে হয়তো চাঁদ কেন আকাশের এক দিক থেকে অন্য দিকে যাচ্ছে তা বোঝার জন্য ঈশ্বরের অবতরণা করতে হতো। কিন্তু, এখন অবস্থা সেরকম নেই।
গ্যালিলিও এবং নিউটন এসে বললেন, শক্তির নিত্যতা সূত্র বলে একটা কিছু আছে যা বস্তুগুলো ঘুরতে বাধ্য করে।
এ যুগে অনেকে বলে থাকেন, “আপনি অবশ্যই ঈশ্বরের অবতারণা ছাড়া মহাবিশ্বের সৃষ্টি ব্যাখ্যা করতে পারবেন না।” এবং এক্ষেত্রে আমি বলতে চাই, “এর বিরুদ্ধে বাজি ধরে বসবেন না”।
*****
- মূল সাক্ষাৎকার: লস এঞ্জেলেস টাইম্স
*****
পুরো সাক্ষাৎকারের একেবারে শেষে এসে শন ক্যারলকে ঈশ্বর নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, ক্যারল বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেননি। তিনি বলেছেন ঈশ্বর ছাড়া মহাবিশ্বের সৃষ্টিকে ব্যাখ্যা করা যায় না, এই কথার পক্ষে বা বিপক্ষে বাজি ধরাটা ঠিক হবে না। কোন পক্ষেরই বাজি ধরা উচিত হবে না। এভাবে ঈশ্বরের প্রশ্নকে এড়িয়ে যাওয়ার কারণ তিনি নিজের ব্লগে বলেছেন। এই সাক্ষাৎকার নিয়ে কসমিক ভ্যারিয়েন্স ব্লগে তিনি অনেকটা এরকম কথা বলেছেন-
ধর্ম আর বিজ্ঞানের মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই। তারপরও বিশ্বতত্ত্বের সাথে ধর্মতত্ত্ব জড়িয়ে পড়ে। শন্য ক্যারল নিজে সম্পূর্ণ নাস্তিক, প্রায় সব বিশ্বতত্ত্ববিদেরাই নাস্তিক। ক্যারল বলেছেন, সাক্ষাৎকারটি ছিল বিজ্ঞান নিয়ে। তাই বিজ্ঞানের আলোচনায় তিনি ঈশ্বর আনতে চাননি। কারণ, ঈশ্বর নিয়ে আসলে বিজ্ঞানীরা যেভাবে চিন্তা করেন তাকেই অবজ্ঞা করা হয়। এ কারণেই নাস্তিকতা নিয়ে তিনি কিছু বলেননি। তার মানে এই নয় যে, তিনি অন্যদেরকে নাস্তিক হওয়ার পরামর্শ দেন না। তিনি অবশ্যই ধর্ম বিষয়ক যেকোন আলোচনায় নিজেকে নাস্তিক হিসেবে উপস্থাপন করেন এবং এর পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করেন। কিন্তু, বিজ্ঞান বিষয়ক কোন আলোচনায় কখনই এর উল্লেখ করেন না। তিনি সবসময় বলেন, “বিশ্বতত্ত্ববিদের দৈনন্দিন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ঈশ্বরের কোন স্থানই নেই”।
সময় নিয়ে মূলত বিশ্বতত্ত্ববিদেরাই গবেষণা করেন। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির অধ্যাপক শন ক্যারল। তিনি এনট্রপির মাধ্যমে সময়ের ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করছেন। তার মূল উদ্দেশ্য এনট্রপি ও সময়ের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে বের করা। এ নিয়ে জুন মাসের “সায়েন্টিফিক অ্যামেরিকান” পত্রিকায় এক দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তার পর থেকে বিজ্ঞানী মহলে এ নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। এই আলোচনার সূত্র ধরেই “লস এঞ্জেলেস টাইম্স” সম্প্রতি শন ক্যারলের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন টাইম্সের স্টাফ রাইটার জন জনসন জুনিয়র। এই সাক্ষাৎকারের প্রধান দিক হল, সহজবোধ্যতা। সাংবাদিক মহোদয় ক্যারলকে খুব সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করেছেন। ক্যারলও সেগুলোর সরল উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছেন। পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারের বঙ্গানুবাদ তুলে দিচ্ছি:
*****
সময় নিয়ে মূল সমস্যাটা কি?
সময় অপ্রত্যাবর্তী, অর্থাৎ তাকে ফিরিয়ে আনা যায় না, গেল তো গেলই। এটা বিশ্বতত্ত্বের সর্বপ্রধান সমাধানহীন সমস্যাগুলোর একটি।
অনেক দিন ধরেই বিশ্বতত্ত্বে সময় নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। কিন্তু, এখন আমাদের কাছে এমন কিছু তত্ত্ব আর যন্ত্র আছে যা আগে ছিল না।
সাধারণ আপেক্ষিকতা, স্ট্রিং তত্ত্ব, কণা পদার্থবিজ্ঞানের অভিনব আবিষ্কার এই সবই বিশ্বতত্ত্বের জন্য নতুন সম্ভাবনার দার খুলে দিয়েছে। এগুলোর সহায়তায় সঠিক উত্তরে পৌঁছানো খুবই সম্ভব।
এই সবকিছুর সাথে এনট্রপির সম্পর্কটা কোথায়?
মহাবিশ্বের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এনট্রপির বৃদ্ধি। মহাবিশ্বের আদিতে এনট্রপির পরিমাণ ছিল খুবই কম, সে যতই শেষের দিকে যাচ্ছে এনট্রপি ততই বেড়ে চলেছে।
আমরা সবাই জানি, ডিমকে ওমলেটে পরিণত করা সম্ভব কিন্তু ওমলেটকে আস্ত ডিমে ফিরিয়ে আনা সম্ভব না। এই সহজ বিষয়টি আবিষ্কারের জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করে দুরবিন বানানোর প্রয়োজন পড়ে না।
আর এখানেই সম্পর্কটা নিহিত।
এনট্রপির খুব সহজ কোন উদাহরণ দিতে পারেন কি?
এনট্রপির ব্যাখ্যা অনেকটা এরকম: পরিবর্তন বুঝতে না দিয়ে, কোন ব্যবস্থার সকল উপাদানকে যতগুলো উপায়ে বিন্যস্ত করা যায় তাকেই এনট্রপি বলে। স্থূল পর্যবেক্ষনে এই পরিবর্তন কখনই ধরা পরবে না। অর্থাৎ বিভিন্ন এনট্রপি দিয়ে পরিবর্তন ঘটছে কিন্তু তা ধরা যাচ্ছে না।
উদাহরণ হিসেবে এক কাফ কফির মধ্যে দুধ মেশানোর কথা বলা যেতে পারে। যত বেশি মেশানো হবে, দুধের অণুগুলো ততই বিশৃঙ্খল হয়ে পড়বে, আর ততই এনট্রপি গঠিত হবে। অর্থাৎ এনট্রপির পরিমাণ বাড়তে থাকবে।
কোনভাবে যদি দুধের সব অণুকে কফি থেকে আলাদা করা যায় তাহলে এনট্রপির পরিমাণ হবে সবচেয়ে কম।
তো, সমস্যাটা কোথায়?
আপনি যদি বিশ্বাস করে নেন যে, মহা বিস্ফোরণের মাধ্যমে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে এবং এর আগে কিছুই ছিল না, তাহলে সমস্যাটা ব্যাখ্যা করা খুব কঠিন হয়ে পড়বে।
পদার্থবিজ্ঞানে এমন কোন সূত্র নেই যাতে বলা হয়েছে, মহাবিশ্বকে নিম্ন এনট্রপি থেকে শুরু হতে হবে এবং ধীরে ধীরে এনট্রপির পরিমাণ বাড়তে থাকবে। কিন্তু বাস্তবে মহাবিশ্ব এমন আচরণই করেছে।
একেবারে সরাসরি চিন্তায় দেখা যায়, জিনিসপত্র ছোট থেকে শুরু হবে এবং ধীরে ধীরে বাড়তে থাকবে, এটাই সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত। কিন্তু আপনি বলছেন, এই ধারণা ভুল।
আমার অনেক স্মার্ট কলিগ ঠিক এ কথাটাই বলেন। তারা বলেন, “তুমি কেন এটা নিয়ে চিন্তা করছ? আদি মহাবিশ্ব ছোট ছিল এবং তার এনট্রপিও ছিল খুব কম, এটাই তো সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত”।
কিন্তু আমি মনে করি, এটা এক ধরণের প্রেজুডিস। আমাদের মহাবিশ্বে বিষয়টা এরকম, এ কারণে আমরা মনে করি এটাই প্রাকৃতিক তথা স্বাভাবিক, অন্য কথায় এটাই প্রকৃতির নিয়ম।
হ্যা, পদার্থবিজ্ঞানের বর্তমান সূত্রগুলো দিয়ে এর ব্যাখ্যা করা সম্ভব না। কিন্তু আমি বলতে চাচ্ছি, বিষয়টা ধ্রুব সত্য বলে মেনে নেয়াও উচিত না।
তার মানে আপনি মনে করেন, মহাবিশ্বের শুরুটা ছিল অপ্রাকৃতিক?
নিম্ন-এনট্রপির গড়ন বেশ বিরল।
এক প্যাকেট কার্ড নিয়ে প্যাকেট থেকে সেগুলো বের করলে হয়ত দেখা যাবে, সবগুলো ক্রমান্বয়ে সাজানো আছে। কিন্তু, এক প্যাকেট কার্ড থেকে দৈবভাবে কিছু কার্ড নিলে এটাই স্বাভাবিক যে, সেগুলো অগোছালো হবে।
নিম্ন-এনট্রপির সাথে উচ্চ-এনট্রপির সংঘর্ষটাও এখানে।
তার মানে, মহাবিশ্ব, আমরা যা দেখি তার চেয়েও বেশি কিছু?
কার্ডের প্যাকেটে খুললে সবগুলো কার্ড সাজানো অবস্থায় দেখা যায়। এটা দেখে আপনি আশ্চার্যান্বিত হন না। কারণ এটা নয় যে, সাজানো অবস্থায় থাকাই স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক। বরং মূল কারণ হচ্ছে, কার্ডের প্যাকেট কোন বদ্ধ ব্যবস্থা নয়। প্যাকেটটা এর থেকেও বড় কোন ব্যবস্থা থেকে এসেছে যে ব্যবস্থায় একটা কারখানা ছিল। আর সে কারখানাতেই কার্ডগুলো সাজানো হয়েছে। তাই আমি মনে করি, এর আগে আরেকটি মহাবিশ্ব ছিল যা আমাদের তৈরী করেছে। এক কথা, আমরা সেই বৃহৎ মহাবিশ্ব থেকে বেরিয়েছি।
আমরা অপেক্ষাকৃত বড় কোন ব্যবস্থার অংশ।
আপনি কি বলতে চাচ্ছেন, আমাদের মহাবিশ্ব অন্য একটি মহাবিশ্ব থেকে এসেছে?
ঠিক। এটা বৃহত্তর কোন স্থান-কাল থেকে এসেছে যাকে আমরা পর্যবেক্ষণ করতে পারি না। উচ্চ-এনট্রপির কোন বৃহত্তর স্থানের অতি সামান্য এক অংশ থেকে আমাদের মহাবিশ্ব এসেছে।
আমি বলছি না, এটা সত্য। আমি কেবল বলছি, এটা এমন এক বিষয় যা নিয়ে চিন্তা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
আপনি বলছেন, অন্য কোন মহাবিশ্বে আপনার মতই কোন ব্যক্তি থাকতে পারে যে যে আপনার মতই এখন কফি পান করছে; কিন্তু আপনার মত লাল কাপ থেকে না, হয়তোবা নীল কাপ থেকে।
আমাদের স্থানীয় পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্ব যদি বৃহত্তর কোন কাঠামো তথা বহুবিশ্বের মধ্যে গেঁথে থাকে, তাহলে এই বৃহত্তর কাঠামোতে আরও অনেক স্থান আছে যেগুলোর প্রতিটিতে আবার এমন জাতক স্থান আছে যারা তাদের স্থানীয় প্রতিবেশকে মহাবিশ্ব বলে। সেই অন্যান্য স্থানগুলোর সূত্র একেবারে ভিন্ন হতে পারে, আবার আমাদের মতও হতে পারে।
এরকম অন্যান্য স্থান কতগুলো থাকতে পারে? সত্য বলতে অসীম সংখ্যক থাকতে পারে। সতুরাং এটা খুবই সম্ভব যে বহুবিশ্ব নামের এই বৃহত্তর কাঠামোর অন্য কোন স্থানে আমাদের মতই মানুষ আছে, তারা হয়তো আমাদের মতই এলএ টাইম্সের জন্য রিপোর্ট লিখছে বা একই ধরণের প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে।
তো, সময়ের তীর এই ধারণার সাথে কিভাবে খাপ খায়?
সময় সম্পর্কে আমাদের অভিজ্ঞতা এনট্রপি বৃদ্ধির উপর নির্ভর করে। আপনি কাউকে বলতে শুনবেন না যে, সময় ভুল দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। কারণ সময় সম্পর্কে আমাদের চেতনাটাই এনট্রপি বৃদ্ধির উপর নির্ভর করে। সময়ের স্রোতে আমরা ভেসে বেড়াচ্ছি, এই চেতনার সাথে এনট্রপি খেয়ে আমরা বেঁচে আছি, এই চেতনার বেশ মিল আছে। এনট্রপি ছাড়াও সময়ের অস্তিত্ব থাকে। কিন্তু এনট্রপিই সময়কে তার বিশেষ চরিত্র প্রদান করে।
এনট্রপি সময়কে সামনের দিকে চলার স্বভাব প্রদান করে?
হ্যা, তার দিক প্রদান করে, অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে। আপনি যদি বহির্বিশ্বে স্পেসস্যুট পরে ভাসতে থাকেন, তাহলে আপনার কাছে এক দিকের সাথে অন্য দিকের কোন পার্থক্য থাকবে না। কিন্তু, মহাবিশ্বের সকল স্থানেই গতকাল এবং আজকের মধ্যে পার্থক্য থাকবে। এর মূল কারণ এনট্রপি এবং এটাই সময়ের তীর।
বহুবিশ্বে কি ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে?
আমি কাউকে তার ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাপারে উপদেশ দিতে চাই না। কিন্তু আমি মনে করি, প্রাকৃতিক বিশ্বকে বোঝার জন্য বিজ্ঞানের শক্তির বিরুদ্ধে যাওয়া উচিত না। আজ থেকে হাজার বছর আগে হয়তো চাঁদ কেন আকাশের এক দিক থেকে অন্য দিকে যাচ্ছে তা বোঝার জন্য ঈশ্বরের অবতরণা করতে হতো। কিন্তু, এখন অবস্থা সেরকম নেই।
গ্যালিলিও এবং নিউটন এসে বললেন, শক্তির নিত্যতা সূত্র বলে একটা কিছু আছে যা বস্তুগুলো ঘুরতে বাধ্য করে।
এ যুগে অনেকে বলে থাকেন, “আপনি অবশ্যই ঈশ্বরের অবতারণা ছাড়া মহাবিশ্বের সৃষ্টি ব্যাখ্যা করতে পারবেন না।” এবং এক্ষেত্রে আমি বলতে চাই, “এর বিরুদ্ধে বাজি ধরে বসবেন না”।
*****
- মূল সাক্ষাৎকার: লস এঞ্জেলেস টাইম্স
*****
পুরো সাক্ষাৎকারের একেবারে শেষে এসে শন ক্যারলকে ঈশ্বর নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, ক্যারল বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেননি। তিনি বলেছেন ঈশ্বর ছাড়া মহাবিশ্বের সৃষ্টিকে ব্যাখ্যা করা যায় না, এই কথার পক্ষে বা বিপক্ষে বাজি ধরাটা ঠিক হবে না। কোন পক্ষেরই বাজি ধরা উচিত হবে না। এভাবে ঈশ্বরের প্রশ্নকে এড়িয়ে যাওয়ার কারণ তিনি নিজের ব্লগে বলেছেন। এই সাক্ষাৎকার নিয়ে কসমিক ভ্যারিয়েন্স ব্লগে তিনি অনেকটা এরকম কথা বলেছেন-
ধর্ম আর বিজ্ঞানের মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই। তারপরও বিশ্বতত্ত্বের সাথে ধর্মতত্ত্ব জড়িয়ে পড়ে। শন্য ক্যারল নিজে সম্পূর্ণ নাস্তিক, প্রায় সব বিশ্বতত্ত্ববিদেরাই নাস্তিক। ক্যারল বলেছেন, সাক্ষাৎকারটি ছিল বিজ্ঞান নিয়ে। তাই বিজ্ঞানের আলোচনায় তিনি ঈশ্বর আনতে চাননি। কারণ, ঈশ্বর নিয়ে আসলে বিজ্ঞানীরা যেভাবে চিন্তা করেন তাকেই অবজ্ঞা করা হয়। এ কারণেই নাস্তিকতা নিয়ে তিনি কিছু বলেননি। তার মানে এই নয় যে, তিনি অন্যদেরকে নাস্তিক হওয়ার পরামর্শ দেন না। তিনি অবশ্যই ধর্ম বিষয়ক যেকোন আলোচনায় নিজেকে নাস্তিক হিসেবে উপস্থাপন করেন এবং এর পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করেন। কিন্তু, বিজ্ঞান বিষয়ক কোন আলোচনায় কখনই এর উল্লেখ করেন না। তিনি সবসময় বলেন, “বিশ্বতত্ত্ববিদের দৈনন্দিন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ঈশ্বরের কোন স্থানই নেই”।
ইঙ্গমার বারিমানের সাক্ষাৎকার: প্লেবয়
প্রকাশ: জুন, ১৯৬৭; প্লেবয় ম্যাগাজিন
চলুন বারিমানের “দ্য সাইলেন্স” মুক্তি পাওয়ার সেই উত্তাল মাসগুলোতে ফিরে যাই। স্টকহোমের প্রতিটি সিনেমা হলে উৎসুক দর্শকদের ভীড়, তার দেখাদেখি আরও ডজনখানেক দেশে সাইলেন্স নিয়ে একরকম চাপা উত্তেজনা, একেক জনের হলে আসার কারণ একেক রকম- কেউ এসেছে এই সুয়েডীয় চলচ্চিত্রকারের বিশ্বনন্দিত ট্রিলজির (আগের দুটি হল “থ্রু আ গ্লাস ডার্কলি” ও “উইন্টার লাইট”) শেষ পর্ব দেখতে, কেউ এসেছে সমালোচকদের সেই কথার সত্যতা প্রমাণ করতে- এই “অ্যানাটমি অফ লাস্ট” নাকি বারিমানের ২০ বছরের চলচ্চিত্র জীবনের সেরা কীর্তি। সিনেমা তিনটি “গড ট্রিলজি” নামে পরিচিত যাতে ভালোবাসার অন্বেষণকে দেখা হয়েছে আবেগের মৃত্যু থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষের আসার কারণ এগুলো না, নির্লজ্জ মানুষের ঢল নেমেছিল সিনেমার ইতিহাসে অনন্য ইরটিক দৃশ্যগুলোকে লোলুপ দৃষ্টি দিয়ে ভক্ষণ করতে। মার্কিন সংস্করণে প্রায় এক মিনিটের মত দৃশ্য কেটে রাখার পরও দ্য সাইলেন্সের অসামাজিক নারীপটে যা আঁকা ছিল তা কামাতুর জনতার কামতৃষ্ণা উস্কে দেয়ার জন্য যথেষ্ট বলে প্রতীয়মান হয়েছে। মুক্তি পাওয়ার পর সুইডেনের আইনসভার সদস্যরা ৪৫ বছর বয়সী নির্মাতাকে পর্নোগ্রাফার অভিধায় অভিযুক্ত করেছে, সুইডেনের সকল লুথারান চার্চ থেকে বারিমানকে বলা হয়েছে “অশ্লীলতার যোগানদাতা”, বেনামী চিঠিপত্রে তারুণ্য ও নম্রতাকে কলুষিত করার অভিযোগ এনে তাকে হুমকি দেয়া হয়েছে। মূক জনতার সম্মিলিত শীৎকারেও বারিমান এতটা কষ্ট পাননি যতটা কষ্ট পেয়েছেন মানুষের এই কথা শুনে যে, তিনি নাকি যৌন দৃশ্যগুলো যোগ করেছেন কেবলই মানুষকে আঘাত এবং উত্তেজিত করার জন্য। এক সাংবাদিককে তিনি বলেছিলেন, “আমি একজন শিল্পী। দ্য সাইলেন্স এর ধারণা মাথায় আসার পর আমাকে তা করতেই হয়েছে, এর বেশি কিছু না।” বারিমানের বাবা ছিলেন ইভানজেলিক্যাল লুথারান চার্চের সদস্য, সুইডেনের রাজার চ্যাপলেইন- এই বাবার ঘরে তার শৈশব-কৈশোরের জীবন ছিল তিক্ততায় ভরপুর, সেখানে আবেগের জড়তা আর নৈতিক বাধ্যবাধকতা ছাড়া কিছুই ছিল না। এই জীবন ঝেড়ে ফেলে তিনি নিজস্ব রূপকথার জগতে প্রবেশ করেছেন। ৯ম জন্মদিনে, এক বাক্স টিনের যোদ্ধার বিনিময়ে তিনি এমন একটি খেলনা পেয়েছিলেন যা তার সৃজনশীলতার বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে, সেটি ছিল এক ক্ষত-বিক্ষত জাদুর প্রদীপ। এর এক বছর পরেই তিনি মনে মনে দৃশ্যায়ন শুরু করেছিলেন, পুতুল নকশা করা শুরু করেছিলেন। স্ট্রিন্ডবার্গে তার নিজস্ব পাপেট থিয়েটারে নিজে সবকিছু করতেন- সবগুলো পুতুল নকশা করা, সবগুলো সূতা নিয়ন্ত্রণ করা আর সবগুলো চরিত্রের হয়ে কথা বলা। পরবর্তীতে স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একটি যুব মঞ্চে পরিচালক হিসেবে কাজ করেন, এখানেই ১৯৪০ সালে শেক্সপিয়ারের “ম্যাকবেথ” এর একটি নাৎসিবিরোধী সংস্করণ তৈরি করেন। কিন্তু এর কারণে তার পরিবারের উপর আঘাত আসায় মঞ্চ নাটকটির খুব একটা পসার হয়নি।
সামাজিক প্রতিরোধ আন্দোলনের চেতনায় উদ্বেলিত বারিমান পরের বছর স্কুল ত্যাগ করেন, চলে যান শহরের বোহেমিয়ান অংশে- মঞ্চে অভিনয় শুরু করেন, নাটকের এমন কিছু অবান্তর কাহিনী ভাবতে শুরু করেন যার কোনটাই তার শেষ পর্যন্ত লেখা হয়নি। এক সময় “সহকারী মঞ্চ ব্যবস্থাপক” হিসেবে স্থায়ী কর্মজীবন শুরু করেন, এগোতে শুরু করেন বেশ দ্রুত- ব্যবস্থাপক থেকে পরিচালক এবং সেখান থেকে মেধাবী নাট্যকার। বারিমান কিংবদন্তীর অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল তার ঔদ্ধত্য আর মেয়েদের প্রতি দুর্বলতা (বিয়ে করেছেন চার বার)। ১৯৪৪ সালে একটি চিত্রনাট্য লিখে সুইডেনের বৃহত্তম সিনেমা কোম্পানি Svensk Filmindustri তে জমা দেন। কোম্পানি এটা থেকে সিনেমা করার সিদ্ধান্ত নেয়- নাম “টর্মেন্ট”, এর মাধ্যমেই সুইডেনের চলচ্চিত্র মঞ্চে একটি নতুন ক্যারিয়ার শুরু হয়, এর পরে তিনি আরও ২৫টি সিনেমা করেছেন। “The Seventh Seal”, “Smiles of a Summer Night”, “Wild Strawberries”, “The Magician”, “Brink of Life” এবং “The Virgin Spring” এর আন্তর্জাতিক মুক্তির মাধ্যমে বিশ্ব চলচ্চিত্রের হর্তাকর্তারা এক নতুন মেধা আবিষ্কার করেছেন, সবাই তাকে আভান্ট-গার্ড আর্ট ফিল্মের গুরু মেনেছেন। বহু সমালোচকের সম্মিলিত প্রশংসায় তিনি বিশ্ব চলচ্চিত্রের প্রথম সারির নির্মাতা হিসেবে নাম কুড়িয়েছেন।
বারিমান শ্যুটিং করার সময় মূল চিত্রনাট্য থেকে সামান্য বিচ্যুতিও মেনে নিতে পারেন না। তার স্টুডিওর ত্রিসীমানায় বাইরের কোন মানুষ বা দর্শনার্থীর উপস্থিতি সহ্য করতে পারেন না, সাংবাদিকদের তো নয়ই। শুধু শ্যুটিং সেটে নয়, সেটের বাইরেও তিনি সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে চান না, তাদেরকে একেবারেই পছন্দ করেন না।
তাই আমাদেরকে একটু ভয়ে ভয়েই এই মহান চলচ্চিত্রকারের সাথে এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারের আবেদন নিয়ে যেতে হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল তিনি আমাদের আন্তরিকভাবে উত্তর দিয়েছেন, বলেছেন স্টকহোমে এসে তার সাথে দেখা করতে। তার আমন্ত্রণেই আমরা গত ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে স্টকহোমে এসেছি। বিমর্ষ নর্ডিক শীতের আবহে প্রায় এক সপ্তাহ আমরা স্টকহোমে থাকব।
আমরা কথা বলেছি ডাউনটাউন স্টকহোমের “রয়েল ড্রামাটিক থিয়েটার” এর ব্যাকস্টেজে বারিমানের ছোট্ট অফিসে বসে। জাতীয় মঞ্চের নব নিযুক্ত ম্যানেজার হিসেবে এখানে তিনি পুরোদমে কাজ করছেন- চলচ্চিত্র নির্মাণ থেকে শুরু করে Brecht, Albee ও Ionesco এর মত নাট্যকারদের নাটক মঞ্চায়ন, সবকিছু। প্রতি সকালে আমাদের সাথে ঘণ্টা খানেক কথা বলেছেন, কারণ তার মতে সকালেই তিনি সবচেয়ে জীবিত থাকেন। ঠিক ৯ টায় অফিসে আসেন, পরনে থাকে ভারী ঢিলেঢালা পশমী কাপড়ের পোলো শার্ট, উলের ক্যাপ, হালকা বাদামী রঙের উইন্ডপ্রুফ জ্যাকেট যাতে তখনও ড্রাই ক্লিনারের ট্যাগ লাগানো। সাক্ষাৎকার পর্ব শুরু হতো আমাদের পক্ষ থেকে একটা উষ্ণ হাসি দিয়ে, তিনি আমাদের অভিনন্দন জানিয়ে প্রথম প্রশ্নটা নিজেই করতেন, সব সময়।
বারিমান: তারপর, স্টকহোমে এসে এখনও হতাশ হননি?
প্লেবয়: হতাশ হওয়া উচিত নাকি?
বারিমান: খুব বেশিদিন তো এখনও থাকেননি। বিরক্তি একসময় আসবেই। আমি বুঝি না, মানুষ সব বাদ দিয়ে কেন এতদিন ধরে স্টকহোমে থাকে। দক্ষিণ থেকে এত উত্তরে আসাটা আসলেই বেশ বিদঘুটে। প্লেনে উত্তরের দিকে আসার সময় প্রথমে শহর ও গ্রাম দেখা যায়, কিন্তু আরও এগোলে কেবল গাছপালা-বনজঙ্গল, আরেকটু এগোলেও বন, মাঝখানে হয়ত একটা হ্রদ দেখা যায়, তারপর আবারও জঙ্গল- অনেক দূর পরপর হঠাৎ একটা বাড়ি চোখে পড়ে। তারপর হঠাৎ কোত্থেকে ফুঁড়ে উঠে স্টকহোম। সব বাদ দিয়ে এত উত্তরে এমন একটা শহর বানানো একেবারেই অযৌক্তিক। এখানে আমাদের থাকতে হয় একাকী। আমাদের দেশটা এত বড় অথচ জনসংখ্যা কত কম, পুরো দেশ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করে গুটিকতক মানুষ। এখানকার মানুষেরা নিজেদের জমিতে বিচ্ছিন্নভাবে বাস করে, একজনের সাথে আরেকজনের যোগাযোগ হয় না বললেই চলে। এটা তাদের জন্য খুবই কঠিন, এমনকি শহরে এলেও তাদের কোন লাভ হয় না। কিভাবে যোগাযোগ করতে হয় তা-ই তারা জানে না। মুখ বন্ধ করে বসে থাকে। আর শীতকালটা তো কোন সাহায্যই করে না।
প্লেবয়: সাহায্য করে না মানে?
বারিমান: শীতকালে দিনের দৈর্ঘ্য খুবই কম, খুব বেশি হলে সকাল সাড়ে আটটা থেকে বিকেল আড়াইটা পর্যন্ত। এখান থেকে আরেকটু উত্তরে গেলেই দিন হারিয়ে যায়, চব্বিশ ঘণ্টাই সেখানে অন্ধকার। আমি শীত ঘৃণা করি। স্টকহোমের শীত আরও বেশি ঘৃণা করি। শীতকালে আমি সবসময় ভোর ছয়টায় ঘুম থেকে উঠি, একেবারে ছোটবেলা থেকে। ঘুম ভাঙার পর প্রথমেই আমার জানালার বিপরীতের দেয়ালটার দিকে তাকাই। নভেম্বর-ডিসেম্বরে সেখানে কোন আলোই দেখা যায় না। জানুয়ারিতে এক চিলতে আলোর দেখা মেলে। প্রত্যেক সকালে সেই আলোর রেখাকে একটু একটু করে বাড়তে দেখি। অন্ধকার এবং অসহনীয় শীতকালটা এভাবেই পার করি: যত বসন্তের দিকে এগোই আলোর রেখাটাও তত বাড়তে থাকে।
প্লেবয়: এখানকার শীত এত ঘৃণা করলে শীতের সময় উষ্ণ শহরগুলোতে চলে যান না কেন? এখানে শীতের সময়টা তো রোম বা হলিউডের মত সিনেমার রাজধানীতে গিয়েও কাজ করতে পারেন।
বারিমান: নতুন শহর আমার মধ্যে অতিরিক্ত সংবদনের জন্ম দেয়। একসাথে এত অভিজ্ঞতা আর অনুভূতি সামাল দেয়া সম্ভব না; তারা সব আমার ওপর জেঁকে বসে। নতুন শহর আমাকে অভিভূত করে, আচ্ছন্ন করে রাখে, অস্থির করে তোলে।
প্লেবয়: একটা রিপোর্টে আপনি বলেছিলেন সুইডেন ছেড়ে যেতে আপনার ভীষণ ভয় হয়। এ কারণেই কি সুইডেনের বাইরে কোন সিনেমা তৈরি করেন নি?
বারিমান: তা নয়, ছবি তৈরির ক্ষেত্রে তা সামান্য কারণই বলতে পারেন। তাছাড়া পৃথিবীর সবখানে অভিনেতা-অভিনেত্রী এবং স্টুডিওগুলো প্রায় একই। আমার শৈল্পিক নিয়ন্ত্রণ টুকু হারিয়ে ফেলার ভয়েই অন্য কোন দেশে ছবি নির্মাণ করিনি। যখন ছবি বানাই, ছবির শুরু থেকে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত সবকিছু আমার নিয়ন্ত্রণে থাকে। আমি সুইডেনে বেড়ে উঠেছি, এখানেই আমার শিকড়। আর এখানে আমি পেশা নিয়ে কখনো হতোদ্যম হইনি, অন্ততপক্ষে প্রযোজকের দিক থেকে। চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রায় ২০ বছর ধরে একই মানুষের সাথে কাজ করছি। তারা আমাকে শুরু থেকে এই পর্যন্ত দেখছে। প্রযুক্তির চাহিদা চলচ্চিত্র নির্মাতাকে দাসে পরিণত করে, কিন্তু এখানে সবকিছু মানুষের সাহায্যে হয়। ক্যামেরাম্যান, অপারেটর, প্রধান ইলেকট্রিশিয়ান আমরা সকলেই একে অপরকে ভালোভাবে জানি এবং বুঝতে পারি সহজে। আমি কদাচিৎই তাদেরকে কী করতে হবে বলি। এটাই আদর্শ এবং এটা সৃজনশীল কাজকে সহজ করে তোলে। অবশ্যই মার্কিন কোম্পানির জন্য চলচ্চিত্র নির্মাণ একটা লোভনীয় ব্যাপার। কিন্তু তা প্রথমটির জন্য নয়, দ্বিতীয়টির জন্য। আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে এবং প্রযোজকের সাথে একই সম্পর্ক ঠিক রেখে, কাজ করার পুরো সময়টাতে আমার নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকবে কি? আমার মনে হয় না।
প্লেবয়: আপনি একবার বলেছিলেন, এমন কি স্টকহোমে আপনার সেটের বাইরে কারও সাথে সাক্ষাৎ করবেন না, যেখানে বাইরের কারও প্রবেশ নিষেধ, কেন?
বারিমান: আপনি কি জানেন ছবি বানানোটা কী? প্রতিদিন আট ঘণ্টার কঠিন শ্রমে আপনি পাবেন তিন মিনিটের ফিল্ম। যদি খুব ভাগ্যবান হন তবে যা সৃষ্টি হবে তার আয়ুষ্কাল হবে ৮ থেকে ১০ মিনিট। হয়তো বা তাও হবে না। এরপর আবার আট ঘণ্টা শ্রম দিয়ে দশ মিনিটের কাজ আশা করবেন। সেটের প্রত্যেকটা মানুষ উৎকীর্ণ হয়ে থাকে এই একটু সত্যিকারের সৃষ্টি দেখার জন্য। এ সময় শিল্পী এবং আপনার নিজেকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতে হবে নির্দিষ্ট বলয়ে। আর বাইরের প্রেক্ষাপটে, যদি তা বন্ধুত্বপূর্ণও হয়, তা আপনার কাছে অপরিচিত মনে হবে। যে কোন সময় বহিরাগত কেউ সেটে প্রবেশ করে মনোযোগের বিঘ্ন ঘটাতে পারে অভিনেতাদের, টেকনিশিয়ানদের এমনকি আমারও। তা হয়তো আমার কাজের খুব অল্প সময় নষ্ট করবে। কিন্তু তাও আমরা নষ্ট করতে চাই না। খুব অল্প সময়েই আমি ভিন্ন কিছু তৈরি করি। আর সেজন্য আমি অনুতপ্ত হতে চাই না।
প্লেবয়: আপনার সমালোচকরা বলেন আপনার সেটে কাউকে ঢুকতে তো দেনই না বরঞ্চ অনেককে বের করে দেন। এমনকি রেগে গেলে ফোন ছুঁড়ে মারেন দেয়ালে অথবা চেয়ার ছুঁড়ে ফেলেন কাঁচের বুথে, এগুলো কি সত্য?
বারিমান: হ্যাঁ, এরকমই। যখন আমি তরুণ ছিলাম, টগবগে তরুণ, অন্য অনেক তরুণের মতই নিজের সম্পর্কে অনিশ্চিত ছিলাম। কিন্তু খুবই উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলাম। এবং যখন আপনি অনিশ্চিত ও অনিরাপদ তখন নিজ ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য মরিয়া হয়ে উঠবেন এটাই স্বাভাবিক। নিজের পথ করে নেওয়ার জন্য আগ্রাসী হয়ে উঠবেন। আমার ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। প্রাদেশিক মঞ্চে যখন নির্দেশক হিসেবে কাজ করছিলাম তখন আজ যে ব্যবহার করি তা করতাম না। তখন আমার অভিনেতা ও কলাকুশলীদের সম্মানের চোখে দেখতাম। কিন্তু যখন দিনের প্রতিটি মিনিটের গুরুত্ব বুঝতে পারলাম, যখন শান্ত পরিবেশ ও সেটের নিরাপত্তার বিষয়টা অনুভব করলাম তখনও কি আমি আগের মত রয়ে যাব, আমি চুপচাপ থেকে নিজেকে শেষ করে দেব এটা আপনি ভাবতে পারেন? মুভির সেটে একজন পরিচালক একটি জাহাজের ক্যাপ্টেনের মত, তার প্রাপ্য সম্মানটুকু তাকে আদায় করে নিতে হবে। আমি ২৫-২৬ বছর আগে এমন ব্যবহার করতাম না।
প্লেবয়: এই বদমেজাজের কাহিনী এখনও পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
বারিমান: অবশ্যই, প্রকাশিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। সাংবাদিকরা তাদের সম্পাদক ও পাঠকদের কাছে এ ধরণের চটকদার খবর পৌঁছে দেয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে। একজন পরিচালক মেজাজ না দেখিয়ে শান্তভাবে কথা বলে তার অভিনেতাদের মনোবল চাঙ্গা করে তুলেছে, পাঠকের কাছে এমন খবরের তো কোন আকর্ষণ নেই। মানুষ বছরের পর বছর এই ধরণের খবর আশা করে। আপনি কি বুঝতে পারছেন কেন আমি প্রেসের সাথে কলা বলা পছন্দ করি না? মানুষ বলে আমি সাংবাদিকদের চোখের সামনে দেখতেও ইচ্ছুক না, আমি তাদের সাথে যেকোন ধরণের সাক্ষাৎকার প্রত্যাখ্যান করি। এই একটি ক্ষেত্রে তাদের ধারণা সঠিক। যখন কোন সাংবাদিককে কথা বলার জন্য সময় দেই তখন তাদের সাথে ভাল ব্যবহারই করি। কথা শেষে পত্রিকা অফিসে গিয়ে তারা সব ভুলে যান, সম্পাদক আমার এইমাত্র বলা কথাগুলো ছুঁড়ে ফেলে পুরনো কথাগুলো আবার প্রকাশ করে। কেননা তারা মনে করে আমার সত্য কথার তুলনায় পুরনো গালগল্পগুলো অনেক চটকদার। কয়েক বছর আগে আমেরিকার একটি পত্রিকায় আমাকে নিয়ে এমনই একটা কাভার স্টোরি লেখা হয়েছিল।
প্লেবয়: টাইম ম্যাগাজিন?
বারিমান। হ্যাঁ, তাই। বের হওয়ার পর আমার স্ত্রী আমাকে পড়ে শুনিয়েছিল। পত্রিকায় যে মানুষটার কথা বলা হচ্ছিল তার সাথে পরিচিত হতে খুব ইচ্ছা হচ্ছিল আমার- কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সে খুব একটা ভাল মানুষ নয়, কিন্তু বেশ আকর্ষণীয়। কিন্তু পত্রিকার এই মানুষটার মধ্যে আমি নিজেকে খুঁজে পাইনি। আমি জানি সে সত্যিকারের কেউ নয়।
প্লেবয়: আপনার কিছু সিনেমার অর্থবোধকতা নিয়ে সমালোচনা করা হলে তার খুব সামান্যই আপনি মেনে নিয়েছেন, এটা কি সত্য?
বারিমান: আমি এগুলোকে পাত্তাই দেই না। এগুলো বিরক্তিকর। অধিকাংশ সমালোচকই জানে না কিভাবে একটি সিনেমা বানাতে হয়। চলচ্চিত্রের সংস্কৃতি সম্পর্কে তাদের জ্ঞান অতি সামান্য। কিন্তু আমরা একটা নতুন প্রজন্ম পেয়েছি যাদের সিনেমা সম্পর্কে অনেক জানাশোনা রয়েছে। কিছু তরুণ ফরাসি সমালোচকের সমালোচনা আমি পড়ি। তাদের মতামতের সাথে সবসময় একাত্মতা প্রকাশ করি না, কিন্তু তারা যোগ্য। তাদের কোন বক্তব্য আমার বিপক্ষে গেলেও আমি তাদের স্বীকৃতি দেই।
প্লেবয়: আপনার সিনেমার নেতিবাচক সমালোচনা করা হয়েছে বেশ কয়েকটি কারণে, যেমন- ব্যক্তিগত অর্থবোধকতা, বেশ কিছু অংশের অস্পষ্টতা, প্রতীকধর্মীতা ইত্যাদি। এই অভিযোগগুলো স্বীকার করেন?
বারিমান: সম্ভবত আমি তা মনে করি না। কারণ সিনেমা বানানোর সময় পরিচালক দর্শকদের সিনেমার সাথে একাত্ম করতে চান। এটা অবশ্যই কঠিন কাজ। ব্যক্তিগত সিনেমা তৈরি করা সহজ, আমি মনে করি না কোন পরিচালকের সহজ সিনেমা বানানো উচিত। পরিচালক চেষ্টা করবেন তার একেকটি সিনেমার মাধ্যমে দর্শকদের একটু একটু করে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে। সাধারণ জনগণের জন্য এটা ভাল। কিন্তু পরিচালকের কখনও ভুলে গেলে চলবে না তিনি কার জন্য সিনেমা বানাচ্ছেন। আর যাই হোক, আমার সিনেমা দেখে দর্শকরা মেধা খাটিয়ে সেটা নিমেষের মধ্যে বুঝে ফেলবে সেটা আমি চাই না, তারা সিনেমাটিকে হৃদয়ে ধারণ করুক সেটাই চাই। হৃদয়ই এখানে মুখ্য।
প্লেবয়: তারা আপনার সিনেমা কেমন বুঝেছেন জানি না, তবে এটা ঠিক যে অনেক আন্তর্জাতিক সমালোচক আপনাকে বিশ্ব চলচ্চিত্রের শীর্ষস্থানীয় পরিচালকদের সারিতে সম্মানের আসন দিয়েছেন। এ ধরণের র্যাংকিং সম্পর্কে আপনার কী মত?
বারিমান: বহির্বিশ্বে সফলতাই সুইডেনে আমার কাজকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। আমি মৌলিক সৃষ্টি নিয়ে কারও সাথে প্রতিযোগিতা করতে ইচ্ছুক নই। সাফল্যে সবসময় অনুপ্রাণিত হই, কাজের মাধ্যমে সেটা অর্জন করি। চলচ্চিত্র জগতে সাফল্য খুব ক্ষণস্থায়ী। প্যারিসে কয়েক বছর আগেও আমি ছিলাম সফল পরিচালক। তারপর আন্তোনিওনি আসল। তিনি নতুন একজন। কেউ কি তাকে চিনে? এই নবীন সৃজনশীল পরিচালক যখন সিনেমা বানাতে শুরু করলেন তখন আমি তার প্রতি ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়েছিলাম। ঈর্ষার বশবর্তী হয়েই ফিল্ম লাইব্রেরি থেকে নিয়ে তার সব সিনেমা দেখলাম। সিনেমার টেকনিক্যাল বিষয় সব যে তার জানা তা নয়। টেকনিক্যাল দিক থেকে আমি তার চেয়ে অনেক বেশি উজ্জ্বল। এটাই আমাকে আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছিল। এখন আমি অন্য কোন পরিচালকের সিনেমা দেখে ঈর্ষান্বিত বা ভীত হই না। কারণ জানি, ভীত বা ঈর্ষান্বিত হওয়ার কোন কারণ নেই।
প্লেবয়: সিনেমার স্টাইল ও কৌশলের ক্ষেত্রে অন্য পরিচালকদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন?
বারিমান: সিনেমা সম্পর্কে সবকিছু আমার নিজে থেকেই জানতে হয়েছে। মঞ্চের ক্ষেত্রে এটা ঠিক না, গোটেবর্গে চার বছর থাকার সময় এক বর্ষীয়ান পণ্ডিতের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছিলাম। সে কঠোর হলেও মঞ্চ সম্পর্কে সবকিছু জানতো, তার কাছ থেকে অনেক কিছু জেনেছি। কিন্তু সিনেমার জগতে আমার কোন শিক্ষক ছিল না। যুদ্ধের আগে আমি স্কুলে পড়তাম, আর যুদ্ধের সময় কোন বিদেশী সিনেমা দেখার উপায় ছিল না। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর স্ত্রী ও তিন সন্তানের ভরণ পোষণের জন্য কঠোর পরিশ্রম করছিলাম। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে আমি স্বশিক্ষায় খুব দক্ষ ছিলাম, যদিও এই গুণ সবসময় উপকারী না। কারণ স্বশিক্ষিতরা অনেক সময় টেকনিক্যাল বিষয়গুলোকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়, টেকনিক্যাল নৈপুণ্য নিয়ে বেশি চিন্তা করে, এটা নিশ্চিত করার পরই কেবল অন্যদিকে মনোযোগ দেয়। আমার মনে হয় সিনেমায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, কিছু বলা।
প্লেবয়: আপনার কি মনে হয় আমেরিকার নিউ ওয়েভ পরিচালকদের কিছু বলার আছে?
বারিমান: হ্যাঁ, আছে। আমি তাদের খুব বেশি সিনেমা দেখিনি। “দ্য কানেকশন”, “শ্যাডোস” এবং “পুল মাই ডেইজি” বারবার দেখার মত সিনেমা। যতদূর দেখেছি সে অনুসারে ফরাসি নিউ ওয়েভের তুলনায় মার্কিন নিউ ওয়েভ আমার বেশি পছন্দ। মার্কিনরা অনেক বেশি উৎসুক, আদর্শবাদী, তাদের সিনেমা নৈপুণ্যে ফরাসিদের চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও সিনেমার মাধ্যমে তারা কিছু বলতে চায়। এই বলার চেষ্টাটাই ভাল। এটাই গুরুত্বপূর্ণ এবং আমার পছন্দের।
প্লেবয়: যেসব রুশ সিনেমা দেখেছেন সেগুলো কি ভাল লেগেছে?
বারিমান: খুবই ভাল লেগেছে। রুশদের কাছ থেকে শীঘ্রই চমৎকার কিছু বেরিয়ে আসবে বলে মনে করি। কারণ জানি না, কিন্তু আমার মনে হয়। “চাইল্ডহুড অফ আইভান” দেখেছেন? এটাতে অনন্যসাধারণ কিছু বিষয় আছে। রাশিয়ার অনেক সিনেমাই বেশ খারাপ সন্দেহ নেই, কিন্তু সেখানে মেধা ও শক্তি আছে।
প্লেবয়: ইতালীয় পরিচালকদের সম্পর্কে কি মনে করেন?
বারিমান: ফেলিনি চমৎকার। আমি যা নই ফেলিনি ঠিক তাই। আমার তার মত হতে চাওয়া উচিত। তার মধ্যে বারোক যুগের প্রচুর উপাদান আছে। তার সিনেমা প্রচণ্ড উদার, উষ্ণ, সহজবোধ্য এবং স্নায়ুর উপর খুব কম চাপ ফেলে। “লা দোলচে ভিতা” আমার খুবই পছন্দের সিনেমা, বিশেষ করে বাবার সাথের দৃশ্যটা অসাধারণ। বিশাল মাছের সাথে করা শেষ দৃশ্যটাও চমৎকার। ভিসকন্তির প্রথম সিনেমাটা খুব ভাল লেগেছিল- লা তেরা ত্রেমা। এটাই বোধহয় তার সেরা সিনেমা। আন্তোনিওনির “লা নোত্তে” ও খুব ভাল লেগেছিল।
প্লেবয়: জীবনে দেখা সেরা সিনেমা বেছে নিতে বললে কি এগুলোই বেছে নেবেন?
বারিমান: না, আমার মনে হয় সমসাময়িক সিনেমার মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় তিনটি: দ্য ল্যাডি উইথ দ্য ডগ, রাশোমোন এবং Umberto D. ও হ্যাঁ, আরেকটা আছে, চতুর্থ, “মিস্টার হুলোস হলিডে”, এই সিনেমাটা ভালোবেসে ফেলেছিলাম।
প্লেবয়: আচ্ছা আপনার সিনেমার কথায় ফিরে আসি। আপনার সর্বশেষ এবং সবচেয়ে বিতর্কিত সিনেমা “দ্য সাইলেন্স” এর ধারণা কিভাবে পেয়েছেন?
বারিমান: এক বিশালবপু বৃদ্ধের কাছ থেকে। হ্যাঁ, ঠিক তাই। চার বছর আগে এক বন্ধুকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলাম। হাসপাতালে তার রুমের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি, খুব মোটা ও প্যারালাইজড এক বৃদ্ধ পার্কে একটি গাছের নিচে চেয়ারে বসে আছে। দেখলাম, চার জন সুশ্রী ও হাশিখুশি নার্স এসে তাকে চেয়ার সমেত উঠিয়ে হাসপাতালের ভেতরে নিয়ে গেল। কেন জানি দৃশ্যটা অন্তরে গেঁথে গিয়েছিল। আমার অন্য অনেক ছবির মত এবারও একটিমাত্র দৃশ্য থেকে চিত্রনাট্যের কাঠামোটা তৈরি করে ফেললাম। আমি প্রায় সব সময়ই এভাবে সিনেমার থিম পাই- ছোট্ট একটা অনুভূতি, কারো বলা ছোট্ট কোন কথা, হয়তোবা কোন ইশারা বা কোন অভিনেতার ছোট্ট একটি মুখভঙ্গি। এরকম ছোট ছোট ঘটনা থেকেই চিন্তা শুরু করি এবং এক সময় তা পূর্ণতা অর্জন করে। আরও সূক্ষ্ণভাবে বললে, আমার চিত্রনাট্যগুলো বেরিয়ে আসে আত্মার তাগিদ থেকে, এই তাগিদেরও রকমফের আছে, একেক সময় তা একেক রূপে আবির্ভূত হয়। আমার অধিকাংশ সিনেমাই শুরু হয় কোন বিশেষ দৃশ্য বা অনুভূতি দিয়ে। এই সূচনাকে ঘিরেই আমার কল্পনাশক্তি কাজ করে এবং সেটাকে পরিপূর্ণতার দিকে নিয়ে যায়। বিভিন্ন সময়ে আমার চিন্তাগুলো আলাদা আলাদা করে লিখে রাখি, নোটের আকারে। এভাবে মাথায় অনেকগুলো বিচ্ছিন্ন ধারণা তৈরি হয়ে থাকে যাদেরকে বলা যায় মানসিক ফাইল। কয়েক বছর কেটে যাওয়ার পর এই ঘটনাগুলো ধারাবাহিকভাবে একটি পূর্ণাঙ্গ দৃশ্যে রূপান্তরিত হয়। একটা প্রজেক্ট শুরু হওয়ার পর আমার সেই মানসিক ফাইলগুলো খুলে দৃশ্যায়ন শুরু করি, চরিত্রগুলো সেভাবেই সাজাই। অনেক সময় মানসিক ফাইল থেকে করা চরিত্রগুলোর সাথে চিত্রনাট্যের অন্য চরিত্রগুলোর বনিবনা হয় না। তখন ফাইলের চরিত্র ফাইলে ফিরিয়ে নিয়ে যাই, অন্য কিছু খুঁজতে শুরু করি। আমার সিনেমা শুরু হয় স্নোবলের মত করে, বরফের একটি ছোট্ট কণা থেকে খুব ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে। এমনকি মাঝেমাঝে সিনেমা শেষ হলে শুরুর সেই ছোট্ট বরফকণার কথাই ভুলে যাই।
প্লেবয়: কিন্তু প্যারালাইজড বৃদ্ধ থেকে পাওয়া সেই ছোট্ট বরফকণা থেকে কিভাবে দ্য সাইলেন্স এর এক্সপ্লিসিট সেক্স ও মাস্টারবেশনের দৃশ্য উঠে এল তা সহজে বোঝা যায় না। যে এক্সপ্লিসিট দৃশ্যগুলো বিশ্বময় বিতর্কের জন্ম দিয়েছে তার সঠিক তাৎপর্য বোঝা কঠিন হয়ে গেছে। আপনি কেন পর্দায় সেক্স দেখানোর এই গ্রাফিক্যাল পন্থাটা বেছে নিলেন?
বারিমান: অনেক দিন ধরেই আমার সিনেমায় সেক্স দৃশ্যায়নের ব্যাপারে খুব প্রথাগত ছিলাম, খানিকটা ভয়েও ছিলাম। কিন্তু সিনেমায় সেক্স সঠিকভাবে বিকশিত করা বিশেষ করে আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমি কেবল ইন্টেলেকচুয়াল সিনেমা বানাতে চাই না। আমি চাই দর্শকরা আমার সিনেমা অনুভব করুক, তাদের চেতনায় সেটা প্রবেশ করুক। বোঝার চেয়ে এটাকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। গ্রীষ্মকালের একটি সুন্দর সকালের দৃশ্যের সাথে সেক্স এর দৃশ্যের অনেক মিল আছে। কিন্তু আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, গ্রীষ্মের সুন্দর সকাল চিত্রায়িত করার উপায় জানলেও সেক্সকে সুন্দরভাবে চিত্রায়িত করার উপায় আমি এখনও বের করতে পারিনি। আর ভালোবাসার ইন্টেরিয়র অ্যানাটমি নিয়ে আমি খুবই আগ্রহী। সেক্স পরবর্তী সন্তুষ্টি দেখানোর চেয়ে তাই সে ইন্টেরিয়র অ্যানাটমি দেখানো আমার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
প্লেবয়: অনেকে বলছেন দ্য সাইলেন্স এর মার্কিন সংস্করণে প্রায় দুই মিনিটের মত ইরটিক দৃশ্য কেটে নেয়ায় মুভিটা তার স্বাভাবিকত্ব হারিয়েছে, তার মূল বৈশিষ্ট্যই নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এর সাথে কি আপনি একমত?
বারিমান: এ বিষয়ে আমার কোন মন্তব্য করা ঠিক হবে না। আমি করছিও না।
প্লেবয়: ঠিক আছে। কিন্তু এমন কি হতে পারে না যে, মার্কিন কর্তৃপক্ষের এই সেন্সরের কারণে ভবিষ্যতে আপনি নিজের উপর একটি সেন্সরশিপ আরোপ করতে পারেন যাতে তা মার্কিন দর্শকরা কাটছাট ছাড়াই দেখতে পারে?
বারিমান: না, কখনোই নয়।
প্লেবয়: সিনেমার বহুল বিতর্কিত দৃশ্যগুলোতে থুলিন ও লিন্ডব্লোম এর মত অভিনেত্রীদেরকে এত অকপটে অভিনয় করাতে রাজি করালেন কিভাবে?
বারিমান: শুধু তাদের না, অন্য সব অভিনেতা-অভিনেত্রীদেরকে আমি যেভাবে পেয়েছি ঠিক সেভাবেই তাদেরকে এই দৃশ্যগুলোতে অভিনয় করিয়েছি। আমার অভিনয়শিল্পীরা এটা মেনেই সিনেমায় আসেন যে আমার যে কোন সিনেমায় যে কোন দৃশ্যে অভিনয় করতে প্রস্তুত থাকবেন। আমরা খুব স্বাভাবিক ও সাবলীলভাবে আলোচনা করি, দৃশ্যটিতে তাদের কি করতে হবে। অনেকে দাবী করে, আমি নাকি অভিনেতাদের সম্মোহিত করে তাদের কাছ থেকে এমন অভিনয় আদায় করে নিই। যত্তসব আজগুবি কথাবার্তা! আমি কেবল তাদেরকে সেই জিনিসটা দিতে চাই যা ছাড়া কারও পক্ষে সফল অভিনেতা হওয়া সম্ভব না: আত্মবিশ্বাস। একজন অভিনেতা কেবল এটাই চায়। পরিচালক যা চাচ্ছেন তার পুরোটা অভিনয় করে দেখানোর ক্ষমতা তার মধ্যে তখনই আসবে যখন সে আত্মবিশ্বাসী হবে। তাই আত্মবিশ্বাস ও বিশ্বস্ততা দিয়ে আমি আমার শিল্পীদের ঘিরে রাখি। আমি অনেক সময় তাদের সাথে সিনেমা নিয়ে কথা না বলে সাধারণ কথাবার্তা বলি যাতে তারা স্বাভাবিক থাকতে পারে। এটাই যদি জাদু হয় তাহলে বলতেই হয় আমি একজন জাদুকর। তারপরও একটা কথা না বললে নয় যে, দীর্ঘদিন ধরে একই অভিনেতা, কলাকুশলীদের সাথে কাজ করায় আমাদের স্টুডিওতে বিশ্বস্ততার একটা আবহ তৈরি হয়ে গেছে যা কাজে অনেক সাহায্য করে।
প্লেবয়: আজ থেকে পাঁচ-ছয় বছর আগে আপনি বলেছিলেন, “আমি দরকার হলে আমার মেধাকে বেশ্যাবৃত্তিতে কাজে লাগাবো, অন্য কোন উপায় না থাকলে চুরি করবো, আমার বন্ধু বা অন্য কাউকে খুন করলে যদি শিল্পের সাহায্য হয় তবে তাই করবো।” এই বক্তব্যকে আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
বারিমান: আমি তখন অনেক বেশি রক্ষণাত্মক ছিলাম। যখন একজন মানুষ নিজেকে ভালভাবে জানে না, বিশ্বে তার অবস্থান এমনকি তার সৃজনশীলতা নিয়েও চিন্তিত থাকে তখন সে নিজেকে আক্রমনাত্মক উপায়ে প্রকাশ করতে চায়, কেবলমাত্র কঠোর সমালোচনা ঠেকানোর উদ্দেশ্যে। কিন্তু একবার সফল হয়ে যাওয়ার পর মানুষ সাফল্যের শর্তগুলো থেকে মুক্ত হয়ে যায়। লড়াইয়ে টিকে থাকার আর কোন প্রয়োজন পড়ে না, সে তার কাজে ভালভাবে মনোনিবেশ করতে পারে। তখন জীবন অনেক সহজ হয়ে যায়। নিজেকে পছন্দ হতে শুরু করে। যেমন এখন আমি জীবনটা আগের চেয়ে অনেক বেশি উপভোগ করছি, বুঝতে শুরু করেছি যে এমন অনেক কিছু আছে যা আমি দেখি নি। নিজেকে খানিকটা বুড়োও মনে হচ্ছে, তবে খুব বেশি না।
আরেকটা ব্যাপার হল, আমি মনে করতাম জীবন বা শিল্পে সমঝোতার কোন স্থান নেই। ভাবতাম একজন মানুষের জন্য সবচেয়ে খারাপ কাজ হতে পারে সমঝোতা করা। কিন্তু এটা ঠিক যে আমি নিজেই অনেক সময় আপোস করেছি। এটা আমাদের সবাইকেই করতে হয় এবং আমরা করি। এছাড়া বেঁচে থাকা সম্ভব না। কিন্তু একটা দীর্ঘ সময় আমি অনেক কিছুর সাথে আপোস করে চলছি এটা জানার পরেও মেনে নিতে চাইতাম না, নিজেকে আপোসহীন বলে সান্ত্বনা দিতাম। মনে করতাম আমি সবকিছুর উপরে উঠতে পারব। কিন্তু এখন জানি যে সেটা সম্ভব না। এখন বুঝতে পেরেছি, সবচেয়ে বড় বিষয় হল বেঁচে থাকা এবং বেঁচে যে আছি তা বুঝতে পারা। মৃত বা অর্ধমৃত মানুষের সাথে বাস করা তো সম্ভব না। অনুভব করতে পারাটাই এখন আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। উইন্টার লাইট এ আমি এটাই তুলে ধরতে চেয়েছিলাম। এই সিনেমা আমাকে নিয়ে যদিও খুব কম মানুষই তা বুঝেছে। এখন যেহেতু আপনারা শীতের মাঝখানে স্টকহোমে এসেছেন, আশাকরি উইন্টার লাইট বুঝতে শুরু করবেন। এই সিনেমা সম্পর্কে আপনাদের মত কী?
প্লেবয়: আমরা আসলে সিনেমা সম্পর্কে আপনার মত নিয়েই বেশি আগ্রহী।
বারিমান: আচ্ছা আমিই বলি। এটা বেশ কঠিন সিনেমা, আমার বানানো সবচেয়ে কঠিন সিনেমাগুলোর একটি। দর্শকদের পরীশ্রম করতে হবে। “থ্রু আ গ্লাস ডার্কলি” থেকে প্রগতির মাধ্যমে এর জন্ম হয়েছে এবং এটা বাড়তে বাড়তেই এক সময় “দ্য সাইলেন্স” এর জন্ম দিয়েছে, অর্থাৎ সাইলেন্স এ এটার থিমই বয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সিনেমা তিনটি এক সাথে অবস্থান করে। এগুলো বানানোর উদ্দেশ্য ছিল, মানুষে মানুষে যোগাযোগের গুরুত্বকে নাট্যায়িত করা, মানুষের অনুভব করার ক্ষমতাকে চিত্রায়িত করা। অনেক সমালোচক বলেছেন ঈশ্বর এবং তার অনুপস্থিতিই এগুলোতে মুখ্য যা ঠিক না। এগুলোর মূল বক্তব্য ভালোবাসা রক্ষার শক্তি। এই সিনেমাগুলোর অধিকাংশ চরিত্রই মৃত, সম্পূর্ণ মৃত। কিভাবে ভালোবাসতে হয় বা কিভাবে অনুভব করতে হয় তা তারা জানে না। নিজেদের বাইরে কারও কাছে পৌঁছতে পারে না বলেই তারা হারিয়ে গেছে।
উইন্টার লাইট এর প্যাস্টর চরিত্রটি কিছুই না। আশাকরি বুঝতে পেরেছেন যে সে প্রায় মৃত। অন্য সবার থেকে সে বিচ্ছিন্ন। কেন্দ্রীয় চরিত্র হচ্ছে নারীটি। সে ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না, কিন্তু শক্তিশালী, সে ভালোবাসতে পারে। যেসব নারী ভালোবাসতে পারে তারা ভালোবাসার মাধ্যমে অনেক কিছু রক্ষা করতে পারে। কিন্তু সমস্যা হল এই ভালোবাসা কিভাবে প্রকাশ করতে হয় তা উইন্টার লাইট এর নারীটি জানে না। সে কুৎসিত ও কদর্য। সে প্যাস্টরকে শ্বাসরুদ্ধ করে রাখে এবং এজন্যই প্যাস্টর তাকে ঘৃণা করে, কুৎসিত চেহারাও একটা কারণ। কিন্তু এই নারী একসময় ভালোবাসা প্রকাশ করতে শিখে যায়। সিনেমার শেষ দিকে যখন সবাই বিকেল তিনটার চার্চ সার্ভিসের জন্য জড়ো হয় কেবল তখনই এক দিক থেকে চিন্তা করলে নারীটির প্রার্থনা মঞ্জুর হয়। সার্ভিস প্যাস্টরের কাছে সম্পূর্ণ অর্থহীন হয়ে পড়ে, তারপরও সেই শূন্য চার্চের সার্ভিসে যোগদানের মাধ্যমে সে ভালোবাসার পথে প্রথম পদক্ষেপ নেয়। এটা অনুভূতির দিকেও তার প্রথম পদক্ষেপ, কিভাবে ভালোবাসতে হয় তার দিকেও। এখানে তাই ভালোবাসাই আমাদের রক্ষা করে, ঈশ্বর নয়। আমরা সর্বোচ্চ এই ভালোবাসারই আশা করতে পারি।
প্লেবয়: ট্রিলজির অন্য দুটি সিনেমাতে এই থিমটি কিভাবে এসেছে?
বারিমান: লক্ষ্য করলে দেখবেন, প্রত্যেক সিনেমারই একটি যোগাযোগের মুহূর্ত থাকে , মানবিক যোগাযোগের মুহূর্ত: থ্রু আ গ্লাস ডার্কলি-র শেষ দৃশ্যে ছেলেটি বলে “Father spoke to me”; উইন্টার লাইটের শেষে প্যাস্টর শূন্য চার্চে কেবল মার্টার জন্য সার্ভিস পরিচালনা করে; দ্য সাইলেন্স এর শেষে ছেলেটি এস্টারের চিঠি পড়ে। প্রতি সিনেমাতেই এই মুহূর্তগুলো খুব ছোট কিন্তু প্রচণ্ড গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় বিষয় হল অন্য আরেক জন মানুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা। অন্যথায় আপনি মৃত, মাটির সাথে মিশে যাওয়া লক্ষ-কোটি মৃত মানুষের মতই। কিন্তু কেউ যদি যোগাযোগ, অন্যকে বোঝা বা ভালোবাসার পথে কেবল প্রথম পদক্ষেপটি নিতে পারে এবং এ নিয়ে তার মধ্যে কোন ভ্রম না থাকে তাহলে এটাই তার জীবনের জন্য যথেষ্ট। কারণ ভবিষ্যৎ যত কঠিনই হোক না কেন সে বেঁচে থাকতে পারবে, ভালোবাসাই তাকে রক্ষা করবে। কিন্তু ভ্রমের মধ্যে বাস করলে পৃথিবী ভরা ভালোবাসাও তার কিছু করতে পারবে না। ভালোবাসাই তো সবচেয়ে বড় বিষয়, তাই না?
প্লেবয়: অনেক সমালোচক তো মনে করেন, আপনার সবচেয়ে ব্যবসাসফল সিনেমা “ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিস” এও এই থিম কাজ করেছে, এতেও ভালোবাসার মাধ্যমে মুক্তির সন্ধান করা হয়েছে। এই সিনেমার বৃদ্ধ চিকিৎসক চরিত্রটি সম্পর্কে এক সমালোচক লিখেছেন, “সারা জীবন নিজের আবেগ লুকিয়ে রাখার পর অবশেষে সে সহানুভূতির সন্ধান পায়, হৃদয়ের পরিবর্তনই তার মুক্তি এনে দেয়।” এই কথা কি ঠিক?
বারিমান: কিন্তু সে নিজেকে পরিবর্তন করে না, করতে পারেও না। এটাই ঠিক। আমি মনে করি, মানুষ চাইলেই নিজের পরিবর্তন করতে পারে না, মৌলিক পরিবর্তন আসলেই অসম্ভব। আপনিও কি তা মনে করেন না? তারা এক মুহূর্তের জন্য আলোর সন্ধান পেতে পারে, সেই সময়ে নিজেকে দেখতে পারে, সচেতন হতে পারে, কিন্তু এই মুহূর্তটাই সব, এর বেশি আশা করা যায় না। উইন্টার লাইট এ নারী চরিত্রটি শক্তিশালী, সে দেখতে পারে। সে নিজের সম্পর্কে সচেতন হয়েছে, কিন্তু তাই বলে তাদের জীবন পরিবর্তিত হয়ে যাবে না। তাদের জীবন ভয়াবহই থেকে যাবে। মুক্তির মুহূর্তটি আসার পর তাদের জীবনে কি হয়েছে তা নিয়ে সিনেমা করার কথা আমি ভাবতেও পারি না, কোনকিছুর বিনিময়েই না। আমাকে ছাড়াই এই চরিত্রগুলোকে বাকি জীবন পার করতে হবে।
প্লেবয়: উইন্টার লাইট এর মার্টা চরিত্র সম্পর্কে বলতে হয়- আপনি নারী প্রোটাগনিস্ট চরিত্রগুলো রূপায়নে অনেক গভীরতা ও সহানুভূতি দেখিয়েছেন, অনেকেই আপনার এই দিকটার প্রশংসা করেছে। এটা কিভাবে করেছেন?
বারিমান: আপনি হয়তো জিজ্ঞেস করবেন আমি নারীদের কিভাবে এত ভাল বুঝেছি। অনেক আগে থেকেই “নারী” বিষয়টি নিয়ে আমার আগ্রহ ছিল, সিনেমাতে তাদেরকে এত উদ্ভটভাবে দেখানো হয় বলেই আগ্রহী হয়েছিলাম। আমি এ অবস্থা পরিবর্তনের চেষ্টা করেছি। নারীরা যেমন ঠিক তেমনভাবেই তুলে ধরেছি, অন্তত ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে তাদেরকে যেমন অদ্ভুতভাবে দেখানো হয়েছে তার পরিবর্তন করেছি। বর্তমানে নারী চরিত্র রূপায়নে বাস্তবতার একটু কাছাকাছি থাকলেই তা পুরনো সিনেমার চেয়ে অনেক ভাল হয়ে যায়, আগের সিনেমাগুলোর অবস্থা এতই খারাপ ছিল। যাহোক, গত কয়েক বছরে আমি বুঝতে পারছি, মৌলিক দিক দিয়ে পুরুষ ও নারী একই, তাদের সবার সমস্যাই এক ধরণের। তাই আমার সিনেমায় এখন আর নারীদের গল্প বা নারীদের সমস্যা বলে কিছু নেই, পুরুষের গল্প বা পুরুষদের সমস্যার সাথে তা একাকার হয়ে গেছে। সবকিছু আমার কাছে এখন কেবলই মানবিক সমস্যা। মানুষই এখন আমার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।
প্লেবয়: আপনার পরবর্তী সিনেমাতে কি কোনভাবে অধুনা সমাপ্ত এই ট্রিলজির ছাপ থাকবে?
বারিমান: না, আমার নতুন সিনেমাটা কমেডি, ইরটিক কমেডি, খানিকটা ভূতের গল্প। এটা আমার প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র এবং আপাতত কিছুদিনের জন্য এটাই আমার শেষ সিনেমা হতে যাচ্ছে।
প্লেবয়: সিনেমাটার নাম কী?
বারিমান: “অল দি উইমেন”। আমেরিকার দর্শকরা এটা পছন্দ করতে পারে। এর থিম সঙ্গীত হচ্ছে “ইয়েস, উই হ্যাভ নো ব্যানানাস”। এটা করে আমি বেশ আনন্দ পাচ্ছি। ইতিমধ্যে একজন সুয়েডীয় লেখককে বলে দিয়েছি যে, এই সিনেমার মাধ্যমে “Bergman Ballyhoo Era” শুরু হতে যাচ্ছে। ফাইনাল কাটিং শেষ করতে আর বেশি দিন বাকি নেই। আপনি তো জানেনই, আমি নিজের সিনেমাকে ইচ্ছেমত কাটছাট করতে ইতস্তত করি না। নিজের সিনেমাকে কাটছাট করার সাথে অনেক পরিচালকের যে ভালোবাসা-ঘৃণার সম্পর্ক থাকে তা আমার মধ্যে নেই। ডেভিড লিন একবার আমাকে বলেছিলেন, তিনি শ্যুটিং শেষে সিনেমা কাটছাট করাটা একেবারেই পছন্দ করেন না, এটা তাকে রীতিমত অসুস্থ করে ফেলে। সেদিক থেকে আমি পুরোপুরি মুক্ত।
প্লেবয়: একটু আগেই আপনি বললেন, আপাতত কিছুদিনের জন্য এটাই আপনার শেষ সিনেমা হতে যাচ্ছে। এই কিছুদিনটা কত দিন?
বারিমান: সম্ভবত দুই বছর। আমি এই রয়েল ড্রামাটিক থিয়েটারে পরিচালক হিসেবে পুরোদমে কাজ শুরু করতে চাই। বেশ কয়েকটি কারণে মঞ্চ আমাকে খুব আকর্ষণ করে: প্রথম কারণ এর চাহিদা সিনেমার চেয়ে অনেক কম। সিনেমার ফুটেজ তৈরির জন্য যে পরিমাণ যন্ত্রপাতি লাগে তার দয়া থেকে মুক্ত থাকা যায়, আর মঞ্চে আপনি কখনোই নিঃসঙ্গ বোধ করবেন না। মঞ্চ মানেই অভিনেতা ও পরিচালকের মধ্যে সম্পর্ক, পরবর্তীতে দর্শক ও পরিচালকের সম্পর্ক। অভিনেতাদের তাৎক্ষণিক অভিব্যক্তিতে দর্শকদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া- বিষয়টা খুবই চমৎকার। এটা খুব অকপট ও জীবন্ত। সিনেমা একবার করে ফেললে আর পরিবর্তনের উপায় নেই, কিন্তু নাটক প্রত্যেক বার মঞ্চস্থ করার সময় পরিবর্তনের উপায় আছে, দর্শকদের প্রতিক্রিয়া সাপেক্ষে এই পরিবর্তন আনা যায়। মঞ্চ মানেই সার্বক্ষণিক পরিবর্তন, এখানে উন্নতির দুয়ার সব সময়ের জন্য খোলা। মঞ্চ ছাড়া বেঁচে থাকতে পারতাম বলে আমার মনে হয় না।
© Playboy
সূত্র: PLAYBOY INTERVIEW: INGMAR BERGMAN; A candid conversation with Sweden’s one-man new wave of cinematic sorcery
বি:দ্র: এই সাক্ষাৎকারের অধিকাংশ বঙ্গানুবাদ “চরাচর” পত্রিকার বিশেষ ইঙ্গমার বার্গম্যান সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। এই সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৭ সালের আগস্টে বারিমানের মৃত্যুর পরপর। পত্রিকার বাংলা অনুবাদটি করেছিলেন “অয়ন আয়শ্”। তার অনুবাদ থেকে অনেক কিছু হুবহু তুলে দেয়া হয়েছে। প্রায় অর্ধেক অংশ তাই অয়নের অনুবাদ থেকে নেয়া। তিনি যে অংশ অনুবাদ করেননি তা আমি নিজে করেছি। তার অনুবাদের অনেকগুলো বাক্য পরিবর্তন করেছি।
চলুন বারিমানের “দ্য সাইলেন্স” মুক্তি পাওয়ার সেই উত্তাল মাসগুলোতে ফিরে যাই। স্টকহোমের প্রতিটি সিনেমা হলে উৎসুক দর্শকদের ভীড়, তার দেখাদেখি আরও ডজনখানেক দেশে সাইলেন্স নিয়ে একরকম চাপা উত্তেজনা, একেক জনের হলে আসার কারণ একেক রকম- কেউ এসেছে এই সুয়েডীয় চলচ্চিত্রকারের বিশ্বনন্দিত ট্রিলজির (আগের দুটি হল “থ্রু আ গ্লাস ডার্কলি” ও “উইন্টার লাইট”) শেষ পর্ব দেখতে, কেউ এসেছে সমালোচকদের সেই কথার সত্যতা প্রমাণ করতে- এই “অ্যানাটমি অফ লাস্ট” নাকি বারিমানের ২০ বছরের চলচ্চিত্র জীবনের সেরা কীর্তি। সিনেমা তিনটি “গড ট্রিলজি” নামে পরিচিত যাতে ভালোবাসার অন্বেষণকে দেখা হয়েছে আবেগের মৃত্যু থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষের আসার কারণ এগুলো না, নির্লজ্জ মানুষের ঢল নেমেছিল সিনেমার ইতিহাসে অনন্য ইরটিক দৃশ্যগুলোকে লোলুপ দৃষ্টি দিয়ে ভক্ষণ করতে। মার্কিন সংস্করণে প্রায় এক মিনিটের মত দৃশ্য কেটে রাখার পরও দ্য সাইলেন্সের অসামাজিক নারীপটে যা আঁকা ছিল তা কামাতুর জনতার কামতৃষ্ণা উস্কে দেয়ার জন্য যথেষ্ট বলে প্রতীয়মান হয়েছে। মুক্তি পাওয়ার পর সুইডেনের আইনসভার সদস্যরা ৪৫ বছর বয়সী নির্মাতাকে পর্নোগ্রাফার অভিধায় অভিযুক্ত করেছে, সুইডেনের সকল লুথারান চার্চ থেকে বারিমানকে বলা হয়েছে “অশ্লীলতার যোগানদাতা”, বেনামী চিঠিপত্রে তারুণ্য ও নম্রতাকে কলুষিত করার অভিযোগ এনে তাকে হুমকি দেয়া হয়েছে। মূক জনতার সম্মিলিত শীৎকারেও বারিমান এতটা কষ্ট পাননি যতটা কষ্ট পেয়েছেন মানুষের এই কথা শুনে যে, তিনি নাকি যৌন দৃশ্যগুলো যোগ করেছেন কেবলই মানুষকে আঘাত এবং উত্তেজিত করার জন্য। এক সাংবাদিককে তিনি বলেছিলেন, “আমি একজন শিল্পী। দ্য সাইলেন্স এর ধারণা মাথায় আসার পর আমাকে তা করতেই হয়েছে, এর বেশি কিছু না।” বারিমানের বাবা ছিলেন ইভানজেলিক্যাল লুথারান চার্চের সদস্য, সুইডেনের রাজার চ্যাপলেইন- এই বাবার ঘরে তার শৈশব-কৈশোরের জীবন ছিল তিক্ততায় ভরপুর, সেখানে আবেগের জড়তা আর নৈতিক বাধ্যবাধকতা ছাড়া কিছুই ছিল না। এই জীবন ঝেড়ে ফেলে তিনি নিজস্ব রূপকথার জগতে প্রবেশ করেছেন। ৯ম জন্মদিনে, এক বাক্স টিনের যোদ্ধার বিনিময়ে তিনি এমন একটি খেলনা পেয়েছিলেন যা তার সৃজনশীলতার বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে, সেটি ছিল এক ক্ষত-বিক্ষত জাদুর প্রদীপ। এর এক বছর পরেই তিনি মনে মনে দৃশ্যায়ন শুরু করেছিলেন, পুতুল নকশা করা শুরু করেছিলেন। স্ট্রিন্ডবার্গে তার নিজস্ব পাপেট থিয়েটারে নিজে সবকিছু করতেন- সবগুলো পুতুল নকশা করা, সবগুলো সূতা নিয়ন্ত্রণ করা আর সবগুলো চরিত্রের হয়ে কথা বলা। পরবর্তীতে স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একটি যুব মঞ্চে পরিচালক হিসেবে কাজ করেন, এখানেই ১৯৪০ সালে শেক্সপিয়ারের “ম্যাকবেথ” এর একটি নাৎসিবিরোধী সংস্করণ তৈরি করেন। কিন্তু এর কারণে তার পরিবারের উপর আঘাত আসায় মঞ্চ নাটকটির খুব একটা পসার হয়নি।
সামাজিক প্রতিরোধ আন্দোলনের চেতনায় উদ্বেলিত বারিমান পরের বছর স্কুল ত্যাগ করেন, চলে যান শহরের বোহেমিয়ান অংশে- মঞ্চে অভিনয় শুরু করেন, নাটকের এমন কিছু অবান্তর কাহিনী ভাবতে শুরু করেন যার কোনটাই তার শেষ পর্যন্ত লেখা হয়নি। এক সময় “সহকারী মঞ্চ ব্যবস্থাপক” হিসেবে স্থায়ী কর্মজীবন শুরু করেন, এগোতে শুরু করেন বেশ দ্রুত- ব্যবস্থাপক থেকে পরিচালক এবং সেখান থেকে মেধাবী নাট্যকার। বারিমান কিংবদন্তীর অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল তার ঔদ্ধত্য আর মেয়েদের প্রতি দুর্বলতা (বিয়ে করেছেন চার বার)। ১৯৪৪ সালে একটি চিত্রনাট্য লিখে সুইডেনের বৃহত্তম সিনেমা কোম্পানি Svensk Filmindustri তে জমা দেন। কোম্পানি এটা থেকে সিনেমা করার সিদ্ধান্ত নেয়- নাম “টর্মেন্ট”, এর মাধ্যমেই সুইডেনের চলচ্চিত্র মঞ্চে একটি নতুন ক্যারিয়ার শুরু হয়, এর পরে তিনি আরও ২৫টি সিনেমা করেছেন। “The Seventh Seal”, “Smiles of a Summer Night”, “Wild Strawberries”, “The Magician”, “Brink of Life” এবং “The Virgin Spring” এর আন্তর্জাতিক মুক্তির মাধ্যমে বিশ্ব চলচ্চিত্রের হর্তাকর্তারা এক নতুন মেধা আবিষ্কার করেছেন, সবাই তাকে আভান্ট-গার্ড আর্ট ফিল্মের গুরু মেনেছেন। বহু সমালোচকের সম্মিলিত প্রশংসায় তিনি বিশ্ব চলচ্চিত্রের প্রথম সারির নির্মাতা হিসেবে নাম কুড়িয়েছেন।
বারিমান শ্যুটিং করার সময় মূল চিত্রনাট্য থেকে সামান্য বিচ্যুতিও মেনে নিতে পারেন না। তার স্টুডিওর ত্রিসীমানায় বাইরের কোন মানুষ বা দর্শনার্থীর উপস্থিতি সহ্য করতে পারেন না, সাংবাদিকদের তো নয়ই। শুধু শ্যুটিং সেটে নয়, সেটের বাইরেও তিনি সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে চান না, তাদেরকে একেবারেই পছন্দ করেন না।
তাই আমাদেরকে একটু ভয়ে ভয়েই এই মহান চলচ্চিত্রকারের সাথে এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারের আবেদন নিয়ে যেতে হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল তিনি আমাদের আন্তরিকভাবে উত্তর দিয়েছেন, বলেছেন স্টকহোমে এসে তার সাথে দেখা করতে। তার আমন্ত্রণেই আমরা গত ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে স্টকহোমে এসেছি। বিমর্ষ নর্ডিক শীতের আবহে প্রায় এক সপ্তাহ আমরা স্টকহোমে থাকব।
আমরা কথা বলেছি ডাউনটাউন স্টকহোমের “রয়েল ড্রামাটিক থিয়েটার” এর ব্যাকস্টেজে বারিমানের ছোট্ট অফিসে বসে। জাতীয় মঞ্চের নব নিযুক্ত ম্যানেজার হিসেবে এখানে তিনি পুরোদমে কাজ করছেন- চলচ্চিত্র নির্মাণ থেকে শুরু করে Brecht, Albee ও Ionesco এর মত নাট্যকারদের নাটক মঞ্চায়ন, সবকিছু। প্রতি সকালে আমাদের সাথে ঘণ্টা খানেক কথা বলেছেন, কারণ তার মতে সকালেই তিনি সবচেয়ে জীবিত থাকেন। ঠিক ৯ টায় অফিসে আসেন, পরনে থাকে ভারী ঢিলেঢালা পশমী কাপড়ের পোলো শার্ট, উলের ক্যাপ, হালকা বাদামী রঙের উইন্ডপ্রুফ জ্যাকেট যাতে তখনও ড্রাই ক্লিনারের ট্যাগ লাগানো। সাক্ষাৎকার পর্ব শুরু হতো আমাদের পক্ষ থেকে একটা উষ্ণ হাসি দিয়ে, তিনি আমাদের অভিনন্দন জানিয়ে প্রথম প্রশ্নটা নিজেই করতেন, সব সময়।
বারিমান: তারপর, স্টকহোমে এসে এখনও হতাশ হননি?
প্লেবয়: হতাশ হওয়া উচিত নাকি?
বারিমান: খুব বেশিদিন তো এখনও থাকেননি। বিরক্তি একসময় আসবেই। আমি বুঝি না, মানুষ সব বাদ দিয়ে কেন এতদিন ধরে স্টকহোমে থাকে। দক্ষিণ থেকে এত উত্তরে আসাটা আসলেই বেশ বিদঘুটে। প্লেনে উত্তরের দিকে আসার সময় প্রথমে শহর ও গ্রাম দেখা যায়, কিন্তু আরও এগোলে কেবল গাছপালা-বনজঙ্গল, আরেকটু এগোলেও বন, মাঝখানে হয়ত একটা হ্রদ দেখা যায়, তারপর আবারও জঙ্গল- অনেক দূর পরপর হঠাৎ একটা বাড়ি চোখে পড়ে। তারপর হঠাৎ কোত্থেকে ফুঁড়ে উঠে স্টকহোম। সব বাদ দিয়ে এত উত্তরে এমন একটা শহর বানানো একেবারেই অযৌক্তিক। এখানে আমাদের থাকতে হয় একাকী। আমাদের দেশটা এত বড় অথচ জনসংখ্যা কত কম, পুরো দেশ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করে গুটিকতক মানুষ। এখানকার মানুষেরা নিজেদের জমিতে বিচ্ছিন্নভাবে বাস করে, একজনের সাথে আরেকজনের যোগাযোগ হয় না বললেই চলে। এটা তাদের জন্য খুবই কঠিন, এমনকি শহরে এলেও তাদের কোন লাভ হয় না। কিভাবে যোগাযোগ করতে হয় তা-ই তারা জানে না। মুখ বন্ধ করে বসে থাকে। আর শীতকালটা তো কোন সাহায্যই করে না।
প্লেবয়: সাহায্য করে না মানে?
বারিমান: শীতকালে দিনের দৈর্ঘ্য খুবই কম, খুব বেশি হলে সকাল সাড়ে আটটা থেকে বিকেল আড়াইটা পর্যন্ত। এখান থেকে আরেকটু উত্তরে গেলেই দিন হারিয়ে যায়, চব্বিশ ঘণ্টাই সেখানে অন্ধকার। আমি শীত ঘৃণা করি। স্টকহোমের শীত আরও বেশি ঘৃণা করি। শীতকালে আমি সবসময় ভোর ছয়টায় ঘুম থেকে উঠি, একেবারে ছোটবেলা থেকে। ঘুম ভাঙার পর প্রথমেই আমার জানালার বিপরীতের দেয়ালটার দিকে তাকাই। নভেম্বর-ডিসেম্বরে সেখানে কোন আলোই দেখা যায় না। জানুয়ারিতে এক চিলতে আলোর দেখা মেলে। প্রত্যেক সকালে সেই আলোর রেখাকে একটু একটু করে বাড়তে দেখি। অন্ধকার এবং অসহনীয় শীতকালটা এভাবেই পার করি: যত বসন্তের দিকে এগোই আলোর রেখাটাও তত বাড়তে থাকে।
প্লেবয়: এখানকার শীত এত ঘৃণা করলে শীতের সময় উষ্ণ শহরগুলোতে চলে যান না কেন? এখানে শীতের সময়টা তো রোম বা হলিউডের মত সিনেমার রাজধানীতে গিয়েও কাজ করতে পারেন।
বারিমান: নতুন শহর আমার মধ্যে অতিরিক্ত সংবদনের জন্ম দেয়। একসাথে এত অভিজ্ঞতা আর অনুভূতি সামাল দেয়া সম্ভব না; তারা সব আমার ওপর জেঁকে বসে। নতুন শহর আমাকে অভিভূত করে, আচ্ছন্ন করে রাখে, অস্থির করে তোলে।
প্লেবয়: একটা রিপোর্টে আপনি বলেছিলেন সুইডেন ছেড়ে যেতে আপনার ভীষণ ভয় হয়। এ কারণেই কি সুইডেনের বাইরে কোন সিনেমা তৈরি করেন নি?
বারিমান: তা নয়, ছবি তৈরির ক্ষেত্রে তা সামান্য কারণই বলতে পারেন। তাছাড়া পৃথিবীর সবখানে অভিনেতা-অভিনেত্রী এবং স্টুডিওগুলো প্রায় একই। আমার শৈল্পিক নিয়ন্ত্রণ টুকু হারিয়ে ফেলার ভয়েই অন্য কোন দেশে ছবি নির্মাণ করিনি। যখন ছবি বানাই, ছবির শুরু থেকে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত সবকিছু আমার নিয়ন্ত্রণে থাকে। আমি সুইডেনে বেড়ে উঠেছি, এখানেই আমার শিকড়। আর এখানে আমি পেশা নিয়ে কখনো হতোদ্যম হইনি, অন্ততপক্ষে প্রযোজকের দিক থেকে। চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রায় ২০ বছর ধরে একই মানুষের সাথে কাজ করছি। তারা আমাকে শুরু থেকে এই পর্যন্ত দেখছে। প্রযুক্তির চাহিদা চলচ্চিত্র নির্মাতাকে দাসে পরিণত করে, কিন্তু এখানে সবকিছু মানুষের সাহায্যে হয়। ক্যামেরাম্যান, অপারেটর, প্রধান ইলেকট্রিশিয়ান আমরা সকলেই একে অপরকে ভালোভাবে জানি এবং বুঝতে পারি সহজে। আমি কদাচিৎই তাদেরকে কী করতে হবে বলি। এটাই আদর্শ এবং এটা সৃজনশীল কাজকে সহজ করে তোলে। অবশ্যই মার্কিন কোম্পানির জন্য চলচ্চিত্র নির্মাণ একটা লোভনীয় ব্যাপার। কিন্তু তা প্রথমটির জন্য নয়, দ্বিতীয়টির জন্য। আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে এবং প্রযোজকের সাথে একই সম্পর্ক ঠিক রেখে, কাজ করার পুরো সময়টাতে আমার নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকবে কি? আমার মনে হয় না।
প্লেবয়: আপনি একবার বলেছিলেন, এমন কি স্টকহোমে আপনার সেটের বাইরে কারও সাথে সাক্ষাৎ করবেন না, যেখানে বাইরের কারও প্রবেশ নিষেধ, কেন?
বারিমান: আপনি কি জানেন ছবি বানানোটা কী? প্রতিদিন আট ঘণ্টার কঠিন শ্রমে আপনি পাবেন তিন মিনিটের ফিল্ম। যদি খুব ভাগ্যবান হন তবে যা সৃষ্টি হবে তার আয়ুষ্কাল হবে ৮ থেকে ১০ মিনিট। হয়তো বা তাও হবে না। এরপর আবার আট ঘণ্টা শ্রম দিয়ে দশ মিনিটের কাজ আশা করবেন। সেটের প্রত্যেকটা মানুষ উৎকীর্ণ হয়ে থাকে এই একটু সত্যিকারের সৃষ্টি দেখার জন্য। এ সময় শিল্পী এবং আপনার নিজেকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতে হবে নির্দিষ্ট বলয়ে। আর বাইরের প্রেক্ষাপটে, যদি তা বন্ধুত্বপূর্ণও হয়, তা আপনার কাছে অপরিচিত মনে হবে। যে কোন সময় বহিরাগত কেউ সেটে প্রবেশ করে মনোযোগের বিঘ্ন ঘটাতে পারে অভিনেতাদের, টেকনিশিয়ানদের এমনকি আমারও। তা হয়তো আমার কাজের খুব অল্প সময় নষ্ট করবে। কিন্তু তাও আমরা নষ্ট করতে চাই না। খুব অল্প সময়েই আমি ভিন্ন কিছু তৈরি করি। আর সেজন্য আমি অনুতপ্ত হতে চাই না।
প্লেবয়: আপনার সমালোচকরা বলেন আপনার সেটে কাউকে ঢুকতে তো দেনই না বরঞ্চ অনেককে বের করে দেন। এমনকি রেগে গেলে ফোন ছুঁড়ে মারেন দেয়ালে অথবা চেয়ার ছুঁড়ে ফেলেন কাঁচের বুথে, এগুলো কি সত্য?
বারিমান: হ্যাঁ, এরকমই। যখন আমি তরুণ ছিলাম, টগবগে তরুণ, অন্য অনেক তরুণের মতই নিজের সম্পর্কে অনিশ্চিত ছিলাম। কিন্তু খুবই উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলাম। এবং যখন আপনি অনিশ্চিত ও অনিরাপদ তখন নিজ ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য মরিয়া হয়ে উঠবেন এটাই স্বাভাবিক। নিজের পথ করে নেওয়ার জন্য আগ্রাসী হয়ে উঠবেন। আমার ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। প্রাদেশিক মঞ্চে যখন নির্দেশক হিসেবে কাজ করছিলাম তখন আজ যে ব্যবহার করি তা করতাম না। তখন আমার অভিনেতা ও কলাকুশলীদের সম্মানের চোখে দেখতাম। কিন্তু যখন দিনের প্রতিটি মিনিটের গুরুত্ব বুঝতে পারলাম, যখন শান্ত পরিবেশ ও সেটের নিরাপত্তার বিষয়টা অনুভব করলাম তখনও কি আমি আগের মত রয়ে যাব, আমি চুপচাপ থেকে নিজেকে শেষ করে দেব এটা আপনি ভাবতে পারেন? মুভির সেটে একজন পরিচালক একটি জাহাজের ক্যাপ্টেনের মত, তার প্রাপ্য সম্মানটুকু তাকে আদায় করে নিতে হবে। আমি ২৫-২৬ বছর আগে এমন ব্যবহার করতাম না।
প্লেবয়: এই বদমেজাজের কাহিনী এখনও পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
বারিমান: অবশ্যই, প্রকাশিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। সাংবাদিকরা তাদের সম্পাদক ও পাঠকদের কাছে এ ধরণের চটকদার খবর পৌঁছে দেয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে। একজন পরিচালক মেজাজ না দেখিয়ে শান্তভাবে কথা বলে তার অভিনেতাদের মনোবল চাঙ্গা করে তুলেছে, পাঠকের কাছে এমন খবরের তো কোন আকর্ষণ নেই। মানুষ বছরের পর বছর এই ধরণের খবর আশা করে। আপনি কি বুঝতে পারছেন কেন আমি প্রেসের সাথে কলা বলা পছন্দ করি না? মানুষ বলে আমি সাংবাদিকদের চোখের সামনে দেখতেও ইচ্ছুক না, আমি তাদের সাথে যেকোন ধরণের সাক্ষাৎকার প্রত্যাখ্যান করি। এই একটি ক্ষেত্রে তাদের ধারণা সঠিক। যখন কোন সাংবাদিককে কথা বলার জন্য সময় দেই তখন তাদের সাথে ভাল ব্যবহারই করি। কথা শেষে পত্রিকা অফিসে গিয়ে তারা সব ভুলে যান, সম্পাদক আমার এইমাত্র বলা কথাগুলো ছুঁড়ে ফেলে পুরনো কথাগুলো আবার প্রকাশ করে। কেননা তারা মনে করে আমার সত্য কথার তুলনায় পুরনো গালগল্পগুলো অনেক চটকদার। কয়েক বছর আগে আমেরিকার একটি পত্রিকায় আমাকে নিয়ে এমনই একটা কাভার স্টোরি লেখা হয়েছিল।
প্লেবয়: টাইম ম্যাগাজিন?
বারিমান। হ্যাঁ, তাই। বের হওয়ার পর আমার স্ত্রী আমাকে পড়ে শুনিয়েছিল। পত্রিকায় যে মানুষটার কথা বলা হচ্ছিল তার সাথে পরিচিত হতে খুব ইচ্ছা হচ্ছিল আমার- কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সে খুব একটা ভাল মানুষ নয়, কিন্তু বেশ আকর্ষণীয়। কিন্তু পত্রিকার এই মানুষটার মধ্যে আমি নিজেকে খুঁজে পাইনি। আমি জানি সে সত্যিকারের কেউ নয়।
প্লেবয়: আপনার কিছু সিনেমার অর্থবোধকতা নিয়ে সমালোচনা করা হলে তার খুব সামান্যই আপনি মেনে নিয়েছেন, এটা কি সত্য?
বারিমান: আমি এগুলোকে পাত্তাই দেই না। এগুলো বিরক্তিকর। অধিকাংশ সমালোচকই জানে না কিভাবে একটি সিনেমা বানাতে হয়। চলচ্চিত্রের সংস্কৃতি সম্পর্কে তাদের জ্ঞান অতি সামান্য। কিন্তু আমরা একটা নতুন প্রজন্ম পেয়েছি যাদের সিনেমা সম্পর্কে অনেক জানাশোনা রয়েছে। কিছু তরুণ ফরাসি সমালোচকের সমালোচনা আমি পড়ি। তাদের মতামতের সাথে সবসময় একাত্মতা প্রকাশ করি না, কিন্তু তারা যোগ্য। তাদের কোন বক্তব্য আমার বিপক্ষে গেলেও আমি তাদের স্বীকৃতি দেই।
প্লেবয়: আপনার সিনেমার নেতিবাচক সমালোচনা করা হয়েছে বেশ কয়েকটি কারণে, যেমন- ব্যক্তিগত অর্থবোধকতা, বেশ কিছু অংশের অস্পষ্টতা, প্রতীকধর্মীতা ইত্যাদি। এই অভিযোগগুলো স্বীকার করেন?
বারিমান: সম্ভবত আমি তা মনে করি না। কারণ সিনেমা বানানোর সময় পরিচালক দর্শকদের সিনেমার সাথে একাত্ম করতে চান। এটা অবশ্যই কঠিন কাজ। ব্যক্তিগত সিনেমা তৈরি করা সহজ, আমি মনে করি না কোন পরিচালকের সহজ সিনেমা বানানো উচিত। পরিচালক চেষ্টা করবেন তার একেকটি সিনেমার মাধ্যমে দর্শকদের একটু একটু করে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে। সাধারণ জনগণের জন্য এটা ভাল। কিন্তু পরিচালকের কখনও ভুলে গেলে চলবে না তিনি কার জন্য সিনেমা বানাচ্ছেন। আর যাই হোক, আমার সিনেমা দেখে দর্শকরা মেধা খাটিয়ে সেটা নিমেষের মধ্যে বুঝে ফেলবে সেটা আমি চাই না, তারা সিনেমাটিকে হৃদয়ে ধারণ করুক সেটাই চাই। হৃদয়ই এখানে মুখ্য।
প্লেবয়: তারা আপনার সিনেমা কেমন বুঝেছেন জানি না, তবে এটা ঠিক যে অনেক আন্তর্জাতিক সমালোচক আপনাকে বিশ্ব চলচ্চিত্রের শীর্ষস্থানীয় পরিচালকদের সারিতে সম্মানের আসন দিয়েছেন। এ ধরণের র্যাংকিং সম্পর্কে আপনার কী মত?
বারিমান: বহির্বিশ্বে সফলতাই সুইডেনে আমার কাজকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। আমি মৌলিক সৃষ্টি নিয়ে কারও সাথে প্রতিযোগিতা করতে ইচ্ছুক নই। সাফল্যে সবসময় অনুপ্রাণিত হই, কাজের মাধ্যমে সেটা অর্জন করি। চলচ্চিত্র জগতে সাফল্য খুব ক্ষণস্থায়ী। প্যারিসে কয়েক বছর আগেও আমি ছিলাম সফল পরিচালক। তারপর আন্তোনিওনি আসল। তিনি নতুন একজন। কেউ কি তাকে চিনে? এই নবীন সৃজনশীল পরিচালক যখন সিনেমা বানাতে শুরু করলেন তখন আমি তার প্রতি ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়েছিলাম। ঈর্ষার বশবর্তী হয়েই ফিল্ম লাইব্রেরি থেকে নিয়ে তার সব সিনেমা দেখলাম। সিনেমার টেকনিক্যাল বিষয় সব যে তার জানা তা নয়। টেকনিক্যাল দিক থেকে আমি তার চেয়ে অনেক বেশি উজ্জ্বল। এটাই আমাকে আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছিল। এখন আমি অন্য কোন পরিচালকের সিনেমা দেখে ঈর্ষান্বিত বা ভীত হই না। কারণ জানি, ভীত বা ঈর্ষান্বিত হওয়ার কোন কারণ নেই।
প্লেবয়: সিনেমার স্টাইল ও কৌশলের ক্ষেত্রে অন্য পরিচালকদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন?
বারিমান: সিনেমা সম্পর্কে সবকিছু আমার নিজে থেকেই জানতে হয়েছে। মঞ্চের ক্ষেত্রে এটা ঠিক না, গোটেবর্গে চার বছর থাকার সময় এক বর্ষীয়ান পণ্ডিতের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছিলাম। সে কঠোর হলেও মঞ্চ সম্পর্কে সবকিছু জানতো, তার কাছ থেকে অনেক কিছু জেনেছি। কিন্তু সিনেমার জগতে আমার কোন শিক্ষক ছিল না। যুদ্ধের আগে আমি স্কুলে পড়তাম, আর যুদ্ধের সময় কোন বিদেশী সিনেমা দেখার উপায় ছিল না। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর স্ত্রী ও তিন সন্তানের ভরণ পোষণের জন্য কঠোর পরিশ্রম করছিলাম। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে আমি স্বশিক্ষায় খুব দক্ষ ছিলাম, যদিও এই গুণ সবসময় উপকারী না। কারণ স্বশিক্ষিতরা অনেক সময় টেকনিক্যাল বিষয়গুলোকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়, টেকনিক্যাল নৈপুণ্য নিয়ে বেশি চিন্তা করে, এটা নিশ্চিত করার পরই কেবল অন্যদিকে মনোযোগ দেয়। আমার মনে হয় সিনেমায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, কিছু বলা।
প্লেবয়: আপনার কি মনে হয় আমেরিকার নিউ ওয়েভ পরিচালকদের কিছু বলার আছে?
বারিমান: হ্যাঁ, আছে। আমি তাদের খুব বেশি সিনেমা দেখিনি। “দ্য কানেকশন”, “শ্যাডোস” এবং “পুল মাই ডেইজি” বারবার দেখার মত সিনেমা। যতদূর দেখেছি সে অনুসারে ফরাসি নিউ ওয়েভের তুলনায় মার্কিন নিউ ওয়েভ আমার বেশি পছন্দ। মার্কিনরা অনেক বেশি উৎসুক, আদর্শবাদী, তাদের সিনেমা নৈপুণ্যে ফরাসিদের চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও সিনেমার মাধ্যমে তারা কিছু বলতে চায়। এই বলার চেষ্টাটাই ভাল। এটাই গুরুত্বপূর্ণ এবং আমার পছন্দের।
প্লেবয়: যেসব রুশ সিনেমা দেখেছেন সেগুলো কি ভাল লেগেছে?
বারিমান: খুবই ভাল লেগেছে। রুশদের কাছ থেকে শীঘ্রই চমৎকার কিছু বেরিয়ে আসবে বলে মনে করি। কারণ জানি না, কিন্তু আমার মনে হয়। “চাইল্ডহুড অফ আইভান” দেখেছেন? এটাতে অনন্যসাধারণ কিছু বিষয় আছে। রাশিয়ার অনেক সিনেমাই বেশ খারাপ সন্দেহ নেই, কিন্তু সেখানে মেধা ও শক্তি আছে।
প্লেবয়: ইতালীয় পরিচালকদের সম্পর্কে কি মনে করেন?
বারিমান: ফেলিনি চমৎকার। আমি যা নই ফেলিনি ঠিক তাই। আমার তার মত হতে চাওয়া উচিত। তার মধ্যে বারোক যুগের প্রচুর উপাদান আছে। তার সিনেমা প্রচণ্ড উদার, উষ্ণ, সহজবোধ্য এবং স্নায়ুর উপর খুব কম চাপ ফেলে। “লা দোলচে ভিতা” আমার খুবই পছন্দের সিনেমা, বিশেষ করে বাবার সাথের দৃশ্যটা অসাধারণ। বিশাল মাছের সাথে করা শেষ দৃশ্যটাও চমৎকার। ভিসকন্তির প্রথম সিনেমাটা খুব ভাল লেগেছিল- লা তেরা ত্রেমা। এটাই বোধহয় তার সেরা সিনেমা। আন্তোনিওনির “লা নোত্তে” ও খুব ভাল লেগেছিল।
প্লেবয়: জীবনে দেখা সেরা সিনেমা বেছে নিতে বললে কি এগুলোই বেছে নেবেন?
বারিমান: না, আমার মনে হয় সমসাময়িক সিনেমার মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় তিনটি: দ্য ল্যাডি উইথ দ্য ডগ, রাশোমোন এবং Umberto D. ও হ্যাঁ, আরেকটা আছে, চতুর্থ, “মিস্টার হুলোস হলিডে”, এই সিনেমাটা ভালোবেসে ফেলেছিলাম।
প্লেবয়: আচ্ছা আপনার সিনেমার কথায় ফিরে আসি। আপনার সর্বশেষ এবং সবচেয়ে বিতর্কিত সিনেমা “দ্য সাইলেন্স” এর ধারণা কিভাবে পেয়েছেন?
বারিমান: এক বিশালবপু বৃদ্ধের কাছ থেকে। হ্যাঁ, ঠিক তাই। চার বছর আগে এক বন্ধুকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলাম। হাসপাতালে তার রুমের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি, খুব মোটা ও প্যারালাইজড এক বৃদ্ধ পার্কে একটি গাছের নিচে চেয়ারে বসে আছে। দেখলাম, চার জন সুশ্রী ও হাশিখুশি নার্স এসে তাকে চেয়ার সমেত উঠিয়ে হাসপাতালের ভেতরে নিয়ে গেল। কেন জানি দৃশ্যটা অন্তরে গেঁথে গিয়েছিল। আমার অন্য অনেক ছবির মত এবারও একটিমাত্র দৃশ্য থেকে চিত্রনাট্যের কাঠামোটা তৈরি করে ফেললাম। আমি প্রায় সব সময়ই এভাবে সিনেমার থিম পাই- ছোট্ট একটা অনুভূতি, কারো বলা ছোট্ট কোন কথা, হয়তোবা কোন ইশারা বা কোন অভিনেতার ছোট্ট একটি মুখভঙ্গি। এরকম ছোট ছোট ঘটনা থেকেই চিন্তা শুরু করি এবং এক সময় তা পূর্ণতা অর্জন করে। আরও সূক্ষ্ণভাবে বললে, আমার চিত্রনাট্যগুলো বেরিয়ে আসে আত্মার তাগিদ থেকে, এই তাগিদেরও রকমফের আছে, একেক সময় তা একেক রূপে আবির্ভূত হয়। আমার অধিকাংশ সিনেমাই শুরু হয় কোন বিশেষ দৃশ্য বা অনুভূতি দিয়ে। এই সূচনাকে ঘিরেই আমার কল্পনাশক্তি কাজ করে এবং সেটাকে পরিপূর্ণতার দিকে নিয়ে যায়। বিভিন্ন সময়ে আমার চিন্তাগুলো আলাদা আলাদা করে লিখে রাখি, নোটের আকারে। এভাবে মাথায় অনেকগুলো বিচ্ছিন্ন ধারণা তৈরি হয়ে থাকে যাদেরকে বলা যায় মানসিক ফাইল। কয়েক বছর কেটে যাওয়ার পর এই ঘটনাগুলো ধারাবাহিকভাবে একটি পূর্ণাঙ্গ দৃশ্যে রূপান্তরিত হয়। একটা প্রজেক্ট শুরু হওয়ার পর আমার সেই মানসিক ফাইলগুলো খুলে দৃশ্যায়ন শুরু করি, চরিত্রগুলো সেভাবেই সাজাই। অনেক সময় মানসিক ফাইল থেকে করা চরিত্রগুলোর সাথে চিত্রনাট্যের অন্য চরিত্রগুলোর বনিবনা হয় না। তখন ফাইলের চরিত্র ফাইলে ফিরিয়ে নিয়ে যাই, অন্য কিছু খুঁজতে শুরু করি। আমার সিনেমা শুরু হয় স্নোবলের মত করে, বরফের একটি ছোট্ট কণা থেকে খুব ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে। এমনকি মাঝেমাঝে সিনেমা শেষ হলে শুরুর সেই ছোট্ট বরফকণার কথাই ভুলে যাই।
প্লেবয়: কিন্তু প্যারালাইজড বৃদ্ধ থেকে পাওয়া সেই ছোট্ট বরফকণা থেকে কিভাবে দ্য সাইলেন্স এর এক্সপ্লিসিট সেক্স ও মাস্টারবেশনের দৃশ্য উঠে এল তা সহজে বোঝা যায় না। যে এক্সপ্লিসিট দৃশ্যগুলো বিশ্বময় বিতর্কের জন্ম দিয়েছে তার সঠিক তাৎপর্য বোঝা কঠিন হয়ে গেছে। আপনি কেন পর্দায় সেক্স দেখানোর এই গ্রাফিক্যাল পন্থাটা বেছে নিলেন?
বারিমান: অনেক দিন ধরেই আমার সিনেমায় সেক্স দৃশ্যায়নের ব্যাপারে খুব প্রথাগত ছিলাম, খানিকটা ভয়েও ছিলাম। কিন্তু সিনেমায় সেক্স সঠিকভাবে বিকশিত করা বিশেষ করে আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমি কেবল ইন্টেলেকচুয়াল সিনেমা বানাতে চাই না। আমি চাই দর্শকরা আমার সিনেমা অনুভব করুক, তাদের চেতনায় সেটা প্রবেশ করুক। বোঝার চেয়ে এটাকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। গ্রীষ্মকালের একটি সুন্দর সকালের দৃশ্যের সাথে সেক্স এর দৃশ্যের অনেক মিল আছে। কিন্তু আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, গ্রীষ্মের সুন্দর সকাল চিত্রায়িত করার উপায় জানলেও সেক্সকে সুন্দরভাবে চিত্রায়িত করার উপায় আমি এখনও বের করতে পারিনি। আর ভালোবাসার ইন্টেরিয়র অ্যানাটমি নিয়ে আমি খুবই আগ্রহী। সেক্স পরবর্তী সন্তুষ্টি দেখানোর চেয়ে তাই সে ইন্টেরিয়র অ্যানাটমি দেখানো আমার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
প্লেবয়: অনেকে বলছেন দ্য সাইলেন্স এর মার্কিন সংস্করণে প্রায় দুই মিনিটের মত ইরটিক দৃশ্য কেটে নেয়ায় মুভিটা তার স্বাভাবিকত্ব হারিয়েছে, তার মূল বৈশিষ্ট্যই নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এর সাথে কি আপনি একমত?
বারিমান: এ বিষয়ে আমার কোন মন্তব্য করা ঠিক হবে না। আমি করছিও না।
প্লেবয়: ঠিক আছে। কিন্তু এমন কি হতে পারে না যে, মার্কিন কর্তৃপক্ষের এই সেন্সরের কারণে ভবিষ্যতে আপনি নিজের উপর একটি সেন্সরশিপ আরোপ করতে পারেন যাতে তা মার্কিন দর্শকরা কাটছাট ছাড়াই দেখতে পারে?
বারিমান: না, কখনোই নয়।
প্লেবয়: সিনেমার বহুল বিতর্কিত দৃশ্যগুলোতে থুলিন ও লিন্ডব্লোম এর মত অভিনেত্রীদেরকে এত অকপটে অভিনয় করাতে রাজি করালেন কিভাবে?
বারিমান: শুধু তাদের না, অন্য সব অভিনেতা-অভিনেত্রীদেরকে আমি যেভাবে পেয়েছি ঠিক সেভাবেই তাদেরকে এই দৃশ্যগুলোতে অভিনয় করিয়েছি। আমার অভিনয়শিল্পীরা এটা মেনেই সিনেমায় আসেন যে আমার যে কোন সিনেমায় যে কোন দৃশ্যে অভিনয় করতে প্রস্তুত থাকবেন। আমরা খুব স্বাভাবিক ও সাবলীলভাবে আলোচনা করি, দৃশ্যটিতে তাদের কি করতে হবে। অনেকে দাবী করে, আমি নাকি অভিনেতাদের সম্মোহিত করে তাদের কাছ থেকে এমন অভিনয় আদায় করে নিই। যত্তসব আজগুবি কথাবার্তা! আমি কেবল তাদেরকে সেই জিনিসটা দিতে চাই যা ছাড়া কারও পক্ষে সফল অভিনেতা হওয়া সম্ভব না: আত্মবিশ্বাস। একজন অভিনেতা কেবল এটাই চায়। পরিচালক যা চাচ্ছেন তার পুরোটা অভিনয় করে দেখানোর ক্ষমতা তার মধ্যে তখনই আসবে যখন সে আত্মবিশ্বাসী হবে। তাই আত্মবিশ্বাস ও বিশ্বস্ততা দিয়ে আমি আমার শিল্পীদের ঘিরে রাখি। আমি অনেক সময় তাদের সাথে সিনেমা নিয়ে কথা না বলে সাধারণ কথাবার্তা বলি যাতে তারা স্বাভাবিক থাকতে পারে। এটাই যদি জাদু হয় তাহলে বলতেই হয় আমি একজন জাদুকর। তারপরও একটা কথা না বললে নয় যে, দীর্ঘদিন ধরে একই অভিনেতা, কলাকুশলীদের সাথে কাজ করায় আমাদের স্টুডিওতে বিশ্বস্ততার একটা আবহ তৈরি হয়ে গেছে যা কাজে অনেক সাহায্য করে।
প্লেবয়: আজ থেকে পাঁচ-ছয় বছর আগে আপনি বলেছিলেন, “আমি দরকার হলে আমার মেধাকে বেশ্যাবৃত্তিতে কাজে লাগাবো, অন্য কোন উপায় না থাকলে চুরি করবো, আমার বন্ধু বা অন্য কাউকে খুন করলে যদি শিল্পের সাহায্য হয় তবে তাই করবো।” এই বক্তব্যকে আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
বারিমান: আমি তখন অনেক বেশি রক্ষণাত্মক ছিলাম। যখন একজন মানুষ নিজেকে ভালভাবে জানে না, বিশ্বে তার অবস্থান এমনকি তার সৃজনশীলতা নিয়েও চিন্তিত থাকে তখন সে নিজেকে আক্রমনাত্মক উপায়ে প্রকাশ করতে চায়, কেবলমাত্র কঠোর সমালোচনা ঠেকানোর উদ্দেশ্যে। কিন্তু একবার সফল হয়ে যাওয়ার পর মানুষ সাফল্যের শর্তগুলো থেকে মুক্ত হয়ে যায়। লড়াইয়ে টিকে থাকার আর কোন প্রয়োজন পড়ে না, সে তার কাজে ভালভাবে মনোনিবেশ করতে পারে। তখন জীবন অনেক সহজ হয়ে যায়। নিজেকে পছন্দ হতে শুরু করে। যেমন এখন আমি জীবনটা আগের চেয়ে অনেক বেশি উপভোগ করছি, বুঝতে শুরু করেছি যে এমন অনেক কিছু আছে যা আমি দেখি নি। নিজেকে খানিকটা বুড়োও মনে হচ্ছে, তবে খুব বেশি না।
আরেকটা ব্যাপার হল, আমি মনে করতাম জীবন বা শিল্পে সমঝোতার কোন স্থান নেই। ভাবতাম একজন মানুষের জন্য সবচেয়ে খারাপ কাজ হতে পারে সমঝোতা করা। কিন্তু এটা ঠিক যে আমি নিজেই অনেক সময় আপোস করেছি। এটা আমাদের সবাইকেই করতে হয় এবং আমরা করি। এছাড়া বেঁচে থাকা সম্ভব না। কিন্তু একটা দীর্ঘ সময় আমি অনেক কিছুর সাথে আপোস করে চলছি এটা জানার পরেও মেনে নিতে চাইতাম না, নিজেকে আপোসহীন বলে সান্ত্বনা দিতাম। মনে করতাম আমি সবকিছুর উপরে উঠতে পারব। কিন্তু এখন জানি যে সেটা সম্ভব না। এখন বুঝতে পেরেছি, সবচেয়ে বড় বিষয় হল বেঁচে থাকা এবং বেঁচে যে আছি তা বুঝতে পারা। মৃত বা অর্ধমৃত মানুষের সাথে বাস করা তো সম্ভব না। অনুভব করতে পারাটাই এখন আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। উইন্টার লাইট এ আমি এটাই তুলে ধরতে চেয়েছিলাম। এই সিনেমা আমাকে নিয়ে যদিও খুব কম মানুষই তা বুঝেছে। এখন যেহেতু আপনারা শীতের মাঝখানে স্টকহোমে এসেছেন, আশাকরি উইন্টার লাইট বুঝতে শুরু করবেন। এই সিনেমা সম্পর্কে আপনাদের মত কী?
প্লেবয়: আমরা আসলে সিনেমা সম্পর্কে আপনার মত নিয়েই বেশি আগ্রহী।
বারিমান: আচ্ছা আমিই বলি। এটা বেশ কঠিন সিনেমা, আমার বানানো সবচেয়ে কঠিন সিনেমাগুলোর একটি। দর্শকদের পরীশ্রম করতে হবে। “থ্রু আ গ্লাস ডার্কলি” থেকে প্রগতির মাধ্যমে এর জন্ম হয়েছে এবং এটা বাড়তে বাড়তেই এক সময় “দ্য সাইলেন্স” এর জন্ম দিয়েছে, অর্থাৎ সাইলেন্স এ এটার থিমই বয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সিনেমা তিনটি এক সাথে অবস্থান করে। এগুলো বানানোর উদ্দেশ্য ছিল, মানুষে মানুষে যোগাযোগের গুরুত্বকে নাট্যায়িত করা, মানুষের অনুভব করার ক্ষমতাকে চিত্রায়িত করা। অনেক সমালোচক বলেছেন ঈশ্বর এবং তার অনুপস্থিতিই এগুলোতে মুখ্য যা ঠিক না। এগুলোর মূল বক্তব্য ভালোবাসা রক্ষার শক্তি। এই সিনেমাগুলোর অধিকাংশ চরিত্রই মৃত, সম্পূর্ণ মৃত। কিভাবে ভালোবাসতে হয় বা কিভাবে অনুভব করতে হয় তা তারা জানে না। নিজেদের বাইরে কারও কাছে পৌঁছতে পারে না বলেই তারা হারিয়ে গেছে।
উইন্টার লাইট এর প্যাস্টর চরিত্রটি কিছুই না। আশাকরি বুঝতে পেরেছেন যে সে প্রায় মৃত। অন্য সবার থেকে সে বিচ্ছিন্ন। কেন্দ্রীয় চরিত্র হচ্ছে নারীটি। সে ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না, কিন্তু শক্তিশালী, সে ভালোবাসতে পারে। যেসব নারী ভালোবাসতে পারে তারা ভালোবাসার মাধ্যমে অনেক কিছু রক্ষা করতে পারে। কিন্তু সমস্যা হল এই ভালোবাসা কিভাবে প্রকাশ করতে হয় তা উইন্টার লাইট এর নারীটি জানে না। সে কুৎসিত ও কদর্য। সে প্যাস্টরকে শ্বাসরুদ্ধ করে রাখে এবং এজন্যই প্যাস্টর তাকে ঘৃণা করে, কুৎসিত চেহারাও একটা কারণ। কিন্তু এই নারী একসময় ভালোবাসা প্রকাশ করতে শিখে যায়। সিনেমার শেষ দিকে যখন সবাই বিকেল তিনটার চার্চ সার্ভিসের জন্য জড়ো হয় কেবল তখনই এক দিক থেকে চিন্তা করলে নারীটির প্রার্থনা মঞ্জুর হয়। সার্ভিস প্যাস্টরের কাছে সম্পূর্ণ অর্থহীন হয়ে পড়ে, তারপরও সেই শূন্য চার্চের সার্ভিসে যোগদানের মাধ্যমে সে ভালোবাসার পথে প্রথম পদক্ষেপ নেয়। এটা অনুভূতির দিকেও তার প্রথম পদক্ষেপ, কিভাবে ভালোবাসতে হয় তার দিকেও। এখানে তাই ভালোবাসাই আমাদের রক্ষা করে, ঈশ্বর নয়। আমরা সর্বোচ্চ এই ভালোবাসারই আশা করতে পারি।
প্লেবয়: ট্রিলজির অন্য দুটি সিনেমাতে এই থিমটি কিভাবে এসেছে?
বারিমান: লক্ষ্য করলে দেখবেন, প্রত্যেক সিনেমারই একটি যোগাযোগের মুহূর্ত থাকে , মানবিক যোগাযোগের মুহূর্ত: থ্রু আ গ্লাস ডার্কলি-র শেষ দৃশ্যে ছেলেটি বলে “Father spoke to me”; উইন্টার লাইটের শেষে প্যাস্টর শূন্য চার্চে কেবল মার্টার জন্য সার্ভিস পরিচালনা করে; দ্য সাইলেন্স এর শেষে ছেলেটি এস্টারের চিঠি পড়ে। প্রতি সিনেমাতেই এই মুহূর্তগুলো খুব ছোট কিন্তু প্রচণ্ড গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় বিষয় হল অন্য আরেক জন মানুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা। অন্যথায় আপনি মৃত, মাটির সাথে মিশে যাওয়া লক্ষ-কোটি মৃত মানুষের মতই। কিন্তু কেউ যদি যোগাযোগ, অন্যকে বোঝা বা ভালোবাসার পথে কেবল প্রথম পদক্ষেপটি নিতে পারে এবং এ নিয়ে তার মধ্যে কোন ভ্রম না থাকে তাহলে এটাই তার জীবনের জন্য যথেষ্ট। কারণ ভবিষ্যৎ যত কঠিনই হোক না কেন সে বেঁচে থাকতে পারবে, ভালোবাসাই তাকে রক্ষা করবে। কিন্তু ভ্রমের মধ্যে বাস করলে পৃথিবী ভরা ভালোবাসাও তার কিছু করতে পারবে না। ভালোবাসাই তো সবচেয়ে বড় বিষয়, তাই না?
প্লেবয়: অনেক সমালোচক তো মনে করেন, আপনার সবচেয়ে ব্যবসাসফল সিনেমা “ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিস” এও এই থিম কাজ করেছে, এতেও ভালোবাসার মাধ্যমে মুক্তির সন্ধান করা হয়েছে। এই সিনেমার বৃদ্ধ চিকিৎসক চরিত্রটি সম্পর্কে এক সমালোচক লিখেছেন, “সারা জীবন নিজের আবেগ লুকিয়ে রাখার পর অবশেষে সে সহানুভূতির সন্ধান পায়, হৃদয়ের পরিবর্তনই তার মুক্তি এনে দেয়।” এই কথা কি ঠিক?
বারিমান: কিন্তু সে নিজেকে পরিবর্তন করে না, করতে পারেও না। এটাই ঠিক। আমি মনে করি, মানুষ চাইলেই নিজের পরিবর্তন করতে পারে না, মৌলিক পরিবর্তন আসলেই অসম্ভব। আপনিও কি তা মনে করেন না? তারা এক মুহূর্তের জন্য আলোর সন্ধান পেতে পারে, সেই সময়ে নিজেকে দেখতে পারে, সচেতন হতে পারে, কিন্তু এই মুহূর্তটাই সব, এর বেশি আশা করা যায় না। উইন্টার লাইট এ নারী চরিত্রটি শক্তিশালী, সে দেখতে পারে। সে নিজের সম্পর্কে সচেতন হয়েছে, কিন্তু তাই বলে তাদের জীবন পরিবর্তিত হয়ে যাবে না। তাদের জীবন ভয়াবহই থেকে যাবে। মুক্তির মুহূর্তটি আসার পর তাদের জীবনে কি হয়েছে তা নিয়ে সিনেমা করার কথা আমি ভাবতেও পারি না, কোনকিছুর বিনিময়েই না। আমাকে ছাড়াই এই চরিত্রগুলোকে বাকি জীবন পার করতে হবে।
প্লেবয়: উইন্টার লাইট এর মার্টা চরিত্র সম্পর্কে বলতে হয়- আপনি নারী প্রোটাগনিস্ট চরিত্রগুলো রূপায়নে অনেক গভীরতা ও সহানুভূতি দেখিয়েছেন, অনেকেই আপনার এই দিকটার প্রশংসা করেছে। এটা কিভাবে করেছেন?
বারিমান: আপনি হয়তো জিজ্ঞেস করবেন আমি নারীদের কিভাবে এত ভাল বুঝেছি। অনেক আগে থেকেই “নারী” বিষয়টি নিয়ে আমার আগ্রহ ছিল, সিনেমাতে তাদেরকে এত উদ্ভটভাবে দেখানো হয় বলেই আগ্রহী হয়েছিলাম। আমি এ অবস্থা পরিবর্তনের চেষ্টা করেছি। নারীরা যেমন ঠিক তেমনভাবেই তুলে ধরেছি, অন্তত ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে তাদেরকে যেমন অদ্ভুতভাবে দেখানো হয়েছে তার পরিবর্তন করেছি। বর্তমানে নারী চরিত্র রূপায়নে বাস্তবতার একটু কাছাকাছি থাকলেই তা পুরনো সিনেমার চেয়ে অনেক ভাল হয়ে যায়, আগের সিনেমাগুলোর অবস্থা এতই খারাপ ছিল। যাহোক, গত কয়েক বছরে আমি বুঝতে পারছি, মৌলিক দিক দিয়ে পুরুষ ও নারী একই, তাদের সবার সমস্যাই এক ধরণের। তাই আমার সিনেমায় এখন আর নারীদের গল্প বা নারীদের সমস্যা বলে কিছু নেই, পুরুষের গল্প বা পুরুষদের সমস্যার সাথে তা একাকার হয়ে গেছে। সবকিছু আমার কাছে এখন কেবলই মানবিক সমস্যা। মানুষই এখন আমার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।
প্লেবয়: আপনার পরবর্তী সিনেমাতে কি কোনভাবে অধুনা সমাপ্ত এই ট্রিলজির ছাপ থাকবে?
বারিমান: না, আমার নতুন সিনেমাটা কমেডি, ইরটিক কমেডি, খানিকটা ভূতের গল্প। এটা আমার প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র এবং আপাতত কিছুদিনের জন্য এটাই আমার শেষ সিনেমা হতে যাচ্ছে।
প্লেবয়: সিনেমাটার নাম কী?
বারিমান: “অল দি উইমেন”। আমেরিকার দর্শকরা এটা পছন্দ করতে পারে। এর থিম সঙ্গীত হচ্ছে “ইয়েস, উই হ্যাভ নো ব্যানানাস”। এটা করে আমি বেশ আনন্দ পাচ্ছি। ইতিমধ্যে একজন সুয়েডীয় লেখককে বলে দিয়েছি যে, এই সিনেমার মাধ্যমে “Bergman Ballyhoo Era” শুরু হতে যাচ্ছে। ফাইনাল কাটিং শেষ করতে আর বেশি দিন বাকি নেই। আপনি তো জানেনই, আমি নিজের সিনেমাকে ইচ্ছেমত কাটছাট করতে ইতস্তত করি না। নিজের সিনেমাকে কাটছাট করার সাথে অনেক পরিচালকের যে ভালোবাসা-ঘৃণার সম্পর্ক থাকে তা আমার মধ্যে নেই। ডেভিড লিন একবার আমাকে বলেছিলেন, তিনি শ্যুটিং শেষে সিনেমা কাটছাট করাটা একেবারেই পছন্দ করেন না, এটা তাকে রীতিমত অসুস্থ করে ফেলে। সেদিক থেকে আমি পুরোপুরি মুক্ত।
প্লেবয়: একটু আগেই আপনি বললেন, আপাতত কিছুদিনের জন্য এটাই আপনার শেষ সিনেমা হতে যাচ্ছে। এই কিছুদিনটা কত দিন?
বারিমান: সম্ভবত দুই বছর। আমি এই রয়েল ড্রামাটিক থিয়েটারে পরিচালক হিসেবে পুরোদমে কাজ শুরু করতে চাই। বেশ কয়েকটি কারণে মঞ্চ আমাকে খুব আকর্ষণ করে: প্রথম কারণ এর চাহিদা সিনেমার চেয়ে অনেক কম। সিনেমার ফুটেজ তৈরির জন্য যে পরিমাণ যন্ত্রপাতি লাগে তার দয়া থেকে মুক্ত থাকা যায়, আর মঞ্চে আপনি কখনোই নিঃসঙ্গ বোধ করবেন না। মঞ্চ মানেই অভিনেতা ও পরিচালকের মধ্যে সম্পর্ক, পরবর্তীতে দর্শক ও পরিচালকের সম্পর্ক। অভিনেতাদের তাৎক্ষণিক অভিব্যক্তিতে দর্শকদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া- বিষয়টা খুবই চমৎকার। এটা খুব অকপট ও জীবন্ত। সিনেমা একবার করে ফেললে আর পরিবর্তনের উপায় নেই, কিন্তু নাটক প্রত্যেক বার মঞ্চস্থ করার সময় পরিবর্তনের উপায় আছে, দর্শকদের প্রতিক্রিয়া সাপেক্ষে এই পরিবর্তন আনা যায়। মঞ্চ মানেই সার্বক্ষণিক পরিবর্তন, এখানে উন্নতির দুয়ার সব সময়ের জন্য খোলা। মঞ্চ ছাড়া বেঁচে থাকতে পারতাম বলে আমার মনে হয় না।
© Playboy
সূত্র: PLAYBOY INTERVIEW: INGMAR BERGMAN; A candid conversation with Sweden’s one-man new wave of cinematic sorcery
বি:দ্র: এই সাক্ষাৎকারের অধিকাংশ বঙ্গানুবাদ “চরাচর” পত্রিকার বিশেষ ইঙ্গমার বার্গম্যান সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। এই সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৭ সালের আগস্টে বারিমানের মৃত্যুর পরপর। পত্রিকার বাংলা অনুবাদটি করেছিলেন “অয়ন আয়শ্”। তার অনুবাদ থেকে অনেক কিছু হুবহু তুলে দেয়া হয়েছে। প্রায় অর্ধেক অংশ তাই অয়নের অনুবাদ থেকে নেয়া। তিনি যে অংশ অনুবাদ করেননি তা আমি নিজে করেছি। তার অনুবাদের অনেকগুলো বাক্য পরিবর্তন করেছি।
ধর্মনিপেক্ষতা বিষয়ে তালাল আসাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নার্মিন শেখ
‘ধর্ম, জাতিরাষ্ট্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা’- প্রবন্ধে আপনি লিখেছিলেন, ‘কখনো কখনো ইতিহাসের-ভুল-ব্যতয় নিয়ে ধর্মকে পাঠ করা হয়’। কেন ধর্ম তার টিকে থাকা এবং মানুষের আন্তরিক চর্চার সাথে সম্পর্কিত হয়ে পূর্ণাঙ্গ ভাবে আলোচিত হয়না? কি করেইবা ধর্মকে নিয়ে প্রচলিত এক ধরনের বুঝ তৈরী হয়? এবং কেন এই প্রত্যয়টিকে বুঝে নেয়ার ব্যাপারে আপনার বিকল্প রকম প্রচেষ্ঠা?
আমার মনে হয় এখানে খানিকটা ভুল বুঝাবুঝি আছে। আমি মূলতঃ ধর্মের আলাদা কোন সংজ্ঞা দিতে চাইনি এখানে। আমি বলতে চাইনি, আমরা অন্য একটি সমন্বয়কারী, ব্যপক অর্থবহ বা অন্য কোন ভাবে গুরুত্বপূর্ণ সংজ্ঞায়নের জন্য প্রস্তুত। আমি বরং সে বিষয়ে দৃষ্টিক্ষেপ করতে চেয়েছি যে, সমাজিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে একটি প্রকরণ (ক্যাটাগরি) হিশেবে ধর্ম কি করে প্রতিনিয়তই ধারনায়িত হচ্ছে। এবং এরকম এক-একটি ধারনার পেছনে মানুষেরও রয়েছে সুনির্দিষ্ঠ যুক্তি-কাঠামো। মানুষের বিবিধ অভিজ্ঞতা, সংগঠন, কর্মময়তা, বিতর্ক এবং এরকম নানান বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত হয়ে আছে ধর্ম। আর এজন্যই আমি ধর্মকে প্রতিনিয়ত সংজ্ঞায়নের বিষয়টিতে চোখ রাখি। আবার এটি কোন বিমূর্ত ধারনায়নও নয়, যার প্রতি আমার আগ্রহ তৈরী হয়েছে। যারা ধর্মের বিমূর্ত সংজ্ঞা বানায় তারা মূলতঃ ধর্মের সমাজিক ও ঐতিহাসিক সত্যতাকে পাশকাটিয়ে চলে; যার রয়েছে আইনি পরিধি, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা; এবং এমন অন্যান্য। আর তাই মানুষের পারিপার্শ্বিকতার পরিবর্তনের সাথে সাথে সঠিক উপাত্ত সমূহ বিবেচনায় ধর্মের সংজ্ঞায়নের পথ খুঁজে নেয়া দরকার। এভাবে মানুষ সমাজিক জীবনের মধ্যেই ধর্মকে চিন্তা করে। প্রবন্ধে এ বিষয়টিই ছিল আমার আলোচ্য।
ধর্মের বংশানুক্রম গ্রন্থে ধর্মের সংজ্ঞায়নে সংস্কৃতির তুল্যমূল্যতা‘র চেয়ে ইতিহাসের তৈয়ার গুলো আমার কাছে বিবেচ্য হয়েছিল, যেটি যেকোন সমাজেই প্রয়োগ সম্ভব।
এরকম একটি বিতর্ক বেশ প্রচলিত আছে যে, ব্যক্তিক পরিসরে ধর্মের সংকোচনের মধ্যদিয়ে পশ্চিমের আধুনিকীকরণ (মডার্নাইজেশন) প্রকল্প‘র চুড়ান্ত বাস্তবায়ন সম্ভব হবে; যদিও ধর্ম নিজেকে জনপরিসরেই উপস্থাপন করে থাকে। কিন্তু আধুনিকায়নের এধারনা একটি অসম্পূর্ণ বা ব্যর্থ প্রকল্পই উৎপাদন করে মাত্র। অথবা সমাজ ঐতিহ্যের শেষ চিহ্ন হিসেবে ধর্ম আধুনিকতার অপ্রতিরোধ্য বিজয়ে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়- এবিষয়ে আপনার অভিমতটি কেমন?
নিশ্চিত ভাবে বলতে গেলে এটি একটি তত্ত্বই মূলতঃ। কিন্তু এভাবে চিনত্মা করা সঠিকও হবেনা যে, অনেকদিন ধরে যে সত্যটি তৈরী হয়ে আছে, ইতিহাস পরিসমাপ্ত। উনিশ শতকের শুরুর থেকে বিবিধ আলোচনায় এবিষয়টিও পরিষ্কার নয়, কথিত ধর্মের পরিসমাপ্তি কি করে একেবারেই একটি সহজ ব্যপার। এছাড়া লক্ষ্যনীয়, রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে পৃথকীকরণের মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতার যে ভাবনা মানুষ পোষন করে সেটি কিছু সুনির্দিষ্ট (প্রকরণের) দেশেই কেবল অভিযোজিত হতে পরেছে।
এখানে পশ্চিমের তিনটি রাষ্ট্রের উল্লেখ হতে পারে যেগুলো অন্যদের কাছে উদারনৈতিক, গনতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিশেবে উপস্থাপিত হয়; আর এগুলো হচ্ছে- ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। খুব পরিকল্পিত ভাবে বলি যদি, ফ্রান্স একটি রাষ্ট্র হিশেবে এবং একটি সমাজ হিশেবে ধর্মনিরপেক্ষ। আর ইংলেন্ডে যদিও একটি প্রতিষ্ঠিত ধর্ম রয়েছে, তবুও এটি একটি ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ। এবং যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে একটি নিবিড় ধর্ম-সমাজ, রাষ্ট্র হিশেবে এটি ধর্মনিরপেক্ষ। এছাড়া ধর্ম ও রাজনীতি এখানে নিজস্বতার বাইরে এসে ভিন্ন ভিন্ন সমঝোতার পথ রচনা করে। ফলে এখানে, আলোচ্য তিন সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যেও রয়েছে এবিষয়ে সংবেদনশীলতার ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা। এক্ষেত্রে মানুষ এমন সব ভুল প্রতিক্রিয়াও করে যা ধর্মনিরপেক্ষতার মূল ভাবনার বিপরীত।
উদাহরণ স্বরূপ: এমন সংবেদন প্রতিক্রিয়ার প্রমান মেলে, ফ্রান্সের মুসলিম মেয়েদের সরকারী স্কুলে হিজাব পরিধানের বৈধ অনুমতি দেয়া নিয়ে বিতর্কে। বিষয়টি ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের মধ্যে একটি নেতিপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে; যেখানে সরকারী স্কুলে ইয়াহুদিদের ইয়ারমূলকা (ধর্মীয় প্রতীকী টুপি) পরবার বিষয়ে তাদের কোন প্রতিক্রিয়াই নেই। আমি এখানে অনৈতিক অসাম্যর বিষয়টি তুলে ধরতে চাইছিনা; বরং আমি বলতে চাইছি একটি সুনির্দিষ্ট ধর্মনিরপেক্ষ সমাজে জনপরিসরে ধর্মীয় প্রতীকের ব্যবহার নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের যে বিবিধ রাজনৈতিক মূল্যায়ন তার প্রকৃত অর্থবোধকতার কথা। অন্যদিকে আমেরিকার কথা যদি বলি; এখানে ধর্ম এবং রাষ্ট্রের মধ্যকার দূর-সম্পর্ক নিরুপনে পরিষ্কার নিয়মনীতি যদিও রয়েছে, কিন্তু তবুও এটি বর্তমান আমেরিকান প্রশাসনে ‘ধর্মভিত্তিক’ (ননসেক্যুলার) রাজনৈতিক কর্মকান্ডকে প্রতিহত করতে অপারগ। যেমন আমরা যেভাবে জানি যে, খৃষ্টানদের অধিকারের বিষয়টি বুশ সরকারের অন্তরবস্তু হিশেবেই আছে। এটি আমেরিকায় অবস্থিত জাইওনিস্ট (ইহুদি স্বরাজের স্বপ্নধারী) সংস্থা সমূহের এন্টি-সেমেটিক একটি জোট, যার রাজনৈতিক ভাবনা হচ্ছে বাইবেলে বর্ণিত ঈশ্বর ও শয়তানের মধ্যকার যুদ্ধটি (Armageddon) শুরু করা এবং এই স্বপ্নের সঠিক প্রারম্ভটি ইরাকের সাথে যুদ্ধ দিয়েই এগিয়েছে। এভাবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ যুদ্ধ সমর্থিত হয়েছে ধর্মীয় কারণ দিয়ে। এখানে আবার বলি, ধর্মের অধিকার নিয়ে কারো বিরোধীতা করবার জন্য আমার এ বক্তব্য নয় (আমি এরূপ আচরনের অবশ্য-বিরোধিতা করে), বরং এ সত্যটি তুলে ধরাই আমার উদ্দেশ্য যে একটি সেক্যুলার রাষ্ট্র উপর-উক্ত রকমের পলিটিকস অনায়াসেই খেলতে পারে, যেকোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই।
আর তাই আমার মনে হয়, আমাদের এখন সেই শুরুর প্রশ্ন নিয়ে শুরু করা উচিৎ যে কোনটি আধুনিকতা আর কোনটি নয়; এবং কোন বিষয়টি স্বভাবতই একটি উদারনৈতিক আধুনিক রাষ্ট্রের জন্য প্রত্যাশিত। এক্ষেত্রে আমার মনে হয় সমাজ পরিবর্তনে আধুনিকতার গতিপথটি প্রথমেই বিবেচ্য হওয়া উচিত; যেখানে মানুষের সহাবস্থান চর্চা, পরিবর্তন-প্রকৃতি এবং পূণঃ গ্রহণযোগ্যতা দিয়ে সকল মানিয়ে নেওয়ার বিষয়গুলো সম্পৃক্ত থাকবে। কেননা এই পরিবর্তনের ফলশ্রুতি হিশেবেই ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির জন্ম। আর এজন্যই আধুনিকতা-ধর্মনিরপেক্ষতা‘র প্রসঙ্গ সমূহ নিশ্চিন্ত কোন মামুলি কিস্সা নয়। সকলের জন্য আধুনিকতা একটি অবসম্ভাবী গন্তব্য- এমন চিন্তাকে আমি প্রশ্নাতিত ভাবে মেনে নিতে নারাজ। এমনও একটি চিন্তা আছে যেখানে আধুনিকতাকে ইতিহাসের একটি স্তর হিশেবে বিবেচনা করে, তবে মানুষ এমন সময়ের মধ্যদিয়ে বসবাস করে। আমরা নিশ্চিত ভাবে বলতে পারিনা, আধুনিকতার মাঝে এমন ধারনাও অন্তর্ভূক্ত হয়ে আছে যে, মানুষ একটি কথিত উদারনৈতিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রই প্রত্যাশা করে।
ধর্মনিরপেক্ষতা দীর্ঘদিন থেকে আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়ার একটি মৌলিক বিবেচনা হিশেবে আলোচিত হয়ে আসছে। এই প্রেক্ষিতে ধর্ম এবং ধর্মনিপেক্ষতার সম্পর্ককে আপনি কিভাবে দেখেন?
ধর্মনিরপেক্ষতার গড়ে ওঠা- গ্রন্থে আমি মানুষের সংবেদনশীলতা, অভিজ্ঞতা এবং পারিপার্শ্বিক নানা ধারনা (concepts) সমূহ মানুষের জ্ঞানেন্দ্রিয়ে বিষয় (subjects) হিশেবে অভিযোজন করবার প্রসঙ্গটিতে দৃষ্টি দিয়েছি; যাকিনা মানুষের সত্য বুঝবার পথ নিয়ন্ত্রন করে। পাশাপাশি রাজনৈতিক মতবাদ হিশেবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বুঝতে চেয়েছি। আধুনিক রাষ্ট্রে আইনের ধর্মনিরপেক্ষকরণ এবং নৈতিকতার প্রসঙ্গ সমূহও এক্ষেত্রে বিবেচ্য হয়েছে। ফলে, এটি একটি জটিল প্রশ্ন হিশেবেই আমাদের সামনে উপস্থিত হয়। এছাড়া অন্য কোন ভাবে আমরা আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ নিত্য রাজনৈতিক বাস্তবতাকে তার সার্বিক গূঢ়ার্থসহ বুঝতে অসমর্থ হব। আমার মনে হয় এসকল বিষয়ে মানব বিজ্ঞান সমূহে আরো অধিক ভাবনা ও মনযোগিতা প্রয়োজন, এবং অতঃপর এগুনো যাবে আরো।
ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মীয় অনুশাসনের পরিপ্রেক্ষিতে ‘অন্য’ হিশেবে চিহ্নিত, আর তাই রাজনৈতিক মতবাদ হিশেবে এটি ধর্মের গড়ে ওঠার সাথে নিবিড় ভাবে সম্পর্কিত হয়। ধরে নেয়া হয়, একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র সুনির্দিষ্ট ভাবে ধর্ম হতে সম্পূর্ণতঃই আলাদা হবে। ফলে রাষ্ট্রকে প্রতিনিয়তই তার আইনী নীতি-প্রক্রিয়া‘র নির্ধারণ/পূণঃনির্ধারণ জরুরী হয়ে পড়ে; কোনটি প্রকৃতই ধর্মীয় আচরণ এবং কতটুকুইবা এর পরিধি তা নির্ধারণ করা বা আইনী সংজ্ঞা প্রণয়ন করা রাষ্ট্রের একটি নৈমিত্তিক কাজ হয়ে পড়ে। অন্য ভাবে বললে, রাষ্ট্রকে এর থেকে কোন ভাবেই আলাদা করা যায়না। আত্মবিরোধী সত্য হিশেবে (Paradoxically) আধুনিক রাজনীতি কোন ভাবেই ধর্ম থেকে আলাদা বা স্বাধীন আবস্থান নিতে পারেনা; যেমনি করে ধর্মনিরপেক্ষতার একধরনের মামুলি মতবাদ দাবী করে থাকে। তারা মনে করে, ধর্ম ও রাজনীতির নিজেদের জন্য আলাদা আলাদা পরিসর তৈরী করে নেবে। একটি রাজনৈতিক স্বত্তা বা বাস্তবতা হিশেবে রাষ্ট্র‘র কাজ হচ্ছে কেবল ধর্মের জন-গ্রহণযোগ্য কোন গড়ন দাঁড় করা।
ধর্মনিরপেক্ষতার গড়ে ওঠা- গ্রন্থে আপনি লিখেছেন ‘যুদ্ধ এবং শান্তির মতবাদ হিশেবে ধর্মনিরপেক্ষতা পশ্চিমীয় (এবং অপশ্চিমাদের জন্য অপরিচিত এমন) নয়। বরং ধনতান্ত্রিক জাতিরাষ্ট্র গড়ে ওঠার সাথে এটি নিবিড় ভাবে সম্পর্কিত, পাশাপাশি ক্ষমতা ও সাফল্যের ক্ষেত্রে ধর্ম ও রাষ্ট্র উভয়ের মধ্যে এটি প্রশ্ন-সাপেক্ষ ও অসম সম্পর্কের সৃষ্টি করে; যা মূলতঃ বিবিধ সমঝোতার ভিত্তিতে, গ্রহণযোগ্যতায় এবং হুমকি নিয়ে একটি সমবেত-ব্যক্তিত্ব অধিগ্রহণ করে’। ধর্মনিরপেক্ষতার বিশ্ব রাজনীতি বিবেচনায় আপনি কিভাবে এই অসামঞ্জস্যতার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করবেন?
তৃত্বীয় বিশ্বে আরবদেশ সমূহে ধর্মনিরপেক্ষতার একটি সাধারণ সমলোচনা হচ্ছে- এটি মতবাদ হিশেবে বাইরের বা আরবদেশ গুলোর জন্য অপরিচিত এবং মুসলিম সমাজের জন্য অগ্রহণযোগ্য। আমার কাছে এটি এমন কোন বাঙ্ময় বিতর্ক বলে মনে হয়নি। পূর্ব থেকেই আরব সমাজ ও এর জনগোষ্ঠি বাইরের বিভিন্ন ধারনা ও চর্চা সমূহকে নিজেদের মধ্যে অভিযোজন করে নিয়েছে। এমন কি আমরা এও জানি, মুসলিম দুনিয়া পূর্বের অনেক ধ্যান-ধারনা ও জীবন-যাপন রীতির-ই সমন্বিত ও উন্নত রূপ; এবং এভাবেই তাদের বর্তমান সময়ের চিন্তা-ভাবনা, জীবন-যাপন ইত্যাদি তৈরী হয়েছে। এছাড়া সবসময়ই তারা চিন্তা ও চর্চার ক্ষেত্রে উদারতার সাথে ঋণী হয়েছে। এখন তাই প্রশ্ন হচ্ছে- তাদের কাছে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ এমন কোন্ সমস্যা তৈরী করে যার সমাধান হওয়া প্রয়োজনীয় বলে মনে করা হচ্ছে? আমার মনে হয়, এক্ষেত্রে আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের ক্ষমতায়নের বিবিধ সমস্যাবলীই ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে জটিলতার সূত্রপাত করে। আধুনিক রাষ্ট্রের কেন্দ্রীভূত শাসন প্রক্রিয়া, সহিংসতায় রাষ্ট্রের একচ্ছত্র অধিকার, একমাত্র রাষ্ট্র‘র-ই আছে অভ্যন্তরীন ভাবে ক্ষমতা-চর্চা বা শক্তি প্রয়োগের বৈধ নিশ্চিদ্র অধিকার (স্বত্তাধিকার)- এমনসব পূর্বধারণা এবং বহির বিশ্বের সাথে একমাত্র রাষ্ট্রই যুদ্ধ পরিচালনা করতে পারে ও একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠিকে সমরূপ শৃংখলায় আগলে রাখতে পারে- মূলতঃ এ সমস্ত কিছুই একটি প্রকল্প হিশেবে কাজ করছে যার মধ্যদিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার ক্রমবিকাশ সম্ভব হয়ে ওঠেছে। আমরা জানি, পশ্চিম ইউরোপে শুধুমাত্র একটি একক ধর্মকেই কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র সমূহের আত্মপরিচয়ে একমাত্র বিবেচ্য বানানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল একসময়। বিফলে চেষ্ঠা করা হয়েছিল মানুষের ধর্ম বিশ্বাসকে একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় হিশেবে গন্য করবার। এটি ছিল মূলতঃ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও প্রচল-আলাপচারিতার (discourse) ভিত্তিতে রাষ্ট্রের মাধ্যকার বিভিন্ন গড়ন গুলো তৈরী করে নেয়ার-ই একটি প্রক্রিয়া। অন্যদিকে একটি রাষ্ট্রের অন্যান্য ক্রিয়াশীলতাকে (এ্যাকটর হিশেবে ব্যক্তির ঝোঁক বা প্রবনতাকে) অবিবেচ্য রেখে রাষ্ট্রের মধ্যকার সামাজিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব‘র পূণব্যবস্থাপনাকে তারা তাদের প্রধান সমস্যা হিশেবে মোকাবিলা করেছে। কিন্তু এসমস্ত কিছুই তাদের নিজেদের মধ্যকার (আত্ম‘র) অন্তর্ভূক্ত বিষয় হিশেবে আসেনি; বরং বিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক প্রবণতা হিশেবেই ছিল। একটি দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও চিন্তুকেরা অন্য কোন রাষ্ট্রে রাজনৈতিকদের সাথে নানান সমঝোতা ও মিথষ্ক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হতো- এমনকি তাদের মধ্যে অনেকেই নিজ দেশের বৈরী রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পশ্চিম ইউরোপিয়ান অন্যান্য দেশগুলোর সাথে আলোচনা করতো নিজেদের অভ্যনত্মরীণ সমস্যাবলী নিয়ে। এবং প্রিন্সরা নিজেদের মধ্যে মাঝে মাঝে একধরনের ঐক্য গড়ে তুলতো; আবার ঝগড়া করতো একে অন্যের সাথে। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে থেকে তারা নিজেদের স্বরাজ টিকিয়ে রাখতে সমস্ত বৈদেশিক কার্যক্রমকেই প্রতিহত করতো। ইউরোপের জাতিরাষ্ট্র গুলোর মধ্যকার সম্পর্ক ও টানাপোড়নের ভিত্তিতেই উদ্ভব হয়েছিল আন্তর্জাতিক আইন (international law)| কিন্তু পরে বিশ্বব্যাপী, বিশেষতঃ উপনিবেশিক চর্চা ও বানিজ্যিক সাম্রাজ্য গঠিত হওয়ার সময়ে আমেরিকা ও এশিয়ার দেশ সমূহের জন্যও এটি সম্পর্কিত হয়ে উঠে। (এ পরিসরে আফ্রিকার ইউরোপিয়ান উপনিবেশ অন্তর্ভূক্ত হয় আরো পরে।) আন্তঃর্জাতিক বাজারে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার বৈধতা বিষয়ে একটি বিখ্যাত বিতর্কে একসময় বিশেষ ভাবে জড়িয়ে পড়েন আন্তঃর্জাতিক আইনের প্রতিষ্ঠাতা হুগো গ্রোজিয়াস (Hugo Grotius); যেখানে ইউরোপিয়ান খ্রিষ্টান এবং অন্যান্য ধর্মালম্বীদের মধ্যে গঠিত বানিজ্যিক চুক্তি সমূহ ছিল এ বিতর্কের মৌলিক/ সমস্যাসঙ্কুল জিজ্ঞাসা। আর তাই ধর্মনিরপেক্ষতা- যে পদ্ধতি বা উদ্দেশ্যেই ক্রিয়াশীল হোকনা কেন- রাষ্ট্রের ক্ষমতা চক্র কি কোন ভাবেই ধর্মীয় বৈসাদৃশ্যকে এড়িয়ে যেতে পারে? উনিশ এবং বিশ শতকের শুরুর দিকে উপনিবেশ সরকারের বিবর্তনে রাষ্ট্রের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠায় ‘স্থানীয়’দের ধর্ম এবং খ্রীষ্টান মিশনারীর ধর্ম প্রচারের প্রসঙ্গটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বর্তমান সময়ে আমেরিকা সক্রিয়ভাবে তৃত্বীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক নীতিমালা (ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে মুক্ত) প্রয়োগে আগ্রহী; এবং সেটি এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে যে ধর্মনিরপেক্ষতা গনতন্ত্র ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। ধর্মনিরপেক্ষতার গড়ে ওঠা গ্রন্থে আমি বলেছি, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আমেরিকান ইন্টারনেশন্যাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম এ্যাক্ট ২০০৮- এর কিছু প্রয়োগ লক্ষণীয় এবং এটি রাজনৈতিক পূণরুদ্ধার প্রচেষ্ঠারই একটি অংশ যা ধর্মনিরপেক্ষতার সাথে মৌলিক ভাবে সম্পর্কিত।
যদিও আধুনিকতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে যৌথভাবে কখনো কখনো গঠনমূলক মনে হয়; কোন একটি জায়গায় আপনি এমনটি উলে¬খ করেছেন যে, আধুনিকতার জন্য ধর্মের প্রাতিস্বিকীকরণ (privatization of religion) ধর্মনিরপেক্ষতার নিজস্ব পরিসরেও (যাকে ধর্মনিরপেক্ষকরণ প্রক্রিয়া বলি) গুরুত্বপূর্ণ নয়। তার চেয়ে বরং, ধর্ম কি করে জনপরিসরে বারবার ফিরে আসে এবং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে এটি অনেক জরুরী বিষয়। এক্ষেত্রে উপনিবেশিকতার ভূমিকাকে আপনি বিশেষভাবে মূল্যায়ন করেছেন। আপনি কি বিষয়টি আরো একটু খোলাসা করে বলবেন?
আমার মনে হয়, জোস কসানোভা (Jose Casanova) বিতর্কে আমার যে মন্তব্য ছিল সে সম্পর্কেই আপনি ইংগিত করছেন এখানে; যেখানে বলা হয়েছিল- আধুনিকতার জন্য ধর্মকে ব্যক্তি পর্যায়ে সংক্ষিপ্ত করবার কোন প্রয়োজন নেই; যেভাবে মতবাদ হিশেবে ধ্রুপদি ধর্মনিরপেক্ষতা ভাবতে আগ্রহী হয়। কসানোভার বক্তব্য ছিল- কিছু কিছু ক্সেত্রে ধর্মকে গনতন্ত্র ও আধুনিকতার অগ্রযাত্রায় সহায়ক হিশেবে দেখা যেতে পারে, যেমন কমিউনিষ্ট শাসিত পোলান্ডে ক্যাথলিক চার্চের নীতি প্রচলিত থাকা; এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে চার্চ কখনো কখনো ‘অগ্রবর্তী’ রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করে। উনার ইতিবাচক উদাহরণ ও বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে এই আলোচনায় আমার আলাপ ছিল- উলে¬খিত গুলো ধর্মের এমন কিছু নির্দিষ্ট গড়ন যেগুলো ছিল উদারীকৃত, ধর্মনিরপেক্ষ ধর্মীয় আন্দোলন; এবং যা মোটেও ‘সমস্যাসঙ্কুল’ ছিলনা। ভিন্ন ভাবে, আধুনিকতার অগ্রযাত্রায় ধর্ম প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সমস্ত মূল্যবোধ গুলোকে এটি অনেকাংশে প্রতিনিধিত্ব করে এবং এ বিষয়ে ধর্ম সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী ও গড়ন তৈরী করে দিতে সহায়তা করে। কিন্তু পরবর্তীতে আমরা যেটি দেখি, ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়ে ফ্রান্সের সামপ্রতিক যে মূল্যায়ন এটি তেমনও নয়।
প্রকৃত অর্থে বিষয়টি কি এভাবে হাজির নয় যে, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র নিজস্ব একটি অনুধাবনা থাকা সত্ত্বেও ইউরোপের ইতিহাসে প্রক্রিয়াটি কখনোই সেভাবে উপস্থিত ছিলনা? ধর্মনিরপেক্ষকরণের সময়কালে ‘ইহুদি-প্রশ্ন’, বিশেষ করে ইউরোপে এসময় ব্যপক ভাবে ইহুদিদের খ্রীষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরের বিষয়টিও এক্ষেত্রে নির্বন্ধ উদাহরন হতে পারে। এছাড়া উপনিবেশকালে, বিশেষতঃ যখন ধর্মনিরপেক্ষকরণ প্রক্রিয়াটিও শুরু হয়ে গিয়েছিল, সেই সময়ে পশ্চিমারা সারাবিশ্ব জুড়ে খ্রীষ্টান মিশনারী প্রেরণের কাজটি শুরু করেছিল; এবং এখনো কাজটি চলছে সভ্যতা ও সভ্যতা-প্রকল্পের সমার্থক হয়ে। ভিন্ন ভাবে বলা হলে বিষয়টি কি এমনও নয় যে, ধর্মনিরপেক্ষকরণ প্রকল্পে ধর্মীয় বিষয়াবলী ম্রীয়মান হয়ে যাওয়া দূরে থাক, খ্রীষ্টান ধর্ম এবং ধর্মতত্ত্বের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, এবং এটি মূলতঃ নাটকীয় ভাবেই আধুনিকতায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনও বানায়?
না, আপনার এমন প্রারম্ভিক মন্তব্য‘র আমি দ্বিমত পোষন করছি। মনে রাখতে হবে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ মূলতঃ একটি প্রক্রিয়া; সম্পূর্ণভাবে পরিসমাপ্ত কোন অবস্থা নয়। এবং নিশ্চিত ভাবে এটি পশ্চিমের ’স্ব-বোধগম্যতা’ থেকে উদ্ভুত। কিন্তু ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এটি বিভিন্ন গড়ন নিয়েছে, এবং সর্বোপরি এটি তৈরী করেছে নানান বৈপরীত্ব ও টানাপোড়ন। সমপ্রতি ফান্সের ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়ে আমার লেখা একটি প্রবন্ধে আমি বিশদ ভাবে এই বিষয়টিই উপস্থাপন করেছি যে, প্রকৃত অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতার এমন একটি উদাহরণও খোঁজে পাওয়া যাবেনা যাকে আদর্শ (ideal) বলা যায়। তবে আপনার শেষ প্রশ্নে‘র প্রতিউত্তরে আমি বলতে চাই- হ্যাঁ, অবশ্যই ইউরোপে খ্রীষ্টান ধর্ম এখনো সজীব (এবং ভূমিকা রাখছে দেশের অভ্যন্তরে আর বাইরেও) এবং অবশ্যই এটাও স্বীকার্য যে, আধুনিক সময়ে খ্রীষ্টান ধর্মতত্ত্বে অনেক নিবিড় সংস্কার এসেছে। কিন্তু তাতে ধর্মনিরপেক্ষতার কোন প্রকরণ ইউরোপে নেই বলে প্রমানিত হয়না। আমার বিতর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, ইউরোপে প্রকৃতই ধর্মনিরপেক্ষ কোন রাষ্ট্র নেই- এমন প্রচল ধারনাকে বাতিল করা। আমি মনে করিনা এখানে ‘প্রকৃত’ কোন ধর্মনিরপেক্ষ বিষয় বর্তমান আছে। বরং আছে ধর্মনিরপেক্ষতার ঐতিহাসিকতাপূর্ণ কিছু গড়ন যাকে ইতিহাসে আধুনিক সমাজে ক্ষমতা-সম্পর্কের সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যা ‘রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও প্রগতি‘র ক্ষেত্রে জনধর্মের হুমকি স্বরূপ।
আপনি বলেছেন, ‘কোন বিপ্লব নিতান্ত বিশ্বাস থেকে চালিত হয়না অথবা ইউরোপে জনপরিসরের অযৌক্তিক আলাপচারিতা কোন ভাবেই রাষ্ট্র ক্ষমতা সম্পর্কে নিরপেক্ষ নয়’। এটি যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে কেন বলা হয় যে, ইসলামপন্থিরা ধর্মের ‘রাজনীতিকীকরণ’ ঘটাচ্ছে?
সংক্ষিপ্ত ভাবে বললে, ইসলামপন্থিরা কোন ভাবেই রাষ্ট্র ক্ষমতার উর্দ্ধে কিছু নয়, তারা চাননা জিহাদ কেবল ব্যক্তিবিশ্বাসের (mere personal belief) তলানি হিশেবে থাক।
আপনি আরো বলেছেন, ‘(প্রত্যাশানুযায়ি) ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র সার্বিক সহিষ্ণুতার দায়ভার গ্রহণ করেনা; বরং যাবতীয় উচ্চাকাংখা ও উদ্বেগ নিয়েই এটি সচেষ্ট/সচেতন থাকে’। এমন ভাবনা দিয়ে- ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ যেকোন ধর্মভিত্তিক সমাজের চেয়ে কম সহিংস ও কম দ্বন্ধ মূখর- এই পূর্বধারনাকে কি করে অমীমাংসিত অবস্থায় উপস্থাপন করতে পারে? ধর্মীয় সহিংসতা নিয়ন্ত্রন, লালন ও এড়ানোর ক্ষেত্রে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ভূমিকা-ইবা কি?
অন্যান্য‘র মতন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র নিজেও এধরনের কিছু দায়ভার নিয়ে থাকে, তবে অন্যের দায় থেকে সে মুক্তই থাকে। এটি যেকোন ধরনের প্রতিবন্ধতকা ও গোপনীয়তা ব্যতিরেখে রাষ্ট্রের জনমানুষের ধর্ম ও বিশ্বাস চর্চার অধিকারকে নিশ্চয়তা প্রদান করে। এবং রাষ্ট্র এই-নিশ্চয়তা ততক্ষণ পর্যনত্মই দিতে থাকে যতক্ষণ না এটি রাষ্ট্রের অখন্ডতায় হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ‘হুমকি’কে কোন সুনির্দিষ্ট অর্থে ধরা যায়না এখনে। দ্বন্ধ ও সহিংসতায় সত্যিই কি একটি ধর্মনিরপেড়্গ সমাজ কম পড়্গপাত পোষন করে? সহিংসতা আর দমন প্রক্রিয়ার কিছু প্রসিদ্ধ গড়ন আপনি হয়তো পাবেন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের কম-সহিংসতা-ব্রতকে ব্যাখ্যা করবার জন্য; যে গড়ন গুলোকে খোদ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রই সংঙ্গায়িত করে থাকে, যেমন রাষ্ট্রে অভ্যন্তরে- রেস, জেন্ডার, ক্লাস ইত্যাদি এইসব; এবং বহির্বিশ্বে নব্য-সাম্রাজ্যবাদী কর্তৃত্ব, বিদ্রোহ দমন ইত্যাদি। দেশের অভ্যনত্মরে এবং বাইরের সহিংসতা, দমন, দ্বন্ধ-এসকল বিষয়ে উদার গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র সমূহ রাজনৈতিক ভাবে বরং এখন অনেক সচেতন।
মূল
আমার মনে হয় এখানে খানিকটা ভুল বুঝাবুঝি আছে। আমি মূলতঃ ধর্মের আলাদা কোন সংজ্ঞা দিতে চাইনি এখানে। আমি বলতে চাইনি, আমরা অন্য একটি সমন্বয়কারী, ব্যপক অর্থবহ বা অন্য কোন ভাবে গুরুত্বপূর্ণ সংজ্ঞায়নের জন্য প্রস্তুত। আমি বরং সে বিষয়ে দৃষ্টিক্ষেপ করতে চেয়েছি যে, সমাজিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে একটি প্রকরণ (ক্যাটাগরি) হিশেবে ধর্ম কি করে প্রতিনিয়তই ধারনায়িত হচ্ছে। এবং এরকম এক-একটি ধারনার পেছনে মানুষেরও রয়েছে সুনির্দিষ্ঠ যুক্তি-কাঠামো। মানুষের বিবিধ অভিজ্ঞতা, সংগঠন, কর্মময়তা, বিতর্ক এবং এরকম নানান বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত হয়ে আছে ধর্ম। আর এজন্যই আমি ধর্মকে প্রতিনিয়ত সংজ্ঞায়নের বিষয়টিতে চোখ রাখি। আবার এটি কোন বিমূর্ত ধারনায়নও নয়, যার প্রতি আমার আগ্রহ তৈরী হয়েছে। যারা ধর্মের বিমূর্ত সংজ্ঞা বানায় তারা মূলতঃ ধর্মের সমাজিক ও ঐতিহাসিক সত্যতাকে পাশকাটিয়ে চলে; যার রয়েছে আইনি পরিধি, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা; এবং এমন অন্যান্য। আর তাই মানুষের পারিপার্শ্বিকতার পরিবর্তনের সাথে সাথে সঠিক উপাত্ত সমূহ বিবেচনায় ধর্মের সংজ্ঞায়নের পথ খুঁজে নেয়া দরকার। এভাবে মানুষ সমাজিক জীবনের মধ্যেই ধর্মকে চিন্তা করে। প্রবন্ধে এ বিষয়টিই ছিল আমার আলোচ্য।
ধর্মের বংশানুক্রম গ্রন্থে ধর্মের সংজ্ঞায়নে সংস্কৃতির তুল্যমূল্যতা‘র চেয়ে ইতিহাসের তৈয়ার গুলো আমার কাছে বিবেচ্য হয়েছিল, যেটি যেকোন সমাজেই প্রয়োগ সম্ভব।
এরকম একটি বিতর্ক বেশ প্রচলিত আছে যে, ব্যক্তিক পরিসরে ধর্মের সংকোচনের মধ্যদিয়ে পশ্চিমের আধুনিকীকরণ (মডার্নাইজেশন) প্রকল্প‘র চুড়ান্ত বাস্তবায়ন সম্ভব হবে; যদিও ধর্ম নিজেকে জনপরিসরেই উপস্থাপন করে থাকে। কিন্তু আধুনিকায়নের এধারনা একটি অসম্পূর্ণ বা ব্যর্থ প্রকল্পই উৎপাদন করে মাত্র। অথবা সমাজ ঐতিহ্যের শেষ চিহ্ন হিসেবে ধর্ম আধুনিকতার অপ্রতিরোধ্য বিজয়ে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়- এবিষয়ে আপনার অভিমতটি কেমন?
নিশ্চিত ভাবে বলতে গেলে এটি একটি তত্ত্বই মূলতঃ। কিন্তু এভাবে চিনত্মা করা সঠিকও হবেনা যে, অনেকদিন ধরে যে সত্যটি তৈরী হয়ে আছে, ইতিহাস পরিসমাপ্ত। উনিশ শতকের শুরুর থেকে বিবিধ আলোচনায় এবিষয়টিও পরিষ্কার নয়, কথিত ধর্মের পরিসমাপ্তি কি করে একেবারেই একটি সহজ ব্যপার। এছাড়া লক্ষ্যনীয়, রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে পৃথকীকরণের মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতার যে ভাবনা মানুষ পোষন করে সেটি কিছু সুনির্দিষ্ট (প্রকরণের) দেশেই কেবল অভিযোজিত হতে পরেছে।
এখানে পশ্চিমের তিনটি রাষ্ট্রের উল্লেখ হতে পারে যেগুলো অন্যদের কাছে উদারনৈতিক, গনতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিশেবে উপস্থাপিত হয়; আর এগুলো হচ্ছে- ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। খুব পরিকল্পিত ভাবে বলি যদি, ফ্রান্স একটি রাষ্ট্র হিশেবে এবং একটি সমাজ হিশেবে ধর্মনিরপেক্ষ। আর ইংলেন্ডে যদিও একটি প্রতিষ্ঠিত ধর্ম রয়েছে, তবুও এটি একটি ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ। এবং যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে একটি নিবিড় ধর্ম-সমাজ, রাষ্ট্র হিশেবে এটি ধর্মনিরপেক্ষ। এছাড়া ধর্ম ও রাজনীতি এখানে নিজস্বতার বাইরে এসে ভিন্ন ভিন্ন সমঝোতার পথ রচনা করে। ফলে এখানে, আলোচ্য তিন সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যেও রয়েছে এবিষয়ে সংবেদনশীলতার ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা। এক্ষেত্রে মানুষ এমন সব ভুল প্রতিক্রিয়াও করে যা ধর্মনিরপেক্ষতার মূল ভাবনার বিপরীত।
উদাহরণ স্বরূপ: এমন সংবেদন প্রতিক্রিয়ার প্রমান মেলে, ফ্রান্সের মুসলিম মেয়েদের সরকারী স্কুলে হিজাব পরিধানের বৈধ অনুমতি দেয়া নিয়ে বিতর্কে। বিষয়টি ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের মধ্যে একটি নেতিপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে; যেখানে সরকারী স্কুলে ইয়াহুদিদের ইয়ারমূলকা (ধর্মীয় প্রতীকী টুপি) পরবার বিষয়ে তাদের কোন প্রতিক্রিয়াই নেই। আমি এখানে অনৈতিক অসাম্যর বিষয়টি তুলে ধরতে চাইছিনা; বরং আমি বলতে চাইছি একটি সুনির্দিষ্ট ধর্মনিরপেক্ষ সমাজে জনপরিসরে ধর্মীয় প্রতীকের ব্যবহার নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের যে বিবিধ রাজনৈতিক মূল্যায়ন তার প্রকৃত অর্থবোধকতার কথা। অন্যদিকে আমেরিকার কথা যদি বলি; এখানে ধর্ম এবং রাষ্ট্রের মধ্যকার দূর-সম্পর্ক নিরুপনে পরিষ্কার নিয়মনীতি যদিও রয়েছে, কিন্তু তবুও এটি বর্তমান আমেরিকান প্রশাসনে ‘ধর্মভিত্তিক’ (ননসেক্যুলার) রাজনৈতিক কর্মকান্ডকে প্রতিহত করতে অপারগ। যেমন আমরা যেভাবে জানি যে, খৃষ্টানদের অধিকারের বিষয়টি বুশ সরকারের অন্তরবস্তু হিশেবেই আছে। এটি আমেরিকায় অবস্থিত জাইওনিস্ট (ইহুদি স্বরাজের স্বপ্নধারী) সংস্থা সমূহের এন্টি-সেমেটিক একটি জোট, যার রাজনৈতিক ভাবনা হচ্ছে বাইবেলে বর্ণিত ঈশ্বর ও শয়তানের মধ্যকার যুদ্ধটি (Armageddon) শুরু করা এবং এই স্বপ্নের সঠিক প্রারম্ভটি ইরাকের সাথে যুদ্ধ দিয়েই এগিয়েছে। এভাবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ যুদ্ধ সমর্থিত হয়েছে ধর্মীয় কারণ দিয়ে। এখানে আবার বলি, ধর্মের অধিকার নিয়ে কারো বিরোধীতা করবার জন্য আমার এ বক্তব্য নয় (আমি এরূপ আচরনের অবশ্য-বিরোধিতা করে), বরং এ সত্যটি তুলে ধরাই আমার উদ্দেশ্য যে একটি সেক্যুলার রাষ্ট্র উপর-উক্ত রকমের পলিটিকস অনায়াসেই খেলতে পারে, যেকোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই।
আর তাই আমার মনে হয়, আমাদের এখন সেই শুরুর প্রশ্ন নিয়ে শুরু করা উচিৎ যে কোনটি আধুনিকতা আর কোনটি নয়; এবং কোন বিষয়টি স্বভাবতই একটি উদারনৈতিক আধুনিক রাষ্ট্রের জন্য প্রত্যাশিত। এক্ষেত্রে আমার মনে হয় সমাজ পরিবর্তনে আধুনিকতার গতিপথটি প্রথমেই বিবেচ্য হওয়া উচিত; যেখানে মানুষের সহাবস্থান চর্চা, পরিবর্তন-প্রকৃতি এবং পূণঃ গ্রহণযোগ্যতা দিয়ে সকল মানিয়ে নেওয়ার বিষয়গুলো সম্পৃক্ত থাকবে। কেননা এই পরিবর্তনের ফলশ্রুতি হিশেবেই ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির জন্ম। আর এজন্যই আধুনিকতা-ধর্মনিরপেক্ষতা‘র প্রসঙ্গ সমূহ নিশ্চিন্ত কোন মামুলি কিস্সা নয়। সকলের জন্য আধুনিকতা একটি অবসম্ভাবী গন্তব্য- এমন চিন্তাকে আমি প্রশ্নাতিত ভাবে মেনে নিতে নারাজ। এমনও একটি চিন্তা আছে যেখানে আধুনিকতাকে ইতিহাসের একটি স্তর হিশেবে বিবেচনা করে, তবে মানুষ এমন সময়ের মধ্যদিয়ে বসবাস করে। আমরা নিশ্চিত ভাবে বলতে পারিনা, আধুনিকতার মাঝে এমন ধারনাও অন্তর্ভূক্ত হয়ে আছে যে, মানুষ একটি কথিত উদারনৈতিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রই প্রত্যাশা করে।
ধর্মনিরপেক্ষতা দীর্ঘদিন থেকে আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়ার একটি মৌলিক বিবেচনা হিশেবে আলোচিত হয়ে আসছে। এই প্রেক্ষিতে ধর্ম এবং ধর্মনিপেক্ষতার সম্পর্ককে আপনি কিভাবে দেখেন?
ধর্মনিরপেক্ষতার গড়ে ওঠা- গ্রন্থে আমি মানুষের সংবেদনশীলতা, অভিজ্ঞতা এবং পারিপার্শ্বিক নানা ধারনা (concepts) সমূহ মানুষের জ্ঞানেন্দ্রিয়ে বিষয় (subjects) হিশেবে অভিযোজন করবার প্রসঙ্গটিতে দৃষ্টি দিয়েছি; যাকিনা মানুষের সত্য বুঝবার পথ নিয়ন্ত্রন করে। পাশাপাশি রাজনৈতিক মতবাদ হিশেবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বুঝতে চেয়েছি। আধুনিক রাষ্ট্রে আইনের ধর্মনিরপেক্ষকরণ এবং নৈতিকতার প্রসঙ্গ সমূহও এক্ষেত্রে বিবেচ্য হয়েছে। ফলে, এটি একটি জটিল প্রশ্ন হিশেবেই আমাদের সামনে উপস্থিত হয়। এছাড়া অন্য কোন ভাবে আমরা আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ নিত্য রাজনৈতিক বাস্তবতাকে তার সার্বিক গূঢ়ার্থসহ বুঝতে অসমর্থ হব। আমার মনে হয় এসকল বিষয়ে মানব বিজ্ঞান সমূহে আরো অধিক ভাবনা ও মনযোগিতা প্রয়োজন, এবং অতঃপর এগুনো যাবে আরো।
ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মীয় অনুশাসনের পরিপ্রেক্ষিতে ‘অন্য’ হিশেবে চিহ্নিত, আর তাই রাজনৈতিক মতবাদ হিশেবে এটি ধর্মের গড়ে ওঠার সাথে নিবিড় ভাবে সম্পর্কিত হয়। ধরে নেয়া হয়, একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র সুনির্দিষ্ট ভাবে ধর্ম হতে সম্পূর্ণতঃই আলাদা হবে। ফলে রাষ্ট্রকে প্রতিনিয়তই তার আইনী নীতি-প্রক্রিয়া‘র নির্ধারণ/পূণঃনির্ধারণ জরুরী হয়ে পড়ে; কোনটি প্রকৃতই ধর্মীয় আচরণ এবং কতটুকুইবা এর পরিধি তা নির্ধারণ করা বা আইনী সংজ্ঞা প্রণয়ন করা রাষ্ট্রের একটি নৈমিত্তিক কাজ হয়ে পড়ে। অন্য ভাবে বললে, রাষ্ট্রকে এর থেকে কোন ভাবেই আলাদা করা যায়না। আত্মবিরোধী সত্য হিশেবে (Paradoxically) আধুনিক রাজনীতি কোন ভাবেই ধর্ম থেকে আলাদা বা স্বাধীন আবস্থান নিতে পারেনা; যেমনি করে ধর্মনিরপেক্ষতার একধরনের মামুলি মতবাদ দাবী করে থাকে। তারা মনে করে, ধর্ম ও রাজনীতির নিজেদের জন্য আলাদা আলাদা পরিসর তৈরী করে নেবে। একটি রাজনৈতিক স্বত্তা বা বাস্তবতা হিশেবে রাষ্ট্র‘র কাজ হচ্ছে কেবল ধর্মের জন-গ্রহণযোগ্য কোন গড়ন দাঁড় করা।
ধর্মনিরপেক্ষতার গড়ে ওঠা- গ্রন্থে আপনি লিখেছেন ‘যুদ্ধ এবং শান্তির মতবাদ হিশেবে ধর্মনিরপেক্ষতা পশ্চিমীয় (এবং অপশ্চিমাদের জন্য অপরিচিত এমন) নয়। বরং ধনতান্ত্রিক জাতিরাষ্ট্র গড়ে ওঠার সাথে এটি নিবিড় ভাবে সম্পর্কিত, পাশাপাশি ক্ষমতা ও সাফল্যের ক্ষেত্রে ধর্ম ও রাষ্ট্র উভয়ের মধ্যে এটি প্রশ্ন-সাপেক্ষ ও অসম সম্পর্কের সৃষ্টি করে; যা মূলতঃ বিবিধ সমঝোতার ভিত্তিতে, গ্রহণযোগ্যতায় এবং হুমকি নিয়ে একটি সমবেত-ব্যক্তিত্ব অধিগ্রহণ করে’। ধর্মনিরপেক্ষতার বিশ্ব রাজনীতি বিবেচনায় আপনি কিভাবে এই অসামঞ্জস্যতার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করবেন?
তৃত্বীয় বিশ্বে আরবদেশ সমূহে ধর্মনিরপেক্ষতার একটি সাধারণ সমলোচনা হচ্ছে- এটি মতবাদ হিশেবে বাইরের বা আরবদেশ গুলোর জন্য অপরিচিত এবং মুসলিম সমাজের জন্য অগ্রহণযোগ্য। আমার কাছে এটি এমন কোন বাঙ্ময় বিতর্ক বলে মনে হয়নি। পূর্ব থেকেই আরব সমাজ ও এর জনগোষ্ঠি বাইরের বিভিন্ন ধারনা ও চর্চা সমূহকে নিজেদের মধ্যে অভিযোজন করে নিয়েছে। এমন কি আমরা এও জানি, মুসলিম দুনিয়া পূর্বের অনেক ধ্যান-ধারনা ও জীবন-যাপন রীতির-ই সমন্বিত ও উন্নত রূপ; এবং এভাবেই তাদের বর্তমান সময়ের চিন্তা-ভাবনা, জীবন-যাপন ইত্যাদি তৈরী হয়েছে। এছাড়া সবসময়ই তারা চিন্তা ও চর্চার ক্ষেত্রে উদারতার সাথে ঋণী হয়েছে। এখন তাই প্রশ্ন হচ্ছে- তাদের কাছে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ এমন কোন্ সমস্যা তৈরী করে যার সমাধান হওয়া প্রয়োজনীয় বলে মনে করা হচ্ছে? আমার মনে হয়, এক্ষেত্রে আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের ক্ষমতায়নের বিবিধ সমস্যাবলীই ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে জটিলতার সূত্রপাত করে। আধুনিক রাষ্ট্রের কেন্দ্রীভূত শাসন প্রক্রিয়া, সহিংসতায় রাষ্ট্রের একচ্ছত্র অধিকার, একমাত্র রাষ্ট্র‘র-ই আছে অভ্যন্তরীন ভাবে ক্ষমতা-চর্চা বা শক্তি প্রয়োগের বৈধ নিশ্চিদ্র অধিকার (স্বত্তাধিকার)- এমনসব পূর্বধারণা এবং বহির বিশ্বের সাথে একমাত্র রাষ্ট্রই যুদ্ধ পরিচালনা করতে পারে ও একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠিকে সমরূপ শৃংখলায় আগলে রাখতে পারে- মূলতঃ এ সমস্ত কিছুই একটি প্রকল্প হিশেবে কাজ করছে যার মধ্যদিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার ক্রমবিকাশ সম্ভব হয়ে ওঠেছে। আমরা জানি, পশ্চিম ইউরোপে শুধুমাত্র একটি একক ধর্মকেই কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র সমূহের আত্মপরিচয়ে একমাত্র বিবেচ্য বানানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল একসময়। বিফলে চেষ্ঠা করা হয়েছিল মানুষের ধর্ম বিশ্বাসকে একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় হিশেবে গন্য করবার। এটি ছিল মূলতঃ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও প্রচল-আলাপচারিতার (discourse) ভিত্তিতে রাষ্ট্রের মাধ্যকার বিভিন্ন গড়ন গুলো তৈরী করে নেয়ার-ই একটি প্রক্রিয়া। অন্যদিকে একটি রাষ্ট্রের অন্যান্য ক্রিয়াশীলতাকে (এ্যাকটর হিশেবে ব্যক্তির ঝোঁক বা প্রবনতাকে) অবিবেচ্য রেখে রাষ্ট্রের মধ্যকার সামাজিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব‘র পূণব্যবস্থাপনাকে তারা তাদের প্রধান সমস্যা হিশেবে মোকাবিলা করেছে। কিন্তু এসমস্ত কিছুই তাদের নিজেদের মধ্যকার (আত্ম‘র) অন্তর্ভূক্ত বিষয় হিশেবে আসেনি; বরং বিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক প্রবণতা হিশেবেই ছিল। একটি দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও চিন্তুকেরা অন্য কোন রাষ্ট্রে রাজনৈতিকদের সাথে নানান সমঝোতা ও মিথষ্ক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হতো- এমনকি তাদের মধ্যে অনেকেই নিজ দেশের বৈরী রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পশ্চিম ইউরোপিয়ান অন্যান্য দেশগুলোর সাথে আলোচনা করতো নিজেদের অভ্যনত্মরীণ সমস্যাবলী নিয়ে। এবং প্রিন্সরা নিজেদের মধ্যে মাঝে মাঝে একধরনের ঐক্য গড়ে তুলতো; আবার ঝগড়া করতো একে অন্যের সাথে। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে থেকে তারা নিজেদের স্বরাজ টিকিয়ে রাখতে সমস্ত বৈদেশিক কার্যক্রমকেই প্রতিহত করতো। ইউরোপের জাতিরাষ্ট্র গুলোর মধ্যকার সম্পর্ক ও টানাপোড়নের ভিত্তিতেই উদ্ভব হয়েছিল আন্তর্জাতিক আইন (international law)| কিন্তু পরে বিশ্বব্যাপী, বিশেষতঃ উপনিবেশিক চর্চা ও বানিজ্যিক সাম্রাজ্য গঠিত হওয়ার সময়ে আমেরিকা ও এশিয়ার দেশ সমূহের জন্যও এটি সম্পর্কিত হয়ে উঠে। (এ পরিসরে আফ্রিকার ইউরোপিয়ান উপনিবেশ অন্তর্ভূক্ত হয় আরো পরে।) আন্তঃর্জাতিক বাজারে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার বৈধতা বিষয়ে একটি বিখ্যাত বিতর্কে একসময় বিশেষ ভাবে জড়িয়ে পড়েন আন্তঃর্জাতিক আইনের প্রতিষ্ঠাতা হুগো গ্রোজিয়াস (Hugo Grotius); যেখানে ইউরোপিয়ান খ্রিষ্টান এবং অন্যান্য ধর্মালম্বীদের মধ্যে গঠিত বানিজ্যিক চুক্তি সমূহ ছিল এ বিতর্কের মৌলিক/ সমস্যাসঙ্কুল জিজ্ঞাসা। আর তাই ধর্মনিরপেক্ষতা- যে পদ্ধতি বা উদ্দেশ্যেই ক্রিয়াশীল হোকনা কেন- রাষ্ট্রের ক্ষমতা চক্র কি কোন ভাবেই ধর্মীয় বৈসাদৃশ্যকে এড়িয়ে যেতে পারে? উনিশ এবং বিশ শতকের শুরুর দিকে উপনিবেশ সরকারের বিবর্তনে রাষ্ট্রের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠায় ‘স্থানীয়’দের ধর্ম এবং খ্রীষ্টান মিশনারীর ধর্ম প্রচারের প্রসঙ্গটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বর্তমান সময়ে আমেরিকা সক্রিয়ভাবে তৃত্বীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক নীতিমালা (ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে মুক্ত) প্রয়োগে আগ্রহী; এবং সেটি এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে যে ধর্মনিরপেক্ষতা গনতন্ত্র ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। ধর্মনিরপেক্ষতার গড়ে ওঠা গ্রন্থে আমি বলেছি, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আমেরিকান ইন্টারনেশন্যাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম এ্যাক্ট ২০০৮- এর কিছু প্রয়োগ লক্ষণীয় এবং এটি রাজনৈতিক পূণরুদ্ধার প্রচেষ্ঠারই একটি অংশ যা ধর্মনিরপেক্ষতার সাথে মৌলিক ভাবে সম্পর্কিত।
যদিও আধুনিকতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে যৌথভাবে কখনো কখনো গঠনমূলক মনে হয়; কোন একটি জায়গায় আপনি এমনটি উলে¬খ করেছেন যে, আধুনিকতার জন্য ধর্মের প্রাতিস্বিকীকরণ (privatization of religion) ধর্মনিরপেক্ষতার নিজস্ব পরিসরেও (যাকে ধর্মনিরপেক্ষকরণ প্রক্রিয়া বলি) গুরুত্বপূর্ণ নয়। তার চেয়ে বরং, ধর্ম কি করে জনপরিসরে বারবার ফিরে আসে এবং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে এটি অনেক জরুরী বিষয়। এক্ষেত্রে উপনিবেশিকতার ভূমিকাকে আপনি বিশেষভাবে মূল্যায়ন করেছেন। আপনি কি বিষয়টি আরো একটু খোলাসা করে বলবেন?
আমার মনে হয়, জোস কসানোভা (Jose Casanova) বিতর্কে আমার যে মন্তব্য ছিল সে সম্পর্কেই আপনি ইংগিত করছেন এখানে; যেখানে বলা হয়েছিল- আধুনিকতার জন্য ধর্মকে ব্যক্তি পর্যায়ে সংক্ষিপ্ত করবার কোন প্রয়োজন নেই; যেভাবে মতবাদ হিশেবে ধ্রুপদি ধর্মনিরপেক্ষতা ভাবতে আগ্রহী হয়। কসানোভার বক্তব্য ছিল- কিছু কিছু ক্সেত্রে ধর্মকে গনতন্ত্র ও আধুনিকতার অগ্রযাত্রায় সহায়ক হিশেবে দেখা যেতে পারে, যেমন কমিউনিষ্ট শাসিত পোলান্ডে ক্যাথলিক চার্চের নীতি প্রচলিত থাকা; এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে চার্চ কখনো কখনো ‘অগ্রবর্তী’ রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করে। উনার ইতিবাচক উদাহরণ ও বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে এই আলোচনায় আমার আলাপ ছিল- উলে¬খিত গুলো ধর্মের এমন কিছু নির্দিষ্ট গড়ন যেগুলো ছিল উদারীকৃত, ধর্মনিরপেক্ষ ধর্মীয় আন্দোলন; এবং যা মোটেও ‘সমস্যাসঙ্কুল’ ছিলনা। ভিন্ন ভাবে, আধুনিকতার অগ্রযাত্রায় ধর্ম প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সমস্ত মূল্যবোধ গুলোকে এটি অনেকাংশে প্রতিনিধিত্ব করে এবং এ বিষয়ে ধর্ম সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী ও গড়ন তৈরী করে দিতে সহায়তা করে। কিন্তু পরবর্তীতে আমরা যেটি দেখি, ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়ে ফ্রান্সের সামপ্রতিক যে মূল্যায়ন এটি তেমনও নয়।
প্রকৃত অর্থে বিষয়টি কি এভাবে হাজির নয় যে, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র নিজস্ব একটি অনুধাবনা থাকা সত্ত্বেও ইউরোপের ইতিহাসে প্রক্রিয়াটি কখনোই সেভাবে উপস্থিত ছিলনা? ধর্মনিরপেক্ষকরণের সময়কালে ‘ইহুদি-প্রশ্ন’, বিশেষ করে ইউরোপে এসময় ব্যপক ভাবে ইহুদিদের খ্রীষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরের বিষয়টিও এক্ষেত্রে নির্বন্ধ উদাহরন হতে পারে। এছাড়া উপনিবেশকালে, বিশেষতঃ যখন ধর্মনিরপেক্ষকরণ প্রক্রিয়াটিও শুরু হয়ে গিয়েছিল, সেই সময়ে পশ্চিমারা সারাবিশ্ব জুড়ে খ্রীষ্টান মিশনারী প্রেরণের কাজটি শুরু করেছিল; এবং এখনো কাজটি চলছে সভ্যতা ও সভ্যতা-প্রকল্পের সমার্থক হয়ে। ভিন্ন ভাবে বলা হলে বিষয়টি কি এমনও নয় যে, ধর্মনিরপেক্ষকরণ প্রকল্পে ধর্মীয় বিষয়াবলী ম্রীয়মান হয়ে যাওয়া দূরে থাক, খ্রীষ্টান ধর্ম এবং ধর্মতত্ত্বের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, এবং এটি মূলতঃ নাটকীয় ভাবেই আধুনিকতায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনও বানায়?
না, আপনার এমন প্রারম্ভিক মন্তব্য‘র আমি দ্বিমত পোষন করছি। মনে রাখতে হবে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ মূলতঃ একটি প্রক্রিয়া; সম্পূর্ণভাবে পরিসমাপ্ত কোন অবস্থা নয়। এবং নিশ্চিত ভাবে এটি পশ্চিমের ’স্ব-বোধগম্যতা’ থেকে উদ্ভুত। কিন্তু ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এটি বিভিন্ন গড়ন নিয়েছে, এবং সর্বোপরি এটি তৈরী করেছে নানান বৈপরীত্ব ও টানাপোড়ন। সমপ্রতি ফান্সের ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়ে আমার লেখা একটি প্রবন্ধে আমি বিশদ ভাবে এই বিষয়টিই উপস্থাপন করেছি যে, প্রকৃত অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতার এমন একটি উদাহরণও খোঁজে পাওয়া যাবেনা যাকে আদর্শ (ideal) বলা যায়। তবে আপনার শেষ প্রশ্নে‘র প্রতিউত্তরে আমি বলতে চাই- হ্যাঁ, অবশ্যই ইউরোপে খ্রীষ্টান ধর্ম এখনো সজীব (এবং ভূমিকা রাখছে দেশের অভ্যন্তরে আর বাইরেও) এবং অবশ্যই এটাও স্বীকার্য যে, আধুনিক সময়ে খ্রীষ্টান ধর্মতত্ত্বে অনেক নিবিড় সংস্কার এসেছে। কিন্তু তাতে ধর্মনিরপেক্ষতার কোন প্রকরণ ইউরোপে নেই বলে প্রমানিত হয়না। আমার বিতর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, ইউরোপে প্রকৃতই ধর্মনিরপেক্ষ কোন রাষ্ট্র নেই- এমন প্রচল ধারনাকে বাতিল করা। আমি মনে করিনা এখানে ‘প্রকৃত’ কোন ধর্মনিরপেক্ষ বিষয় বর্তমান আছে। বরং আছে ধর্মনিরপেক্ষতার ঐতিহাসিকতাপূর্ণ কিছু গড়ন যাকে ইতিহাসে আধুনিক সমাজে ক্ষমতা-সম্পর্কের সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যা ‘রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও প্রগতি‘র ক্ষেত্রে জনধর্মের হুমকি স্বরূপ।
আপনি বলেছেন, ‘কোন বিপ্লব নিতান্ত বিশ্বাস থেকে চালিত হয়না অথবা ইউরোপে জনপরিসরের অযৌক্তিক আলাপচারিতা কোন ভাবেই রাষ্ট্র ক্ষমতা সম্পর্কে নিরপেক্ষ নয়’। এটি যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে কেন বলা হয় যে, ইসলামপন্থিরা ধর্মের ‘রাজনীতিকীকরণ’ ঘটাচ্ছে?
সংক্ষিপ্ত ভাবে বললে, ইসলামপন্থিরা কোন ভাবেই রাষ্ট্র ক্ষমতার উর্দ্ধে কিছু নয়, তারা চাননা জিহাদ কেবল ব্যক্তিবিশ্বাসের (mere personal belief) তলানি হিশেবে থাক।
আপনি আরো বলেছেন, ‘(প্রত্যাশানুযায়ি) ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র সার্বিক সহিষ্ণুতার দায়ভার গ্রহণ করেনা; বরং যাবতীয় উচ্চাকাংখা ও উদ্বেগ নিয়েই এটি সচেষ্ট/সচেতন থাকে’। এমন ভাবনা দিয়ে- ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ যেকোন ধর্মভিত্তিক সমাজের চেয়ে কম সহিংস ও কম দ্বন্ধ মূখর- এই পূর্বধারনাকে কি করে অমীমাংসিত অবস্থায় উপস্থাপন করতে পারে? ধর্মীয় সহিংসতা নিয়ন্ত্রন, লালন ও এড়ানোর ক্ষেত্রে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ভূমিকা-ইবা কি?
অন্যান্য‘র মতন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র নিজেও এধরনের কিছু দায়ভার নিয়ে থাকে, তবে অন্যের দায় থেকে সে মুক্তই থাকে। এটি যেকোন ধরনের প্রতিবন্ধতকা ও গোপনীয়তা ব্যতিরেখে রাষ্ট্রের জনমানুষের ধর্ম ও বিশ্বাস চর্চার অধিকারকে নিশ্চয়তা প্রদান করে। এবং রাষ্ট্র এই-নিশ্চয়তা ততক্ষণ পর্যনত্মই দিতে থাকে যতক্ষণ না এটি রাষ্ট্রের অখন্ডতায় হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ‘হুমকি’কে কোন সুনির্দিষ্ট অর্থে ধরা যায়না এখনে। দ্বন্ধ ও সহিংসতায় সত্যিই কি একটি ধর্মনিরপেড়্গ সমাজ কম পড়্গপাত পোষন করে? সহিংসতা আর দমন প্রক্রিয়ার কিছু প্রসিদ্ধ গড়ন আপনি হয়তো পাবেন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের কম-সহিংসতা-ব্রতকে ব্যাখ্যা করবার জন্য; যে গড়ন গুলোকে খোদ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রই সংঙ্গায়িত করে থাকে, যেমন রাষ্ট্রে অভ্যন্তরে- রেস, জেন্ডার, ক্লাস ইত্যাদি এইসব; এবং বহির্বিশ্বে নব্য-সাম্রাজ্যবাদী কর্তৃত্ব, বিদ্রোহ দমন ইত্যাদি। দেশের অভ্যনত্মরে এবং বাইরের সহিংসতা, দমন, দ্বন্ধ-এসকল বিষয়ে উদার গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র সমূহ রাজনৈতিক ভাবে বরং এখন অনেক সচেতন।
মূল
সাহিত্য চর্চা এক ধরণের জুয়া খেলা
--- নরমান মেইলার, অনুবাদ : বিদ্যুত খোশনবীশ
প্যারিস রিভিউ : ডুয়েট ম্যাকডোনাল্ড এই প্রোভিন্সটাউনকে (চৎড়ারহপবঃড়হি) আখ্যায়িত করেছেন সমুদ্রস্নাত অষ্টম-সরণি হিসেবে। আপনি কতদিন আগে এখানে এসেছিলেন?
মেইলার : আমি যখন এখানে প্রথম আসি তখন আমার বয়স উনিশ। একটি মেয়ের সাথে আমার মন দেয়া-নেয়া চলছিল। পরে তাকে বিয়ে করেছিলাম। সে আমার প্রথম স্ত্রী বেট্রিস সিলভারম্যান। আমরা স্থির করেছিলাম উইকেন্ডে কোথাও হাওয়া খেতে যাব এবং আগে থেকেই ঈধঢ়ব ঈড়ফ- এর চূড়ায় এই শহরটির কথা বেট্রিসের জানা ছিল। সময়টা ঠিক মনে নেই, ১৯৪২ কিংবা ’৪৩ হবে। প্রথম দেখাতেই আমি এই শহরটির প্রেমে পড়ে যাই। প্রোভিন্সটাউনে প্রায় ৪০ মাইলেরও বেশি অরক্ষিত সমুদ্র সৈকত থাকায় সে সময় নাৎসি বাহিনীর হঠাৎ অবতরণের আশংকাও ছিল। তাই শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ ছিল না। রাতে রাস্তায় বেড়োলে মনে হতো যেন ঔপনিবেসিক আমেরিকায় এসেছি। যুদ্ধের পুরোটা সময় ধরেই আমার স্ত্রীর কাছে লেখা চিঠিতে তাকে মনে করিয়ে দিতাম, যদি আমি ফিরে আসি তবে আমাদের প্রথম কাজটাই হবে এই প্রোভিন্সটাউনে চলে আসা।
প্যারিস রিভিউ : আর তখন থেকেই আপনি ঞযব ঘধশবফ ধহফ ঃযব উবধফ লেখা শুরু করলেন?
মেইলার : ’৪৬ এর মে মাসে আমি সেনাবাহিনী ছেড়ে দেই এবং জুন মাসেই এখানটায় চলে আসি। জুনে কিংবা জুলাই এর একদম গোড়ার দিকে বইটি লেখায় হাত দেই। আমার মনে আছে, সৈকতে ভাড়া করা একটি কুড়ে ঘরে লেখার কাজ শুরু করেছিলাম। কোন বই লেখার প্রস্তুতি নিতে সাধারণত আমার সপ্তা দুয়েক সময় লাগে।
প্যারিস রিভিউ : এ বিষয়ে কোন নোট করেছিলেন?
মেইলার : লেখা শুরুর আগে আমি প্রচুর নোট করি। তাছাড়া সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বাড়তি পড়াশুনা এবং তা নিয়ে চিন্তাভাবনা ও বিশ্লেষণ করার অভ্যাসও আমার আছে। এখন একটা উপন্যাস শেষ করতে বছরের অর্ধেকটাই পার হয়ে যায়। কিন্তু ঞযব ঘধশবফ ধহফ ঃযব উবধফ শেষ করতে মাত্র কয়েক সপ্তাহ লেগেছিল। তার কারণও ছিল, তখন আমি যুবক, চিন্তা ও যুদ্ধের চেতনায় পরিপূর্ণ। সত্যি কথা বলতে, তখন আমাকে কোন গবেষণাই করতে হয়নিÑ মগজেই সব ছিল। সেই গ্রীষ্মে আমি প্রায় দু’শ পৃষ্ঠা লিখেছিলাম।
প্যারিস রিভিউ : আপনি জানতেন উপন্যাসটি ভালো হচ্ছে?
মেইলার : কখনো মনে হতো ওটা একটা ভয়ঙ্কর জিনিস হচ্ছে আবার কখনো ভাবতামÑ আমি আসলে জানিইনা কিভাবে লিখতে হয়। তখন আমার লেখা খুব একটা শৈল্পীক ছিল না, তবে ভালো লেখার কলা-কৌশল সম্পর্কে আমার অনেক কিছুই জানা ছিলো। আপনার হয়তো মনে আছে, গত রাতে আমরা থিওডর ড্রিজার সম্পর্কে আলোচনা করেছিলাম। দু’জনেই কম-বেশি একমত হয়েছিলাম যে, রচনা শৈলীতে ড্রিজারের তেমন কোন পারঙ্গমতা ছিলো না তবে তাঁর এমন কিছু গুণ ছিলো যা রচনা শৈলীর চেয়েও উৎকৃষ্ট। ঐ সময় আমি যাদের লেখা পড়তাম ড্রিজার তাঁদের একজন। যখন আমার লেখাগুলোর সাহিত্যমান দুর্বল বলে মনে হত তখন আমি নিজেকে এই বলে সান্তনা দিতাম যে, স্বয়ং ড্রিজারের লেখাতেও যথেষ্ট শিল্প নৈপুণ্য নেই।
আমার মনে হয়, একমাত্র প্রাউষ্টই (চৎড়ঁংঃ) শিল্প নৈপুণ্যের কর্মটি সাধন করতে পেরেছিলেন। প্রকৃত অর্থেই সাহিত্য উপাদান ও শৈলীর সাথে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক ছিলো। সাধারণত, যদি আপনার রচনা শৈলী চমৎকার হয় তবে সাহিত্য উপাদানগুলো হবে অধিকতর দুর্বোধ্য বা অস্বাভাবিক। যেমনটা হয়েছে হেনরি জেমস্ ও হেমিংওয়ে’র ক্ষেত্রে। তবে এর ঠিক উল্টোটা ঘটেছে জোলা’র ক্ষেত্রে। তাঁর রচনাশৈলী ছিলো যুক্তি সঙ্গতভাবে শোভন। যা বড় গলায় উল্লেখ করার মত কিছু নয় কিন্তু তাঁর উপাদানগুলো এককথায় মারাত্মক।
নিজের কাজ সম্পর্কে আমার মূল্যায়ন হলো, আমি রচনা শৈলীকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছি। যার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ অহ অসবৎরপধহ উৎবধস। কিন্তু ঞযব ঊীবপঁঃরড়হবৎ’ং ংড়হম- এ এই দিকটি কার্যত অনুপস্থিত, কারণ এর উপাদানগুলো অপূর্ব। অহ অসবৎরপধহ উৎবধস পুরোপুরিই আমার নিজস্ব কল্পনাÑ বলতে পারেন, বাবুর্চির কাজটা আমিই করেছি।
প্যারিস রিভিউ : আপনার ক্ষেত্রে একটি বিষয় নিয়ে বির্তক হতে পারে যে, আপনার লেখার বিষয় বস্তুগুলো কোননা কোন রহস্যকে উন্মোচণ করতে চায়, যা আগে স্পষ্ট ছিলো না।
মেইলার : আমি হাসছি, কারণ আপনি বিষয়টিকে একটি সুন্দর কাঠামো দিয়েছেন। ঞযব ঊীবপঁঃরড়হবৎ’ং ঝড়হম- লেখার সময় আমার উদ্দেশ্য এতোটা সম্মানজনক ছিলোনা। উপন্যাস লিখতে গিয়ে বারোক রীতি (ইধৎড়য়ঁব ঝঃুষব, ১৭ ও ১৮ শতকের অতিরঞ্জনমূলক ইউরোপীয় শিল্পরীতিÑ অনুবাদক) অনুসরণ করায় মূলতঃ আমি সমালোচিত হবার পথেই পা বাড়িয়েছিলাম এবং হয়েছিলামও তাই। আপনি কি মনে করেন এই বারোক রীতি খুব সহজ? মোটেই তা নয়। এটি এমন একটি বিষয় যেখানে আপনাকে পৌঁছতে হবে। এর জন্য বছরের পর বছর চর্চা করা প্রয়োজন। আপনারা সব সময় সারল্যের গুণ ও শক্তি নিয়ে কথা বলেন। সারল্যের মধ্যে একেবারেই কিছু নেই এবং আমি এই বই দিয়ে তা প্রমাণ করতে সক্ষম। এর কারণ, সম্ভবত একটি সরল বই লেখার মত যথার্থ উপাদান আমার আছে এবং আমি একটি সরল বই লিখতে পারি। তাই আমি সে ভাবেই অগ্রসর হয়েছি। এই বইয়ে আমার গর্বের মূল উপাদানই হল গ্যারি গিলমোরের চিঠি। আমি অক্ষরে অক্ষরে চিঠিটির দুই-তৃতীয়াংশ উদ্বৃত করেছি। এ পর্যন্ত আমার কোন লেখাই এ চিঠির চাইতে উৎকৃষ্ট হতে পারেনি। কারণ চিঠিটিই তাকে জীবন দিয়েছে এবং হঠাৎই লক্ষ্য করবেন অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে এই মানুষটিই ছিলো শক্তির আধার। সে হয়তো অকর্মন্য ছিলো। কারণ তাকে এভাবেই ডাকা হতো; কিংবা সে বীভৎস কায়দায় দু’জন লোককে হত্যাও করতে পারতো। কিন্তু তার একটা হৃদয় এবং নিজস্ব সাহিত্য রীতি ছিলো, যা তার ঐ চিঠিতে সুস্পষ্ট রূপ পেয়েছে।
সুদীর্ঘ সময় ধরে আমার মধ্যে এক মৌলিক ধারণা জন্ম নিয়েছে, তা হলোÑ বাস্তবতা এক রহস্যময় পবর্ত। আমরা ঔপন্যাসিকরা সেই পর্বতে আরোহণের চেষ্টা করছি। আমরা পবর্তারোহী আর প্রশ্ন হলোÑ আমরা কোন পথ দিয়ে তাতে আরোহণ করছি? ভিন্ন ভিন্ন পথে ভিন্ন ভিন্ন কৌশল প্রয়োজন। কোন কোন পথ দাবি করে অন্তরের জটিল ও দুরূহ পদ্ধতি আর অন্যরা সারল্য। তবে মূল বিষয় হচ্ছে, বাস্তবতার জগতে এটি একধরণের আগ্রাসন। তাই খুব সাদামাটাভাবেই আমি বইটি রচনা করেছি। হয়তো বইটি আমাকে এই ধারণা দিয়েছিলো যে, আমিও হেমিংওয়ের হাতে কড়ি পরাতে পারি। কিন্তু বইটা যখন লেখা হলো, দেখলাম আমি আর হেমিংওয়ে এক নই। আমি হেমিংওয়ের প্রশংসা করি তাঁর সৃষ্ট চরিত্রটির জন্য, ঐ মানুষটির জন্য নয়। আমার ধারণা তাঁর সাথে কখনো দেখা হলে সেটা হতো আমার জন্য ছোটখাট একটি বিপর্যয়। তারপরও অন্যেরা যা পারেনি তিনি আমাকে তাই দেখিয়েছেন। আমি বুঝতে পেরেছি, ইংরেজি বাক্য গঠনের সুপ্ত শক্তিটা ঠিক কোথায়।
প্যারিস রিভিউ : হেমিংওয়ে সম্পর্কে আরো কিছুক্ষণ কথা বলি। তিনি দেখিয়েছিলেন কোন বাক্যে আবেগ- অনুভূতির কথা উল্লেখ না করেই আবেগ সৃষ্টি করা যায়, এটা কি সম্ভব?
মেইলার : হ্যাঁ, তিনি এটা পেরেছিলেন যা তাঁর আগে বা পরে কেউ পারেনি। কিন্তু তিনি নিজেই একটি ফাঁদ। যদি আপনি সতর্ক না থাকেন তবে আপনার লেখাটাও ঠিক তার মতোই হয়ে যাবে। হেমিংওয়ের মতো কিছু লেখা বিপদজনক তবে যে কারো জন্যে সেটা মাইলফলকও বটে। আমি এমন কোন তরুণ ঔপন্যাসিকের ওপর আস্থা রাখতে রাজি নই যে তারুণ্যে হেমিংওয়েকে অনুসরণ করে না, অবশ্য আমি শুধু পুরুষ ঔপন্যাসিকদের কথাই বলছি।
প্যারিস রিভিউ : যখন হেমিংওয়ের আত্মহত্যার সংবাদ পেলেন তখন কোথায় ছিলেন, মনে করতে পারেন কি?
মেইলার : বেশ ভাল ভাবেই মনে করতে পারছি। আমি তখন জিমক্যামবেল এর সাথে মেক্সিকোতে। আমি খুব বিস্মিত হয়েছিলাম। সত্যি বলতে, ঐ ধাক্কা আমি কখনোই কাটিয়ে ওঠতে পারিনি। ওটা ছিলো একটি সতর্কবার্তা। তিনি যেন বলছিলেন: হে ঔপন্যাসিকগণ, মন দিয়ে শোনÑ যে মুহূর্ত থেকে তুমি একজন ঔপন্যাসিক সে মুহূর্ত থেকে তুমি এক চরম বিপদজনক মনস্তাত্বিক যাত্রা শুরু করেছো, এটি তোমাকে আঘাত করতে পারে।
প্যারিস রিভিউ : তাঁর এ সাহসিকতার সাথে আপনি কি আপোষ করতে চান?
মেইলার : এ কথা ভাবতেও আমার ঘৃণা হয়। তাঁর মৃত্যু সম্পর্কীত একটি থিসিস আছেÑ হেমিংওয়ে আগে থেকেই জানতেন যে তিনি যতোই মৃত্যুর কাছাকাছি যাবেন ততোই তাঁর জন্য মঙ্গল। মৃত্যুর নিকটবর্তী হবার সাহসকে তিনি এক প্রকার পথ্য মনে করতেন। এবং আমার ধারণা রাতের পর রাত বেডরুমে বসে তিনি শর্টগানের ব্যারেল মুখে পুরে মৃদু ট্রিগার চাপতেন এবং মৃত্যুর নিকটবর্তী হবার স্বাদ নিতেন। কিন্তু ঐ রাতে হয়তো ট্রিগারটা একটু বেশিই চেপে ফেলেছিলেন। সে যাই হোক, এটি নিছক তত্ত্ব মাত্র। বাস্তবতা হলো, হেমিংওয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন।
প্যারিস রিভিউ : তা হলে কি বলা যায় না, সাহিত্য চর্চা আত্মঘাতী?
মেইলার : সাহিত্য একজন সাহিত্যিককে গভীরভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম। একটি বই লেখার পর সাহিত্যিকের নিজের বলতে তেমন কিছুই আর থাকে না। একারণেই লেখকরা যদি মনে করেন তাঁদের অন্যায় ভাবে সমালোচনা করা হচ্ছে তবে তাঁরা সহজেই ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন। আমরা মনে করি, বই লিখতে গিয়ে আমরা নিজেদের একবার হত্যা করেছি আর সমালোচকরা তুচ্ছ কারণে আবার আমাদের হত্যা করতে চাচ্ছেন। গ্যারি গিলমোর একবার মন্তব্য করেছিলেন ‘‘পৃথিবীতে ন্যায় বলে কিছু নেই।” আমি এই মন্তব্যকে বার বার ব্যবহার করেছি। যদি আপনি একটি ভালো উপন্যাস লিখতে শুরু করেন তবে আপনি হয়ে যাবেন একজন অভিযাত্রিক। আপনি এমন কিছুর দিকে ছুটতে থাকবেন যার সীমা আপনার জানা নেই, প্রকৃতঅর্থে যার কোন সীমাই নেই। সেখানে আছে ভয় ও উত্তেজনার সংমিশ্রণ যা আপনাকে সামনে নিয়ে যাবে। আমার মতে, যদি সফলতার কোন সম্ভাবনা নাই থাকে তবে উপন্যাস লেখা মূল্যহীন। আপনি ব্যর্থ হবেন। কারণ আপনার মানসিক সীমাবদ্ধতার সাথে এটি একধরণের জুয়া খেলা। যেন আপনি এক সদস্যের সেনাবাহিনীর একমাত্র সেনাপতি, যে কানাগলির দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
প্যারিস রিভিউ : এবার বয়স নিয়ে কথাবলি। বার্ধক্য লেখক সত্তার অহংকারকে কিভাবে প্রভাবিত করে? ফেলে আসা বছরগুলোই শ্রেষ্ঠÑ কারো অহংকারের জন্য এমন ধারণার চাইতে ক্ষতিকর হয়তো আর কিছুই নেই।
মেইলার : যদি এমন হয় যে, আপনি বৃদ্ধ হয়েগেছেন এবং আপনার মধ্যে বস্তুনিষ্ঠতার অভাব আছে, তবে বলবোÑ বিপদেই আছেন। বস্তুনিষ্ঠতা মানুষকে বার্ধক্যেও বলিষ্ঠ রাখে। যদি আপনি মনে করেন, আগের যে কোন সময়ের তুলোনায় অল্প কিছু কাজ আপনার হাতে আছে এবং আপনার কৃতকর্ম ভারসাম্যপূর্ণ, তবে এটাই পারে আপনাকে স্থায়ীত্ব দিতে। তবেই আপনি বুঝতে পারবেন লেখক হিসেবে আপনার আর কী করার আছে এবং কী নেই। আপনি কেন আগের চাইতে বেশি প্রাজ্ঞ হচ্ছেন নাÑ এমন চিন্তা করার কোন যুক্তিই নেই। কারণ এখন আপনি বৃদ্ধ। আপনার এখন উচিত নিজের জীবন থেকে মানব চরিত্র সম্পর্কে শিক্ষা নেয়া। আপনি কি এখনও আগের মতো কলম চালাতে পারেন? উত্তর যদি হয় না, তবে আপনি প্রায় মূল্যহীন।
প্যারিস রিভিউ : কেন?
মেইলার : কারণ খুব সোজাÑ ব্রেইন ডেমেজ। মস্তিস্ক ক্ষয়িষ্ণু। জানেন তো, কেন পুরোনো গাড়ি নতুন গাড়ির মতো চলে না? এই বাস্তবতা মেনে নিতে হবে। আপনি তো আর গাড়িকে লাথি-ঘুষি দিয়ে বলবেন না যেÑ তুই আমার সাথে প্রতারণা করেছিস! সবচেয়ে ভালো হয় যদি আপনি গাড়ির প্রতিটা শব্দের অর্থ বুঝেন।
প্যারিস রিভিউ : শুনেছি, কোন এক বর্ষীয়ান আমেরিকান ঔপন্যাসিক জীবনের গোধূলী লগ্নে অপর এক বর্ষীয়ান আমেরিকান ঔপন্যাসিকের সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে বলেছিলেনÑ যথেষ্ট হয়েছে, আর লেখালেখি নয়।
মেইলার : তিনি বলেছিলেনÑ আর লিখবেন না।
প্যারিস রিভিউ : হ্যাঁ। এটি নিউ ইয়র্কের খুব জনপ্রিয় গল্প। অনেকে বিষয়টাকে মনে করে পারস্পারিক ভালোবাসা। একজন মহান, অভিজাত সৈনিক আরেক সৈনিককে নিরস্ত্র করছেন।
মেইলার : না, আমি এটা বিশ্বাস করিনা। যদি আমার ক্ষেত্রে এমন হতো তবে বলতামÑ যা বলার বলেছেন, এবার দয়াকরে আসুন।
প্যারিস রিভিউ : আপনি কি মনে করেন শিল্প চর্চার জন্যে আমেরিকা একটি উৎকৃষ্ট স্থান?
মেইলার : আমি যখন তরুণ তখন আমেরিকা ছিলো লেখকদের জন্য এক অসাধারণ স্থান। তার কারণ, আমেরিকায় অনেক ভালো লেখক ছিলোÑ আর আমাদের অধিকাংশ সাহিত্যই তখন পর্যন্ত লিখিত হয়নি। ১৮ ও ১৯ শতকের অধিকাংশ প্রতিভাবান ঔপন্যাসিক ছিলেন ইংরেজ, যারা অন্যদের ছাড়িয়ে যেতে পেরেছিলেন। কিন্তু অন্যদের ছাড়িয়ে যাবার জন্য আমাদের কী ছিল?
গবষারষব ও ঐধঃিযড়ৎহব এর মত গুটি কয়েক ভালো লেখক। তালিকাটা খুব সংক্ষিপ্ত কিন্তু আমাদের জন্যে ময়দান ছিল উন্মুক্ত। অথচ আমরা এখন সমালোচিত, বিপদগ্রস্থ। আমাদের চলচ্চিত্রগুলোও বাজে ছিলÑ শুধুই আনন্দদায়ক। মানব জীবন সম্পর্কে ওগুলো থেকে কিছুই শিখার ছিলো না, কারণ আমি মনে করি সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলোÑ আমরা কেন এই পৃথিবীতে এসেছি।
এখনকার ছেলে-মেয়েরা তো টেলিভিশন নিয়েই মেতে আছে। এই যন্ত্রটির এমন একটি উপাদান আছে যা চিন্তাশীল পাঠাভ্যাসের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারকÑ তা হলো বিজ্ঞাপন। হয়তো আপনি নাটক কিংবা সিনেমা দেখছেন, লক্ষ্য করবেন প্রতি সাত কিংবা দশ মিনিট পর পর বিজ্ঞাপন প্রচারিত হচ্ছে। যা আপনার মনোযোগকে নষ্ট করে দিতে যথেষ্ট। বাচ্চারা এভাবেই টিভি দেখে দেখে সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। একজন ঔপন্যাসিক হিসেবে আমি মনে করি, বিলুপ্ত প্রায় কুটির শিল্পের আমিও একজন রুগ্ন কারিগর। সাহিত্য এক সময় শিল্প ছিল, এখন কুটির শিল্পের পরিণত হয়েছে, যার নিয়তি বিলুপ্তি। তাই আপনার প্রশ্নের উত্তর হলো- ঔপন্যাসিকদের জন্যে আমেরিকা এক সময় ছিলো চমৎকার আবাসভূমি কিন্তু এখন আর সেরকম নেই।
প্যারিস রিভিউ : এমন কোন সময় কি ছিলো, যখন আমেরিকানরা সত্যের জন্যে ঔপন্যাসিকদের দ্বারস্থ হয়েছে?
মেইলার : চল্লিশের দশকের গোড়ার দিককার প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ লেখকই আমার কাছে চলচ্চিত্র তারকাদের চাইতেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। চলচ্চিত্র তারকারা অদ্ভুত ও দুর্লভ। তারা হতে পারেন বহুমাত্রিক কিংবা আকর্ষণীয় কিন্তু আমার কাছে সেটা কোন ভাবেই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো না। গুরুত্বপূর্ণ ছিলো ঔপন্যাসিকরা। আমি কোন যাযকের অনুভূতি বলতে পারবো না তবে ঔপন্যাসিক হিসেবে এটাই আমার অনুভূতিÑ পেশাদারিত্ব। অন্য কোন কিছুই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো না।
প্যারিস রিভিউ : আমেরিকানরা শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক ও উপন্যাস পাবার জন্যে উদগ্রীবÑ এ ধারণাই কি আপনাকে পেশাদার করে তুলেছিল?
মেইলার : ঠিক তাই। আমার ধারণা পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে অনেকেই এরকম কিছু করার স্বপ্ন দেখতোÑ শ্রেষ্ঠ আমেরিকান উপন্যাস রচনা করার স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন এখন চুরমার হয়ে গেছে।
প্যারিস রিভিউ : আপনি কি মিল্টন ও চধৎধফরংব খড়ংঃ এর সাথে একমত যে, কোন কোন সময় শয়তানও যথার্থ কথা বলে?
মেইলার : হ্যাঁ। আমি সত্যিই বিশ্বাস করি, ঈশ্বর ও শয়তানের মধ্যে এক ধরণের স্বার্থের দ্বন্দ্ব চলছে যার প্রভাব আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই পড়েছে। কিন্তু মানুষ এ ধরণের চিন্তাকে এখন ঘৃণা করে। কারণ এটা প্রযুক্তির যুগ, মধ্যযুগ সম্পর্কে তারা বিতৃষ্ণ, ক্লান্ত। অথচ মধ্যযুগে আমরা ঈশ্বরের সামনে হাটু গেড়ে বসেছি, অশ্র“ সিক্ত হয়েছি আর প্রার্থনা করেছিÑ হে প্রভু, আমাদের দিকে ফিরে তাকাও, আমাদের রক্ষা কর, শয়তানকে বিতাড়িত কর। যাইহোক, তারপর থেকেই আমরা আলোকিত হয়েছি; ভলতেয়ারকে পেয়েছি। গত কয়েক শতাব্দী ধরে মানুষ হিসেবে আমাদের অহংকারকে আরো তীব্র করেছি। তাই এখন আমরা তৃতীয় এক শক্তি। এক প্রান্তে ঈশ্বর, অন্য প্রান্তে শয়তান। মাঝের বিশাল কেন্দ্র মানুষের দখলে। আর পৃথিবীর অর্ধেক মানুষই বেঁচে আছে ঈশ্বর কিংবা শয়তানকে বিশ্বাস না করেই।
প্যারিস রিভিউ : আপনি কি ঈশ্বরকে বিশ্বাস করেন?
মেইলার : অবশ্যই বিশ্বাস করি। কিন্তু ঈশ্বরকে আমি জেহভার মতো বিধানদাতা মনে করি না। আমি মনে করি, ধর্ম যাযকরাই এমন ধারণার সৃষ্টি করেছেন যে, মানুষ যদি মহাশক্তির উপাসনা না করে তবে পরকালে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে। মূলতঃ এর মাধ্যমেই তারা নিজেরা ক্ষমতাবান হয়েছেন। তাই এই ধারণার প্রতি আমার কোন বিশ্বাস নেই। আমি ঈশ্বরকে স্রষ্টা হিসেবেই মানি। তাঁর সম্পর্কে আমার বিশ্বাস, তিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং চলমান ঘটনা প্রবাহের উপর তাঁর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই।
প্যারিস রিভিউ : অর্থাৎ আপনার ঈশ্বর নিজেই অস্তিত্ববাদী?
মেইলার : ঠিক তাই। তিনি জানেন না ঘটনা কোন দিকে মোড় নেবে কিংবা তিনি ব্যর্থ না সফল হবেন। তিনি শয়তানের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত। চাইলে আপনি তাকে স্থানীয় বা আঞ্চলিক ঈশ্বরও বলতে পারেন। এরকম বহু ঈশ্বর এই মহাবিশ্বে রয়েছেন। অস্তিত্ব সম্পর্কে তাদের অনুভূতিও ভিন্ন। তাদের কেউ কেউ পরস্পারিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত আবার কেউ এতোটাই ভিন্ন যে অস্তিত্ব নিয়ে তাদের কোন দুঃশ্চিন্তা নেই। আমরা যদি কারো মর্যাদা নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করি তবে তা হবে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত বিশ্লেষণ, অবৈধ বিশ্লেষণ। কারণ আমি মনে করি, শয়তানকে সম্ভবত ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হিসেবেই পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়েছে। অন্য কথায়, মহাবিশ্বের পরম শক্তি মানবিক বোধ সম্পন্ন এই ভুঁইফোড় ঈশ্বরকে পছন্দ করেননি।
প্যারিস রিভিউ : বহু আমেরিকান এখন এমন ধারণা পোষণ করে যে, ঈশ্বর ও শয়তান তাদের স্ব স্ব কর্মে নিয়োজিত।
মেইলার : আমিও তাই মনে করি। তবে আমি এটা বিশ্বাস করি না যে, কেউ শয়তানের খপ্পরে পড়লেই চিরতরে নষ্ট হয়ে গেল। কিন্তু তারপরও আপনি কি কখনো বলতে পারবেন যে, ক্ষণিকের জন্যে হলেও নিজেকে কখনো পাপী মনে করেননি।
প্যারিস রিভিউ : কিছুটা আধ্যাত্বিক কথা।
মেইলার : না। কিছুটা অশুভ। আর এটাই যথার্থ উত্তর।
প্যারিস রিভিউ : আমার যদি ভুল না হয়, ঞযব ঈধংঃষব রহ ঃযব ঋড়ৎবংঃ- এ আপনি বলতে চেয়েছেন যে, হিটলারকে শুধু হিটলারই বলা যায়, অন্য কিছু নয়। তা হলে তো বিষয়টি রহস্যাবৃতই রয়েগেল। কারণ হিটলারের চিন্তা-চেতনাতেও তো শয়তানের অস্তিত্ব ছিলো। এই বই সম্পর্কে আমার যুক্তি হলোÑ নিজস্ব চিন্তা ও জীবন ব্যবস্থায় মানুষের ত্রাস সৃষ্টি করার ক্ষমতাকে কোন ঔপন্যাসিকই অবজ্ঞা করতে পারেন না।
মেইলার : আপনি এটা নিয়ে বির্তক করতে পারেন। হিটলার একজনই, তার সম্পর্কে অন্য কোন ব্যাখ্যা নেই। ষ্টালিনও দানব ছিলো কিন্তু বোধগম্য প্রকৃতির। আমরা তার জীবনী পড়ে দেখতে পারি, বলশেভিক আন্দোলন নিয়ে পড়াশুনা করতে পারি, আমরা রাশিয়ার বর্তমান অবস্থা যাচাই করতে পারি, আমরা রুশ বিপ্লবের ভয়ানক প্রতিক্রিয়াও প্রত্যক্ষ করতে পারি। আমরা ষ্টালিনকে ধাপে ধাপে এর সাথে সম্পৃক্ত করতে পারি এবং মানবিক উপায়েই তাকে বুঝতে পারি। তিনি হয়তো মহাপাপীদের একজন কিন্তু তারপরও তিনি মানুষ ছিলেন। ষ্টালিনকে ব্যাখ্যা করার জন্যে শয়তানকে টেনে আনবার প্রয়োজন নেই। কিন্তু হিটলার একেবারেই ভিন্ন। ষ্টালিনের মতো হিটলার দৃঢ়চেতা ছিলো না। সে ছিলো ভিরু, কাপুরুষ। হিটলার অব্যাখ্যেয়। অবশ্য, আপনি যদি মনে করেন, হিটলারের শয়তানের আজ্ঞাবহ হবার কারণ জার্মানদের চরিত্রের গভীরে নিহিত তবে সেটা ভিন্ন কথা।
আমি এর চেয়েও বেশি দূর যাব। আমি আমার পরবর্তী বই লেখার প্রস্তুতি নিচ্ছি। জানিনা শেষ করতে পারবো কিনা, কিন্তু যদি পারি তবে সে বই-এ হিটলার আবির্ভূত হবে শয়তানের আজ্ঞাবহ হিসেবে। ঞযব ঈধংঃষব-এর শেষ ভাগে সে হবে মানুষের মাঝে শয়তান কর্তৃক রোপিত হাজারো বীজের একটি। শয়তানও ঈশ্বরের মতো অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করে কিন্তু ইতিহাসকে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যায় না। ঈশ্বর ও শয়তান একে অন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন। মানুষও তাদের এবং নিজেদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত। ঈশ্বর যেভাবে একজন যিশু সৃষ্টি করেছেন, শয়তান সেভাবে একজন হিটলার সৃষ্টি করেনা। শয়তান প্রয়োগবাদী, সে লক্ষ লক্ষ গুপ্ত হিটলার সৃষ্টি করে আর আমরা যে হিটলারের কথা বলছি সে তাদেরই দৃশ্যমান রূপ। কেন? কারণ জার্মানির স্বতন্ত্র দৃশ্যপট, যা হিটলারের আবির্ভাবের পূর্বে অনুপস্থিত ছিল। এটাই আমার পরবর্তী বইয়ের বিষয় বস্তু।
প্যারিস রিভিউ : আমরা এমন মানুষের বিশ্বে বাস করছি যারা বিশ্বাস করে তাদের বিরুদ্ধ শক্তিই হলো শয়তানের শক্তি।
মেইলার : জী।
প্যারিস রিভিউ : শয়তান, শয়তানের অক্ষ শক্তি, শয়তানের সাম্রাজ্যÑ আমরা তো এসব নিয়েই আছি।
মেইলার : আমার মূল প্রচেষ্টাই হলো সবগুলো রুটিতে সমান মাখন লাগানো হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া। আমেরিকায় কি অশুভ শক্তি আছে? হ্যাঁ। ইসলামে কি অশুভ শক্তি আছে? হ্যাঁ। একপক্ষ কি অন্য পক্ষের চেয়ে বেশি অশুভ? কে জানে সেটা।
আমরা উভয়ই প্রচন্ড অশুভ, আমরা উভয়ই প্রচন্ড শুভ। আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাসও তাই বলে আমরা এ দু’য়ের মিশ্রণ, গভীর মিশ্রণ। নাস্তিকরা বলে থাকেন, স্রষ্টাকে বিশ্বাস না করেও তারা সুখী। কিন্তু দার্শনিকভাবে তারা সুখী হতে পারেননা, কারণ আমরা কিভাবে অস্তিত্ব পেলাম এ প্রশ্নের উত্তর তাদের জানা নেই। নাস্তিক্যবাদী হয়ে মানব চরিত্রের জটিলতার ব্যাখ্যা দেয়া খুবই কষ্টসাধ্য কাজ। কিন্তু ঈশ্বরে বিশ্বাসী হলে, আমরা কেন পৃথিবীতে এসেছি তার খুব ভালো ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব। আমরা ঈশ্বরের সৃষ্ট জীব, আমাদের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে। ঠিক পিতার মতো, একজন পিতা যেমন চান তার সন্তানরা তার চেয়েও বেশি আকর্ষণীয় হোক, ঈশ্বরও ঠিক তাই চান। মায়ের ক্ষেত্রেও তাই। সে অর্থে আমরা ঈশ্বরের অগ্রদূত।
প্যারিস রিভিউ : আপনি পুনর্জন্মে বিশ্বাস করেন। আবার কি নরমান হয়েই ফিরে আসবেন?
মেইলার : আমি অপেক্ষা করছি, তাই না? বলা চলে, আমি এখন ওয়েটিং রুমে। আমাকে ডাকা হবে, আমি ভেতরে যাব। সেখানে যে দেবদূত থাকবেন তিনি বলবেন- মিষ্টার মেইলার, আমরা আপনার অপেক্ষাতেই ছিলাম। আপনি পুনর্জন্মের জন্য মনোনীত হয়েছেন। আমি বলবো, ধন্যবাদ। আমি আসলে পরকালে থেকে যেতে চাই না। ঐ দেবদূত বলবেন, থেকে যাওয়াটা খুব জরুরী নয়। আপনি কোন রূপে ফিরে যেতে চান? আমি বলবো, একজন কৃষ্ণাঙ্গ অ্যাথলেট হয়ে। তখন দেবদূত বলবেন, সবাই তাই হতে চায়; ঠিক আছে দেখা যাক আপনার জন্যে কী নির্ধারণ করা হয়েছে। তিনি বিশাল খাতা খুলবেন, দেখবেন এবং বলবেন আপনাকে একটি তেলাপোকা হিসেবে ফেরত পাঠানো হবে। তবে সুসংবাদ হলোÑ আপনার এলাকায় আপনিই হবেন সবচেয়ে দ্রুতগতির তেলাপোকা।
প্যারিস রিভিউ : মন্দ বলেননি।
মেইলার : পুনর্জন্ম হলো ঈশ্বরের প্রজ্ঞা ও ন্যায়বোধের উৎকৃষ্ট প্রমাণ। আমি আবারো বলছি, ঈশ্বর বিধানদাতা নন। তিনি স্রষ্টা এবং বিচারক।
প্যারিস রিভিউ : পুনর্জন্মে গ্যারি গিলমোরের বিশ্বাসই তাঁর প্রতি আপনার আকর্ষণের মূল কারণ?
মেইলার : হ্যাঁ। কিন্তু এ বিষয়ে আগের থেকেই আমার ধারণা ছিলো। ১৯৫৪ সালে আমি যখন নাস্তিক; নিজেকে নিয়ে গর্বিত; মনে করতাম ঈশ্বরকে পরিহার করা যায়, তখন জেমস্ জোনস্রে সাথে দেখা করতে ইলিনইস রাজ্যে গিয়েছিলাম। তিনি আমার সাথে পুনর্জন্ম নিয়ে কথা বলেছিলেন। তিনি ছিলেন আমার দেখা বাস্তববাদী ঔপন্যাসিকদের একজনÑ সাচ্চা মিডওয়েষ্টার্ন। বাস্তবতা নিয়ে তাঁর চিন্তা ছিল সুদৃঢ়। রূঢ় বাস্তবতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতেই তিনি আনন্দবোধ করতেন। তিনি ছিলেন বাস্তবতায় বিশ্বাসী এবং পরে বিশ্বাস করেছেন পুনর্জন্মে। আমি তাকে বলেছিলামÑ আমি নিশ্চিত আপনি পুনর্জন্মে বিশ্বাস করেন না। তিনি বলেছিলেনÑ বিশ্বাস করি। কারণ একমাত্র এটিই চেতনার জন্ম দেয়। এই মন্তব্য নিয়ে আমি দশ বছর ভেবেছি এবং তারপর মেনে নিয়েছি।
প্যারিস রিভিউ : সহিংস কোন স্বপ্ন দেখেন?
মেইলার : না। আমি এ ধরণের স্বপ্ন সাহিত্যে প্রয়োগ করি।
প্যারিস রিভিউ : মানুষের সহিংসতা আপনাকে উদ্বিগ্ন করে এবং সহিংসতা আপনার খ্যাতির সাথেও সম্পর্কীত।
মেইলার : খ্যাতি বিপদজনক।
প্যারিস রিভিউ : আপনার সাহিত্যকর্মে সব সময় সহিংসতা থাকে।
মেইলার : সহিংসতার প্রতি আগ্রহ অবৈধ কিছু নয়। ঔপন্যাসিকদের জন্যে সহিংসতা একটি বিচরণ ক্ষেত্র। উনিশ শতকের বিখ্যাত ঔপন্যাসিকরা কাজ করেছেন প্রেম, বিরহ, হতাশা, সততা ও কিছুটা দুর্নীতি নিয়ে। তাঁরা কাজ করেছেন বিভিন্ন সামাজিক শক্তির সম্মিলিত বিমূর্ত শক্তি নিয়ে যা একজন ব্যক্তির ইচ্ছাকে পরাস্ত করতে পারে। কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে আসুন, দেখবেন হেমিংওয়ে সহিংসতার প্রতি প্রবলভাবে আকর্ষিত হয়েছেন। কারণ যুদ্ধে তাঁর দেহ ক্ষত-বিক্ষত হয়েছিলো। সহিংসতাই ছিলো তাঁর সাহিত্য কর্মের কেন্দ্রবিন্দু। হেমিংওয়ে সহিংসতাকে সাহিত্যে যেভাবে উপস্থাপন করেছেন তা আমাকেও অভিভূত করে কিন্তু আমি তাতে তৃপ্ত নই।
প্যারিস রিভিউ : মানুষ গণসহিংসতার হুমকির মধ্যেই বেঁচে আছেÑ এটা কি আপনারও ধারণা নয়?
মেইলার : কিন্তু ওটা একধরণের বিড়ম্বনা। ব্যক্তি সহিংসতা ছিলো অস্পৃশ্য বা নিষেধের বেড়াজালে আবৃত এবং তখনো গণসহিংসতার একটি স্পষ্ট ধারণা আমাদের মধ্যে ছিলো। ঐ সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকাতে এমন কিছু কর্মপটু লোক ছিল যারা কিভাবে এ দু’দেশকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করা যায় দিবা-নিশি সে স্বপ্নই দেখতো। অর্থাৎ তারা গবেষণা করতো সোভিয়েত ইউনিয়নকে পুরোপুরি ধ্বংস করতে গেলে নিজেরা কতটুকু ভোগান্তির শিকার হবে, তা নিয়ে। এ ধরণের হিসাব নিকাশ সব যুগেই করা হয়েছে।
প্যারিস রিভিউ : বর্তমান পর্যায়ে আপনার প্রজন্মের ঔপন্যাসিকরা এক ধরণের সূক্ষ্মবোধ অর্জনের চেষ্টা করেছেন যে, সহিংসতা কিভাবে আমাদের কল্পনা ও সমাজে একই সাথে বিকাশ লাভ করে। এ বিষয়ে যদি কিছু বলেন।
মেইলার : সহিংসতা নিয়ে কাজ করার সময় সাহিত্য জগত যে বিদ্বেষ পোষণ করছিলো সে সম্পর্কে আমি সচেতন ছিলাম। আসলে এ কাজ কবে নাগাদ শেষ হবে তার কোন নিশ্চয়তা ছিলো না। অনিশ্চয়তা তখনো ছিলো, এখনো আছে। একই সময়ে, ব্যক্তি সহিংসতাকে বিবেচনা করা হতো অপ্রীতিকর এবং আড়াল করবার মতো বিষয় হিসেবে। আমার দৃষ্টিতে সহিংস মুহুর্ত সর্বদাই অস্তিত্ববাদী মুহুর্ত। এই মুহুর্তগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো ব্যবহার করে কেউ চাইলে দারুণ কিছু করতে পারে।
প্যারিস রিভিও ঃ লী হার্ভে অসওয়াল্ড, (খবব ঐধৎাবু ঙংধিষফ) ব্যক্তি হিসেবে যার নাম চিরকালই ব্যক্তি সহিংসতার সাথে জড়িয়ে থাকবে- তাকে আপনি কিভাবে দেখেন?
মেইলার ঃ প্রথমেই আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে সে কেনেডিকে (ঔড়যহ ঋ. কবহহবফু) হত্যা করেছিল কিনা। যখন আমি ঙংধিষফ’ং ঞধষব লেখা শুরু করি তখন ঘটনাটি ষড়যন্ত্র বলেই বিশ্বাস করতাম। কিন্তু অসওয়াল্ড সম্পর্কে আমি যখন আরো বেশি জানতে শুরু করলাম, বুঝতে পারলাম সে ষড়যন্ত্র করার মত কোন ব্যক্তি ছিলনা। কারণ সে ছিল নিঃসঙ্গ এবং যথেষ্ট অহংকারী। সে একাই কাজ করেছিল। আমার ভুলও হতে পারে কিন্তু আমি এটাই বিশ্বাস করি। কারণ খুব সহজ- অসওয়াল্ড চেয়েছিল বিখ্যাত হতে। সে চেয়েছিল অমর হতে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেকিায় নিজ অভিজ্ঞতার কারনেই গনসহিংসতা থেকে সে প্রবেশ করেছিল ব্যক্তি সহিংসতায়।
প্যারিস রিভিউ : আপনার ঞযব ডযরঃব ঘবমৎড় প্রবন্ধ সম্পর্কে এখনো কি আগের অবস্থানেই আছেন?
মেইলার : হ্যাঁ। সংখ্যা যাইহোক কিছু মানুষ বিশেষ করে যুবকরা যৌন তৎপরতাকেই প্রেম মনে করে। এটাকে ভুল বলবারই বা কী আছে। যৌনতা আমাদের গভীর প্রকাশ। তবে অনেক কৃষ্ণাঙ্গ অভিযোগ করে বলেন, আমি নাকি শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে যৌন তৎপরতা বেশি অনুসন্ধান করেছি।
প্যারিস রিভিউ : কিভাবে একজন ঔপন্যাসিক বাস্তব ঘটনা বা উপাদানগুলোকে উপন্যাসে প্রতিস্থাপন করেন? বাস্তবকে শিল্পে রূপান্তর করলে কী ঘটে?
মেইলার : বাস্তব ও কল্পনার (ঋধপঃং ধহফ ঋরপভরড়হ) মধ্যে একটি মজার সম্পর্ক আছে। বিষয়টা ঠিক পুরোপুরি ব্যাখ্যা করতে পারবো না, তবে গ্রন্থ প্রাপ্ত তথ্যের যত কাছাকাছি থাকবে তার বর্ণনা ততোই কাল্পনিক হবে। যদি আপনার সংগ্রহে কিছু সত্য তথ্য থাকে তবে সমস্যা হলো ওগুলোর অধিকাংশই পরিশুদ্ধ নয়। ওগুলো বিকৃত, পরিবর্তিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মিথ্যা-সত্য। তাই যথেষ্ট আন্তরিকতা থাকা সত্বেও গল্পের সমাপ্তি ঘটে বাস্তবতার সাথে প্রতারণার মধ্য দিয়ে।
প্যারিস রিভিউ : চমৎকার। আরেকটু ভেঙ্গে বলুন।
মেইলার : ঠিক আছে। যে কোন ইতিহাস, যদি শুধুমাত্র নিখাদ সত্য দিয়ে রচিত হয় তবে তা ভুলে পরিপূর্ণ এবং বিভ্রান্তিকর হতে বাধ্য। একমাত্র মানব মনই পারে ঘটনার মধ্যে নিহিত সত্যকে আবিস্কার করতে। যা ঘটে গেছে সেটিই একমাত্র বাস্তবতা নয়, মানুষ তার সংকীর্ণ মনে যা লালন করে তাও বাস্তবতা। ঘটনার পেছনে এগুলোও সম্ভাব্য শক্তি হিসেবে কাজ করে। কোন বই পড়ে যদি বলেনÑ হ্যাঁ, ঘটনাটি এভাবেই ঘটতে পারতো, তবে আপনার মন সমৃদ্ধ। ঞযব ঊীবপঁঃরড়হবৎ’ং ঝড়হম নিয়ে আমার অনুভূতি ছিলোÑ এ বইয়ের জন্য আমার সংগৃহীত তথ্যগুলো বারবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা, কাটছাট এবং পরিশুদ্ধ করলে আমি যা পাব তা হবে সাহিত্য। সাহিত্য হবে, কারণ তার স্পন্দন থাকবে। নির্ভেজাল সত্য ও সাহিত্যের মধ্যে এটাই পার্থক্য। আপনার বলা সত্য কথাগুলো পাঠকের হৃদয়ে স্পন্দন সৃষ্টি করতে পারলে সেটাই হবে সাহিত্য। সাহিত্য কোন কিচ্ছা কাহিনী নয়, কিংবদন্তী কিংবা অসত্য ভাষণও নয়। সাহিত্য যেমন সত্য তেমনি কল্পনাও।
প্যারিস রিভিউ : আপনি যখন ঞযব অৎসরবং ড়ভ ঃযব ঘরমযঃ লিখেন তখন কি মনে হয়েছিল এটি একটি উপন্যাস?
মেইলার : ‘‘ইতিহাসকে সাহিত্য, সাহিত্যকে ইতিহাস’’ করার মত কাজ আমি খুব একটা করিনি। আমি মনে করি, ঞযব অৎসরবং ড়ভ ঃযব ঘরমযঃ যথার্থ অর্থে সৃজনশীল সাহিত্য নয়। এটি আত্মজীবনী মূলক রচনা সৃজনশীল সাহিত্যের সাথে যার খুব একটা মিল নেই।
প্যারিস রিভিউ : পুলিৎজার পুরস্কার জেতা আপনার দু’টো বই-ই বাস্তব ঘটনার ভিত্তিতে রচিত; আপনি কি এর জন্য বিব্রত বোধ করেন না?
মেইলার : অনেকে বিনীত ভাবে বলেন, মেইলার নিঃসন্দেহে একজন ভাল ননফিকশন লেখক তবে তিনি পুরোপুরি ঔপন্যাসিক নন। হ্যাঁ, এতে বিরক্ত হই। কারণ এ ধরণের কথা যিনি বলেন তিনি আমার পুরো সাহিত্য কর্মের সাথে পরিচত নন। এমন কাউকে আমি পাইনি, যে আমার ঐধৎষড়ঃ’ং এযড়ংঃ এবং অহপরবহঃ ঊাবহরহমং পড়ে এগুলোকে ননফিকশন বলেছেন। যারা আমাকে ননফিকশন লেখক বলেন তারা এই বই দু’টির সাথে পরিচিত নন। তারা শুধুমাত্র ঐ বইগুলোই পড়েছেন যেগুলো কিছুটা ননফিকশন। তারপরও আমি স্বীকার করি আমার জন্য এটি একটি সমস্যা। কিন্তু আমি খুশি, কারণ উপন্যাসের চেয়ে ননফিকশন লেখা সহজ, কাহিনীর পরিণতি নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করতে হয় না।
প্যারিস রিভিউ : ঠিক আছে। কিন্তু শুধু সহজ বলেই কি আপনি ননফিকশন লিখেছিলেন?
মেইলার : না- তা নয়। আমি ননফিকশন লিখার প্রস্তাব পেয়েছিলাম। উদাহরণ স্বরূপ, গধৎরষুহ এর কথা বলতে পারি। আমার এজেন্ট স্কট মেরিডিথ একবার প্রস্তাব দিলেনÑ মেরিলিন মনরোকে নিয়ে পচিশ হাজার শব্দের বই লিখে দিলে মোটা অংকের অর্থ পাওয়া যাবে। তিনি অংকটাও বলেছিলেন।
প্যারিস রিভিউ : কত?
মেইলার : পঞ্চাশ হাজার ডলার। ঐ সময় পঞ্চাশ হাজার ডলার মানে বিশাল কিছু। অবশ্য স্কট বলেছিলেন ননফিকশন লিখা ভালো, তবে বেশি লিখবেন না। যাই হোক, পচিশ হাজারের জায়গায আমি পচানব্বই হাজার শব্দ লিখেছিলাম। লক্ষনীয় বিষয় হলো: এরকম একটি চমৎকার বই লিখতে আমাকে কোন চিন্তা-ভাবনাই করতে হয়নি। সবকিছু আমার হাতের মুঠোয় ছিলো। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই বইটি লিখতে গিয়ে সত্য এবং মিথ্যা-সত্যের সাথে আমার ভালো পরিচয় ঘটেছে। আমি আসলে একদল মিথ্যাবাদীর সাথে কাজ করছিলাম। হলিউডের প্রায় প্রত্যেকে মেরিলিন সম্পর্কে মিথ্যা, বানোয়াট, বিভ্রান্তিকর ও অতিরঞ্জিত বক্তব্য দিয়েছে। তাই আমাকে ডিটেকটিভের মতো কাজ করতে হয়েছে। আমাকেই স্থির করতে হয়েছে কোনটি সত্য, কোনটি মিথ্যা।
প্যারিস রিভিও ঃ আপনার সাথে কথা বলবো অথচ রাজনীতি আসবে না- এটা অসম্ভব। আপনি এক সময় নিজেকে রক্ষণশীল বামপন্থী বলে দাবি করতেন।
মেইলার ঃ এখনো তাই করি। আমি রক্ষণশীল বামপন্থী।
প্যারিস রিভিও ঃ নব্য রক্ষণশীলতা নিয়ে কিছু বলুন। আমেরিকাতেও এই আদর্শের উপস্থিতি লক্ষনীয়। বিশেষ করে নরমান পডহোরেজের (ঘড়ৎসধহ চড়ফযড়ৎবঃু) সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল? আমার ধারণা তিনি অনেক দূরে এগিয়ে গিয়েছিলেন।
মেইলার ঃ তিনি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। গধশরহম ওঃ নামে তিনি যে বই লেখেছিলেন পাঠক তা প্রত্যাখান করেছিল। বামপন্থীদের মধ্যে তার কোন জনপ্রিয়তা ছিলনা। এর কারণ তখন পর্যন্ত আমার কাছে খুব একটা বোধগম্য ছিল না। আপনি বিশ্বাস করতে পারবেন না, কতটা নোংরা ভাবে তার বইটিকে প্রত্যাখান করা হয়েছিল। তখন পর্যন্ত পুরো বইটি আমার পড়া হয়ে উঠেনি, তবে প্রথম অর্ধেক বেশ ভালই ছিল। কিন্তু পুরো বইটা পড়ার পর শেষের অর্ধেক একেবারেই বাজে মনে হয়েছে। বইটির প্রথম অর্ধেকে তিনি বামপন্থী, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবিদের কিছু নোংরা মানসিকতা তুলে ধরেছেন। তিনি দেখাতে চেয়েছেন, বামপন্থীরা তাদের আদর্শকে খুব বড় করে তুলে ধরতে চান ঠিকই কিন্তু এ বিষয়ে অন্যদের সাথেতো দূরের কথা নিজেদের সাথেও কথা বলেন না। মানুষ যৌনতা নিয়ে কথা বলে কিন্তু নিজের উচ্চাকাঙ্খা নিয়ে কথা বলে না। অথচ পডহোরেজ তাই করেছিলেন। বাম আদর্শের কর্ণধাররা যে সকল ভাল মানুষদের সাথে নিয়ে তাদের আদর্শকে পূত-পবিত্র করার সংগ্রাম করেছেন তারা যে ততো ভাল ছিলেন না তিনি সেটাই তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি নিজেই তার বইয়ের সাথে প্রতারণা করেছেন কারণ তার সাহসের অভাব ছিল।
একারণেই বইটির উপর সমালোচনা লিখতে গিয়ে আমি তাকে নিষ্ঠুরভাবে ভর্ৎসনা করেছি। ফলে তিনি হতাশ হয়ে প্রায় এক বছর নিজেকে আড়াল করে রেখেছিলেন। ঐ এক বছর গান শুনে আর নিজের পত্রিকা সম্পাদনা করে সময় পার করেছেন, কারো সাথে খুব একটা দেখা করেননি। এর পরই তিনি ডানপন্থী হয়ে উঠেন তবে তার জন্য সেটা উপযুক্ত সময় ছিল না। তার এই সিদ্ধান্তের জন্যে আমিও কিছুটা দায়ী। ইরাক যুদ্ধে সমর্থন দিয়ে ও নব্য রক্ষণশীলতার সকল বোকামীর অংশীদার হয়ে তিনি এখন পাপের প্রায়শ্চিত্য করছেন।
প্যারিস রিভিও ঃ কর্ম ও সাহিত্য উভয় ক্ষেত্রেই আপনি প্রচন্ড রাজনৈতিক। সবক্ষেত্রেই প্রত্যাশিত রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলেন কি?
মেইলার ঃ যদি আপনার কোন রাজনৈতিক দর্শন থেকে থাকে তবে বিরুদ্ধ দর্শনের সমালোচনা আপনি করবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই সমালোচনা খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারে না। রাজনীতিতে যোগদিয়ে নিউ ইয়র্কের (ঘবি ণড়ৎশ) মেয়র পদে দু’বার প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেছিলাম। আমার বিশ্বাস ছিল আমি ভিন্ন কিছু করতে পারবো। কিন্তু আবিস্কার করলাম, নিয়ম-কানুন না জেনেই আমি ফুটবল খেলতে এসেছি।
প্যারিস রিভিও ঃ মেয়র পদের জন্য ১৯৬৯ সালের প্রতিদ্বন্দ্বীতাই আপনার রাজনৈতিক জীবনের শেষ অধ্যায়।
মেইলার ঃ দেরিতেও হলেও আমি বুঝতে পেরেছিলাম দীর্ঘ পরিশ্রম করার ক্ষমতা আমার ছিলনা। তিন-চার মাস প্রচারনা চালিয়ে আমি প্রায় বুড়ো হয়ে গিয়েছিলাম। প্রায় সব সময়ই ক্লান্ত থাকতাম। তাছাড়া মিডিয়ার সমর্থনও খুব একটা পাইনি। অবস্থা ছিল দেয়ালে মাথা ঠুকার মত।
প্যারিস রিভিও ঃ তাহলে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছিলেন ভেইসলাভ হেভেল (ঠধপষধা ঐধাবষ) কিভাবে একই সাথে লেখক ও প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন?
মেইলার ঃ তার সম্পর্কে আমার খুব একটা ধারণা নেই। হাভানাতে (ঐধাধহধ, কিউবার রাজধানী) তার সাথে একবার দেখা হয়েছিল কিন্তু ফিদেল কেস্ট্রোর সাথে দেখা করবো শুনে তিনি আর কোন কথা বলেননি।
প্যারিস রিভিও ঃ এক পর্যায়েতো তাকে বুঝতেই হয়েছিল, নাকি?
মেইলার ঃ বুঝেছিলাম কিন্তু তার পরও আমি তাকে সংকীর্ণ মনাই মনেকরি। তিনি কমিউনিষ্টদের ঘৃনা করতেন এবং সাড়া জীবন তাদের বিরুদ্ধেই লড়াই করেছেন। কিন্তু প্রত্যেকেরই পার্থক্য বুঝার সামর্থ্য থাকা উচিত। পৃথিবীতে যদি একজন মাত্র ভাল কমিউনিষ্ট থাকেন তবে তিনি ফিদেল কেষ্ট্রো।
প্যারিস রিভিও ঃ ফ্ল্যানরি ও’কনোর একবার প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘এ যুগে আমেরিকার কণ্ঠস্বর কে?’’ উত্তরে তিনি নিজেই বলেছিলেন- বিজ্ঞাপন সংস্থা। আপনার কি মনে হয় আবারো এমন একদিন আসবে যখন এ প্রশ্নের উত্তর হবে আমেরিকান ঔপন্যাসিকরা?
মেইলার ঃ না, এখনই তা মনে করি না। আমি হতাশ। আমি হয়তো আরো ইতিবাচক হতে পারতাম কিন্তু বাস্তবতা হলো ব্যবসায়ীরা পুরো দেশটাই দখল করে নিয়েছে। আমেকিার নীতি আমূল পাল্টে গেছে। এক সময় আমেরিকার গর্বের কারণ ছিল উৎকৃষ্ট পণ্য আর এখন তার গর্বের কারণ সে পণ্য বিপণন করার সামর্থ্য।
প্যারিস রিভিও ঃ এফ,স্কট ফিৎজেরাল্ড জানতেন আমেরিকা বিভ্রান্ত। কিন্তু এখন এটাই কি বড় সত্য নয় যে, আমেরিকা তার নিজের মিথ্যাকেই পুরোপুরি বিশ্বাস করে?
মেইলার ঃ আন্তর্জাতিক সম্পর্কে ক্ষেত্রে আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই মিথ্যাশ্রয়ী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী পাঁচ কিংবা দশ বছর রাশিয়া আমাদের জন্য আদর্শিক হুমকী ছিল। কারণ, বলতে দ্বিধা নেই- বেশ কিছু দরিদ্র রাষ্ট্রের উপর তার প্রভাব ছিল। কিন্তু এরপর থেকেই তার মন্দা শুরু। ফলে রাশিয়া আমাদের জন্য আর কখনো হুমকী হয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু বিগত চল্লিশ বছরেরও অধিক সময় ধরে আমরা আমেরিকানদের বুঝিয়ে আসছি যে, আমরা এক আদর্শিক সংগ্রামে লিপ্ত এবং এ সংগ্রামে জয়ের কোন বিকল্প নেই। আর এভাবেই আমেরিকানদের মনে ধীরে ধীরে বিভ্রান্তিক পুরু আস্তরণ পড়ে গেছে।
অধিকাংশ দেশই যিশুকে বিশ্বাস করে। তারা আরো বিশ্বাস করে ক্ষমাই শ্রেষ্ঠ আদর্শ। কিন্তু আমরা শুধুমাত্র রবিবারে এ কথা বিশ্বাস করি। আর সপ্তাহের অন্য ছয়দিন আমরা হয়ে যাই প্রচন্ড প্রতিযোগিতামূলক জাতি। ডলার উপার্জনের জন্যে নরকের আগুনের মত জ্বলে উঠি। সংস্কৃতি এমন এক শব্দ যার প্রতি আমেরিকানরা দ্রুত সারা দেয় না। কিন্তু একজন ইউরোপিয়ান বুঝে, সংস্কৃতি বলতে ঠিক কী বুঝায়। স্থাপত্য তো বটেই এমনকি রাস্তার মোড়েও তারা সংস্কৃতিকে লালন করে। অথচ আমরা এমন ভাবে রাস্তা তৈরিকরি যাতে খুব দ্রুত মার্কেটে যাওয়া যায়। তাই আমেরিকান জীবন ব্যবস্থায় একটি বড় অপরাধ আছে, সে অপরাধ হল- আমরা যথেষ্ট ভাল খ্রিষ্টান নই। মুর্খতা এবং দেশাত্ববোধ এখানে এক সাথে কাজ করে। রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে রিপাবলিকানদের প্রচারনার মুল তত্বই হলো আমেরিনাকদের এটা বুঝনো যে, আমরাই একমাত্র মহান জাতি, একমাত্র ভাল রাষ্ট্র- যারা অন্য রাষ্ট্রের মঙ্গল কামনা করে এবং আমরাই ঈশ্বরের আশির্বাদপুষ্ট তাই ঈশ্বর স্বয়ং আমাদের সাফল্য দেখতে চান। এ কারণেই আমার মধ্যে এক প্রকার লজ্জা ও অপরাধবোধ কাজ করে যখন দেখি যতটা ভান করি আমরা আসলে ততটা ভাল নয়।
প্যারিস রিভিও ঃ ‘‘বৈবাহিক সম্পর্ক একটি কার্যকর প্রতিষ্ঠান’’ এবং ‘‘বিশেষ করে ভয়ঙ্কর ব্যক্তিদের জন্যে’’- আপনার বইয়ের এই লাইন দু’টো আমাকে হাসিয়েছে।
মেইলার ঃ তাই নাকি? আসলে ওটা শয়তানের বক্তব্য ছিল, আমার নয়।
প্যারিস রিভিও ঃ বুঝলাম। কিন্তু বিয়ে করার কারনেই কি আপনি ভাল ঔপন্যাসিক হতে পরেছিলেন?
মেইলার ঃ প্রশ্নটা একটু ঘুরিয়ে দেই। বিয়ে করেছিল বলেই কি পিকাসো ভাল শিল্পী হতে পেরেছিল? আসলে এটা একটা তর্ক করার মত বিষয়।
প্যারিস রিভিও ঃ নিঃসন্দেহে বিয়ে তাঁকে বৈচিত্র এনেদিয়েছিল।
মেইলার ঃ প্রত্যেক স্ত্রী-ই একটি সংস্কৃতি আর অন্য সংস্কৃতিতে ডুব দিলে অভিজ্ঞতা ভয়ানকও হতে পারে। বাস্তবতা হলো বিয়ে সব সময় স্বস্তিদায়ক প্রতিষ্ঠান নয়, এটি আপনার বিরক্তির কারণও হতে পারে।… নারীর সাথে পিকাসোর প্রতিটি সম্পর্কই তাঁর শিল্পী সত্বাকে প্রভাবিত করেছে। বিয়ের কারণেই আমার লেখা কিছুটা প্রভাবিত হয়েছে। তাই বলে ভাববেন না পিকাসোর সাথে আমি নিজেকে তুলনা করছি। আমার চেয়ে বিশ্বসভ্যতায় পিকাসোর অবদান ঢের বেশি। প্রত্যেকের আনুগত্য ভিন্ন, পছন্দ ভিন্ন, উপলব্ধি ভিন্ন। শুভ ও অশুভ নিয়ে প্রত্যেকের ভাবনাও ভিন্ন।
প্যারিস রিভিও ঃ শুভ ও অশুভ?
মেইলার ঃ শুভ ও অশুভ সম্পর্কে আমাদের উপলব্ধির সূত্রপাত আমাদের পিতা-মাতা থেকে। কালক্রমে সেই উপলব্ধি পরিবর্তিত হয় অন্যের সাথে আমাদের সম্পর্কের মাধ্যমে।
প্যারিস রিভিও ঃ এবার বন্ধুত্বের প্রশ্নে আসি। আমেরিকান ঔপন্যাসিকরা প্রায়ই কিছুটা হলেও বন্ধুত্ব দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছেন। যেমন- ফিৎজেরাল্ড ও হেমিংওয়ে কিংবা শেরওড অ্যান্ডারসন ও থিয়েডর ড্রিজার।
মেইলার ঃ ফিজেরাল্ড ও হেমিংয়ের বন্ধুত্ব বেশির ভাগ সময়ই সংকট পূর্ণ ছিল।
প্যারিস রিভিও ঃ কিন্তু তারপরও বন্ধুত্ব তাদের জীবনের অনেক কিছুই নির্ধারণ করে দিয়েছিল।
মেইলার ঃ ঠিক আছে। আমি জেমস জোনস ও আমার কথা বলতে পারি।
প্যারিস রিভিও ঃ উইলিয়াম স্টাইরন?
মেইলার ঃ এক পর্যায়ে আমি ষ্টাইরনের উপর ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। তবে তিনি খুব মেধাবী ছিলেন। জোনস, ষ্টাইরন ও আমার সম্পর্ক ছিল তীব্র প্রতিযোগিতামূলক। আমাদের এই প্রতিদ্বন্দ্বী সম্পর্ক বুঝা খুব সহজ নয়। বলা যায়, অনেকটা খ্যাতিমান অ্যাথলেটদের মতÑ কেউ কারো চেয়ে কম নয়। কেন আমরা একে অনকে ঈর্ষা করি? আমরা সবাই মেধাবী- এটাই কি যথেষ্ঠ নয়? আমরা একে অন্যকে কেনই বা মেনে নিচ্ছিনা? এই প্রশ্নগুলো নিয়ে আমরা কখনো ভাবিনি। কারণ আমরা প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলাম। কিন্তু একই সাথে আমরা একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীলও ছিলাম। আমার মনে আছে, একবার জোনসের কাছে ঋৎড়স ঐবৎব ঃড় ঊঃবৎহরঃু’র একটি কপি চয়েছিলাম। তিনি বইটিতে লিখে দিয়েছিলেনÑ ‘‘আমার সবচেয়ে বিপদজনক বন্ধু; সবচেয়ে প্রিয় প্রতিদ্বন্দ্বী- নরমানের প্রতি’’। লেখকদের বন্ধুত্বের ধরণটাই এমন। গোর ভিডাল, (এড়ৎব ঠরফধষ) মানুষের দোষ-দ্রুতি ধরতে যার ভুল হয় না, একবার বলেছিলেন- ‘‘যখন আমার কোন বন্ধু সফল হয়, তখন আমার সত্বার খানিকটা মৃত্যু ঘটে’’। অবশ্য আমরা চাইলেই মানসিকতা পাল্টাতে পারি। অন্য কেউ সফল হলে নিজে সফল হবার প্রতিজ্ঞা করতে পারি।
প্যারিস রিভিউ : চিরস্থায়ী শত্র“কে? অহংকার?
মেইলার : অহংকার আপনাকে ধ্বংস করতে সক্ষম। ট্রুম্যানের দিকে তাকান। তার চিন্তাটা এমন ছিল যেÑ যদি আমি স্বীকৃতি না পাই তবে সমাজে ভয়াবহ কিছু একটা ঘটে যাবে। তাই খুব সতর্ক হয়ে অহংকারকে প্রশ্রয় দিতে হবে। অহংকার আমাদের সত্ত্বার শুভ অংশকে হত্যা করতে পারে। অহংকারকে পরিত্যাগ করা শিখতে হবে। অহংকারকে ইতিহাসে নিক্ষেপ করতে হবে।
মেইলার : আমি যখন এখানে প্রথম আসি তখন আমার বয়স উনিশ। একটি মেয়ের সাথে আমার মন দেয়া-নেয়া চলছিল। পরে তাকে বিয়ে করেছিলাম। সে আমার প্রথম স্ত্রী বেট্রিস সিলভারম্যান। আমরা স্থির করেছিলাম উইকেন্ডে কোথাও হাওয়া খেতে যাব এবং আগে থেকেই ঈধঢ়ব ঈড়ফ- এর চূড়ায় এই শহরটির কথা বেট্রিসের জানা ছিল। সময়টা ঠিক মনে নেই, ১৯৪২ কিংবা ’৪৩ হবে। প্রথম দেখাতেই আমি এই শহরটির প্রেমে পড়ে যাই। প্রোভিন্সটাউনে প্রায় ৪০ মাইলেরও বেশি অরক্ষিত সমুদ্র সৈকত থাকায় সে সময় নাৎসি বাহিনীর হঠাৎ অবতরণের আশংকাও ছিল। তাই শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ ছিল না। রাতে রাস্তায় বেড়োলে মনে হতো যেন ঔপনিবেসিক আমেরিকায় এসেছি। যুদ্ধের পুরোটা সময় ধরেই আমার স্ত্রীর কাছে লেখা চিঠিতে তাকে মনে করিয়ে দিতাম, যদি আমি ফিরে আসি তবে আমাদের প্রথম কাজটাই হবে এই প্রোভিন্সটাউনে চলে আসা।
প্যারিস রিভিউ : আর তখন থেকেই আপনি ঞযব ঘধশবফ ধহফ ঃযব উবধফ লেখা শুরু করলেন?
মেইলার : ’৪৬ এর মে মাসে আমি সেনাবাহিনী ছেড়ে দেই এবং জুন মাসেই এখানটায় চলে আসি। জুনে কিংবা জুলাই এর একদম গোড়ার দিকে বইটি লেখায় হাত দেই। আমার মনে আছে, সৈকতে ভাড়া করা একটি কুড়ে ঘরে লেখার কাজ শুরু করেছিলাম। কোন বই লেখার প্রস্তুতি নিতে সাধারণত আমার সপ্তা দুয়েক সময় লাগে।
প্যারিস রিভিউ : এ বিষয়ে কোন নোট করেছিলেন?
মেইলার : লেখা শুরুর আগে আমি প্রচুর নোট করি। তাছাড়া সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বাড়তি পড়াশুনা এবং তা নিয়ে চিন্তাভাবনা ও বিশ্লেষণ করার অভ্যাসও আমার আছে। এখন একটা উপন্যাস শেষ করতে বছরের অর্ধেকটাই পার হয়ে যায়। কিন্তু ঞযব ঘধশবফ ধহফ ঃযব উবধফ শেষ করতে মাত্র কয়েক সপ্তাহ লেগেছিল। তার কারণও ছিল, তখন আমি যুবক, চিন্তা ও যুদ্ধের চেতনায় পরিপূর্ণ। সত্যি কথা বলতে, তখন আমাকে কোন গবেষণাই করতে হয়নিÑ মগজেই সব ছিল। সেই গ্রীষ্মে আমি প্রায় দু’শ পৃষ্ঠা লিখেছিলাম।
প্যারিস রিভিউ : আপনি জানতেন উপন্যাসটি ভালো হচ্ছে?
মেইলার : কখনো মনে হতো ওটা একটা ভয়ঙ্কর জিনিস হচ্ছে আবার কখনো ভাবতামÑ আমি আসলে জানিইনা কিভাবে লিখতে হয়। তখন আমার লেখা খুব একটা শৈল্পীক ছিল না, তবে ভালো লেখার কলা-কৌশল সম্পর্কে আমার অনেক কিছুই জানা ছিলো। আপনার হয়তো মনে আছে, গত রাতে আমরা থিওডর ড্রিজার সম্পর্কে আলোচনা করেছিলাম। দু’জনেই কম-বেশি একমত হয়েছিলাম যে, রচনা শৈলীতে ড্রিজারের তেমন কোন পারঙ্গমতা ছিলো না তবে তাঁর এমন কিছু গুণ ছিলো যা রচনা শৈলীর চেয়েও উৎকৃষ্ট। ঐ সময় আমি যাদের লেখা পড়তাম ড্রিজার তাঁদের একজন। যখন আমার লেখাগুলোর সাহিত্যমান দুর্বল বলে মনে হত তখন আমি নিজেকে এই বলে সান্তনা দিতাম যে, স্বয়ং ড্রিজারের লেখাতেও যথেষ্ট শিল্প নৈপুণ্য নেই।
আমার মনে হয়, একমাত্র প্রাউষ্টই (চৎড়ঁংঃ) শিল্প নৈপুণ্যের কর্মটি সাধন করতে পেরেছিলেন। প্রকৃত অর্থেই সাহিত্য উপাদান ও শৈলীর সাথে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক ছিলো। সাধারণত, যদি আপনার রচনা শৈলী চমৎকার হয় তবে সাহিত্য উপাদানগুলো হবে অধিকতর দুর্বোধ্য বা অস্বাভাবিক। যেমনটা হয়েছে হেনরি জেমস্ ও হেমিংওয়ে’র ক্ষেত্রে। তবে এর ঠিক উল্টোটা ঘটেছে জোলা’র ক্ষেত্রে। তাঁর রচনাশৈলী ছিলো যুক্তি সঙ্গতভাবে শোভন। যা বড় গলায় উল্লেখ করার মত কিছু নয় কিন্তু তাঁর উপাদানগুলো এককথায় মারাত্মক।
নিজের কাজ সম্পর্কে আমার মূল্যায়ন হলো, আমি রচনা শৈলীকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছি। যার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ অহ অসবৎরপধহ উৎবধস। কিন্তু ঞযব ঊীবপঁঃরড়হবৎ’ং ংড়হম- এ এই দিকটি কার্যত অনুপস্থিত, কারণ এর উপাদানগুলো অপূর্ব। অহ অসবৎরপধহ উৎবধস পুরোপুরিই আমার নিজস্ব কল্পনাÑ বলতে পারেন, বাবুর্চির কাজটা আমিই করেছি।
প্যারিস রিভিউ : আপনার ক্ষেত্রে একটি বিষয় নিয়ে বির্তক হতে পারে যে, আপনার লেখার বিষয় বস্তুগুলো কোননা কোন রহস্যকে উন্মোচণ করতে চায়, যা আগে স্পষ্ট ছিলো না।
মেইলার : আমি হাসছি, কারণ আপনি বিষয়টিকে একটি সুন্দর কাঠামো দিয়েছেন। ঞযব ঊীবপঁঃরড়হবৎ’ং ঝড়হম- লেখার সময় আমার উদ্দেশ্য এতোটা সম্মানজনক ছিলোনা। উপন্যাস লিখতে গিয়ে বারোক রীতি (ইধৎড়য়ঁব ঝঃুষব, ১৭ ও ১৮ শতকের অতিরঞ্জনমূলক ইউরোপীয় শিল্পরীতিÑ অনুবাদক) অনুসরণ করায় মূলতঃ আমি সমালোচিত হবার পথেই পা বাড়িয়েছিলাম এবং হয়েছিলামও তাই। আপনি কি মনে করেন এই বারোক রীতি খুব সহজ? মোটেই তা নয়। এটি এমন একটি বিষয় যেখানে আপনাকে পৌঁছতে হবে। এর জন্য বছরের পর বছর চর্চা করা প্রয়োজন। আপনারা সব সময় সারল্যের গুণ ও শক্তি নিয়ে কথা বলেন। সারল্যের মধ্যে একেবারেই কিছু নেই এবং আমি এই বই দিয়ে তা প্রমাণ করতে সক্ষম। এর কারণ, সম্ভবত একটি সরল বই লেখার মত যথার্থ উপাদান আমার আছে এবং আমি একটি সরল বই লিখতে পারি। তাই আমি সে ভাবেই অগ্রসর হয়েছি। এই বইয়ে আমার গর্বের মূল উপাদানই হল গ্যারি গিলমোরের চিঠি। আমি অক্ষরে অক্ষরে চিঠিটির দুই-তৃতীয়াংশ উদ্বৃত করেছি। এ পর্যন্ত আমার কোন লেখাই এ চিঠির চাইতে উৎকৃষ্ট হতে পারেনি। কারণ চিঠিটিই তাকে জীবন দিয়েছে এবং হঠাৎই লক্ষ্য করবেন অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে এই মানুষটিই ছিলো শক্তির আধার। সে হয়তো অকর্মন্য ছিলো। কারণ তাকে এভাবেই ডাকা হতো; কিংবা সে বীভৎস কায়দায় দু’জন লোককে হত্যাও করতে পারতো। কিন্তু তার একটা হৃদয় এবং নিজস্ব সাহিত্য রীতি ছিলো, যা তার ঐ চিঠিতে সুস্পষ্ট রূপ পেয়েছে।
সুদীর্ঘ সময় ধরে আমার মধ্যে এক মৌলিক ধারণা জন্ম নিয়েছে, তা হলোÑ বাস্তবতা এক রহস্যময় পবর্ত। আমরা ঔপন্যাসিকরা সেই পর্বতে আরোহণের চেষ্টা করছি। আমরা পবর্তারোহী আর প্রশ্ন হলোÑ আমরা কোন পথ দিয়ে তাতে আরোহণ করছি? ভিন্ন ভিন্ন পথে ভিন্ন ভিন্ন কৌশল প্রয়োজন। কোন কোন পথ দাবি করে অন্তরের জটিল ও দুরূহ পদ্ধতি আর অন্যরা সারল্য। তবে মূল বিষয় হচ্ছে, বাস্তবতার জগতে এটি একধরণের আগ্রাসন। তাই খুব সাদামাটাভাবেই আমি বইটি রচনা করেছি। হয়তো বইটি আমাকে এই ধারণা দিয়েছিলো যে, আমিও হেমিংওয়ের হাতে কড়ি পরাতে পারি। কিন্তু বইটা যখন লেখা হলো, দেখলাম আমি আর হেমিংওয়ে এক নই। আমি হেমিংওয়ের প্রশংসা করি তাঁর সৃষ্ট চরিত্রটির জন্য, ঐ মানুষটির জন্য নয়। আমার ধারণা তাঁর সাথে কখনো দেখা হলে সেটা হতো আমার জন্য ছোটখাট একটি বিপর্যয়। তারপরও অন্যেরা যা পারেনি তিনি আমাকে তাই দেখিয়েছেন। আমি বুঝতে পেরেছি, ইংরেজি বাক্য গঠনের সুপ্ত শক্তিটা ঠিক কোথায়।
প্যারিস রিভিউ : হেমিংওয়ে সম্পর্কে আরো কিছুক্ষণ কথা বলি। তিনি দেখিয়েছিলেন কোন বাক্যে আবেগ- অনুভূতির কথা উল্লেখ না করেই আবেগ সৃষ্টি করা যায়, এটা কি সম্ভব?
মেইলার : হ্যাঁ, তিনি এটা পেরেছিলেন যা তাঁর আগে বা পরে কেউ পারেনি। কিন্তু তিনি নিজেই একটি ফাঁদ। যদি আপনি সতর্ক না থাকেন তবে আপনার লেখাটাও ঠিক তার মতোই হয়ে যাবে। হেমিংওয়ের মতো কিছু লেখা বিপদজনক তবে যে কারো জন্যে সেটা মাইলফলকও বটে। আমি এমন কোন তরুণ ঔপন্যাসিকের ওপর আস্থা রাখতে রাজি নই যে তারুণ্যে হেমিংওয়েকে অনুসরণ করে না, অবশ্য আমি শুধু পুরুষ ঔপন্যাসিকদের কথাই বলছি।
প্যারিস রিভিউ : যখন হেমিংওয়ের আত্মহত্যার সংবাদ পেলেন তখন কোথায় ছিলেন, মনে করতে পারেন কি?
মেইলার : বেশ ভাল ভাবেই মনে করতে পারছি। আমি তখন জিমক্যামবেল এর সাথে মেক্সিকোতে। আমি খুব বিস্মিত হয়েছিলাম। সত্যি বলতে, ঐ ধাক্কা আমি কখনোই কাটিয়ে ওঠতে পারিনি। ওটা ছিলো একটি সতর্কবার্তা। তিনি যেন বলছিলেন: হে ঔপন্যাসিকগণ, মন দিয়ে শোনÑ যে মুহূর্ত থেকে তুমি একজন ঔপন্যাসিক সে মুহূর্ত থেকে তুমি এক চরম বিপদজনক মনস্তাত্বিক যাত্রা শুরু করেছো, এটি তোমাকে আঘাত করতে পারে।
প্যারিস রিভিউ : তাঁর এ সাহসিকতার সাথে আপনি কি আপোষ করতে চান?
মেইলার : এ কথা ভাবতেও আমার ঘৃণা হয়। তাঁর মৃত্যু সম্পর্কীত একটি থিসিস আছেÑ হেমিংওয়ে আগে থেকেই জানতেন যে তিনি যতোই মৃত্যুর কাছাকাছি যাবেন ততোই তাঁর জন্য মঙ্গল। মৃত্যুর নিকটবর্তী হবার সাহসকে তিনি এক প্রকার পথ্য মনে করতেন। এবং আমার ধারণা রাতের পর রাত বেডরুমে বসে তিনি শর্টগানের ব্যারেল মুখে পুরে মৃদু ট্রিগার চাপতেন এবং মৃত্যুর নিকটবর্তী হবার স্বাদ নিতেন। কিন্তু ঐ রাতে হয়তো ট্রিগারটা একটু বেশিই চেপে ফেলেছিলেন। সে যাই হোক, এটি নিছক তত্ত্ব মাত্র। বাস্তবতা হলো, হেমিংওয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন।
প্যারিস রিভিউ : তা হলে কি বলা যায় না, সাহিত্য চর্চা আত্মঘাতী?
মেইলার : সাহিত্য একজন সাহিত্যিককে গভীরভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম। একটি বই লেখার পর সাহিত্যিকের নিজের বলতে তেমন কিছুই আর থাকে না। একারণেই লেখকরা যদি মনে করেন তাঁদের অন্যায় ভাবে সমালোচনা করা হচ্ছে তবে তাঁরা সহজেই ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন। আমরা মনে করি, বই লিখতে গিয়ে আমরা নিজেদের একবার হত্যা করেছি আর সমালোচকরা তুচ্ছ কারণে আবার আমাদের হত্যা করতে চাচ্ছেন। গ্যারি গিলমোর একবার মন্তব্য করেছিলেন ‘‘পৃথিবীতে ন্যায় বলে কিছু নেই।” আমি এই মন্তব্যকে বার বার ব্যবহার করেছি। যদি আপনি একটি ভালো উপন্যাস লিখতে শুরু করেন তবে আপনি হয়ে যাবেন একজন অভিযাত্রিক। আপনি এমন কিছুর দিকে ছুটতে থাকবেন যার সীমা আপনার জানা নেই, প্রকৃতঅর্থে যার কোন সীমাই নেই। সেখানে আছে ভয় ও উত্তেজনার সংমিশ্রণ যা আপনাকে সামনে নিয়ে যাবে। আমার মতে, যদি সফলতার কোন সম্ভাবনা নাই থাকে তবে উপন্যাস লেখা মূল্যহীন। আপনি ব্যর্থ হবেন। কারণ আপনার মানসিক সীমাবদ্ধতার সাথে এটি একধরণের জুয়া খেলা। যেন আপনি এক সদস্যের সেনাবাহিনীর একমাত্র সেনাপতি, যে কানাগলির দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
প্যারিস রিভিউ : এবার বয়স নিয়ে কথাবলি। বার্ধক্য লেখক সত্তার অহংকারকে কিভাবে প্রভাবিত করে? ফেলে আসা বছরগুলোই শ্রেষ্ঠÑ কারো অহংকারের জন্য এমন ধারণার চাইতে ক্ষতিকর হয়তো আর কিছুই নেই।
মেইলার : যদি এমন হয় যে, আপনি বৃদ্ধ হয়েগেছেন এবং আপনার মধ্যে বস্তুনিষ্ঠতার অভাব আছে, তবে বলবোÑ বিপদেই আছেন। বস্তুনিষ্ঠতা মানুষকে বার্ধক্যেও বলিষ্ঠ রাখে। যদি আপনি মনে করেন, আগের যে কোন সময়ের তুলোনায় অল্প কিছু কাজ আপনার হাতে আছে এবং আপনার কৃতকর্ম ভারসাম্যপূর্ণ, তবে এটাই পারে আপনাকে স্থায়ীত্ব দিতে। তবেই আপনি বুঝতে পারবেন লেখক হিসেবে আপনার আর কী করার আছে এবং কী নেই। আপনি কেন আগের চাইতে বেশি প্রাজ্ঞ হচ্ছেন নাÑ এমন চিন্তা করার কোন যুক্তিই নেই। কারণ এখন আপনি বৃদ্ধ। আপনার এখন উচিত নিজের জীবন থেকে মানব চরিত্র সম্পর্কে শিক্ষা নেয়া। আপনি কি এখনও আগের মতো কলম চালাতে পারেন? উত্তর যদি হয় না, তবে আপনি প্রায় মূল্যহীন।
প্যারিস রিভিউ : কেন?
মেইলার : কারণ খুব সোজাÑ ব্রেইন ডেমেজ। মস্তিস্ক ক্ষয়িষ্ণু। জানেন তো, কেন পুরোনো গাড়ি নতুন গাড়ির মতো চলে না? এই বাস্তবতা মেনে নিতে হবে। আপনি তো আর গাড়িকে লাথি-ঘুষি দিয়ে বলবেন না যেÑ তুই আমার সাথে প্রতারণা করেছিস! সবচেয়ে ভালো হয় যদি আপনি গাড়ির প্রতিটা শব্দের অর্থ বুঝেন।
প্যারিস রিভিউ : শুনেছি, কোন এক বর্ষীয়ান আমেরিকান ঔপন্যাসিক জীবনের গোধূলী লগ্নে অপর এক বর্ষীয়ান আমেরিকান ঔপন্যাসিকের সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে বলেছিলেনÑ যথেষ্ট হয়েছে, আর লেখালেখি নয়।
মেইলার : তিনি বলেছিলেনÑ আর লিখবেন না।
প্যারিস রিভিউ : হ্যাঁ। এটি নিউ ইয়র্কের খুব জনপ্রিয় গল্প। অনেকে বিষয়টাকে মনে করে পারস্পারিক ভালোবাসা। একজন মহান, অভিজাত সৈনিক আরেক সৈনিককে নিরস্ত্র করছেন।
মেইলার : না, আমি এটা বিশ্বাস করিনা। যদি আমার ক্ষেত্রে এমন হতো তবে বলতামÑ যা বলার বলেছেন, এবার দয়াকরে আসুন।
প্যারিস রিভিউ : আপনি কি মনে করেন শিল্প চর্চার জন্যে আমেরিকা একটি উৎকৃষ্ট স্থান?
মেইলার : আমি যখন তরুণ তখন আমেরিকা ছিলো লেখকদের জন্য এক অসাধারণ স্থান। তার কারণ, আমেরিকায় অনেক ভালো লেখক ছিলোÑ আর আমাদের অধিকাংশ সাহিত্যই তখন পর্যন্ত লিখিত হয়নি। ১৮ ও ১৯ শতকের অধিকাংশ প্রতিভাবান ঔপন্যাসিক ছিলেন ইংরেজ, যারা অন্যদের ছাড়িয়ে যেতে পেরেছিলেন। কিন্তু অন্যদের ছাড়িয়ে যাবার জন্য আমাদের কী ছিল?
গবষারষব ও ঐধঃিযড়ৎহব এর মত গুটি কয়েক ভালো লেখক। তালিকাটা খুব সংক্ষিপ্ত কিন্তু আমাদের জন্যে ময়দান ছিল উন্মুক্ত। অথচ আমরা এখন সমালোচিত, বিপদগ্রস্থ। আমাদের চলচ্চিত্রগুলোও বাজে ছিলÑ শুধুই আনন্দদায়ক। মানব জীবন সম্পর্কে ওগুলো থেকে কিছুই শিখার ছিলো না, কারণ আমি মনে করি সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলোÑ আমরা কেন এই পৃথিবীতে এসেছি।
এখনকার ছেলে-মেয়েরা তো টেলিভিশন নিয়েই মেতে আছে। এই যন্ত্রটির এমন একটি উপাদান আছে যা চিন্তাশীল পাঠাভ্যাসের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারকÑ তা হলো বিজ্ঞাপন। হয়তো আপনি নাটক কিংবা সিনেমা দেখছেন, লক্ষ্য করবেন প্রতি সাত কিংবা দশ মিনিট পর পর বিজ্ঞাপন প্রচারিত হচ্ছে। যা আপনার মনোযোগকে নষ্ট করে দিতে যথেষ্ট। বাচ্চারা এভাবেই টিভি দেখে দেখে সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। একজন ঔপন্যাসিক হিসেবে আমি মনে করি, বিলুপ্ত প্রায় কুটির শিল্পের আমিও একজন রুগ্ন কারিগর। সাহিত্য এক সময় শিল্প ছিল, এখন কুটির শিল্পের পরিণত হয়েছে, যার নিয়তি বিলুপ্তি। তাই আপনার প্রশ্নের উত্তর হলো- ঔপন্যাসিকদের জন্যে আমেরিকা এক সময় ছিলো চমৎকার আবাসভূমি কিন্তু এখন আর সেরকম নেই।
প্যারিস রিভিউ : এমন কোন সময় কি ছিলো, যখন আমেরিকানরা সত্যের জন্যে ঔপন্যাসিকদের দ্বারস্থ হয়েছে?
মেইলার : চল্লিশের দশকের গোড়ার দিককার প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ লেখকই আমার কাছে চলচ্চিত্র তারকাদের চাইতেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। চলচ্চিত্র তারকারা অদ্ভুত ও দুর্লভ। তারা হতে পারেন বহুমাত্রিক কিংবা আকর্ষণীয় কিন্তু আমার কাছে সেটা কোন ভাবেই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো না। গুরুত্বপূর্ণ ছিলো ঔপন্যাসিকরা। আমি কোন যাযকের অনুভূতি বলতে পারবো না তবে ঔপন্যাসিক হিসেবে এটাই আমার অনুভূতিÑ পেশাদারিত্ব। অন্য কোন কিছুই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো না।
প্যারিস রিভিউ : আমেরিকানরা শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক ও উপন্যাস পাবার জন্যে উদগ্রীবÑ এ ধারণাই কি আপনাকে পেশাদার করে তুলেছিল?
মেইলার : ঠিক তাই। আমার ধারণা পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে অনেকেই এরকম কিছু করার স্বপ্ন দেখতোÑ শ্রেষ্ঠ আমেরিকান উপন্যাস রচনা করার স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন এখন চুরমার হয়ে গেছে।
প্যারিস রিভিউ : আপনি কি মিল্টন ও চধৎধফরংব খড়ংঃ এর সাথে একমত যে, কোন কোন সময় শয়তানও যথার্থ কথা বলে?
মেইলার : হ্যাঁ। আমি সত্যিই বিশ্বাস করি, ঈশ্বর ও শয়তানের মধ্যে এক ধরণের স্বার্থের দ্বন্দ্ব চলছে যার প্রভাব আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই পড়েছে। কিন্তু মানুষ এ ধরণের চিন্তাকে এখন ঘৃণা করে। কারণ এটা প্রযুক্তির যুগ, মধ্যযুগ সম্পর্কে তারা বিতৃষ্ণ, ক্লান্ত। অথচ মধ্যযুগে আমরা ঈশ্বরের সামনে হাটু গেড়ে বসেছি, অশ্র“ সিক্ত হয়েছি আর প্রার্থনা করেছিÑ হে প্রভু, আমাদের দিকে ফিরে তাকাও, আমাদের রক্ষা কর, শয়তানকে বিতাড়িত কর। যাইহোক, তারপর থেকেই আমরা আলোকিত হয়েছি; ভলতেয়ারকে পেয়েছি। গত কয়েক শতাব্দী ধরে মানুষ হিসেবে আমাদের অহংকারকে আরো তীব্র করেছি। তাই এখন আমরা তৃতীয় এক শক্তি। এক প্রান্তে ঈশ্বর, অন্য প্রান্তে শয়তান। মাঝের বিশাল কেন্দ্র মানুষের দখলে। আর পৃথিবীর অর্ধেক মানুষই বেঁচে আছে ঈশ্বর কিংবা শয়তানকে বিশ্বাস না করেই।
প্যারিস রিভিউ : আপনি কি ঈশ্বরকে বিশ্বাস করেন?
মেইলার : অবশ্যই বিশ্বাস করি। কিন্তু ঈশ্বরকে আমি জেহভার মতো বিধানদাতা মনে করি না। আমি মনে করি, ধর্ম যাযকরাই এমন ধারণার সৃষ্টি করেছেন যে, মানুষ যদি মহাশক্তির উপাসনা না করে তবে পরকালে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে। মূলতঃ এর মাধ্যমেই তারা নিজেরা ক্ষমতাবান হয়েছেন। তাই এই ধারণার প্রতি আমার কোন বিশ্বাস নেই। আমি ঈশ্বরকে স্রষ্টা হিসেবেই মানি। তাঁর সম্পর্কে আমার বিশ্বাস, তিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং চলমান ঘটনা প্রবাহের উপর তাঁর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই।
প্যারিস রিভিউ : অর্থাৎ আপনার ঈশ্বর নিজেই অস্তিত্ববাদী?
মেইলার : ঠিক তাই। তিনি জানেন না ঘটনা কোন দিকে মোড় নেবে কিংবা তিনি ব্যর্থ না সফল হবেন। তিনি শয়তানের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত। চাইলে আপনি তাকে স্থানীয় বা আঞ্চলিক ঈশ্বরও বলতে পারেন। এরকম বহু ঈশ্বর এই মহাবিশ্বে রয়েছেন। অস্তিত্ব সম্পর্কে তাদের অনুভূতিও ভিন্ন। তাদের কেউ কেউ পরস্পারিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত আবার কেউ এতোটাই ভিন্ন যে অস্তিত্ব নিয়ে তাদের কোন দুঃশ্চিন্তা নেই। আমরা যদি কারো মর্যাদা নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করি তবে তা হবে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত বিশ্লেষণ, অবৈধ বিশ্লেষণ। কারণ আমি মনে করি, শয়তানকে সম্ভবত ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হিসেবেই পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়েছে। অন্য কথায়, মহাবিশ্বের পরম শক্তি মানবিক বোধ সম্পন্ন এই ভুঁইফোড় ঈশ্বরকে পছন্দ করেননি।
প্যারিস রিভিউ : বহু আমেরিকান এখন এমন ধারণা পোষণ করে যে, ঈশ্বর ও শয়তান তাদের স্ব স্ব কর্মে নিয়োজিত।
মেইলার : আমিও তাই মনে করি। তবে আমি এটা বিশ্বাস করি না যে, কেউ শয়তানের খপ্পরে পড়লেই চিরতরে নষ্ট হয়ে গেল। কিন্তু তারপরও আপনি কি কখনো বলতে পারবেন যে, ক্ষণিকের জন্যে হলেও নিজেকে কখনো পাপী মনে করেননি।
প্যারিস রিভিউ : কিছুটা আধ্যাত্বিক কথা।
মেইলার : না। কিছুটা অশুভ। আর এটাই যথার্থ উত্তর।
প্যারিস রিভিউ : আমার যদি ভুল না হয়, ঞযব ঈধংঃষব রহ ঃযব ঋড়ৎবংঃ- এ আপনি বলতে চেয়েছেন যে, হিটলারকে শুধু হিটলারই বলা যায়, অন্য কিছু নয়। তা হলে তো বিষয়টি রহস্যাবৃতই রয়েগেল। কারণ হিটলারের চিন্তা-চেতনাতেও তো শয়তানের অস্তিত্ব ছিলো। এই বই সম্পর্কে আমার যুক্তি হলোÑ নিজস্ব চিন্তা ও জীবন ব্যবস্থায় মানুষের ত্রাস সৃষ্টি করার ক্ষমতাকে কোন ঔপন্যাসিকই অবজ্ঞা করতে পারেন না।
মেইলার : আপনি এটা নিয়ে বির্তক করতে পারেন। হিটলার একজনই, তার সম্পর্কে অন্য কোন ব্যাখ্যা নেই। ষ্টালিনও দানব ছিলো কিন্তু বোধগম্য প্রকৃতির। আমরা তার জীবনী পড়ে দেখতে পারি, বলশেভিক আন্দোলন নিয়ে পড়াশুনা করতে পারি, আমরা রাশিয়ার বর্তমান অবস্থা যাচাই করতে পারি, আমরা রুশ বিপ্লবের ভয়ানক প্রতিক্রিয়াও প্রত্যক্ষ করতে পারি। আমরা ষ্টালিনকে ধাপে ধাপে এর সাথে সম্পৃক্ত করতে পারি এবং মানবিক উপায়েই তাকে বুঝতে পারি। তিনি হয়তো মহাপাপীদের একজন কিন্তু তারপরও তিনি মানুষ ছিলেন। ষ্টালিনকে ব্যাখ্যা করার জন্যে শয়তানকে টেনে আনবার প্রয়োজন নেই। কিন্তু হিটলার একেবারেই ভিন্ন। ষ্টালিনের মতো হিটলার দৃঢ়চেতা ছিলো না। সে ছিলো ভিরু, কাপুরুষ। হিটলার অব্যাখ্যেয়। অবশ্য, আপনি যদি মনে করেন, হিটলারের শয়তানের আজ্ঞাবহ হবার কারণ জার্মানদের চরিত্রের গভীরে নিহিত তবে সেটা ভিন্ন কথা।
আমি এর চেয়েও বেশি দূর যাব। আমি আমার পরবর্তী বই লেখার প্রস্তুতি নিচ্ছি। জানিনা শেষ করতে পারবো কিনা, কিন্তু যদি পারি তবে সে বই-এ হিটলার আবির্ভূত হবে শয়তানের আজ্ঞাবহ হিসেবে। ঞযব ঈধংঃষব-এর শেষ ভাগে সে হবে মানুষের মাঝে শয়তান কর্তৃক রোপিত হাজারো বীজের একটি। শয়তানও ঈশ্বরের মতো অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করে কিন্তু ইতিহাসকে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যায় না। ঈশ্বর ও শয়তান একে অন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন। মানুষও তাদের এবং নিজেদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত। ঈশ্বর যেভাবে একজন যিশু সৃষ্টি করেছেন, শয়তান সেভাবে একজন হিটলার সৃষ্টি করেনা। শয়তান প্রয়োগবাদী, সে লক্ষ লক্ষ গুপ্ত হিটলার সৃষ্টি করে আর আমরা যে হিটলারের কথা বলছি সে তাদেরই দৃশ্যমান রূপ। কেন? কারণ জার্মানির স্বতন্ত্র দৃশ্যপট, যা হিটলারের আবির্ভাবের পূর্বে অনুপস্থিত ছিল। এটাই আমার পরবর্তী বইয়ের বিষয় বস্তু।
প্যারিস রিভিউ : আমরা এমন মানুষের বিশ্বে বাস করছি যারা বিশ্বাস করে তাদের বিরুদ্ধ শক্তিই হলো শয়তানের শক্তি।
মেইলার : জী।
প্যারিস রিভিউ : শয়তান, শয়তানের অক্ষ শক্তি, শয়তানের সাম্রাজ্যÑ আমরা তো এসব নিয়েই আছি।
মেইলার : আমার মূল প্রচেষ্টাই হলো সবগুলো রুটিতে সমান মাখন লাগানো হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া। আমেরিকায় কি অশুভ শক্তি আছে? হ্যাঁ। ইসলামে কি অশুভ শক্তি আছে? হ্যাঁ। একপক্ষ কি অন্য পক্ষের চেয়ে বেশি অশুভ? কে জানে সেটা।
আমরা উভয়ই প্রচন্ড অশুভ, আমরা উভয়ই প্রচন্ড শুভ। আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাসও তাই বলে আমরা এ দু’য়ের মিশ্রণ, গভীর মিশ্রণ। নাস্তিকরা বলে থাকেন, স্রষ্টাকে বিশ্বাস না করেও তারা সুখী। কিন্তু দার্শনিকভাবে তারা সুখী হতে পারেননা, কারণ আমরা কিভাবে অস্তিত্ব পেলাম এ প্রশ্নের উত্তর তাদের জানা নেই। নাস্তিক্যবাদী হয়ে মানব চরিত্রের জটিলতার ব্যাখ্যা দেয়া খুবই কষ্টসাধ্য কাজ। কিন্তু ঈশ্বরে বিশ্বাসী হলে, আমরা কেন পৃথিবীতে এসেছি তার খুব ভালো ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব। আমরা ঈশ্বরের সৃষ্ট জীব, আমাদের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে। ঠিক পিতার মতো, একজন পিতা যেমন চান তার সন্তানরা তার চেয়েও বেশি আকর্ষণীয় হোক, ঈশ্বরও ঠিক তাই চান। মায়ের ক্ষেত্রেও তাই। সে অর্থে আমরা ঈশ্বরের অগ্রদূত।
প্যারিস রিভিউ : আপনি পুনর্জন্মে বিশ্বাস করেন। আবার কি নরমান হয়েই ফিরে আসবেন?
মেইলার : আমি অপেক্ষা করছি, তাই না? বলা চলে, আমি এখন ওয়েটিং রুমে। আমাকে ডাকা হবে, আমি ভেতরে যাব। সেখানে যে দেবদূত থাকবেন তিনি বলবেন- মিষ্টার মেইলার, আমরা আপনার অপেক্ষাতেই ছিলাম। আপনি পুনর্জন্মের জন্য মনোনীত হয়েছেন। আমি বলবো, ধন্যবাদ। আমি আসলে পরকালে থেকে যেতে চাই না। ঐ দেবদূত বলবেন, থেকে যাওয়াটা খুব জরুরী নয়। আপনি কোন রূপে ফিরে যেতে চান? আমি বলবো, একজন কৃষ্ণাঙ্গ অ্যাথলেট হয়ে। তখন দেবদূত বলবেন, সবাই তাই হতে চায়; ঠিক আছে দেখা যাক আপনার জন্যে কী নির্ধারণ করা হয়েছে। তিনি বিশাল খাতা খুলবেন, দেখবেন এবং বলবেন আপনাকে একটি তেলাপোকা হিসেবে ফেরত পাঠানো হবে। তবে সুসংবাদ হলোÑ আপনার এলাকায় আপনিই হবেন সবচেয়ে দ্রুতগতির তেলাপোকা।
প্যারিস রিভিউ : মন্দ বলেননি।
মেইলার : পুনর্জন্ম হলো ঈশ্বরের প্রজ্ঞা ও ন্যায়বোধের উৎকৃষ্ট প্রমাণ। আমি আবারো বলছি, ঈশ্বর বিধানদাতা নন। তিনি স্রষ্টা এবং বিচারক।
প্যারিস রিভিউ : পুনর্জন্মে গ্যারি গিলমোরের বিশ্বাসই তাঁর প্রতি আপনার আকর্ষণের মূল কারণ?
মেইলার : হ্যাঁ। কিন্তু এ বিষয়ে আগের থেকেই আমার ধারণা ছিলো। ১৯৫৪ সালে আমি যখন নাস্তিক; নিজেকে নিয়ে গর্বিত; মনে করতাম ঈশ্বরকে পরিহার করা যায়, তখন জেমস্ জোনস্রে সাথে দেখা করতে ইলিনইস রাজ্যে গিয়েছিলাম। তিনি আমার সাথে পুনর্জন্ম নিয়ে কথা বলেছিলেন। তিনি ছিলেন আমার দেখা বাস্তববাদী ঔপন্যাসিকদের একজনÑ সাচ্চা মিডওয়েষ্টার্ন। বাস্তবতা নিয়ে তাঁর চিন্তা ছিল সুদৃঢ়। রূঢ় বাস্তবতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতেই তিনি আনন্দবোধ করতেন। তিনি ছিলেন বাস্তবতায় বিশ্বাসী এবং পরে বিশ্বাস করেছেন পুনর্জন্মে। আমি তাকে বলেছিলামÑ আমি নিশ্চিত আপনি পুনর্জন্মে বিশ্বাস করেন না। তিনি বলেছিলেনÑ বিশ্বাস করি। কারণ একমাত্র এটিই চেতনার জন্ম দেয়। এই মন্তব্য নিয়ে আমি দশ বছর ভেবেছি এবং তারপর মেনে নিয়েছি।
প্যারিস রিভিউ : সহিংস কোন স্বপ্ন দেখেন?
মেইলার : না। আমি এ ধরণের স্বপ্ন সাহিত্যে প্রয়োগ করি।
প্যারিস রিভিউ : মানুষের সহিংসতা আপনাকে উদ্বিগ্ন করে এবং সহিংসতা আপনার খ্যাতির সাথেও সম্পর্কীত।
মেইলার : খ্যাতি বিপদজনক।
প্যারিস রিভিউ : আপনার সাহিত্যকর্মে সব সময় সহিংসতা থাকে।
মেইলার : সহিংসতার প্রতি আগ্রহ অবৈধ কিছু নয়। ঔপন্যাসিকদের জন্যে সহিংসতা একটি বিচরণ ক্ষেত্র। উনিশ শতকের বিখ্যাত ঔপন্যাসিকরা কাজ করেছেন প্রেম, বিরহ, হতাশা, সততা ও কিছুটা দুর্নীতি নিয়ে। তাঁরা কাজ করেছেন বিভিন্ন সামাজিক শক্তির সম্মিলিত বিমূর্ত শক্তি নিয়ে যা একজন ব্যক্তির ইচ্ছাকে পরাস্ত করতে পারে। কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে আসুন, দেখবেন হেমিংওয়ে সহিংসতার প্রতি প্রবলভাবে আকর্ষিত হয়েছেন। কারণ যুদ্ধে তাঁর দেহ ক্ষত-বিক্ষত হয়েছিলো। সহিংসতাই ছিলো তাঁর সাহিত্য কর্মের কেন্দ্রবিন্দু। হেমিংওয়ে সহিংসতাকে সাহিত্যে যেভাবে উপস্থাপন করেছেন তা আমাকেও অভিভূত করে কিন্তু আমি তাতে তৃপ্ত নই।
প্যারিস রিভিউ : মানুষ গণসহিংসতার হুমকির মধ্যেই বেঁচে আছেÑ এটা কি আপনারও ধারণা নয়?
মেইলার : কিন্তু ওটা একধরণের বিড়ম্বনা। ব্যক্তি সহিংসতা ছিলো অস্পৃশ্য বা নিষেধের বেড়াজালে আবৃত এবং তখনো গণসহিংসতার একটি স্পষ্ট ধারণা আমাদের মধ্যে ছিলো। ঐ সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকাতে এমন কিছু কর্মপটু লোক ছিল যারা কিভাবে এ দু’দেশকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করা যায় দিবা-নিশি সে স্বপ্নই দেখতো। অর্থাৎ তারা গবেষণা করতো সোভিয়েত ইউনিয়নকে পুরোপুরি ধ্বংস করতে গেলে নিজেরা কতটুকু ভোগান্তির শিকার হবে, তা নিয়ে। এ ধরণের হিসাব নিকাশ সব যুগেই করা হয়েছে।
প্যারিস রিভিউ : বর্তমান পর্যায়ে আপনার প্রজন্মের ঔপন্যাসিকরা এক ধরণের সূক্ষ্মবোধ অর্জনের চেষ্টা করেছেন যে, সহিংসতা কিভাবে আমাদের কল্পনা ও সমাজে একই সাথে বিকাশ লাভ করে। এ বিষয়ে যদি কিছু বলেন।
মেইলার : সহিংসতা নিয়ে কাজ করার সময় সাহিত্য জগত যে বিদ্বেষ পোষণ করছিলো সে সম্পর্কে আমি সচেতন ছিলাম। আসলে এ কাজ কবে নাগাদ শেষ হবে তার কোন নিশ্চয়তা ছিলো না। অনিশ্চয়তা তখনো ছিলো, এখনো আছে। একই সময়ে, ব্যক্তি সহিংসতাকে বিবেচনা করা হতো অপ্রীতিকর এবং আড়াল করবার মতো বিষয় হিসেবে। আমার দৃষ্টিতে সহিংস মুহুর্ত সর্বদাই অস্তিত্ববাদী মুহুর্ত। এই মুহুর্তগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো ব্যবহার করে কেউ চাইলে দারুণ কিছু করতে পারে।
প্যারিস রিভিও ঃ লী হার্ভে অসওয়াল্ড, (খবব ঐধৎাবু ঙংধিষফ) ব্যক্তি হিসেবে যার নাম চিরকালই ব্যক্তি সহিংসতার সাথে জড়িয়ে থাকবে- তাকে আপনি কিভাবে দেখেন?
মেইলার ঃ প্রথমেই আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে সে কেনেডিকে (ঔড়যহ ঋ. কবহহবফু) হত্যা করেছিল কিনা। যখন আমি ঙংধিষফ’ং ঞধষব লেখা শুরু করি তখন ঘটনাটি ষড়যন্ত্র বলেই বিশ্বাস করতাম। কিন্তু অসওয়াল্ড সম্পর্কে আমি যখন আরো বেশি জানতে শুরু করলাম, বুঝতে পারলাম সে ষড়যন্ত্র করার মত কোন ব্যক্তি ছিলনা। কারণ সে ছিল নিঃসঙ্গ এবং যথেষ্ট অহংকারী। সে একাই কাজ করেছিল। আমার ভুলও হতে পারে কিন্তু আমি এটাই বিশ্বাস করি। কারণ খুব সহজ- অসওয়াল্ড চেয়েছিল বিখ্যাত হতে। সে চেয়েছিল অমর হতে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেকিায় নিজ অভিজ্ঞতার কারনেই গনসহিংসতা থেকে সে প্রবেশ করেছিল ব্যক্তি সহিংসতায়।
প্যারিস রিভিউ : আপনার ঞযব ডযরঃব ঘবমৎড় প্রবন্ধ সম্পর্কে এখনো কি আগের অবস্থানেই আছেন?
মেইলার : হ্যাঁ। সংখ্যা যাইহোক কিছু মানুষ বিশেষ করে যুবকরা যৌন তৎপরতাকেই প্রেম মনে করে। এটাকে ভুল বলবারই বা কী আছে। যৌনতা আমাদের গভীর প্রকাশ। তবে অনেক কৃষ্ণাঙ্গ অভিযোগ করে বলেন, আমি নাকি শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে যৌন তৎপরতা বেশি অনুসন্ধান করেছি।
প্যারিস রিভিউ : কিভাবে একজন ঔপন্যাসিক বাস্তব ঘটনা বা উপাদানগুলোকে উপন্যাসে প্রতিস্থাপন করেন? বাস্তবকে শিল্পে রূপান্তর করলে কী ঘটে?
মেইলার : বাস্তব ও কল্পনার (ঋধপঃং ধহফ ঋরপভরড়হ) মধ্যে একটি মজার সম্পর্ক আছে। বিষয়টা ঠিক পুরোপুরি ব্যাখ্যা করতে পারবো না, তবে গ্রন্থ প্রাপ্ত তথ্যের যত কাছাকাছি থাকবে তার বর্ণনা ততোই কাল্পনিক হবে। যদি আপনার সংগ্রহে কিছু সত্য তথ্য থাকে তবে সমস্যা হলো ওগুলোর অধিকাংশই পরিশুদ্ধ নয়। ওগুলো বিকৃত, পরিবর্তিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মিথ্যা-সত্য। তাই যথেষ্ট আন্তরিকতা থাকা সত্বেও গল্পের সমাপ্তি ঘটে বাস্তবতার সাথে প্রতারণার মধ্য দিয়ে।
প্যারিস রিভিউ : চমৎকার। আরেকটু ভেঙ্গে বলুন।
মেইলার : ঠিক আছে। যে কোন ইতিহাস, যদি শুধুমাত্র নিখাদ সত্য দিয়ে রচিত হয় তবে তা ভুলে পরিপূর্ণ এবং বিভ্রান্তিকর হতে বাধ্য। একমাত্র মানব মনই পারে ঘটনার মধ্যে নিহিত সত্যকে আবিস্কার করতে। যা ঘটে গেছে সেটিই একমাত্র বাস্তবতা নয়, মানুষ তার সংকীর্ণ মনে যা লালন করে তাও বাস্তবতা। ঘটনার পেছনে এগুলোও সম্ভাব্য শক্তি হিসেবে কাজ করে। কোন বই পড়ে যদি বলেনÑ হ্যাঁ, ঘটনাটি এভাবেই ঘটতে পারতো, তবে আপনার মন সমৃদ্ধ। ঞযব ঊীবপঁঃরড়হবৎ’ং ঝড়হম নিয়ে আমার অনুভূতি ছিলোÑ এ বইয়ের জন্য আমার সংগৃহীত তথ্যগুলো বারবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা, কাটছাট এবং পরিশুদ্ধ করলে আমি যা পাব তা হবে সাহিত্য। সাহিত্য হবে, কারণ তার স্পন্দন থাকবে। নির্ভেজাল সত্য ও সাহিত্যের মধ্যে এটাই পার্থক্য। আপনার বলা সত্য কথাগুলো পাঠকের হৃদয়ে স্পন্দন সৃষ্টি করতে পারলে সেটাই হবে সাহিত্য। সাহিত্য কোন কিচ্ছা কাহিনী নয়, কিংবদন্তী কিংবা অসত্য ভাষণও নয়। সাহিত্য যেমন সত্য তেমনি কল্পনাও।
প্যারিস রিভিউ : আপনি যখন ঞযব অৎসরবং ড়ভ ঃযব ঘরমযঃ লিখেন তখন কি মনে হয়েছিল এটি একটি উপন্যাস?
মেইলার : ‘‘ইতিহাসকে সাহিত্য, সাহিত্যকে ইতিহাস’’ করার মত কাজ আমি খুব একটা করিনি। আমি মনে করি, ঞযব অৎসরবং ড়ভ ঃযব ঘরমযঃ যথার্থ অর্থে সৃজনশীল সাহিত্য নয়। এটি আত্মজীবনী মূলক রচনা সৃজনশীল সাহিত্যের সাথে যার খুব একটা মিল নেই।
প্যারিস রিভিউ : পুলিৎজার পুরস্কার জেতা আপনার দু’টো বই-ই বাস্তব ঘটনার ভিত্তিতে রচিত; আপনি কি এর জন্য বিব্রত বোধ করেন না?
মেইলার : অনেকে বিনীত ভাবে বলেন, মেইলার নিঃসন্দেহে একজন ভাল ননফিকশন লেখক তবে তিনি পুরোপুরি ঔপন্যাসিক নন। হ্যাঁ, এতে বিরক্ত হই। কারণ এ ধরণের কথা যিনি বলেন তিনি আমার পুরো সাহিত্য কর্মের সাথে পরিচত নন। এমন কাউকে আমি পাইনি, যে আমার ঐধৎষড়ঃ’ং এযড়ংঃ এবং অহপরবহঃ ঊাবহরহমং পড়ে এগুলোকে ননফিকশন বলেছেন। যারা আমাকে ননফিকশন লেখক বলেন তারা এই বই দু’টির সাথে পরিচিত নন। তারা শুধুমাত্র ঐ বইগুলোই পড়েছেন যেগুলো কিছুটা ননফিকশন। তারপরও আমি স্বীকার করি আমার জন্য এটি একটি সমস্যা। কিন্তু আমি খুশি, কারণ উপন্যাসের চেয়ে ননফিকশন লেখা সহজ, কাহিনীর পরিণতি নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করতে হয় না।
প্যারিস রিভিউ : ঠিক আছে। কিন্তু শুধু সহজ বলেই কি আপনি ননফিকশন লিখেছিলেন?
মেইলার : না- তা নয়। আমি ননফিকশন লিখার প্রস্তাব পেয়েছিলাম। উদাহরণ স্বরূপ, গধৎরষুহ এর কথা বলতে পারি। আমার এজেন্ট স্কট মেরিডিথ একবার প্রস্তাব দিলেনÑ মেরিলিন মনরোকে নিয়ে পচিশ হাজার শব্দের বই লিখে দিলে মোটা অংকের অর্থ পাওয়া যাবে। তিনি অংকটাও বলেছিলেন।
প্যারিস রিভিউ : কত?
মেইলার : পঞ্চাশ হাজার ডলার। ঐ সময় পঞ্চাশ হাজার ডলার মানে বিশাল কিছু। অবশ্য স্কট বলেছিলেন ননফিকশন লিখা ভালো, তবে বেশি লিখবেন না। যাই হোক, পচিশ হাজারের জায়গায আমি পচানব্বই হাজার শব্দ লিখেছিলাম। লক্ষনীয় বিষয় হলো: এরকম একটি চমৎকার বই লিখতে আমাকে কোন চিন্তা-ভাবনাই করতে হয়নি। সবকিছু আমার হাতের মুঠোয় ছিলো। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই বইটি লিখতে গিয়ে সত্য এবং মিথ্যা-সত্যের সাথে আমার ভালো পরিচয় ঘটেছে। আমি আসলে একদল মিথ্যাবাদীর সাথে কাজ করছিলাম। হলিউডের প্রায় প্রত্যেকে মেরিলিন সম্পর্কে মিথ্যা, বানোয়াট, বিভ্রান্তিকর ও অতিরঞ্জিত বক্তব্য দিয়েছে। তাই আমাকে ডিটেকটিভের মতো কাজ করতে হয়েছে। আমাকেই স্থির করতে হয়েছে কোনটি সত্য, কোনটি মিথ্যা।
প্যারিস রিভিও ঃ আপনার সাথে কথা বলবো অথচ রাজনীতি আসবে না- এটা অসম্ভব। আপনি এক সময় নিজেকে রক্ষণশীল বামপন্থী বলে দাবি করতেন।
মেইলার ঃ এখনো তাই করি। আমি রক্ষণশীল বামপন্থী।
প্যারিস রিভিও ঃ নব্য রক্ষণশীলতা নিয়ে কিছু বলুন। আমেরিকাতেও এই আদর্শের উপস্থিতি লক্ষনীয়। বিশেষ করে নরমান পডহোরেজের (ঘড়ৎসধহ চড়ফযড়ৎবঃু) সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল? আমার ধারণা তিনি অনেক দূরে এগিয়ে গিয়েছিলেন।
মেইলার ঃ তিনি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। গধশরহম ওঃ নামে তিনি যে বই লেখেছিলেন পাঠক তা প্রত্যাখান করেছিল। বামপন্থীদের মধ্যে তার কোন জনপ্রিয়তা ছিলনা। এর কারণ তখন পর্যন্ত আমার কাছে খুব একটা বোধগম্য ছিল না। আপনি বিশ্বাস করতে পারবেন না, কতটা নোংরা ভাবে তার বইটিকে প্রত্যাখান করা হয়েছিল। তখন পর্যন্ত পুরো বইটি আমার পড়া হয়ে উঠেনি, তবে প্রথম অর্ধেক বেশ ভালই ছিল। কিন্তু পুরো বইটা পড়ার পর শেষের অর্ধেক একেবারেই বাজে মনে হয়েছে। বইটির প্রথম অর্ধেকে তিনি বামপন্থী, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবিদের কিছু নোংরা মানসিকতা তুলে ধরেছেন। তিনি দেখাতে চেয়েছেন, বামপন্থীরা তাদের আদর্শকে খুব বড় করে তুলে ধরতে চান ঠিকই কিন্তু এ বিষয়ে অন্যদের সাথেতো দূরের কথা নিজেদের সাথেও কথা বলেন না। মানুষ যৌনতা নিয়ে কথা বলে কিন্তু নিজের উচ্চাকাঙ্খা নিয়ে কথা বলে না। অথচ পডহোরেজ তাই করেছিলেন। বাম আদর্শের কর্ণধাররা যে সকল ভাল মানুষদের সাথে নিয়ে তাদের আদর্শকে পূত-পবিত্র করার সংগ্রাম করেছেন তারা যে ততো ভাল ছিলেন না তিনি সেটাই তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি নিজেই তার বইয়ের সাথে প্রতারণা করেছেন কারণ তার সাহসের অভাব ছিল।
একারণেই বইটির উপর সমালোচনা লিখতে গিয়ে আমি তাকে নিষ্ঠুরভাবে ভর্ৎসনা করেছি। ফলে তিনি হতাশ হয়ে প্রায় এক বছর নিজেকে আড়াল করে রেখেছিলেন। ঐ এক বছর গান শুনে আর নিজের পত্রিকা সম্পাদনা করে সময় পার করেছেন, কারো সাথে খুব একটা দেখা করেননি। এর পরই তিনি ডানপন্থী হয়ে উঠেন তবে তার জন্য সেটা উপযুক্ত সময় ছিল না। তার এই সিদ্ধান্তের জন্যে আমিও কিছুটা দায়ী। ইরাক যুদ্ধে সমর্থন দিয়ে ও নব্য রক্ষণশীলতার সকল বোকামীর অংশীদার হয়ে তিনি এখন পাপের প্রায়শ্চিত্য করছেন।
প্যারিস রিভিও ঃ কর্ম ও সাহিত্য উভয় ক্ষেত্রেই আপনি প্রচন্ড রাজনৈতিক। সবক্ষেত্রেই প্রত্যাশিত রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলেন কি?
মেইলার ঃ যদি আপনার কোন রাজনৈতিক দর্শন থেকে থাকে তবে বিরুদ্ধ দর্শনের সমালোচনা আপনি করবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই সমালোচনা খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারে না। রাজনীতিতে যোগদিয়ে নিউ ইয়র্কের (ঘবি ণড়ৎশ) মেয়র পদে দু’বার প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেছিলাম। আমার বিশ্বাস ছিল আমি ভিন্ন কিছু করতে পারবো। কিন্তু আবিস্কার করলাম, নিয়ম-কানুন না জেনেই আমি ফুটবল খেলতে এসেছি।
প্যারিস রিভিও ঃ মেয়র পদের জন্য ১৯৬৯ সালের প্রতিদ্বন্দ্বীতাই আপনার রাজনৈতিক জীবনের শেষ অধ্যায়।
মেইলার ঃ দেরিতেও হলেও আমি বুঝতে পেরেছিলাম দীর্ঘ পরিশ্রম করার ক্ষমতা আমার ছিলনা। তিন-চার মাস প্রচারনা চালিয়ে আমি প্রায় বুড়ো হয়ে গিয়েছিলাম। প্রায় সব সময়ই ক্লান্ত থাকতাম। তাছাড়া মিডিয়ার সমর্থনও খুব একটা পাইনি। অবস্থা ছিল দেয়ালে মাথা ঠুকার মত।
প্যারিস রিভিও ঃ তাহলে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছিলেন ভেইসলাভ হেভেল (ঠধপষধা ঐধাবষ) কিভাবে একই সাথে লেখক ও প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন?
মেইলার ঃ তার সম্পর্কে আমার খুব একটা ধারণা নেই। হাভানাতে (ঐধাধহধ, কিউবার রাজধানী) তার সাথে একবার দেখা হয়েছিল কিন্তু ফিদেল কেস্ট্রোর সাথে দেখা করবো শুনে তিনি আর কোন কথা বলেননি।
প্যারিস রিভিও ঃ এক পর্যায়েতো তাকে বুঝতেই হয়েছিল, নাকি?
মেইলার ঃ বুঝেছিলাম কিন্তু তার পরও আমি তাকে সংকীর্ণ মনাই মনেকরি। তিনি কমিউনিষ্টদের ঘৃনা করতেন এবং সাড়া জীবন তাদের বিরুদ্ধেই লড়াই করেছেন। কিন্তু প্রত্যেকেরই পার্থক্য বুঝার সামর্থ্য থাকা উচিত। পৃথিবীতে যদি একজন মাত্র ভাল কমিউনিষ্ট থাকেন তবে তিনি ফিদেল কেষ্ট্রো।
প্যারিস রিভিও ঃ ফ্ল্যানরি ও’কনোর একবার প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘এ যুগে আমেরিকার কণ্ঠস্বর কে?’’ উত্তরে তিনি নিজেই বলেছিলেন- বিজ্ঞাপন সংস্থা। আপনার কি মনে হয় আবারো এমন একদিন আসবে যখন এ প্রশ্নের উত্তর হবে আমেরিকান ঔপন্যাসিকরা?
মেইলার ঃ না, এখনই তা মনে করি না। আমি হতাশ। আমি হয়তো আরো ইতিবাচক হতে পারতাম কিন্তু বাস্তবতা হলো ব্যবসায়ীরা পুরো দেশটাই দখল করে নিয়েছে। আমেকিার নীতি আমূল পাল্টে গেছে। এক সময় আমেরিকার গর্বের কারণ ছিল উৎকৃষ্ট পণ্য আর এখন তার গর্বের কারণ সে পণ্য বিপণন করার সামর্থ্য।
প্যারিস রিভিও ঃ এফ,স্কট ফিৎজেরাল্ড জানতেন আমেরিকা বিভ্রান্ত। কিন্তু এখন এটাই কি বড় সত্য নয় যে, আমেরিকা তার নিজের মিথ্যাকেই পুরোপুরি বিশ্বাস করে?
মেইলার ঃ আন্তর্জাতিক সম্পর্কে ক্ষেত্রে আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই মিথ্যাশ্রয়ী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী পাঁচ কিংবা দশ বছর রাশিয়া আমাদের জন্য আদর্শিক হুমকী ছিল। কারণ, বলতে দ্বিধা নেই- বেশ কিছু দরিদ্র রাষ্ট্রের উপর তার প্রভাব ছিল। কিন্তু এরপর থেকেই তার মন্দা শুরু। ফলে রাশিয়া আমাদের জন্য আর কখনো হুমকী হয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু বিগত চল্লিশ বছরেরও অধিক সময় ধরে আমরা আমেরিকানদের বুঝিয়ে আসছি যে, আমরা এক আদর্শিক সংগ্রামে লিপ্ত এবং এ সংগ্রামে জয়ের কোন বিকল্প নেই। আর এভাবেই আমেরিকানদের মনে ধীরে ধীরে বিভ্রান্তিক পুরু আস্তরণ পড়ে গেছে।
অধিকাংশ দেশই যিশুকে বিশ্বাস করে। তারা আরো বিশ্বাস করে ক্ষমাই শ্রেষ্ঠ আদর্শ। কিন্তু আমরা শুধুমাত্র রবিবারে এ কথা বিশ্বাস করি। আর সপ্তাহের অন্য ছয়দিন আমরা হয়ে যাই প্রচন্ড প্রতিযোগিতামূলক জাতি। ডলার উপার্জনের জন্যে নরকের আগুনের মত জ্বলে উঠি। সংস্কৃতি এমন এক শব্দ যার প্রতি আমেরিকানরা দ্রুত সারা দেয় না। কিন্তু একজন ইউরোপিয়ান বুঝে, সংস্কৃতি বলতে ঠিক কী বুঝায়। স্থাপত্য তো বটেই এমনকি রাস্তার মোড়েও তারা সংস্কৃতিকে লালন করে। অথচ আমরা এমন ভাবে রাস্তা তৈরিকরি যাতে খুব দ্রুত মার্কেটে যাওয়া যায়। তাই আমেরিকান জীবন ব্যবস্থায় একটি বড় অপরাধ আছে, সে অপরাধ হল- আমরা যথেষ্ট ভাল খ্রিষ্টান নই। মুর্খতা এবং দেশাত্ববোধ এখানে এক সাথে কাজ করে। রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে রিপাবলিকানদের প্রচারনার মুল তত্বই হলো আমেরিনাকদের এটা বুঝনো যে, আমরাই একমাত্র মহান জাতি, একমাত্র ভাল রাষ্ট্র- যারা অন্য রাষ্ট্রের মঙ্গল কামনা করে এবং আমরাই ঈশ্বরের আশির্বাদপুষ্ট তাই ঈশ্বর স্বয়ং আমাদের সাফল্য দেখতে চান। এ কারণেই আমার মধ্যে এক প্রকার লজ্জা ও অপরাধবোধ কাজ করে যখন দেখি যতটা ভান করি আমরা আসলে ততটা ভাল নয়।
প্যারিস রিভিও ঃ ‘‘বৈবাহিক সম্পর্ক একটি কার্যকর প্রতিষ্ঠান’’ এবং ‘‘বিশেষ করে ভয়ঙ্কর ব্যক্তিদের জন্যে’’- আপনার বইয়ের এই লাইন দু’টো আমাকে হাসিয়েছে।
মেইলার ঃ তাই নাকি? আসলে ওটা শয়তানের বক্তব্য ছিল, আমার নয়।
প্যারিস রিভিও ঃ বুঝলাম। কিন্তু বিয়ে করার কারনেই কি আপনি ভাল ঔপন্যাসিক হতে পরেছিলেন?
মেইলার ঃ প্রশ্নটা একটু ঘুরিয়ে দেই। বিয়ে করেছিল বলেই কি পিকাসো ভাল শিল্পী হতে পেরেছিল? আসলে এটা একটা তর্ক করার মত বিষয়।
প্যারিস রিভিও ঃ নিঃসন্দেহে বিয়ে তাঁকে বৈচিত্র এনেদিয়েছিল।
মেইলার ঃ প্রত্যেক স্ত্রী-ই একটি সংস্কৃতি আর অন্য সংস্কৃতিতে ডুব দিলে অভিজ্ঞতা ভয়ানকও হতে পারে। বাস্তবতা হলো বিয়ে সব সময় স্বস্তিদায়ক প্রতিষ্ঠান নয়, এটি আপনার বিরক্তির কারণও হতে পারে।… নারীর সাথে পিকাসোর প্রতিটি সম্পর্কই তাঁর শিল্পী সত্বাকে প্রভাবিত করেছে। বিয়ের কারণেই আমার লেখা কিছুটা প্রভাবিত হয়েছে। তাই বলে ভাববেন না পিকাসোর সাথে আমি নিজেকে তুলনা করছি। আমার চেয়ে বিশ্বসভ্যতায় পিকাসোর অবদান ঢের বেশি। প্রত্যেকের আনুগত্য ভিন্ন, পছন্দ ভিন্ন, উপলব্ধি ভিন্ন। শুভ ও অশুভ নিয়ে প্রত্যেকের ভাবনাও ভিন্ন।
প্যারিস রিভিও ঃ শুভ ও অশুভ?
মেইলার ঃ শুভ ও অশুভ সম্পর্কে আমাদের উপলব্ধির সূত্রপাত আমাদের পিতা-মাতা থেকে। কালক্রমে সেই উপলব্ধি পরিবর্তিত হয় অন্যের সাথে আমাদের সম্পর্কের মাধ্যমে।
প্যারিস রিভিও ঃ এবার বন্ধুত্বের প্রশ্নে আসি। আমেরিকান ঔপন্যাসিকরা প্রায়ই কিছুটা হলেও বন্ধুত্ব দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছেন। যেমন- ফিৎজেরাল্ড ও হেমিংওয়ে কিংবা শেরওড অ্যান্ডারসন ও থিয়েডর ড্রিজার।
মেইলার ঃ ফিজেরাল্ড ও হেমিংয়ের বন্ধুত্ব বেশির ভাগ সময়ই সংকট পূর্ণ ছিল।
প্যারিস রিভিও ঃ কিন্তু তারপরও বন্ধুত্ব তাদের জীবনের অনেক কিছুই নির্ধারণ করে দিয়েছিল।
মেইলার ঃ ঠিক আছে। আমি জেমস জোনস ও আমার কথা বলতে পারি।
প্যারিস রিভিও ঃ উইলিয়াম স্টাইরন?
মেইলার ঃ এক পর্যায়ে আমি ষ্টাইরনের উপর ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। তবে তিনি খুব মেধাবী ছিলেন। জোনস, ষ্টাইরন ও আমার সম্পর্ক ছিল তীব্র প্রতিযোগিতামূলক। আমাদের এই প্রতিদ্বন্দ্বী সম্পর্ক বুঝা খুব সহজ নয়। বলা যায়, অনেকটা খ্যাতিমান অ্যাথলেটদের মতÑ কেউ কারো চেয়ে কম নয়। কেন আমরা একে অনকে ঈর্ষা করি? আমরা সবাই মেধাবী- এটাই কি যথেষ্ঠ নয়? আমরা একে অন্যকে কেনই বা মেনে নিচ্ছিনা? এই প্রশ্নগুলো নিয়ে আমরা কখনো ভাবিনি। কারণ আমরা প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলাম। কিন্তু একই সাথে আমরা একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীলও ছিলাম। আমার মনে আছে, একবার জোনসের কাছে ঋৎড়স ঐবৎব ঃড় ঊঃবৎহরঃু’র একটি কপি চয়েছিলাম। তিনি বইটিতে লিখে দিয়েছিলেনÑ ‘‘আমার সবচেয়ে বিপদজনক বন্ধু; সবচেয়ে প্রিয় প্রতিদ্বন্দ্বী- নরমানের প্রতি’’। লেখকদের বন্ধুত্বের ধরণটাই এমন। গোর ভিডাল, (এড়ৎব ঠরফধষ) মানুষের দোষ-দ্রুতি ধরতে যার ভুল হয় না, একবার বলেছিলেন- ‘‘যখন আমার কোন বন্ধু সফল হয়, তখন আমার সত্বার খানিকটা মৃত্যু ঘটে’’। অবশ্য আমরা চাইলেই মানসিকতা পাল্টাতে পারি। অন্য কেউ সফল হলে নিজে সফল হবার প্রতিজ্ঞা করতে পারি।
প্যারিস রিভিউ : চিরস্থায়ী শত্র“কে? অহংকার?
মেইলার : অহংকার আপনাকে ধ্বংস করতে সক্ষম। ট্রুম্যানের দিকে তাকান। তার চিন্তাটা এমন ছিল যেÑ যদি আমি স্বীকৃতি না পাই তবে সমাজে ভয়াবহ কিছু একটা ঘটে যাবে। তাই খুব সতর্ক হয়ে অহংকারকে প্রশ্রয় দিতে হবে। অহংকার আমাদের সত্ত্বার শুভ অংশকে হত্যা করতে পারে। অহংকারকে পরিত্যাগ করা শিখতে হবে। অহংকারকে ইতিহাসে নিক্ষেপ করতে হবে।
ধ্রুপদী লেখক আবুল বাশারের সাক্ষাৎকার
শক্তিমান কথাশিল্পী আবুল বাশার। জন্ম ১৯৫১ সালে। ছ-বছর বয়সে সপরিবারে গ্রাম ত্যাগ করে মুর্শিদাবাদের লালবাগ মহকুমার টেকা গ্রামে বসবাস শুরু। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানিজ্যের স্নাতক। হিন্দি ভাষা সাহিত্যেও ডিপ্লোমা করেছেন। শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করলেও এক সময় চাকুরী ছেড়ে বামপন্থী রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ‘দেশ’ পত্রিকায় ছিলেন বেশ কিছুকাল। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ”জড় উপড়ানো ডালপালা ভাঙা আর এক ঋতু” প্রকাশিত হয় ১৯৭১ সালে। প্রথম মুদ্রিত গল্প- ‘মাটি ছেড়ে যায়’ । “ফুলবউ” উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন ১৩৯৪ সালের আনন্দ- পুরস্কার। ‘অগ্নিবলাকা’ উপন্যাসের জন্য ১৯৯৩-৯৪ সালে সাহিত্য-শিরোমনি পুরস্কার। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে স্পর্শের বাইরে সিমার, শেষ রুপকথা, ময়ূরী এবং ময়ূরী, রাজাবলি, মরুস্বর্গ, সুরের সাম্পান প্রভৃতি।.‘কবিতায় জীবনের অনুরাগ থাকে কিন্তু ব্যাপ্তি থাকে না’.
বিডি টুয়েন্টি ফোর লাইভের পক্ষ থেকে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ধ্রুপদী লেখক আবুল বাশারকে একটি সাক্ষাৎকারের অনুরোধ করলে তিনি ফোনে বলে দিলেন তার বাড়ির হদিশ। দিন তারিখ ঠিক করে অভিক দত্তের নেতৃত্বে আমাদের কলকাতা টীম চলে গেলো বারুইপুর। বেশ আন্তরিক ভঙ্গিতে ডেকে বসালেন যেন অনেকদিনের চেনা। বসিয়েই শোনালেন একটা উপন্যাস লিখছেন তার থেকে খানিকটা। অহংশূন্য মানুষ বলতে যা বোঝায় একেবারে তাই। তবুও ইন্টারভিউয়ের জন্য তৈরী করা প্রশ্নগুলি প্রথমে পড়ে শোনাতে একটু শংকাই কাজ করছিল ; তবে ধীরে ধীরে সেটা কেটে গিয়ে আড্ডার মেজাজটা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে গেল খুব সহজেই।
বিডি টুয়েন্টি ফোর : আপনার লেখালেখির উৎসাহদাতা কি আপনার পরিবার? না অন্য কেউ?
আবুল বাশারঃ পরিবারের উৎসাহ বলতে কী বলো তো, আমার ঠাকুরদা ছিলেন চাষী। আমি আদতে চাষী ঘরের ছেলে, ঠাকুরদা চাষ করতেন ধান ও পান। বাবা লেখাপড়ার জগতে চলে এসেছিলেন। রায়তের জীবন থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন বাবা। গান বাজনা করতেন। বিভিন্ন ধরণের চাকরি করেছেন। কোয়েটা করাচীতে ছিলেন। পাঞ্জাবে ছিলেন। সুতরাং বাবা যেহেতু নানা জায়গায় ঘোরা লোক, নানা কিছু দেখেছেন জীবনে, এবং গান বাজনা খুব পছন্দ করতেন একটা স্বাভাবিক কারণেই আমার মনে সাহিত্যপ্রীতি চলে এসেছিল ছোটবেলা থেকেই। মাত্র ষোল বছর বয়সে আমার কবিতা ছাপা হয়েছিল। উনিশ বছর বয়সে কবিতার বই বেরিয়েছিল।
বিডি টুয়েন্টি ফোর : সালটা বোধহয় ১৯৭১, বইয়ের নাম “জড় ওপড়ানো ডালপালা”।
রাজনীতি আর কবিতা। একসাথে…
আবুল বাশারঃ হ্যাঁ , আমার জীবনের দুটো পর্যায়। একটা হল সক্রিয় রাজনীতিতে এসে পড়া আবার আগের একটা জীবন যখন অরাজনৈতিক আমি। রাজনীতি করার আগেই আমি কবিতা লিখেছি। রাজনীতি আর কবিতা আমার জীবনে একসাথে ছিল, তবে সেই সময়টা খুব বেশি হবে না।
বিডি টুয়েন্টি ফোর : সেই সময়ের রাজনীতি আর এই সময়ের রাজনীতি। তফাৎ কোথায়?
আবুল বাশারঃ আমি বামপন্থী রাজনীতি করা লোক। সেই সময়ে বামপন্থী রাজনীতি করা মানে মৃত্যুর টিকিট কেটে রাজনীতি করা। নকশাল রাজনীতিই নয়, বামপন্থী রাজনীতিই ছিল তখন বিপজ্জনক। এখন লোকে রাজনীতি করে কিছু পাবার আশায়। সে সময়ের রাজনীতি চাওয়া পাওয়ার রাজনীতি ছিল না। সেটা ছিল আত্মত্যাগের রাজনীতি। আজকের প্রজন্ম সেটা ভাবতে কিংবা অনুভবও করতে পারবে না ঠিক কী ছিল সেটা। থিওরিটিক্যাল পলিটিক্স ছিল না সেটা আবার শৌখিন ছাত্র রাজনীতিও ছিল না। আমি ছাত্র রাজনীতিকে চিরকালই শৌখিন রাজনীতি মনে করি। যদিও তখন ছাত্র রাজনীতিও ভয়ংকর ছিল। তখন আমরা বামপন্থী রাজনীতি বলতে বুঝতাম রাজনীতি হয় চাষীর সাথে থেকে অথবা শ্রমিকের সাথে থেকে করতে হবে। বামপন্থী রাজনীতির মূল যেটা। শ্রমিক কৃষক খেটে পাওয়া লোকেদের সাথে থেকে লড়াই করাই আসল রাজনীতি।
বিডি টুয়েন্টি ফোর : তাহলে গদ্যে এলেন কিভাবে?
আবুল বাশারঃ এদেশে যখন জরুরি অবস্থা হল তখন অদ্ভুত সংকটে পড়লাম আমরা। মানুষের কোন স্বাধীনতা ছিল না। রাশিয়া ধীরে ধীরে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে, শোধনবাদের পথ ধরছে। চীন তখনও সঠিক, একথা মনে করা হচ্ছিল ; যদিও চীন সম্পর্কেও সংশয় দেখা দিয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও হাতে ছিল মন্ত্র মার্ক্সবাদ। এরই ভেতর দিয়ে মানুষকে যে জানার অভিজ্ঞতা হল সেটাই আমার জীবনের এক অন্যতম অভিজ্ঞতা। সেই সময়ে আমার রৌরবের বন্ধুরা বলল : বাশার’দা এই কথাগুলো কবিতায় হবে না। তা একজনের লেখা প্রবন্ধ পড়ছি তখন। একজন মার্ক্সবাদীরই লেখা পড়তে পড়তে এক জায়গায় ভদ্রলোক লিখেছেন যে কথাটা আমি আমার মত করে গ্রহণ করেছিলাম। আমার ভাষায় তা হল : কবিতায় জীবনের অনুরাগ থাকে কিন্তু ব্যাপ্তি থাকে না।
সেদিন একটা অনুষ্ঠানে গেছি। সেখানে আমার সম্পর্কে বলা হল “গ্রাম তার হাতের কররেখার মত”। কথাটা সত্যিই। গ্রামকে আমি নিজের হাতের তালুর মতোই দেখতে পাই। কিন্তু সেই দর্শনটা আমি কবিতায় আনতে পারছিলাম না। কবিতায় একটা অনুরাগ প্রকাশ পায়, জীবনের প্রতি নিবিড় ভালবাসা প্রকাশ পায় কিন্তু জীবনের সবটা পাচ্ছিল না। তারপর তো তোমায় বললামই রৌরবের বন্ধুরা বলল “বাশার’দা আপনি গদ্য লিখুন”। তো সেই থেকেই গদ্য মানে গল্প লেখা শুরু করলাম। প্রবন্ধ ভাবনাও ছিল। বিস্তর প্রবন্ধ লিখেছি। এই করতে করতে কবিতার প্রতি আমার একটা অবহেলাও চলে এল। কবিতা আমার দুয়োরানী হয়ে গেল। আমি কবিতাকে বলা যায় উপেক্ষাই করেছি। কিন্তু কাব্যকে উপেক্ষা করিনি। কবিত্ব আমার গদ্যে সঞ্চারিত হয়েছে।
বিডি টুয়েন্টি ফোর : “ফুলবউ” সম্পর্কে কিছু বলুন।
আবুল বাশারঃ ফুলবউ থেকেই সচেতন পাঠক আমাকে চিনেছে। অত্যন্ত বিতর্কিত উপন্যাস। ঐ উপন্যাসের জন্য আমার জীবন বিপন্নও হয়েছিল। ১৯৮৮ সালে লিখেছিলাম ফুলবউ।
বিডি টুয়েন্টি ফোর : এই উপন্যাসটি আপনাকে সাহিত্যের বৃহত্তর অঙ্গনে নিয়ে আসে। মুসলিম দাম্পত্য, যৌন সংস্কার, প্রেম অপ্রেম এই উপন্যাসে নতুনভাবে এসেছে। আবার মুসলিম সমাজে নারী স্বাধীনতার অভাব, বহু বিবাহ, তালাক এই বিষয়ের জটিলতর কথাগুলি ফুলবউ ছাড়াও আপনার অসংখ্য উপন্যাসে দেখি।
আবুল বাশারঃ তোমার এই কথাটা আমাকে সমরেশ বসুও বলেছিলেন, “বাশার একই কথা তো বারবার লিখছ”। আমার মনে হয় বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের একটা প্রধান সমস্যা ছিল বৈধব্য সমস্যা। রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’-তেও কেন্দ্রীয় সমস্যা ছিল বৈধব্য সমস্যা। শরৎ সাহিত্যে বৈধব্য সমস্যাই প্রাধান্য পেয়েছে। তাঁরা কি নিছক উপন্যাস লেখার জন্য এই বৈধব্য সমস্যার অবতারনা করেছিলেন। তোমার কী মনে হয়?
বিডি টুয়েন্টি ফোর : হ্যাঁ সেটা তো মস্ত বড় একটা সমস্যা ছিল বটেই।
আবুল বাশারঃ তাহলে? নিশ্চয়ই সমস্যা একটা ছিল নইলে একজন সাহিত্য সম্রাট, একজন কথাশিল্পী আর একজন বাংলা সাহিত্যের সর্বস্ব কেন অকারণ এই সমস্যার অবতারনা করবেন। কথাটা এখানেই। সাবজেক্ট ম্যাটারটা এক। আমাকে কেউ নারীপ্রধান বললে আমি আপত্তি করব না। ধর্ম সমস্যা ভারতের অন্যতম সমস্যা। এই সমস্যা চিরন্তন। নারী জীবনের স্বাধীনতা কিছু নেই। তারা এখনও ভুগছে। এই প্রেরণা থেকেই বিভিন্ন রূপে তাদের প্রকাশ করেছি। তালাক একটা বিরাট সমস্যা। তালাক মানে বিচ্ছেদ। একটি নারীর সাথে পুরুষের বিচ্ছেদ। এই বিচ্ছেদ আমাদের গ্রামবাংলাতেও যেমন একটি সমস্যা, পশ্চিমদেশেও এই সমস্যা আছে। আমি ফুলবউতে যেমন লিখেছি তেমনি অন্যান্য লেখাতেও দেখিয়েছি। নারী মানে কি? ফেলনা? একী? বোরখা নিয়েও সমস্যা। যেটা সত্য, সেটা মানুষকে বারবার বলতে হবে। নইলে মানুষ বুঝবে না। আমার কাছে অগ্রাধিকার পাঠকের। সেই পাঠক হিন্দু না মুসলিম আমার জানার দরকার নেই। পাঠককে ভাবিত করে না তুলতে পারলে একজন লেখক কখনই সমাজের কাছে দায়বদ্ধ থাকে না। আমি এই সমস্যাটা তাই বিস্তৃতভাবে দেখাতে চেয়েছি, আমৃত্যু দেখিয়ে যাব। এই সমস্যাগুলি মুসলিম সমাজের অগ্রগতির পথ অবরোধ করে রেখেছে। ঐ তিন দিকপাল বিধবা সমস্যার কথা বুঝতে পেরেছিলেন বলেই তাঁরা তাঁদের একের পর এক উপন্যাসে সে কথা উল্লেখ করে গেছেন। এই জন্যই তাঁরা মহান। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরে হলেও বলা হবে আবুল বাশার এই সমস্যার কথা বলে গিয়েছিলেন। সমাজ সংস্কারকের কাজই করে গেছেন। সমস্যাটা কিন্তু যাচ্ছে না। সমাজের বাকি অংশ এগিয়ে যাচ্ছে। বাঙালী হিন্দু সমাজ এগিয়ে যাচ্ছে। আর এরা মদের ঘোরে, ইন্টারনেটে ইমেল করে তালাক দিয়ে দিচ্ছে। এটা সমস্যা নয়? আর আবুল বাশার এটা নিয়ে না লিখে বসে থাকবে? এটা হয়?
বিডি টুয়েন্টি ফোর : বেশ কিছুকাল আপনার লেখায় যৌনতার বাড়াবাড়ি পাঠকদের অভিযোগ। সাহিত্যের আড়ালে যৌনতার মোড়ক সস্তায় বাজিমাতের লক্ষণ। তাতে প্রকৃত সাহিত্যের স্বাদ ও মান দুইই খর্ব হয়। তাই নয় কি?
আবুল বাশারঃ দেখো সময়ের সাথে যৌন মনস্তাত্ত্বিক ধারনা পাল্টাচ্ছে। যৌনতা কিন্তু ক্ষমতাকেন্দ্রিক। যেমন ক্ষমতার কেন্দ্র হিসেবে বলতে পারি মন্দির মসজিদ কিংবা চার্চের নাম। এগুলো কিন্তু এক একটা ক্ষমতার কেন্দ্র। ভগবানের নাম করে কুমারী মেয়েদের ভোগ করার জন্য দেবদাসী বানানো হত। যৌনতা কেন্দ্রিক ক্ষমতা কেন্দ্র সমাজের বিশেষ বিশেষ শ্রেণী ব্যবহার করত। রাষ্ট্র যৌন ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রন করে। রাষ্ট্র বলে দিল, আঠারো বছর ও একুশ বছরের আগে মেয়ে কিংবা ছেলের বিয়ে হবে না। যৌন ক্রিয়ায় কনডম ব্যবহার কর নইলে থাপ্পড় মারব। নারী পুরুষের একান্ত যৌন মিলন তাতে থাবা বসাচ্ছে রাষ্ট্র। দুয়ের বেশি সন্তান হলে রাষ্ট্র রক্তচক্ষু দেখাচ্ছে। আবার একটা মুসলিম চারটে বউ নিয়ে ঘর করছে। কে বাঁধা দেবে? সমাজ? রাষ্ট্র? কেউ বাঁধা দিতে পারবে না। একজন ভারতীয় বাড়িতে মোটামুটি হারেম খুলে চারটে বউ নিয়ে বাস করছে। সেই লাইসেন্সও সমাজই দিয়েছে। দুটি ধর্মের জন্য দু’রকম নীতি। এগুলি আমি বলব। একশবার বলব। ক্ষমতার চেহারাকে দেখাব। যৌন ক্ষমতা মানুষের যৌনতা নয়! যৌনতা রাষ্ট্রের। এখন সমকামীরা বলছে তাদের লাইসেন্স চাই। তারা সামাজিক স্বীকৃতি চাইছে। এই যৌনতার ধারনা দিন দিন পালটাবে। সমস্ত কিছু পালটাবে সময়ের সাথে। আবার যৌনতা দেখিয়ে বই বিক্রি হয় না। তাহলে পথের পাঁচালীর থেকে বিবর বিক্রি হত বেশি।
বিডি টুয়েন্টি ফোর : আপনার লেখা রাজনৈতিক উপন্যাস বাশার’দা?
আবুল বাশারঃ বাস্তব আর কল্পনার মিশেলে লেখা “অগ্নিবলাকা”। শুরুতেই বললাম রাজনীতির ভূমিকা আমার জীবনে প্রবল। বলতে পার রাজনীতির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কিংবা আমার জীবনের অভিজ্ঞতাই ‘অগ্নিবলাকা’য় প্রকাশ পেয়েছে।
বিডি টুয়েন্টি ফোর : গদ্যে কাব্যের প্রভাব নিয়ে কিছু বলুন।
আবুল বাশারঃ এখন এ সংক্রান্ত একটা কথা আছে। কবিতাকে কিভাবে একজন গদ্যকার দেখেন। আমাদের সাহিত্যে অনেকেই গদ্য লিখেছেন। যেমন বিভূতিভূষণ। তিনি আসলে কবিই।মহাকবি। যেমন কমলকুমার। এঁদেরকে কিন্তু কেউ বাংলা সাহিত্যে স্বীকৃতি দেননি কিন্তু এঁরা আসলে কবি। স্বীকৃত কবিরা গদ্য লিখেছেন এবং সেই গদ্য পাঠকের কাছে চির সমাদৃত হয়েছে সে ঘটনা কম। এক রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন। গল্পগুচ্ছ তো এক কবিরই লেখা। অদ্বৈত মল্লবর্মণ বা জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী যাদের কবিতা সমীহ জাগিয়ে তোলে। আরেকজন সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ্। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবার কবিত্বের মধ্যে চিত্রকলাবৃত্তি ছিল। বঙ্কিমচন্দ্র হচ্ছেন সেই ধরণের মানুষ যিনি চিত্রকলাবৃত্তি আর কবিত্বকে খুব উৎকৃষ্ট একটা কাঠামোয় ধরতে পেরেছিলেন, এবং এক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্র বারবার একটা বিষয়ে সাবধান করেছিলেন সেটা হল, উনি নবীন লেখকদের বলেছিলেন অজানা কবিত্ব চেষ্টা করিও না। কবিতা ভেতরে থাকলে আপনা হতেই আসবে। চেষ্টিত কবিত্ব লেখাকে নষ্ট করে দেবে। অনেকেই আজকাল লেখায় চেষ্টিত কবিত্ব এনে লেখার মান নামিয়ে ফেলেন। কবিত্ব এমন একটা বস্তু যা গদ্যকে লাবণ্য এনে দিতে পারে আবার মগজে চর্বিও এনে দিতে পারে। আমার ক্ষেত্রে বলতে পারি আমার গদ্যে যখন কবিতা এসেছে আমি দমাইনি তবে যেখানে দরকার নেই সে জায়গা থেকে অতি সন্তর্পণে আমি কবিত্ব ছেঁটে বাদ দিয়ে দিয়েছি। গদ্য যেখানে এলায়িত হয়েছে, যেখানে গদ্যের ক্ষতি হয়েছে, সেখানে কবিতাকে আমি বাদ দিয়েছি।
বিডি টুয়েন্টি ফোর : আপনার জীবনের পরম প্রাপ্তি কী মনে করেন?
আবুল বাশারঃ এরকম পাঠক আছেন যারা আমারই লেখা পড়েন, যারা আবুল বাশার পেলে আর কিছু চান না, আমার লেখাই ধ্রুবতারার মত পড়েন সেই পাঠকেরাই আমার লেখক জীবনের পরম প্রাপ্তি।
সাক্ষাৎকার গ্রহন ও অনুলিখন : অভিক দত্ত
বিডি টুয়েন্টি ফোর লাইভের পক্ষ থেকে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ধ্রুপদী লেখক আবুল বাশারকে একটি সাক্ষাৎকারের অনুরোধ করলে তিনি ফোনে বলে দিলেন তার বাড়ির হদিশ। দিন তারিখ ঠিক করে অভিক দত্তের নেতৃত্বে আমাদের কলকাতা টীম চলে গেলো বারুইপুর। বেশ আন্তরিক ভঙ্গিতে ডেকে বসালেন যেন অনেকদিনের চেনা। বসিয়েই শোনালেন একটা উপন্যাস লিখছেন তার থেকে খানিকটা। অহংশূন্য মানুষ বলতে যা বোঝায় একেবারে তাই। তবুও ইন্টারভিউয়ের জন্য তৈরী করা প্রশ্নগুলি প্রথমে পড়ে শোনাতে একটু শংকাই কাজ করছিল ; তবে ধীরে ধীরে সেটা কেটে গিয়ে আড্ডার মেজাজটা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে গেল খুব সহজেই।
বিডি টুয়েন্টি ফোর : আপনার লেখালেখির উৎসাহদাতা কি আপনার পরিবার? না অন্য কেউ?
আবুল বাশারঃ পরিবারের উৎসাহ বলতে কী বলো তো, আমার ঠাকুরদা ছিলেন চাষী। আমি আদতে চাষী ঘরের ছেলে, ঠাকুরদা চাষ করতেন ধান ও পান। বাবা লেখাপড়ার জগতে চলে এসেছিলেন। রায়তের জীবন থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন বাবা। গান বাজনা করতেন। বিভিন্ন ধরণের চাকরি করেছেন। কোয়েটা করাচীতে ছিলেন। পাঞ্জাবে ছিলেন। সুতরাং বাবা যেহেতু নানা জায়গায় ঘোরা লোক, নানা কিছু দেখেছেন জীবনে, এবং গান বাজনা খুব পছন্দ করতেন একটা স্বাভাবিক কারণেই আমার মনে সাহিত্যপ্রীতি চলে এসেছিল ছোটবেলা থেকেই। মাত্র ষোল বছর বয়সে আমার কবিতা ছাপা হয়েছিল। উনিশ বছর বয়সে কবিতার বই বেরিয়েছিল।
বিডি টুয়েন্টি ফোর : সালটা বোধহয় ১৯৭১, বইয়ের নাম “জড় ওপড়ানো ডালপালা”।
রাজনীতি আর কবিতা। একসাথে…
আবুল বাশারঃ হ্যাঁ , আমার জীবনের দুটো পর্যায়। একটা হল সক্রিয় রাজনীতিতে এসে পড়া আবার আগের একটা জীবন যখন অরাজনৈতিক আমি। রাজনীতি করার আগেই আমি কবিতা লিখেছি। রাজনীতি আর কবিতা আমার জীবনে একসাথে ছিল, তবে সেই সময়টা খুব বেশি হবে না।
বিডি টুয়েন্টি ফোর : সেই সময়ের রাজনীতি আর এই সময়ের রাজনীতি। তফাৎ কোথায়?
আবুল বাশারঃ আমি বামপন্থী রাজনীতি করা লোক। সেই সময়ে বামপন্থী রাজনীতি করা মানে মৃত্যুর টিকিট কেটে রাজনীতি করা। নকশাল রাজনীতিই নয়, বামপন্থী রাজনীতিই ছিল তখন বিপজ্জনক। এখন লোকে রাজনীতি করে কিছু পাবার আশায়। সে সময়ের রাজনীতি চাওয়া পাওয়ার রাজনীতি ছিল না। সেটা ছিল আত্মত্যাগের রাজনীতি। আজকের প্রজন্ম সেটা ভাবতে কিংবা অনুভবও করতে পারবে না ঠিক কী ছিল সেটা। থিওরিটিক্যাল পলিটিক্স ছিল না সেটা আবার শৌখিন ছাত্র রাজনীতিও ছিল না। আমি ছাত্র রাজনীতিকে চিরকালই শৌখিন রাজনীতি মনে করি। যদিও তখন ছাত্র রাজনীতিও ভয়ংকর ছিল। তখন আমরা বামপন্থী রাজনীতি বলতে বুঝতাম রাজনীতি হয় চাষীর সাথে থেকে অথবা শ্রমিকের সাথে থেকে করতে হবে। বামপন্থী রাজনীতির মূল যেটা। শ্রমিক কৃষক খেটে পাওয়া লোকেদের সাথে থেকে লড়াই করাই আসল রাজনীতি।
বিডি টুয়েন্টি ফোর : তাহলে গদ্যে এলেন কিভাবে?
আবুল বাশারঃ এদেশে যখন জরুরি অবস্থা হল তখন অদ্ভুত সংকটে পড়লাম আমরা। মানুষের কোন স্বাধীনতা ছিল না। রাশিয়া ধীরে ধীরে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে, শোধনবাদের পথ ধরছে। চীন তখনও সঠিক, একথা মনে করা হচ্ছিল ; যদিও চীন সম্পর্কেও সংশয় দেখা দিয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও হাতে ছিল মন্ত্র মার্ক্সবাদ। এরই ভেতর দিয়ে মানুষকে যে জানার অভিজ্ঞতা হল সেটাই আমার জীবনের এক অন্যতম অভিজ্ঞতা। সেই সময়ে আমার রৌরবের বন্ধুরা বলল : বাশার’দা এই কথাগুলো কবিতায় হবে না। তা একজনের লেখা প্রবন্ধ পড়ছি তখন। একজন মার্ক্সবাদীরই লেখা পড়তে পড়তে এক জায়গায় ভদ্রলোক লিখেছেন যে কথাটা আমি আমার মত করে গ্রহণ করেছিলাম। আমার ভাষায় তা হল : কবিতায় জীবনের অনুরাগ থাকে কিন্তু ব্যাপ্তি থাকে না।
সেদিন একটা অনুষ্ঠানে গেছি। সেখানে আমার সম্পর্কে বলা হল “গ্রাম তার হাতের কররেখার মত”। কথাটা সত্যিই। গ্রামকে আমি নিজের হাতের তালুর মতোই দেখতে পাই। কিন্তু সেই দর্শনটা আমি কবিতায় আনতে পারছিলাম না। কবিতায় একটা অনুরাগ প্রকাশ পায়, জীবনের প্রতি নিবিড় ভালবাসা প্রকাশ পায় কিন্তু জীবনের সবটা পাচ্ছিল না। তারপর তো তোমায় বললামই রৌরবের বন্ধুরা বলল “বাশার’দা আপনি গদ্য লিখুন”। তো সেই থেকেই গদ্য মানে গল্প লেখা শুরু করলাম। প্রবন্ধ ভাবনাও ছিল। বিস্তর প্রবন্ধ লিখেছি। এই করতে করতে কবিতার প্রতি আমার একটা অবহেলাও চলে এল। কবিতা আমার দুয়োরানী হয়ে গেল। আমি কবিতাকে বলা যায় উপেক্ষাই করেছি। কিন্তু কাব্যকে উপেক্ষা করিনি। কবিত্ব আমার গদ্যে সঞ্চারিত হয়েছে।
বিডি টুয়েন্টি ফোর : “ফুলবউ” সম্পর্কে কিছু বলুন।
আবুল বাশারঃ ফুলবউ থেকেই সচেতন পাঠক আমাকে চিনেছে। অত্যন্ত বিতর্কিত উপন্যাস। ঐ উপন্যাসের জন্য আমার জীবন বিপন্নও হয়েছিল। ১৯৮৮ সালে লিখেছিলাম ফুলবউ।
বিডি টুয়েন্টি ফোর : এই উপন্যাসটি আপনাকে সাহিত্যের বৃহত্তর অঙ্গনে নিয়ে আসে। মুসলিম দাম্পত্য, যৌন সংস্কার, প্রেম অপ্রেম এই উপন্যাসে নতুনভাবে এসেছে। আবার মুসলিম সমাজে নারী স্বাধীনতার অভাব, বহু বিবাহ, তালাক এই বিষয়ের জটিলতর কথাগুলি ফুলবউ ছাড়াও আপনার অসংখ্য উপন্যাসে দেখি।
আবুল বাশারঃ তোমার এই কথাটা আমাকে সমরেশ বসুও বলেছিলেন, “বাশার একই কথা তো বারবার লিখছ”। আমার মনে হয় বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের একটা প্রধান সমস্যা ছিল বৈধব্য সমস্যা। রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’-তেও কেন্দ্রীয় সমস্যা ছিল বৈধব্য সমস্যা। শরৎ সাহিত্যে বৈধব্য সমস্যাই প্রাধান্য পেয়েছে। তাঁরা কি নিছক উপন্যাস লেখার জন্য এই বৈধব্য সমস্যার অবতারনা করেছিলেন। তোমার কী মনে হয়?
বিডি টুয়েন্টি ফোর : হ্যাঁ সেটা তো মস্ত বড় একটা সমস্যা ছিল বটেই।
আবুল বাশারঃ তাহলে? নিশ্চয়ই সমস্যা একটা ছিল নইলে একজন সাহিত্য সম্রাট, একজন কথাশিল্পী আর একজন বাংলা সাহিত্যের সর্বস্ব কেন অকারণ এই সমস্যার অবতারনা করবেন। কথাটা এখানেই। সাবজেক্ট ম্যাটারটা এক। আমাকে কেউ নারীপ্রধান বললে আমি আপত্তি করব না। ধর্ম সমস্যা ভারতের অন্যতম সমস্যা। এই সমস্যা চিরন্তন। নারী জীবনের স্বাধীনতা কিছু নেই। তারা এখনও ভুগছে। এই প্রেরণা থেকেই বিভিন্ন রূপে তাদের প্রকাশ করেছি। তালাক একটা বিরাট সমস্যা। তালাক মানে বিচ্ছেদ। একটি নারীর সাথে পুরুষের বিচ্ছেদ। এই বিচ্ছেদ আমাদের গ্রামবাংলাতেও যেমন একটি সমস্যা, পশ্চিমদেশেও এই সমস্যা আছে। আমি ফুলবউতে যেমন লিখেছি তেমনি অন্যান্য লেখাতেও দেখিয়েছি। নারী মানে কি? ফেলনা? একী? বোরখা নিয়েও সমস্যা। যেটা সত্য, সেটা মানুষকে বারবার বলতে হবে। নইলে মানুষ বুঝবে না। আমার কাছে অগ্রাধিকার পাঠকের। সেই পাঠক হিন্দু না মুসলিম আমার জানার দরকার নেই। পাঠককে ভাবিত করে না তুলতে পারলে একজন লেখক কখনই সমাজের কাছে দায়বদ্ধ থাকে না। আমি এই সমস্যাটা তাই বিস্তৃতভাবে দেখাতে চেয়েছি, আমৃত্যু দেখিয়ে যাব। এই সমস্যাগুলি মুসলিম সমাজের অগ্রগতির পথ অবরোধ করে রেখেছে। ঐ তিন দিকপাল বিধবা সমস্যার কথা বুঝতে পেরেছিলেন বলেই তাঁরা তাঁদের একের পর এক উপন্যাসে সে কথা উল্লেখ করে গেছেন। এই জন্যই তাঁরা মহান। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরে হলেও বলা হবে আবুল বাশার এই সমস্যার কথা বলে গিয়েছিলেন। সমাজ সংস্কারকের কাজই করে গেছেন। সমস্যাটা কিন্তু যাচ্ছে না। সমাজের বাকি অংশ এগিয়ে যাচ্ছে। বাঙালী হিন্দু সমাজ এগিয়ে যাচ্ছে। আর এরা মদের ঘোরে, ইন্টারনেটে ইমেল করে তালাক দিয়ে দিচ্ছে। এটা সমস্যা নয়? আর আবুল বাশার এটা নিয়ে না লিখে বসে থাকবে? এটা হয়?
বিডি টুয়েন্টি ফোর : বেশ কিছুকাল আপনার লেখায় যৌনতার বাড়াবাড়ি পাঠকদের অভিযোগ। সাহিত্যের আড়ালে যৌনতার মোড়ক সস্তায় বাজিমাতের লক্ষণ। তাতে প্রকৃত সাহিত্যের স্বাদ ও মান দুইই খর্ব হয়। তাই নয় কি?
আবুল বাশারঃ দেখো সময়ের সাথে যৌন মনস্তাত্ত্বিক ধারনা পাল্টাচ্ছে। যৌনতা কিন্তু ক্ষমতাকেন্দ্রিক। যেমন ক্ষমতার কেন্দ্র হিসেবে বলতে পারি মন্দির মসজিদ কিংবা চার্চের নাম। এগুলো কিন্তু এক একটা ক্ষমতার কেন্দ্র। ভগবানের নাম করে কুমারী মেয়েদের ভোগ করার জন্য দেবদাসী বানানো হত। যৌনতা কেন্দ্রিক ক্ষমতা কেন্দ্র সমাজের বিশেষ বিশেষ শ্রেণী ব্যবহার করত। রাষ্ট্র যৌন ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রন করে। রাষ্ট্র বলে দিল, আঠারো বছর ও একুশ বছরের আগে মেয়ে কিংবা ছেলের বিয়ে হবে না। যৌন ক্রিয়ায় কনডম ব্যবহার কর নইলে থাপ্পড় মারব। নারী পুরুষের একান্ত যৌন মিলন তাতে থাবা বসাচ্ছে রাষ্ট্র। দুয়ের বেশি সন্তান হলে রাষ্ট্র রক্তচক্ষু দেখাচ্ছে। আবার একটা মুসলিম চারটে বউ নিয়ে ঘর করছে। কে বাঁধা দেবে? সমাজ? রাষ্ট্র? কেউ বাঁধা দিতে পারবে না। একজন ভারতীয় বাড়িতে মোটামুটি হারেম খুলে চারটে বউ নিয়ে বাস করছে। সেই লাইসেন্সও সমাজই দিয়েছে। দুটি ধর্মের জন্য দু’রকম নীতি। এগুলি আমি বলব। একশবার বলব। ক্ষমতার চেহারাকে দেখাব। যৌন ক্ষমতা মানুষের যৌনতা নয়! যৌনতা রাষ্ট্রের। এখন সমকামীরা বলছে তাদের লাইসেন্স চাই। তারা সামাজিক স্বীকৃতি চাইছে। এই যৌনতার ধারনা দিন দিন পালটাবে। সমস্ত কিছু পালটাবে সময়ের সাথে। আবার যৌনতা দেখিয়ে বই বিক্রি হয় না। তাহলে পথের পাঁচালীর থেকে বিবর বিক্রি হত বেশি।
বিডি টুয়েন্টি ফোর : আপনার লেখা রাজনৈতিক উপন্যাস বাশার’দা?
আবুল বাশারঃ বাস্তব আর কল্পনার মিশেলে লেখা “অগ্নিবলাকা”। শুরুতেই বললাম রাজনীতির ভূমিকা আমার জীবনে প্রবল। বলতে পার রাজনীতির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কিংবা আমার জীবনের অভিজ্ঞতাই ‘অগ্নিবলাকা’য় প্রকাশ পেয়েছে।
বিডি টুয়েন্টি ফোর : গদ্যে কাব্যের প্রভাব নিয়ে কিছু বলুন।
আবুল বাশারঃ এখন এ সংক্রান্ত একটা কথা আছে। কবিতাকে কিভাবে একজন গদ্যকার দেখেন। আমাদের সাহিত্যে অনেকেই গদ্য লিখেছেন। যেমন বিভূতিভূষণ। তিনি আসলে কবিই।মহাকবি। যেমন কমলকুমার। এঁদেরকে কিন্তু কেউ বাংলা সাহিত্যে স্বীকৃতি দেননি কিন্তু এঁরা আসলে কবি। স্বীকৃত কবিরা গদ্য লিখেছেন এবং সেই গদ্য পাঠকের কাছে চির সমাদৃত হয়েছে সে ঘটনা কম। এক রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন। গল্পগুচ্ছ তো এক কবিরই লেখা। অদ্বৈত মল্লবর্মণ বা জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী যাদের কবিতা সমীহ জাগিয়ে তোলে। আরেকজন সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ্। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবার কবিত্বের মধ্যে চিত্রকলাবৃত্তি ছিল। বঙ্কিমচন্দ্র হচ্ছেন সেই ধরণের মানুষ যিনি চিত্রকলাবৃত্তি আর কবিত্বকে খুব উৎকৃষ্ট একটা কাঠামোয় ধরতে পেরেছিলেন, এবং এক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্র বারবার একটা বিষয়ে সাবধান করেছিলেন সেটা হল, উনি নবীন লেখকদের বলেছিলেন অজানা কবিত্ব চেষ্টা করিও না। কবিতা ভেতরে থাকলে আপনা হতেই আসবে। চেষ্টিত কবিত্ব লেখাকে নষ্ট করে দেবে। অনেকেই আজকাল লেখায় চেষ্টিত কবিত্ব এনে লেখার মান নামিয়ে ফেলেন। কবিত্ব এমন একটা বস্তু যা গদ্যকে লাবণ্য এনে দিতে পারে আবার মগজে চর্বিও এনে দিতে পারে। আমার ক্ষেত্রে বলতে পারি আমার গদ্যে যখন কবিতা এসেছে আমি দমাইনি তবে যেখানে দরকার নেই সে জায়গা থেকে অতি সন্তর্পণে আমি কবিত্ব ছেঁটে বাদ দিয়ে দিয়েছি। গদ্য যেখানে এলায়িত হয়েছে, যেখানে গদ্যের ক্ষতি হয়েছে, সেখানে কবিতাকে আমি বাদ দিয়েছি।
বিডি টুয়েন্টি ফোর : আপনার জীবনের পরম প্রাপ্তি কী মনে করেন?
আবুল বাশারঃ এরকম পাঠক আছেন যারা আমারই লেখা পড়েন, যারা আবুল বাশার পেলে আর কিছু চান না, আমার লেখাই ধ্রুবতারার মত পড়েন সেই পাঠকেরাই আমার লেখক জীবনের পরম প্রাপ্তি।
সাক্ষাৎকার গ্রহন ও অনুলিখন : অভিক দত্ত
এফ এল মিনিজেরোডের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎকার
রবীন্দ্রজীবনী, রবীন্দ্রনাথবিষয়ক ইংরেজি বা বাংলা গবেষণাগ্রন্থে মিনিজেরোড-সম্পর্কিত কোনো তথ্য মেলে না। ইন্টারনেট ঘেঁটেও তাঁর কোনো উল্লেখ পাওয়া যায়নি। খুব সম্ভবত মার্কিন কোনো পত্রিকায় সাংবাদিকতা করতেন। রবীন্দ্রনাথের এই সাক্ষাৎকারটি তিনি নিয়েছিলেন ১৯১৬ সালে। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ‘ল্যাক অব আইডিয়ালস: ইস্টার্ন পোয়েট অন সিভিলাইজেশন’ শিরোনামে এটি মুদ্রিত হয়েছিল। ১৯২৬ সালের ২ ডিসেম্বর এটি পুনর্মুদ্রিত হয় নিউজিল্যান্ডের দ্য উইকলি প্রেস পত্রিকায়।
সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন মুহাম্মদ হাবিবুর রহমাননিউইয়র্ক টাইমস-এ এফ এল মিনিজেরোদ লিখেছেন, ১৯১৩ সালে সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরস্কারজয়ী এবং বাংলায়, শান্তিনিকেতনে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের স্থাপয়িতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রশ্নটি বারবার ধীরে ধীরে উত্থাপন করেন, ‘খ্রিষ্টীয় সভ্যতা সম্পর্কে এশিয়ার কী ধারণা?’
রবীন্দ্রনাথের চেয়ে আরও মর্যাদাবান ও আরও অভিজাত ব্যক্তির কল্পনা করা বেশ কঠিনই হবে। তাঁর দীর্ঘ তুষারশুভ্র চুল ও তুষারশুভ্র শ্মশ্রু, তাঁর সূক্ষ্ম ও কোমল হাত, তাঁর সুন্দর মুখমণ্ডল (এমন মানুষের মুখ, যিনি সারা জীবন কেবল সুন্দর চিন্তা করে এসেছেন) পরমভাবে মনে হয় এক শুভেচ্ছার বাণীবাহকের।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে প্রায় মরমি বলে অভিহিত করা হয়। কিন্তু মানবিক দয়া পীযূসধারায় এমনভাবে তা পূর্ণ যে তাঁকে চিরাচরিত ভাবধারায় মরমি বলা যায় না।
হঠাৎ সোজা হয়ে তিনি সামনে ঝুঁকলেন। তারপর ধীরে ধীরে ইংরেজি ভাষার ঢঙে যেখানে প্রতিটি শব্দ পরিষ্কার ও সংগীতময় শোনা যায়, তিনি তাঁর প্রশ্ন পুনর্বার উচ্চারণ করলেন, ‘খ্রিষ্টীয় সভ্যতা সম্পর্কে এশিয়ার কী ধারণা?’ আর উত্তরটা সামনে এগিয়ে আসে।
তিনি শুরু করেন, ‘সারা এশিয়ায় ইউরোপ তার মর্যাদা হারিয়েছে বড় করে এবং এশিয়াবাসী অনেক বেশি নিশ্চিত যে আদর্শগতভাবে ইউরোপের তাদের দেওয়ার কিছুই নেই। বিগত বছরগুলোতে এশিয়া ইউরোপের দিকে তাকাত সম্ভ্রম ভরে। আজ এশিয়া মনে করে, ইউরোপ সত্য কথা বলছে না।
চমকপ্রদ স্বপ্ন
ছেলেবেলায় আমি বড় আগ্রহের সঙ্গে সে দিনের দিকে তাকিয়ে থাকতাম, যখন আমি প্রথমবারের মতো সেখানে যাব। সেখানে আমি চমকপ্রদ জিনিসের স্বপ্ন দেখতাম, বস্তুগত জিনিস নয়, বরং সুন্দর চিন্তাধারা, সুন্দর বৈশিষ্ট্যাদি। বিবেকবান যাঁরা, শুধু ব্যক্তিকে নয় বরং সারা জাতিকে পথ দেখিয়েছে এমন সব বিবেকবান লোকের সঙ্গে দেখা হবে বলে সামনের দিকে তাকিয়েছিলাম। আমি অবশ্য বড় বেশি ঊনবিংশ শতাব্দীর আধ্যা্ত্মিকতার কথা ভেবেছিলাম, যখন কিটস, শেলি ও বায়রন এবং এমন অন্যান্য গোষ্ঠীর, যারা উচ্চতর জিনিসের দিকে তূর্যধ্বনির ডাক দিয়েছিলেন।
‘পরে আব্রাহাম লিংকন চরম শিখরে ওঠেন। অধিকারের লড়াইয়ের খোঁজে গ্যারিবল্ডির মতো মানুষ আমার মনে দাগ রেখে যান। এমন মানুষের লেখা ও ইতিহাস আমাকে দারুণভাবে প্রভাবান্বিত করে। আমার মনে এই বিশ্বাস জন্মায় যে ইউরোপে আমি মানুষ, জনগণ, জাতির মধ্যে সত্য বিবেকের সন্ধান পাব, আমি এমন এক মহাদেশ আবিষ্কার করব, যেখানে সব মানুষ উচ্চ আদর্শের জন্য সচেষ্ট রয়েছে। আমি মর্মান্তিকভাবে হতাশ হই।
‘তথাকথিত ভীষণ সুসভ্য দেশ ইউরোপ, আমেরিকা ও জাপানে ভ্রমণ করে আমি লক্ষ করলাম, এইসব দেশে বিরাজমান প্রভাবসমূহ তাদেরকে আধ্যাত্মিক বিষয়গুলো থেকে সোজা বস্তুগত জিনিসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই বস্তুগত জিনিসগুলোর সামান্যই মূল্য রয়েছে। আজকাল বড় জাতি এবং তাদের বড় মহান ব্যক্তিরা আয়তন দিয়ে সাফল্যের মূল্যায়ন করে। এর অর্থ, তাঁরা মহান নন।
বৈদ্যুতিক শক্তিকে বোঝা এবং তাকে কাজে লাগানো এমন কোনো বড় সাফল্য নয়। একজন কেবল দিনে এক হাজারটা গাড়ি তৈরি করে তাতে এমন বড় কিছু সাফল্য অর্জন করে না। এসব মাপজোখ ও রেখার কাজ, এসব পঙ্খানুপুঙ্খ কাজ মানুষ আরও সহজেই করতে পারে। কিন্তু মানব সত্তার জটিলতার পরিমাপ কে করতে পারে? বড় শৈল্যচিকিৎসকের পেশিজ্ঞান রয়েছে, মনুষ্যকুলের আত্মাকে জানার চেষ্টা আর কে করছে?
গুণের নামতা দশ অনুশাসনের (Ten commandments) চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে। আজকের বড় কথা হচ্ছে, সবকিছু আমরা বিরাট মাত্রায় পেতে চাই। মানুষের মনের কার্যকর চিন্তাধারা ও প্রভাবকে বাদ দিয়ে পশ্চিমা সভ্যতা সবকিছুকে বিপুল উৎপাদনের মাত্রায় স্থান দিয়েছে।
তবে তীব্র আকাংখা নিয়ে এশীয় জনগণ যা লক্ষ্য করছে তাহলো ইউরোপীয় জাতিগুলোর জন্ম দেওয়া সাম্রাজ্যবাদ ও জাতীয়তাবাদের আগ্রাসী মানসিকতা। এ তো সারা পৃথিবীর জন্য এক মহাবিপদ। ইউরোপের রাজনৈতিক নীতিহীনতা এতই প্রবল যে অবশ্যম্ভাবীভাবে এশিয়ার ওপর তার প্রতিক্রিয়া হয়, যেখানকার জনগণ পশ্চিমা শোষণের শিকার হয়ে দাঁড়ায়।
রবীন্দ্রনাথ জাপানের কথা উল্লেখ করলে মিনিজেরোড জিজ্ঞেস করেন, তাঁর মতে, কীভাবে জাপানের আত্মা পরিবর্তিত হয়েছে ইউরোপের ভাবধারার সঙ্গে দৃঢ় বর্ধিষ্ণু সংস্পর্শের সঙ্গে সঙ্গে।
‘এ তাকে সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তিত করেছে।’ তিনি বললেন, ‘বিরাটত্বের আদর্শ, বস্তুগত প্রাচুর্যের আগ্রাসন তাকে দৃঢ়ভাবে পাকড়াও করেছে। প্রাচীন সামুরাই আদর্শ এখন মৃত। জাপান রাজ্য বিস্তারের অভিযাত্রায় যোগ দিয়েছে।
সব বস্তুগত গৌরবের চেয়ে জাতির নৈতিক আত্মমর্যাদা অনেক বড়। সাম্রাজ্যবাদ আত্মমর্যাদাকে সংকীর্ণ করে এবং মানুষকে দাস বানায়। এ তাদের চিন্তা করতে এবং নিজেদের হয়ে কথা বলতে দেয় না। পশ্চিমা সভ্যতার জন্ম হয়েছে শাসন করার ক্ষমতা সারা জাতির মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার কারণে। সেখানে রয়েছে ব্যক্তিগত মর্যাদা, গুরুত্বের এক ব্যক্তিগত চেতনা।
স্বৈরাচার এমন ব্যক্তিত্বকে শেষ করে দেয়
স্বৈরশাসকদের সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয়, ড. রবীন্দ্রনাথ, সম্প্রতি মহা হৃদ্যতার সঙ্গে মুসোলিনি আপনাকে স্বাগতম জানান, যদিও ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতি আপনার ভালোবাসা নিশ্চয়ই ফ্যাসিস্টপন্থা অনুমোদন করে না? ‘আমার জনপ্রিয়তা হঠাৎ ইতালিতে হ্রাস পায়।’ তিনি উত্তর দেন, ‘যে সরকার সামান্য বা মোটেই ব্যক্তিস্বাধীনতা অনুমোদন করে না, সে সম্পর্কে আমার সত্যিকার মতামত জানানোর পর পর দেখলাম, যাঁরা আমাকে সম্মান জানানোর জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁরা আমাকে ছেড়ে গেছেন।’
‘ইতালিতে বিবেকহীন শক্তির পূজাই হচ্ছে জাতীয়তাবাদের বাহন এবং এই শক্তি আন্তর্জাতিক হিংসা-রেষারেষির আগুন প্রজ্বলিত রাখে। অবশেষে এ হয়তো সার্বিক বিপর্যয়ের মাধ্যম হয়ে দাঁড়াবে। আজকাল দ্রুতযান, রেলওয়ে ও বিমানের বদৌলতে পৃথিবী পরস্পরের কাছে চলে এসেছে। সীমান্তগুলো এমন সব কল্পিত রেখা, যা এক জাতিকে আরেক জাতি থেকে আলাদা করে না। যেকোনো ধ্বংসাত্মক প্রক্রিয়া একবার শুরু হলে সীমান্ত পেরিয়ে তা ছড়িয়ে পড়বে। পর্বত আর সমুদ্র আর তেমন বাধা নয়।
ইতালীয় অভিযাত্রার অনেক প্রতিধ্বনি রয়েছে। কেবল(Cable) বার্তা অনুযায়ী ইতালীয় প্রেস ড. রবীন্দ্রনাথের মোসাহেবি মন্তব্য প্রকাশ করে এই ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করে যে তিনি সম্পূর্ণভাবে ফ্যাসিবাদী নীতি-আদর্শের সঙ্গে একমত, কিন্তু কবি ইতালি ছেড়ে চলে আসার পর তা অস্বীকার করতে বাধ্য হন। তিনি একটি বিবৃতি দেন, যার কিছু অংশ:
‘ফ্যাসিবাদের পন্থা ও আদর্শ সম্পর্কে সমগ্র মানবসমাজ উদ্বিগ্ন এবং যে-আন্দোলন নির্মমভাবে বাকস্বাধীনতাকে রোধ করে, যে-আন্দোলন ব্যক্তি বিশ্বাসের বিরোধী নির্দেশগুলো মানতে বাধ্য করে এবং যা গোপন অপরাধ ও সহিংসতার রক্তাক্ত পথ অনুসরণ করে তাকে সমর্থন করা এক উদ্ভট কল্পনা।
‘বেশিরভাগ পশ্চিমা দেশগুলোর দ্বারা জাতীয়তাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসী ধ্যানধারণাকে ধর্মের মতো অনুসরণ করা যা গোটা বিশ্বের জন্য এক অব্যাহত হুমকি–তার বিরুদ্ধে আমি বারবার সোচ্চার হয়েছি। ইউরোপীয় রাজনীতি যে নৈতিক পশ্চাৎপদতার জন্ম দিয়েছে, তারও বিপর্যয়কর পরিণতি রয়েছে, বিশেষ করে, যারা পশ্চিমা শোষণ-প্রক্রিয়ার করুণার পাত্র প্রাচ্যের জনগণের জন্য।
‘এ প্রায় অপরাধের পর্যায়ে না পড়লেও আমার জন্য বড় নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক হবে সেই রাজনৈতিক আদর্শের প্রশংসা করা, যা প্রকাশ্যে নৃশংস সন্ত্রাসকে সভ্যতার চলমান শক্তি হিসেবে গণ্য করে। কেউ যদি এই বর্বরতাকে, যাকে বস্তুগত উন্নতির সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা মোটেই অসম্ভব নয়–কাম্য মনে করে তাহলে এর জন্য ভয়ঙ্কর মূল্য দিতে হবে।’
বহু বছর ধরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর শান্তির বাণী ও সার্বিক সৌভ্রাতৃত্বের কথা প্রচার করে আসছেন। একে অপরের প্রতি অবিরাম দ্বন্দ্বময় সমগ্রের ভগ্নাংশ নয়, বরং যথাযথ সমগ্রই হচ্ছে তাঁর আদর্শ। রবীন্দ্রনাথের দর্শন সংক্ষিপ্ত করে তাঁর এক শিষ্য এক সময় লেখেন–
‘বিশ্বকে এক পরিবার হিসেবে দেখতে হবে, যেখানে বিভিন্ন প্রতিবেশী তার সদস্য, প্রত্যেকে সবার মঙ্গলের জন্য তার নির্দিষ্ট অংশ দান করবে। সূর্যের নিচে তখন সব মানুষের জন্য স্থানসংকুলান হবে, এবং রবীন্দ্রনাথের নিজের ভাবনাটি এরকম:
‘যেমন নিজের পাপড়ি উন্মোচন করাই গোলাপের জন্য বিশেষ কাজ, তেমনি মানবতার গোলাপ তখনই উৎকৃষ্ট, যখন বিভিন্ন বর্ণ এবং জাতি তাদের নির্দিষ্ট উৎকৃষ্ট বৈশিষ্ট্য উন্মোচন করবে, তবে তা প্রেমবন্ধনে মানবকাণ্ডের সঙ্গে সংলগ্ন।’ তিনি আরও বলেন, এই পৃথবীতে একটা নৈতিক আইন রয়েছে, যা ব্যক্তি ও মানুষের সংগঠিত সত্তা–উভয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আপনি আপনার জাতির নাম করে এসব বিধান লঙ্ঘন করে ব্যক্তি হিসেবে তা উপভোগ করতে পারেন না। আমরা আমাদের সুবিধার জন্য সত্যকে ভুলে যেতে পারি, কিন্তু সত্য আমাদের ভুলে যাবে না। নৈতিক ভিত্তি ছাড়া সমৃদ্ধি নিজেকে বাঁচাতে পারে না। যদি মানুষ তার পূর্ণ ভাঁড়ার এবং তার মানবতার মধ্যকার ব্যাদানকৃত ফাঁক দেখতে না পায়, মানবজাতির ঐক্য অনুভব না করে, তাহলে সভ্যতা-নামক বর্বরতার ধরনটি থেকেই যাবে।
মিনিজেরোড বলেন, ‘আমার মনে আছে ড. রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, যদি যিশুখ্রিষ্ট নিউ ইয়র্কে আসতেন, অন্য কোনো কারণে না হলেও ডলার না থাকার কারণে তিনি ফিরে যেতে বাধ্য হতেন আর যিশুখ্রিষ্ট আমেরিকায় জন্মগ্রহণ করলে কু ক্লাক্স ক্লানরা তাঁকে ধ্বংস করে ফেলত।’
আপনি কী সত্যিই ভাবেন, আমরা অতটাই খারাপ? নিজের একটি প্রশ্ন দিয়ে তিনি সে প্রশ্নের মোকাবিলা করলেন।
‘নম্ররাই আশীর্বাদপুষ্ট’ কথাটা আজ রাজনৈতিক ঈশ্বরদ্রোহিতা সামিল নয় কি? মনে করুন, যিশু আমেরিকায় বললেন, ‘দরিদ্ররা আশীর্বাদপুষ্ট’। এটাকে তাহলে অর্থনৈতিক বিপথগামিতা বলে মনে করা হতো। আর তিনি যদি আপনার দেশে বলতেন উটের পক্ষে সুঁইয়ের ছিদ্র দিয়ে যাওয়ার মতোই বিত্তবানদের স্বর্গে যাওয়াটা সহজ–তাহলে কি তাঁকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হতো না? হয়তো তার কথাবার্তার জন্য আমেরিকা যিশুর ওপর শারীরিক দণ্ড আরোপ করা পর্যন্ত যেত না, কিন্তু আমার মনে হয়, আমেরিকায় নম্র বা দরিদ্র হওয়া—(মূল পাণ্ডুলিপিতে কিছু শব্দ স্পষ্ট ছিল না)।
‘আপনি কি আমেরিকাকে মহা ইউরোপীয় শক্তিগুলোর মতো সম্পূর্ণভাবে আধ্যাত্মিকতাশূন্য মনে করেন বা আপনি কী মনে করেন, অনাধ্যাত্মিকতার মশাল সেখানে এখনো প্রজ্বালমান?তিনি উত্তর দিলেন, ‘আমার বিশ্বাস আমেরিকা আদর্শের অনুসন্ধান করেছে, নিশ্চয় কিছু আমেরিকাবাসী অনুসন্ধান করছেন। আমার সেই ভবিষ্যদ্বাণী করার যোগ্যতা নেই। ভালো জিনিসের এই অনুসন্ধানকারীরা জেগে উঠবেন বিরুদ্ধবাদীদের ভারে আচ্ছন্ন হয়ে বা তাঁরা পৃথিবীর সর্বত্র তাঁদের বক্তব্য পৌঁছে দিতে পারবেন এবং সব মানুষের মঙ্গলের জন্য এক বড় শক্তি হবেন। সব মানুষ আশা করে, তাঁরা সাফল্য লাভ করুন।
সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন মুহাম্মদ হাবিবুর রহমাননিউইয়র্ক টাইমস-এ এফ এল মিনিজেরোদ লিখেছেন, ১৯১৩ সালে সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরস্কারজয়ী এবং বাংলায়, শান্তিনিকেতনে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের স্থাপয়িতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রশ্নটি বারবার ধীরে ধীরে উত্থাপন করেন, ‘খ্রিষ্টীয় সভ্যতা সম্পর্কে এশিয়ার কী ধারণা?’
রবীন্দ্রনাথের চেয়ে আরও মর্যাদাবান ও আরও অভিজাত ব্যক্তির কল্পনা করা বেশ কঠিনই হবে। তাঁর দীর্ঘ তুষারশুভ্র চুল ও তুষারশুভ্র শ্মশ্রু, তাঁর সূক্ষ্ম ও কোমল হাত, তাঁর সুন্দর মুখমণ্ডল (এমন মানুষের মুখ, যিনি সারা জীবন কেবল সুন্দর চিন্তা করে এসেছেন) পরমভাবে মনে হয় এক শুভেচ্ছার বাণীবাহকের।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে প্রায় মরমি বলে অভিহিত করা হয়। কিন্তু মানবিক দয়া পীযূসধারায় এমনভাবে তা পূর্ণ যে তাঁকে চিরাচরিত ভাবধারায় মরমি বলা যায় না।
হঠাৎ সোজা হয়ে তিনি সামনে ঝুঁকলেন। তারপর ধীরে ধীরে ইংরেজি ভাষার ঢঙে যেখানে প্রতিটি শব্দ পরিষ্কার ও সংগীতময় শোনা যায়, তিনি তাঁর প্রশ্ন পুনর্বার উচ্চারণ করলেন, ‘খ্রিষ্টীয় সভ্যতা সম্পর্কে এশিয়ার কী ধারণা?’ আর উত্তরটা সামনে এগিয়ে আসে।
তিনি শুরু করেন, ‘সারা এশিয়ায় ইউরোপ তার মর্যাদা হারিয়েছে বড় করে এবং এশিয়াবাসী অনেক বেশি নিশ্চিত যে আদর্শগতভাবে ইউরোপের তাদের দেওয়ার কিছুই নেই। বিগত বছরগুলোতে এশিয়া ইউরোপের দিকে তাকাত সম্ভ্রম ভরে। আজ এশিয়া মনে করে, ইউরোপ সত্য কথা বলছে না।
চমকপ্রদ স্বপ্ন
ছেলেবেলায় আমি বড় আগ্রহের সঙ্গে সে দিনের দিকে তাকিয়ে থাকতাম, যখন আমি প্রথমবারের মতো সেখানে যাব। সেখানে আমি চমকপ্রদ জিনিসের স্বপ্ন দেখতাম, বস্তুগত জিনিস নয়, বরং সুন্দর চিন্তাধারা, সুন্দর বৈশিষ্ট্যাদি। বিবেকবান যাঁরা, শুধু ব্যক্তিকে নয় বরং সারা জাতিকে পথ দেখিয়েছে এমন সব বিবেকবান লোকের সঙ্গে দেখা হবে বলে সামনের দিকে তাকিয়েছিলাম। আমি অবশ্য বড় বেশি ঊনবিংশ শতাব্দীর আধ্যা্ত্মিকতার কথা ভেবেছিলাম, যখন কিটস, শেলি ও বায়রন এবং এমন অন্যান্য গোষ্ঠীর, যারা উচ্চতর জিনিসের দিকে তূর্যধ্বনির ডাক দিয়েছিলেন।
‘পরে আব্রাহাম লিংকন চরম শিখরে ওঠেন। অধিকারের লড়াইয়ের খোঁজে গ্যারিবল্ডির মতো মানুষ আমার মনে দাগ রেখে যান। এমন মানুষের লেখা ও ইতিহাস আমাকে দারুণভাবে প্রভাবান্বিত করে। আমার মনে এই বিশ্বাস জন্মায় যে ইউরোপে আমি মানুষ, জনগণ, জাতির মধ্যে সত্য বিবেকের সন্ধান পাব, আমি এমন এক মহাদেশ আবিষ্কার করব, যেখানে সব মানুষ উচ্চ আদর্শের জন্য সচেষ্ট রয়েছে। আমি মর্মান্তিকভাবে হতাশ হই।
‘তথাকথিত ভীষণ সুসভ্য দেশ ইউরোপ, আমেরিকা ও জাপানে ভ্রমণ করে আমি লক্ষ করলাম, এইসব দেশে বিরাজমান প্রভাবসমূহ তাদেরকে আধ্যাত্মিক বিষয়গুলো থেকে সোজা বস্তুগত জিনিসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই বস্তুগত জিনিসগুলোর সামান্যই মূল্য রয়েছে। আজকাল বড় জাতি এবং তাদের বড় মহান ব্যক্তিরা আয়তন দিয়ে সাফল্যের মূল্যায়ন করে। এর অর্থ, তাঁরা মহান নন।
বৈদ্যুতিক শক্তিকে বোঝা এবং তাকে কাজে লাগানো এমন কোনো বড় সাফল্য নয়। একজন কেবল দিনে এক হাজারটা গাড়ি তৈরি করে তাতে এমন বড় কিছু সাফল্য অর্জন করে না। এসব মাপজোখ ও রেখার কাজ, এসব পঙ্খানুপুঙ্খ কাজ মানুষ আরও সহজেই করতে পারে। কিন্তু মানব সত্তার জটিলতার পরিমাপ কে করতে পারে? বড় শৈল্যচিকিৎসকের পেশিজ্ঞান রয়েছে, মনুষ্যকুলের আত্মাকে জানার চেষ্টা আর কে করছে?
গুণের নামতা দশ অনুশাসনের (Ten commandments) চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে। আজকের বড় কথা হচ্ছে, সবকিছু আমরা বিরাট মাত্রায় পেতে চাই। মানুষের মনের কার্যকর চিন্তাধারা ও প্রভাবকে বাদ দিয়ে পশ্চিমা সভ্যতা সবকিছুকে বিপুল উৎপাদনের মাত্রায় স্থান দিয়েছে।
তবে তীব্র আকাংখা নিয়ে এশীয় জনগণ যা লক্ষ্য করছে তাহলো ইউরোপীয় জাতিগুলোর জন্ম দেওয়া সাম্রাজ্যবাদ ও জাতীয়তাবাদের আগ্রাসী মানসিকতা। এ তো সারা পৃথিবীর জন্য এক মহাবিপদ। ইউরোপের রাজনৈতিক নীতিহীনতা এতই প্রবল যে অবশ্যম্ভাবীভাবে এশিয়ার ওপর তার প্রতিক্রিয়া হয়, যেখানকার জনগণ পশ্চিমা শোষণের শিকার হয়ে দাঁড়ায়।
রবীন্দ্রনাথ জাপানের কথা উল্লেখ করলে মিনিজেরোড জিজ্ঞেস করেন, তাঁর মতে, কীভাবে জাপানের আত্মা পরিবর্তিত হয়েছে ইউরোপের ভাবধারার সঙ্গে দৃঢ় বর্ধিষ্ণু সংস্পর্শের সঙ্গে সঙ্গে।
‘এ তাকে সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তিত করেছে।’ তিনি বললেন, ‘বিরাটত্বের আদর্শ, বস্তুগত প্রাচুর্যের আগ্রাসন তাকে দৃঢ়ভাবে পাকড়াও করেছে। প্রাচীন সামুরাই আদর্শ এখন মৃত। জাপান রাজ্য বিস্তারের অভিযাত্রায় যোগ দিয়েছে।
সব বস্তুগত গৌরবের চেয়ে জাতির নৈতিক আত্মমর্যাদা অনেক বড়। সাম্রাজ্যবাদ আত্মমর্যাদাকে সংকীর্ণ করে এবং মানুষকে দাস বানায়। এ তাদের চিন্তা করতে এবং নিজেদের হয়ে কথা বলতে দেয় না। পশ্চিমা সভ্যতার জন্ম হয়েছে শাসন করার ক্ষমতা সারা জাতির মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার কারণে। সেখানে রয়েছে ব্যক্তিগত মর্যাদা, গুরুত্বের এক ব্যক্তিগত চেতনা।
স্বৈরাচার এমন ব্যক্তিত্বকে শেষ করে দেয়
স্বৈরশাসকদের সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয়, ড. রবীন্দ্রনাথ, সম্প্রতি মহা হৃদ্যতার সঙ্গে মুসোলিনি আপনাকে স্বাগতম জানান, যদিও ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতি আপনার ভালোবাসা নিশ্চয়ই ফ্যাসিস্টপন্থা অনুমোদন করে না? ‘আমার জনপ্রিয়তা হঠাৎ ইতালিতে হ্রাস পায়।’ তিনি উত্তর দেন, ‘যে সরকার সামান্য বা মোটেই ব্যক্তিস্বাধীনতা অনুমোদন করে না, সে সম্পর্কে আমার সত্যিকার মতামত জানানোর পর পর দেখলাম, যাঁরা আমাকে সম্মান জানানোর জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁরা আমাকে ছেড়ে গেছেন।’
‘ইতালিতে বিবেকহীন শক্তির পূজাই হচ্ছে জাতীয়তাবাদের বাহন এবং এই শক্তি আন্তর্জাতিক হিংসা-রেষারেষির আগুন প্রজ্বলিত রাখে। অবশেষে এ হয়তো সার্বিক বিপর্যয়ের মাধ্যম হয়ে দাঁড়াবে। আজকাল দ্রুতযান, রেলওয়ে ও বিমানের বদৌলতে পৃথিবী পরস্পরের কাছে চলে এসেছে। সীমান্তগুলো এমন সব কল্পিত রেখা, যা এক জাতিকে আরেক জাতি থেকে আলাদা করে না। যেকোনো ধ্বংসাত্মক প্রক্রিয়া একবার শুরু হলে সীমান্ত পেরিয়ে তা ছড়িয়ে পড়বে। পর্বত আর সমুদ্র আর তেমন বাধা নয়।
ইতালীয় অভিযাত্রার অনেক প্রতিধ্বনি রয়েছে। কেবল(Cable) বার্তা অনুযায়ী ইতালীয় প্রেস ড. রবীন্দ্রনাথের মোসাহেবি মন্তব্য প্রকাশ করে এই ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করে যে তিনি সম্পূর্ণভাবে ফ্যাসিবাদী নীতি-আদর্শের সঙ্গে একমত, কিন্তু কবি ইতালি ছেড়ে চলে আসার পর তা অস্বীকার করতে বাধ্য হন। তিনি একটি বিবৃতি দেন, যার কিছু অংশ:
‘ফ্যাসিবাদের পন্থা ও আদর্শ সম্পর্কে সমগ্র মানবসমাজ উদ্বিগ্ন এবং যে-আন্দোলন নির্মমভাবে বাকস্বাধীনতাকে রোধ করে, যে-আন্দোলন ব্যক্তি বিশ্বাসের বিরোধী নির্দেশগুলো মানতে বাধ্য করে এবং যা গোপন অপরাধ ও সহিংসতার রক্তাক্ত পথ অনুসরণ করে তাকে সমর্থন করা এক উদ্ভট কল্পনা।
‘বেশিরভাগ পশ্চিমা দেশগুলোর দ্বারা জাতীয়তাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসী ধ্যানধারণাকে ধর্মের মতো অনুসরণ করা যা গোটা বিশ্বের জন্য এক অব্যাহত হুমকি–তার বিরুদ্ধে আমি বারবার সোচ্চার হয়েছি। ইউরোপীয় রাজনীতি যে নৈতিক পশ্চাৎপদতার জন্ম দিয়েছে, তারও বিপর্যয়কর পরিণতি রয়েছে, বিশেষ করে, যারা পশ্চিমা শোষণ-প্রক্রিয়ার করুণার পাত্র প্রাচ্যের জনগণের জন্য।
‘এ প্রায় অপরাধের পর্যায়ে না পড়লেও আমার জন্য বড় নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক হবে সেই রাজনৈতিক আদর্শের প্রশংসা করা, যা প্রকাশ্যে নৃশংস সন্ত্রাসকে সভ্যতার চলমান শক্তি হিসেবে গণ্য করে। কেউ যদি এই বর্বরতাকে, যাকে বস্তুগত উন্নতির সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা মোটেই অসম্ভব নয়–কাম্য মনে করে তাহলে এর জন্য ভয়ঙ্কর মূল্য দিতে হবে।’
বহু বছর ধরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর শান্তির বাণী ও সার্বিক সৌভ্রাতৃত্বের কথা প্রচার করে আসছেন। একে অপরের প্রতি অবিরাম দ্বন্দ্বময় সমগ্রের ভগ্নাংশ নয়, বরং যথাযথ সমগ্রই হচ্ছে তাঁর আদর্শ। রবীন্দ্রনাথের দর্শন সংক্ষিপ্ত করে তাঁর এক শিষ্য এক সময় লেখেন–
‘বিশ্বকে এক পরিবার হিসেবে দেখতে হবে, যেখানে বিভিন্ন প্রতিবেশী তার সদস্য, প্রত্যেকে সবার মঙ্গলের জন্য তার নির্দিষ্ট অংশ দান করবে। সূর্যের নিচে তখন সব মানুষের জন্য স্থানসংকুলান হবে, এবং রবীন্দ্রনাথের নিজের ভাবনাটি এরকম:
‘যেমন নিজের পাপড়ি উন্মোচন করাই গোলাপের জন্য বিশেষ কাজ, তেমনি মানবতার গোলাপ তখনই উৎকৃষ্ট, যখন বিভিন্ন বর্ণ এবং জাতি তাদের নির্দিষ্ট উৎকৃষ্ট বৈশিষ্ট্য উন্মোচন করবে, তবে তা প্রেমবন্ধনে মানবকাণ্ডের সঙ্গে সংলগ্ন।’ তিনি আরও বলেন, এই পৃথবীতে একটা নৈতিক আইন রয়েছে, যা ব্যক্তি ও মানুষের সংগঠিত সত্তা–উভয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আপনি আপনার জাতির নাম করে এসব বিধান লঙ্ঘন করে ব্যক্তি হিসেবে তা উপভোগ করতে পারেন না। আমরা আমাদের সুবিধার জন্য সত্যকে ভুলে যেতে পারি, কিন্তু সত্য আমাদের ভুলে যাবে না। নৈতিক ভিত্তি ছাড়া সমৃদ্ধি নিজেকে বাঁচাতে পারে না। যদি মানুষ তার পূর্ণ ভাঁড়ার এবং তার মানবতার মধ্যকার ব্যাদানকৃত ফাঁক দেখতে না পায়, মানবজাতির ঐক্য অনুভব না করে, তাহলে সভ্যতা-নামক বর্বরতার ধরনটি থেকেই যাবে।
মিনিজেরোড বলেন, ‘আমার মনে আছে ড. রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, যদি যিশুখ্রিষ্ট নিউ ইয়র্কে আসতেন, অন্য কোনো কারণে না হলেও ডলার না থাকার কারণে তিনি ফিরে যেতে বাধ্য হতেন আর যিশুখ্রিষ্ট আমেরিকায় জন্মগ্রহণ করলে কু ক্লাক্স ক্লানরা তাঁকে ধ্বংস করে ফেলত।’
আপনি কী সত্যিই ভাবেন, আমরা অতটাই খারাপ? নিজের একটি প্রশ্ন দিয়ে তিনি সে প্রশ্নের মোকাবিলা করলেন।
‘নম্ররাই আশীর্বাদপুষ্ট’ কথাটা আজ রাজনৈতিক ঈশ্বরদ্রোহিতা সামিল নয় কি? মনে করুন, যিশু আমেরিকায় বললেন, ‘দরিদ্ররা আশীর্বাদপুষ্ট’। এটাকে তাহলে অর্থনৈতিক বিপথগামিতা বলে মনে করা হতো। আর তিনি যদি আপনার দেশে বলতেন উটের পক্ষে সুঁইয়ের ছিদ্র দিয়ে যাওয়ার মতোই বিত্তবানদের স্বর্গে যাওয়াটা সহজ–তাহলে কি তাঁকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হতো না? হয়তো তার কথাবার্তার জন্য আমেরিকা যিশুর ওপর শারীরিক দণ্ড আরোপ করা পর্যন্ত যেত না, কিন্তু আমার মনে হয়, আমেরিকায় নম্র বা দরিদ্র হওয়া—(মূল পাণ্ডুলিপিতে কিছু শব্দ স্পষ্ট ছিল না)।
‘আপনি কি আমেরিকাকে মহা ইউরোপীয় শক্তিগুলোর মতো সম্পূর্ণভাবে আধ্যাত্মিকতাশূন্য মনে করেন বা আপনি কী মনে করেন, অনাধ্যাত্মিকতার মশাল সেখানে এখনো প্রজ্বালমান?তিনি উত্তর দিলেন, ‘আমার বিশ্বাস আমেরিকা আদর্শের অনুসন্ধান করেছে, নিশ্চয় কিছু আমেরিকাবাসী অনুসন্ধান করছেন। আমার সেই ভবিষ্যদ্বাণী করার যোগ্যতা নেই। ভালো জিনিসের এই অনুসন্ধানকারীরা জেগে উঠবেন বিরুদ্ধবাদীদের ভারে আচ্ছন্ন হয়ে বা তাঁরা পৃথিবীর সর্বত্র তাঁদের বক্তব্য পৌঁছে দিতে পারবেন এবং সব মানুষের মঙ্গলের জন্য এক বড় শক্তি হবেন। সব মানুষ আশা করে, তাঁরা সাফল্য লাভ করুন।
সিলভিয়া প্লাথ এর একটি সাক্ষাৎকার
পিটার অর-এর সাথে [১৯৬২]
[সিলভিয়া প্লাথের জন্ম বোস্টনে। ১৯৩২ সালে। তিনি জার্মান ও অস্ট্রিয়ান বংশোদ্ভূত। গ্রাজুয়েশন করেছিলেন Massachusettsএর স্মিথ কলেজ থেকে, ১৯৫৬ তে। আর ১৯৫৭ তে ইংল্যান্ডে, কেম্রবিজে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে পড়াশোনা করেন। এরপর তিনি স্মিথ কলেজে লেকচারার হিসাবে যোগ দেন। ১৯৬০ এ ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন স্থায়ীভাবে থাকার জন্য। এবং ১৯৬৩ তে মারা যান। তার দুই ছেলেমেয়ে ছিল।
তার প্রথম কবিতার বই The Colossus বের হয় ১৯৬১ তে। তার উপন্যাস The Bell jar ১৯৬৩ এর জানুয়ারীতে ছদ্মনামে বের হয়। তার শেষদিকের কবিতা Ariel প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ তে।]
অর: সিলভিয়া, কোন বিষয়টা তোমাকে কবিতা লিখতে শুরু করিয়েছে?
প্লাথ: আমি জানি না কী আমাকে শুরু করিয়েছে, আমি আসলে এটা লিখতে শুরু করি যখন আমি খুব ছোট। আমার মনে হয়, নার্সারি রাইমসগুলি আমি খুব পছন্দ করতাম আর মনে হয় ভাবতাম যে, আমিও হয়ত এরকম লিখতে পারি। আমি প্রথম কবিতা লিখি, যেটা প্রথম ছাপা হয় তখন আমার বয়স সাড়ে আট বছর। সেটা দি বোস্টন ট্রাভেলার -এ বের হয়েছিল আর তারপর থেকেই আমার মনে হয়, আমি একটু প্রফেশনাল।
অর: তুমি কোন জিনিসগুলি নিয়ে লিখতে, যখন তুমি শুরু করেছিলে?
প্লাথ : প্রকৃতি, আমার মনে পড়ে: পাখি, মোমাছি, বসন্ত, ঝর্ণা - এইসব বিষয়গুলি, যা অনিঃশেষ উপহার একজন মানুষের প্রতি, যার নিজস্ব কোন অভিজ্ঞতা নেই লিখবার জন্য। আমার মনে পড়ে, বসন্তের শুরু হওয়া, মাথার ওপরে তারাগুলি, প্রথম তুষারপাত আরও অনেককিছু যা একটা শিশুর কাছে, একজন নবীন কবির কাছে উপহারের মত।
অর: এখন, এতগুলি বছর পার হয়ে, তুমি কি বলতে পার, এখানে এমন কোন বিষয় কি আছে, যা তোমাকে কবি হিসাবে আর্কষণ করে, এমন কোন জিনিস যা নিয়ে তুমি লিখতে পছন্দ করবে?
প্লাথ : হয়ত এটা একটা আমেরিকান বিষয়: আমি খুব উত্তেজিত বোধ করি, যখন আমি অনুভব করি যে, এটা নতুন কোন কিছু যা তৈরী হয়েছে, বলা যায়, জড়নবৎঃ খড়বিষষ এর খরভব ঝঃঁফরবং, এটা প্রচন্ড নতুন একটা জিনিস, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, খুবই ব্যক্তিগত, আবেগ কাতর অভিজ্ঞতা, যা আমার মনে হয়, অনেকটাই ট্যাবু। উদাহারণ হিসাবে বলা যায়, রবার্ট লওয়েল এর মানসিক হাসপাতালে তার অভিজ্ঞতা বিষয়ে কবিতাগুলি আমাকে আগ্রহী করে। এই অদ্ভুত, ব্যক্তিগত আর ট্যাবু বিষয়গুলি, আমার মনে হয়, সাম্প্রতিক আমেরিকান কবিতায় এক্সপ্লোর হচ্ছে। আমি বিশেষভাবে চিন্তা করি, মহিলা কবি অহহ ঝবীঃড়হ এর কথা, যে মা হিসাবে তার অভিজ্ঞতাগুলির কথা লিখেছে, মা হিসাবে যার একটা নার্ভাস ব্রেক ডাউন হয়েছিল, যা খুবই আবেগ কাতর এবং একজন তরুণীর অনুভূতি । আর তার কবিতাগুলি চমৎকারভাবে μাফটম্যানসশীপের কবিতা এবং যদিও তাদের একধরণের আবেগ আর মানসিক গভীরতা আছে যা আমার মনে হয়, অনেকটাই নতুন, অনেকটাই উত্তেজনার।
অর: এখন তুমি, একজন কবি হিসাবে, একজন মানুষ হিসাবে যার এক পা আটলান্টিকের এক দিকে আর অন্য পা অন্যদিকে - যদি আমি এইভাবে দেখি, একজন আমেরিকান হিসাবে...
প্লাথ: এটা হয়ত একটা বিব্রতকর অবস্থান, কিন্তু আমি এটা স্বীকার করব!
অর: ... কোন দিকে তোমার অবস্থানটা বেশি যাবে, যদি আমি রূপক অর্থেও বলতে চাই?
প্লাথ: আচ্ছা, আমি যদি ভাষার কথা বলি, তাহলে আমি আমেরিকান, আমি ভীত যে, আমার উচ্চারণ আমেরিকান, আমার কথা বলার ধরণ আমেরিকানদের মত, আমি একজন পুরানো ধরণের আমেরিকান। এটা সম্ভবত একটা কারণ যে জন্য এখন আমি ইংল্যান্ডে এবং সবসময় ইংল্যান্ডে থাকব। যতদূর পর্যন্ত আমার আগ্রহ যায়, আমি ৫০ বছর পেছনে আছি, আমি অবশ্যই বলব যে যেসব কবি আমাকে আগ্রহী করে তাদের অধিকাংশই আমেরিকান। খুব কম সমসাময়িক ইংরেজ কবিই আছেন যাদের কবিতা আমি পছন্দ করি।
অর: এটা কি ইঙ্গিত করে যে, বর্তমান সময়ের ইংরেজ কবিরা আমেরিকানদের চাইতে পিছিয়ে?
প্লাথ: না, আমার মনে হয় এটা একটু জটিল, যদি আমি এটা বলেও থাকি। ব্রিটিশ সমালোচক অষাধৎবু একটা প্রবন্ধ ছিল: ইংল্যান্ডে ভদ্রতার বিপত্তি সর্ম্পকে তার যুক্তিগুলি খুবই মানানসই, খুবই সত্যি। আমি অবশ্যই বলব যে, আমি খুব ভদ্র নই আর আমি এটা মনে করি যে, ভদ্রতার একটা ভয়ানক জিনিস আছে - পরিচ্ছন্নতা, চমৎকার কমনীয়তা, যা ইংল্যান্ডের সর্বত্র এতবেশি দেখা যায় যে, সম্ভবতঃ এটা অনেকবেশি ভয়ানক বাস্তবে যা দেখায়, তার চাইতে।
অর: কিন্তু তুমি কি এটাও মনে কর না যে, ইংলিশ কবিদের যে কাজ তা তাদের ওপর চাপানো একটা ভারের ভিতর দিয়ে করতে হচ্ছে, যাকে মোটা দাগে ‘ইংলিশ লিটারেচার’ বলা হচ্ছে?
প্লাথ: হ্যাঁ, এর চাইতে বেশি আমি একমত হতে পারি না। আমি জানি যখন আমি কেম্রবীজে ছিলাম, তখন আমার সাথে কি হয়েছিল। একজন তরুণী আসত আমার কাছে আর বলত ‘কি করে তুমি সাহস কর লেখালেখি করার, আর তা ছাপানোর, একটা লেখা ছাপানো হলে যে সমালোচনা, ভয়ানক সমালোচনা করা হয়, তারপরও?’ আর সমালোচনাটা কখনই ঐ কবিতাটার সমালোচনা না। আমার মনে পড়ে একবার আমি অবাক হয়েছিলাম, যখন কেউ একজন আমাকে সমালোচনা করল জন ডানের মত শুরু করার জন্য কিস্তু জন ডানের মত শেষ না করতে পারার জন্য, আর প্রথমবারের মত ঐ মুহূর্তে সমস্ত ইংরেজী সাহিত্যের ভার আমি আমার ওপর অনুভব করলাম। আমি মনে করি, যে সম্পূর্ণ গুরুত্ব দেয়া হয় ইংল্যান্ডে, এর বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে, বাস্তব সমালোচনার ওপর (কিন্তু ঐতিহাসিক সমালোচনার ওপর এতটা না, এটা জেনে যে, কোন সমযে এটা লেখা হচ্ছে) তা অনেকটা অবশ করে দেয়ার মত। আমেরিকাতে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে আমরা কী পড়ি? - টি.এস. এলিয়ট, ডিলান টমাস, ইয়েটস; এখান থেকেই আমরা শুরু করি। শেক্সপিয়র থাকেন ব্যাকগ্রাউন্ডে।
আমি নিশ্চিত নই আমি এর সাথে একমত হব কিনা, কিন্তু আমি মনে করি এতসব কারণে একজন নতুন কবি’র পক্ষে, যে কবিতা লিখছে, আমেরিকাতে তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া এতটা ভীতিকর না যতটা ইংল্যান্ডে।
অর: সিলভিয়া, তুমি বলছ যে, তুমি নিজেকে একজন আমেরিকান মনে কর, কিন্তু যখন তুমি ‘ফধফফু’র মত একটা কবিতা পড় যা বলে উধপযধঁ, অঁংপযরিঃু আর সবরহ কধসঢ়ভ এর কথা; আমার এমন একটা ধারণা আছে যে, এই ধরণের কবিতা একজন সত্যিকারের আমেরিকান লিখতে পারে না, কারণ এটা খুব বেশি কিছু বোঝায় না, এই নামগুলি হয়ত আটলান্টিকের ঐপারে খুব বেশি কিছু বলে না, তাই কি?
প্লাথ: আচ্ছা, এখন তুমি আমাকে একজন সাধারণ আমেরিকান ধরে নিয়ে বলছ। ঠিক করে বলতে গেলে, আমার পূর্বপুরুষ, আমি বলতে পারি, জার্মান আর অস্ট্রিয়ান। একদিক দিয়ে দেখতে গেলে আমি প্রথম প্রজন্মের আমেরিকান, আর অন্যদিক দিয়ে দেখতে গেলে আমি দ্বিতীয় প্রজন্মের আমেরিকান আর তাই কনসানট্রেশন ক্যাম্পগুলি ও অনান্য ক্ষেত্রে আমার আগ্রহ অনন্যভাবে তীব্র। আর তারপর আবার আমি নিজেকে রাজনৈতিকভাবেও দেখি, যা আমি মনে করি এখান থেকেও একটা অংশ এসেছে।
অর: আর একজন কবি হিসাবে, তোমার কি ইতিহাস সর্ম্পকে মহৎ ও তীক্ষ্ম ধারণা আছে?
প্লাথ: আমি ইতিহাসবিদ নই, কিন্তু ইদানিং ইতিহাসের প্রতি মুগ্ধতা আরো বাড়ছে আর এখন আমি নিজেকে দেখছি আরো বেশি ইতিহাস সর্ম্পকে পড়তে। বর্তমানে আমি নেপোলিয়ন বিষয়ে খুবই আগ্রহী : আমি খুবই আগ্রহী লড়াই আর যুদ্ধ সর্ম্পকে; এধষষরঢ়ড়ষ আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আর এইরকম বিষয়ে; আর আমার মনে হচ্ছে, এই বয়সে আমি অনেকবেশি ইতিহাস সচেতন। আমার প্রথম বিশে - আমি কখনই এরকম ছিলাম না।
অর: তোমার কবিতাগুলি’র কি বইয়ের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসার প্রবণতা থাকে, তোমার নিজস্ব জীবনের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসার চাইতে?
প্লাথ: না, না, আমি এটাকে এইভাবে কখনই বলব না। আমি মনে করি, আমার কবিতাগুলি তাৎক্ষণিকভাবে বেরিয়ে আসে উপলদ্ধি আর আবেগের অভিজ্ঞতাগুলি থেকে, যা আমার আছে; কিন্তু আমি অবশ্যই বলব যে, এইসব কান্না আমি সহানুভূতির সাথে হৃদয় থেকে বের করতে পারি না, সুই অথবা ছুরি অথবা এমন একটা কিছু ছাড়া। আমি বিশ্বাস করি, একজনের অবশ্যই ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন অভিজ্ঞতাকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করার, সেটা যত ভয়াবহই হোক না কেন, পাগল হওয়ার মত বা অত্যাচারিত হওয়ার মত - এরকম অভিজ্ঞতা আর এইসব অভিজ্ঞতাকে একজনের পরিচালিত করা প্রয়োজন সুগঠিত এবং বুদ্ধিমত্তার ছোট আকৃতিতে, আমার মনে হয় সেই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাটা খুবই জরুরী, কিন্তু এটা অবশ্যই কোন বদ্ধ-বাক্স বা নিজেকে আযনায় দেখার নার্সিসিজম-এর মত কোনো ব্যাপার না। আমি বিশ্বাস করি, এটা অবশ্যই প্রাসঙ্গিক হতে হবে, বৃহত্তর অর্থগুলির ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক হতে হবে, বড় বিষয়গুলি, যেমন ঐরৎড়ংযরসধ বা উধপযধঁ বা এইরকম কোনো কিছুর ক্ষেত্রে।
অর: আর তাই, এই আদি, আবেগী প্রতিক্রিয়ার পিছনে নিশ্চয় কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক শৃঙ্খলা থাকবে।
প্লাথ: এটা খুব গভীরভাবে অনুভব করি, একাডেমিক হবার কারণে, পিএইচডি ডিগ্রী’র জন্য থেকে যাবার আমন্ত্রণের প্রলোভনের জন্যে, একজন প্রফেসর হওয়ার কারণে- এইসব কিছুর জন্যে, আমার একটা দিক অবশ্যই সব ডিসিপি−নকে শ্রদ্ধা করে, যতক্ষণ না পর্যন্ত তারা অনঢ় হয়ে ওঠে।
অর: যেসব লেখকরা তোমাকে প্রভাবিত করেছে, তাদের সর্ম্পকে তুমি কি বলবে? কে তোমার কাছে অনেক বেশি অর্থপূর্ণ?
প্লাথ: এমন খুব অল্প কজনই আছেন। তাদের সত্যিকারভাবে খুঁজে পাওয়া খুবই মুশকিল। যখন আমি কলেজে ছিলাম আধুনিকদের দ্বারা হতবিহ্বল আর অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম, ডিলান টমাস, ইয়েটস, অডেন দ্বারা, এমনকি একটা সময়ে আমি অডেনের জন্য সম্পূর্ণভাবে পাগল ছিলাম আর আমি যা লিখতাম তা ছিল মারাত্কভাবে অডেনীয়। এখন আমি আবার পিছনের দিকে ফিরে গেছি, উদাহরণস্বরুপ, আমি বে−ক-এর দিকে দেখছি। আর তারপর, এটা খুব উদ্ধত্যের সাথে বলা যায় যে, কেউ একজন শেকসপীয়র দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে যেমন: একজন শেকসপীয়র পড়ল আর এটা তা-ই।
অর: সিলভিয়া, কেউ খেয়াল করবে যে, তোমার কবিতা পড়তে গেলে এবং শুনতে গেলে দুই রকমের শোনায়, যা খুবই দ্রুত আর স্পষ্টভাবেই মনে হয়; যার একটা সহজবোধ্যতা (আর আমার মনে হয় এই দুইটা রকমেরই একটার আরেকটার সাথে সর্ম্পক আছে) তাদের সহজবোধ্যতা আর তারা যে প্রভাব ফেলে পড়া হলে। তো, তুমি কি সচেতনভাবে তোমার কবিতাকে গড়ে তোল একই সাথে স্বচ্ছ এবং বাস্তবিক করে, যখন তাদের শব্দ করে পড়া হয়?
প্লাথ: এটা এমন একটা কিছু যা আমি আমার প্রথম কবিতাগুলির ক্ষেত্রে করিনি। উদাহারণস্বরুপ আমার প্রথম বই ঞযব ঈড়ষড়ংংঁং, এর কোন কবিতাই এখন আমি শব্দ করে পড়তে পারি না। আমি এগুলিকে শব্দ করে পড়ার মত করে লিখিনি। তারা, সত্যিকারভাবে, খুব ব্যক্তিগতভাবে, আমাকে ক্লান্ত করে। যেগুলি আমি এখন পড়ছি, যেগুলি খুবই নতুন, আমি তাদের সর্ম্পকে বলতে পারি, আমি নিজের কাছে তাদের উচ্চস্বরে বলতে পারি, আর আমি মনে করি যে, এটা আমার নিজের লেখার ক্ষেত্রে একটা অগ্রগতি, আমার কাছে একটা নতুন বিষয়। আর যেটা সহজবোধ্য, সেটা সম্ভবতঃ এমন একটা জায়গা থেকে এসেছে যেখানে আমি তাদেরকে আমার নিজের কাছে বলি, আমি উচ্চস্বরে বলি।
অর: তুমি কি মনে কর, এটা একটা ভালো কবিতার জন্য অত্যাবশকীয় একটা অংশ, যে কবিতাটা আবৃত্তি করা যাবে?
প্লাথ: আচ্ছা , আমি এটা এখন অনুভব করি আর মনে করি যে, এটা কবিতা রের্কড করার ক্ষেত্রে একটা অগ্রগতি, পড়ার সময় কবিতাটা আবৃত্তি করতে পারা; কবিদের নিজস্ব রের্কড থাকা আমি মনে করি চমৎকার একটা বিষয়। আমি এটা নিয়ে খুবই উত্তেজিত। একদিক দিয়ে এটা একরকম ফিরে আসা পুরানো কবিদের অবস্থানে, যখন একদল মানুষের মাঝে কবিতা পড়া হত।
অর: অথবা একদল মানুষের মাঝে যখন কবিতা গাওয়া হত?
প্লাথ: একদল মানুষের মাঝে গাওয়া হত, ঠিক তাই।
অর: কবিতাকে একটু সময়ের জন্যে সরিয়ে রেখে বলি, আরও অন্য কোন কিছু কি তুমি লেখ বা লিখেছো?
প্লাথ: আচ্ছা, আমি সবসময় গদ্যের বিষয়ে আগ্রহী। কিশোর বয়সে আমি ছোট গল্প ছাপিয়েছিলাম। আর সবসময় চাইতাম বড় গল্প লিখতে, আমি চাইতাম একটা উপন্যাস লিখতে। এখন আমি যেটা অর্জন করেছি, আমি বলব একটা পরিণত বয়সে এবং যখন অভিজ্ঞতা হয়েছে, আমি আরো বেশি আগ্রহ বোধ করি গদ্যের বিষয়ে, উপন্যাসের ক্ষেত্রে। আমি অনুভব করি, একটা উপন্যাসে, উদাহারণস্বরূপ, আপনি টুথব্রাশের ভিতর ঢুকতে পারেন এবং এর সব কলকব্জা যা একজন প্রতিদিনকার জীবনে পায় তা দেখাতে পারে আর কবিতার ক্ষেত্রে বিষয়টা অনেক কঠিন। কবিতা, আমি অনুভব করি, একটা নির্মম শৃংখলা, আপনাকে অনেকদূর যেতে হবে, এত দ্রুত, এমন একটা ছোট্র জায়গার মধ্যে যে, আপনি শুধুমাত্র সমস্ত সীমাবদ্ধতাকে অগ্রাহ্য করতে পারেন। আর আমি তাদের হারিয়ে ফেলি! আমি একজন নারী, আমার ছোট খধৎবং আর চবহধঃবং এর মত, একটা তুচ্ছ জিনিসের মত আর আমি দেখি যে, একটা উপন্যাসে আমি জীবনের অনেকটাই পাই, হয়ত এমন তীব্র জীবন নয়, কিস্তু অবশ্যই জীবনের অনেকটুকুই আর তাই এর ফলে আমি উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে অনেক বেশি আগ্রহী।
অর: এটা অনেকটা ডঃ জনসনের মত দৃষ্টিভঙ্গি, তাই না? যেটা তিনি বলেছিলেন ‘এমন কিছু বিষয় আছে, যা কবিতায় অর্ন্তভুক্ত হওয়ার মত আর অন্য অনেককিছুই নয়’?
প্লাথ: আচ্ছা, একজন কবি হিসাবে আমি অবশ্যই বলব পুরুষ সমকামী! আমি বলব যে সবকিছুই কবিতার ভিতর আসতে পারে, কিন্তু আমি কখনই পারি না টুথব্রাশগুলিকে একটা কবিতায় আনতে, আমি সত্যিই পারি না!
অর: তুমি কি অন্য লেখক, কবিদের সান্নিধ্যে নিজের বেশিরভাগ সময় কাটাও ?
প্লাথ : আমি ডাক্তার, ধাত্রী, আইনজীবি অথবা অন্য যে কাউকেই পছন্দ করি লেখকদের চাইতে। আমি মনে করি লেখক-শিল্পীরা হচ্ছেন সবচেয়ে নার্সিসাস লোক। আমার অবশ্য এটা বলা উচিত না, আমি তাদের অনেককেই পছন্দ করি। এমন কি আমার অনেক বন্ধুরাই লেখক ও শিল্পী। কিন্তু আমি অবশ্যই বলব যে, আমি তাদেরকেই পছন্দ করি, যারা কোনো একটা বাস্তব বিষয়ে দক্ষ এবং আমাকে কিছু শেখাতে পারেন। আমি বলতে চাচ্ছি, আমার ধাত্রী আমাকে শিখিয়েছে কীভাবে মৌমাছি পালতে হয়। যদিও সে আমার লেখার কিছুই বুঝতে পারে না। আর আমি নিজের ক্ষেত্রে দেখি যে, অনেক কবিদের চাইতে আমি তাকে বেশি পছন্দ করি। আমি আমার বন্ধুদের মধ্যে এমন মানুষদের দেখি যিনি নৌকা সর্ম্পকে সবকিছুই জানেন অথবা একটা খেলার সবকিছুই জানেন অথবা জানেন কীভাবে একজনকে/ একটা শরীর কেটে খুলতে হয় অথবা একটা অঙ্গ কিভাবে কাটতে হয়। এই বাস্তব জ্ঞানের দক্ষতা আমাকে মুগ্ধ করে। একজন কবি হিসাবে যে কেউ একটু হাওয়ায় ভাসে। আমি সবসময় এমন কাউকে পছন্দ করি, যে আমাকে বাস্তব কিছু শেখাতে পারে।
অর: অন্য এমন কোনো কিছু কি আছে কবিতা লেখার বাইরে যা তুমি করতে চাইতে? কারণ এটা অবশ্যই এমন একটা কিছু যা বাস্তব জীবনের অনেক কিছুই নিয়ে নেয়, যদি কেউ সফলতা লাভ করতে পারে। তোমার মনে কি কোনো জমানো আক্ষেপ আছে, এমন কোনো কিছু না করার জন্য?
প্লাথ: আমার মনে হয় আমি যদি অন্য কোনো কিছু করতে চাইতাম, তাহলে ডাক্তার হতে চাইতাম। আমার মনে হয়, এটা হয়ত একজন লেখক হওয়ার সবচেয়ে বিপরীত একটা কিছু। আমি যখন তরুণ ছিলাম তখন আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাই ছিল ডাক্তার। আমি সাদা জালের টুপি পড়ে রাউন্ডে যেতাম, দেখতাম শিশুরা জন্ম নিচ্ছে, শবগুলির ব্যবচ্ছেদ করা হচ্ছে। এটা আমাকে মুগ্ধ করত, কিন্তু আমি নিজেকে কখনই গোছাতে পারিনি, নিজেকে ঐ একটা জায়গায় নিয়ে আসতে পারিনি, য়েখানে আমি সেই সমস্ত কিছু শিখতে পারবো যা একজন ভাল ডাক্তার হতে হলে জানতে হয়। এটা সেই বৈপরীত্য - যে মানুষের অভিজ্ঞতাগুলি নিয়ে সরাসরি কাজ করে, তাকে সারিয়ে তোলে, শারীরিক অবস্থার উনড়বতি করে, সাহায্য করে, এইরকম একটা বিষয়। আমার মনে হয়, আমার যদি কোনো নস্টালজিয়া থাকে, এটা তাই। কিন্তু আমি নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিই যে, আমি অনেক ডাক্তারদের চিনি। আর আমি হয়ত এটাও বলতে পারি যে, একজন ডাক্তার হওয়ার চাইতে, ডাক্তারদের নিয়ে লিখতে পেরে আমি আরো বেশি খুশি।
অর: কিন্তু মূলতঃ এই ব্যাপারটা, কবিতা লেখাটা, তোমার জীবনে নিশ্চয় একটা গভীর পরিতৃপ্তির একটা বিষয়, তাই না?
প্লাথ: আহ, পরিতৃপ্তি! আমি মনে করি না এটা ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো। এটা আমার কাছে রুটি-পানির মত অথবা এমন কিছু যা আমার জন্য নিঃশর্তভাবে প্রয়োজনীয়। আমি পরিপূর্ণভাবে তৃপ্তি পাই যখন একটা কবিতা
লিখতে পারি, যখন আমি লিখছি। একটা কবিতা লেখার পর একজন খুব দ্রুত কবি হওয়া থেকে সরে যেতে থাকে; কবিতা লেখার সময় আর বাকি সময়টাতে কবি থাকা মোটেও একই ব্যাপার নয়। কিন্তু আমার মনে হয় একটা কবিতা লেখার আসল অভিজ্ঞতা চমৎকার একটা অনুভূতি।
৩০ অক্টোবর, ১৯৬২
সত্য, ক্ষমতা, সত্তা: মিশেল ফুকোর সাথে একটি কথোপকথন
- আপনি ইউনিভাসিটি অফ ভেরমন্ট-এ কী কাজে এসেছেন?
আমি এখানে এসেছি কয়েকজন মানুষের কাছে আরো বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করার জন্য যে, আমি কি ধরনের কাজ করছি, জানার জন্যে তারা কি ধরনের কাজ করছেন এবং তাদের সাথে কিছু স্থায়ী সর্ম্পক স্থাপন করার জন্য। আমি একজন লেখক, একজন দার্শনিক কিংবা চিন্তা জগতের এক মহান ব্যক্তিত্ব নই: আমি একজন শিক্ষক। এখানে সামাজিক কিছু বিষয় আছে যা আমাকে প্রচ- ঝামেলায় ফেলেছে: ১৯৬০ সাল থেকে এটা শুরু হয়েছে, আরো কয়েকজন শিক্ষক আছেন যারা পাবলিক মেন-এ পরিণত হয়েছেন, একই ধরনের বাধ্যবাধকতা নিয়ে। আমি একজন নবী হতে চাই না আর বলতে চাই না যে, “দয়া করে বসুন, আমি যা বলছি তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।” আমি এখানে এসেছি আমাদের কমন কাজগুলি নিয়ে আলোচনা করার জন্যে।
- আপনাকে প্রায়ই অভিহিত করা হয় “দার্শনিক” হিসাবে, কিন্তু আবার “ঐতিহাসিক”, “স্ট্রাকচারালিস্ট” এবং “মার্কসিস্ট” হিসাবেও। কলেজ ডি ফ্রান্সে আপনার চেয়ারের টাইটেল হচ্ছে “চিন্তার পদ্ধতিগুলির ইতিহাসের অধ্যাপক (Professor of the History of Systems of Thought)। এর দ্বারা কী বোঝায়?
আমি মনে করি না যে, এটা জানা খুব জরুরী যে সত্যি সত্যি আমি কে। জীবনে এবং কাজের মধ্যে মানুষের মূল উদ্দেশ্য থাকে এমন একজন হওয়া যা সে প্রথম থেকেই ছিল না। আপনি যদি একটা বই লিখতে চান আর প্রথম থেকেই জানেন যে এর শেষে আপনি কী বলবেন, তাহলে আপনি কি সেটা লেখার সাহস করতে পারবেন? একটা লেখার ক্ষেত্রে বা প্রেমের সর্ম্পকের ক্ষেত্রে যা সত্যি, জীবনের ক্ষেত্রেও তা সত্যি। এই খেলাটা ততদূর পর্যন্তই অর্থপূর্ণ যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা তার শেষটা জানতে পারি না। আমার কাজের ক্ষেত্র হচ্ছে, চিন্তার ইতিহাস। মানুষ একটা চিন্তাশীল প্রাণী। সে যা চিন্তা করে তা তার সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি ও ইতিহাসের সাথে জড়িত এবং কিছু সাধারণ ও সার্বজনীন প্রণালী এবং আনুষ্ঠানিক নির্মিতির সাথেও জড়িত। কিন্তু চিন্তা অবশ্যই সামাজিক সর্ম্পকগুলির বাইরে আলাদা একটা জিনিস। মানুষ সত্যিকারভাবে যেভাবে চিন্তা করে তা যুক্তির সার্বজনীন প্রণালীগুলি দিয়ে পর্যাপ্তভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। সামাজিক ইতিহাস এবং চিন্তার পদ্ধতিগত দিকগুলির মাঝখানে আরেকটা পথ আছে, একটা লাইন আছে-হয়ত খুব সরু-সেই পথটাই হচ্ছে চিন্তার ইতিহাসের পথ।
- যৌনতার ইতিহাসে আপনি এমন একজন ব্যক্তিত্বের কথা বলেছেন, যে “স্থায়ী নিয়মগুলিকে বিব্রত করে এবং কোন না কোনভাবে অনাগত স্বাধীনতাকে এন্টিসিপেড করতে পারে”। আপনি কি আপনার কাজগুলিকে এই আলোকে দেখেন?
না। বরং অনেকসময় ধরে, লোকজন আমাকে জিজ্ঞাসা করত তাদেরকে বলার জন্য যে কী ঘটবে এবং ভবিষ্যতের জন্য তাদেরকে একটা কর্মসূচি দেয়ার জন্যে। আমরা খুব ভালো করেই জানি যে, খুব ভালো উদ্দেশ্য থাকা সত্ত্বেও, এইসব কর্মসূচিগুলি নিপীড়নের জন্য একটা উপায় হিসাবে, একটা হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হয়। স্বাধীনতার একজন প্রেমিক হিসাবে রুশোকে ফরাসী বিপ্লবে ব্যবহার করা হয়েছে সামাজিক নিপীড়নের একটা আদর্শ তৈরী করার জন্যে। স্ট্যালিনিজম আর লেনিনিজম দেখলে মার্কস আঁতকে উঠতেন। আমার ভূমিকা হচ্ছে একটা শব্দ আরো জোরালোভাবে বলা-মানুষদেরকে দেখানো যে, তারা যা অনুভব করে তার চাইতে তারা অনেকবেশি স্বাধীন; মানুষ সত্য হিসাবে, প্রমাণ হিসাবে যা গ্রহণ করে, কিছু বিষয়বস্তু যা ইতিহাসের একটা নির্দিষ্ট ক্ষণের মধ্যে গড়ে উঠেছে এবং এইসব তথাকথিত প্রমাণগুলিকে সমালোচনা এবং ধ্বংস করা সম্ভব। মানুষের মনের ভিতরের কোনকিছুকে পরিবর্তন করা-এটাই একজন ইন্টেলেকচুয়ালের কাজ।
- আপনার লেখাগুলিতে দেখা যায় যে আপনাকে সেই চরিত্রগুলি প্রবলভাবে আর্কষণ করে যারা সমাজের প্রান্তে অবস্থান করে, যেমন: পাগল, কুষ্ঠরোগী, অপরাধী, বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি, হিজড়া, খুনী, অখ্যাত চিন্তাবিদ। এটা কেন?
আমাকে প্রায়ই গাল-মন্দ করা হয়েছে ইতিহাসের মূলধারার চাইতে প্রান্তিক চিন্তাবিদদের নির্বাচন করার জন্যে। আমার উত্তরটা এই ক্ষেত্রে উদ্ধতই হবে : বপ এবং রিকার্ডোর মতো চরিত্রদেরকে অবসকিউর হিসাবে দেখা অসম্ভব।
- কিন্তু র্নিবান্ধদের (social outcasts) প্রতি আপনার আগ্রহের কারণ কী ?
আমি অবসকিউর চরিত্রগুলি এবং প্রক্রিয়াগুলি নিয়ে কাজ করি মূলত দুইটা কারণে: পশ্চিম ইউরোপীয় সমাজগুলি যে রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রক্রিয়াগুলির মাধ্যমে বিন্যস্ত করে তা খুব বেশি আলাদা কিছু নয়, যা ভুলে যাওয়া হয়েছে অথবা যা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তারা আমাদের সবচেয়ে পরিচিত ল্যান্ডস্কেপের অংশ এবং আমরা তাদেরকে আর উপলদ্ধি করতে পারি না। কিন্তু তাদের বেশিরভাগই ছিল খারাপভাবে আলোচিত ব্যক্তি। এটা আমার টার্গেটগুলির মধ্যে একটা যে, মানুষকে দেখানো, এমন অনেক কিছু আছে যা আমাদের ল্যান্ডস্কেপের অংশ-এবং মানুষ যে সার্বজনীন-তা আসলে কয়েকটা খুব সংক্ষিপ্ত ঐতিহাসিক পরিবর্তনের ফলাফল। আমার সমস্ত পর্যালোচনা মানুষের সার্বজনীন অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তার ধারণার বিরুদ্ধে। তারা সংস্থাগুলির আবেগায়িত দিকগুলিকে তুলে ধরে এবং তুলে ধরে স্বাধীনতার কোন স্পেস আমরা এখনো উপভোগ করতে পারি এবং কতগুলি পরিবর্তন এখনো সম্ভব।
- আপনার লেখাগুলি গভীর আবেগের প্রবণতা বহন করে যা পাণ্ডিত্যপূর্ণ পর্যালোচনাগুলিতে পাওয়া যায় না: যেমন ডিসিপ্লিন এবং পানিশ এ গভীর যন্ত্রণা, দি অর্ডার অফ থিন্কস এ অবজ্ঞা এবং আশা, ম্যাডনেস এন্ড সিভিলাইজেশন এ নিষ্ঠুরতা এবং বিষন্নতা।
আমার প্রতিটা কাজই আমার জীবনের অংশ। যে কোন একটা বা অন্য কারণেই হোক এইসব বিষয় দেখার এবং উপলদ্ধি করার সুযোগ আমার হয়েছিল। একটা সহজ উদাহারণ নেয়া যাক, ১৯৫০ সালের দিকে আমি একটা মনোচিকিৎসার হাসপাতালে কাজ করতাম। দর্শন পড়ার পর আমি দেখতে চাচ্ছিলাম যে, পাগলামিটা কী রকম: আমি যুক্তি বোঝার জন্য যথেষ্ঠ পাগল ছিলাম , আর আমি যথেষ্ঠ যৌক্তিক ছিলাম পাগলামি বোঝার জন্য। আমি রোগী থেকে এটেনডেন্টস পর্যন্ত যাবার জন্য স্বাধীন ছিলাম, আমার নির্দিষ্ট কোন ভূমিকা ছিল না। এটা ছিল নিউরোসার্জারির প্রস্ফুটিত হওয়ার সময়, সাইকোফার্মালজি শুরুর সময়, ট্রাডিশন্যাল সংস্থাগুলির বিদায়ের সময়। প্রথমে আমি এটা ধরে নিয়েছিলাম যে, এর প্রয়োজন আছে, কিন্তু এর তিনমাস পরে (আমি এমনিতেই সবকিছু একটু দেরিতে বুঝি), আমি প্রশ্ন করলাম “এই জিনিসগুলির কী দরকার?” এর তিন বছর পর আমি চাকরিটা ছেড়ে দেই এবং প্রচ- ব্যক্তিগত মানসিক অস্বত্বি নিয়ে সুইডেন যাই এবং এইসব প্রাকটিসগুলির ইতিহাস নিয়ে লিখতে শুরু করি (মেডনেস এন্ড সিভিলাইজেশন)। মেডনেস এন্ড সিভিলাইজেশন প্রথম খ- হওয়ার কথা ছিল। আমি প্রথম খ-টা লিখতে চাচ্ছিলাম এবং দ্বিতীয় খন্ডটা লিখতে ঘৃণাবোধ করছিলাম। এটা দেখা হয়েছিল মনোচিকিৎসা-নিকেতন এর একটা বিষয় হিসাবে, কিন্তু এটা ছিল ইতিহাসের একটা বর্ণনা। আপনি কী বিজ্ঞান এবং কপট বিজ্ঞানের পার্থক্যটা জানেন? একটা সত্যিকারের বিজ্ঞান নিজেকে আক্রান্ত মনে না করে তার নিজস্ব ইতিহাসকে বুঝতে পারে এবং গ্রহণ করে। যখন আপনি কোনো মনোচিকিৎসককে বলেন যে, তার মানসিক হাসপাতাল ল্যাজার হাউজ থেকে উৎপত্তি হয়েছে, তখন সে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে।
- আর ডিসিপ্লিন এন্ড পানিশ এর ঘটনাটা কী?
আমি অবশ্যই স্বীকার করব যে, আমার সাথে জেলখানার বা কয়েদীদের কোনো সরাসরি যোগাযোগ ছিল না, যদিও আমি একটা ফরাসী জেলখানায় সাইকোলজিস্ট হিসাবে কাজ করেছি। আমি যখন তিউনিসিয়ায় ছিলাম, তখন দেখেছি যে, লোকজনকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে জেলে পোরা হচ্ছে, আর এটা আমাকে প্রভাবিত করেছিল।
- আপনার লেখাগুলিতে ক্ল্যাসিক্যাল যুগ কেন্দ্রীয় বিষয় হিসাবে এসেছে। আপনি কি ঐ সময়ের স্পষ্টতার জন্য নস্টালজিক বোধ করেন বা রেঁনেসার “দৃষ্টিগ্রাহ্যতা”র জন্য যখন সবকিছুই সংঘবদ্ধ এবং দৃশ্যমান ছিল?
অতীত সময়ের সৌন্দর্যের একটা প্রভাব আছে এবং তা নস্টালজিয়ার কারণে না। আমি খুব ভালো করেই জানি যে, এটা আমাদের নিজেদের আবিষ্কার। কিন্তু এই ধরনের নস্টালজিয়া থাকা ভালো, যতটা ভালো নিজের ছেলেবেলার সাথে সর্ম্পক থাকা যখন আপনার সন্তান আছে। কিছু সময় ধরে এই ধরনের নস্টালজিয়া থাকা ভালো এই শর্তে যে, বর্তমানের সাথে তখন সুচিন্তিত এবং পজিটিভ একটা সর্ম্পক থাকে। কিন্তু নস্টালজিয়া যদি বর্তমানের সাথে আগ্রাসী হওয়ার জন্যে এবং বর্তমানকে উপলব্ধি না করার জন্য হয়, তাহলে তা বাদ দেয়া উচিত।
- আপনি অবসর সময়ে কী ধরনের বই পড়েন?
যে ধরনের বই আমার সবচেয়ে বেশি আবেগ জাগিয়ে তোলে, তা হচ্ছে: ফকনার, টমাস মান, ম্যালকম লরি’র অ্যান্ডার দ্যা ভলকানো।
- আপনার চিন্তা-ভাবনার উপর এদের প্রভাবটা কী রকম?
আমি খুব বিস্মিত হয়েছি যখন বার্কলিতে আমার দুইজন বন্ধু আমার সর্ম্পকে লিখেছেন এবং বলেছেন যে, আমার উপর হাইডেগারের প্রভাব আছে Hubert L. Dreyfus and Paul Rabinow, Michel Foucault: Beyond Structuralism and Hermeneutics (Chicago; University of Chicago Press, 1982)]। অবশ্যই এটা খানিকটা সত্যি, কিন্তু ফ্রান্সে এটা কেউ বুঝতে পারবে না। ১৯৫০ এর দিকে যখন আমি ছাত্র ছিলাম, আমি হুসার্ল, সার্ত্রে, মার্লো-পন্টি পড়েছি। আপনি যখন বুঝতে পারবেন যে, কারো প্রভাব আপনাকে ছেয়ে ফেলছে তখন আপনি একটা পথ বের করার চেষ্টা করবেন। স্ববিরোধী মনে হলেও এটা যথেষ্ঠ সত্যি যে, হাইডেগারকে বোঝা একজন ফরাসীর জন্যে এতটা কঠিন নয়। যখন প্রতিটা শব্দই একটা বিভ্রান্তিকর প্রশ্ন তখন হাইডেগারকে বোঝার জন্য আপনি খুব একটা বাজে অবস্থায় থাকবেন না। তার বিয়িং এন্ড টাইম কঠিন; কিন্তু তার সাম্প্রতিক কাজগুলি অনেক বেশি স্পষ্ট। নিটশে-কে আমার একটা বিস্ময়কর প্রকাশ বলে মনে হয়েছে। আমার মনে হয়েছে যে, এ পর্যন্ত আমি যা শিখেছি এটা তার চাইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা কিছু। আমি তাকে প্রচ- আবেগের সাথে পড়েছি এবং আমার জীবন দিয়ে ভেঙেছি, আমি পাগলাগারদের চাকরিটা ছেড়ে দিই এবং ফ্রান্স ছেড়ে দিই : আমার এমন একটা অনুভূতি ছিল যে, আমি আটকা পড়ে যাচ্ছি। নিটশে-র মাধ্যমেই আমি এইসব কিছুর প্রতি একজন অপরিচিত ব্যক্তিতে পরিণত হতে পেরেছি। আমি এখনো ফ্রান্সের সামাজিক এবং বুদ্ধিবৃত্তির সাথে এতটা জড়িত নই। আমি যদি আরেকটু কমবয়স্ক হতাম, তাহলে আমি যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হতাম।
- কেন?
আমি এর সম্ভাবনা দেখি। কারণ সেখানে একই ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সাংস্কৃতিক জীবন নেই; একজন বিদেশী হিসাবে আপনার জড়িত হওয়ার প্রসঙ্গ আসতো না। সেখানে আমার উপর কোনো চাপ আসতো না। সেখানে অনেক ভালো বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যাদের বিভিন্ন বিষয়ে আগ্রহ আছে। তবে অবশ্যই সেখান থেকে আমাকে বের করে দেয়া হতে পারতো এবং সবচেয়ে জঘন্যভাবে।
- আপনি এটা মনে করছেন কেন যে, আপনাকে তারা বের করে দিত?
আমি খুব গর্বিত এই কারণে যে, কিছু লোক মনে করে আমি ছাত্রদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। যখন লোকজন তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করতে শুরু করে আমার মনে হয় সেখানে একটা গ-গোল আছে। তাদের মতামত অনুসারে আমি একজন ক্ষতিকর ব্যক্তি, যেহেতু আমি একজন ছদ্ম-মার্কসবাদী, একজন অযৌক্তিকতাবাদী, একজন নাস্তিবাদী।
- আপনার দি অর্ডার অফ থিন্কস পড়ে যে কেউ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারে যে, সংস্কারের জন্য যে কোনো ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা অসম্ভব, কেননা নতুন আবিষ্কারগুলির এত অর্থ এবং নিহিতার্থ আছে যে, আবিষ্কারকের পক্ষে এই বিষয়গুলি বোঝা সম্ভব নয়। আবার ডিসিপ্লিন এন্ড পানিশ এ আপনি দেখিয়েছেন যে, সংঘবদ্ধ পুলিশের সাহসের চাইতে একটা চেইন গ্যাং-এর সাহসের ক্ষেত্রটাতে হঠাৎ একটা পরিবর্তন আছে, জাঁকজমকপূর্ণ শাস্তির জায়গায় এসেছে নিয়মতান্ত্রিক সংস্থার শাস্তি। কিন্তু আপনি এই জিনিসটাও দেখিয়েছেন যে, একটা সময় যা মনে হয়েছে “সংস্কার”, তা আসলে সমাজের শাস্তি প্রদানের ক্ষমতাটাকে স্বাভাবিক করেছে মাত্র। তো, সচেতন পরিবর্তন কীভাবে সম্ভব?
আপনি কী করে ভাবেন যে, আমি চিন্তা করি পরিবর্তন অসম্ভব, যেখানে আমি যা বিশ্লেষণ করেছি তা সবসময় রাজনৈতিক কাজকর্মের সাথে জড়িত? ডিসিপ্লিন এন্ড পানশ এ আমার সমস্ত চেষ্টাই হচ্ছে এই প্রশ্নটার উত্তর দেয়া এবং দেখানো যে, একটা নতুন ধরনের চিন্তা তৈরি হচ্ছে। আমরা সবাই হচ্ছি জীবন্ত এবং চিন্তাশীল বিষয়। আমি যার বিপক্ষে বলি, তা হচ্ছে সামাজিক ইতিহাস এবং চিন্তার ইতিহাসের মধ্যে যে ফাঁকটা আছে, তা নিয়ে। সামাজিক ঐতিহাসিকরা বর্র্ণনা করতে চান যে, কীভাবে মানুষ চিন্তা না করে কাজ করে, আর চিন্তার ঐতিহাসিকরা বর্ণনা করতে চান যে, কীভাবে মানুষ কাজ না করে চিন্তা করে। সবাই কাজ করে এবং চিন্তা করে। মানুষ যেভাবে কাজ করে বা প্রতিক্রিয়া জানায় তা তার চিন্তার পদ্ধতির সাথে জড়িত আর তার চিন্তা অবশ্যই একটা ঐতিহ্যের সাথে জড়িত। যা আমি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি তা একটা জটিল বিষয় যা অল্প সময়ের মধ্যে মানুষকে অপরাধ এবং অপরাধীদেরকে ভিন্ন একটা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে বাধ্য করেছে। আমি দুই ধরনের বই লিখেছি। একটা হচ্ছে, দি অর্ডার অফ থিন্কস, যা শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক চিন্তার সাথে জড়িত : আর অন্যটি, ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ, যা সামাজিক রীতি-নীতি এবং প্রতিষ্ঠানগুলির সাথে জড়িত। বিজ্ঞানের ইতিহাস একইভাবে বিকশিত হয় নাই যেভাবে সামাজিক সংবেদনশীলতাগুলি তৈরি হয়েছে। একটা বৈজ্ঞানিক ডিসকোর্স হিসাবে চিহ্ণিত করতে গেলে চিন্তাকে অবশ্যই নির্দিষ্ট কিছু মানদ- মেনে চলতে হবে। ডিসিপ্লিন এন্ড পানিশ এ টেক্সটগুলি, প্রয়োগগুলি এবং মানুষ একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। আমার বইগুলিতে আমি এই পরিবর্তনগুলি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি; বস্তুগত কারণগুলি আবিষ্কার করার জন্য নয় বরং সব উপাদানগুলি দেখানোর জন্য যা মানুষের মিথস্ক্রিয়ায় এবং প্রতিক্রিয়াগুলিতে এসেছে। আমি মানুষের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। একই পরিস্থিতিতে মানুষ সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে।
- আপনি ডিসিপ্লিন এন্ড পানিশ এই বলে শেষ করেছেন যে, এটা “আধুনিক সমাজের বিভিন্ন অধ্যয়নের নিয়মানুগকরণ এবং জ্ঞানের ক্ষমতার মেরুদন্ড হিসাবে কাজ করবে”। এই নিয়মানুগ এবং জ্ঞানের কেন্দ্র হিসাবে মানুষ এর ধারণার মধ্যে সর্ম্পকটা কী?
মনোবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান, প্রায়শ্চিত্তের বিধান, শিক্ষামূলক-এইসব বিভিন্ন কর্মগুলির মাধ্যমে মানবিকতা সর্ম্পকে একটা নির্দিষ্ট রকমের ধারণা বা রূপ তৈরি করা হয়েছে, আর এখন মানুষ সর্ম্পকে এই ধারণাটা অনেকটাই নিয়মাত্মক, স্বতঃসিদ্ধ এবং সার্বজনীন বলে ধরে নেয়া হচ্ছে। মানবতাবাদ সার্বজনীন নাও হতে পারে, কিন্তু নির্দিষ্ট একটা পরিস্থিতির উপর নির্ভরশীল হতে পারে। আমরা যাকে মানবতাবাদ বলছি, তা মার্কসবাদীদের দ্বারা, উদারপন্থীদের দ্বারা, নাজীদের দ্বারা, ক্যাথলিকদের দ্বারা ব্যবহার করা হয়েছে। এর মাধ্যমে এটা বোঝায় না যে, আমরা মানবিক অধিকার বা স্বাধীনতা থেকে মুক্তি পেয়েছি, কিন্তু আবার আমরা স্বাধীনতা বা মানবিক অধিকারকে নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রের ভিতর সীমাবদ্ধ করতে পারি না। উদাহারণস্বরূপ, আপনি যদি আশি বছর আগে প্রশ্ন করতেন যে, নারীর সতীত্ব সার্বজনীন মানবিকতার অংশ কিনা, সম্ভবত সবাই হ্যাঁ-সূচক উত্তর দিতেন। আমি মানবতাবাদের যে দিকটা নিয়ে ভীত তা হচ্ছে এটা আমাদের নৈতিকতার নির্দিষ্ট একটা রূপকে প্রকাশ করে যা যে কোন ধরনের স্বাধীনতার জন্য একটা সার্বজনীন আদর্শ। আমার মনে হয় এখানে আরো অনেক গোপন আছে, আরো অনেক সম্ভাব্য স্বাধীনতা আছে, আরো অনেক উদ্ভাবন অপেক্ষা করছে আমাদের ভবিষ্যতে, যা মানবতাবাদের মধ্যে আমরা কল্পনা করি, যা গোঁড়ামিভাবে প্রকাশ করা হয় রাজনৈতিক রংধনুর প্রতিটা দিক থেকে: বাম, মধ্যপন্থী এবং ডানদের কাছ থেকে।
- আর এটাই কী প্রস্তাব করা হয়েছে “টেকনোলজিস অফ দি সেলফ”-এ?
হ্যাঁ। আপনি এর আগে বলেছিলেন যে, আপনার এইরকম একটা ধারণা আছে যে, আমার সর্ম্পকে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না। এটা সত্যি। কিন্তু আমি মাঝে মাঝে নিজেকে প্রকাশ করি অনেক সুশৃংখল এবং অপরিবর্তনীয়ভাবে। আমি যা অধ্যয়ন করেছি তা আসলে তিনটি প্রথাগত সমস্যা: (১) বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের মধ্যে দিয়ে সত্যের সাথে আমাদের সর্ম্পকগুলি কী রকম, আর এই “সত্যের খেলাগুলি”র মধ্যে সভ্যতার জন্যে কোনটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কোনটাতে আমরা বিষয় এবং বিষয়ী উভয়ই? (২) এইসব অদ্ভুত কৌশলগুলি এবং ক্ষমতা-সর্ম্পকগুলির মধ্যে দিয়ে অন্যদের সাথে আমাদের কোন সর্ম্পকগুলি আছে? (৩) সত্য, ক্ষমতা এবং সত্তার মধ্যে কোন সর্ম্পকগুলি আছে? আমি একটা প্রশ্নের মাধ্যমে এই আলোচনাটা শেষ করতে চাই: এই প্রশ্নগুলির চাইতে ক্ল্যাসিক আর কী আছে এবং এর চাইতে সুশৃংখল যাচাইয়ের পথ আর কী আছে প্রশ্ন এক, দুই ও তিন এবং এর থেকে আবার এক এ ফিরে যাওয়ার পথটাতে? আর আমি এই জায়গাটাতেই দাঁড়িয়ে আছি।
২৫ শে অক্টোবর, ১৯৮২
মিশেল ফুকো; জন্ম: ১৫ই অক্টোবর ১৯২৬, মৃত্যু: ২৫শে জুন ১৯৮৪.
ইংরেজী টেক্সটা নিচের ওয়েব পেজ-এ আছে:
http://www.thefoucauldian.co.uk/techne.htm
বুদ্ধিচর্চাকারীগণ এবং ক্ষমতা:
মিশেল ফুকো এবং গিলেজ দেল্যুজ-এর মধ্যে আলাপচারিতা
মিশেল ফুকো : একবার একজন মাওবাদী আমাকে বলেছিলেন যে, ‘আমি খুব সহজেই বুঝতে পারি সার্ত্রের আমাদের সাথে থাকার উদ্দেশ্যটা; আমি বুঝতে পারি তার লক্ষ্যগুলি এবং রাজনীতিতে তার অংশগ্রহণটাকে; আমি আপনার অবস্থানটাও কিছুটা বুঝতে পারি, যেহেতু আপনি বন্দিত্বের সমস্যা নিয়া সবসময় চিন্তিত আছেন। কিন্তু দেল্যুজ আমার কাছে একটা বিভ্রান্তি।’ আমি তার এই মন্তব্যে হতভম্ব, কেননা আপনার অবস্থান আমার কাছে সবসময় বিশেষভাবে স্পষ্ট মনে হয়েছে।
গিলেজ দেল্যুজ : সম্ভবত আমরা তত্ত্ব এবং বাস্তব প্রয়োগের একটা নতুন সম্পর্কের যে প্রক্রিয়া, তার অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে যাচ্ছি। একটা সময় মনে করা হতো যে, বাস্তব প্রয়োগ হচ্ছে তত্ত্বের একটা ব্যবহৃত রূপ, এরই একটা ফলাফল; আবার আরেকটা সময়ে, এর বিপরীত একটা ধারণা আছে এবং ভাবা হতো যে সেটা তত্ত্বকে উদীপ্ত করে, যা ভবিষ্যতের তত্ত্বের অবয়ব সৃষ্টি করার জন্য অপরিহার্য একটা বিষয়। যে কোনো ক্ষেত্রেই, তাদের সম্পর্ককে দেখা হতো একটা সামগ্রিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে এই প্রশ্নটাকে আমরা ভিন্নভাবে দেখছি। তত্ত্ব এবং বাস্তব প্রয়োগের বিষয়টা অনেক বেশি অসম্পূর্ণ এবং খন্ডিত। এক দিক দিয়ে, তত্ত্ব সবসময় স্থানীয় একটা ব্যাপার এবং সবসময় একটা সীমাবদ্ধ ক্ষেত্র নিয়া থাকে, কিন্তু এটা প্রযোগ করা হয় অন্য আরেকটা ক্ষেত্রের উপর, যা কম বেশি এর থেকে ভিন্ন। একটা তত্ত্বের ব্যবহারের সাথে যে সম্পর্ক তা কখনোই সাদৃশ্যমূলক না। আরো ভালোভাবে বলতে গেলে, যখন একটা তত্ত্ব তার সঠিক এলাকাতে প্রবেশ করে, তখন সে মুখোমুখি হয় বাধাগুলির, দেয়ালগুলির এবং অবরুদ্ধ-অবস্থাগুলির যার প্রয়োজন হয় অন্য ধরনের ডিসকোর্সগুলিতে রিলে করার জন্য (আর এটা অনান্য ডিসকোর্সে যাওয়ার মাধ্যমে ধীরে ধীরে অন্য আরেকটা এলাকায় প্রবেশ করে)। বাস্তব প্রয়োগ হচেছ একটা তত্ত্বীয় জায়গা থেকে আরেকটা জায়গায় যাওয়ার একটা রিলের ক্রম এবং তত্ত্ব হচ্ছে একটা প্রয়োগ থেকে আরেকটাতে যাওয়ার রিলে পথ। কোনো একটা দেয়ালের সম্মুখীন হওয়া ছাড়া কোনো তত্ত্ব তৈরি হতে পারে না আর বাস্তব প্রয়োগটা জরুরি সেই দেয়ালটাকে ছিদ্র করার জন্য। উদাহারণস্বরূপ, আপনার কাজ শুরু হয়েছিল বন্দিত্ব নিয়া তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে, বিশেষ করে উনবিংশ শতাব্দীর একটা পুঁজিবাদী সমাজে মানসিক হাসপাতালের কাজ-কর্মের প্রেক্ষিতে। তারপর আপনি সচেতন হয়ে উঠলেন সীমাবদ্ধ মানুষজনের তাদের নিজেদের নিয়ে কথা বলার প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে, একটা রিলে পথ তৈরি করার জন্য (আবার বিপরীতভাবে, এটাও সম্ভব যে, আপনার কাজ প্রথম থেকেই তাদের সম্পর্কে একটা রিলে হয়ে ছিল); আর সেই দলটা ছিল হাজতে-সেই মানুষগুলি ছিল কয়েদে। আর এই ভিত্তিতে আপনি সংগঠিত করলেন ইনফরমেশন গ্র“প অফ প্রিজনস (জি.আই.পি.)১, একটা জায়গা যেটা শর্তগুলি তৈরি করেেলা যাতে কয়েদীরা নিজেদের সর্ম্পকে কথা বলার অনুমতি পেলো। এটা বলা সম্পূর্ণ মিথ্যা হবে, যেমনটা মাওবাদী লোকটি বলেছেন যে, এই প্রাকটিসের মধ্যে দিয়ে আপনি আপনার তত্ত্ব প্রয়োগ করছেন। এটা একটা বাস্তব প্রয়োগ ছিল না কিংবা সংস্কারের জন্য বা সনাতন ভাবধারার প্রতি ইনকোয়ারির কোনো প্রজেক্ট ছিল না। এর গুরুত্বটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা বিষয় : একটা বিশাল বলয়ের মধ্যে রিলেগুলির একটা শৃঙ্খলা, অসংখ্য অংশগুলির মধ্যের একটা যারা একইসাথে তত্ত্বীয় এবং প্রায়োগিক। একজন তত্ত্বীয় বুদ্ধিচর্চাকারী, আমাদের জন্য, শুধুমাত্র একটা বিষয় নন, সজ্ঞানতার একটা প্রতীক অথবা একজন প্রতিনিধিত্বকারী। যে কাজ করে এবং সংগ্রাম করে সে আর প্রতিনিধিত্বকারী নয়, কোনো একটার মাধ্যমেও না, একটা গ্র“প অথবা একটা ইউনিয়ন যারা তাদের বিবেকের পক্ষে দাঁড়ানোটারে যথোপযুক্ত মনে করে। আর যে বলে আর কাজ করে? এটা সবসময় অসংখ্য একটা ব্যাপার, এমনকি একটা মানুষের মধ্যেও যে কথা বলে এবং কাজ করে। আমরা সবাই হচ্ছি ‘গ্র“পসকোলস’ (groupuscules)২। প্রতিনিধিত্বতা কখনোই বিরাজ করে না; এইখানে শুধুমাত্র ক্রিয়া আছে-তত্ত্বীয়-ক্রিয়া এবং প্রায়োগিক-ক্রিয়া, যা রিলেগুলি হিসাবে কাজ করে এবং নেটওর্য়াক তৈরি করে।
ফুকো : আমার কাছে মনে হচ্ছে যে, একজন বুদ্ধিচর্চাকারীর রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ঐতিহ্যগতভাবে দেখা হয়েছে তার কাজ-কর্মের দুইটা ভিন্নরূপের ফলাফল হিসাবে : বুর্জোয়া সমাজে একজন বুদ্ধিচর্চাকারী হিসাবে তার অবস্থান হিসাবে, অর্থাৎ পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা এবং যে ভাবাদর্শ এটা তৈরি করে বা চাপিয়ে দেয় (তার সুযোগ গ্রহণ, দারিদ্র, প্রত্যাখ্যান, যন্ত্রণা-ভোগ, নাশকতামূলক কাজ-কর্মের অভিযোগগুলি, দুষ্কর্ম ইত্যাদি) তার উপর; এবং তার যথোচিত ডিসকোর্স যদ্দুর পর্যন্ত একটা নির্দিষ্ট সত্যকে উন্মোচন করে, রাজনৈতিক সর্ম্পকগুলিকে অনাবৃত করে, যেখানে তারা অশঙ্কিত (unsuspected) ছিল। এই দুই ধরনের রাজনৈতিকীকরণ একটা আরেকটাকে বাদ দিয়া চলে না, সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের হওয়ার কারণে, তারা আবার সামঞ্জস্যপূর্ণও হয় না। কাউকে বলা হয় “বাদাইম্মা” (outcasts), আবার অন্যদের বলা হয় “সমাজতান্ত্রিক” (socialists)। কর্তৃত্বের অংশগুলির বিপক্ষে ভয়ংকর প্রতিক্রিয়ার সময়গুলিতে এই দুই ধরনের অবস্থানগুলি স্পষ্টভাবে বের হয়ে আসে : ১৮৪৮ সালের পরে, কমিউনের পরে, আবার ১৯৪০-এ। বুদ্ধিচর্চাকারীদের বাতিল করা হয় এবং যন্ত্রণা দেয়া হয় সেই যথার্থ সময়ে, যখন ঘটনাগুলি অখন্ডনীয় ছিল, যখন এটা নিষিদ্ধ ছিল বলা যে, রাজার গায়ে কোনো কাপড় নাই। বুদ্ধিচর্চাকারীরা তাদেরকে এই কথা বলত যারা তখনও তা দেখে নাই, তাদের নামে বলত, যাদের জন্য সত্য বলা নিষিদ্ধ ছিল : সে ছিল বিবেক, সচেতনতা এবং বাগ্মী। বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় অভ্যুত্থানের পর৩ বুদ্ধিচর্চাকারীরা আবিষ্কার করলো যে, জনসাধারণের পক্ষে জ্ঞান অর্জনের জন্য আর তাদের প্রয়োজন নাই : কোনোরকম বিভ্রম ছাড়াই তারা খুব ভালোভাবে জানে, তার চাইতে এবং তারা অনেক বেশি জানে এবং তারা নিজেদেরকে প্রকাশ করতে যথেষ্ঠই সক্ষম। কিন্তু এইখানে ক্ষমতার একটা শৃঙ্খল আছে, যা বাধা দেয়, নিষেধ করে, অকার্যকর করে এই ডিসকোর্সকে এবং এই ক্ষমতাকে, একটা ক্ষমতা যা শুধুমাত্র সেন্সরশিপের কর্তৃত্বের স্পষ্ট ধারাতেই পাওয়া যায় না, বরং একজন গভীরভাবে ও সূক্ষভাবে দেখতে পাবে সমগ্র সামাজিক নেটওর্য়াকের ভিতর। বুদ্ধিচর্চাকারীরা নিজেরাই এই ক্ষমতা শৃংখলার এক একজন এজেন্ট-তাদের “বিবেক”-এর প্রতি দায়িত্ববোধের ধারণাটা এবং ডিসকোর্স এই শৃঙ্খলার অংশ তৈরি করে। একজন বুদ্ধিচর্চাকারীর ভূমিকা আর তাকে এই জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করে না যে, “একটু এগিয়ে থাকে আর পক্ষে থাকে” জনগণের দমন করা সত্যকে প্রকাশ করার জন্যে; বরং তার সংগ্রাম হচ্ছে ক্ষমতার রূপগুলির বিপক্ষে যা তাকে তার (ক্ষমতার) অবজেক্ট হিসাবে পরিবর্তিত করে এবং বিভিন্ন বলয়ের, যেমন “জ্ঞান”, “সত্য”, “বিবেক” এবং “ডিসকোর্স”-এর উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করে।৪
এইভাবে দেখতে গেলে, তত্ত্ব কখনোই প্রকাশ করতে, অনুবাদ করতে বা সেবা দিতে পারে না বাস্তব প্রয়োগকে ব্যবহার করার জন্যে : এটা হচ্ছে বাস্তব প্রয়োগ। কিন্তু এটা স্থানীয় এবং আঞ্চলিক, যেমনটা আপনি বলছেন, কোনো সামগ্রিক বিষয় না। এটা ক্ষমতার বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধ, একটা যুদ্ধ যা উন্মোচন করতে চায় এবং দুর্বল করতে চায় ক্ষমতার ভিত্তিটাকে, যেখানে তাদের অবস্থান সবচেয়ে বেশি অনির্ণেয় এবং কুচক্রী। আমরা যেখানে যুদ্ধ করছি সেটা “বিবেক জাগিয়ে” তোলার কার্যক্রম না (জনগণ অনেক সময় বুঝতে পারে যে, সচেতনতা জ্ঞানেরই একটা রূপ; এবং আত্মনিষ্ঠতার দিক থেকে সচেতনতা বুর্জোয়াদেরই একটা বিশেষাধিকার), কিন্তু ক্ষমতাকে দুর্বল করার জন্যে, ক্ষমতা দখল করার জন্যে; এটা এমন একটা কার্যক্রম যা পরিচালনা করা হয় তাদের পাশাপাশি, যারা ক্ষমতার জন্যে লড়াই করে এবং একটা দূরত্বে থেকে তাদের অলংকার হিসাবে কাজ করে না। একটা “তত্ত্ব” এই সংগ্রামের একটা আঞ্চলিক শৃঙ্খলা।
দেল্যুজ : সংক্ষেপে, এইটা তা-ই। একটা তত্ত্ব হচ্ছে একটা বাক্সভর্তি যন্ত্রপাতি। এটা কী অর্থ বহন করে তা দিয়ে কিছু করার নাই। তাকে ব্যবহারযোগ্য হতে হবে। তার অবশ্যই কার্যক্ষমতা থাকতে হবে। সে শুধুমাত্র তার নিজের জন্যে না। কেউ যদি এটা ব্যবহার না করে, এর আবিষ্কর্তা থেকে শুরু করে যে কেউ (কে আর তখন তাত্ত্বিক হতে চাইবে!), তাহলে এই তত্ত্ব কোনো কিছুই না অথবা সময়টা তার জন্যে অনুপযুক্ত। আমরা একটা তত্ত্বকে পুনরায় লিখি না বরং নতুন করে তৈরি করি; আমাদের নতুন একটা তৈরি করা ছাড়া আর কোনো পথ থাকে না। এটা খুব আশ্চর্যজনক যে, প্র“স্ত, একজন লেখক, যিনি একজন খাঁটি বুদ্ধিচর্চাকারী হওয়ার কথা, খুব স্পষ্টভাবে এটা বলেছিলেন: আমার বইটাকে তুমি ধরে নাও একজোড়া চশমার মতো, যা দিয়ে তুমি বাইরেটাকে দেখবে; যদি এটা তোমার ভালো না লাগে আরেক জোড়া খুঁজে নাও; আমি এটা তোমার উপর ছেড়ে দিচ্ছি, তুমি নিজের মতো করে হাতিয়ার খুঁজে নাও, যেটা জরুরি তা হচ্ছে সংগ্রাম করার জন্য বিনিয়োগ করা। একটা তত্ত্ব কখনো সম্পূর্ণতা দান করে না; এইটা গুণনের (multiplication) একটা হাতিয়ার এবং এটা নিজেকেও মাল্টিপাই করে। ক্ষমতার প্রকৃতি সামগ্রিকতা আনতে চায় এবং এটা হচ্ছে আপনার অবস্থান। আর আমি আপনার সাথে সম্পূর্ণ একমত যে, তত্ত্ব প্রকৃতিগতভাবে ক্ষমতার বিপক্ষে। একটা তত্ত্ব যখন নিজেকে একটা নির্দিষ্ট পয়েন্টে জড়িয়ে ফেলে তখন তার সামান্যতম কোনো বাস্তবিক গুরুত্ব থাকে না যতক্ষণ পর্যন্ত না এটা অন্য আরেকটা ভিন্ন জায়গা দিয়ে বের হতে পারে। এইজন্যেই সংস্কারের ধারণা এতোটাই মূঢ় এবং ভন্ডামিপূর্ণ। সংস্কার প্রস্তাব করা হয় দুইটাভাবে, এটা তারা করে যারা এর প্রতিনিধিত্বকারী হতে চায়, যারা অন্যদের জন্যে কথা বলার একটা পেশা বেছে নেয়, তারা ক্ষমতার একটা ক্ষেত্ররে নেতৃত্ব দেয়, এই নতুন ক্ষমতার বিপণন করে যা অবদমনের মাত্রারে দিগুণ করে; অথবা তারা এটা করে তাদের সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ বা দাবি থেকে। এই পরবর্তী কারণটা একটা সংস্কার না বরং বিপ্লবী কাজ যা ক্ষমতার টোটালিটিটাকে এবং এর ক্ষমতা পরম্পরাটাকে প্রশ্ন করে (তার আংশিকতার পুরা রূপটাকে প্রকাশ করে)। এটা অবশ্যই হাজতে দেখা যায় : সবচেয়ে ক্ষুদ্র এবং গুরুত্বহীন হাজতীদের দাবিগুলিও প্লেভেনএর (Pleven's) সংস্কারকে পাংচার করে দিতে পারে।৫ যদি কিন্ডারগার্টেনে শিশুদের প্রতিবাদগুলি শোনা যেতো, তাদের প্রশ্নগুলিতে যদি মনোযোগ দেয়া হতো, সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থাকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করার জন্য তা যথেষ্ঠ ছিল। অস্বীকার করার কোনো উপায় নাই যে, আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় কোনো ধরনের সহনশীলতা নাই; এটা সবদিক দিয়েই এর চূড়ান্ত ভঙ্গুরতাকে প্রমাণ করে এবং তার প্রয়োজনে অবদমনের একটা বৈশ্বিক রূপায়ণকে প্রকাশ করে। আমার ধারণায়, আপনি-ই প্রথম, যিনি তার বইগুলিতে দেখিয়েছেন এবং প্রয়োগের ক্ষেত্রে শিখিয়েছেন যা সম্পূর্ণভাবে মৌলিক : অন্যদের জন্যে বলাটা অবমাননাকর (the indignity of speaking for others)। আমরা প্রতিনিধিত্ব করাটাকে কৌতুক করতাম এবং বলতাম যে, এটা শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু আমরা এই “তাত্ত্বিক” জিনিসটার রূপান্তরের একটা পরিণতি টানতে ব্যর্থ হয়েছি-সেই তাত্ত্বিক ঘটনাকে উপলব্ধি করতে যে, যারা সরাসরিভাবে জড়িত তারাই প্রাকটিক্যালি তাদের পক্ষ নিয়ে বলতে সক্ষম।
ফুকো : এবং যখন হাজতীরা বলতে শুরু করলো, হাজত সম্পর্কে, পেনাল সিস্টেম সম্পর্কে তখন তারা বিচার সম্পর্কে একটা ব্যক্তিগত তত্ত্ব হাজির করলো। এটা এমন একটা ডিসকোর্স, যার একটা চরম মূল্য আছে, হাজতীদের এই কাউন্টার ডিসকোর্সটা হচ্ছে ক্ষমতার বিপক্ষে একটা ডিসকোর্স, যাদেরকে আমরা দুষ্কৃতিকারী বলি-আর এটা দুষ্কৃতি সম্পর্কে কোনো তত্ত্ব না। হাজতের সমস্যাটা হচ্ছে স্থানীয় এবং প্রান্তিক সমস্যা : প্রতি বছর ১০০,০০০ লোকের বেশি হাজতে যায় না। ফ্রান্সে বর্তমানে ৩০০,০০০ থেকে ৪০০,০০০ লোক হাজতে আছে। কিন্তু এই প্রান্তিক সমস্যাটাই সবাইকে বিরক্ত করতেছে। আমি খুব আশ্চর্য হয়েছি যে, অনেক লোক যারা এর সাথে জড়িত না এই সমস্যাটার ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছেন, আরো আশ্চর্য হয়েছি যে, যারা এই ডিসকোর্সের ব্যাপারে কোনোদিন কিছু শোনে নাই তারাও এইটা খুব সহজেই বুঝতে পারছে। আপনি এটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? এটা কি এই কারণে না যে, পেনাল সিস্টেম হচেছ সেই রূপ যার মাধ্যমে ক্ষমতাকে সবচেয়ে পরিষ্কারভাবে দেখা যায়? একজনকে হাজতে রাখা, তাকে খাদ্য এবং উত্তাপের ব্যাপারে সীমিত করা, বাইরে যাইতে বাধা দেয়া, ভালবাসাবাসি করতে না দেয়া, ইত্যাদি-এইসবই হচ্ছে ক্ষমতা সর্ম্পকে কল্পনার সবচাইতে ক্ষিপ্ত এবং স্পষ্ট প্রকাশ। আরেকদিন আমি এক মহিলার সাথে কথা বলছিলাম, যে একসময় হাজতে ছিল আর শে বলছিল : “চিন্তা করো, আমি চল্লিশ বছর বয়সের একজন মহিলা, আর আমারে একদিন শুকনা রুটি খাওয়ার শাস্তি দিল।” এই গল্পের সবচে স্ট্রাইকিং বিষয় ক্ষমতার শিশুসুলভ প্রয়োগটা না বরং ক্ষমতাকে ক্ষমতা হিসাবে ব্যবহার করার হতাশাবাদ, সবচেয়ে প্রাচীন, তুচ্ছ, বালসুলভভাবে প্রয়োগ করার দিকটা। একটা বাচ্চা হিসাবে আমরা বুঝতে পারি, রুটি আর পানি কমিয়ে দেওয়া কী বোঝায়। হাজত হচ্ছে একমাত্র জায়গা, যেখানে ক্ষমতা তার নগ্ন রূপটাকে প্রকাশ করে, সবচেয়ে অপরিমিতভাবে করে আর সেইখানে ন্যায্যতা দেওয়া হয় নৈতিকতার ভিত্তিতে। “আমার অধিকার আছে তোমাকে শাস্তি দেওয়ার কারণ তুমি জান যে, কাউকে খুন করা বা ডাকাতি করা অপরাধ. . .” হাজতের ব্যাপারে সবচেয়ে মজার বিষয়টা হচ্ছে যে, ক্ষমতা এখানে নিজেরে আড়াল করে না বা কোনো মুখোশ পড়ে না; ক্ষমতা নিপীড়নের জন্য নিজেকে উন্মোচন করতে একদম পুঁচকে ঘটনাগুলিকেও ব্যবহার করে; এটা নৈরাশ্যবাদী আচরণ এবং একইসাথে শুদ্ধ এবং সম্পূর্ণভাবে “ন্যায্য”, কারণ এর প্রয়োগ পুরাপুরিভাবে নৈতিকতার ঘোরটোপের মধ্যে তৈরি করা। এর নিষ্ঠুর নিপীড়ন ক্রমাগতভাবে দেখানো হয় প্রশান্তভাবে খারাপের উপর ভালো’র এবং বিশৃঙ্খলার উপর শৃঙ্খলার বিজয় হিসাবে।
দেল্যুজ : হ্যাঁ এবং এর বিপরীতটাও একইভাবে সত্যি। শুধুমাত্র কয়েদীদেরকেই শিশু হিসাবে দেখা হয় না, আবার শিশুদেরকেও কয়েদী হিসাবে দেখা হয়। শিশুদেরকে একটা অপ্রাপ্তবয়স্কতার (infantilization) মধ্যে ঢুকানো হয়, যা তাদের কাছে অপরিচিত। এর ভিত্তিতে এটা অস্বীকার করা সম্ভব না যে, স্কুলগুলি হাজতের মতোই এবং কারখানাগুলি হচ্ছে এর কাছাকাছি একটা ব্যাপার। রেনাল প্ল্যান্ট (Renault plant) এ ঢোকার দিকটা একবার দেখেন অথবা এইরকম যে কোনো জায়গাতেই: দিনে ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য তিনটা টিকিট দেয়া হয়। আপনি আঠারোশ শতকে জেরেমি বেন্থামের (Jeremy Bentham) একটা লেখা পাবেন, হাজত-ব্যবস্থা সংস্কারের উপর; এই পদমর্যাদাসম্পন্ন সংস্কারের নামে প্রস্তাব করা হয় একটা বৃত্তাকার ব্যবস্থার, যেখানে পরিবর্তিত হাজতগুলি একটা মডেল হিসাবে কাজ করবে এবং যেখানে একজন আনুক্রমিকভাবে স্কুল থেকে কারখানায় যাবে, আবার কারখানা থেকে হাজতে যাবে, মানে এইভাবে চলতে থাকবে। এটা হচ্ছে সংস্কারের প্রণোদনা, প্রতিনিধিত্বের সংস্কারক । অন্যদিক থেকে দেখতে গেলে, যখন মানুষ নিজের জন্যে কথা বলা এবং কাজ করা শুরু করে, তখন তারা তাদের প্রতিনিধিত্বটা অস্বীকার করে না (যদি তার বিপরীতও হয়) অন্যের কাছে; তারা একটা নতুন প্রতিনিধিত্বের বিরোধিতা করে না, ক্ষমতার একটা ভুয়া প্রতিনিধিত্ব করার চাইতে। উদাহারণস্বরূপ, আমি আপনার একটা কথা মনে করতে পারছি যে, বিচারের বিপরীতে কোনো জনপ্রিয় বিচার নাই (there is no popular justice against justice), এখানে বোঝাপড়াটা অন্য একটা লেভেলে।
ফুকো : আমি মনে করি না এই ধারণাটা এতোটা সরল যে, মানুষ আরো ভালো এবং ন্যায়সঙ্গত বিচারের রূপ প্রত্যাশা করে বিচারব্যাবস্থা, বিচারক, আদালত এবং হাজতে; বরং বাইরে থেকে এবং এসব কিছুর আগে, একটামাত্র উপলব্ধি আছে যে, ক্ষমতা সবসময় জনগণের মূল্যে ব্যবহার করা হয়। বিচার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম তা হচ্ছে ক্ষমতার বিরুদ্ধে একটা সংগ্রাম এবং আমি মনে করি না যে, এটা বিচার ব্যবস্থার অন্যায়ের বিরুদ্ধে বা এই সংস্থাগুলির কর্মদক্ষতা বাড়ানোর কোনো সংগ্রাম। বিশেষ করে, এটা খুব স্ট্রাইকিং যে, দাঙ্গা-হাঙ্গামার এবং বিপ্লবের সময় বা রাষ্ট্রবিরোধী আন্দোলনগুলির সময় ক্ষমতার অনান্য সংস্থাগুলি যেমন অর্থনৈতিক সংগঠন বা সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি বিচার ব্যবস্থাকেও টার্গেট করা হয়। আমার হাইপোথিসিস-কিন্তু এটা একটা হাইপোথিসিস-ই-যে জনপ্রিয় আদালতগুলি, বিপ্লবের সময়গুলাতে যেটা দেখা যায়, নিন্ম মধ্যবিত্ত শ্রেণীদের একটা উপায়, যারা জনগণের মিত্র হিসাবে থাকে, যারা উদ্ধার করে এবং পুনরায় দখল করে বিচার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রচেষ্টাকে। এটা অর্জন করার জন্যে, তারা প্রস্তাব করে একটা আদালত ব্যবস্থার যেখানে ন্যায় বিচারের একটা সম্ভাবনা থাকে, যেখানে হয়ত রায় প্রদান করার একটা অভিনয় করা হয়। আদালতের আইনি ব্যবস্থার চিহ্নিত রূপটা আসলে বুর্জোয়া ভাবধারার ন্যায়ের মধ্যেই বিরাজ করে।
দেল্যুজ : আমাদের এই বাস্তব অবস্থার উপর ভিত্তি করে, ক্ষমতা প্রবলভাবে তৈরি করতে চায় একটা সম্পূর্ণ বা বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি। তার মানে, বর্তমান সময়ের সমস্ত ধরনের অবদমন (অভিবাসী শ্রমিকদের প্রতি জাতিগত অবদমন, কারখানাগুলিতে অবদমন, শিক্ষা ব্যবস্থাগুলিতে এবং তরুণদের প্রতি সাধারণ অবদমন) খুব সহজেই সাধারণীকরণ করা সম্ভব ক্ষমতার দৃষ্টিকোণ থেকে। আমাদের শুধুমাত্র ’৬৮ সালের মে’র প্রতিক্রিয়ার প্রেক্ষিতে এই রূপগুলির ঐক্য খুঁজতে যাওয়াটা ঠিক হবে না, বরং এটা আরো মানানসই হবে নিকট ভবিষ্যতের পূর্ণপ্রস্তুতি নিতে এবং তা সংগঠিত করতে, ফরাসী পুঁজিবাদ এখন নির্ভর করতেছে “প্রান্তিক” বেকারত্বের উপর এবং লিবারাল ধারণাটা ত্যাগ করছে এবং পুরা কাজ দেয়ার জন্য ভালো স্বৈরাচারের মুখোশ পরছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, আমরা সমস্ত ধরনের অবদমনের ঐক্যটা দেখা শুরু করতে পারি : অভিবাসীদের উপর বাধা-নিষেধ, যখন এটা স্বীকার করা হলো যে, সবচেয়ে কঠিন আর থ্যাংকলেস কজিগুলি করানো হয় অভিবাসী শ্রমিকদের দিয়ে-যা দিয়ে চলে কারখানাগুলির অবদমন, কারণ তা না হলে ফরাসীদের আবার শিখতে হবে, “স্বাদ” নিতে হবে ক্রমাগত কঠিন পরিশ্রম করার; তরুণদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং শিক্ষা ব্যবস্থায় অবদমন চলে, কারণ পুলিশী ব্যবস্থায় অবদমন অনেক বেশি কার্যকর থাকে যখন সেইখানে নতুন লোকের দরকার কম পড়ে। একটা বিশাল সারির পেশাজীবীদের (শিক্ষক, মানসিক চিকিৎসক, সব ধরনের শিক্ষাবিদ, ইত্যাদি) বলা হয় সেই কাজগুলি করার জন্য যা সনাতনভাবে পুলিশদের করার কথা। এ কথা আপনি অনেকদিন আগে অনুমান করতে পারছিলেন, এবং সেই সময়ে এটা অসম্ভব বলে ভাবা হয়েছিল : কাঠামোর ভিতর সমস্ত রকমের অবরোধগুলিকে কাজে লাগানো। ক্ষমতার বৈশ্বিক নীতির বিপরীতে আমরা চালু করছি প্রতি-উত্তর, বিচ্ছিন্ন লড়াই, সক্রিয় এবং সময়ে সময়ে নিবৃত্তিমূলক প্রতিরক্ষা। আমাদের এমন সামগ্রিকতা তৈরি করার কোনো দরকার নাই যা ক্ষমতার দিক থেকে অপরিবর্তনীয়ভাবে সামগ্রিক করা আছে; আমাদের যদি একই পথে যেতে হয়, তাহলে তা কেন্দ্রিকতার রূপের মতোই হবে এবং সেই একই পুরোহিত ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠা করবে। আমাদের অবশ্যই পার্শ্বিক সম্বন্ধ তৈরি করতে হবে এবং নেটওয়ার্কের একটা সম্পূর্ণ শৃঙ্খলা দাঁড় করাতে হবে এবং তা জনপ্রিয় ভিতগুলির উপর; আর এটা বিশেষভাবে কঠিন। কোনোভাবেই আমরা আর বাস্তবতাকে সংজ্ঞায়িত করতে পারি না প্রতিযোগিতার প্রথাগত ধারণার ভিতর একটা অবিরাম রাজনৈতিক ঘটনা হিসাবে এবং কমিউনিস্ট পার্টি বা জেনারেল ওর্য়াকার্স ইউনিয়ন(৬) এর প্রতিনিধিত্বকারীদের ক্ষমতার বিপনেন ভিতর। বাস্তবতা হচ্ছে যা সত্যিকারের অর্থে ঘটছে কারখানাগুলিতে, স্কুলগুলিতে, ব্যারাকগুলিতে, হাজতখানাতে আর পুলিশ ফাঁড়িগুলিতে। এই কাজগুলি অন্য ধরনের তথ্য নিয়া আসে সংবাদপত্রগুলিতে যা পাওয়া যায় না, তার চাইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু (এটা ব্যাখ্যা করে Agence de Press Liberation (৭) কী ধরণের তথ্য বহন করে)।
ফুকো: সংগ্রাম করার জন্য প্রয়োজনীয় পথগুলি আবিষ্কার করাটা কি কঠিন না, এই কারণে যে, আমরা ক্রমাগতভাবে এড়িয়ে চলছি ক্ষমতার সমস্যাটাকে? শেষ পর্যন্ত আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হয়েছে উনিশ শতক পর্যন্ত, শোষণের প্রকৃতি বোঝার আগ পর্যন্ত, এবং আজ পর্যন্ত আমাদের এখনো বোঝার বাকি আছে ক্ষমতার সব মিত্রশক্তিগুলিকে। হয়তো মার্কস এবং ফ্রয়েড আমাদের বোঝার ইচ্ছাটাকে পুরাপুরি সন্তুষ্ট করতে পারেন নাই, যেই বিভ্রান্তিকর জিনিসটাকে আমরা ক্ষমতা বলি, যা একইসাথে দৃশ্যমান আবার অদৃশ্য, চোখের সামনে আবার আড়ালে লুকানো, সর্বব্যাপী। সরকার সম্পর্কে তথ্যগুলি এবং তাদের নির্মাণকৌশলগুলির সনাতন বিশ্লেষণগুলি অবশ্যই সবক্ষেত্রগুলির কথা বলতে পারে না যে, কোথায় ক্ষমতার ব্যবহার করা হয় এবং কোথায় এটা কাজ করে? ক্ষমতার প্রশ্নটা থাকে একটা সম্পূর্ণ বিভ্রান্তি হিসাবে। কে ক্ষমতার ব্যবহার করে? এবং কোন ক্ষেত্রে তা করে? আমরা এখন অবশ্যই যুক্তিপূর্ণভাবে জানি কে অন্যদেরকে শোষণ করে, কে মুনাফাগুলি পায়, কোন কোন লোক এর সাথে জড়িত এবং আমরা জানি কীভাবে এইসব ফান্ডগুলি পুনরায় বিনিয়োগ করা হয়। কিন্তু ক্ষমতার ক্ষেত্রে . . . আমরা জানি যে, এটা তারা না যারা শাসন করে। কিন্তু, অবশ্যই “শাসকশ্রেণী”র ধারণাটা কখনোই যথেষ্ঠভাবে সূত্রবদ্ধ করা হয় নাই এবং অনান্য টার্মগুলিও, যেমন “কর্তৃত্ব খাটানো” . . . “বিচার করা” . . . “শাসন করা”, ইত্যাদি। এই ধারণাগুলি খুবই তরল এবং এদের বিশ্লেষণ প্রয়োজন। আমাদের আরো তদন্ত করা প্রয়োজন ক্ষমতার ব্যবহারের আরোপিত সীমাবদ্ধতাগুলি-যে রিলে পথের মধ্যে দিয়া সে ক্রিয়াশীল থাকে এবং মাঝে মাঝে তার প্রভাবের সীমানা ক্ষমতাক্রমের খুব অগুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলীর মধ্যেও এবং নিয়ন্ত্রণ, নজরদারী, নিষিদ্ধকরণ এবং বাধাগুলির রূপের মধ্যে। সবখানে, যেখানে ক্ষমতা বিরাজ করে, তার ব্যবহার করা হয়। কঠোরভাবে বলতে গেলে, ক্ষমতার অফিসিয়াল অধিকার কারোরই নাই; তারপরও এটাকে সবসময় সক্রিয় করা হয় একটা নির্দিষ্ট দিকে; কিছু লোককে একদিকে রেখে আবার কিছু লোককে অন্যদিকে রেখে। মাঝে মাঝে এটা যথাযথভাবে বলা মুশকিল যে, কে ক্ষমতাবান, কিন্তু এটা দেখা সহজ যে, কার ক্ষমতা নাই। যদি আপনার বইটা পড়া আমার জন্য প্রয়োজনীয় মনে হয় (অ্যান্টি-অডিপাস৮) সেটা এই কারণে যে, তারা এই সমস্যাটাকে অনেকদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে দিতে পারে : প্রাচীন অর্থের মানের ভিতর, চিহ্নিতকারী এবং চিহ্নিতের ভিতর, ইত্যাদি; আপনি ক্ষমতার প্রশ্নটাকে ক্ষমতার অসাম্যতাটাকে এবং তাদের সংগ্রামগুলিকে তৈরি করেছেন। প্রত্যেকটা সংগ্রাম একটা বিশেষ ধরনের উৎসকে ভরাট করছে (অসংখ্যের মধ্যে যে কোনো একটাকে, ছোট্ট উৎসগুলি-স্বল্প সময়ের বস, “এইচ.এল.এম.” এর ম্যানেজার, একজন কারারক্ষক, একজন বিচারক, একজন ইউনিয়নের প্রতিনিধিত্বকারী, সংবাদপত্রের এডিটর-ইন-চিফ)। আর উৎসগুলিকে নির্দিষ্ট করা-অভিযুক্ত করা এবং বলা-যদি সংগ্রামের একটা অংশ হয়ে থাকে, এর কারণ এটা না যে আগে কেউ জানতো না। বরং এই বিষয়ে এটা বলার কারণ, তথ্যের নেটওর্য়াকের সংস্থাগুলিকে শুনতে বাধ্য করা, নামগুলি বলা, দোষীদের দিকে আঙুল তোলা, টার্গেটগুলিকে খুঁজে বের করা; ক্ষমতার বিপরীতে প্রথম পদক্ষেপ এবং ক্ষমতার বর্তমান রূপগুলির বিরুদ্ধে সংগ্রামের দীক্ষা। যদি কারাগারে বসবাসকারীরা বা হাজতীদের ডাক্তারদের ডিসকোর্স নতুন ধরনের সংগ্রামের সূচনা করে, এর কারণ তারা বাজেয়াপ্ত করে, খুব অস্থায়ীভাবে হলেও তারা ক্ষমতাবান হাজতের পরিস্থিতি সর্ম্পকে বলার জন্য-বর্তমানে হাজতের প্রশাসনিক ব্যবস্থাগুলির একচেটিয়া সম্পত্তির উপর এবং সংস্কার গ্র“পগুলির ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সাথে। সংগ্রামের ডিসকোর্সটা অজ্ঞানতার বিপক্ষে না, বরং গোপনীয়তার বিরুদ্ধে। এটাকে একইরকম মনে হতে পারে; কিন্তু আমরা যা ধারণা করি, যদি তার চাইতে বেশি কিছু হয়? ভুলবোঝাবুঝির একটা পুরা ক্রম এই বিষয়গুলার সাথে জড়িত, যারা “সুযোগ-সন্ধানী” “অবদমিত” এবং “বলতে-না-পারা” এবং তার অনুমতি দেয় সস্তা “মনোসমীক্ষণ”কে সংগ্রামের সঠিক অবজেক্টগুলিকে ব্যাখ্যা করার জন্য। সম্ভবত এটা অপেক্ষাকৃত কঠিন, একটা অচেতন বিষয়ের চাইতে একটা গোপনীয় বিষয়কে উদঘাটন করা। সম্প্রতি দুইটা বিষয়ই ক্রমাগতভাবে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে যে, “লেখালেখি অবদমিত বিষয়গুলাকে তুলে ধরে” এবং আরেকটা বিষয় হচ্ছে “লেখালেখি অবশ্যই একটা নাশকতা মূলক কাজ” যা মনে হচ্ছে প্রতারণামূলক যা অনেক ক্রিয়ার ভিতর অনেকবারই অভিযুক্ত হওয়ার যোগ্যতা পাচ্ছে।
দেল্যুজ : আপনি যে সমস্যাটা উত্থাপন করলেন, তার প্রতি সম্মান রেখে বলছি : এটা খুব স্পষ্ট যে, কে শোষণ করে, কে মুনাফা বানায়, এবং কে শাসন করে, কিন্তু এইসব কিছুর পরেও ক্ষমতা এমন একটা কিছু যা সবদিকে ছড়িয়ে আছে। আমি একটা হাইপোথিসিস বলার ঝুঁকি নিবো : মার্কসিজম-এর প্রচেষ্টাটা ছিল স্বার্থের দিক দিয়ে আবশ্যিকভাবে বিবেচনা করে সমস্যাটাকে সংজ্ঞায়িত করা (শাসকশ্রেণী নিজেদের স্বার্থে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখে)। যে প্রশ্নটা সাথে সাথে আসে : যাদের স্বার্থ রক্ষা করা হচ্ছে না তারা কীভাবে বিরাজমান ক্ষমতা-ব্যবস্থাটাকে সমর্থন করবে, তাদের অংশের একটা কাজের দাবির মাধ্যমে? সম্ভবত এর কারণ বিনিয়োগের দিক থেকে, অর্থনৈতিক বা অচেতন যে কোনোভাবেই, স্বার্থটাই শেষ উত্তর না; এখানে বাসনার বিনিয়োগও আছে, যার ভূমিকা আরো বেশি গভীর এবং পরিব্যাপ্ত, আমাদের স্বার্থ যা নির্দেশ করে, তার চাইতে। কিন্তু অবশ্যই, আমরা ইচ্ছাকে স্বার্থের বিপরীতে দাঁড় করাই না, কারণ স্বার্থ সবসময় অনুসরণ করে এবং নিজেকে খুঁজে পায় যেখানে তার বাসনা আছে। আমরা চিৎকার করে রাইখ (Reich) বন্ধ করে দিতে পারি না: জনগণ বিভ্রান্ত না; একটা নির্দিষ্ট সময়ে তারা ফ্যাস্টিট শাসন চাইছিলো! ইচ্ছার একটা ভূমিকা আছে যা ক্ষমতার ছাঁচ তৈরি করে এবং তার বিপনন করে, এটাকে একজন পুলিশের জন্য যেমন সম্পত্তিতে পরিণত করে যেমন করে একজন প্রধানমন্ত্রীর জন্যেও; এই প্রেক্ষিতে, পুলিশের বা প্রধানমন্ত্রীর ব্যবহৃত ক্ষমতার মধ্যে কোনো গুণগত পার্থক্য নাই। একটা সামাজিক গ্র“পের ভিতর বাসনার এইসব প্রকৃতিগত বিনিয়োগগুলি ব্যাখ্যা করতে পারে শ্রেণীস্বার্থের কারণে রাজনৈতিক দলগুলি বা ইউনিয়নগুলি কী কারণে বিপ্লবী বিনিয়োগগুলি করে বা করতে পারে, যা বেশিরভাগ সময়ই সংস্কারমুখী বা পুরাপুরি প্রতিক্রিয়াশীল ইচ্ছার দিক থেকে।
ফুকো : আপনি যেমনটা বলেছেন যে, বাসনা, ক্ষমতা এবং স্বার্থের সম্পর্কটা অনেক বেশি জটিল আমরা স্বাভাবিকভাবে যা চিন্তা করি তার চাইতে, কিন্তু আবশ্যিকভাবে তাদের জন্য না যারা ক্ষমতার ব্যবহার করে, যাদের এটা সম্পাদন করার স্বার্থ থাকে; কিংবা তাদের জন্য যারা ক্ষমতা ব্যবহার করার জন্য স্বার্থ দান করে। তাছাড়া, ক্ষমতার ইচ্ছা, ক্ষমতা এবং স্বার্থের মধ্যে একটা অনন্য সর্ম্পক স্থাপন করে। ফ্যাস্টিট পিরিয়ডের সময় এটা হতে পারে যে, জনগণ চাইছিলো কিছু লোকের কাছে ক্ষমতা যাক, সেই লোকগুলিকে তারা চিনতে পারে নাই, যারা জনগণের বিরুদ্ধে ক্ষমতার প্রয়োগ করেছিলো এবং তাদেরকে নিজেদের বিনিময়ে এর মূল্য দিতে হয়েছে, তাদের মৃত্যুর বিনিময়ে, তাদের বিসর্জনের মাধ্যমে, তাদের গণহত্যার মাধ্যমে। তা সত্ত্বেও, তারা এই বিশেষ ক্ষমতাটা চাইছিলো; তারা চাইছিলো যে, এটা ব্যবহৃত হোক। বাসনা (desire) , ক্ষমতা এবং স্বার্থ-এর এই খেলাটা খুব একটা মনোযোগ পায় নাই। শোষণের বিষয়টা বুঝতে আমাদের অনেক সময় লেগেছিল; এবং ইচ্ছার ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার এবং এরও দীর্ঘ একটা ইতিহাস আছে। এটা সম্ভব যে সংগ্রামগুলি চলছে এবং স্থানীয়, আঞ্চলিক ও বিচ্ছিন্ন তত্ত্বগুলি এই সংগ্রামগুলি থেকে উদ্ভূত হচ্ছে, এবং যা তাদের অবস্থানের থেকে অবিচ্ছিন্ন এবং আমাদের আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে এইভাবে দাঁড়িয়ে আছে যার ভিতর ক্ষমতার চর্চা হয়।
দেল্যুজ : এই জায়গাটাতে এসে আমি আবার সেই প্রশ্নটাতে ফেরত যেতে চাই : বর্তমান সময়ের বিপ্লবী আন্দোলনগুলি বহুবিধ কেন্দ্র সৃষ্টি করছে এবং দুর্বলতা বা অপর্যাপ্ততার জন্যে না, যেহেতু একটা বিশেষ ধরনের সামগ্রিকতার ক্ষমতা তৈরি হচ্ছে এবং প্রতিক্রিয়ার জন্যে বাধ্য করছে। (দৃষ্টান্তস্বরূপ, স্থানীয় প্রতি-কৌশল হিসাবে ভিয়েতনাম একটা ভালো উদাহরণ)। কিন্তু আমরা কী করে নেটওর্য়াকগুলিকে সংজ্ঞায়িত করব, এইসব সক্রিয় এবং বিচ্ছিন্ন জায়গাগুলাকে, একটা দেশ থেকে আরেকটা দেশে অথবা একটা দেশের ভিতর?
ফুকো : আপনি ভৌগলিক বিচ্ছিন্নতার যে প্রশ্নটা তুলছেন, তা হয়তো এই অর্থটা বোঝায় : যখন আমরা শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করি, প্রলেতারিয়েতরা শুধুমাত্র সংগ্রামের নেতৃত্বই দেয় না বরং টার্গেটগুলিকেও ঠিক করে, তার পদ্ধতিগুলিকেও, জায়গাগুলিকে এবং সংঘর্ষের হাতিয়ারগুলিকে; এবং নিজেকে প্রলেতারিয়েতদের সাথে যুক্ত করার মানে তার অবস্থানগুলিকে, তাদের আদর্শকে এবং যুদ্ধ করার প্রবৃত্তিগুলিকে স্বীকার করা। তার মানে সম্পূর্ণ একটা চিহ্নিতকরণ। কিন্তু এই যুদ্ধটা যখন ক্ষমতার বিরুদ্ধে চালিত করা হয়, তখন যাদের উপর ক্ষমতার প্রয়োগ করা হয়েছিল তাদের ক্ষতির জন্যে, যারা এটাকে দুর্বিষহ মনে করবে, তারা নিজেদের ভূখন্ডে এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করতে পারে, তাদের নিজস্ব কাজ-কর্মের মাধ্যমে (অথবা তাদের নিষ্ক্রিয়তার মাধ্যমে)। একটা সংগ্রামে জড়িত হওয়া যেখানে তাদের নিজস্ব স্বার্থ জড়িত, যার উদ্দেশ্যগুলি স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে এবং যার পদ্ধতিগুলি তারা নিজেরা ঠিক করতে পারছে, তখন তারা একটা বিপ্লবী প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করছে। তারা স্বাভাবিকভাবেই নিজেরা প্রলেতারিয়েতদের মিত্র হয়ে যাচ্ছে; কেননা ক্ষমতা ব্যবহার করা হয় এমন একটা ভাবে যেখানে পুঁজিবাদী শোষণ বজায় রাখা হয়। তারা সত্যিকারভাবে প্রলেতারিয়েতদের কারণকে সমর্থন করে এসব জায়গাগুলিতে যুদ্ধ করার মাধ্যমে, যেখানে তারা নিজেদেরকে শোষিত হিসাবে দেখতে পায়। নারী, হাজতীরা, জোর করে সেনাবাহিনীতে নেয়া সৈন্যরা, হাসপাতালের রোগীরা এবং সমকামীরা এখন একটা বিশেষ ধরণের সংগ্রাম শুরু করছে ক্ষমতার বিশেষায়িত দিকটার বিপরীতে, যে বাধাগুলি এবং নিয়ন্ত্রণগুলি তাদের উপর চাপানো হয়েছিল তার বিরুদ্ধে। এই ধরনের সংগ্রামগুলি আসলে বিপ্লবী আন্দোলনগুলির সাথে জড়িত, যেদিক থেকে তারা মৌলিক, আপোসহীন এবং অ-সংস্কারমুখী, এবং একই ক্ষমতার নতুন কোনো বিন্যাসের চেষ্টাকে তারা অস্বীকার করে, অন্তত, প্রভুর পরিবর্তনকেও। আর এই আন্দোলনগুলি প্রলেতারিয়েতদের বিপ্লবী আন্দোলনগুলির সাথে সম্পর্কিত যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নিয়ন্ত্রণগুলির এবং সীমাবদ্ধতাগুলির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যা ক্ষমতার একই ব্যবস্থাকে সেবা করে।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে, সংগ্রামটার যে পুরা চিত্র আমরা পাই, সেটা আপনি প্রথমে যে টোটালাইজেশন-এর কথা বলেছিলেন তা না, এই তাত্ত্বিক টোটালাইজেশনটা তৈরি হচ্ছে একটা “সত্য”-এর ভানের ভিতর। সংগ্রামটার সাধারণ রূপটা বিশেষভাবে বের হয়ে আসছে ক্ষমতা ব্যবস্থার নিজের ভিতর থেকে, ক্ষমতা যেখানে ব্যবহার করা হয় এবং প্রয়োগ করা হয় তার সমস্ত রূপ থেকে।
দেল্যুজ : আর এখানে এসে আমরা কোনো ধরনের প্রয়োগই করতে পারি না তার বিস্তৃত চরিত্রটাকে উন্মোচন না করে, যাতে আমরা অপরিহার্যভাবে নেতৃত্ব দিতে পারি-সবচেয়ে তাৎপর্যহীন দাবি-দাওয়ার ভিত্তিতেও - তার ইচ্ছাটাকে সম্পূর্ণভাবে উপড়ে ফেলতে পারি। প্রত্যেকটা বিপ্লবী আক্রমণ অথবা প্রতিরক্ষা, আংশিকভাবে হলেও, এইভাবে, শ্রমিকদের সংগ্রামের সাথে যুক্ত।
পাদটীকা:
১. "Groupe d'information de prisons": ফুকোর সাম্প্রতিক সময়ের দুইটা পাবলিকেশন (I, Pierre Riviere and Surveiller et Punir) এই সঙ্গ থেকে এসেছে।
২. উপরের বইয়ের-ই কথা; পৃষ্টা ১৮৫.
৩. মে ১৯৬৮, “মে মাসের ঘটনাবলী” হিসাবে খ্যাত।
৪. L'Ordre du discours তে দেখুন, পৃষ্টা. ৪৭-৫৩.
৫. রেনে প্লেভেন (Rene Pleven) ১৯৫০ এর প্রথম দিকে ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
৬. "Confederation Generale de Travailleurs."
৭. লিবারেশন নিউজ এজেন্সী ।
৮. Nietzsche et la Philosophie (Paris: P.U.F., ১৯৬২) and Capitalisme et schizophrenie, ভলিউম.১, অ্যান্টি-অডিপাস ফেলিক্স গুট্টেরীর সাথে সহলেখক হিসাবে প্রকাশিত (Paris: Editions de Minuit, ১৯১২).
৯. à Loyer Modéré এর বাসস্থান - মোটামুটি দামের ভাড়া বাসা।
________________________________________________________
বাংলা অনুবাদের নোট:
ইংরেজী ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ শব্দটার বাংলা ‘বুদ্ধিজীবি’ বলতে আমি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না, বলা যায় সঠিক বলেও মনে হয় না। কারণ এতে পেশার একটা ব্যাপার আবিশ্যিকভাবে ধরে নেয়া হয়, শব্দটার ভিতর, যা সবসময় একই ঘটনা বলে আমার মনে হয় না, বরং এর সাথে চর্চার একটা ব্যাপার বেশি জড়িত বলে আমার ধারণা। এইক্ষেত্রে ‘বুদ্ধিজীবি’ শব্দটাকে এড়াতে গিয়াই বুদ্ধিচর্চাকারী, তবে ‘ইন্টেলেক’ বিষয়টাকে শুধুমাত্র ‘বুদ্ধি’ দিয়া সীমিত করা হৈছে কিনা, সেই প্রশ্নটাও আছে। আমার ধারণা, ‘বুদ্ধিচর্চাকারী’র চাইতেও ভালো বাংলা হওয়া সম্ভব।
যখনই তত্ত্ব এর প্রসঙ্গ আসে, তখনই প্রশ্ন আসে যে, কে তত্ত্ব প্রণয়ন করেন আর যিনি করেন তিনি কি একজন বুদ্ধিচর্চাকারী? একজন বুদ্ধিচর্চাকারীর দায়িত্বটা কি? সে কি জনগণের পক্ষে সত্য কথা প্রচার বা জানাবে যে, ‘সত্য’ কি? ফুকো এবং দেল্যুজ দুইজনেই একমত যে, বুদ্ধিচর্চাকারীর সেই ভূমিকাটা নিবার কোন দরকার নাই, কারণ তারা নিজেরাই হয়া উঠতে পারেন বা হয়া উঠছেন ‘ক্ষমতার এক একজন এজেন্ট’। বরং একজন বুদ্ধিচর্চাকারীর ভূমিকা হচ্ছে ক্ষমতার গোপন জায়গাগুলিকে চিহ্নিত করা, যেখানে সে অপারেট করে এবং নিয়ন্ত্রণ কাঠামোকে প্রতিষ্ঠা করে। সেইক্ষেত্রে একা তত্ত্ব কোন অর্থই তৈরি করে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তা, বাস্তবে ব্যবহারযোগ্য হিসাবে আর্বিভুত হচ্ছে।
তাদের চিন্তার মিল যেমন আছে, তেমনি অমিলটাও অস্পষ্ট না। দেল্যুজ যারে বলতে চাইতেছেন ডিজায়ার বা বাসনা, ফুকো তারে বলতে চান, প্লেজার বা আনন্দ বলে। যেমন, ক্ষমতার একটা আনন্দ আছে। আবার দেল্যুজ এর ডিজায়ার কোন রেটরিক জিনিস না। লাঁকা এবং দেল্যুজের ‘ডিজায়ার’ও একই জিনিস না। লাঁকা যেখানে ডিজায়ারকে আবিষ্কার করেন, একটা ঘাটতি হিসাবে সেখানে দেল্যুজ তারে দেখতে চান একটা প্রক্রিয়া হিসাবে। ফুকো’র কথামতো মনে হয় যে, তিনি আসলে দেল্যুজের ‘ডিজায়ার’কে ‘প্লেজার’ দিয়া পরিবর্তিত করতে চান। কিন্তু ফুকোর বিশ্লেষণে ক্ষমতা যেমন একটা কেন্দ্রীয় মনোযোগ একইভাবে দেল্যুজের ক্ষেত্রে সেই বিষয়টা সম্ভবত মানুষ একটা ডিজায়ার মেশিন হিসাবে। মানে, এই নিয়া আসলে আরো অনেক আলাপ আছে!
আমার ধারণা, আমাদের দেশে অনেকেই ফরাসী দার্শনিকদেরকে চিন্তার কোট করেন; কিন্তু তাদের লেখাপত্র সাধারণের আওতায় নিয়া আসার কোন কোশিশ করেন না, কেন করেন না সেইটা আমার কাছে মাঝে মাঝে আজবই লাগে। কারো মতো কৈরা কথা বলার চাইতে বা কারো কথা কোট করার চাইতে তার কথাটারে বৈলা দেয়াই তো ভালো; বরং এর থিকা নতুন কোনো চিন্তা-ভাবনার সূত্রপাত হৈতে পারে। আর ফুকো এবং দেল্যুজ এর এই কথা-বার্তা সেই নতুন চিন্তা-ভাবনার জন্য একটা ভালো উপাদান।
ফুকো এবং দেল্যুজ এর মধ্যে এই কথা-বার্তাগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হৈছে আমার কাছে, এই কারণে যে, এই কথা-বার্তাটা কিছু বিষয়কে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করে এবং প্রেক্ষাপটকে বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়া সামনে আগানোর পথগুলিকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেন; যেখানে, তত্ত্বচিন্তা ও প্রায়োগিকতার সর্ম্পকটাকে তার ব্যাখ্যা করেন এবং তাদের স্বরূপ ও সর্ম্পকটাকে নতুন জায়গায় নিয়া আসেন।
এই আলাপচারিতা সম্পর্কে বলা যায়, ফুকো এবং দেল্যুজ দুইজনে ঘনিষ্ঠ লোক ছিলেন, একসাথে বেশ কিছু কাজও করছেন। দ্জুনেই বলা যায় ছিলেন, অ্যাকাডেমিক গুরু। দেল্যুজের একটা বইয়ের উপর আলোচনা লিখতে গিয়া ফুকো বলছিলেন যে, ‘হয়তো একদিন এই শতাব্দীকে বলা হবে দেল্যুজিয়ান শতাব্দী।’ এই সার্টিফিকেট এর উল্লেখ মোটামুটি দেল্যুজের সব বইয়ের পিছনেই দেয়া থাকে। আর ১৯৮৪ সালে ফুকো মারা যাওয়ার পর দেল্যুজ তার উপর একটা বই লেখেন এবং দেল্যুজ বিভিন্ন জায়গায় ফুকোর বিষয়গুলিকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছেন।
এই আলাপটা রেকর্ড করা হয় ১৯৭২ সালের ৪ঠা মার্চ; এবং এটা ছাপা হয় লার্ক-এর (খ'অৎপ) ৪৯ নম্বর সংখ্যায়, পৃষ্ঠা ৩-১০; যে সংখ্যটা করা হৈছিল দেল্যুজের উপর। লিখাটা লার্ক-এর পারমিশন নিয়া রিপ্রিন্ট করা হয় ইন্টারঅ্যাক্টিভিস্ট নামে একটা ওয়েব সাইটে (যঃঃঢ়://রহভড়.রহঃবৎধপঃরারংঃ.হবঃ/ধহধষুংরং/০৩/০১/১৩/০০৫৬২০০.ংযঃসষ)। বাংলা অনুবাদের ক্ষেত্রে সেই ইংরেজীটাই নেয়া হৈছে। এর ফুটনোটগুলি লার্ক-এর সম্পাদকের দেয়া।
বাংলা অনুবাদটা প্রথম প্রচারিত হয় কবিসভা নামে একটা ওয়েব গ্র“পে, সম্ভবত ২০০৬ খ্রীষ্টাব্দের জুন মাসে এবং দৈনিক সমকালের সাহিত্য পাতা কালের খেয়াতে ছাপা হয় ২০০৭ খ্রীষ্টাব্দের প্রথম দিকে।
আমি সিংহের ইতিহাস লিখতে চেয়েছিলাম
চিনুয়া আঁচেবে
ভাষান্তর: বিদ্যুত খোশনবীশ
[পরিচিতি: আফ্রিকান সাহিত্যের কিংবদন্তী, সদ্য প্রয়াত (২০ মার্চ ২০১৩) ঔপন্যাসিক চিনুয়া আঁচেবের জন্ম ১৯৩০ সালে পূর্ব নাইজেরিয়ায়। তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয় স্থানীয় একটি পাবলিক স্কুলে এবং তিনি দেশটির ইবাদান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম গ্র্যাজুয়েটদের একজন। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর আঁচেবে নাইজেরিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন-এ রেডিও প্রোডিওসার হিসেবে যোগ দেন এবং পরে বহিঃস¤প্রচার বিভাগের পরিচালক পদে নিযুক্ত হন। এ সময়েই তাঁর লেখক জীবনের শুরু।
আঁচেবের প্রথম উপন্যাস The Things Fall Apart ১৯৫৮ সালে, No Longer at Ease ১৯৬০ সালে, Arrow of God ১৯৬৪ সালে, A Man of the people ১৯৬৬ সালে এবং Anthills of Savannah প্রকাশিত হয় ১৯৮৭ সালে। চিনুয়া আঁচেবে ছিলেন সাহিত্য ম্যাগাজিন Okike’র সম্পাদক এবং The Heinemann Series on African Literature এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অর্জন করেন পঁচিশটি সম্মানজনক ডক্টরেট ডিগ্রি। আধুনিক আফ্রিকান সাহিত্যের জনক বলে খ্যাত চিনুয়া আঁচেবে তার The Things Fall Apart উপন্যাস ও সাহিত্যে অসাধারণ অবদানের জন্য ২০০৭ সালে ভূষিত হন Booker International Prize-এ।
বিশ্বখ্যাত সাময়িকী The Paris Review এর পক্ষ থেকে Jerome Brooks চিনুয়া আঁচেবের এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছিলেন ১৯৯৫ সালে। তাঁর স্মরণে এই দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটি কিছুটা সংক্ষিপ্ত করে তুলে ধরা হলো। ]
প্যারিস রিভিউ: আপনি কি আমাদের আঁচেবে পরিবার, ইবো গ্রামে আপনার বেড়ে উঠা এবং আপনার প্রথম জীবনের শিক্ষা সম্পর্কে কিছু বলবেন? তাছাড়া ঐ গ্রামে এমন কিছু কি ছিল যা আপনাকে লিখতে অনুপ্রাণিত করেছে?
আঁচেবে: সত্যিকার অর্থে গল্পের প্রতি আকর্ষণই লেখালেখির দিকে আমাকে টেনে এনেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না আকর্ষণটা গল্প লেখার প্রতি ছিল না। তাছাড়া ঐ গ্রামে তেমন কিছু করাও ছিল অসম্ভব। শুধু জানতাম আমি গল্প ভালোবাসি। আমাদের বাড়িতেই গল্প বলার প্রচলন ছিল। আমার মা গল্প বলতেন, বড় বোনও গল্প বলতেনÑ যেমন ধরুণ কচ্ছপের গল্প। আলাপচারিতার মধ্যে থেকে সামান্য হলেও আমি গল্প খুঁজে নিতাম। বাবার কাছে অতিথি এলে আমি আশেপাশে ঘুরঘুর করতাম কিংবা পাশে গিয়েই বসে থাকতাম। এরপর যখন স্কুলে যাওয়া শুরু করলাম পাঠ্য গল্পের প্রতি আমার ভালোবাসা জন্ম নিল। যদিও ওগুলো একটু ভিন্ন ধাচের ছিল, তারপরও আমি ভালোবাসতাম। নাইজেরিয়া থাকাকালে আমার বাবা-মা ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টান হন। তারা শুধু ধর্মান্তরিতই হননি, বাবা ছিলেন গসপেল প্রচারক ও ধর্মীয় শিক্ষক। আমার বাবা ও মা গসপেল প্রচার করতে গিয়ে প্রায় ৩৫ বছর ইবোল্যান্ডের বিভিন্ন অংশে ভ্রমণ করেছেন। আমি ছিলাম তাদের ছয় সন্তানের মধ্যে পঞ্চম। এভাবেই আমি বেড়ে উঠছিলাম আর ততোদিনে বাবা অবসর নিয়ে নিজ পিতৃপুরুষের গ্রামে ফিরে এলেন। পড়তে শিখার পর আমি বিচিত্র সব মানুষ ও দেশের গল্পের সাথে পরিচিত হলাম। আমাকে তখন যে বিষয়গুলো মুগ্ধ করেছিল কোন একটি প্রবন্ধে আমি সেগুলোর কথা উল্লেখ করেছি। অপার্থিব বস্তু এমনকি সেই জাদুকরের কথাও যে কিনা একটি প্রদীপের জন্য আফ্রিকা থেকে চীন পর্যন্ত গিয়েছিল। এগুলো ছিল চমকপ্রদ। আমি আরো বড় হয়ে উঠলাম এবং অ্যাডভেঞ্চার পড়া শুরু করলাম। তখনো আমি জানতাম না, আমাকে সেই বর্বরদের পক্ষ নিতে হবে যাদের বিরুদ্ধে কিছু সাহসী শেতাঙ্গ অবস্থান নিয়েছিল। আমি সহজাতভাবেই শেতাঙ্গদের পক্ষ নিয়েছিলাম। তারা খুব ভাল ছিল! চমৎকার মানুষ ছিল! বুদ্ধিমান ছিল। কিন্তু অন্যরা তেমন ছিল নাÑ তারা ছিল মূর্খ ও কুৎসিত। আর এভাবেই আমার পরিচয় ঘটেছিল নিজেদের গল্প না থাকার বিপদের সাথে। একটা প্রবাদ আছেÑ যতদিন সিংহরা তাদের ইতিহাস না লিখবে, ততোদিন শিকারের ইতিহাস শিকারিকেই মহিমান্বিত করবে। আমার এ উপলব্ধি হয়েছিল তবে অনেক দেরিতে। আমি বুঝতে পারলাম আমাকে লেখক হতে হবে। আমাকে ইতিহাসবিদ হতে হবে। এটা একজন মাত্র মানুষের কাজ নয়। এটা একক কোন ব্যক্তির কাজ নয়। এটা এমন কিছু যা আমাদেরই করতে হবে, যাতে শিকারের কাহিনীতে ফুটে উঠে যন্ত্রণা, সংগ্রাম এবং এমনকি সিংহের বীরত্বও।
প্যারিস রিভিউ: আপনি বিখ্যাত ইবাদান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম গ্র্যাজুয়েটদের একজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুর বছরগুলো কেমন ছিল এবং আপনি সেখানে কোন বিষয়ে অধ্যয়ন করেছেন? আপনার লেখালেখির সাথে বিষয়টার সম্পর্ক কতটুকু?
আঁচেবে: পিছন ফিরে তাকালে বলতে হয়, ইবাদান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান। এটি ঔপনিবেশিকতার দ্বৈতরূপ উন্মোচন করেছিল। কারণ ইবাদান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নাইজেরিয়ায় ব্রিটিশ উপনিবেশের সমাপ্তির প্রাক্কালে। যদি ব্রিটিশদের কোন ভাল কাজ থেকে থাকে তবে ইবাদান তার একটি। এটি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কলেজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, কারণ ব্রিটিশদের অধীনে আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মত কিছু করতে পারেন না। আপনাকে অন্যের উপাঙ্গ হিসেবেই যাত্রা শুরু করতে হবে। আর তাদের অভিভাবকত্বের একটি পর্যায়ও আপনাকে পাড়ি দিতে হবে। তাই এটা ছিল লন্ডন-ইবাদান বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। তাই বলা চলে আমি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ডিগ্রি নিয়েছি। প্রতিষ্ঠানটি এভাবেই গড়ে উঠেছিল। আর ইবাদানের পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হওয়াটা ছিল স্বাধীনতার আগাম বার্তা।
আমি বিজ্ঞান দিয়ে শুরু করেছিলাম, পরে ইংরেজি, ইতিহাস ও ধর্মের উপর পড়াশুনা করেছি। এই বিষয়গুলোকে আমার কাছে খুব উত্তেজক ও কার্যকর মনে হয়েছে। ধর্ম অধ্যয়ন করা ছিল আমার জন্য নতুন ও আকর্ষণীয়। কারণ শুধু খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্বই নয়, পশ্চিম আফ্রিকার ধর্মগুলোও আমাদের পড়তে হয়েছে। বর্তমানে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরিটাস অধ্যাপক এবং আমার তৎকালীন শিক্ষক ড. পারিনদার ছিলেন এ বিষয়ে অগ্রনায়ক। তখনই প্রথমবারের মত আমি আমার পদ্ধতিসহ অন্যান্য পদ্ধতিগুলোর তুলোনামূলক পর্যবেক্ষণের সুযোগ পেয়েছিলাম। জেমস ওয়েলচ নামক আরো একজন অধ্যাপকের সাথে আমি পরিচিত হই। তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ মানুষ। ইবাদানে আসার আগে তিনি রাজা ষষ্ঠ জর্জ ও বিবিসি’র ধর্ম যাজক হওয়াসহ প্রায় সব ক্ষমতারই স্বাদ নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন বাগ্মী ধর্ম প্রচারক। কোন এক অনুষ্ঠানে তিনি আমাকে বলেছিলেন, তোমার যে শিক্ষা প্রয়োজন কিংবা তুমি যে শিক্ষা চাও আমরা হয়তো তা দিতে পারবো না। তোমাকে শুধু ততটুকু শিখাতে পারবো যতটুকু আমরা জানি। তিনি ছিলেন চমৎকার একজন মানুষ আর ওটাই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা। এ ধরনের মনোভাব অর্জন করা ছাড়া সত্যিকার অর্থে আমার যে শিক্ষা প্রয়োজন ছিল আমি সেখানে তা পাইনি। আমাকে আমার নিজের মত করেই চলতে হয়েছে। যেমন, আমি ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের কথা বলতে পারি। তাদের মধ্যে কেউ একজন লেখক হতে চায় একথা শুনে প্রায় সবাই হাসাহাসি করতো। আসলে এভাবে তখনো কেউ চিন্তা করতে শেখেনি। একবার আমাদের ডিপার্টমেন্ট থেকে ঘোষণা করা হলো, পরবর্তী ছুটিতে একটি ছোট গল্প লিখে আনতে হবে এবং শ্রেষ্ঠ গল্পের জন্য পুরস্কার দেয়া হবে। সে সময়ের আগে আমি কখনো ছোটগল্প লিখিনি। কিন্তু বাড়িতে গিয়ে গল্প লিখলাম এবং জমাও দিলাম। বেশ কয়েকমাস পর নোটিশ দিয়ে জানানো হলো কোন গল্পই মানসম্মত হয়নি তাই পুরস্কার দেয়া হবে না। তবে নোটিশে বলা হয়েছিল আমার গল্পটি উল্লেখ করার দাবি রাখে। বুঝতেই পারছেন তখনকার দিনে ইবাদানের এমন মন্তব্য যথেষ্ট উঁচু দরের ছিল। পরবর্তীতে আমি সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের কাছে আমার গল্পের ভুল-ত্র“টি জানতে চেয়েছিলাম কিন্তু নানা অজুহাতে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যেতেন। অবশ্য দীর্ঘদিন পর তিনি বলেছিলেন আমার গল্পে কোন ভুল ছিল না। আমি এভাবেই ছোটগল্প লেখা শিখেছিলাম। বুঝতে পারলাম আমাকে নিজের মত করেই চলতে হবে।
প্যারিস রিভিউ: বিশ্ববিদ্যালয় পেড়োবার পর আপনি নাইজেরিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনেই কর্মজীবন শুরু করেছিলেন।
আঁচেবে: অধ্যাপক ওয়েলচ এর সহযোগিতায় আমি ওখানে কাজ শুরু করেছিলাম। তিনি আমাকে ক্যাম্ব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে স্কলারসিপ পাইয়ে দেবার চেষ্টা করেছিলেন, তবে কাজ হয়নি। তাই নাইজেরিয়ায় সদ্য প্রতিষ্ঠিত স¤প্রচার বিভাগে যোগ দেই। সেখানে অধিকাংশই ছিল বিবিসি’র লোকজন। মূলতঃ শুরুটা এভাবেই হয়েছিল। আমি তখন স¤প্রচার নিয়ে মোটেই ভাবিনি। কলেজ ছেড়ে যাবার সময় আমার কোন ধারনাই ছিল না আমি কী করবো। একালের শিক্ষার্থীদের নিয়ে ভাবলে আমি অবাক হয়ে যাই, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিন থেকেই তারা জানে নিজেরা কী হতে যাচ্ছে। আমরা জানতাম না। আমরা শুধু সামনে চলেছি। আমরা শুধু জানতাম, একটা উপায় হবেই। সৌভাগ্যবশত হয়েছিলও তাই। সংখ্যায় আমরা খুব একটা বেশি ছিলাম না। আজকের দিন হলে সেরকম কিছু করা অসম্ভব হতো এবং টিকেও থাকা যেত না। তাই আমি স¤প্রচার বিভাগে যোগ দিয়েই আবিস্কার করলাম, সেখানকার পরিবেশ আমার জন্য যথেষ্ট সহায়ক, ঠিক যেমনটা আমি চেয়েছিলাম। প্রথমে স্ক্রিপ্ট, পরে বিভিন্ন ব্যক্তিদের ভাষণ এবং সবশেষে ছোটগল্প সম্পাদনা করতে থাকলাম। সত্যিকার অর্থে এভাবেই আমি ছোটগল্প সম্পাদনা ও প্রকাশনার কাজে প্রবেশ করেছিলাম। সদ্য স্বাধীন দেশে সবকিছুই খুব দ্রুত ঘটছিল। আমার পদোন্নতি হয় এবং এই চমৎকার কাজটি ছেড়ে নির্বাহী পদে যোগ দেই।
প্যারিস রিভিউ: আপনার প্রথম দুটি বই Things Fall Apart ও No Longer at Ease এর শিরোণাম আধুনিক আইরিশ ও আমেরিকান কবিদের কাছ থেকে ধার করা। পল মার্শাল এর মত অন্যান্য কৃষ্ণাঙ্গ লেখকরাও ইয়েটস এর কাছ থেকে ধার করেছিলেন। আমার ধারনা, ইয়েটস ও ইলিয়টÑ দুজনই আপনার প্রিয় কবি।
আঁচেবে: ঠিক তাই। তাঁরা দুজনেই আমার প্রিয় কবি। আসলে আমি আর কোন লেখাতেই এরকম করিনি। যেমনটা বলেছি, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমি সাধারণ ডিগ্রি নিয়েছি এবং ইংরেজি ছিল তার একটা অংশ মাত্র। আর আপনাকে তার তো একটা প্রমাণ দিতেই হবে, তাই নয় কি? তবে বেপরোয়া আইরিশ কবি ইয়েটসকে আমি পছন্দ করতাম। তাঁর কাব্যের প্রবহমানতা এবং ভাষার প্রতি ভালোবাসাকে আমি সত্যিই পছন্দ করতাম। যদি তাঁর ভাবাবেগের কথা বলি তবে বলবো, তিনি ঠিক জায়গাতেই ছিলেন। তাঁর মধ্যে হয়তো একগুঁয়েমি ছিল কিন্তু তার হৃদয় সঠিক স্থান থেকে বিচ্যুত হয়নি। তিনি চমৎকার কবিতা লিখেছেন। তাঁর কবিতার মধ্যে সেই জাদু ছিল যে জাদু আমি আমার ছোট বেলার জাদুকরের মধ্যে দেখেছিলাম। যা কিছুই আকর্ষণীয় মনে হয়েছে কিংবা আমার ভাবনায় যখন যা কিছু এসেছে আমি সেগুলো দিয়েই কিছু বাক্য লিখে ফেলতাম। আর ইয়েটস ছিল আমার কাছে তেমনই এক ব্যক্তিত্ব। তাই Things Fall Apart শব্দগুলো আমার কাছে সঠিক ও যথার্থই মনে হয়েছে। অন্যদিকে ইলিয়ট ছিলেন কিছুটা ভিন্ন। ইবাদানে তাঁর সম্পর্কে আমাকে পড়তে হয়েছে। তাঁর মধ্যে এক ধরনের যাজকীয় বাগ্মীতা ছিল। তিনি ছিলেন প্রচন্ড মেধাবী। কিন্তু আমার মনে হয়, তিন জ্ঞানী ব্যক্তি (The Three Magi) সম্পর্কীত তাঁর যে কবিতা থেকে আমি No Longer at Ease শিরোণামটি গ্রহণ করেছি তা ইংরেজি ভাষার শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলোর একটি। আমার মতে, যখন কোন বিষয়ে গভীর ও মর্মস্পর্শী আলোচনা করা হয় তখন খুব সাধারণ ভাষা ব্যবহার করা উচিত। আমি ঠিক তাই করেছি। অবশ্য আপনি লক্ষ্য করবেন, ঐ দুই বই এর পর আমি আর কখনো শিরোণাম ধার করিনি।
প্যারিস রিভিউ: আমি একবার আপনার প্রকাশক অ্যালান হিল এর কাছে শুনেছিলাম আপনি কিভাবে Things Fall Apart এর পান্ডুলিপি তার কাছে পাঠিয়েছিলেন।
আঁচেবে: ওটা একটা লম্বা কাহিনী। পান্ডুলিপিটা হারিয়েই গিয়েছিল প্রায়। ১৯৫৭ সালে বিবিসি’র স্কলারসিপ নিয়ে লন্ডন যেতে হয়েছিল আমাকে। Things Fall Apart এর অসমাপ্ত পান্ডুলিপিটা সাথে নিয়ে গিয়েছিলাম শেষ করার জন্য। সেখানে আমার এক নাইজেরিয়ান বন্ধু পরামর্শ দিল গিলবার্ট ফেল্পস নামক এক ইন্সট্রাক্টরের কাছে পান্ডুলিপিটা জমা দেবার জন্য। ফেল্পস ছিলেন একজন ঔপন্যাসিক। আমি মোটেই রাজি ছিলাম না। তবে শেষ পর্যন্ত বন্ধুর চাপে ফেল্পসকে পান্ডুলিপিটা দেখাতে বাধ্য হলাম। তিনি যদিও খুব একটা আগ্রহ দেখাননি কিন্তু যথেষ্ট বিনয়ের সাথে সেটা গ্রহণ করেছিলেন। আমার পর গিলবার্ট ফেল্পসই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি ঐ পান্ডুলিপিকে ‘আকর্ষণীয়’ বলেছিলেন। তারপর কোন এক শনিবারে তিনি আমার খোঁজ করলেন, আমি তখন লন্ডনের বাইরে ছিলাম। তিনি সেখানেই ফোন করে আমাকে ডেকে নিয়েছিলেন। তিনি বললেন, ’This is wonderful.’ তিনি পান্ডুলিপিটা তার প্রকাশককে দেখাবার কথা বললেন। কিন্তু আরো কিছু কাজ বাকি আছে বলে তখনই সেটা প্রকাশকের হাতে দিতে রাজি হলাম না। আমি নাইজেরিয়া ফিরে এলাম।
ইংল্যান্ডে থাকাকালে পত্রিকায় এক টাইপিং এজেন্সির বিজ্ঞাপন দেখেছিলাম। ঐ বিজ্ঞাপন থেকেই জানতে পারলাম, ভাল করে টাইপ করা পান্ডুলিপি সহজেই হৃদয়গ্রাহী হয়ে উঠে। তাই আমি খুব দ্রুত হাতে লেখা পান্ডুলিপিটি ওদের কাছে পাঠিয়ে দিলাম। ওটা বোকামিই ছিল। ওরা আমাকে জানালো দুই কপি টাইপের জন্য ৩২ পাউন্ড লাগবে এবং কাজ শুরুর আগেই তা পরিশোধ করতে হবে। আমি করলামও তাই। সপ্তাহ গেল, মাস গেল, তবু কোন উত্তর নেই। আমি ক্রমাগত চিঠি লিখলাম, কোন উত্তর এলো না। আমি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়লাম। কিন্তু আমার ভাগ্য ভাল ছিল। আমার জাদরেল বস মিসেস বেটি ছুটিতে লন্ডন ফিরছিলেন। তাকে বিষয়টা জানালাম। তিনি টাইপিং এজেন্সির নাম-ঠিকানা নিয়ে গেলেন। মূলত তার শাসানিতেই খুব দ্রুত পান্ডুলিপিটার টাইপকরা একটি কপি আমি পেয়েছিলাম। আমার প্রকাশক অ্যালান হিল এর মতে, টাইপিং এজেন্সির কোন গাফিলতি ছিল না। ওরা আসলে পান্ডুলিপিটি আমাকে ফেরত দিতে চায়নি। সে যাই হোক, টাইপকরা পান্ডুলিপিটি প্রকাশনা সংস্থা হাইনম্যান এ পাঠিয়ে দিলাম। এর আগে তারা কোন আফ্রিকান উপন্যাস দেখেনি। ফলে বুঝে উঠতে পারেনি ঠিক কী করতে হবে। সংস্থাটি পরামর্শের জন্য লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিক্স-এর অধ্যাপক ডন ম্যাক্রের দ্বারস্থ হয়েছিল। পরে শুনেছি তিনি মাত্র সাতটি শব্দের একটি রিপোর্ট হাইনম্যান এ পাঠিয়ে দেন যা ছিল নজিরবিহীন। ডন ম্যাক্রে লিখেছিলেন- The best first novel since the war. আর এভাবেই আমার যাত্রা শুরু।
প্যারিস রিভিউ: হাইনম্যান ঠিক কত কপি বই ছাপাবে তা নিয়ে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছিল।
আঁচেবে: ও হ্যাঁ। ওরা খুব অল্প সংখ্যক বই ছেপেছিল। কারণ কাজটা ছিল বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। কেউ বইটি পড়বে কিনা সে বিষয়ে তাদের সন্দেহ ছিল। কিন্তু বইগুলো খুব দ্রুত শেষ হয়ে যায়। এরকম হতো না যদি না অ্যালান হিল বইটির পেপারব্যাক সংস্করণ বের করার সিদ্ধান্ত নিতেনে। অন্যান্য প্রকাশকরা পুরো বিষয়টিকে পাগলামো বলেই মনে করেছিলেন। কিন্তু এভাবেই আফ্রিকান লেখকদের বইগুলো প্রকাশিত হতে শুরু করে। শেষ পর্যন্ত অ্যালান হিল হয়ে উঠেন সাহিত্যের এক বিরাট অংশকে আলোর জগতে নিয়ে আসার পথিকৃৎ। এ ঘটনা বৃটিশ সাহিত্যের বড় অগ্রগতির একটি হিসেবে স্বীকৃত। শুরুটা ছিল নগন্য কিন্তু এটা আগুন ধরাতে পেরেছিল।
প্যারিস রিভিউ: আপনি বলেছেন, জয়েস ক্যারির Mr. Johnson এর প্রতি উত্তরে আপনি Things Fall Apart লিখেছেন।
আঁচেবে: আমার মনে হয় আমি তা বলিনি।
প্যারিস রিভিউ: আপনি Mr. Johnson কে বিখ্যাত করেছেন। কিন্তু ঔপনিবেশিক উপন্যাস নিয়ে আপনার লেখা সবচেয়ে তীক্ষ্ণ রচনাটি হলো কনরাড Heart of Darkness এর সমালোচনা। পশ্চিমাদের মনে আফ্রিকা সম্পর্কে এখন কেমন ধারণা হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
আঁচেবে: আমার মনে হয় ধারণা কিছুটা পাল্টেছে। কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। আমি সেই সব ব্যক্তিদের অবস্থান, গুরুত্ব ও জ্ঞান নিয়ে ভাবি যারা Heart of Darkness এ কোন সা¤প্রদায়িকতা দেখেন না। আমি নিশ্চিত, আমরা সত্যি আলাদা জগতে বাস করছি। যাই হোক, যদি আপনি কারো গল্প পছন্দ না করেন তবে নিজের গল্প লিখুন। আপনার যদি কারো কথা পছন্দ না হয় তবে বলুন কোনটুকু পছন্দ হচ্ছে না। কেউ কেউ মনে করেন আমি কনরাড পড়তে নিষেধ করি। হায় ঈশ্বর! মোটেই তা নয়। আমি নিজেই কনরাড পড়াই। আমি Heart of Darkness পড়াই। আমি শুধু বলি, দেখুন, এ লোকটি আফ্রিকার সাথে কেমন আচরণ করেছে। আচ্ছা আপনিই বলুন, বইটিতে আপনি কি কোন মানবতা দেখতে পান? অনেকেই হয়তো আপনাকে বলবে, কনরাড সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ছিলেন। কিন্তু আমি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কিংবা এই এই কারণে আমি গরীব মানুষগুলোর বিরুদ্ধেÑ শুধু এটুকু বলাই যথেষ্ট নয়। বিশেষ করে যখন তিনি আফ্রিকানদের বলেছেন, ‘পেছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানো কুকুর।’ এটা একটি পাশবিক চিত্রকল্প। তিনি এর মধ্যে কোন ভুলই খুঁজে পাননি। সুতরাং আমরা আলাদা জগতের মানুষ। আর যতদিন এই দুই জগত এক না হবে ততদিন আমাদের সমস্যা শেষ হবে না।
প্যারিস রিভিউ: আপনি কি কখনো সৃজনশীল লেখালেখির উপর ক্লাস নিয়েছেন?
আঁচেবে: না।
প্যারিস রিভিউ: কেন নয়?
আঁচেবে: আমি জানি না কাজটা কিভাবে করতে হয়। সত্যিই জানি না। আমি কেবল বলতে পারি, এটা শুধু লেখকদের কর্মসংস্থান করতে পারে। হাসবেন না! বিষয়টা খবুই গুরুত্বপূর্ণ। আমার মতে যে সব লেখকদের অন্য কিছু করার প্রয়োজন আছে তাদের জন্য এটা আরো গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে এই অনিশ্চিত সময়ে। অনেক লেখকই জীবিকা নির্বাহ করতে পারেন না। তাই কিভাবে লিখতে হয় তা শিখাতে পারাটা তাদের জন্য মূল্যবান। অবশ্য শিক্ষার্থীদের জন্য এর কী মূল্য আছে আমি তা জানি না। তবে একেবারে অকার্যকরও বলছি না। যদিও আমি নিজে চাইবো না কেউ আমাকে শিখাক কিভাবে লিখতে হয়। এটা আমার নিজস্ব রুচি। আমি হোঁচট খেতে পছন্দ করি, সবকিছু করার চেষ্টার মধ্য দিয়েই চলতে পছন্দ করি। ব্যাপারটা ঠিক এভাবেই ঘটেছে।
প্যারিস রিভিউ: জনসেবামূলক কাজের সাথে লেখকদের কতটুকু সম্পৃক্ত থাকা উচিত বলে আপনার মনে হয়?
আঁচেবে: কারো জন্যই আইনকে উৎসর্গ করার পক্ষে আমি নই। লেখকরা শুধু লেখকই নন, তারা নাগরিকও বটে। সাধারণত তারা প্রাপ্তবয়স্ক। কল্যানকর শিল্প সবসময় মানবতার সাহায্য ও সেবায় নিয়োজিত থেকেছে। মানবতাকে অভিযুক্ত করেনি। শিল্পের উদ্দেশ্য যদি হয় মানবতাকে ব্যাহত করা কিংবা অস্বস্তিকর করে তোলা তবে তাকে কিভাবে শিল্প বলা যায় আমি বুঝি না। কেউ সহজাতভাবে মানবতার বিরুদ্ধে- এ কথা আমি স্বীকার করি না। আর এ কারণেই সা¤প্রদায়িকতাকে আমি অসম্ভব বলে মনে করি। কারণ এটা মানবতার বিরুদ্ধে। কেউ কেউ মনে করে, আমি হয়তো আমার জাতিকে নির্বিচারে প্রশংসা করতে বলছি। খোদার কসম! আমার বইগুলো পড়ুন। দেখবেন আমি নিজেই তাদের প্রশংসা করি না। আমি নিজেই তাদের সবচেয়ে বড় সমালোচক। অনেকে মনে করেন, আমার The Travel with Nigeria সীমালঙ্ঘন করেছিল। আমি আমার লেখার জন্য সব রকমের বিপদেরই সম্মুখিন হয়েছি। শিল্পের উচিত মানবতার পক্ষে থাকা। এক্ষেত্রে র্যাঁবো সম্পর্কে ইয়েভতুশেনকোর কথাই ধরুন না কেন। ঐ ফ্রেঞ্চ লোকটি ইথিওপিয়া গিয়েছিলেন এবং ফিরেছিলেন সকল প্রকার রোগ-জীবাণু নিয়ে। ইয়েভতুশেনকো তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘একজন কবি দাস ব্যবসায়ী হতে পারেন না।’ দাস ব্যবসায়ী হবার পর র্যাঁবো কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছিলেন। কবিতা ও দাস ব্যবসা শয্যাসঙ্গী হতে পারে না। এটাই আমার অবস্থান।
প্যারিস রিভিউ: লেখার অঙ্কুরোদগম সম্পর্কে কিছু বলবেন কি? কোনটি প্রথমে আসে? সাধারণ ধারণা, বিশেষ কোন ঘটনা, প্লট নাকি চরিত্র?
আঁচেবে: সব ক্ষেত্রে এটা একরকম হয় না। তবে আমি বলবো, সাধারণ ধারণাটাই সবার আগে আসে, তাকে অনুসরণ করে মূল চরিত্রগুলো। আমরা অসংখ্য ধারণার সমুদ্রে বাস করি কিন্তু সেগুলো উপন্যাস নয়। কারণ তাদের প্রাচুর্যতা রয়েছে। কিন্তু ঠিক যে মুহূর্তে একটি নির্দিষ্ট ধারণা কোন চরিত্রের সাথে যুক্ত হয় তখন তা একটি ইঞ্জিনের মত কাজ শুরু করে। আর ঠিক তখনই একটি উপন্যাসের যাত্রা শুরু হয়। বিশেষ করে যে উপন্যাসে স্বতন্ত্র ও কর্তৃত্বপরায়ণ চরিত্র থাকে। যেমন: Arrow of God এর জুলু চরিত্র। তবে A Man of the People ও No Longer at Ease এর মত উপন্যাস, যেখানে চরিত্রগুলো নিজ ব্যক্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণ করে না সেখানে সাধারণ ধারণাই প্রাথমিক পর্যায়ে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। কিন্তু আপনি যদি একবার প্রাথমিক পর্যায় পার হয়ে যান তখন সাধারণ ধারণা ও চরিত্রের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না।
প্যারিস রিভিউ: প্লটের অবস্থান কোথায়? আপনি কি প্লট নিয়ে ভাবেন? প্লট কি চরিত্র থেকে সৃষ্ট না ধারণা থেকে?
আঁচেবে: যখন উপন্যাস চলতে শুরু করে এবং যখন আমি বুঝতে পারি এটি ঠিক পথেই এগুচ্ছে তখন প্লট বা থিম নিয়ে চিন্তা করি না। এ বিষয়গুলো আপনা-আপনিই আসবে কারণ ততক্ষণে চরিত্রগুলোই কাহিনীকে ঠেলে নিচ্ছে। এক পর্যায়ে মনে হবে ঘটনার উপর আপনার তেমন কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। এরকম ঘটতেই হবে, তা না হলে কাহিনী অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। অর্থাৎ এ বিষয়গুলো স্বাভাবিকভাবেই ঘটবে। যদি এমন না ঘটে তবে বুঝতে হবে আপনি বিপদে পড়েছেন এবং আপনার উপন্যাস থেমে যেতে বাধ্য।
প্যারিস রিভিউ: তার মানে সাহিত্যকর্ম আপনার জন্য সহজ? কিংবা আপনার কাছে এটা কঠিন মনে হয় কি?
আঁচেবে: সত্যি বলতে এটা কঠিন কাজ। কিন্তু এই কঠিন শব্দটি দিয়ে আমি যা বুঝাতে চাচ্ছি তা প্রকাশ পাচ্ছে না। এটা মল্লযুদ্ধের মত; আপনি ধারণা ও কাহিনীর সাথে মল্লযুদ্ধে লিপ্ত। এর জন্য প্রচুর শক্তি প্রয়োজন। একই সাথে এটি উত্তেজনাকরও। তাই বিষয়টি কঠিন ও সহজ দুটোই। আপনাকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে লেখা শুরু করার পর আপনার জীবন আর আগের মত থাকবে না। লেখালেখি মূলত এক ধরনের কারাবাস। তাই পুরো বিষয়টি আনন্দদায়ক ও কঠিন।
প্যারিস রিভিউ: কখন ও কোথায় লিখতে পছন্দ করেন?
আঁচেবে: আমি লক্ষ্য করেছি নাইজেরিয়াতেই আমি সবচেয়ে ভাল লিখতে পারি। তবে যে বিষয়ে আমি লিখছি তার সাথে সম্পর্কিত পরিবেশেই বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করি। দিনের কোন ভাগে লিখলাম তা মুখ্য নয়। আমি ভোরের পাখি নই, চটজলদি বিছানা ছাড়তে আমার ভাল লাগে না। তাই সকালে আমার লেখা হয়ে উঠে না। যদিও শুনেছি অনেকে তাই করেন। দিনের যে কোন সময় লিখতে শুরু করি এবং অনেক রাত পর্যন্ত লিখতে পারি। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সংখ্যক বাক্য লিখতে চেষ্টা করি না। শৃঙ্খলা হলো কাজ করে যাওয়া, কম হলো না বেশি হলো সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ খুব বেশি লিখলেই যে খুব ভালো কিছু হলো তা তো নয়। তাই আপনার চেষ্টা করা উচিত শক্ত কোন টাইম টেবল নিজের উপর না চাপিয়ে সাধ্য অনুযায়ী নিয়মিত লিখে যাওয়া। এটাই আমার আদর্শ।
প্যারিস রিভিউ: আপনি কি কলম দিয়ে লিখেন, না টাইপ রাইটার ব্যবহার করেন? নাকি কম্পিউটার দ্বারা প্রলুব্ধ হয়েছেন?
আঁচেবে: না না। আমি খুবই সেকেলেÑ কলম দিয়ে লিখি। টেবিলে রাখা একটি কলমই আমার জন্য আদর্শ। যন্ত্রের সাথে কাজ করতে আমি স্বাচ্ছন্দ বোধ করি না, তাছাড়া ভাল টাইপ করতেও শিখিনি। যখন টাইপ রাইটার ব্যবহার করতে যাই মনে হয় আমার ও শব্দের মাঝখানে একটি যন্ত্র দাঁড়িয়ে আছে। আর লেখার অবস্থা যা দাঁড়ায় তা হিজিবিজি ছাড়া আর কিছুই না। আরেকটা কারণ আছে, আমি ঘষামাজা পছন্দ করি না। পরিচ্ছন্ন পান্ডুলিপিই আমার পছন্দ।
প্যারিস রিভিউ: Things Fall Apart এর মত বিশ্ববিখ্যাত বই এর লেখক হিসেবে আপনি কি বিব্রতবোধ করেন না, বিশেষ করে যখন দেখেন আপনার অন্য বইগুলো ঠিক সেভাবে আলোচিত হচ্ছে না?
আঁচেবে: মাঝে মধ্যে। তবে এটাকে আমি কোন সমস্যা মনে করি না। আপনি জানেন, বইগুলো সব একই পরিবারের। Things Fall Apart প্রথমেই আসার সুযোগ পেয়েছিল তাই খ্যাতির রাজ্যে পাকাপোক্ত স্থান করে নিতে পেরেছে। বাকি বইগুলো অন্যদিক দিয়ে ভাল করেছে। Things Fall Apart আমার বাস্তবতায় একটি মৌলিক গল্প তাই এটি শোনার দাবি রেখেছিল। ইউরোপের সাথে আমার হঠাৎ সাক্ষাতের গল্পটি পুনরায় বলার জন্য ওটাই ছিল আমার কাছে গ্রহণযোগ্য উপায়। তাই আমার চিন্তার জগতে অন্য বইগুলো অভিন্ন স্থান করে নিতে পারেনি। আর এ কারণেই Things Fall Apart সব মনোযোগ কেড়ে নেবার পরও আমি বিরক্ত বোধ করি না। আপনি যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন এটিই আমার সেরা বই কিনা, আমি বলবো, আমি সত্যিই জানি না।
আমার লেখা প্রতিটি বই ভিন্ন হবার চেষ্টা করেছে কারণ আমি মানব জীবনের জটিলতায় বিশ্বাস করি। সব সময় এমন একজনকে পাওয়া যাবেই যিনি তার নিজস্ব অবস্থান থেকে এ গল্পটিকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করবেন এবং এই একই ব্যক্তি আরো ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করবেন যখন তার অবস্থানও ভিন্ন হবে। আমাদের ইবো উৎসবগুলোতে মাসকারেড নৃত্য অনুষ্ঠিত হয়। ইবোরা বলে থাকে, তুমি যদি ভাল করে এই নৃত্য দেখতে চাও তবে তোমাকেও জায়গা বদলাতে হবে। কারণ মাসকারেড নৃত্য জায়গা বদলায়। যদি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাক তবে তুমি অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত হবে। আমার মনে হয়, পৃথিবীর গল্পগুলো এভাবেই বলা উচিত, অর্থাৎ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে।
প্যারিস রিভিউ: গল্প বলা ও লেখার মধ্যে কোন পার্থক্য আছে?
আঁচেবে: অবশ্যই। আমার মনে আছে, আমাদের সন্তানরা যখন ছোট ছিল তখন ঘুমাবার আগে প্রায়ই তাদের গল্প পড়ে শুনানো হতো। মাঝে মধ্যে আমি তাদের বলতাম, আমি তোমাদের একটি গল্প বলবো। এতে ওদের চোখ যেভাবে জ্বলে উঠতো গল্প পড়ে শুনালে সেরকম হতো না। সন্দেহ নেই, গল্প পড়ার চেয়ে শুনতেই ওরা বেশি পছন্দ করতো। আমরা এমন এক সমাজে বাস করি যা এখন ধ্বনি ও বর্ণের সন্ধিক্ষণে আছে। মৌখিক গল্পগুলো ম্লান হয়ে গেছে ঠিকই কিন্তু লিখিত গল্পের সাথে তাদের পার্থক্য এখনো সুস্পষ্ট। প্রত্যেক মাধ্যমেরই নিজস্ব পথ, পদ্ধতি ও নিয়ম আছে। তারা একে অন্যকে মজবুত করতে পারে। আমরা মুখে বলা গল্পগুলোর খানিকটা শক্তি লিখিত গল্পে নিয়ে আসতে পারি। এই সুবিধা আমার প্রজন্মের আছে। সমসাময়িক সাহিত্যে আমাদের সাহিত্য (নাইজেরিয়ান সাহিত্য) এই অবদানটুকু রাখতে পেরেছে।
প্যারিস রিভিউ: বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের সময় পাঠকদের কোন মন্তব্যে বিস্মিত হয়েছেন কি? কিংবা তারা কিভাবে আপনার লেখার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেছে?
আঁচেবে: জী জী, হয়েছি। লোকজন বিস্ময়কর সব মন্তব্য করে। আমি আপনাকে এক লাজুক শেতাঙ্গ আমেরিকানের কথা বলতে পারি। সে সত্তর দশকে মেসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো। একবার আমার অফিসে এসে সে মন্তব্য করলোÑ ওকাংকো আমার বাবা।
প্যারিস রিভিউ: ওকাংকো নামে কাউকে কি আপনি চিনতেন? কয়েক বছর আগে আমি যখন নাইজেরিয়া গিয়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক যুবক নিজেকে ওকাংকো বলে পরিচয় দিয়েছিল। আমি তাকে ভন্ড ভেবেছিলাম। এটা কি কোন সত্যিকারের নাম?
আঁচেবে: জী জী, হয়েছি। লোকজন বিস্ময়কর সব মন্তব্য করে। আমি আপনাকে এক লাজুক শেতাঙ্গ আমেরিকানের কথা বলতে পারি। সে সত্তর দশকে মেসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো। একবার আমার অফিসে এসে সে মন্তব্য করলো-- ওকাংকো আমার বাবা।
প্যারিস রিভিউ: ওকাংকো নামে কাউকে কি আপনি চিনতেন? কয়েক বছর আগে আমি যখন নাইজেরিয়া গিয়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক যুবক নিজেকে ওকাংকো বলে পরিচয় দিয়েছিল। আমি তাকে ভন্ড ভেবেছিলাম। এটা কি কোন সত্যিকারের নাম?
আঁচেবে: এটা খুব সাধারণ একটি নাম। এই নামটি ইবোল্যান্ডে খুব বেশি প্রচলিত। কারণ সেখানে চারদিনে এক সপ্তাহ এবং প্রত্যেকটি বারের নামই কারও না কারও নাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ আপনি সোমবার, মঙ্গলবার, বুধবার কিংবা বৃহস্পতিবারে জন্মেছেন। আপনি যদি একজন ইবো হন তবে আপনার নাম রাখা হবে ‘সোমবারের পুত্র’ অথবা ‘মঙ্গলবারের পুত্র’ অথবা ‘বুধবারের পুত্র’ অথবা ‘বৃহস্পতিবারের পুত্র।’ ওকাংকো বলতে তাই বুঝায়। সপ্তাহের প্রথম দিন জন্মালে এই নাম রাখা হয়। যদি আপনি ঐ দিনে না জন্মে থাকেন তবে আপনার নাম হবে ওকিকি কিংবা ওকোয়ি কিংবা ওকাফো। অবশ্য সবাই এ নিয়ম মানে না। আপনার বাবা-মা চাইলে অন্য নামও রাখতে পারেন, যেমনÑ আঁচেবে। কিন্তু যে নামই রাখা হোক না কেন জন্মবার আপনার নাম হিসেবেই থেকে যাবে। তাই ওকাংকো খুবই সাধারণ নাম।
প্যারিস রিভিউ: শ্রেষ্ঠ নারী চরিত্রগুলোর একটি আপনার সৃষ্টি। আমি Anthills of Savannah’র বেট্রিস এর কথা বলছি। আপনি কি তার সাথে একাত্মতা বোধ করেন? আপনার নিজের কোন বৈশিষ্ট্য কি এই চরিত্রের মধ্যে দেখতে পান? আমার কাছে বেট্রিসকে খানিকটা পরিত্রাতা বলে মনে হয়েছে।
আঁচেবে: জী জী, আমি তার সাথে একাত্মতা বোধ করি। আসলে ভাল ও মন্দÑ আমার সব চরিত্রের সাথেই আমি একাত্ম হয়ে যাই। চরিত্রগুলোকে অকৃত্রিম করতেই আমাকে এমন করতে হয়। আমাকে চরিত্রগুলো বুঝতে হয় এমনকি যদি আমি তাদের সমর্থন নাও করি। অবশ্য পুরোপুরি নয়Ñ এটা সম্ভবও নয়। চরিত্রের পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ প্রকৃত অর্থে কাক্সিক্ষতও নয়। এমন অনেক ক্ষেত্র আছে যেখানে বিশেষ কোন চরিত্র আপনার বা আমার প্রতিনিধিত্ব করে না। যদিও মাঝে মাঝে বেট্রিস এর মত চরিত্রগুলো আমার নিজস্ব উপাদান, বিশ্বাসের পদ্ধতি, আশা ও আকাক্সক্ষা ধারণ করে। অনেকেই আমার লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়েন না কিন্তু মন্তব্য করেন বেট্রিসই আমার সৃষ্ট একমাত্র নারী চরিত্র এবং সম্ভবত আমি নারীবাদীদের চাপে পড়েই এই চরিত্র সৃষ্টি করেছি। আসলে, No Longer at Ease, A Man of the People থেকে শুরু করে Anthills of Savannah পর্যন্ত সব উপন্যাসেই কার্যত বেট্রিস উপস্থিত ছিল। বিশৃঙ্খলা থেকে আমাদের মুক্ত করার ক্ষেত্রে নারীদের প্রতি আমি যে গুরুত্বারোপ করি নিঃসন্দেহে সেটা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা আমার প্রথাগত সংস্কৃতিতে নারীদের ভূমিকার একটি প্রতিফলন। তা হলো, নারীরা ততক্ষণ পর্যন্ত রাজনীতিতে প্রবেশ করে না, যতক্ষণ না পুরুষরা এমন একটি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে যার ফলে সমাজ সামনে কিংবা পেছনে চলার শক্তি হারিয়ে ফেলে। এভাবেই গল্পগুলো সাজানো হয়েছে এবং আমি তাই বলতে চেয়েছি।
প্যারিস রিভিউ: সাহিত্যের প্রতি প্রতিশ্র“তিশীল কারো জন্য আপনার কী পরামর্শ থাকবে? আমার ধারণা উদীয়মান ঔপন্যাসিকদের কাছ থেকে পরামর্শ চেয়ে এবং পান্ডুলিপি পড়ে দেখার জন্য আপনি ক্রমাগত অনুরোধ পেয়ে যাচ্ছেন।
আঁচেবে: পান্ডুলিপির বানে ভেসে যাবার মত অবস্থা এখনো হয়নি। তবে কেউ কেউ আমার কাছে আসেন। আমি যেটুকু বুঝি, উদীয়মান লেখকরা উৎসাহিত হতে চান। তবে আমি বিশ্বাস করি, লেগে থাকার পরামর্শ দেয়া ছাড়া একজন ভাল লেখককে আর কিছু বলার নেই। যে কাজ করার জন্য আপনি মনস্থির করেছেন তা নিয়ে ভাবুন এবং সেই সাথে সাধ্যমত কাজ চালিয়ে যান। এক সময় আপনি সাফল্য পাবেন এবং মানুষকে আপনার কাজ দেখাতে পারবেন। কিন্তু আমি লক্ষ্য করি, আজকালকার তরুণরা তা করছে না। তারা প্রথমে একটি খসড়া পান্ডুলিপি তৈরি করে এবং অন্যের সৎ পরামর্শ অনুযায়ী সেটা শেষ করে। আমি কৌশলে এমন বিষয় থেকে নিজেকে বিরত রাখি। আমি বলি-- লেগে থাকুন। আমি যে সত্য শিখতে শিখতে বড় হয়েছি তা হলো আমাকে পরামর্শ দেবার কেউ নেই। তাই সর্বোত্তম চেষ্টা চালিয়ে যান। যদি আপনার লেখা যথেষ্ট ভাল না হয় তবে আপনি নিজেই একদিন তা মেনে নেবেন। আমি সেই ব্যক্তি হতে চাই না যে অন্যকে বলে- আপনি পারবেন না। যদিও আমি জানি, আমার কাছে আসা অধিকাংশ পান্ডুলিপিই ভাল নয়। কিন্তু আপনি কোন তরুণ লেখককে বলতে পারেন না যে, তুমি পারবে না কিংবা তোমার লেখা ভাল নয়। অন্য কেউ বলতে পারে, তবে আমি মনে করি আমি সাহিত্য জগতের পুলিশ নই।
আঁচেবের প্রথম উপন্যাস The Things Fall Apart ১৯৫৮ সালে, No Longer at Ease ১৯৬০ সালে, Arrow of God ১৯৬৪ সালে, A Man of the people ১৯৬৬ সালে এবং Anthills of Savannah প্রকাশিত হয় ১৯৮৭ সালে। চিনুয়া আঁচেবে ছিলেন সাহিত্য ম্যাগাজিন Okike’র সম্পাদক এবং The Heinemann Series on African Literature এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অর্জন করেন পঁচিশটি সম্মানজনক ডক্টরেট ডিগ্রি। আধুনিক আফ্রিকান সাহিত্যের জনক বলে খ্যাত চিনুয়া আঁচেবে তার The Things Fall Apart উপন্যাস ও সাহিত্যে অসাধারণ অবদানের জন্য ২০০৭ সালে ভূষিত হন Booker International Prize-এ।
বিশ্বখ্যাত সাময়িকী The Paris Review এর পক্ষ থেকে Jerome Brooks চিনুয়া আঁচেবের এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছিলেন ১৯৯৫ সালে। তাঁর স্মরণে এই দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটি কিছুটা সংক্ষিপ্ত করে তুলে ধরা হলো। ]
প্যারিস রিভিউ: আপনি কি আমাদের আঁচেবে পরিবার, ইবো গ্রামে আপনার বেড়ে উঠা এবং আপনার প্রথম জীবনের শিক্ষা সম্পর্কে কিছু বলবেন? তাছাড়া ঐ গ্রামে এমন কিছু কি ছিল যা আপনাকে লিখতে অনুপ্রাণিত করেছে?
আঁচেবে: সত্যিকার অর্থে গল্পের প্রতি আকর্ষণই লেখালেখির দিকে আমাকে টেনে এনেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না আকর্ষণটা গল্প লেখার প্রতি ছিল না। তাছাড়া ঐ গ্রামে তেমন কিছু করাও ছিল অসম্ভব। শুধু জানতাম আমি গল্প ভালোবাসি। আমাদের বাড়িতেই গল্প বলার প্রচলন ছিল। আমার মা গল্প বলতেন, বড় বোনও গল্প বলতেনÑ যেমন ধরুণ কচ্ছপের গল্প। আলাপচারিতার মধ্যে থেকে সামান্য হলেও আমি গল্প খুঁজে নিতাম। বাবার কাছে অতিথি এলে আমি আশেপাশে ঘুরঘুর করতাম কিংবা পাশে গিয়েই বসে থাকতাম। এরপর যখন স্কুলে যাওয়া শুরু করলাম পাঠ্য গল্পের প্রতি আমার ভালোবাসা জন্ম নিল। যদিও ওগুলো একটু ভিন্ন ধাচের ছিল, তারপরও আমি ভালোবাসতাম। নাইজেরিয়া থাকাকালে আমার বাবা-মা ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টান হন। তারা শুধু ধর্মান্তরিতই হননি, বাবা ছিলেন গসপেল প্রচারক ও ধর্মীয় শিক্ষক। আমার বাবা ও মা গসপেল প্রচার করতে গিয়ে প্রায় ৩৫ বছর ইবোল্যান্ডের বিভিন্ন অংশে ভ্রমণ করেছেন। আমি ছিলাম তাদের ছয় সন্তানের মধ্যে পঞ্চম। এভাবেই আমি বেড়ে উঠছিলাম আর ততোদিনে বাবা অবসর নিয়ে নিজ পিতৃপুরুষের গ্রামে ফিরে এলেন। পড়তে শিখার পর আমি বিচিত্র সব মানুষ ও দেশের গল্পের সাথে পরিচিত হলাম। আমাকে তখন যে বিষয়গুলো মুগ্ধ করেছিল কোন একটি প্রবন্ধে আমি সেগুলোর কথা উল্লেখ করেছি। অপার্থিব বস্তু এমনকি সেই জাদুকরের কথাও যে কিনা একটি প্রদীপের জন্য আফ্রিকা থেকে চীন পর্যন্ত গিয়েছিল। এগুলো ছিল চমকপ্রদ। আমি আরো বড় হয়ে উঠলাম এবং অ্যাডভেঞ্চার পড়া শুরু করলাম। তখনো আমি জানতাম না, আমাকে সেই বর্বরদের পক্ষ নিতে হবে যাদের বিরুদ্ধে কিছু সাহসী শেতাঙ্গ অবস্থান নিয়েছিল। আমি সহজাতভাবেই শেতাঙ্গদের পক্ষ নিয়েছিলাম। তারা খুব ভাল ছিল! চমৎকার মানুষ ছিল! বুদ্ধিমান ছিল। কিন্তু অন্যরা তেমন ছিল নাÑ তারা ছিল মূর্খ ও কুৎসিত। আর এভাবেই আমার পরিচয় ঘটেছিল নিজেদের গল্প না থাকার বিপদের সাথে। একটা প্রবাদ আছেÑ যতদিন সিংহরা তাদের ইতিহাস না লিখবে, ততোদিন শিকারের ইতিহাস শিকারিকেই মহিমান্বিত করবে। আমার এ উপলব্ধি হয়েছিল তবে অনেক দেরিতে। আমি বুঝতে পারলাম আমাকে লেখক হতে হবে। আমাকে ইতিহাসবিদ হতে হবে। এটা একজন মাত্র মানুষের কাজ নয়। এটা একক কোন ব্যক্তির কাজ নয়। এটা এমন কিছু যা আমাদেরই করতে হবে, যাতে শিকারের কাহিনীতে ফুটে উঠে যন্ত্রণা, সংগ্রাম এবং এমনকি সিংহের বীরত্বও।
প্যারিস রিভিউ: আপনি বিখ্যাত ইবাদান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম গ্র্যাজুয়েটদের একজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুর বছরগুলো কেমন ছিল এবং আপনি সেখানে কোন বিষয়ে অধ্যয়ন করেছেন? আপনার লেখালেখির সাথে বিষয়টার সম্পর্ক কতটুকু?
আঁচেবে: পিছন ফিরে তাকালে বলতে হয়, ইবাদান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান। এটি ঔপনিবেশিকতার দ্বৈতরূপ উন্মোচন করেছিল। কারণ ইবাদান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নাইজেরিয়ায় ব্রিটিশ উপনিবেশের সমাপ্তির প্রাক্কালে। যদি ব্রিটিশদের কোন ভাল কাজ থেকে থাকে তবে ইবাদান তার একটি। এটি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কলেজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, কারণ ব্রিটিশদের অধীনে আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মত কিছু করতে পারেন না। আপনাকে অন্যের উপাঙ্গ হিসেবেই যাত্রা শুরু করতে হবে। আর তাদের অভিভাবকত্বের একটি পর্যায়ও আপনাকে পাড়ি দিতে হবে। তাই এটা ছিল লন্ডন-ইবাদান বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। তাই বলা চলে আমি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ডিগ্রি নিয়েছি। প্রতিষ্ঠানটি এভাবেই গড়ে উঠেছিল। আর ইবাদানের পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হওয়াটা ছিল স্বাধীনতার আগাম বার্তা।
আমি বিজ্ঞান দিয়ে শুরু করেছিলাম, পরে ইংরেজি, ইতিহাস ও ধর্মের উপর পড়াশুনা করেছি। এই বিষয়গুলোকে আমার কাছে খুব উত্তেজক ও কার্যকর মনে হয়েছে। ধর্ম অধ্যয়ন করা ছিল আমার জন্য নতুন ও আকর্ষণীয়। কারণ শুধু খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্বই নয়, পশ্চিম আফ্রিকার ধর্মগুলোও আমাদের পড়তে হয়েছে। বর্তমানে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরিটাস অধ্যাপক এবং আমার তৎকালীন শিক্ষক ড. পারিনদার ছিলেন এ বিষয়ে অগ্রনায়ক। তখনই প্রথমবারের মত আমি আমার পদ্ধতিসহ অন্যান্য পদ্ধতিগুলোর তুলোনামূলক পর্যবেক্ষণের সুযোগ পেয়েছিলাম। জেমস ওয়েলচ নামক আরো একজন অধ্যাপকের সাথে আমি পরিচিত হই। তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ মানুষ। ইবাদানে আসার আগে তিনি রাজা ষষ্ঠ জর্জ ও বিবিসি’র ধর্ম যাজক হওয়াসহ প্রায় সব ক্ষমতারই স্বাদ নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন বাগ্মী ধর্ম প্রচারক। কোন এক অনুষ্ঠানে তিনি আমাকে বলেছিলেন, তোমার যে শিক্ষা প্রয়োজন কিংবা তুমি যে শিক্ষা চাও আমরা হয়তো তা দিতে পারবো না। তোমাকে শুধু ততটুকু শিখাতে পারবো যতটুকু আমরা জানি। তিনি ছিলেন চমৎকার একজন মানুষ আর ওটাই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা। এ ধরনের মনোভাব অর্জন করা ছাড়া সত্যিকার অর্থে আমার যে শিক্ষা প্রয়োজন ছিল আমি সেখানে তা পাইনি। আমাকে আমার নিজের মত করেই চলতে হয়েছে। যেমন, আমি ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের কথা বলতে পারি। তাদের মধ্যে কেউ একজন লেখক হতে চায় একথা শুনে প্রায় সবাই হাসাহাসি করতো। আসলে এভাবে তখনো কেউ চিন্তা করতে শেখেনি। একবার আমাদের ডিপার্টমেন্ট থেকে ঘোষণা করা হলো, পরবর্তী ছুটিতে একটি ছোট গল্প লিখে আনতে হবে এবং শ্রেষ্ঠ গল্পের জন্য পুরস্কার দেয়া হবে। সে সময়ের আগে আমি কখনো ছোটগল্প লিখিনি। কিন্তু বাড়িতে গিয়ে গল্প লিখলাম এবং জমাও দিলাম। বেশ কয়েকমাস পর নোটিশ দিয়ে জানানো হলো কোন গল্পই মানসম্মত হয়নি তাই পুরস্কার দেয়া হবে না। তবে নোটিশে বলা হয়েছিল আমার গল্পটি উল্লেখ করার দাবি রাখে। বুঝতেই পারছেন তখনকার দিনে ইবাদানের এমন মন্তব্য যথেষ্ট উঁচু দরের ছিল। পরবর্তীতে আমি সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের কাছে আমার গল্পের ভুল-ত্র“টি জানতে চেয়েছিলাম কিন্তু নানা অজুহাতে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যেতেন। অবশ্য দীর্ঘদিন পর তিনি বলেছিলেন আমার গল্পে কোন ভুল ছিল না। আমি এভাবেই ছোটগল্প লেখা শিখেছিলাম। বুঝতে পারলাম আমাকে নিজের মত করেই চলতে হবে।
প্যারিস রিভিউ: বিশ্ববিদ্যালয় পেড়োবার পর আপনি নাইজেরিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনেই কর্মজীবন শুরু করেছিলেন।
আঁচেবে: অধ্যাপক ওয়েলচ এর সহযোগিতায় আমি ওখানে কাজ শুরু করেছিলাম। তিনি আমাকে ক্যাম্ব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে স্কলারসিপ পাইয়ে দেবার চেষ্টা করেছিলেন, তবে কাজ হয়নি। তাই নাইজেরিয়ায় সদ্য প্রতিষ্ঠিত স¤প্রচার বিভাগে যোগ দেই। সেখানে অধিকাংশই ছিল বিবিসি’র লোকজন। মূলতঃ শুরুটা এভাবেই হয়েছিল। আমি তখন স¤প্রচার নিয়ে মোটেই ভাবিনি। কলেজ ছেড়ে যাবার সময় আমার কোন ধারনাই ছিল না আমি কী করবো। একালের শিক্ষার্থীদের নিয়ে ভাবলে আমি অবাক হয়ে যাই, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিন থেকেই তারা জানে নিজেরা কী হতে যাচ্ছে। আমরা জানতাম না। আমরা শুধু সামনে চলেছি। আমরা শুধু জানতাম, একটা উপায় হবেই। সৌভাগ্যবশত হয়েছিলও তাই। সংখ্যায় আমরা খুব একটা বেশি ছিলাম না। আজকের দিন হলে সেরকম কিছু করা অসম্ভব হতো এবং টিকেও থাকা যেত না। তাই আমি স¤প্রচার বিভাগে যোগ দিয়েই আবিস্কার করলাম, সেখানকার পরিবেশ আমার জন্য যথেষ্ট সহায়ক, ঠিক যেমনটা আমি চেয়েছিলাম। প্রথমে স্ক্রিপ্ট, পরে বিভিন্ন ব্যক্তিদের ভাষণ এবং সবশেষে ছোটগল্প সম্পাদনা করতে থাকলাম। সত্যিকার অর্থে এভাবেই আমি ছোটগল্প সম্পাদনা ও প্রকাশনার কাজে প্রবেশ করেছিলাম। সদ্য স্বাধীন দেশে সবকিছুই খুব দ্রুত ঘটছিল। আমার পদোন্নতি হয় এবং এই চমৎকার কাজটি ছেড়ে নির্বাহী পদে যোগ দেই।
প্যারিস রিভিউ: আপনার প্রথম দুটি বই Things Fall Apart ও No Longer at Ease এর শিরোণাম আধুনিক আইরিশ ও আমেরিকান কবিদের কাছ থেকে ধার করা। পল মার্শাল এর মত অন্যান্য কৃষ্ণাঙ্গ লেখকরাও ইয়েটস এর কাছ থেকে ধার করেছিলেন। আমার ধারনা, ইয়েটস ও ইলিয়টÑ দুজনই আপনার প্রিয় কবি।
আঁচেবে: ঠিক তাই। তাঁরা দুজনেই আমার প্রিয় কবি। আসলে আমি আর কোন লেখাতেই এরকম করিনি। যেমনটা বলেছি, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমি সাধারণ ডিগ্রি নিয়েছি এবং ইংরেজি ছিল তার একটা অংশ মাত্র। আর আপনাকে তার তো একটা প্রমাণ দিতেই হবে, তাই নয় কি? তবে বেপরোয়া আইরিশ কবি ইয়েটসকে আমি পছন্দ করতাম। তাঁর কাব্যের প্রবহমানতা এবং ভাষার প্রতি ভালোবাসাকে আমি সত্যিই পছন্দ করতাম। যদি তাঁর ভাবাবেগের কথা বলি তবে বলবো, তিনি ঠিক জায়গাতেই ছিলেন। তাঁর মধ্যে হয়তো একগুঁয়েমি ছিল কিন্তু তার হৃদয় সঠিক স্থান থেকে বিচ্যুত হয়নি। তিনি চমৎকার কবিতা লিখেছেন। তাঁর কবিতার মধ্যে সেই জাদু ছিল যে জাদু আমি আমার ছোট বেলার জাদুকরের মধ্যে দেখেছিলাম। যা কিছুই আকর্ষণীয় মনে হয়েছে কিংবা আমার ভাবনায় যখন যা কিছু এসেছে আমি সেগুলো দিয়েই কিছু বাক্য লিখে ফেলতাম। আর ইয়েটস ছিল আমার কাছে তেমনই এক ব্যক্তিত্ব। তাই Things Fall Apart শব্দগুলো আমার কাছে সঠিক ও যথার্থই মনে হয়েছে। অন্যদিকে ইলিয়ট ছিলেন কিছুটা ভিন্ন। ইবাদানে তাঁর সম্পর্কে আমাকে পড়তে হয়েছে। তাঁর মধ্যে এক ধরনের যাজকীয় বাগ্মীতা ছিল। তিনি ছিলেন প্রচন্ড মেধাবী। কিন্তু আমার মনে হয়, তিন জ্ঞানী ব্যক্তি (The Three Magi) সম্পর্কীত তাঁর যে কবিতা থেকে আমি No Longer at Ease শিরোণামটি গ্রহণ করেছি তা ইংরেজি ভাষার শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলোর একটি। আমার মতে, যখন কোন বিষয়ে গভীর ও মর্মস্পর্শী আলোচনা করা হয় তখন খুব সাধারণ ভাষা ব্যবহার করা উচিত। আমি ঠিক তাই করেছি। অবশ্য আপনি লক্ষ্য করবেন, ঐ দুই বই এর পর আমি আর কখনো শিরোণাম ধার করিনি।
প্যারিস রিভিউ: আমি একবার আপনার প্রকাশক অ্যালান হিল এর কাছে শুনেছিলাম আপনি কিভাবে Things Fall Apart এর পান্ডুলিপি তার কাছে পাঠিয়েছিলেন।
আঁচেবে: ওটা একটা লম্বা কাহিনী। পান্ডুলিপিটা হারিয়েই গিয়েছিল প্রায়। ১৯৫৭ সালে বিবিসি’র স্কলারসিপ নিয়ে লন্ডন যেতে হয়েছিল আমাকে। Things Fall Apart এর অসমাপ্ত পান্ডুলিপিটা সাথে নিয়ে গিয়েছিলাম শেষ করার জন্য। সেখানে আমার এক নাইজেরিয়ান বন্ধু পরামর্শ দিল গিলবার্ট ফেল্পস নামক এক ইন্সট্রাক্টরের কাছে পান্ডুলিপিটা জমা দেবার জন্য। ফেল্পস ছিলেন একজন ঔপন্যাসিক। আমি মোটেই রাজি ছিলাম না। তবে শেষ পর্যন্ত বন্ধুর চাপে ফেল্পসকে পান্ডুলিপিটা দেখাতে বাধ্য হলাম। তিনি যদিও খুব একটা আগ্রহ দেখাননি কিন্তু যথেষ্ট বিনয়ের সাথে সেটা গ্রহণ করেছিলেন। আমার পর গিলবার্ট ফেল্পসই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি ঐ পান্ডুলিপিকে ‘আকর্ষণীয়’ বলেছিলেন। তারপর কোন এক শনিবারে তিনি আমার খোঁজ করলেন, আমি তখন লন্ডনের বাইরে ছিলাম। তিনি সেখানেই ফোন করে আমাকে ডেকে নিয়েছিলেন। তিনি বললেন, ’This is wonderful.’ তিনি পান্ডুলিপিটা তার প্রকাশককে দেখাবার কথা বললেন। কিন্তু আরো কিছু কাজ বাকি আছে বলে তখনই সেটা প্রকাশকের হাতে দিতে রাজি হলাম না। আমি নাইজেরিয়া ফিরে এলাম।
ইংল্যান্ডে থাকাকালে পত্রিকায় এক টাইপিং এজেন্সির বিজ্ঞাপন দেখেছিলাম। ঐ বিজ্ঞাপন থেকেই জানতে পারলাম, ভাল করে টাইপ করা পান্ডুলিপি সহজেই হৃদয়গ্রাহী হয়ে উঠে। তাই আমি খুব দ্রুত হাতে লেখা পান্ডুলিপিটি ওদের কাছে পাঠিয়ে দিলাম। ওটা বোকামিই ছিল। ওরা আমাকে জানালো দুই কপি টাইপের জন্য ৩২ পাউন্ড লাগবে এবং কাজ শুরুর আগেই তা পরিশোধ করতে হবে। আমি করলামও তাই। সপ্তাহ গেল, মাস গেল, তবু কোন উত্তর নেই। আমি ক্রমাগত চিঠি লিখলাম, কোন উত্তর এলো না। আমি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়লাম। কিন্তু আমার ভাগ্য ভাল ছিল। আমার জাদরেল বস মিসেস বেটি ছুটিতে লন্ডন ফিরছিলেন। তাকে বিষয়টা জানালাম। তিনি টাইপিং এজেন্সির নাম-ঠিকানা নিয়ে গেলেন। মূলত তার শাসানিতেই খুব দ্রুত পান্ডুলিপিটার টাইপকরা একটি কপি আমি পেয়েছিলাম। আমার প্রকাশক অ্যালান হিল এর মতে, টাইপিং এজেন্সির কোন গাফিলতি ছিল না। ওরা আসলে পান্ডুলিপিটি আমাকে ফেরত দিতে চায়নি। সে যাই হোক, টাইপকরা পান্ডুলিপিটি প্রকাশনা সংস্থা হাইনম্যান এ পাঠিয়ে দিলাম। এর আগে তারা কোন আফ্রিকান উপন্যাস দেখেনি। ফলে বুঝে উঠতে পারেনি ঠিক কী করতে হবে। সংস্থাটি পরামর্শের জন্য লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিক্স-এর অধ্যাপক ডন ম্যাক্রের দ্বারস্থ হয়েছিল। পরে শুনেছি তিনি মাত্র সাতটি শব্দের একটি রিপোর্ট হাইনম্যান এ পাঠিয়ে দেন যা ছিল নজিরবিহীন। ডন ম্যাক্রে লিখেছিলেন- The best first novel since the war. আর এভাবেই আমার যাত্রা শুরু।
প্যারিস রিভিউ: হাইনম্যান ঠিক কত কপি বই ছাপাবে তা নিয়ে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছিল।
আঁচেবে: ও হ্যাঁ। ওরা খুব অল্প সংখ্যক বই ছেপেছিল। কারণ কাজটা ছিল বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। কেউ বইটি পড়বে কিনা সে বিষয়ে তাদের সন্দেহ ছিল। কিন্তু বইগুলো খুব দ্রুত শেষ হয়ে যায়। এরকম হতো না যদি না অ্যালান হিল বইটির পেপারব্যাক সংস্করণ বের করার সিদ্ধান্ত নিতেনে। অন্যান্য প্রকাশকরা পুরো বিষয়টিকে পাগলামো বলেই মনে করেছিলেন। কিন্তু এভাবেই আফ্রিকান লেখকদের বইগুলো প্রকাশিত হতে শুরু করে। শেষ পর্যন্ত অ্যালান হিল হয়ে উঠেন সাহিত্যের এক বিরাট অংশকে আলোর জগতে নিয়ে আসার পথিকৃৎ। এ ঘটনা বৃটিশ সাহিত্যের বড় অগ্রগতির একটি হিসেবে স্বীকৃত। শুরুটা ছিল নগন্য কিন্তু এটা আগুন ধরাতে পেরেছিল।
প্যারিস রিভিউ: আপনি বলেছেন, জয়েস ক্যারির Mr. Johnson এর প্রতি উত্তরে আপনি Things Fall Apart লিখেছেন।
আঁচেবে: আমার মনে হয় আমি তা বলিনি।
প্যারিস রিভিউ: আপনি Mr. Johnson কে বিখ্যাত করেছেন। কিন্তু ঔপনিবেশিক উপন্যাস নিয়ে আপনার লেখা সবচেয়ে তীক্ষ্ণ রচনাটি হলো কনরাড Heart of Darkness এর সমালোচনা। পশ্চিমাদের মনে আফ্রিকা সম্পর্কে এখন কেমন ধারণা হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
আঁচেবে: আমার মনে হয় ধারণা কিছুটা পাল্টেছে। কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। আমি সেই সব ব্যক্তিদের অবস্থান, গুরুত্ব ও জ্ঞান নিয়ে ভাবি যারা Heart of Darkness এ কোন সা¤প্রদায়িকতা দেখেন না। আমি নিশ্চিত, আমরা সত্যি আলাদা জগতে বাস করছি। যাই হোক, যদি আপনি কারো গল্প পছন্দ না করেন তবে নিজের গল্প লিখুন। আপনার যদি কারো কথা পছন্দ না হয় তবে বলুন কোনটুকু পছন্দ হচ্ছে না। কেউ কেউ মনে করেন আমি কনরাড পড়তে নিষেধ করি। হায় ঈশ্বর! মোটেই তা নয়। আমি নিজেই কনরাড পড়াই। আমি Heart of Darkness পড়াই। আমি শুধু বলি, দেখুন, এ লোকটি আফ্রিকার সাথে কেমন আচরণ করেছে। আচ্ছা আপনিই বলুন, বইটিতে আপনি কি কোন মানবতা দেখতে পান? অনেকেই হয়তো আপনাকে বলবে, কনরাড সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ছিলেন। কিন্তু আমি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কিংবা এই এই কারণে আমি গরীব মানুষগুলোর বিরুদ্ধেÑ শুধু এটুকু বলাই যথেষ্ট নয়। বিশেষ করে যখন তিনি আফ্রিকানদের বলেছেন, ‘পেছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানো কুকুর।’ এটা একটি পাশবিক চিত্রকল্প। তিনি এর মধ্যে কোন ভুলই খুঁজে পাননি। সুতরাং আমরা আলাদা জগতের মানুষ। আর যতদিন এই দুই জগত এক না হবে ততদিন আমাদের সমস্যা শেষ হবে না।
প্যারিস রিভিউ: আপনি কি কখনো সৃজনশীল লেখালেখির উপর ক্লাস নিয়েছেন?
আঁচেবে: না।
প্যারিস রিভিউ: কেন নয়?
আঁচেবে: আমি জানি না কাজটা কিভাবে করতে হয়। সত্যিই জানি না। আমি কেবল বলতে পারি, এটা শুধু লেখকদের কর্মসংস্থান করতে পারে। হাসবেন না! বিষয়টা খবুই গুরুত্বপূর্ণ। আমার মতে যে সব লেখকদের অন্য কিছু করার প্রয়োজন আছে তাদের জন্য এটা আরো গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে এই অনিশ্চিত সময়ে। অনেক লেখকই জীবিকা নির্বাহ করতে পারেন না। তাই কিভাবে লিখতে হয় তা শিখাতে পারাটা তাদের জন্য মূল্যবান। অবশ্য শিক্ষার্থীদের জন্য এর কী মূল্য আছে আমি তা জানি না। তবে একেবারে অকার্যকরও বলছি না। যদিও আমি নিজে চাইবো না কেউ আমাকে শিখাক কিভাবে লিখতে হয়। এটা আমার নিজস্ব রুচি। আমি হোঁচট খেতে পছন্দ করি, সবকিছু করার চেষ্টার মধ্য দিয়েই চলতে পছন্দ করি। ব্যাপারটা ঠিক এভাবেই ঘটেছে।
প্যারিস রিভিউ: জনসেবামূলক কাজের সাথে লেখকদের কতটুকু সম্পৃক্ত থাকা উচিত বলে আপনার মনে হয়?
আঁচেবে: কারো জন্যই আইনকে উৎসর্গ করার পক্ষে আমি নই। লেখকরা শুধু লেখকই নন, তারা নাগরিকও বটে। সাধারণত তারা প্রাপ্তবয়স্ক। কল্যানকর শিল্প সবসময় মানবতার সাহায্য ও সেবায় নিয়োজিত থেকেছে। মানবতাকে অভিযুক্ত করেনি। শিল্পের উদ্দেশ্য যদি হয় মানবতাকে ব্যাহত করা কিংবা অস্বস্তিকর করে তোলা তবে তাকে কিভাবে শিল্প বলা যায় আমি বুঝি না। কেউ সহজাতভাবে মানবতার বিরুদ্ধে- এ কথা আমি স্বীকার করি না। আর এ কারণেই সা¤প্রদায়িকতাকে আমি অসম্ভব বলে মনে করি। কারণ এটা মানবতার বিরুদ্ধে। কেউ কেউ মনে করে, আমি হয়তো আমার জাতিকে নির্বিচারে প্রশংসা করতে বলছি। খোদার কসম! আমার বইগুলো পড়ুন। দেখবেন আমি নিজেই তাদের প্রশংসা করি না। আমি নিজেই তাদের সবচেয়ে বড় সমালোচক। অনেকে মনে করেন, আমার The Travel with Nigeria সীমালঙ্ঘন করেছিল। আমি আমার লেখার জন্য সব রকমের বিপদেরই সম্মুখিন হয়েছি। শিল্পের উচিত মানবতার পক্ষে থাকা। এক্ষেত্রে র্যাঁবো সম্পর্কে ইয়েভতুশেনকোর কথাই ধরুন না কেন। ঐ ফ্রেঞ্চ লোকটি ইথিওপিয়া গিয়েছিলেন এবং ফিরেছিলেন সকল প্রকার রোগ-জীবাণু নিয়ে। ইয়েভতুশেনকো তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘একজন কবি দাস ব্যবসায়ী হতে পারেন না।’ দাস ব্যবসায়ী হবার পর র্যাঁবো কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছিলেন। কবিতা ও দাস ব্যবসা শয্যাসঙ্গী হতে পারে না। এটাই আমার অবস্থান।
প্যারিস রিভিউ: লেখার অঙ্কুরোদগম সম্পর্কে কিছু বলবেন কি? কোনটি প্রথমে আসে? সাধারণ ধারণা, বিশেষ কোন ঘটনা, প্লট নাকি চরিত্র?
আঁচেবে: সব ক্ষেত্রে এটা একরকম হয় না। তবে আমি বলবো, সাধারণ ধারণাটাই সবার আগে আসে, তাকে অনুসরণ করে মূল চরিত্রগুলো। আমরা অসংখ্য ধারণার সমুদ্রে বাস করি কিন্তু সেগুলো উপন্যাস নয়। কারণ তাদের প্রাচুর্যতা রয়েছে। কিন্তু ঠিক যে মুহূর্তে একটি নির্দিষ্ট ধারণা কোন চরিত্রের সাথে যুক্ত হয় তখন তা একটি ইঞ্জিনের মত কাজ শুরু করে। আর ঠিক তখনই একটি উপন্যাসের যাত্রা শুরু হয়। বিশেষ করে যে উপন্যাসে স্বতন্ত্র ও কর্তৃত্বপরায়ণ চরিত্র থাকে। যেমন: Arrow of God এর জুলু চরিত্র। তবে A Man of the People ও No Longer at Ease এর মত উপন্যাস, যেখানে চরিত্রগুলো নিজ ব্যক্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণ করে না সেখানে সাধারণ ধারণাই প্রাথমিক পর্যায়ে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। কিন্তু আপনি যদি একবার প্রাথমিক পর্যায় পার হয়ে যান তখন সাধারণ ধারণা ও চরিত্রের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না।
প্যারিস রিভিউ: প্লটের অবস্থান কোথায়? আপনি কি প্লট নিয়ে ভাবেন? প্লট কি চরিত্র থেকে সৃষ্ট না ধারণা থেকে?
আঁচেবে: যখন উপন্যাস চলতে শুরু করে এবং যখন আমি বুঝতে পারি এটি ঠিক পথেই এগুচ্ছে তখন প্লট বা থিম নিয়ে চিন্তা করি না। এ বিষয়গুলো আপনা-আপনিই আসবে কারণ ততক্ষণে চরিত্রগুলোই কাহিনীকে ঠেলে নিচ্ছে। এক পর্যায়ে মনে হবে ঘটনার উপর আপনার তেমন কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। এরকম ঘটতেই হবে, তা না হলে কাহিনী অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। অর্থাৎ এ বিষয়গুলো স্বাভাবিকভাবেই ঘটবে। যদি এমন না ঘটে তবে বুঝতে হবে আপনি বিপদে পড়েছেন এবং আপনার উপন্যাস থেমে যেতে বাধ্য।
প্যারিস রিভিউ: তার মানে সাহিত্যকর্ম আপনার জন্য সহজ? কিংবা আপনার কাছে এটা কঠিন মনে হয় কি?
আঁচেবে: সত্যি বলতে এটা কঠিন কাজ। কিন্তু এই কঠিন শব্দটি দিয়ে আমি যা বুঝাতে চাচ্ছি তা প্রকাশ পাচ্ছে না। এটা মল্লযুদ্ধের মত; আপনি ধারণা ও কাহিনীর সাথে মল্লযুদ্ধে লিপ্ত। এর জন্য প্রচুর শক্তি প্রয়োজন। একই সাথে এটি উত্তেজনাকরও। তাই বিষয়টি কঠিন ও সহজ দুটোই। আপনাকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে লেখা শুরু করার পর আপনার জীবন আর আগের মত থাকবে না। লেখালেখি মূলত এক ধরনের কারাবাস। তাই পুরো বিষয়টি আনন্দদায়ক ও কঠিন।
প্যারিস রিভিউ: কখন ও কোথায় লিখতে পছন্দ করেন?
আঁচেবে: আমি লক্ষ্য করেছি নাইজেরিয়াতেই আমি সবচেয়ে ভাল লিখতে পারি। তবে যে বিষয়ে আমি লিখছি তার সাথে সম্পর্কিত পরিবেশেই বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করি। দিনের কোন ভাগে লিখলাম তা মুখ্য নয়। আমি ভোরের পাখি নই, চটজলদি বিছানা ছাড়তে আমার ভাল লাগে না। তাই সকালে আমার লেখা হয়ে উঠে না। যদিও শুনেছি অনেকে তাই করেন। দিনের যে কোন সময় লিখতে শুরু করি এবং অনেক রাত পর্যন্ত লিখতে পারি। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সংখ্যক বাক্য লিখতে চেষ্টা করি না। শৃঙ্খলা হলো কাজ করে যাওয়া, কম হলো না বেশি হলো সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ খুব বেশি লিখলেই যে খুব ভালো কিছু হলো তা তো নয়। তাই আপনার চেষ্টা করা উচিত শক্ত কোন টাইম টেবল নিজের উপর না চাপিয়ে সাধ্য অনুযায়ী নিয়মিত লিখে যাওয়া। এটাই আমার আদর্শ।
প্যারিস রিভিউ: আপনি কি কলম দিয়ে লিখেন, না টাইপ রাইটার ব্যবহার করেন? নাকি কম্পিউটার দ্বারা প্রলুব্ধ হয়েছেন?
আঁচেবে: না না। আমি খুবই সেকেলেÑ কলম দিয়ে লিখি। টেবিলে রাখা একটি কলমই আমার জন্য আদর্শ। যন্ত্রের সাথে কাজ করতে আমি স্বাচ্ছন্দ বোধ করি না, তাছাড়া ভাল টাইপ করতেও শিখিনি। যখন টাইপ রাইটার ব্যবহার করতে যাই মনে হয় আমার ও শব্দের মাঝখানে একটি যন্ত্র দাঁড়িয়ে আছে। আর লেখার অবস্থা যা দাঁড়ায় তা হিজিবিজি ছাড়া আর কিছুই না। আরেকটা কারণ আছে, আমি ঘষামাজা পছন্দ করি না। পরিচ্ছন্ন পান্ডুলিপিই আমার পছন্দ।
প্যারিস রিভিউ: Things Fall Apart এর মত বিশ্ববিখ্যাত বই এর লেখক হিসেবে আপনি কি বিব্রতবোধ করেন না, বিশেষ করে যখন দেখেন আপনার অন্য বইগুলো ঠিক সেভাবে আলোচিত হচ্ছে না?
আঁচেবে: মাঝে মধ্যে। তবে এটাকে আমি কোন সমস্যা মনে করি না। আপনি জানেন, বইগুলো সব একই পরিবারের। Things Fall Apart প্রথমেই আসার সুযোগ পেয়েছিল তাই খ্যাতির রাজ্যে পাকাপোক্ত স্থান করে নিতে পেরেছে। বাকি বইগুলো অন্যদিক দিয়ে ভাল করেছে। Things Fall Apart আমার বাস্তবতায় একটি মৌলিক গল্প তাই এটি শোনার দাবি রেখেছিল। ইউরোপের সাথে আমার হঠাৎ সাক্ষাতের গল্পটি পুনরায় বলার জন্য ওটাই ছিল আমার কাছে গ্রহণযোগ্য উপায়। তাই আমার চিন্তার জগতে অন্য বইগুলো অভিন্ন স্থান করে নিতে পারেনি। আর এ কারণেই Things Fall Apart সব মনোযোগ কেড়ে নেবার পরও আমি বিরক্ত বোধ করি না। আপনি যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন এটিই আমার সেরা বই কিনা, আমি বলবো, আমি সত্যিই জানি না।
আমার লেখা প্রতিটি বই ভিন্ন হবার চেষ্টা করেছে কারণ আমি মানব জীবনের জটিলতায় বিশ্বাস করি। সব সময় এমন একজনকে পাওয়া যাবেই যিনি তার নিজস্ব অবস্থান থেকে এ গল্পটিকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করবেন এবং এই একই ব্যক্তি আরো ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করবেন যখন তার অবস্থানও ভিন্ন হবে। আমাদের ইবো উৎসবগুলোতে মাসকারেড নৃত্য অনুষ্ঠিত হয়। ইবোরা বলে থাকে, তুমি যদি ভাল করে এই নৃত্য দেখতে চাও তবে তোমাকেও জায়গা বদলাতে হবে। কারণ মাসকারেড নৃত্য জায়গা বদলায়। যদি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাক তবে তুমি অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত হবে। আমার মনে হয়, পৃথিবীর গল্পগুলো এভাবেই বলা উচিত, অর্থাৎ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে।
প্যারিস রিভিউ: গল্প বলা ও লেখার মধ্যে কোন পার্থক্য আছে?
আঁচেবে: অবশ্যই। আমার মনে আছে, আমাদের সন্তানরা যখন ছোট ছিল তখন ঘুমাবার আগে প্রায়ই তাদের গল্প পড়ে শুনানো হতো। মাঝে মধ্যে আমি তাদের বলতাম, আমি তোমাদের একটি গল্প বলবো। এতে ওদের চোখ যেভাবে জ্বলে উঠতো গল্প পড়ে শুনালে সেরকম হতো না। সন্দেহ নেই, গল্প পড়ার চেয়ে শুনতেই ওরা বেশি পছন্দ করতো। আমরা এমন এক সমাজে বাস করি যা এখন ধ্বনি ও বর্ণের সন্ধিক্ষণে আছে। মৌখিক গল্পগুলো ম্লান হয়ে গেছে ঠিকই কিন্তু লিখিত গল্পের সাথে তাদের পার্থক্য এখনো সুস্পষ্ট। প্রত্যেক মাধ্যমেরই নিজস্ব পথ, পদ্ধতি ও নিয়ম আছে। তারা একে অন্যকে মজবুত করতে পারে। আমরা মুখে বলা গল্পগুলোর খানিকটা শক্তি লিখিত গল্পে নিয়ে আসতে পারি। এই সুবিধা আমার প্রজন্মের আছে। সমসাময়িক সাহিত্যে আমাদের সাহিত্য (নাইজেরিয়ান সাহিত্য) এই অবদানটুকু রাখতে পেরেছে।
প্যারিস রিভিউ: বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের সময় পাঠকদের কোন মন্তব্যে বিস্মিত হয়েছেন কি? কিংবা তারা কিভাবে আপনার লেখার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেছে?
আঁচেবে: জী জী, হয়েছি। লোকজন বিস্ময়কর সব মন্তব্য করে। আমি আপনাকে এক লাজুক শেতাঙ্গ আমেরিকানের কথা বলতে পারি। সে সত্তর দশকে মেসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো। একবার আমার অফিসে এসে সে মন্তব্য করলোÑ ওকাংকো আমার বাবা।
প্যারিস রিভিউ: ওকাংকো নামে কাউকে কি আপনি চিনতেন? কয়েক বছর আগে আমি যখন নাইজেরিয়া গিয়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক যুবক নিজেকে ওকাংকো বলে পরিচয় দিয়েছিল। আমি তাকে ভন্ড ভেবেছিলাম। এটা কি কোন সত্যিকারের নাম?
আঁচেবে: জী জী, হয়েছি। লোকজন বিস্ময়কর সব মন্তব্য করে। আমি আপনাকে এক লাজুক শেতাঙ্গ আমেরিকানের কথা বলতে পারি। সে সত্তর দশকে মেসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো। একবার আমার অফিসে এসে সে মন্তব্য করলো-- ওকাংকো আমার বাবা।
প্যারিস রিভিউ: ওকাংকো নামে কাউকে কি আপনি চিনতেন? কয়েক বছর আগে আমি যখন নাইজেরিয়া গিয়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক যুবক নিজেকে ওকাংকো বলে পরিচয় দিয়েছিল। আমি তাকে ভন্ড ভেবেছিলাম। এটা কি কোন সত্যিকারের নাম?
আঁচেবে: এটা খুব সাধারণ একটি নাম। এই নামটি ইবোল্যান্ডে খুব বেশি প্রচলিত। কারণ সেখানে চারদিনে এক সপ্তাহ এবং প্রত্যেকটি বারের নামই কারও না কারও নাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ আপনি সোমবার, মঙ্গলবার, বুধবার কিংবা বৃহস্পতিবারে জন্মেছেন। আপনি যদি একজন ইবো হন তবে আপনার নাম রাখা হবে ‘সোমবারের পুত্র’ অথবা ‘মঙ্গলবারের পুত্র’ অথবা ‘বুধবারের পুত্র’ অথবা ‘বৃহস্পতিবারের পুত্র।’ ওকাংকো বলতে তাই বুঝায়। সপ্তাহের প্রথম দিন জন্মালে এই নাম রাখা হয়। যদি আপনি ঐ দিনে না জন্মে থাকেন তবে আপনার নাম হবে ওকিকি কিংবা ওকোয়ি কিংবা ওকাফো। অবশ্য সবাই এ নিয়ম মানে না। আপনার বাবা-মা চাইলে অন্য নামও রাখতে পারেন, যেমনÑ আঁচেবে। কিন্তু যে নামই রাখা হোক না কেন জন্মবার আপনার নাম হিসেবেই থেকে যাবে। তাই ওকাংকো খুবই সাধারণ নাম।
প্যারিস রিভিউ: শ্রেষ্ঠ নারী চরিত্রগুলোর একটি আপনার সৃষ্টি। আমি Anthills of Savannah’র বেট্রিস এর কথা বলছি। আপনি কি তার সাথে একাত্মতা বোধ করেন? আপনার নিজের কোন বৈশিষ্ট্য কি এই চরিত্রের মধ্যে দেখতে পান? আমার কাছে বেট্রিসকে খানিকটা পরিত্রাতা বলে মনে হয়েছে।
আঁচেবে: জী জী, আমি তার সাথে একাত্মতা বোধ করি। আসলে ভাল ও মন্দÑ আমার সব চরিত্রের সাথেই আমি একাত্ম হয়ে যাই। চরিত্রগুলোকে অকৃত্রিম করতেই আমাকে এমন করতে হয়। আমাকে চরিত্রগুলো বুঝতে হয় এমনকি যদি আমি তাদের সমর্থন নাও করি। অবশ্য পুরোপুরি নয়Ñ এটা সম্ভবও নয়। চরিত্রের পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ প্রকৃত অর্থে কাক্সিক্ষতও নয়। এমন অনেক ক্ষেত্র আছে যেখানে বিশেষ কোন চরিত্র আপনার বা আমার প্রতিনিধিত্ব করে না। যদিও মাঝে মাঝে বেট্রিস এর মত চরিত্রগুলো আমার নিজস্ব উপাদান, বিশ্বাসের পদ্ধতি, আশা ও আকাক্সক্ষা ধারণ করে। অনেকেই আমার লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়েন না কিন্তু মন্তব্য করেন বেট্রিসই আমার সৃষ্ট একমাত্র নারী চরিত্র এবং সম্ভবত আমি নারীবাদীদের চাপে পড়েই এই চরিত্র সৃষ্টি করেছি। আসলে, No Longer at Ease, A Man of the People থেকে শুরু করে Anthills of Savannah পর্যন্ত সব উপন্যাসেই কার্যত বেট্রিস উপস্থিত ছিল। বিশৃঙ্খলা থেকে আমাদের মুক্ত করার ক্ষেত্রে নারীদের প্রতি আমি যে গুরুত্বারোপ করি নিঃসন্দেহে সেটা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা আমার প্রথাগত সংস্কৃতিতে নারীদের ভূমিকার একটি প্রতিফলন। তা হলো, নারীরা ততক্ষণ পর্যন্ত রাজনীতিতে প্রবেশ করে না, যতক্ষণ না পুরুষরা এমন একটি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে যার ফলে সমাজ সামনে কিংবা পেছনে চলার শক্তি হারিয়ে ফেলে। এভাবেই গল্পগুলো সাজানো হয়েছে এবং আমি তাই বলতে চেয়েছি।
প্যারিস রিভিউ: সাহিত্যের প্রতি প্রতিশ্র“তিশীল কারো জন্য আপনার কী পরামর্শ থাকবে? আমার ধারণা উদীয়মান ঔপন্যাসিকদের কাছ থেকে পরামর্শ চেয়ে এবং পান্ডুলিপি পড়ে দেখার জন্য আপনি ক্রমাগত অনুরোধ পেয়ে যাচ্ছেন।
আঁচেবে: পান্ডুলিপির বানে ভেসে যাবার মত অবস্থা এখনো হয়নি। তবে কেউ কেউ আমার কাছে আসেন। আমি যেটুকু বুঝি, উদীয়মান লেখকরা উৎসাহিত হতে চান। তবে আমি বিশ্বাস করি, লেগে থাকার পরামর্শ দেয়া ছাড়া একজন ভাল লেখককে আর কিছু বলার নেই। যে কাজ করার জন্য আপনি মনস্থির করেছেন তা নিয়ে ভাবুন এবং সেই সাথে সাধ্যমত কাজ চালিয়ে যান। এক সময় আপনি সাফল্য পাবেন এবং মানুষকে আপনার কাজ দেখাতে পারবেন। কিন্তু আমি লক্ষ্য করি, আজকালকার তরুণরা তা করছে না। তারা প্রথমে একটি খসড়া পান্ডুলিপি তৈরি করে এবং অন্যের সৎ পরামর্শ অনুযায়ী সেটা শেষ করে। আমি কৌশলে এমন বিষয় থেকে নিজেকে বিরত রাখি। আমি বলি-- লেগে থাকুন। আমি যে সত্য শিখতে শিখতে বড় হয়েছি তা হলো আমাকে পরামর্শ দেবার কেউ নেই। তাই সর্বোত্তম চেষ্টা চালিয়ে যান। যদি আপনার লেখা যথেষ্ট ভাল না হয় তবে আপনি নিজেই একদিন তা মেনে নেবেন। আমি সেই ব্যক্তি হতে চাই না যে অন্যকে বলে- আপনি পারবেন না। যদিও আমি জানি, আমার কাছে আসা অধিকাংশ পান্ডুলিপিই ভাল নয়। কিন্তু আপনি কোন তরুণ লেখককে বলতে পারেন না যে, তুমি পারবে না কিংবা তোমার লেখা ভাল নয়। অন্য কেউ বলতে পারে, তবে আমি মনে করি আমি সাহিত্য জগতের পুলিশ নই।
“আমিই প্রকৃত দেশপ্রেমিক” : কমরেড কিষানজী
অনুবাদ: শাহেরীন আরাফাত
সন্দেহাতীতভাবে ভারত সরকারের মোস্ট ওয়ান্টেড ব্যক্তিদের তালিকায় তার অবস্থান দুই নম্বরে (এই তালিকার ১ নম্বর নাম কমরেড গণপতি), তিনি সিপিআই (মাওবাদী)’এর পলিট ব্যুরোর সদস্য ও সামরিক শাখার প্রধান কমরেড মাল্লোজুলা কোটেশ্বর রাও,ওরফে ‘প্রহলাদ’, ওরফে ‘বিমল’, ওরফে ‘রামজী’, ওরফে ‘কিষানজী’ (৫৭)। তাঁর বেড়ে উঠা অন্ধ্রপ্রদেশে গান্ধী ও রবি ঠাকুরের বই পড়ে। কিন্তু বিশ্বের মুক্তির ইতিহাস অধ্যয়ন ও অনুধাবন করার পর এক পর্যায়ে তিনি বিপ্লবাকাঙ্খায় অরণ্যে আত্মগোপন করেন। তাঁর জন্ম ১৯৫৪ সালে অন্ধ্রপ্রদেশের করিমনগর জেলার পেদপল্লী গ্রামে (উঃ তেলেঙ্গনা)। ১৯৮০ সালে কান্দাপালি সিথামাইয়াহ নামের এক স্কুল শিক্ষকের নেতৃত্বে “পিপলস্ ওয়ার গ্রুপ” (পিডব্লিউজি) প্রতিষ্ঠিত হয়, যার অন্যতম সহযোগী ছিলেন কিষানজী। পরবর্তীতে ২০০৪ সালে ‘পিডব্লিউজি’ এবং ‘মাওয়িস্ট কমিউনিস্ট সেন্টার অব ইন্ডিয়া’ একীভুত হয়ে গঠিত হয় ‘সিপিআই (মাওবাদী)’। ১৯৮২ সালে সার্চ অপারেশন চলার সময়ে পুলিশ তাঁর পেদপল্লী গ্রামের বাড়ীটি ভেঙ্গে দেয়। তিনি আত্মগোপনে চলে যান, এরপরে আর মায়ের সাথে দেখা করতে আসেননি; তবে তেলেগু পত্রিকার মাধ্যমে তিনি তাঁর মা’কে লিখতেন। কিষানজী’র স্ত্রী সুজাতাও মাওবাদী আন্দোলনের সাথে যুক্ত। তিনি দান্তেওয়াড়া এলাকার মাওবাদী কর্মকাণ্ড তত্ত্বাবধান করেন। মহারাষ্ট্র, ছত্তিশগড়’এর নক্সাল এলাকায় ২০ বছর জড়িত থাকার পর তাকে পুনরায় পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্ব দেওয়া হয়। লালগড় পুলিশ ক্যাম্প থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে কিষানজী’র একটি গুপ্ত আশ্রয়স্থল থাকা সত্ত্বেও তাকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী বাহিনী(র’, সিআরপিএফ, বিএসএফ, পুলিশ, সেনাবাহিনী) তাঁকে খুঁজে না পাওয়ার মূলে ছিল জনগণের সাথে তাঁর একাত্মতা। তিনি প্রতিদিন ১৫টি সংবাদপত্র পড়তেন, সেই সাথে তার পার্টির প্রকাশনাগুলোর সাথে যুক্ত থাকতেন। তিনি ছিলের সিপিআই (মাওবাদী) পার্টির সামরিক শাখার প্রধান। মুখের ছবি তুলতে না দিলেও তিনি সাংবাদিকদের সাথে মন খুলেই কথা বলতেন। ৩৭ বছর যাবৎ একই মতাদর্শে অটুট থেকে নিপীড়িতদের মুক্তির সংগ্রামে আমৃত্যু লড়ে যান এই বিপ্লবী।
২৪ নভেম্বর ২০১১ ছিল এক কালো দিন, সেদিন ‘ভুয়া সংঘর্ষ’ (ফেক এনকাউন্টার) দেখিয়ে পরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্র কর্তৃক সিআরপিএফ দ্বারা হত্যা করা হয় কমরেড কিষানজী’কে। বেশ কিছুদিন ধরেই সরকারের শান্তি আলোচনা প্রক্রিয়া চলছিল মাওবাদীদের সাথে। ২৩ তারিখে কিষানজী এমনই এক গোপন সভায় হাজির হলে তাকে ধোঁকা দিয়ে আটক করা হয় এবং অমানুষিক নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করার পর ২৪ নভেম্বর ২০১১ তারিখ, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার দিকে পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বুড়িশোল জঙ্গলে এক ভুয়া এনকাউন্টারের নাটক সাজানো হয়।
ধিক্কার জানাই ভারত রাষ্ট্রকে বর্বরোচিত এই হত্যাকাণ্ডের জন্য…
শহীদ কমরেড কিষানজী’র প্রতি রইলো আমাদের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা। কিষানজী শুধু কোন একক ব্যক্তি নন; তিনি এমনই এক সত্ত্বা, যা বিদ্যমান সকল মুক্তিকামী মানুষের মাঝে। তাই কিষানজী’দের মৃত্যু নাই, তারা চিরঞ্জীব। তিনি বেঁচে থাকবেন, গণমানুষের মুক্তির নেশায়,লড়াই-সংগ্রামে।
লাল সালাম, কমরেড…..
——————————————–
(২০০৯ সালের নভেম্বরে “তেহেলকা ডট কম”এ প্রকাশিত এই সাক্ষাৎকারে কমরেড মাল্লোজুলা কোটেশ্বর রাও ওরফে ‘কিষানজী’ কথা বলেন সশস্ত্র সংগ্রাম, শান্তি আলোচনা, দলের অর্থায়নের উৎস, ভারতের প্রথাগত গণতন্ত্র ও জনগণতন্ত্রের পার্থক্য এবং সিপিআই (মাওবাদী)’এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন তুষা মিত্তাল।)
মধ্যরাত্রিতে টেলিফোনে দেওয়া সাক্ষাৎকারটির উদ্ধৃতাংশ:
প্রশ্ন: আপনার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কিছু বলুন। আপনি কিভাবে সিপিআই (মাওবাদী) দলে যোগ দিলেন?
সাংবাদিকদের সাথে কথা বলছেন কমরেড কিষানজী
কমরেড কিষানজী: আমি অন্ধ্র প্রদেশের করিম-নগরে জন্মগ্রহণ করি। ১৯৭৩ সালে গণিতে স্নাতক ডিগ্রীর পর আমাকে আইনের মাধ্যমে অভিযুক্ত দেখিয়ে হায়দ্রাবাদে সরিয়ে দেওয়া হয়। আমার রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয় ‘তেলেঙ্গানা সংঘর্ষ সমিতি’(Telangana Sangarsh Samiti)’এর সাথে আমার সংযুক্তি থেকে; এখানে উল্লেখ্য যে, ‘তেলেঙ্গানা সংঘর্ষ সমিতি’ পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্যের দাবী জানাচ্ছিল সেসময়ে। ১৯৭৫ সালের জরুরী অবস্থার মধ্যেই আমি অন্ধ্র প্রদেশে ‘রেডিক্যাল স্টুডেন্টস মুভমেন্ট’ (Radical Students Union (RSU))’এর কাজ শুরু করি। এরপরে আমি বিপ্লবের উদ্দেশ্যে আত্মগোপনে চলে যায়। সেসময়ে বেশ কিছু বিষয়ে আমি অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম; এর মাঝে কিছু বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ,যেমন: লেখক ভারাভারা রাও (যিনি বিপ্লবী লেখক সংঘ, Revolutionary Writers Association’এর প্রতিষ্ঠাতা),তৎকালীন ভারতের রাজনৈতিক আবহ এবং একটি প্রগতিশীল পরিবেশ, যে পরিবেশে আমার বেড়ে উঠা।
আমার বাবা ছিলেন একজন গণতন্ত্রী এবং মহান মুক্তিযোদ্ধা [*তিনি ১৯৪০ এর দশকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন]। তিনি রাজ্য কংগ্রেস পার্টির সহসভাপতিও ছিলেন। আমরা বর্ণে ব্রাহ্মণ হলেও আমাদের পরিবার বর্ণ বিশ্বাস করতো না। যখন আমি সিপিআই (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) দলে যোগদান করি, আমার বাবা কংগ্রেস পরিত্যাগ করেন। তখন তিনি একথা বলেন যে, ‘এক ছাদের নিচে দুই ধারার রাজনীতি বেঁচে থাকতে পারে না।’ তিনি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন, কিন্তু সশস্ত্র সংগ্রামে নয়। ১৯৭৭ সালে জরুরী অবস্থা শেষ হবার পর আমি সামন্তবাদের বিরুদ্ধে কৃষকদের একটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেই। ৬০ হাজারেরও বেশী কৃষক এই আন্দোলনে যোগ দেন, এই কৃষক আন্দোলন পরবর্তীতে সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
প্রশ্ন: গৃহমন্ত্রী (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী) সিপিআই (মাওবাদী)’এর সাথে বন অধিকার, জমি অধিগ্রহণ এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল SEZs(Special Economic Zones)’এর মতো বিষয়গুলোতে কথা বলতে আগ্রহী। আপনারা তার এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন কেন? তিনি শুধুমাত্র আপনাদের সহিংসতা স্থগিত রাখার কথাই বলেছেন।
কমরেড কিষানজী:সরকার তার বাহিনী প্রত্যাহার করলে আমরা আলাপের জন্য প্রস্তুত। সহিংসতা আমাদের কর্মসূচীর অংশ নয়। আমাদের এই সহিংসতা কেবলই আত্মরক্ষার জন্য। সরকারী বাহিনী আমাদের লোকদের প্রতিদিন আক্রমণ করছে। বাস্তারে গত মাসে কোবরা বাহিনী ১৮জন নিরপরাধ আদিবাসী এবং ১২জন মাওবাদীকে হত্যা করেছে। ছত্তিশগড়ে উন্নয়ন খাতে যারা আমাদের সহায়তা করতো, তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। এগুলো বন্ধ করুন; সহিংসতাও বন্ধ হয়ে যাবে। সম্প্রতি, ছত্তিশগড়ে পুলিশের ডিজিপি একটা সন্ত্রাসী সংগঠন ‘সালওয়া জুডুম’এর ৬,০০০ বিশেষ পুলিশ সদস্যদের নিজেদের গৌরব বলে তকমা লাগিয়েছেন। অথচ, তারা বছর বছর ধরে আদিবাসীদের ধর্ষণ, হত্যা, লুটের সাথে জড়িত। ‘সালওয়া জুডুম’এর অত্যাচারে গ্রামের পর গ্রাম বিরানভূমিতে পরিণত হচ্ছে। সরকার নিজের মনগড়া কথা বলে যেতে পারে, তবে আমরা তা বিশ্বাস করিনা। তারা কিভাবে এই কর্মপন্থার পরিবর্তন ঘটাবে, যখন তাদের অধিকারে কিছুই নাই? সবই তো যুক্তরাষ্ট্র আর বিশ্বব্যাংকের এখতিয়ারে!
প্রশ্ন: কোন পরিস্থিতিতে আপনারা সহিংসতা কমাবেন?
কমরেড কিষানজী: প্রধানমন্ত্রীকে আদিবাসীদের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে এবং সেই সাথে এই সব অঞ্চলে মোতায়েন করা সৈন্যদের প্রত্যাহার করতে হবে। এই সেনাবাহিনী নতুন কিছু না, আমরা গত ২০বছর যাবৎ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছি। সকল বন্দীদের মুক্তি দিতে হবে। সেনা প্রত্যাহারের জন্য যা সময় লাগে নিন, কিন্তু এসেময়ে যেন আমাদের উপর পুলিশী হামলা না হয়, তা নিশ্চিত করুন। যদি সরকার তাতে রাজী থাকে, তাহলে আমাদের পক্ষ থেকে কোন সহিংসতা হবে না। আমরা পূর্বের ন্যায় গ্রামাঞ্চলে আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাব।
প্রশ্ন: এতে সম্মত হওয়ার পূর্বে আপনারা কি রাষ্ট্রকে আশ্বস্ত করতে পারেন যে, এক মাসের জন্য আপনারা আক্রমণ করবেন না?
কমরেড কিষানজী: আমরা এবিষয়টা নিয়ে চিন্তা করবো। এবিষয়ে আমাকে দলের সাধারণ সম্পাদকের সাথে আলোচনা করতে হবে। কিন্তু এমন কী নিশ্চয়তা আছে যে, তাদের তরফ থেকে এই এক মাসে কোন সহিংসতা হবে না? তাই সরকারের তরফেই এই ঘোষণা আসতে হবে এবং প্রত্যাহার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। এটা জনগণের জন্য শুধুমাত্র একটি প্রদর্শনী হবে না। অন্ধ্র প্রদেশের দিকে তাকান। তারা আলোচনা শুরু করলো, আবার সেই আলোচনা ভেঙ্গেও দিল। আমাদের একজন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অন্ধ্রের রাজ্য সচিবের সাথে দেখা করতে গেলেন; পরবর্তীতে, সরকারের সাথে আলাপ করার দুঃসাহসের অভিযোগে (!) পুলিশ উনাকে গুলি করে হত্যা করে।
প্রশ্ন: যদি সত্যিই আপনারা গণমানুষের কর্মসূচী নিয়ে কাজ করেন, তাহলে সাথে অস্ত্র রাখার প্রয়োজনীয়তা কী? আপনার লক্ষ্য কি ‘আদিবাসী কল্যাণ’, নাকি ‘রাজনৈতিক শক্তি’?
কমরেড কিষানজী: রাজনৈতিক শক্তি। আদিবাসী কল্যাণকে আমরা অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি, কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতা ছাড়া আমরা কিছুই অর্জন করতে পারব না। একটি সেনাবাহিনী এবং অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া কেউ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে পারবে না। আদিবাসীদের রাজনৈতিক ক্ষমতা না থাকার ফলেই তারা শোষিত এবং এই শোষণ তাদেরকে সবচেয়ে অনুন্নত ও পিছিয়ে পড়াদের চরমে পৌঁছে দিয়েছে। নিজের সম্পদের উপরেও তাদের কোন অধিকার নেই। তাসত্ত্বেও, আমাদের মতাদর্শ অস্ত্রের উপর স্থিত না। আমরা অস্ত্রকে দ্বিতীয় অবস্থানে স্থান দেই। অন্ধ্রে আমরা একারণেই এক বড় ক্ষতির সম্মুখীন হই।
প্রশ্ন: সরকার বলছে আগে সহিংসতা থামান, আপনারা বলছেন আগে সেনা প্রত্যাহার করুন। এই বুদ্ধিবৃত্তিশূণ্য চক্রে আদিবাসী সমাজ,আপনারা যাদের প্রতিনিধিত্ব করেন বলে দাবি করেন, তারা সর্বাধিক কষ্টকর অবস্থার সম্মুখিন হচ্ছে।
কমরেড কিষানজী: আচ্ছা, তাহলে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারীদের আনা হোক। অন্ধ্র প্রদেশ হোক, পশ্চিমবঙ্গ বা মহারাষ্ট্র, আমরা কখনোই সহিংসতা শুরু করিনি। প্রথম আক্রমণ সবসময় সরকার পক্ষ থেকেই আসে। পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম [ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টি(মার্কসবাদী)]’এর সন্ত্রাসীরা তাদের দলের সাথে যুক্ত নয় এমন কাউকেই গ্রামে প্রবেশ করতে দেয় না (*তৎকালীন সময়ে সিপিএম ছিল পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন দল)। পুলিশ ১৯৯৮ সাল থেকে লালগড় এলাকায় ক্যাম্প স্থাপন করে আছে। এমতাবস্থায়, আলুর মূল্যবৃদ্ধি অথবা বিশুদ্ধ পানীয় জলের জন্য কিভাবে আমরা চাপ দিতে পারি? এজন্য এমন কোন মঞ্চ আমাদের নাই। যখন পশ্চিমবঙ্গে সর্বনিম্ন মজুরি দেওয়ার কথা প্রতিদিন ৮৫ টাকা, অথচ মানুষকে দেওয়া হচ্ছে ২২ টাকা করে; আমরা দাবী জানালাম ২৫ টাকা করার। মহাভারতের যুদ্ধ শুরু হয়েছিল যখন পাণ্ডবদের দাবী অনুযায়ী কৌরভরা পাঁচটি গ্রাম তাদের দিতে অস্বীকার করে, তখন। রাষ্ট্রও আমাদের ৩ টাকা মজুরী বৃদ্ধিকে অগ্রাহ্য করলো। এখানে আমরা পাণ্ডব, আর তারা কৌরভ।
প্রশ্ন: আপনি বলেছেন সহিংসতা আপনাদের কর্মসূচী নয়, কিন্তু আপনারা গত চার বছরে প্রায় ৯০০ পুলিশ সদস্যকে হত্যা করেছেন,যাদের বেশিরভাগই এসেছে গরীব আদিবাসী পরিবার থেকে। এমনকি যদি সেটি অপরপক্ষের সহিংসতার কাউন্টারও হয়ে থাকে, এর মধ্য দিয়ে গণ-মানুষের পক্ষের এই লক্ষ্যে কিভাবে এগুনো সম্ভব?
কমরেড কিষানজী: আমাদের যুদ্ধ পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে নয়, এটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। আমরা পুলিশের সাথে হতাহতের সংখ্যা কমাতে চাই। বাংলায়, অনেক পুলিশ পরিবার আসলে আমাদের সাথে সহমর্মী। সেখানে গত ২৮ বছরে ক্ষমতাসীন সিপিএম প্রায় ৫১ হাজার রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। হ্যাঁ, আমরা গত সাত মাসে ৫২ জন সিপিএম সদস্যকে হত্যা করেছি। আর তা কিন্তু সিপিএম ও পুলিশের পশুর ন্যায় বর্বর আচরণের ফলেই করতে হয়েছে।
প্রশ্ন: সিপিআই (মাওবাদী) কিভাবে গঠিত হলো? আপনাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির কী কী অভিযোগ রয়েছে?
কমরেড কিষানজী: সেখানে কোন চাঁদাবাজী হয়নি। আমরা কর্পোরেট এবং বড় বুর্জোয়াদের কাছ থেকে কর সংগ্রহ করেছি, এটি কর্পোরেট সেক্টর থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে তহবিল সংগ্রহে অর্থায়ন ভিন্ন অন্য কিছু নয়। আমাদের একটি ষাণ্মাসিক নিরীক্ষা হয়। একটা পয়সাও নষ্ট হয় না। গ্রামবাসীরাও স্বেচ্ছায় প্রতি বছর তাদের দুই দিনের আয় পার্টি তহবিলে অনুদান হিসেবে দিয়ে থাকেন। গাদচিরলি’তে দুই দিনের বাঁশ কাটা থেকে আমরা ২৫ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করি। বাস্তারে টেন্ডু পাতা সংগ্রহ থেকে আমরা প্রায় ৩৫ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করি। এছাড়াও, কৃষকেরা ১০০০ কুইন্টাল ধান অনুদান হিসেবে দিয়ে থাকে।
প্রশ্ন: যদি কৃষক এই অনুদান দিতে রাজি না হয়?
কমরেড কিষানজী: এমনটা কখনোই হবে না।
প্রশ্ন: এর কারণ কি ভয়?
কমরেড কিষানজী: কখনোই না। তারা আমাদের সঙ্গেই আছেন। আমরা যে উন্নয়ন কর্মকান্ডের উদ্যোগ নিয়েছি, তার জন্য একটা পয়সাও গ্রামবাসীদের কাছ থেকে দাবী করিনি।
প্রশ্ন: মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকায় আপনারা কী কী উন্নয়ন করেছেন? ছত্তিসগড় এবং ঝাড়খন্ডের আদিবাসীদের জীবন-ধারা কিভাবে উন্নত হয়েছে?
কমরেড কিষানজী: আমরা মানুষকে রাষ্ট্রের প্রকৃত চেহারার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছি, তাদেরকে ধনীদের জীবন-যাত্রা ও তারা(আদিবাসীরা) কী কী সুবিধা থেকে বঞ্চিত, সে সম্পর্কে অবগত করেছি। এসব এলাকায় ১টাকায় ১০০০ টেন্ডু পাতা বিক্রি হতো। আমরা মহারাষ্ট্রের ৩টি জেলা, অন্ধ্র প্রদেশের ৫টি জেলা এবং সমগ্র বাস্তার এলাকায় এই দাম বাড়িয়ে প্রতি টেন্ডু পাতার দাম ৫০ পয়সা করেছি। প্রতি বান্ডেল বাঁশ ৫০ পয়সায় বিক্রি হতো। এখন যার দাম ৫৫ টাকা। আমদের এই অর্জন এসেছে রাষ্ট্রের নির্মম প্রতিরোধ ও নিষ্ঠুর চেহারাটার সাক্ষাৎ পাওয়ার মধ্য দিয়ে। শুধুমাত্র গাদচিরলি’তেই তারা আমাদের ৬০ জনকে হত্যা করে, আর আমরা মারি ৫ জনকে।
এছাড়াও সিপিআই (মাওবাদী) পার্টি প্রায় প্রতিদিনই ১২০০টি গ্রামে স্বাস্থ্য সহায়তা দিয়ে থাকে। বাস্তারে আমাদের বেশকিছু সৈনিক রয়েছেন, যারা দক্ষ ডাক্তার, তারা এপ্রোন পরেন এবং জঙ্গলে ধাত্রীর কাজ করে থাকেন। শুধুমাত্র বাস্তারেই আমাদের এমন ৫০টি ভ্রাম্যমান স্বাস্থ্য দল এবং ১০০টি ভ্রাম্যমান হাসপাতাল আছে। গ্রামবাসীরা নির্দিষ্ট অসুস্থতার জন্য মনোনীত ব্যক্তিদের যান; যেমন: জ্বরের জন্য যাবে ইসা’র কাছে, আবার ডাইরিয়ার জন্য যাবে রামু’র কাছে, ইত্যাদি। এই অঞ্চলে মানুষ এতো বেশী অসুস্থ হয় যে কখনো কখনো লাশ উঠানোর মানুষেরও স্বল্পতা দেখা দেয়। আমরা মানুষের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য ডাক্তারদের কাছে ঔষধ সরবরাহ করে থাকি। সরকার জানে না যে, এই ঔষধ কিন্তু সরকারী হাসপাতাল থেকেই আসে।
প্রশ্ন: রাষ্ট্র যদি নক্সাল অধ্যুষিত এলাকায় সিভিল প্রশাসন পাঠায়, আপনারা কি তার অনুমতি দিবেন?
কমরেড কিষানজী: আমরা স্বাগত জানাব। আমরা চাই শিক্ষক ও ডাক্তারেরা এখানে আসুক। লালগড়ের জনগণ যুগ-যুগ ধরে সেখানে একটি হাসপাতালের দাবী জানাচ্ছে। কিন্তু সরকার কিছুই করেনি। যখন জনগণ নিজেদের চেষ্টায় একটা হাসপাতাল গড়ে তুললো,সরকার এটিকে সেনা-ছাউনিতে রূপান্তর করলো।
প্রশ্ন: আপনাদের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা কি? তিনটি সুস্পষ্ট লক্ষ্যের কথা বলুন।
কমরেড কিষানজী: গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং তারপর সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথমেই প্রয়োজন রাজনৈতিক ক্ষমতা। দ্বিতীয়ত, আমাদের অর্থনীতিকে স্বনির্ভর করার জন্য সাম্রাজ্যবাদের ঋণের কোন প্রয়োজন নাই। যুগ-যুগ ধরে আমরা বিদেশী ঋণের টাকা শোধ করে আসছি, আর যেহেতু এখানে মুদ্রার অবমূল্যায়ন ক্রমবর্দ্ধমান তাই অপরিশোধিত ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। এটা কখনোই পরিশোধিত হবে না। আর এটাই চায় বিশ্বব্যাংক। আমাদের এমন এক অর্থনীতি প্রয়োজন, যা দুইটি বিষয়ের উপর কাজ করবে- কৃষি এবং শিল্প। প্রথমত, আদিবাসীরা জমি চায়। জমিতে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্র তাদের শোষণ করেই যাবে। শ্রমের ভিত্তিতে শতকরা হারে জনগণকে শস্য বরাদ্দ দিতে হবে। আমরা শিল্পের বিরোধী নই; শিল্প ছাড়া উন্নয়ন কিভাবে সম্ভব? কিন্তু আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে শিল্পটি ভারতের জন্য সহায়ক, নাকি আমেরিকা বা বিশ্বব্যাংকের সহায়ক। বড় বাঁধ, বড় শিল্পের বদলে আমরা ছোট শিল্প, বিশেষত যা কৃষির উপর নির্ভরশীল, এমন শিল্পকে উন্নীত করার পক্ষপাতী। তৃতীয় লক্ষ্য হলো, টাটা থেকে আম্বানী পর্যন্ত সকল বড় কোম্পানিকে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব করা, সকল স্মারক চুক্তি (MOU) বাতিল করা, তাদের সকল সম্পদকে জাতীয় সম্পদ ঘোষণা করা ও এর মালিকদের জেলে প্রেরণ করা। অবশ্যই, নিম্ন থেকে উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা থাকবেন।
প্রশ্ন: কিন্তু বিশ্বে কমিউনিস্ট সরকারগুলোর দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, তারা যে ব্যবস্থাকে উৎখাত করেছিল শোষণের অভিযোগে, ক্ষমতায় এসে তারা নিজেরাও সেরকমই হয়ে যায়। মাওবাদী শাসন ব্যবস্থারই এমন অনেক উদাহরণ দেওয়া সম্ভব যেখানে বল প্রয়োগ হয়েছে এবং মত পার্থক্য সহ্য করা হয়নি। কিভাবে তা মানুষের স্বার্থে হতে পারে?
গণমানুষের নেতা কমরেড কিষানজী
কমরেড কিষানজী: এই সব পুঁজিবাদীদের দ্বারা ছড়ানো গল্প। গ্রামের মানুষেরা বিনা চিকিৎসায় মরছে, অথচ ডাক্তারেরা সব শহরে থাকতে চায়। আমাদের সব প্রকৌশলীরা জাপানের মতো উন্নত দেশে, অথবা আইটি নিয়ে কাজে আগ্রহী। তারা জনগণের সম্পদ ব্যবহার করেই নিজেদের গন্তব্যে পৌঁছেছেন। তারা আমাদের দেশের জন্য কী করেছেন? রাষ্ট্র আপনাকে ডাক্তার হওয়ার জন্য জোর দিতে পারে না। কিন্তু যদি আপনি তা হয়ে যান, তাহলে আপনাকে জোর দেওয়া উচিৎ (রাষ্ট্র কর্তৃক) নিজের দক্ষতা অনুযায়ী দুই বছর গ্রামে সেবা দেওয়ার জন্য। রাষ্ট্র কতটা শোষক, তা নির্ভর করে রাষ্ট্র ক্ষমতায় কারা আসীন তার উপর।
আমরা একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চাই। যদি সেখানে কোন গণতন্ত্র না থাকে, তাহলে গ্রামবাসীদের বলুন আমাদের ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার জন্য আরেকটি বিপ্লবের সূচনা করতে। একটি প্রাথমিক ধারণা অনুযায়ী, ইতিমধ্যে বাস্তারে আমাদের একটি বিকল্প জনগণতান্ত্রিক সরকার আছে। নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা একটি স্থানীয় সরকার নির্বাচিত করি, যা বিপ্লবী জনগণের কমিটি নামে পরিচিত। জনগণ হাত উঁচিয়ে ভোট দেন। সেখানে একজন চেয়ারম্যান, একজন ভাইস চেয়ারম্যান, এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কল্যাণ, কৃষি,আইন-শৃঙ্খলা, জনসংযোগ ইত্যাদি বিভাগ রয়েছে। এই ব্যবস্থা বর্তমানে ভারতের প্রায় ৪০টি জেলায় বিদ্যমান। ‘মাওবাদীরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না’ বলে যে একটা ধারণা আছে, তা সম্পূর্ণরূপে ভুল।
বর্তমানে ভারতে যা বর্তমান, তা হলো আনুষ্ঠানিক গণতন্ত্র। এটি প্রকৃত গণতন্ত্র নয়। তা মমতা হোক, সিপিএম হোক, আর কংগ্রেস পার্টি,সবগুলোই স্বৈরতান্ত্রিক। আমরা তাদের আসল চেহারাটা সবার সামনে উন্মোচনের জন্যই পশ্চিমবঙ্গে ১৪ জন আদিবাসী নারীকে মুক্তির জন্য আলোচনা করেছি; বিশ্ববাসী দেখুক, তাদের এই জেলে কাদের আটকে রাখা হয়।
প্রশ্ন: আপনি যদি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, তাহলে ইতিমধ্যে বিদ্যমান গণতন্ত্রকে পরিহার করছেন কেন? নেপালে তো মাওবাদীরা নির্বাচনেও অংশ নিয়েছে।
কমরেড কিষানজী: নতুন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য পুরোনোটিকে অবশ্যই ধ্বংস করতে হবে। নেপালে মাওবাদীরা সমঝোতা করেছে (*এরই ফল স্বরূপ বর্তমানে নেপালে মাওবাদী পার্টির নেতৃত্বে আসীন দুই দালাল, প্রচণ্ড আর ভট্টরাই)। ১৮০ জন এমপি (সংসদ সদস্য) গুরুতর অপরাধের আসামী, ৩ শতাধিক এমপি কোটিপতি। এর নামই কি নির্বাচন? আপনি কি জানেন, মার্কিন সেনাবাহিনী ইতিমধ্যেই উত্তর প্রদেশে একটি ঘাঁটিতে অনুশীলন শুরু করেছে? তারা স্বদম্ভে বলছে, ভারতীয় সেনাবাহিনীকে তারা তাদের ইচ্ছানুযায়ী যেকোন স্থানে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে। এই স্পর্ধা কে অনুমোদন দেয়? আমি তো নয়। আমি তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাই। আমিই প্রকৃত দেশপ্রেমিক।
প্রশ্ন: ভারতকে আপনি কেমন রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চান? একটি আদর্শ ব্যবস্থা বাছাই করুন।
কমরেড কিষানজী: আমাদের প্রথম আদর্শ ব্যবস্থা হলো প্যারিস, যা ভেঙ্গে গেছে। এরপর রাশিয়া ধ্বসে পড়লো, আর তখনই জ্বলে উঠলো গণচীন। কিন্তু মাও পরবর্তী সময়ে সেটিরও পতন হয়। এখন বিশ্বের কোনোখানেই জনগণের হাতে সত্যিকারের ক্ষমতা নাই। সর্বত্রই শ্রমিকেরা এজন্য সংগ্রাম করছে। তাই কোন আদর্শ ব্যবস্থা বিদ্যমান নাই।
প্রশ্ন: যখন কমিউনিজম অন্যত্র ফলপ্রসু হয়নি, তখন ভারতে তা কিভাবে কাজ করবে? চীনে বর্তমানে মাও’এর তত্ত্বকে ভ্রান্তিমূলক আখ্যা দেওয়া হয়। নেপালে ইতিমধ্যে মাওবাদীদের বিদেশী বিনিয়োগ খোঁজছেন।
কমরেড কিষানজী: নেপালে মাওবাদীরা যা করছেন, তা ভুল। এই পথ অনুসরণ করার মানে হলো আরেকটি বুদ্ধদেব বাবু ["মার্কসিস্ট"পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী] তৈরী করা। আমরা তাদের নিকট আবেদন জানিয়েছি পুরোনো পন্থায় ফিরে আসার জন্য। যেখানেই সমাজতন্ত্র বা কমিউনিজম শিকড় গজিয়ে উঠে, সেখানেই সাম্রাজ্যবাদ তা স্বমূলে উপড়ে ফেলতে চায়। অবশ্যই, লেনিন, মাও, প্রচণ্ড – সবারই কিছু দুর্বলতা আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিজয়ের পর লেনিন এবং স্তালিন আমলাতন্ত্রের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রকে প্রতিস্থাপিত করেন। তারা জনগণের অংশগ্রহণকে উপেক্ষা করেন। তাদের ভুল থেকে আমাদের শিখতে হবে। পুঁজিবাদও কিন্তু মুখ থুবড়ে পড়েছে। আপনি কিভাবে বলবেন যে পুঁজিবাদই সফল হয়েছে? সমাজতন্ত্রই মুক্তির শুধুমাত্র পথ।
প্রশ্ন: কিন্তু ক্ষমতায় গেলে আপনারাও কী নেপালের মাওবাদীদের মতো বা সিপিএম’এর মতো বিভ্রান্ত হতে পারেন না?
কমরেড কিষানজী: যদি আমরা পরিবর্তিত হই, তাহলে জনগণ আমাদের বিরুদ্ধেই আরেক বিপ্লবের (ক্রান্তিকারী আন্দোলন)সূচনা করবে। শাসক যেই হোক না কেন, যদি সে শোষকে পরিণত হয় তাহলে জনগণ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য উঠে দাঁড়াবেই। তাদের ‘একজন কিষানজী’, ‘একজন প্রচণ্ড’ বা ‘একজন স্তালিন’এর উপর অন্ধ বিশ্বাস থাকা উচিৎ নয়। যদি কোনো নেতা বা পার্টি তাদের নিজস্ব মতাদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়, তাহলে তাদের উপরে আস্থার সমাপ্তি ঘটিয়ে আবারো বিদ্রোহ করতে হবে। জনগণের এই পরম্পরা জিইয়ে রাখতে হবে।
প্রশ্ন: আপনি কি কখনও কোন ব্যক্তিগত দ্বিধার সম্মুখীন হয়েছেন? সহিংসতাই কি একমাত্র পথ রাষ্ট্রের উপর চাপ বৃদ্ধি করার?
কমরেড কিষানজী: আমার বিশ্বাস আমরা সঠিক কাজটিই করার চেষ্টা করছি। আমরা একটা ন্যায়ের যুদ্ধ করে যাচ্ছি। হ্যাঁ, পথ চলতে ভুল হতেই পারে। কিন্তু তা রাষ্ট্রের মতো নয়, আমরা ভুল করলে তা স্বীকার করতেও জানি। ফ্রান্সিস ইন্ডুয়ার’কে হত্যা করাটা ছিল একটি ভুল, আমরা এজন্য ক্ষমাপ্রার্থী। লালগড়ে আমরা একটা ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছি। সেখানে আমরা সম্প্রতি শুধুই উন্নয়নের জন্য সরকারকে (লিখিতভাবে) দাবী জানিয়েছি এবং সরকারকে ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়েছি। আমরা ৩০০টি গভীর নলকূপ এবং ৫০টি অস্থায়ী হাসপাতালের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছি। এছাড়াও আমরা ফরোয়ার্ড ব্লক, আরএসপি, সিপিআই,এমনকি সিপিএম’এর মতো বাম দলগুলোর সাথেও আলোচনা করেছি। আমি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মন্ত্রীদের সাথেও যোগাযোগ করেছি। মুখ্যমন্ত্রীর সাথে আমি নিজে কথা বলেছি।
প্রশ্ন: মুখ্যমন্ত্রীর অফিস এগুলো ময়লার ঝুড়িতে ফেলেছে।
কমরেড কিষানজী: আমি মুখ্যমন্ত্রীর সাথে কথা বলেছি। আমি তাকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বন্ধ করতে বলেছি এবং বলেছি যে, আমরা আমাদের উন্নয়ন চাহিদা চিঠির মাধ্যমে পাঠিয়েছি। তিনি জানালেন যে, তিনি তার দল ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী চিদাম্বরম দ্বারা চাপে আছেন।
প্রশ্ন: পুলিশ কেন আপনাকে ধরতে সক্ষম হচ্ছে না?
কমরেড কিষানজী: আটটি রাজ্যে দিন নেই, রাত নেই, আমাকে ধরার জন্য অভিযান চলতেই থাকে। তাদের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় আমার অবস্থান ২ নম্বরে। পুলিশ যেন আমার কাছে পৌছাতে না পারে, সেজন্য বাংলার ১৬০০ গ্রামের মানুষ রাতে পাহাড়া দেয়। আমি এখন যেখানে আছি, সেখান থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে একটা ক্যাম্পে ৫০০ পুলিশ রয়েছে। বাংলার মানুষ আমাকে ভালোবাসে। পুলিশ আমাকে ধরার আগে তাদের মারতে হবে।
প্রশ্ন: স্বরাষ্ট্র সচিব সম্প্রতি আপনাদের অস্ত্র দেওয়ার জন্য চীনকে উদ্দিষ্ট করেছেন। এটা কি সত্য?
কমরেড কিষানজী: তিনি আমাদের মতাদর্শ সম্পর্কে একদমই কিছু জানেন না। যুদ্ধে জয়ী হতে হলে শত্রু সম্পর্কে জানতে হয়। আমাদের অবস্থান চীন থেকে সম্পূর্ণভাবে বিপরীত। আমি ভেবেছিলাম চিদাম্বরম এবং পিল্লাই আমার প্রতিযোগী, কিন্তু আমার শত্রু এতো নিন্ম-মানের হবে তা কখনোই বুঝতে পারিনি। তারা কেবল হাওয়াতেই তরবারী ঘোরাবেন। বিজয় আমাদেরই হবে।
প্রশ্ন: লষ্কর-ই-তৈয়বা সম্পর্কে আপনার অভিমত কি? আপনি কি তাদের যুদ্ধ সমর্থন করেন?
কমরেড কিষানজী: আমরা তাদের কিছু দাবী সমর্থন করি, কিন্তু তাদের পদ্ধতি ভুল এবং জনবিরুদ্ধ। তাদেরকে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বাদ দিতে হবে, কারণ তা কোন লক্ষ্যের দিকে সহায়ক নয়। শুধুমাত্র জনগণকে সঙ্গে নিয়েই বিজয় অর্জন করা সম্ভব।।
২৪ নভেম্বর ২০১১ ছিল এক কালো দিন, সেদিন ‘ভুয়া সংঘর্ষ’ (ফেক এনকাউন্টার) দেখিয়ে পরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্র কর্তৃক সিআরপিএফ দ্বারা হত্যা করা হয় কমরেড কিষানজী’কে। বেশ কিছুদিন ধরেই সরকারের শান্তি আলোচনা প্রক্রিয়া চলছিল মাওবাদীদের সাথে। ২৩ তারিখে কিষানজী এমনই এক গোপন সভায় হাজির হলে তাকে ধোঁকা দিয়ে আটক করা হয় এবং অমানুষিক নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করার পর ২৪ নভেম্বর ২০১১ তারিখ, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার দিকে পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বুড়িশোল জঙ্গলে এক ভুয়া এনকাউন্টারের নাটক সাজানো হয়।
ধিক্কার জানাই ভারত রাষ্ট্রকে বর্বরোচিত এই হত্যাকাণ্ডের জন্য…
শহীদ কমরেড কিষানজী’র প্রতি রইলো আমাদের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা। কিষানজী শুধু কোন একক ব্যক্তি নন; তিনি এমনই এক সত্ত্বা, যা বিদ্যমান সকল মুক্তিকামী মানুষের মাঝে। তাই কিষানজী’দের মৃত্যু নাই, তারা চিরঞ্জীব। তিনি বেঁচে থাকবেন, গণমানুষের মুক্তির নেশায়,লড়াই-সংগ্রামে।
লাল সালাম, কমরেড…..
——————————————–
(২০০৯ সালের নভেম্বরে “তেহেলকা ডট কম”এ প্রকাশিত এই সাক্ষাৎকারে কমরেড মাল্লোজুলা কোটেশ্বর রাও ওরফে ‘কিষানজী’ কথা বলেন সশস্ত্র সংগ্রাম, শান্তি আলোচনা, দলের অর্থায়নের উৎস, ভারতের প্রথাগত গণতন্ত্র ও জনগণতন্ত্রের পার্থক্য এবং সিপিআই (মাওবাদী)’এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন তুষা মিত্তাল।)
মধ্যরাত্রিতে টেলিফোনে দেওয়া সাক্ষাৎকারটির উদ্ধৃতাংশ:
প্রশ্ন: আপনার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কিছু বলুন। আপনি কিভাবে সিপিআই (মাওবাদী) দলে যোগ দিলেন?
সাংবাদিকদের সাথে কথা বলছেন কমরেড কিষানজী
কমরেড কিষানজী: আমি অন্ধ্র প্রদেশের করিম-নগরে জন্মগ্রহণ করি। ১৯৭৩ সালে গণিতে স্নাতক ডিগ্রীর পর আমাকে আইনের মাধ্যমে অভিযুক্ত দেখিয়ে হায়দ্রাবাদে সরিয়ে দেওয়া হয়। আমার রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয় ‘তেলেঙ্গানা সংঘর্ষ সমিতি’(Telangana Sangarsh Samiti)’এর সাথে আমার সংযুক্তি থেকে; এখানে উল্লেখ্য যে, ‘তেলেঙ্গানা সংঘর্ষ সমিতি’ পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্যের দাবী জানাচ্ছিল সেসময়ে। ১৯৭৫ সালের জরুরী অবস্থার মধ্যেই আমি অন্ধ্র প্রদেশে ‘রেডিক্যাল স্টুডেন্টস মুভমেন্ট’ (Radical Students Union (RSU))’এর কাজ শুরু করি। এরপরে আমি বিপ্লবের উদ্দেশ্যে আত্মগোপনে চলে যায়। সেসময়ে বেশ কিছু বিষয়ে আমি অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম; এর মাঝে কিছু বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ,যেমন: লেখক ভারাভারা রাও (যিনি বিপ্লবী লেখক সংঘ, Revolutionary Writers Association’এর প্রতিষ্ঠাতা),তৎকালীন ভারতের রাজনৈতিক আবহ এবং একটি প্রগতিশীল পরিবেশ, যে পরিবেশে আমার বেড়ে উঠা।
আমার বাবা ছিলেন একজন গণতন্ত্রী এবং মহান মুক্তিযোদ্ধা [*তিনি ১৯৪০ এর দশকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন]। তিনি রাজ্য কংগ্রেস পার্টির সহসভাপতিও ছিলেন। আমরা বর্ণে ব্রাহ্মণ হলেও আমাদের পরিবার বর্ণ বিশ্বাস করতো না। যখন আমি সিপিআই (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) দলে যোগদান করি, আমার বাবা কংগ্রেস পরিত্যাগ করেন। তখন তিনি একথা বলেন যে, ‘এক ছাদের নিচে দুই ধারার রাজনীতি বেঁচে থাকতে পারে না।’ তিনি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন, কিন্তু সশস্ত্র সংগ্রামে নয়। ১৯৭৭ সালে জরুরী অবস্থা শেষ হবার পর আমি সামন্তবাদের বিরুদ্ধে কৃষকদের একটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেই। ৬০ হাজারেরও বেশী কৃষক এই আন্দোলনে যোগ দেন, এই কৃষক আন্দোলন পরবর্তীতে সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
প্রশ্ন: গৃহমন্ত্রী (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী) সিপিআই (মাওবাদী)’এর সাথে বন অধিকার, জমি অধিগ্রহণ এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল SEZs(Special Economic Zones)’এর মতো বিষয়গুলোতে কথা বলতে আগ্রহী। আপনারা তার এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন কেন? তিনি শুধুমাত্র আপনাদের সহিংসতা স্থগিত রাখার কথাই বলেছেন।
কমরেড কিষানজী:সরকার তার বাহিনী প্রত্যাহার করলে আমরা আলাপের জন্য প্রস্তুত। সহিংসতা আমাদের কর্মসূচীর অংশ নয়। আমাদের এই সহিংসতা কেবলই আত্মরক্ষার জন্য। সরকারী বাহিনী আমাদের লোকদের প্রতিদিন আক্রমণ করছে। বাস্তারে গত মাসে কোবরা বাহিনী ১৮জন নিরপরাধ আদিবাসী এবং ১২জন মাওবাদীকে হত্যা করেছে। ছত্তিশগড়ে উন্নয়ন খাতে যারা আমাদের সহায়তা করতো, তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। এগুলো বন্ধ করুন; সহিংসতাও বন্ধ হয়ে যাবে। সম্প্রতি, ছত্তিশগড়ে পুলিশের ডিজিপি একটা সন্ত্রাসী সংগঠন ‘সালওয়া জুডুম’এর ৬,০০০ বিশেষ পুলিশ সদস্যদের নিজেদের গৌরব বলে তকমা লাগিয়েছেন। অথচ, তারা বছর বছর ধরে আদিবাসীদের ধর্ষণ, হত্যা, লুটের সাথে জড়িত। ‘সালওয়া জুডুম’এর অত্যাচারে গ্রামের পর গ্রাম বিরানভূমিতে পরিণত হচ্ছে। সরকার নিজের মনগড়া কথা বলে যেতে পারে, তবে আমরা তা বিশ্বাস করিনা। তারা কিভাবে এই কর্মপন্থার পরিবর্তন ঘটাবে, যখন তাদের অধিকারে কিছুই নাই? সবই তো যুক্তরাষ্ট্র আর বিশ্বব্যাংকের এখতিয়ারে!
প্রশ্ন: কোন পরিস্থিতিতে আপনারা সহিংসতা কমাবেন?
কমরেড কিষানজী: প্রধানমন্ত্রীকে আদিবাসীদের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে এবং সেই সাথে এই সব অঞ্চলে মোতায়েন করা সৈন্যদের প্রত্যাহার করতে হবে। এই সেনাবাহিনী নতুন কিছু না, আমরা গত ২০বছর যাবৎ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছি। সকল বন্দীদের মুক্তি দিতে হবে। সেনা প্রত্যাহারের জন্য যা সময় লাগে নিন, কিন্তু এসেময়ে যেন আমাদের উপর পুলিশী হামলা না হয়, তা নিশ্চিত করুন। যদি সরকার তাতে রাজী থাকে, তাহলে আমাদের পক্ষ থেকে কোন সহিংসতা হবে না। আমরা পূর্বের ন্যায় গ্রামাঞ্চলে আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাব।
প্রশ্ন: এতে সম্মত হওয়ার পূর্বে আপনারা কি রাষ্ট্রকে আশ্বস্ত করতে পারেন যে, এক মাসের জন্য আপনারা আক্রমণ করবেন না?
কমরেড কিষানজী: আমরা এবিষয়টা নিয়ে চিন্তা করবো। এবিষয়ে আমাকে দলের সাধারণ সম্পাদকের সাথে আলোচনা করতে হবে। কিন্তু এমন কী নিশ্চয়তা আছে যে, তাদের তরফ থেকে এই এক মাসে কোন সহিংসতা হবে না? তাই সরকারের তরফেই এই ঘোষণা আসতে হবে এবং প্রত্যাহার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। এটা জনগণের জন্য শুধুমাত্র একটি প্রদর্শনী হবে না। অন্ধ্র প্রদেশের দিকে তাকান। তারা আলোচনা শুরু করলো, আবার সেই আলোচনা ভেঙ্গেও দিল। আমাদের একজন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অন্ধ্রের রাজ্য সচিবের সাথে দেখা করতে গেলেন; পরবর্তীতে, সরকারের সাথে আলাপ করার দুঃসাহসের অভিযোগে (!) পুলিশ উনাকে গুলি করে হত্যা করে।
প্রশ্ন: যদি সত্যিই আপনারা গণমানুষের কর্মসূচী নিয়ে কাজ করেন, তাহলে সাথে অস্ত্র রাখার প্রয়োজনীয়তা কী? আপনার লক্ষ্য কি ‘আদিবাসী কল্যাণ’, নাকি ‘রাজনৈতিক শক্তি’?
কমরেড কিষানজী: রাজনৈতিক শক্তি। আদিবাসী কল্যাণকে আমরা অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি, কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতা ছাড়া আমরা কিছুই অর্জন করতে পারব না। একটি সেনাবাহিনী এবং অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া কেউ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে পারবে না। আদিবাসীদের রাজনৈতিক ক্ষমতা না থাকার ফলেই তারা শোষিত এবং এই শোষণ তাদেরকে সবচেয়ে অনুন্নত ও পিছিয়ে পড়াদের চরমে পৌঁছে দিয়েছে। নিজের সম্পদের উপরেও তাদের কোন অধিকার নেই। তাসত্ত্বেও, আমাদের মতাদর্শ অস্ত্রের উপর স্থিত না। আমরা অস্ত্রকে দ্বিতীয় অবস্থানে স্থান দেই। অন্ধ্রে আমরা একারণেই এক বড় ক্ষতির সম্মুখীন হই।
প্রশ্ন: সরকার বলছে আগে সহিংসতা থামান, আপনারা বলছেন আগে সেনা প্রত্যাহার করুন। এই বুদ্ধিবৃত্তিশূণ্য চক্রে আদিবাসী সমাজ,আপনারা যাদের প্রতিনিধিত্ব করেন বলে দাবি করেন, তারা সর্বাধিক কষ্টকর অবস্থার সম্মুখিন হচ্ছে।
কমরেড কিষানজী: আচ্ছা, তাহলে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারীদের আনা হোক। অন্ধ্র প্রদেশ হোক, পশ্চিমবঙ্গ বা মহারাষ্ট্র, আমরা কখনোই সহিংসতা শুরু করিনি। প্রথম আক্রমণ সবসময় সরকার পক্ষ থেকেই আসে। পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম [ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টি(মার্কসবাদী)]’এর সন্ত্রাসীরা তাদের দলের সাথে যুক্ত নয় এমন কাউকেই গ্রামে প্রবেশ করতে দেয় না (*তৎকালীন সময়ে সিপিএম ছিল পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন দল)। পুলিশ ১৯৯৮ সাল থেকে লালগড় এলাকায় ক্যাম্প স্থাপন করে আছে। এমতাবস্থায়, আলুর মূল্যবৃদ্ধি অথবা বিশুদ্ধ পানীয় জলের জন্য কিভাবে আমরা চাপ দিতে পারি? এজন্য এমন কোন মঞ্চ আমাদের নাই। যখন পশ্চিমবঙ্গে সর্বনিম্ন মজুরি দেওয়ার কথা প্রতিদিন ৮৫ টাকা, অথচ মানুষকে দেওয়া হচ্ছে ২২ টাকা করে; আমরা দাবী জানালাম ২৫ টাকা করার। মহাভারতের যুদ্ধ শুরু হয়েছিল যখন পাণ্ডবদের দাবী অনুযায়ী কৌরভরা পাঁচটি গ্রাম তাদের দিতে অস্বীকার করে, তখন। রাষ্ট্রও আমাদের ৩ টাকা মজুরী বৃদ্ধিকে অগ্রাহ্য করলো। এখানে আমরা পাণ্ডব, আর তারা কৌরভ।
প্রশ্ন: আপনি বলেছেন সহিংসতা আপনাদের কর্মসূচী নয়, কিন্তু আপনারা গত চার বছরে প্রায় ৯০০ পুলিশ সদস্যকে হত্যা করেছেন,যাদের বেশিরভাগই এসেছে গরীব আদিবাসী পরিবার থেকে। এমনকি যদি সেটি অপরপক্ষের সহিংসতার কাউন্টারও হয়ে থাকে, এর মধ্য দিয়ে গণ-মানুষের পক্ষের এই লক্ষ্যে কিভাবে এগুনো সম্ভব?
কমরেড কিষানজী: আমাদের যুদ্ধ পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে নয়, এটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। আমরা পুলিশের সাথে হতাহতের সংখ্যা কমাতে চাই। বাংলায়, অনেক পুলিশ পরিবার আসলে আমাদের সাথে সহমর্মী। সেখানে গত ২৮ বছরে ক্ষমতাসীন সিপিএম প্রায় ৫১ হাজার রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। হ্যাঁ, আমরা গত সাত মাসে ৫২ জন সিপিএম সদস্যকে হত্যা করেছি। আর তা কিন্তু সিপিএম ও পুলিশের পশুর ন্যায় বর্বর আচরণের ফলেই করতে হয়েছে।
প্রশ্ন: সিপিআই (মাওবাদী) কিভাবে গঠিত হলো? আপনাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির কী কী অভিযোগ রয়েছে?
কমরেড কিষানজী: সেখানে কোন চাঁদাবাজী হয়নি। আমরা কর্পোরেট এবং বড় বুর্জোয়াদের কাছ থেকে কর সংগ্রহ করেছি, এটি কর্পোরেট সেক্টর থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে তহবিল সংগ্রহে অর্থায়ন ভিন্ন অন্য কিছু নয়। আমাদের একটি ষাণ্মাসিক নিরীক্ষা হয়। একটা পয়সাও নষ্ট হয় না। গ্রামবাসীরাও স্বেচ্ছায় প্রতি বছর তাদের দুই দিনের আয় পার্টি তহবিলে অনুদান হিসেবে দিয়ে থাকেন। গাদচিরলি’তে দুই দিনের বাঁশ কাটা থেকে আমরা ২৫ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করি। বাস্তারে টেন্ডু পাতা সংগ্রহ থেকে আমরা প্রায় ৩৫ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করি। এছাড়াও, কৃষকেরা ১০০০ কুইন্টাল ধান অনুদান হিসেবে দিয়ে থাকে।
প্রশ্ন: যদি কৃষক এই অনুদান দিতে রাজি না হয়?
কমরেড কিষানজী: এমনটা কখনোই হবে না।
প্রশ্ন: এর কারণ কি ভয়?
কমরেড কিষানজী: কখনোই না। তারা আমাদের সঙ্গেই আছেন। আমরা যে উন্নয়ন কর্মকান্ডের উদ্যোগ নিয়েছি, তার জন্য একটা পয়সাও গ্রামবাসীদের কাছ থেকে দাবী করিনি।
প্রশ্ন: মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকায় আপনারা কী কী উন্নয়ন করেছেন? ছত্তিসগড় এবং ঝাড়খন্ডের আদিবাসীদের জীবন-ধারা কিভাবে উন্নত হয়েছে?
কমরেড কিষানজী: আমরা মানুষকে রাষ্ট্রের প্রকৃত চেহারার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছি, তাদেরকে ধনীদের জীবন-যাত্রা ও তারা(আদিবাসীরা) কী কী সুবিধা থেকে বঞ্চিত, সে সম্পর্কে অবগত করেছি। এসব এলাকায় ১টাকায় ১০০০ টেন্ডু পাতা বিক্রি হতো। আমরা মহারাষ্ট্রের ৩টি জেলা, অন্ধ্র প্রদেশের ৫টি জেলা এবং সমগ্র বাস্তার এলাকায় এই দাম বাড়িয়ে প্রতি টেন্ডু পাতার দাম ৫০ পয়সা করেছি। প্রতি বান্ডেল বাঁশ ৫০ পয়সায় বিক্রি হতো। এখন যার দাম ৫৫ টাকা। আমদের এই অর্জন এসেছে রাষ্ট্রের নির্মম প্রতিরোধ ও নিষ্ঠুর চেহারাটার সাক্ষাৎ পাওয়ার মধ্য দিয়ে। শুধুমাত্র গাদচিরলি’তেই তারা আমাদের ৬০ জনকে হত্যা করে, আর আমরা মারি ৫ জনকে।
এছাড়াও সিপিআই (মাওবাদী) পার্টি প্রায় প্রতিদিনই ১২০০টি গ্রামে স্বাস্থ্য সহায়তা দিয়ে থাকে। বাস্তারে আমাদের বেশকিছু সৈনিক রয়েছেন, যারা দক্ষ ডাক্তার, তারা এপ্রোন পরেন এবং জঙ্গলে ধাত্রীর কাজ করে থাকেন। শুধুমাত্র বাস্তারেই আমাদের এমন ৫০টি ভ্রাম্যমান স্বাস্থ্য দল এবং ১০০টি ভ্রাম্যমান হাসপাতাল আছে। গ্রামবাসীরা নির্দিষ্ট অসুস্থতার জন্য মনোনীত ব্যক্তিদের যান; যেমন: জ্বরের জন্য যাবে ইসা’র কাছে, আবার ডাইরিয়ার জন্য যাবে রামু’র কাছে, ইত্যাদি। এই অঞ্চলে মানুষ এতো বেশী অসুস্থ হয় যে কখনো কখনো লাশ উঠানোর মানুষেরও স্বল্পতা দেখা দেয়। আমরা মানুষের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য ডাক্তারদের কাছে ঔষধ সরবরাহ করে থাকি। সরকার জানে না যে, এই ঔষধ কিন্তু সরকারী হাসপাতাল থেকেই আসে।
প্রশ্ন: রাষ্ট্র যদি নক্সাল অধ্যুষিত এলাকায় সিভিল প্রশাসন পাঠায়, আপনারা কি তার অনুমতি দিবেন?
কমরেড কিষানজী: আমরা স্বাগত জানাব। আমরা চাই শিক্ষক ও ডাক্তারেরা এখানে আসুক। লালগড়ের জনগণ যুগ-যুগ ধরে সেখানে একটি হাসপাতালের দাবী জানাচ্ছে। কিন্তু সরকার কিছুই করেনি। যখন জনগণ নিজেদের চেষ্টায় একটা হাসপাতাল গড়ে তুললো,সরকার এটিকে সেনা-ছাউনিতে রূপান্তর করলো।
প্রশ্ন: আপনাদের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা কি? তিনটি সুস্পষ্ট লক্ষ্যের কথা বলুন।
কমরেড কিষানজী: গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং তারপর সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথমেই প্রয়োজন রাজনৈতিক ক্ষমতা। দ্বিতীয়ত, আমাদের অর্থনীতিকে স্বনির্ভর করার জন্য সাম্রাজ্যবাদের ঋণের কোন প্রয়োজন নাই। যুগ-যুগ ধরে আমরা বিদেশী ঋণের টাকা শোধ করে আসছি, আর যেহেতু এখানে মুদ্রার অবমূল্যায়ন ক্রমবর্দ্ধমান তাই অপরিশোধিত ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। এটা কখনোই পরিশোধিত হবে না। আর এটাই চায় বিশ্বব্যাংক। আমাদের এমন এক অর্থনীতি প্রয়োজন, যা দুইটি বিষয়ের উপর কাজ করবে- কৃষি এবং শিল্প। প্রথমত, আদিবাসীরা জমি চায়। জমিতে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্র তাদের শোষণ করেই যাবে। শ্রমের ভিত্তিতে শতকরা হারে জনগণকে শস্য বরাদ্দ দিতে হবে। আমরা শিল্পের বিরোধী নই; শিল্প ছাড়া উন্নয়ন কিভাবে সম্ভব? কিন্তু আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে শিল্পটি ভারতের জন্য সহায়ক, নাকি আমেরিকা বা বিশ্বব্যাংকের সহায়ক। বড় বাঁধ, বড় শিল্পের বদলে আমরা ছোট শিল্প, বিশেষত যা কৃষির উপর নির্ভরশীল, এমন শিল্পকে উন্নীত করার পক্ষপাতী। তৃতীয় লক্ষ্য হলো, টাটা থেকে আম্বানী পর্যন্ত সকল বড় কোম্পানিকে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব করা, সকল স্মারক চুক্তি (MOU) বাতিল করা, তাদের সকল সম্পদকে জাতীয় সম্পদ ঘোষণা করা ও এর মালিকদের জেলে প্রেরণ করা। অবশ্যই, নিম্ন থেকে উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা থাকবেন।
প্রশ্ন: কিন্তু বিশ্বে কমিউনিস্ট সরকারগুলোর দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, তারা যে ব্যবস্থাকে উৎখাত করেছিল শোষণের অভিযোগে, ক্ষমতায় এসে তারা নিজেরাও সেরকমই হয়ে যায়। মাওবাদী শাসন ব্যবস্থারই এমন অনেক উদাহরণ দেওয়া সম্ভব যেখানে বল প্রয়োগ হয়েছে এবং মত পার্থক্য সহ্য করা হয়নি। কিভাবে তা মানুষের স্বার্থে হতে পারে?
গণমানুষের নেতা কমরেড কিষানজী
কমরেড কিষানজী: এই সব পুঁজিবাদীদের দ্বারা ছড়ানো গল্প। গ্রামের মানুষেরা বিনা চিকিৎসায় মরছে, অথচ ডাক্তারেরা সব শহরে থাকতে চায়। আমাদের সব প্রকৌশলীরা জাপানের মতো উন্নত দেশে, অথবা আইটি নিয়ে কাজে আগ্রহী। তারা জনগণের সম্পদ ব্যবহার করেই নিজেদের গন্তব্যে পৌঁছেছেন। তারা আমাদের দেশের জন্য কী করেছেন? রাষ্ট্র আপনাকে ডাক্তার হওয়ার জন্য জোর দিতে পারে না। কিন্তু যদি আপনি তা হয়ে যান, তাহলে আপনাকে জোর দেওয়া উচিৎ (রাষ্ট্র কর্তৃক) নিজের দক্ষতা অনুযায়ী দুই বছর গ্রামে সেবা দেওয়ার জন্য। রাষ্ট্র কতটা শোষক, তা নির্ভর করে রাষ্ট্র ক্ষমতায় কারা আসীন তার উপর।
আমরা একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চাই। যদি সেখানে কোন গণতন্ত্র না থাকে, তাহলে গ্রামবাসীদের বলুন আমাদের ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার জন্য আরেকটি বিপ্লবের সূচনা করতে। একটি প্রাথমিক ধারণা অনুযায়ী, ইতিমধ্যে বাস্তারে আমাদের একটি বিকল্প জনগণতান্ত্রিক সরকার আছে। নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা একটি স্থানীয় সরকার নির্বাচিত করি, যা বিপ্লবী জনগণের কমিটি নামে পরিচিত। জনগণ হাত উঁচিয়ে ভোট দেন। সেখানে একজন চেয়ারম্যান, একজন ভাইস চেয়ারম্যান, এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কল্যাণ, কৃষি,আইন-শৃঙ্খলা, জনসংযোগ ইত্যাদি বিভাগ রয়েছে। এই ব্যবস্থা বর্তমানে ভারতের প্রায় ৪০টি জেলায় বিদ্যমান। ‘মাওবাদীরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না’ বলে যে একটা ধারণা আছে, তা সম্পূর্ণরূপে ভুল।
বর্তমানে ভারতে যা বর্তমান, তা হলো আনুষ্ঠানিক গণতন্ত্র। এটি প্রকৃত গণতন্ত্র নয়। তা মমতা হোক, সিপিএম হোক, আর কংগ্রেস পার্টি,সবগুলোই স্বৈরতান্ত্রিক। আমরা তাদের আসল চেহারাটা সবার সামনে উন্মোচনের জন্যই পশ্চিমবঙ্গে ১৪ জন আদিবাসী নারীকে মুক্তির জন্য আলোচনা করেছি; বিশ্ববাসী দেখুক, তাদের এই জেলে কাদের আটকে রাখা হয়।
প্রশ্ন: আপনি যদি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, তাহলে ইতিমধ্যে বিদ্যমান গণতন্ত্রকে পরিহার করছেন কেন? নেপালে তো মাওবাদীরা নির্বাচনেও অংশ নিয়েছে।
কমরেড কিষানজী: নতুন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য পুরোনোটিকে অবশ্যই ধ্বংস করতে হবে। নেপালে মাওবাদীরা সমঝোতা করেছে (*এরই ফল স্বরূপ বর্তমানে নেপালে মাওবাদী পার্টির নেতৃত্বে আসীন দুই দালাল, প্রচণ্ড আর ভট্টরাই)। ১৮০ জন এমপি (সংসদ সদস্য) গুরুতর অপরাধের আসামী, ৩ শতাধিক এমপি কোটিপতি। এর নামই কি নির্বাচন? আপনি কি জানেন, মার্কিন সেনাবাহিনী ইতিমধ্যেই উত্তর প্রদেশে একটি ঘাঁটিতে অনুশীলন শুরু করেছে? তারা স্বদম্ভে বলছে, ভারতীয় সেনাবাহিনীকে তারা তাদের ইচ্ছানুযায়ী যেকোন স্থানে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে। এই স্পর্ধা কে অনুমোদন দেয়? আমি তো নয়। আমি তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাই। আমিই প্রকৃত দেশপ্রেমিক।
প্রশ্ন: ভারতকে আপনি কেমন রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চান? একটি আদর্শ ব্যবস্থা বাছাই করুন।
কমরেড কিষানজী: আমাদের প্রথম আদর্শ ব্যবস্থা হলো প্যারিস, যা ভেঙ্গে গেছে। এরপর রাশিয়া ধ্বসে পড়লো, আর তখনই জ্বলে উঠলো গণচীন। কিন্তু মাও পরবর্তী সময়ে সেটিরও পতন হয়। এখন বিশ্বের কোনোখানেই জনগণের হাতে সত্যিকারের ক্ষমতা নাই। সর্বত্রই শ্রমিকেরা এজন্য সংগ্রাম করছে। তাই কোন আদর্শ ব্যবস্থা বিদ্যমান নাই।
প্রশ্ন: যখন কমিউনিজম অন্যত্র ফলপ্রসু হয়নি, তখন ভারতে তা কিভাবে কাজ করবে? চীনে বর্তমানে মাও’এর তত্ত্বকে ভ্রান্তিমূলক আখ্যা দেওয়া হয়। নেপালে ইতিমধ্যে মাওবাদীদের বিদেশী বিনিয়োগ খোঁজছেন।
কমরেড কিষানজী: নেপালে মাওবাদীরা যা করছেন, তা ভুল। এই পথ অনুসরণ করার মানে হলো আরেকটি বুদ্ধদেব বাবু ["মার্কসিস্ট"পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী] তৈরী করা। আমরা তাদের নিকট আবেদন জানিয়েছি পুরোনো পন্থায় ফিরে আসার জন্য। যেখানেই সমাজতন্ত্র বা কমিউনিজম শিকড় গজিয়ে উঠে, সেখানেই সাম্রাজ্যবাদ তা স্বমূলে উপড়ে ফেলতে চায়। অবশ্যই, লেনিন, মাও, প্রচণ্ড – সবারই কিছু দুর্বলতা আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিজয়ের পর লেনিন এবং স্তালিন আমলাতন্ত্রের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রকে প্রতিস্থাপিত করেন। তারা জনগণের অংশগ্রহণকে উপেক্ষা করেন। তাদের ভুল থেকে আমাদের শিখতে হবে। পুঁজিবাদও কিন্তু মুখ থুবড়ে পড়েছে। আপনি কিভাবে বলবেন যে পুঁজিবাদই সফল হয়েছে? সমাজতন্ত্রই মুক্তির শুধুমাত্র পথ।
প্রশ্ন: কিন্তু ক্ষমতায় গেলে আপনারাও কী নেপালের মাওবাদীদের মতো বা সিপিএম’এর মতো বিভ্রান্ত হতে পারেন না?
কমরেড কিষানজী: যদি আমরা পরিবর্তিত হই, তাহলে জনগণ আমাদের বিরুদ্ধেই আরেক বিপ্লবের (ক্রান্তিকারী আন্দোলন)সূচনা করবে। শাসক যেই হোক না কেন, যদি সে শোষকে পরিণত হয় তাহলে জনগণ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য উঠে দাঁড়াবেই। তাদের ‘একজন কিষানজী’, ‘একজন প্রচণ্ড’ বা ‘একজন স্তালিন’এর উপর অন্ধ বিশ্বাস থাকা উচিৎ নয়। যদি কোনো নেতা বা পার্টি তাদের নিজস্ব মতাদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়, তাহলে তাদের উপরে আস্থার সমাপ্তি ঘটিয়ে আবারো বিদ্রোহ করতে হবে। জনগণের এই পরম্পরা জিইয়ে রাখতে হবে।
প্রশ্ন: আপনি কি কখনও কোন ব্যক্তিগত দ্বিধার সম্মুখীন হয়েছেন? সহিংসতাই কি একমাত্র পথ রাষ্ট্রের উপর চাপ বৃদ্ধি করার?
কমরেড কিষানজী: আমার বিশ্বাস আমরা সঠিক কাজটিই করার চেষ্টা করছি। আমরা একটা ন্যায়ের যুদ্ধ করে যাচ্ছি। হ্যাঁ, পথ চলতে ভুল হতেই পারে। কিন্তু তা রাষ্ট্রের মতো নয়, আমরা ভুল করলে তা স্বীকার করতেও জানি। ফ্রান্সিস ইন্ডুয়ার’কে হত্যা করাটা ছিল একটি ভুল, আমরা এজন্য ক্ষমাপ্রার্থী। লালগড়ে আমরা একটা ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছি। সেখানে আমরা সম্প্রতি শুধুই উন্নয়নের জন্য সরকারকে (লিখিতভাবে) দাবী জানিয়েছি এবং সরকারকে ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়েছি। আমরা ৩০০টি গভীর নলকূপ এবং ৫০টি অস্থায়ী হাসপাতালের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছি। এছাড়াও আমরা ফরোয়ার্ড ব্লক, আরএসপি, সিপিআই,এমনকি সিপিএম’এর মতো বাম দলগুলোর সাথেও আলোচনা করেছি। আমি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মন্ত্রীদের সাথেও যোগাযোগ করেছি। মুখ্যমন্ত্রীর সাথে আমি নিজে কথা বলেছি।
প্রশ্ন: মুখ্যমন্ত্রীর অফিস এগুলো ময়লার ঝুড়িতে ফেলেছে।
কমরেড কিষানজী: আমি মুখ্যমন্ত্রীর সাথে কথা বলেছি। আমি তাকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বন্ধ করতে বলেছি এবং বলেছি যে, আমরা আমাদের উন্নয়ন চাহিদা চিঠির মাধ্যমে পাঠিয়েছি। তিনি জানালেন যে, তিনি তার দল ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী চিদাম্বরম দ্বারা চাপে আছেন।
প্রশ্ন: পুলিশ কেন আপনাকে ধরতে সক্ষম হচ্ছে না?
কমরেড কিষানজী: আটটি রাজ্যে দিন নেই, রাত নেই, আমাকে ধরার জন্য অভিযান চলতেই থাকে। তাদের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় আমার অবস্থান ২ নম্বরে। পুলিশ যেন আমার কাছে পৌছাতে না পারে, সেজন্য বাংলার ১৬০০ গ্রামের মানুষ রাতে পাহাড়া দেয়। আমি এখন যেখানে আছি, সেখান থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে একটা ক্যাম্পে ৫০০ পুলিশ রয়েছে। বাংলার মানুষ আমাকে ভালোবাসে। পুলিশ আমাকে ধরার আগে তাদের মারতে হবে।
প্রশ্ন: স্বরাষ্ট্র সচিব সম্প্রতি আপনাদের অস্ত্র দেওয়ার জন্য চীনকে উদ্দিষ্ট করেছেন। এটা কি সত্য?
কমরেড কিষানজী: তিনি আমাদের মতাদর্শ সম্পর্কে একদমই কিছু জানেন না। যুদ্ধে জয়ী হতে হলে শত্রু সম্পর্কে জানতে হয়। আমাদের অবস্থান চীন থেকে সম্পূর্ণভাবে বিপরীত। আমি ভেবেছিলাম চিদাম্বরম এবং পিল্লাই আমার প্রতিযোগী, কিন্তু আমার শত্রু এতো নিন্ম-মানের হবে তা কখনোই বুঝতে পারিনি। তারা কেবল হাওয়াতেই তরবারী ঘোরাবেন। বিজয় আমাদেরই হবে।
প্রশ্ন: লষ্কর-ই-তৈয়বা সম্পর্কে আপনার অভিমত কি? আপনি কি তাদের যুদ্ধ সমর্থন করেন?
কমরেড কিষানজী: আমরা তাদের কিছু দাবী সমর্থন করি, কিন্তু তাদের পদ্ধতি ভুল এবং জনবিরুদ্ধ। তাদেরকে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বাদ দিতে হবে, কারণ তা কোন লক্ষ্যের দিকে সহায়ক নয়। শুধুমাত্র জনগণকে সঙ্গে নিয়েই বিজয় অর্জন করা সম্ভব।।
অক্যুপাই ওয়াল স্ট্রিট ইজ ”সো ইর্ম্পটেন্ট বিকজ ইট ইজ ইন দ্য হার্ট অব এম্পায়ার” : -----------অরুন্ধতী রায়, অনুবাদ: তানজীর মেহেদী
(১৯৯৭ সালে ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ দিয়ে বুকার জিতে বিশ্বে আলোড়ন তুলেছিলেন ভারতের লেখিকা অরুন্ধতী রায়। পরে,সাহিত্যের বদলে তিনি আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে বেশি ব্যস্ত হয়েছেন। সমালোচনা করতে ছাড়েননি কাউকে। ভারতের বর্তমান উন্নয়ন মডেলেরও তীব্র সমালোচক তিনি। ১৫ নভেম্বর ‘ডেমোক্রেসি ওয়াচ’ কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নির্দ্বিধায় বলেছেন অক্যুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন,মাওবাদ, চলমান রাজনীতির নানা বিষয়ে।)
অ্যামি গুডম্যান: এখন কথা বলবো জনপ্রিয় ভারতীয় ঔপনাস্যিক, বিশ্বজুড়ে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় কর্মী অরুন্ধতী রায়ের সঙ্গে। তিনি বেশ কিছু বই লিখেছেন। এগুলোর মধ্যে বুকার পুরস্কার জয়ী ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’। “অ্যান অর্ডিনারি পারসন’স গাইড টু এম্পায়ার“ ও “ফিল্ড নোটস অন ডেমোক্রেসি:লিসেনিং টু দ্য গ্রাসহোপার্স“ বই দুটিতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে তারা সাংবাদিকতার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে লেখা প্রবন্ধসমূহ। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে অরুন্ধতী রায়ের সর্বশেষ বই “ওয়াকিং উইথ দ্য কমরেডস“। এই বইটিতে তুলে ধরা হয়েছে ভারত সরকারের সেনা মোতায়েনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া বিদ্রোহী গেরিলাদের সঙ্গে জঙ্গলে কাটানোর সময়গুলির বর্ণনা। গত সপ্তাহে অরুন্ধতী যখন নিউ ইয়র্কে এসেছিলেন, তখন তার সঙ্গে বসেছিলাম আমি। নিউইয়র্কে এসে প্রথমদিনেই অকুপাই ওয়াল স্ট্রিটের আন্দোলন দেখতে যান তিনি। আন্দোলনের তাৎপর্য নিয়েও আলাপ হয় তার সঙ্গে। এছাড়াও “আরব বসন্ত“ নিয়েও কথা হয়েছে। বাদ পড়েনি ভারতের জঙ্গলে মাওবাদীদের সঙ্গে কাটানোর সময়গুলোর কথাও। ১৬ নভেম্বর ওয়াশিংটন স্কয়ার পার্কে বক্তব্য রাখার কথা ছিল। প্রথমেই কথা বলেছি অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট নিয়ে।
অরুন্ধতী রায়: তারা যা করছে, সেটা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো। কারণ, এটাই হল সাম্রাজ্যের কেন্দ্র, যেটাকে আমরা সাম্রাজ্য হিসেবে দেখছি। ঠিক সেই জায়গা থেকেই ওই মডেলের বিরুদ্ধে সমালোচনা ও বিরোধিতা অবশিষ্ট বিশ্বকেও তাড়িত করেছে। ফলে সবাই অনুধাবন করতে পেরেছে এটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ও গভীরভাবে ভাববার বিষয়। আমি মনে করি, এটি আমাকে অনেক অনেক আশাবাদী তুলেছে। অনেকদিন পর তাকিয়ে দেখুন, কিছু রাজনীতিক জন্ম নিচ্ছে আর প্রকৃত রাজনীতিকরাই আজ ক্রুব্ধ সেখানে।
এর জন্য অনেক চিন্তা ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু যেটা বলতে চাই সেটা হচ্ছে, জনগণকে স্পষ্ট করে একটি লক্ষ্য নিয়ে এগুতে হবে। সেই লক্ষ্য ধরে এগিয়েই গুটিকয়েক রাজনীতিক ও করপোরেটদের সকল ক্ষমতা ও সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখার মডেলটি ভেঙে ফেলতে হবে। এটাই এই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। এরপর আমাদের মতো যেসব দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রকে বিখ্যাত ও অনুকরণীয় মডেল মনে করে, সেই বিশ্বাসকেও ভেঙে দিতে হবে। আপনাকে বলতে পারি, ভারত জুড়ে এখনও প্রচুর সৌন্দর্য বিরাজ করছে। সেখানে এখনও অনেক শক্তি আছে, যারা ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনের মতো রাজনৈতিক আন্দোলনগুলো গড়ে তুলতে সক্ষম। আমার কাছে মনে হয়, ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনকারী ও ভারতের সেন্ট্রাল ইন্ডিয়া ফরেস্ট আসলে একটি বড় পাইপলাইনের মাধ্যমে সংযুক্ত। আমি নিজেও সেই পাইপলাইনের একজন।
অ্যামি গুডম্যান: আপনার কাছে অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন নিয়ে জানতে চাই। প্রেসিডেন্ট ওবামাকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
অরুন্ধতী রায়: তার (ওবামা) বিজয়ের পর মাথার টুপি খুলে বাতাসে উড়িয়ে যারা আনন্দ প্রকাশ করেছে, সেই দলের লোক আমি নই। মনে পড়ছে, প্রবীণ কৃষ্ণাঙ্গ মানুষগুলো হোয়াইট হাউজে কৃষ্ণাঙ্গ লোক দেখতে পেয়ে ভীষণ খুশি হয়েছিলেন, যাদের এড়িয়ে যাওয়ার কোনও সুযোগ ছিল না। তিনি কি করেছেন সেটা আপনিও দেখেছেন। এর মধ্য আমি আসলে তাকে তিরস্কার করাটাই বোঝাতে চেয়েছি। তিনি কী করছেন? আফগানিস্তানে যুদ্ধের সময়সীমা বাড়িয়ে তা এখন ঠেলে দিচ্ছেন পাকিস্তানের দিকে। ড্রোন (চালকবিহীন বিমান) হামলার ফলে প্রতিদিনই মরছে মানুষ। এই উপমহাদেশে তিনি আসলে কী করতে চান, সেই বিষয়ে তার নিজের কোনও পরিষ্কার ধারনা আছে বলে আমার অন্তত মনে হয় না। ধীরে ধীরে এটি আসলে নিয়ন্ত্রণ অযোগ্য ও ভয়ঙ্কর অবস্থার দিকে যাচ্ছে।
এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রে যা ঘটছে তা দেখে আমি আসলে বিপর্যস্ত। সবসময় শুনি বাগপটু সেসব কথা, বেশিরভাগ সময়েই যেগুলোর কোনও অর্থ থাকে না। এখন যদি বলি জর্জ বুশ যা করে গেছে, ওবামাও তা-ই করছে, তাহলে সবাই তাকে ফ্যাসিবাদীই বলবে। কিন্তু আসলেই আমরা পিছু হটছি, সেখানে যা ঘটছে তার জন্য অনেক সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছি। এটি আসলে সেই পুরনো উভয় সঙ্কটে মধ্যেই পতিত হওয়া। আসলেও তাই, একজন ব্যক্তি দিনের আলোতেই সেই কাজগুলো করে চলেছেন, যা করতে অন্যদের রাতের প্রয়োজন হয়। ডেমোক্র্যাট অথবা রিপাবলিকান-এর বাইরে মানুষের কাছে আর কোনও পছন্দ নেই, যেমন ভারতে কংগ্রেস ও বিজেপি। এভাবেই মানুষ আসলে জিম্মি হয়ে আছেন। এরকম নির্বাচন কেন্দ্রিক রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার কল্পনাও আটকে গেছে আমাদের। ফলে তার সম্পর্কে সুন্দর সুন্দর সব কথা বলতে হবে আমাদের। কিন্তু এরকম কিছু অন্তত আমি বলতে চাই না।
অ্যামি গুডম্যান: এবার আসা যাক “ওয়াকিং উইথ দ্য কমরেডস“ বইটি প্রসঙ্গে। যাদের আপনি ‘কমরেডস‘ বলছেন ভারতে তাদের সঙ্গে আপনার অভিজ্ঞতার কথা বলুন। তারা আসলে কারা?
অরুন্ধতী রায়: তারা মাওবাদী গেরিলা। ভারতের সেন্ট্রাল ফরেস্টে তাদের অবস্থান। তাদের যুদ্ধ ভারত সরকারের বিরুদ্ধে। এছাড়া খনি আহরণকারী করপোরেশনের বিরুদ্ধেও তাদের অবস্থান, কেননা এই করপোরেশনগুলো কমবেশি বনভূমি উজাড় করার পাশাপাশি আদিবাসী, উপজাতিদের জীবন বিপন্ন করে তুলছে। “কমরেড আসলে কারা?” প্রশ্নটি আমার ধারণা অনুযায়ী আপনি যতোটা ভেবেছেন তার চেয়েও অনেক বেশি জটিল। কারণ আমি সেখানে গিয়েছি। তারা নিজেদের মাওবাদী বলে, এর বাইরে আমার কিছু জানা ছিল না। ১৯৬৭ সাল থেকে মাওধারার কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া আসলে বিভিন্ন অবতার বা দেবতাকেন্দ্রিক হয়েই অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। কিন্তু সত্য হচ্ছে, তাদের ৯৯ শতাংশ লোকই প্রকৃতার্থে আদিবাসী। আদিবাসীরা কিসের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে মাওবাদী আদর্শ গ্রহণ করলেন কিংবা মাওবাদীরাই কিভাবে তাদেরকে প্রভাবিত করলেন- এটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্ন। যদ্দুর জানি এটা আসলে অমীমাংসিত। কিন্তু…
অ্যামি গুডম্যান: ‘আদিবাসী’ বিষয়টা একটু খোলাসা করুন।
অরুন্ধতী রায়: আদিবাসী বলতে আসলে ভারতের প্রকৃত অধিবাসীদের বোঝানো হয়। ভারতে তাদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। মূলত,বিভিন্ন উপজাতিতে বিভক্ত হয়ে প্রায় দেড়শ মিলিয়ন আদিবাসী এখানে রয়েছে।
অ্যামি গুডম্যান: যা আসলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যার সমান!
অরুন্ধতী রায়: হ্যাঁ। তবে, এই মুহূর্তে ধ্বংসের প্রান্তে বাস করছে তারা। ভারতীয় গণতন্ত্রের সকল উপকরণই কম-বেশি নীরব ষড়যন্ত্রের জাল বুনছে। সেটা অবশ্য এখনও চলছে। ওই জঙ্গল থেকে আসলে খুব কম সংখ্যক খবরই বাইরে আসে। গত বছর মাওবাদীদের বিরুদ্ধে “অপরাশেন গ্রিন হান্ট“ নামে যুদ্ধই শুরু করে ভারত সরকার। খনি খননকারী প্রতিষ্ঠানের থাবা থেকে যারা নিজেদের ভূমি বাঁচাতে চেয়েছেন তাদের সবাই সরকারের কাছে মাওবাদী হয়ে ওঠেন। মাওবাদী, গান্ধীবাদী, জঙ্গি, স্বাধীন আন্দোলনকারী সবাইকেই সরকার তখন মাওবাদী হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
সেখানে বেশকিছু আইনও বলবৎ করা হয়েছে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ‘অনৈতিক কর্ম প্রতিরোধ আইন’ ও ‘ছত্তিশগড় জন নিরাপত্তা আইন’-এর বলে যে কাউকে গ্রেপ্তারের পাশাপাশি বিচার বর্হিভূতভাবে কারাগারে আটকে রাখতে পারে। ফলে হাজারো মানুষ এখন কারারুদ্ধ। ২০ হাজার সেনা নিয়ে গঠিত আধা-সামরিকবাহিনীকে ভারী অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সেই জঙ্গলে মোতায়েন করা হয়েছে। জনগণকে গ্রাম থেকে বের করে দেওয়াটাই তাদের মূল দায়িত্ব। ছত্তিশগড়ের কথাই বলি, যেদিক দিয়ে আমি জঙ্গলে গিয়েছি ও গেরিলার সঙ্গে হেঁটেছি। সেখানেই সরকারের সহযোগিতায় উপজাতিদের নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে পাহারাদার পরিষদ। তারাই আসলে জ্বালাও-পোড়াও, ধর্ষণ, লুটের মতো কাজের সঙ্গে জড়িত। পুরো ধারণাটাই আসলে পুরনো, নতুন কিছু নয়। তারা আসলে সেখানকার মানুষের ওপর জোর খাটাচ্ছে। সেখানকার ছয়শ গ্রামের প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষকে পালাতে হয়েছে। যাদের অনেকেই রাস্তার ধারের পুলিশ ক্যাম্পেও ঠাঁই নিয়েছে। কমপক্ষে ৫০ হাজার লোককে পুলিশ ক্যাম্পে আশ্রয় নিতে বাধ্য করা হয়েছে। অন্যদের অনেকেই আত্মগোপন করে আছেন। হয় তাদের পালিয়ে জঙ্গলেই আশ্রয় নিতে হচ্ছে, নতুবা অন্য কোনও রাজ্যে চলে যেতে হচ্ছে। আর যারা পালিয়ে যাচ্ছেন তাদের অনেকেই যোগ দিচ্ছেন মাওবাদীদের সঙ্গে। সরকারের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে ওই জঙ্গলটি খালি করা। কেননা, ২০০৫ সালে বিভিন্ন খনি খননকারী ও অবকাঠামো উন্নয়নকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একশ‘রও বেশি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে ভারত সরকার। আর এরপরেই শুরু হয়েছে যুদ্ধ।।
অ্যামি গুডম্যান: এখন কথা বলবো জনপ্রিয় ভারতীয় ঔপনাস্যিক, বিশ্বজুড়ে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় কর্মী অরুন্ধতী রায়ের সঙ্গে। তিনি বেশ কিছু বই লিখেছেন। এগুলোর মধ্যে বুকার পুরস্কার জয়ী ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’। “অ্যান অর্ডিনারি পারসন’স গাইড টু এম্পায়ার“ ও “ফিল্ড নোটস অন ডেমোক্রেসি:লিসেনিং টু দ্য গ্রাসহোপার্স“ বই দুটিতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে তারা সাংবাদিকতার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে লেখা প্রবন্ধসমূহ। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে অরুন্ধতী রায়ের সর্বশেষ বই “ওয়াকিং উইথ দ্য কমরেডস“। এই বইটিতে তুলে ধরা হয়েছে ভারত সরকারের সেনা মোতায়েনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া বিদ্রোহী গেরিলাদের সঙ্গে জঙ্গলে কাটানোর সময়গুলির বর্ণনা। গত সপ্তাহে অরুন্ধতী যখন নিউ ইয়র্কে এসেছিলেন, তখন তার সঙ্গে বসেছিলাম আমি। নিউইয়র্কে এসে প্রথমদিনেই অকুপাই ওয়াল স্ট্রিটের আন্দোলন দেখতে যান তিনি। আন্দোলনের তাৎপর্য নিয়েও আলাপ হয় তার সঙ্গে। এছাড়াও “আরব বসন্ত“ নিয়েও কথা হয়েছে। বাদ পড়েনি ভারতের জঙ্গলে মাওবাদীদের সঙ্গে কাটানোর সময়গুলোর কথাও। ১৬ নভেম্বর ওয়াশিংটন স্কয়ার পার্কে বক্তব্য রাখার কথা ছিল। প্রথমেই কথা বলেছি অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট নিয়ে।
অরুন্ধতী রায়: তারা যা করছে, সেটা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো। কারণ, এটাই হল সাম্রাজ্যের কেন্দ্র, যেটাকে আমরা সাম্রাজ্য হিসেবে দেখছি। ঠিক সেই জায়গা থেকেই ওই মডেলের বিরুদ্ধে সমালোচনা ও বিরোধিতা অবশিষ্ট বিশ্বকেও তাড়িত করেছে। ফলে সবাই অনুধাবন করতে পেরেছে এটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ও গভীরভাবে ভাববার বিষয়। আমি মনে করি, এটি আমাকে অনেক অনেক আশাবাদী তুলেছে। অনেকদিন পর তাকিয়ে দেখুন, কিছু রাজনীতিক জন্ম নিচ্ছে আর প্রকৃত রাজনীতিকরাই আজ ক্রুব্ধ সেখানে।
এর জন্য অনেক চিন্তা ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু যেটা বলতে চাই সেটা হচ্ছে, জনগণকে স্পষ্ট করে একটি লক্ষ্য নিয়ে এগুতে হবে। সেই লক্ষ্য ধরে এগিয়েই গুটিকয়েক রাজনীতিক ও করপোরেটদের সকল ক্ষমতা ও সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখার মডেলটি ভেঙে ফেলতে হবে। এটাই এই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। এরপর আমাদের মতো যেসব দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রকে বিখ্যাত ও অনুকরণীয় মডেল মনে করে, সেই বিশ্বাসকেও ভেঙে দিতে হবে। আপনাকে বলতে পারি, ভারত জুড়ে এখনও প্রচুর সৌন্দর্য বিরাজ করছে। সেখানে এখনও অনেক শক্তি আছে, যারা ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনের মতো রাজনৈতিক আন্দোলনগুলো গড়ে তুলতে সক্ষম। আমার কাছে মনে হয়, ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনকারী ও ভারতের সেন্ট্রাল ইন্ডিয়া ফরেস্ট আসলে একটি বড় পাইপলাইনের মাধ্যমে সংযুক্ত। আমি নিজেও সেই পাইপলাইনের একজন।
অ্যামি গুডম্যান: আপনার কাছে অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন নিয়ে জানতে চাই। প্রেসিডেন্ট ওবামাকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
অরুন্ধতী রায়: তার (ওবামা) বিজয়ের পর মাথার টুপি খুলে বাতাসে উড়িয়ে যারা আনন্দ প্রকাশ করেছে, সেই দলের লোক আমি নই। মনে পড়ছে, প্রবীণ কৃষ্ণাঙ্গ মানুষগুলো হোয়াইট হাউজে কৃষ্ণাঙ্গ লোক দেখতে পেয়ে ভীষণ খুশি হয়েছিলেন, যাদের এড়িয়ে যাওয়ার কোনও সুযোগ ছিল না। তিনি কি করেছেন সেটা আপনিও দেখেছেন। এর মধ্য আমি আসলে তাকে তিরস্কার করাটাই বোঝাতে চেয়েছি। তিনি কী করছেন? আফগানিস্তানে যুদ্ধের সময়সীমা বাড়িয়ে তা এখন ঠেলে দিচ্ছেন পাকিস্তানের দিকে। ড্রোন (চালকবিহীন বিমান) হামলার ফলে প্রতিদিনই মরছে মানুষ। এই উপমহাদেশে তিনি আসলে কী করতে চান, সেই বিষয়ে তার নিজের কোনও পরিষ্কার ধারনা আছে বলে আমার অন্তত মনে হয় না। ধীরে ধীরে এটি আসলে নিয়ন্ত্রণ অযোগ্য ও ভয়ঙ্কর অবস্থার দিকে যাচ্ছে।
এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রে যা ঘটছে তা দেখে আমি আসলে বিপর্যস্ত। সবসময় শুনি বাগপটু সেসব কথা, বেশিরভাগ সময়েই যেগুলোর কোনও অর্থ থাকে না। এখন যদি বলি জর্জ বুশ যা করে গেছে, ওবামাও তা-ই করছে, তাহলে সবাই তাকে ফ্যাসিবাদীই বলবে। কিন্তু আসলেই আমরা পিছু হটছি, সেখানে যা ঘটছে তার জন্য অনেক সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছি। এটি আসলে সেই পুরনো উভয় সঙ্কটে মধ্যেই পতিত হওয়া। আসলেও তাই, একজন ব্যক্তি দিনের আলোতেই সেই কাজগুলো করে চলেছেন, যা করতে অন্যদের রাতের প্রয়োজন হয়। ডেমোক্র্যাট অথবা রিপাবলিকান-এর বাইরে মানুষের কাছে আর কোনও পছন্দ নেই, যেমন ভারতে কংগ্রেস ও বিজেপি। এভাবেই মানুষ আসলে জিম্মি হয়ে আছেন। এরকম নির্বাচন কেন্দ্রিক রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার কল্পনাও আটকে গেছে আমাদের। ফলে তার সম্পর্কে সুন্দর সুন্দর সব কথা বলতে হবে আমাদের। কিন্তু এরকম কিছু অন্তত আমি বলতে চাই না।
অ্যামি গুডম্যান: এবার আসা যাক “ওয়াকিং উইথ দ্য কমরেডস“ বইটি প্রসঙ্গে। যাদের আপনি ‘কমরেডস‘ বলছেন ভারতে তাদের সঙ্গে আপনার অভিজ্ঞতার কথা বলুন। তারা আসলে কারা?
অরুন্ধতী রায়: তারা মাওবাদী গেরিলা। ভারতের সেন্ট্রাল ফরেস্টে তাদের অবস্থান। তাদের যুদ্ধ ভারত সরকারের বিরুদ্ধে। এছাড়া খনি আহরণকারী করপোরেশনের বিরুদ্ধেও তাদের অবস্থান, কেননা এই করপোরেশনগুলো কমবেশি বনভূমি উজাড় করার পাশাপাশি আদিবাসী, উপজাতিদের জীবন বিপন্ন করে তুলছে। “কমরেড আসলে কারা?” প্রশ্নটি আমার ধারণা অনুযায়ী আপনি যতোটা ভেবেছেন তার চেয়েও অনেক বেশি জটিল। কারণ আমি সেখানে গিয়েছি। তারা নিজেদের মাওবাদী বলে, এর বাইরে আমার কিছু জানা ছিল না। ১৯৬৭ সাল থেকে মাওধারার কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া আসলে বিভিন্ন অবতার বা দেবতাকেন্দ্রিক হয়েই অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। কিন্তু সত্য হচ্ছে, তাদের ৯৯ শতাংশ লোকই প্রকৃতার্থে আদিবাসী। আদিবাসীরা কিসের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে মাওবাদী আদর্শ গ্রহণ করলেন কিংবা মাওবাদীরাই কিভাবে তাদেরকে প্রভাবিত করলেন- এটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্ন। যদ্দুর জানি এটা আসলে অমীমাংসিত। কিন্তু…
অ্যামি গুডম্যান: ‘আদিবাসী’ বিষয়টা একটু খোলাসা করুন।
অরুন্ধতী রায়: আদিবাসী বলতে আসলে ভারতের প্রকৃত অধিবাসীদের বোঝানো হয়। ভারতে তাদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। মূলত,বিভিন্ন উপজাতিতে বিভক্ত হয়ে প্রায় দেড়শ মিলিয়ন আদিবাসী এখানে রয়েছে।
অ্যামি গুডম্যান: যা আসলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যার সমান!
অরুন্ধতী রায়: হ্যাঁ। তবে, এই মুহূর্তে ধ্বংসের প্রান্তে বাস করছে তারা। ভারতীয় গণতন্ত্রের সকল উপকরণই কম-বেশি নীরব ষড়যন্ত্রের জাল বুনছে। সেটা অবশ্য এখনও চলছে। ওই জঙ্গল থেকে আসলে খুব কম সংখ্যক খবরই বাইরে আসে। গত বছর মাওবাদীদের বিরুদ্ধে “অপরাশেন গ্রিন হান্ট“ নামে যুদ্ধই শুরু করে ভারত সরকার। খনি খননকারী প্রতিষ্ঠানের থাবা থেকে যারা নিজেদের ভূমি বাঁচাতে চেয়েছেন তাদের সবাই সরকারের কাছে মাওবাদী হয়ে ওঠেন। মাওবাদী, গান্ধীবাদী, জঙ্গি, স্বাধীন আন্দোলনকারী সবাইকেই সরকার তখন মাওবাদী হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
সেখানে বেশকিছু আইনও বলবৎ করা হয়েছে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ‘অনৈতিক কর্ম প্রতিরোধ আইন’ ও ‘ছত্তিশগড় জন নিরাপত্তা আইন’-এর বলে যে কাউকে গ্রেপ্তারের পাশাপাশি বিচার বর্হিভূতভাবে কারাগারে আটকে রাখতে পারে। ফলে হাজারো মানুষ এখন কারারুদ্ধ। ২০ হাজার সেনা নিয়ে গঠিত আধা-সামরিকবাহিনীকে ভারী অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সেই জঙ্গলে মোতায়েন করা হয়েছে। জনগণকে গ্রাম থেকে বের করে দেওয়াটাই তাদের মূল দায়িত্ব। ছত্তিশগড়ের কথাই বলি, যেদিক দিয়ে আমি জঙ্গলে গিয়েছি ও গেরিলার সঙ্গে হেঁটেছি। সেখানেই সরকারের সহযোগিতায় উপজাতিদের নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে পাহারাদার পরিষদ। তারাই আসলে জ্বালাও-পোড়াও, ধর্ষণ, লুটের মতো কাজের সঙ্গে জড়িত। পুরো ধারণাটাই আসলে পুরনো, নতুন কিছু নয়। তারা আসলে সেখানকার মানুষের ওপর জোর খাটাচ্ছে। সেখানকার ছয়শ গ্রামের প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষকে পালাতে হয়েছে। যাদের অনেকেই রাস্তার ধারের পুলিশ ক্যাম্পেও ঠাঁই নিয়েছে। কমপক্ষে ৫০ হাজার লোককে পুলিশ ক্যাম্পে আশ্রয় নিতে বাধ্য করা হয়েছে। অন্যদের অনেকেই আত্মগোপন করে আছেন। হয় তাদের পালিয়ে জঙ্গলেই আশ্রয় নিতে হচ্ছে, নতুবা অন্য কোনও রাজ্যে চলে যেতে হচ্ছে। আর যারা পালিয়ে যাচ্ছেন তাদের অনেকেই যোগ দিচ্ছেন মাওবাদীদের সঙ্গে। সরকারের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে ওই জঙ্গলটি খালি করা। কেননা, ২০০৫ সালে বিভিন্ন খনি খননকারী ও অবকাঠামো উন্নয়নকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একশ‘রও বেশি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে ভারত সরকার। আর এরপরেই শুরু হয়েছে যুদ্ধ।।
কাহিনীর শেষে যতিচিহ্ন আঁকা যেন একটি সন্তান জন্মদানের অভিজ্ঞতা
হারুকি মুরাকামি
জাপানের জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক হারুকি মুরাকামি নিয়মিত লেখালেখি করেন। সেই সঙ্গে নিয়মিত দৌড়ান। তাঁর দৌড়ানো ও লেখালেখিবিষয়ক স্মৃতিকথা 'হোয়াট আই টক অ্যাবাউট হোয়েন আই টক অ্যাবাউট রানিং' ইংরেজিসহ আরো অনেক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এটি জার্মান ভাষায় অনূদিত হওয়ার পর ২০০৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সে দেশের 'স্পিগেল' পত্রিকার জন্য দেওয়া সাক্ষাৎকারে লেখক ও দৌড়বিদের একাকিত্ব নিয়ে তিনি কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন মাইক গ্রসেকাথোপার। অনুবাদ : দুলাল আল মনসুর।
মাইক : মি. মুরাকামি, কোনটা বেশি কঠিন : উপন্যাস লেখা, নাকি ম্যারাথন দৌড়ানো?
মুরাকামি : লেখালেখির কাজটা প্রায় পুরোপুরিই একটা মজার বিষয়। আমি প্রতিদিন চার ঘণ্টা লেখালেখি করি। তারপর দৌড়াতে বের হই। নিয়ম করে ১০ কিলোমিটার বা ৬.২ মাইল। সে রকম হলে সহজেই চালিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু একটানা ২৬ মাইল দৌড়ানো অবশ্যই কঠিন। তবে এই কঠিন কাজটাই আমি খুঁজে বের করি। এই অবশ্যম্ভাবী কষ্টটাই আমি নিজের ওপর আরোপ করে থাকি। আমার কাছে ম্যারাথন দৌড়ের এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক।
মাইক : কোনটা বেশি সুন্দর_বই লিখে শেষ করা, নাকি দৌড়ের শেষবিন্দু পার হওয়া?
মুরাকামি : কাহিনীর শেষে যতিচিহ্ন আঁকা যেন একটি সন্তান জন্মদানের অভিজ্ঞতা। এই মুহূর্তটার কোনো তুলনা হয় না। কোনো ভাগ্যবান লেখক জীবদ্দশায় ১২টি উপন্যাস লিখে থাকতে পারেন। জানি না আমার মধ্যে আর কতগুলো উপন্যাস আছে। আশা করি, আরো চার-পাঁচটা। তবে দৌড়ের সময় ওই রকমের সীমাবদ্ধতা আমার বোধের মধ্যে আসে না। বছর চারেকের মধ্যে একটা ঢাউস উপন্যাস প্রকাশ করে থাকি। তবে প্রতিবছর আমি ১০ কিলোমিটারের একটা দৌড়, একটা অর্ধেক ম্যারাথন এবং একটা পুরো ম্যারাথন সম্পন্ন করে থাকি। এযাবৎ আমি ২৭টা ম্যারাথন দৌড়েছি। শেষেরটা ছিল গত জানুয়ারিতে। আশা করি_২৮, ২৯ ও ৩০টা পর্যন্ত পেঁৗছে যাবে স্বাভাবিকভাবেই।
মাইক : আপনার সর্বশেষ বইয়ের জার্মান অনুবাদ প্রকাশিত হতে যাচ্ছে আগামী সোমবার। সেখানে আপনি দৌড়বিদ হিসেবে নিজের কথা বলেছেন এবং লেখালেখির ব্যাপারে দৌড়ের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। এই আত্মজীবনীমূলক লেখাটির পেছনে কী উদ্দেশ্য আছে?
মুরাকামি : আজ থেকে ২৫ বছর আগে ১৯৮২ সালের শরতে দৌড়ানো শুরু করি। তখন থেকেই আমি নিজেকে প্রশ্ন করতে থাকি_কেন দৌড়ের অভ্যাসটা গড়ে তুললাম। আমি ফুটবল খেলি না কেন? কেনইবা আমার সিরিয়াস লেখক সত্তার অস্তিত্ব শুরু হলো প্রথম যেদিন দৌড়াতে বের হলাম সেদিন থেকে? আমার চিন্তাভাবনাকে যদি ধরে রাখি, কেবল তখনই আমি বোধগম্যতার আয়ত্তের মধ্যে পেয়ে যাই যেকোনো বিষয়। ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম দৌড় সম্পর্কে কিছু লিখতে গেলে আমার নিজের সম্পর্কে লিখতে থাকি।
মাইক : আপনি দৌড়ানো শুরু করলেন কেন?
মুরাকামি : ওজন কমানোর জন্য। লেখালেখির প্রথম দিকে মনোযোগ ঠিক রাখার জন্য প্রচুর সিগারেট খেতাম; দিনে ৬০টার মতো। আমার দাঁতের রং হয়ে গিয়েছিল হলুদ; নখগুলোও হলুদ হয়ে গিয়েছিল। ৩৩ বছর বয়সে যখন আমি ধূমপান ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলাম, তখন আমার নিতম্বে অনেক চর্বি জমা হয়ে গেছে। সুতরাং দৌড় শুরু করলাম। দৌড়ই আমার জন্য উপযুক্ত মনে হলো।
মাইক : কেন?
মুরাকামি : দলীয় কোনো খেলা আমার মেজাজের সঙ্গে মানায় না। দেখেছি, নিজের মতো করে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলে যেকোনো কিছুই আমার পক্ষে চালিয়ে নেওয়া সহজ হয়। আর দৌড়ের বেলায় সঙ্গীর দরকার হয় না। বিশেষ কোনো স্থানের দরকার হয় না। যেমন ধরুন টেনিসের কথা। জুডোও আমার সঙ্গে খাপ খায় না। আমি তো আর কোনো যোদ্ধা ধরনের মানুষ নই। দীর্ঘ দূরত্বে দৌড়ের মাধ্যমে কাউকে হারানোর বিষয়ও থাকে না। আমার প্রতিদ্বন্দ্বী আমি নিজেই। আর কেউ আমার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়। আমি শুধু আমার ভেতরের দ্বন্দ্বের মধ্যেই ডুবে থাকতে পারি : নিজেকে প্রশ্ন করতে থাকি, শেষবার যেমন ছিলাম তার চেয়ে আরো ভালো অবস্থানে উঠতে পেরেছি কি? বারবার সীমা অতিক্রম করাটাই দৌড়ের প্রাণ। দৌড় কষ্টের হলেও আমি ছেড়ে দিতে পারি না। এই কষ্টটাও আমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় না। দৌড়ের প্রতি আমি যত্নবান বলতে পারেন। আমার মানসিকতার সঙ্গে খাপ খেয়ে যায় দৌড়।
মাইক : আপনার অবস্থা তখন কেমন ছিল?
মুরাকামি : ২০ মিনিটেই দম বন্ধ হয়ে আসত। হৃৎপিণ্ডে হাতুড়ির আঘাত পড়ার মতো শব্দ হতো। ক্লান্তিতে পা কাঁপতে থাকত। অন্য লোকেরা আমার দৌড়ানো দেখছে বলে অস্বস্তি লাগত প্রথম দিকে। তবে ধীরে ধীরে দাঁত মাজার মতো আমার অন্যান্য দৈনন্দিন কাজের ভেতর দৌড়কেও একাত্ম করে ফেললাম। সুতরাং দৌড়ে আমার অগ্রগতি এসে গেল। এক বছরের মধ্যে আমার আন-অফিশিয়াল ম্যারাথন দৌড়ও শেষ করে ফেললাম।
মাইক : আপনি একাই এথেন্স থেকে ম্যারাথন পর্যন্ত দৌড়েছেন। এখানে আপনার আকর্ষণের বিষয় ছিল কোনটা?
মুরাকামি : যদিও বিপরীত দিকে তবু এটাই তো আসল ম্যারাথন, এটাই তো ঐতিহাসিক রুট। কারণ যে সময়টায় মানুষের ভিড় বেশি থাকে, তখন এথেন্সে পেঁৗছতে চাইনি আমি। আমি ৩৫ কিলোমিটারের বেশি দৌড়াতে চাইনি। আমার পা দুটো এবং শরীরের ওপরের অংশ তখনো খুব বেশি শক্ত হয়ে ওঠেনি। এর বেশি আর কী আশা করা যায় বুঝতে পারিনি তখনো। টেরা ইনকগনিটায় দৌড়ানোর মতো অবস্থা তখন।
মাইক : কিভাবে এগোলেন?
মুরাকামি : তখন জুলাই মাস। প্রচণ্ড গরম। সকালবেলায়ই প্রচণ্ড গরম পড়েছে। গ্রিসে এর আগে আমি কখনো আসিনি। গরমের মাত্রা আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হলো। আধা ঘণ্টা পরই আমি শার্ট খুলে ফেললাম। একটু পরই বরফের মতো ঠাণ্ডা বিয়ার খেতে ইচ্ছে করছিল প্রচণ্ড। রাস্তার পাশে পড়ে থাকা মরা কুকুর-বিড়ালগুলো গুনতে গুনতে সামনে এগোতে থাকলাম। সূর্যের তেজের সঙ্গে আমার মেজাজও জেদি হয়ে উঠল। সূর্যের প্রচণ্ড তাপে আমার ত্বকে ফুসকুড়ি উঠে গেল। সেবার আমার সময় লেগেছিল ৩.৫১ ঘণ্টা। শেষ প্রান্তে পেঁৗছানোর পর একটা পোপ্রাল স্টেশনে ঢুকে গেলাম। ওখানে পেয়ে গেলাম আমার আরাধ্য বিয়ার। আমার কৃতিত্বে খুশি হয়ে ওখানকার অ্যাটেনডেন্ট এক গোছা ফুল উপহার দিল।
মাইক : ম্যারাথনে আপনার সর্বোচ্চ গতি কোন সময় ছিল?
মুরাকামি : ১৯৯১ সালে নিউইয়র্কে তিন ঘণ্টা ২৭ মিনিট। তার মানে প্রতি কিলোমিটারে পাঁচ মিনিট। সে সময়কার কথা মনে হলে গর্ববোধ হয়। কারণ সেন্ট্রাল পার্কের ভেতর দিয়ে শেষ অংশটুকু পার হওয়া আসলেই খুব কঠিন। পরে আরো কয়েকবার চেষ্টা করেছি, তার চেয়ে দ্রুতগতিতে এগোনোর। কিন্তু বয়স তো বেড়েই চলেছে। নিজের সেই সর্বোচ্চ গতিতে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে এখন আর আগ্রহ নেই। এখন শরীরের ক্ষমতা অনুযায়ী যত দূর পারি তাতেই খুশি থাকতে পারি।
মাইক : দৌড়ের সময় কি কোনো মন্ত্র জপ করেন?
মুরাকামি : না। মাঝেমধ্যে নিজেকে বলি : হারুকি, চালিয়ে যাও, পারবে। তবে দৌড়ের সময় আর কোনো চিন্তা মাথায় আসে না।
মাইক : কোনো কিছুই চিন্তা না করে কি থাকা সম্ভব?
মুরাকামি : দৌড়ের সময় মন নিজে থেকেই ফাঁকা হয়ে যায়। যদি কিছু এসেও থাকে, সেটা দৌড়ের চলমানতার কাছে গৌণ। ছোটখাটো বিষয় মনে আসে দমকা হাওয়ার মতো : এসেই আবার চলে যায়। হঠাৎ করেই আসে; আবার চলেও যায় এবং কোনো পরিবর্তন ঘটায় না।
মাইক : দৌড়ের সময় কি কোনো সংগীত শুনে থাকেন?
মুরাকামি : শুধু প্রশিক্ষণের সময়। রক মিউজিক শুনে থাকি। এখন আমার প্রিয় ম্যানিক স্ট্রিট প্রিচারস। সকালবেলা দৌড়ের সময়টা অবশ্য আলাদা। তখন আমার মিনি ডিস্কপ্লেয়ারে ক্রিডেন্স ক্লিয়ারওয়াটার রিভাইভাল লোড করে নিয়ে বের হই। ওদের গানে সহজ-সরল স্বাভাবিক ছন্দ আছে।
মাইক : দৌড়ে বের হয়ে যাওয়ার জন্য সকালবেলা প্রতিদিন নিজেকে প্রণোদিত করেন কিভাবে?
মুরাকামি : মাঝে মধ্যে বাইরে খুব ঠাণ্ডা থাকে, মাঝে মধ্যে খুব গরম। আবার কখনো কখনো খুব মেঘাচ্ছন্ন থাকে আকাশ। কিন্তু আমি বের হয়েই পড়ি। আমি জানি, আজ বের না হলে আগামীকালও হওয়া যাবে না। মানুষের মন সব সময়ই নিজের ওপর অপ্রয়োজনীয় বোঝা চাপিয়ে নেওয়ার বিপক্ষে। সুতরাং শরীর অনভ্যস্ত হয়ে পড়ে খুব তাড়াতাড়িই। কাজেই আমি তো সেটা হতে দিতে পারি না। আমার লেখালেখির ব্যাপারটাও ওই রকম। প্রতিদিনই আমি লিখি, যাতে আমার মন অনভ্যস্ত হয়ে না পড়ে। এভাবে সাহিত্যের মাপকাঠিকে ক্রমাগত ওপরের দিকে ওঠানো সম্ভব। ঠিক একই রকমভাবে পেশিকেও ক্রমাগত শক্তিশালী করা যায়।
মাইক : আপনি মা-বাবার একমাত্র সন্তান হিসেবে বড় হয়েছেন; লেখালেখি একটা সঙ্গীহীন পেশা এবং আপনি দৌড়ের সময় একাই থাকেন। এগুলোর মধ্যে কি কোনো যোগসূত্র আছে?
মুরাকামি : অবশ্যই আছে। একাকী থাকতেই অভ্যস্ত আমি। একাকী থাকতেই ভালো লাগে আমার। আমার স্ত্রী আমার উল্টো। কিন্তু আমি মনুষ্য সঙ্গ পছন্দ করি না। আমাদের দাম্পত্য জীবন ৩৭ বছরের। মাঝেমধ্যে মতবিরোধ হয়। আমার আগের পেশায় ভোররাত পর্যন্ত কাজ করতাম। আর এখন আমি রাত ৯টা-১০টার মধ্যে বিছানায় চলে যাই।
মাইক : লেখকজীবন শুরু করার এবং নিয়মিত দৌড়ানোর আগে আপনি টোকিওতে একটা জ্যাজ ক্লাবের মালিক ছিলেন। এর চেয়ে বেশি আমূল পরিবর্তন কারো জীবনে খুব একটা দেখা যায় না, তাই না?
মুরাকামি : ক্লাব চালানোর সময় আমাকে বারের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে অনেক সময়। আমার কাজটাই ছিল মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা চালানো। সাত বছর ওই কাজ করেছি। তবে স্বভাবগতভাবে আমি বাচাল ধরনের মানুষ নই। তখন থেকেই প্রতিজ্ঞা করেছি, এই পেশা ছেড়ে দিতে পারলে নিতান্ত প্রয়োজন থাকবে যাঁদের সঙ্গে শুধু তাঁদের সঙ্গে কথাবার্তা বলব। সবার সঙ্গে নয়।
মাইক : কখন খেয়াল করলেন নতুন পেশা শুরু করতে হবে?
মুরাকামি : ১৯৭৮ সালের এপ্রিলে একদিন টোকিওর জিঙ্গু স্টেডিয়ামে বেসবল খেলা দেখতে গিয়েছি। মাথার ওপর সূর্যের প্রচণ্ড তেজ। আমি তখন বিয়ার খাচ্ছিলাম। ইকুল্ট সোয়ালোর ডেভ হিল্টনের একটা চমৎকার হিটের মুহূর্তে আমার মনে হলো, আমি নিশ্চিত আমি উপন্যাস লিখতে যাচ্ছি। সে এক প্রচণ্ড উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্ত। এখনো হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারি সেই মুহূর্তটাকে। পুরনো দিনের মুক্তজীবনের বিনিময়ে পেয়েছি এখনকার নতুন আর গুপ্ত জীবন। আমি কোনো দিন টেলিভিশনের পর্দায় হাজির হইনি; রেডিওতেও কেউ আমার কথা শুনতে পায়নি; বাইরে আমার লেখার পাঠেও খুব একটা অংশগ্রহণ করি না বললেই চলে; আমার ছবি তোলার ব্যাপারেও আমি অনিচ্ছুক; সাক্ষাৎকারও খুব বেশি দিই না; আমি পুরোপুরিই একা থাকার মানুষ।
মাইক : আপনি কি অ্যালান সিলিটোর 'দ্য লোনলিনেস অব দ্য লং ডিসট্যান্স রানার' উপন্যাসের কথা শুনেছেন?
মুরাকামি : ওই বইটা আমাকে উৎসাহ দেয়নি। বেশ একঘেয়ে। অ্যালান সিলিটো নিজে দৌড়াতেন না। তবে ওখানকার আইডিয়াটা জুৎসই মনে হয়েছে : নায়ক আত্মপরিচয়ের কাছে পেঁৗছানোর অধিকার পেয়ে থাকে দৌড়ের মাধ্যমে, দৌড়ের মাধ্যমে সে মুক্ত অবস্থার স্বাদ পেয়ে থাকে।
মাইক : দৌড় থেকে কী শিখেছেন?
মুরাকামি : আমি শেষবিন্দু পর্যন্ত পেঁৗছতে পারব_এই আত্মবিশ্বাস। লেখক হিসেবে আমার দক্ষতার ওপর আমার বিশ্বাস রাখতে শিখিয়েছে। নিজের কাছ থেকে কতটুকু প্রত্যাশা করতে পারি, আমার কখন বিরতি দরকার, কখন বিরতি বেশি দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে, নিজেকে সামনের দিকে নিয়ে যেতে কতখানি ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করতে পারি_এসবই শিখেছি দৌড় থেকে।
মাইক : আপনি কি মনে করেন না, দৌড়ালে লেখক হিসেবে যে অবস্থানে থাকতেন তার চেয়ে ভালো অবস্থানে আছেন দৌড়ানোর কারণে?
মুরাকামি : অবশ্যই। আমার পেশি যত শক্ত হয়েছে আমার মনও তত পরিষ্কার হয়েছে। আমার বিশ্বাস, সব শিল্পী অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করেন, তাঁরা খুব তাড়াতাড়ি শিল্পীসত্তাকে হারিয়ে ফেলেন। জিমি হেনড্রিঙ্, জিম মরিসন, জেসি জোপলিন_তাঁরা ছিলেন আমার ছেলেবেলার নায়ক। তাঁদের সবাই অল্প বয়সে মারা গেছেন। অথচ এ রকমটি হওয়ার কথা ছিল না। শুধু মোজার্ট এবং পুশকিনের মতো প্রতিভারা অল্প বয়সে মৃত্যু ডেকে নিয়ে আসার মতো কাজ করেছিলেন। জিমি হেনড্রিঙ্ ভালো ছিলেন; তবে খুব স্মার্ট ছিলেন বলা যায় না। কারণ তিনি নেশা-আসক্ত ছিলেন। শিল্পের কাজে থাকা মানেই অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় সময় পার করা। সে কারণেই শিল্পীর উচিত নিয়মমাফিক জীবনযাপন করে সেটাকে পুষিয়ে নেওয়া। লেখকের জন্য কাহিনী খুঁজে বের করাটা একটা বিপজ্জনক কাজ। আমি এই বিপদটাকে এড়িয়ে চলতে পারি দৌড়ের মাধ্যমে।
মাইক : আরেকটু ব্যাখ্যা করে বলবেন?
মুরাকামি : লেখক যখন কাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন, তাঁর নিজের ভেতরের একটা বিষাক্ত জিনিসের সঙ্গে মুখোমুখি হতে হয়। কোনো কাহিনীতে ওই বিষাক্ত জিনিসটা না থাকলে কাহিনী হয়ে পড়ে জলো আর একঘেয়ে। অনেকটা ফুগুর মতো : পাফার ফিশের মাংস সুস্বাদু। তবে এর ডিম, যকৃত এবং হৃৎপিণ্ড_এগুলো খুব বিষাক্ত। আমার কাহিনীগুলো আমার চেতনার একটা অন্ধকার ও বিপজ্জনক অংশে অবস্থিত। ভেতর থেকে আমি এ বিষের উপস্থিতি টের পাই। তবে উচ্চমাত্রার প্রতিরক্ষাকারী ওষুধে নিজেকে রক্ষা করতে পারি। কারণ আমার শরীর শক্ত আছে। বয়স অল্প থাকলে শরীরও শক্ত থাকে। সুতরাং প্রশিক্ষণ ছাড়াই ওই বিষয়কে জয় করা সহজ হয়। তবে ৪০ বছরের পর থেকে শক্তি কমতে থাকে। অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করলে ওই বিষের সঙ্গে পেরে ওঠা যায় না।
মাইক : জে ডি সেলিঙ্গার তাঁর উপন্যাস 'ক্যাচার ইন দ্য রাই' লিখেছিলেন ৩২ বছর বয়সে। তিনি কি তাঁর ওই বিষের পক্ষে অতিশয় দুর্বল ছিলেন?
মুরাকামি : আমি ওই উপন্যাসটি জাপানি ভাষায় অনুবাদ করেছি। বেশ চমৎকার। তবে অসম্পূর্ণ। কাহিনী ক্রমান্বয়ে অন্ধকারের দিকেই যেতে থাকে। প্রধান চরিত্র হোল্ডেন কলফিল্ড তাঁর অন্ধকার জগৎ থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজে পাননি। আমার মনে সেলিঙ্গার নিজেও খুঁজে পাননি। কোনো খেলাধুলা তাঁকে রক্ষা করতে পারত কি না জানি না।
মাইক : কাহিনী খুঁজে পেতে দৌড়ের ব্যাপারটা কি আপনাকে উৎসাহ দিয়ে থাকে?
মুরাকামি : না। যাঁরা খেলাচ্ছলে কাহিনীর উৎসে পেঁৗছতে চান, আমি তাঁদের মতো লেখক নই। আমি উৎস খুঁড়ে বের করি। আমার আত্মার গভীরে অন্ধকার খুঁড়ে বের করে আনি সেখানে লুকিয়ে থাকা কাহিনী। এ কাজের জন্যও শারীরিকভাবে শক্ত হতে হয়। আমি যেহেতু দৌড়ে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, তাই দীর্ঘক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখতে পারি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অন্ধকারের ভেতর আমার মনোযোগ ধরে রাখতে হয়। খোঁড়াখুঁড়ির প্রক্রিয়ায়ই সব কিছু পাওয়া যায়। চিত্রকল্প, চরিত্র, উপমা_সবই। শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে থাকলে সম্ভাবনা থাকে ওগুলোকে হাতের কাছে না পাওয়ার। কিংবা পেলেও চেতনার উপরিতলে ধরে রাখার সামর্থ্য নাও থাকতে পারে। লেখার সময় ভেতরের দিকে উৎস পর্যন্ত খুঁড়ে যাওয়াটাই আসল কথা নয়; বরং সেখান থেকে বের হয়ে আসার সময় সব কিছু নিয়ে আসার ক্ষমতাটাই বড় কথা। দৌড়ের বেলায়ও একই কথা : শেষবিন্দু পর্যন্ত পেঁৗছতে হবে, কষ্ট যতই হোক না কেন।
মাইক : দৌড়ানোর সময়ও কি একই রকম অন্ধকার অবস্থায় থাকেন?
মুরাকামি : দৌড়ের মধ্যে আমি অতি পরিচিত কিছু দেখতে পাই। দৌড়ের সময় আমি শান্তিপূর্ণ অবস্থানে থাকি।
মাইক : বেশ কয়েক বছর আমেরিকায় থেকেছেন। আমেরিকার আর জাপানি দৌড়বিদদের মধ্যে কি কোনো পার্থক্য আছে?
মুরাকামি : না। তবে আমি হার্ভার্ডের রাইটার ইন রেসিডেন্স হিসেবে যখন কেমব্রিজে ছিলাম, তখন পরিষ্কার বুঝেছি, সাধারণ মানুষের থেকে আলাদাভাবে দৌড়ান এলিট শ্রেণীর সদস্যরা।
মাইক : মানে, একটু বিস্তারিত বলবেন?
মুরাকামি : আমার দৌড়ের রুট চার্লস নদীর ধার ঘেঁষে এগোতে এগোতে হার্ভার্ডের প্রথম বর্ষের অল্প বয়সী স্বর্ণকেশী ছাত্রীদের দৌড়াতে দেখলাম। লম্বা লম্বা পায়ে তারা দৌড়াচ্ছে। কানে আইপড লাগানো, পেছনে পনিটেইল বেণী এদিক-ওদিক দুলছে। তাদের সারা শরীর থেকে আলোর দ্যুতি ছিটকে পড়ছে। তারা যে অন্যদের থেকে আলাদা, সেটা তারা ভালো করেই বুঝতে পারছিল। তাদের এ আত্মচেতনা আমাকে গভীরভাবে মুগ্ধ করল। দৌড়ে আমিই তাদের চেয়ে বেশি সমর্থ। কিন্তু তাদের সামগ্রিক অবয়বেই যেন ইতিবাচক কিছু একটা চোখে লাগার মতো মনে হলো। তারা আমার থেকে কত আলাদা! আমি কখনোই এলিটদের কেউ ছিলাম না।
মাইক : পুরনো দৌড়বিদদের থেকে নতুনদের আলাদা করতে পারেন কি?
মুরাকামি : : নতুনরা খুব দ্রুত দৌড়াতে চায়। তাদের দম খুব অগভীর। আর পুরনোরা বিরতি দিয়ে দৌড়ে থাকেন। একজন লেখক যেমন অন্য লেখকের লিখনশৈলী দেখে চিনতে পারেন, দৌড়ের ব্যাপারেও পুরনো কেউ আরেকজন পুরনোর দৌড় দেখেই বুঝতে পারেন।
মাইক : আপনার বইগুলো জাদুবাস্তবতার শৈলীতে লেখা_বাস্তবতার সঙ্গে জাদু মিশে যায়। দৌড়ের কি বাস্তবতা থেকে দূরে অর্থাৎ পরাবাস্তবতা কিংবা অধিবিদ্যার মতো কোনো বৈশিষ্ট্য আছে?
মুরাকামি : দীর্ঘক্ষণ ধরে চালালে সব কাজই বোধগোম্য কিছু একটা অর্জন করতে পারে। ১৯৯৫ সালে আমি ১০০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটা দৌড়ে অংশগ্রহণ করি। আমার সময় লেগেছিল ১১ ঘণ্টা ৪২ মিনিট। শেষ করার পর মনে হলো, আমি ধর্মীয় একটা অভিজ্ঞতা লাভ করলাম।
মাইক : বাহ্!
মুরাকামি : ৫৫ কিলোমিটার শেষ করার পর দেখলাম আর পারছি না। পা আমার কথা শুনতে চাচ্ছে না। মনে হলো দুটো ঘোড়া আমার শরীরকে দুই দিক থেকে টানছে। ৭৫ কিলোমিটার পার হওয়ার পর দেখলাম স্বাভাবিকতা ফিরে এসেছে। ব্যথা দূর হয়ে গেছে। আমি অন্য প্রান্তে পেঁৗছে গেছি। আমার ভেতর থেকে যেন উল্লাস উথলে উঠছে। স্বর্গীয় অনুভূতি নিয়ে শেষবিন্দুতে পেঁৗছলাম। ওই রকম দৌড় ইচ্ছে করলে আরো দৌড়াতে পারতাম। কিন্তু আমি আর অতি ম্যারাথন দৌড়াতে চাই না।
মাইক : কেন চান না?
মুরাকামি : কারণ আমি ওই চূড়ান্ত পর্যায়ের অভিজ্ঞতা লাভের মাধ্যমে একটা অবস্থায় পেঁৗছলাম, যেটাকে রানার্স ব্লু বলা যায়।
মাইক : সেটা কী রকম?
মুরাকামি : এক ধরনের হতোদ্যম অবস্থা। আমি দৌড়ের প্রতি তখন বীতশ্রদ্ধ হয়ে গেছি। আর ১০০ কিলোমিটার দৌড়ানো অবশ্যই একঘেয়ে ব্যাপার। টানা ১১ ঘণ্টা শুধু নিজের ভেতর আছি_এই একঘেয়ে বোধটাই একটানা কামড়ে ধরেছিল আমাকে। আমার আত্মার ভেতরে প্রেষণা যতটুকু ছিল, সবটুকুই শুষে নিয়েছিল ওই দৌড়টা। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি শেষ হয়ে গিয়েছিল। বেশ কয়েক সপ্তাহ দৌড়ের প্রসঙ্গটাই আমার কাছে অসহ্য মনে হয়েছে।
মাইক : আনন্দ ফিরিয়ে আনলেন কিভাবে?
মুরাকামি : মনের ওপর জোর খাটাতেও চেষ্টা করলাম। কোনো কাজ হলো না। দৌড়ের আকর্ষণ শেষ হয়ে গেছে। সিদ্ধান্ত নিলাম, অন্য কোনো খেলা শুরু করি। নতুন উদ্যম দরকার। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ট্রায়াথলনে অংশ নিলাম। পরে দেখলাম, দৌড়ের প্রতি আকাঙ্ক্ষা ফিরে এসেছে।
মাইক : এখন আপনার বয়স ৫৯। আর কত দিন ম্যারাথনে অংশ নিতে চান?
মুরাকামি : যত দিন হাঁটতে পারি, তত দিন দৌড়ানোর ইচ্ছে আছে। আমার কবরের ওপর কী লেখা থাকবে বলে ঠিক করেছি জানেন?
মাইক : বলুন, প্লিজ!
মুরাকামি : 'অন্তত জীবনে তিনি কখনো হাঁটেননি।'
মাইক : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
মাইক : মি. মুরাকামি, কোনটা বেশি কঠিন : উপন্যাস লেখা, নাকি ম্যারাথন দৌড়ানো?
মুরাকামি : লেখালেখির কাজটা প্রায় পুরোপুরিই একটা মজার বিষয়। আমি প্রতিদিন চার ঘণ্টা লেখালেখি করি। তারপর দৌড়াতে বের হই। নিয়ম করে ১০ কিলোমিটার বা ৬.২ মাইল। সে রকম হলে সহজেই চালিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু একটানা ২৬ মাইল দৌড়ানো অবশ্যই কঠিন। তবে এই কঠিন কাজটাই আমি খুঁজে বের করি। এই অবশ্যম্ভাবী কষ্টটাই আমি নিজের ওপর আরোপ করে থাকি। আমার কাছে ম্যারাথন দৌড়ের এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক।
মাইক : কোনটা বেশি সুন্দর_বই লিখে শেষ করা, নাকি দৌড়ের শেষবিন্দু পার হওয়া?
মুরাকামি : কাহিনীর শেষে যতিচিহ্ন আঁকা যেন একটি সন্তান জন্মদানের অভিজ্ঞতা। এই মুহূর্তটার কোনো তুলনা হয় না। কোনো ভাগ্যবান লেখক জীবদ্দশায় ১২টি উপন্যাস লিখে থাকতে পারেন। জানি না আমার মধ্যে আর কতগুলো উপন্যাস আছে। আশা করি, আরো চার-পাঁচটা। তবে দৌড়ের সময় ওই রকমের সীমাবদ্ধতা আমার বোধের মধ্যে আসে না। বছর চারেকের মধ্যে একটা ঢাউস উপন্যাস প্রকাশ করে থাকি। তবে প্রতিবছর আমি ১০ কিলোমিটারের একটা দৌড়, একটা অর্ধেক ম্যারাথন এবং একটা পুরো ম্যারাথন সম্পন্ন করে থাকি। এযাবৎ আমি ২৭টা ম্যারাথন দৌড়েছি। শেষেরটা ছিল গত জানুয়ারিতে। আশা করি_২৮, ২৯ ও ৩০টা পর্যন্ত পেঁৗছে যাবে স্বাভাবিকভাবেই।
মাইক : আপনার সর্বশেষ বইয়ের জার্মান অনুবাদ প্রকাশিত হতে যাচ্ছে আগামী সোমবার। সেখানে আপনি দৌড়বিদ হিসেবে নিজের কথা বলেছেন এবং লেখালেখির ব্যাপারে দৌড়ের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। এই আত্মজীবনীমূলক লেখাটির পেছনে কী উদ্দেশ্য আছে?
মুরাকামি : আজ থেকে ২৫ বছর আগে ১৯৮২ সালের শরতে দৌড়ানো শুরু করি। তখন থেকেই আমি নিজেকে প্রশ্ন করতে থাকি_কেন দৌড়ের অভ্যাসটা গড়ে তুললাম। আমি ফুটবল খেলি না কেন? কেনইবা আমার সিরিয়াস লেখক সত্তার অস্তিত্ব শুরু হলো প্রথম যেদিন দৌড়াতে বের হলাম সেদিন থেকে? আমার চিন্তাভাবনাকে যদি ধরে রাখি, কেবল তখনই আমি বোধগম্যতার আয়ত্তের মধ্যে পেয়ে যাই যেকোনো বিষয়। ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম দৌড় সম্পর্কে কিছু লিখতে গেলে আমার নিজের সম্পর্কে লিখতে থাকি।
মাইক : আপনি দৌড়ানো শুরু করলেন কেন?
মুরাকামি : ওজন কমানোর জন্য। লেখালেখির প্রথম দিকে মনোযোগ ঠিক রাখার জন্য প্রচুর সিগারেট খেতাম; দিনে ৬০টার মতো। আমার দাঁতের রং হয়ে গিয়েছিল হলুদ; নখগুলোও হলুদ হয়ে গিয়েছিল। ৩৩ বছর বয়সে যখন আমি ধূমপান ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলাম, তখন আমার নিতম্বে অনেক চর্বি জমা হয়ে গেছে। সুতরাং দৌড় শুরু করলাম। দৌড়ই আমার জন্য উপযুক্ত মনে হলো।
মাইক : কেন?
মুরাকামি : দলীয় কোনো খেলা আমার মেজাজের সঙ্গে মানায় না। দেখেছি, নিজের মতো করে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলে যেকোনো কিছুই আমার পক্ষে চালিয়ে নেওয়া সহজ হয়। আর দৌড়ের বেলায় সঙ্গীর দরকার হয় না। বিশেষ কোনো স্থানের দরকার হয় না। যেমন ধরুন টেনিসের কথা। জুডোও আমার সঙ্গে খাপ খায় না। আমি তো আর কোনো যোদ্ধা ধরনের মানুষ নই। দীর্ঘ দূরত্বে দৌড়ের মাধ্যমে কাউকে হারানোর বিষয়ও থাকে না। আমার প্রতিদ্বন্দ্বী আমি নিজেই। আর কেউ আমার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়। আমি শুধু আমার ভেতরের দ্বন্দ্বের মধ্যেই ডুবে থাকতে পারি : নিজেকে প্রশ্ন করতে থাকি, শেষবার যেমন ছিলাম তার চেয়ে আরো ভালো অবস্থানে উঠতে পেরেছি কি? বারবার সীমা অতিক্রম করাটাই দৌড়ের প্রাণ। দৌড় কষ্টের হলেও আমি ছেড়ে দিতে পারি না। এই কষ্টটাও আমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় না। দৌড়ের প্রতি আমি যত্নবান বলতে পারেন। আমার মানসিকতার সঙ্গে খাপ খেয়ে যায় দৌড়।
মাইক : আপনার অবস্থা তখন কেমন ছিল?
মুরাকামি : ২০ মিনিটেই দম বন্ধ হয়ে আসত। হৃৎপিণ্ডে হাতুড়ির আঘাত পড়ার মতো শব্দ হতো। ক্লান্তিতে পা কাঁপতে থাকত। অন্য লোকেরা আমার দৌড়ানো দেখছে বলে অস্বস্তি লাগত প্রথম দিকে। তবে ধীরে ধীরে দাঁত মাজার মতো আমার অন্যান্য দৈনন্দিন কাজের ভেতর দৌড়কেও একাত্ম করে ফেললাম। সুতরাং দৌড়ে আমার অগ্রগতি এসে গেল। এক বছরের মধ্যে আমার আন-অফিশিয়াল ম্যারাথন দৌড়ও শেষ করে ফেললাম।
মাইক : আপনি একাই এথেন্স থেকে ম্যারাথন পর্যন্ত দৌড়েছেন। এখানে আপনার আকর্ষণের বিষয় ছিল কোনটা?
মুরাকামি : যদিও বিপরীত দিকে তবু এটাই তো আসল ম্যারাথন, এটাই তো ঐতিহাসিক রুট। কারণ যে সময়টায় মানুষের ভিড় বেশি থাকে, তখন এথেন্সে পেঁৗছতে চাইনি আমি। আমি ৩৫ কিলোমিটারের বেশি দৌড়াতে চাইনি। আমার পা দুটো এবং শরীরের ওপরের অংশ তখনো খুব বেশি শক্ত হয়ে ওঠেনি। এর বেশি আর কী আশা করা যায় বুঝতে পারিনি তখনো। টেরা ইনকগনিটায় দৌড়ানোর মতো অবস্থা তখন।
মাইক : কিভাবে এগোলেন?
মুরাকামি : তখন জুলাই মাস। প্রচণ্ড গরম। সকালবেলায়ই প্রচণ্ড গরম পড়েছে। গ্রিসে এর আগে আমি কখনো আসিনি। গরমের মাত্রা আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হলো। আধা ঘণ্টা পরই আমি শার্ট খুলে ফেললাম। একটু পরই বরফের মতো ঠাণ্ডা বিয়ার খেতে ইচ্ছে করছিল প্রচণ্ড। রাস্তার পাশে পড়ে থাকা মরা কুকুর-বিড়ালগুলো গুনতে গুনতে সামনে এগোতে থাকলাম। সূর্যের তেজের সঙ্গে আমার মেজাজও জেদি হয়ে উঠল। সূর্যের প্রচণ্ড তাপে আমার ত্বকে ফুসকুড়ি উঠে গেল। সেবার আমার সময় লেগেছিল ৩.৫১ ঘণ্টা। শেষ প্রান্তে পেঁৗছানোর পর একটা পোপ্রাল স্টেশনে ঢুকে গেলাম। ওখানে পেয়ে গেলাম আমার আরাধ্য বিয়ার। আমার কৃতিত্বে খুশি হয়ে ওখানকার অ্যাটেনডেন্ট এক গোছা ফুল উপহার দিল।
মাইক : ম্যারাথনে আপনার সর্বোচ্চ গতি কোন সময় ছিল?
মুরাকামি : ১৯৯১ সালে নিউইয়র্কে তিন ঘণ্টা ২৭ মিনিট। তার মানে প্রতি কিলোমিটারে পাঁচ মিনিট। সে সময়কার কথা মনে হলে গর্ববোধ হয়। কারণ সেন্ট্রাল পার্কের ভেতর দিয়ে শেষ অংশটুকু পার হওয়া আসলেই খুব কঠিন। পরে আরো কয়েকবার চেষ্টা করেছি, তার চেয়ে দ্রুতগতিতে এগোনোর। কিন্তু বয়স তো বেড়েই চলেছে। নিজের সেই সর্বোচ্চ গতিতে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে এখন আর আগ্রহ নেই। এখন শরীরের ক্ষমতা অনুযায়ী যত দূর পারি তাতেই খুশি থাকতে পারি।
মাইক : দৌড়ের সময় কি কোনো মন্ত্র জপ করেন?
মুরাকামি : না। মাঝেমধ্যে নিজেকে বলি : হারুকি, চালিয়ে যাও, পারবে। তবে দৌড়ের সময় আর কোনো চিন্তা মাথায় আসে না।
মাইক : কোনো কিছুই চিন্তা না করে কি থাকা সম্ভব?
মুরাকামি : দৌড়ের সময় মন নিজে থেকেই ফাঁকা হয়ে যায়। যদি কিছু এসেও থাকে, সেটা দৌড়ের চলমানতার কাছে গৌণ। ছোটখাটো বিষয় মনে আসে দমকা হাওয়ার মতো : এসেই আবার চলে যায়। হঠাৎ করেই আসে; আবার চলেও যায় এবং কোনো পরিবর্তন ঘটায় না।
মাইক : দৌড়ের সময় কি কোনো সংগীত শুনে থাকেন?
মুরাকামি : শুধু প্রশিক্ষণের সময়। রক মিউজিক শুনে থাকি। এখন আমার প্রিয় ম্যানিক স্ট্রিট প্রিচারস। সকালবেলা দৌড়ের সময়টা অবশ্য আলাদা। তখন আমার মিনি ডিস্কপ্লেয়ারে ক্রিডেন্স ক্লিয়ারওয়াটার রিভাইভাল লোড করে নিয়ে বের হই। ওদের গানে সহজ-সরল স্বাভাবিক ছন্দ আছে।
মাইক : দৌড়ে বের হয়ে যাওয়ার জন্য সকালবেলা প্রতিদিন নিজেকে প্রণোদিত করেন কিভাবে?
মুরাকামি : মাঝে মধ্যে বাইরে খুব ঠাণ্ডা থাকে, মাঝে মধ্যে খুব গরম। আবার কখনো কখনো খুব মেঘাচ্ছন্ন থাকে আকাশ। কিন্তু আমি বের হয়েই পড়ি। আমি জানি, আজ বের না হলে আগামীকালও হওয়া যাবে না। মানুষের মন সব সময়ই নিজের ওপর অপ্রয়োজনীয় বোঝা চাপিয়ে নেওয়ার বিপক্ষে। সুতরাং শরীর অনভ্যস্ত হয়ে পড়ে খুব তাড়াতাড়িই। কাজেই আমি তো সেটা হতে দিতে পারি না। আমার লেখালেখির ব্যাপারটাও ওই রকম। প্রতিদিনই আমি লিখি, যাতে আমার মন অনভ্যস্ত হয়ে না পড়ে। এভাবে সাহিত্যের মাপকাঠিকে ক্রমাগত ওপরের দিকে ওঠানো সম্ভব। ঠিক একই রকমভাবে পেশিকেও ক্রমাগত শক্তিশালী করা যায়।
মাইক : আপনি মা-বাবার একমাত্র সন্তান হিসেবে বড় হয়েছেন; লেখালেখি একটা সঙ্গীহীন পেশা এবং আপনি দৌড়ের সময় একাই থাকেন। এগুলোর মধ্যে কি কোনো যোগসূত্র আছে?
মুরাকামি : অবশ্যই আছে। একাকী থাকতেই অভ্যস্ত আমি। একাকী থাকতেই ভালো লাগে আমার। আমার স্ত্রী আমার উল্টো। কিন্তু আমি মনুষ্য সঙ্গ পছন্দ করি না। আমাদের দাম্পত্য জীবন ৩৭ বছরের। মাঝেমধ্যে মতবিরোধ হয়। আমার আগের পেশায় ভোররাত পর্যন্ত কাজ করতাম। আর এখন আমি রাত ৯টা-১০টার মধ্যে বিছানায় চলে যাই।
মাইক : লেখকজীবন শুরু করার এবং নিয়মিত দৌড়ানোর আগে আপনি টোকিওতে একটা জ্যাজ ক্লাবের মালিক ছিলেন। এর চেয়ে বেশি আমূল পরিবর্তন কারো জীবনে খুব একটা দেখা যায় না, তাই না?
মুরাকামি : ক্লাব চালানোর সময় আমাকে বারের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে অনেক সময়। আমার কাজটাই ছিল মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা চালানো। সাত বছর ওই কাজ করেছি। তবে স্বভাবগতভাবে আমি বাচাল ধরনের মানুষ নই। তখন থেকেই প্রতিজ্ঞা করেছি, এই পেশা ছেড়ে দিতে পারলে নিতান্ত প্রয়োজন থাকবে যাঁদের সঙ্গে শুধু তাঁদের সঙ্গে কথাবার্তা বলব। সবার সঙ্গে নয়।
মাইক : কখন খেয়াল করলেন নতুন পেশা শুরু করতে হবে?
মুরাকামি : ১৯৭৮ সালের এপ্রিলে একদিন টোকিওর জিঙ্গু স্টেডিয়ামে বেসবল খেলা দেখতে গিয়েছি। মাথার ওপর সূর্যের প্রচণ্ড তেজ। আমি তখন বিয়ার খাচ্ছিলাম। ইকুল্ট সোয়ালোর ডেভ হিল্টনের একটা চমৎকার হিটের মুহূর্তে আমার মনে হলো, আমি নিশ্চিত আমি উপন্যাস লিখতে যাচ্ছি। সে এক প্রচণ্ড উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্ত। এখনো হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারি সেই মুহূর্তটাকে। পুরনো দিনের মুক্তজীবনের বিনিময়ে পেয়েছি এখনকার নতুন আর গুপ্ত জীবন। আমি কোনো দিন টেলিভিশনের পর্দায় হাজির হইনি; রেডিওতেও কেউ আমার কথা শুনতে পায়নি; বাইরে আমার লেখার পাঠেও খুব একটা অংশগ্রহণ করি না বললেই চলে; আমার ছবি তোলার ব্যাপারেও আমি অনিচ্ছুক; সাক্ষাৎকারও খুব বেশি দিই না; আমি পুরোপুরিই একা থাকার মানুষ।
মাইক : আপনি কি অ্যালান সিলিটোর 'দ্য লোনলিনেস অব দ্য লং ডিসট্যান্স রানার' উপন্যাসের কথা শুনেছেন?
মুরাকামি : ওই বইটা আমাকে উৎসাহ দেয়নি। বেশ একঘেয়ে। অ্যালান সিলিটো নিজে দৌড়াতেন না। তবে ওখানকার আইডিয়াটা জুৎসই মনে হয়েছে : নায়ক আত্মপরিচয়ের কাছে পেঁৗছানোর অধিকার পেয়ে থাকে দৌড়ের মাধ্যমে, দৌড়ের মাধ্যমে সে মুক্ত অবস্থার স্বাদ পেয়ে থাকে।
মাইক : দৌড় থেকে কী শিখেছেন?
মুরাকামি : আমি শেষবিন্দু পর্যন্ত পেঁৗছতে পারব_এই আত্মবিশ্বাস। লেখক হিসেবে আমার দক্ষতার ওপর আমার বিশ্বাস রাখতে শিখিয়েছে। নিজের কাছ থেকে কতটুকু প্রত্যাশা করতে পারি, আমার কখন বিরতি দরকার, কখন বিরতি বেশি দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে, নিজেকে সামনের দিকে নিয়ে যেতে কতখানি ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করতে পারি_এসবই শিখেছি দৌড় থেকে।
মাইক : আপনি কি মনে করেন না, দৌড়ালে লেখক হিসেবে যে অবস্থানে থাকতেন তার চেয়ে ভালো অবস্থানে আছেন দৌড়ানোর কারণে?
মুরাকামি : অবশ্যই। আমার পেশি যত শক্ত হয়েছে আমার মনও তত পরিষ্কার হয়েছে। আমার বিশ্বাস, সব শিল্পী অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করেন, তাঁরা খুব তাড়াতাড়ি শিল্পীসত্তাকে হারিয়ে ফেলেন। জিমি হেনড্রিঙ্, জিম মরিসন, জেসি জোপলিন_তাঁরা ছিলেন আমার ছেলেবেলার নায়ক। তাঁদের সবাই অল্প বয়সে মারা গেছেন। অথচ এ রকমটি হওয়ার কথা ছিল না। শুধু মোজার্ট এবং পুশকিনের মতো প্রতিভারা অল্প বয়সে মৃত্যু ডেকে নিয়ে আসার মতো কাজ করেছিলেন। জিমি হেনড্রিঙ্ ভালো ছিলেন; তবে খুব স্মার্ট ছিলেন বলা যায় না। কারণ তিনি নেশা-আসক্ত ছিলেন। শিল্পের কাজে থাকা মানেই অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় সময় পার করা। সে কারণেই শিল্পীর উচিত নিয়মমাফিক জীবনযাপন করে সেটাকে পুষিয়ে নেওয়া। লেখকের জন্য কাহিনী খুঁজে বের করাটা একটা বিপজ্জনক কাজ। আমি এই বিপদটাকে এড়িয়ে চলতে পারি দৌড়ের মাধ্যমে।
মাইক : আরেকটু ব্যাখ্যা করে বলবেন?
মুরাকামি : লেখক যখন কাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন, তাঁর নিজের ভেতরের একটা বিষাক্ত জিনিসের সঙ্গে মুখোমুখি হতে হয়। কোনো কাহিনীতে ওই বিষাক্ত জিনিসটা না থাকলে কাহিনী হয়ে পড়ে জলো আর একঘেয়ে। অনেকটা ফুগুর মতো : পাফার ফিশের মাংস সুস্বাদু। তবে এর ডিম, যকৃত এবং হৃৎপিণ্ড_এগুলো খুব বিষাক্ত। আমার কাহিনীগুলো আমার চেতনার একটা অন্ধকার ও বিপজ্জনক অংশে অবস্থিত। ভেতর থেকে আমি এ বিষের উপস্থিতি টের পাই। তবে উচ্চমাত্রার প্রতিরক্ষাকারী ওষুধে নিজেকে রক্ষা করতে পারি। কারণ আমার শরীর শক্ত আছে। বয়স অল্প থাকলে শরীরও শক্ত থাকে। সুতরাং প্রশিক্ষণ ছাড়াই ওই বিষয়কে জয় করা সহজ হয়। তবে ৪০ বছরের পর থেকে শক্তি কমতে থাকে। অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করলে ওই বিষের সঙ্গে পেরে ওঠা যায় না।
মাইক : জে ডি সেলিঙ্গার তাঁর উপন্যাস 'ক্যাচার ইন দ্য রাই' লিখেছিলেন ৩২ বছর বয়সে। তিনি কি তাঁর ওই বিষের পক্ষে অতিশয় দুর্বল ছিলেন?
মুরাকামি : আমি ওই উপন্যাসটি জাপানি ভাষায় অনুবাদ করেছি। বেশ চমৎকার। তবে অসম্পূর্ণ। কাহিনী ক্রমান্বয়ে অন্ধকারের দিকেই যেতে থাকে। প্রধান চরিত্র হোল্ডেন কলফিল্ড তাঁর অন্ধকার জগৎ থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজে পাননি। আমার মনে সেলিঙ্গার নিজেও খুঁজে পাননি। কোনো খেলাধুলা তাঁকে রক্ষা করতে পারত কি না জানি না।
মাইক : কাহিনী খুঁজে পেতে দৌড়ের ব্যাপারটা কি আপনাকে উৎসাহ দিয়ে থাকে?
মুরাকামি : না। যাঁরা খেলাচ্ছলে কাহিনীর উৎসে পেঁৗছতে চান, আমি তাঁদের মতো লেখক নই। আমি উৎস খুঁড়ে বের করি। আমার আত্মার গভীরে অন্ধকার খুঁড়ে বের করে আনি সেখানে লুকিয়ে থাকা কাহিনী। এ কাজের জন্যও শারীরিকভাবে শক্ত হতে হয়। আমি যেহেতু দৌড়ে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, তাই দীর্ঘক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখতে পারি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অন্ধকারের ভেতর আমার মনোযোগ ধরে রাখতে হয়। খোঁড়াখুঁড়ির প্রক্রিয়ায়ই সব কিছু পাওয়া যায়। চিত্রকল্প, চরিত্র, উপমা_সবই। শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে থাকলে সম্ভাবনা থাকে ওগুলোকে হাতের কাছে না পাওয়ার। কিংবা পেলেও চেতনার উপরিতলে ধরে রাখার সামর্থ্য নাও থাকতে পারে। লেখার সময় ভেতরের দিকে উৎস পর্যন্ত খুঁড়ে যাওয়াটাই আসল কথা নয়; বরং সেখান থেকে বের হয়ে আসার সময় সব কিছু নিয়ে আসার ক্ষমতাটাই বড় কথা। দৌড়ের বেলায়ও একই কথা : শেষবিন্দু পর্যন্ত পেঁৗছতে হবে, কষ্ট যতই হোক না কেন।
মাইক : দৌড়ানোর সময়ও কি একই রকম অন্ধকার অবস্থায় থাকেন?
মুরাকামি : দৌড়ের মধ্যে আমি অতি পরিচিত কিছু দেখতে পাই। দৌড়ের সময় আমি শান্তিপূর্ণ অবস্থানে থাকি।
মাইক : বেশ কয়েক বছর আমেরিকায় থেকেছেন। আমেরিকার আর জাপানি দৌড়বিদদের মধ্যে কি কোনো পার্থক্য আছে?
মুরাকামি : না। তবে আমি হার্ভার্ডের রাইটার ইন রেসিডেন্স হিসেবে যখন কেমব্রিজে ছিলাম, তখন পরিষ্কার বুঝেছি, সাধারণ মানুষের থেকে আলাদাভাবে দৌড়ান এলিট শ্রেণীর সদস্যরা।
মাইক : মানে, একটু বিস্তারিত বলবেন?
মুরাকামি : আমার দৌড়ের রুট চার্লস নদীর ধার ঘেঁষে এগোতে এগোতে হার্ভার্ডের প্রথম বর্ষের অল্প বয়সী স্বর্ণকেশী ছাত্রীদের দৌড়াতে দেখলাম। লম্বা লম্বা পায়ে তারা দৌড়াচ্ছে। কানে আইপড লাগানো, পেছনে পনিটেইল বেণী এদিক-ওদিক দুলছে। তাদের সারা শরীর থেকে আলোর দ্যুতি ছিটকে পড়ছে। তারা যে অন্যদের থেকে আলাদা, সেটা তারা ভালো করেই বুঝতে পারছিল। তাদের এ আত্মচেতনা আমাকে গভীরভাবে মুগ্ধ করল। দৌড়ে আমিই তাদের চেয়ে বেশি সমর্থ। কিন্তু তাদের সামগ্রিক অবয়বেই যেন ইতিবাচক কিছু একটা চোখে লাগার মতো মনে হলো। তারা আমার থেকে কত আলাদা! আমি কখনোই এলিটদের কেউ ছিলাম না।
মাইক : পুরনো দৌড়বিদদের থেকে নতুনদের আলাদা করতে পারেন কি?
মুরাকামি : : নতুনরা খুব দ্রুত দৌড়াতে চায়। তাদের দম খুব অগভীর। আর পুরনোরা বিরতি দিয়ে দৌড়ে থাকেন। একজন লেখক যেমন অন্য লেখকের লিখনশৈলী দেখে চিনতে পারেন, দৌড়ের ব্যাপারেও পুরনো কেউ আরেকজন পুরনোর দৌড় দেখেই বুঝতে পারেন।
মাইক : আপনার বইগুলো জাদুবাস্তবতার শৈলীতে লেখা_বাস্তবতার সঙ্গে জাদু মিশে যায়। দৌড়ের কি বাস্তবতা থেকে দূরে অর্থাৎ পরাবাস্তবতা কিংবা অধিবিদ্যার মতো কোনো বৈশিষ্ট্য আছে?
মুরাকামি : দীর্ঘক্ষণ ধরে চালালে সব কাজই বোধগোম্য কিছু একটা অর্জন করতে পারে। ১৯৯৫ সালে আমি ১০০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটা দৌড়ে অংশগ্রহণ করি। আমার সময় লেগেছিল ১১ ঘণ্টা ৪২ মিনিট। শেষ করার পর মনে হলো, আমি ধর্মীয় একটা অভিজ্ঞতা লাভ করলাম।
মাইক : বাহ্!
মুরাকামি : ৫৫ কিলোমিটার শেষ করার পর দেখলাম আর পারছি না। পা আমার কথা শুনতে চাচ্ছে না। মনে হলো দুটো ঘোড়া আমার শরীরকে দুই দিক থেকে টানছে। ৭৫ কিলোমিটার পার হওয়ার পর দেখলাম স্বাভাবিকতা ফিরে এসেছে। ব্যথা দূর হয়ে গেছে। আমি অন্য প্রান্তে পেঁৗছে গেছি। আমার ভেতর থেকে যেন উল্লাস উথলে উঠছে। স্বর্গীয় অনুভূতি নিয়ে শেষবিন্দুতে পেঁৗছলাম। ওই রকম দৌড় ইচ্ছে করলে আরো দৌড়াতে পারতাম। কিন্তু আমি আর অতি ম্যারাথন দৌড়াতে চাই না।
মাইক : কেন চান না?
মুরাকামি : কারণ আমি ওই চূড়ান্ত পর্যায়ের অভিজ্ঞতা লাভের মাধ্যমে একটা অবস্থায় পেঁৗছলাম, যেটাকে রানার্স ব্লু বলা যায়।
মাইক : সেটা কী রকম?
মুরাকামি : এক ধরনের হতোদ্যম অবস্থা। আমি দৌড়ের প্রতি তখন বীতশ্রদ্ধ হয়ে গেছি। আর ১০০ কিলোমিটার দৌড়ানো অবশ্যই একঘেয়ে ব্যাপার। টানা ১১ ঘণ্টা শুধু নিজের ভেতর আছি_এই একঘেয়ে বোধটাই একটানা কামড়ে ধরেছিল আমাকে। আমার আত্মার ভেতরে প্রেষণা যতটুকু ছিল, সবটুকুই শুষে নিয়েছিল ওই দৌড়টা। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি শেষ হয়ে গিয়েছিল। বেশ কয়েক সপ্তাহ দৌড়ের প্রসঙ্গটাই আমার কাছে অসহ্য মনে হয়েছে।
মাইক : আনন্দ ফিরিয়ে আনলেন কিভাবে?
মুরাকামি : মনের ওপর জোর খাটাতেও চেষ্টা করলাম। কোনো কাজ হলো না। দৌড়ের আকর্ষণ শেষ হয়ে গেছে। সিদ্ধান্ত নিলাম, অন্য কোনো খেলা শুরু করি। নতুন উদ্যম দরকার। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ট্রায়াথলনে অংশ নিলাম। পরে দেখলাম, দৌড়ের প্রতি আকাঙ্ক্ষা ফিরে এসেছে।
মাইক : এখন আপনার বয়স ৫৯। আর কত দিন ম্যারাথনে অংশ নিতে চান?
মুরাকামি : যত দিন হাঁটতে পারি, তত দিন দৌড়ানোর ইচ্ছে আছে। আমার কবরের ওপর কী লেখা থাকবে বলে ঠিক করেছি জানেন?
মাইক : বলুন, প্লিজ!
মুরাকামি : 'অন্তত জীবনে তিনি কখনো হাঁটেননি।'
মাইক : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
বোমাং রাজকন্যারাজপ্রথা দুর্বল হয়ে পড়েছে
বোমাং রাজপরিবারের সর্বশেষ রাজা বাবা ক্য সাইন প্রু চৌধুরী এবং রাজমাতা দএসাং ও দুই বোনের সঙ্গে ডনাই প্রু নেলী। ডান দিক থেকে দ্বিতীয় জন হচ্ছেন নেলি এবং বাম দিক থেকে দ্বিতীয় জন হচ্ছেন রাজা ।
ডনাই প্রু নেলী। বোমাং রাজপরিবারের সর্বশেষ (১৬তম) রাজা ক্য সাইন প্রু চৌধুরীর (কেএস প্রু) কন্যা। সম্প্রতি ভাগ্য বিড়ম্বিত এই রাজকন্যার সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের।
টানা তিন ঘণ্টার কথোপকথনে উঠে আসে বোমাং রাজ পরিবারের তিনশ’ বছরের ইতিহাস। জানা যায় ঐতিহ্য, সংস্কৃতির নানা দিক। ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতি আর সমষ্টিগত স্বার্থ চিন্তার অনেক সুচিন্তিত বিশ্লেষণও উঠে আসে রাজকন্যার সহজ-সরল-সাবলীল বক্তব্যে। বাদ যায় না উত্তরাধিকার নিয়ে পারিবারিক জটিলতাজনিত হতাশা-হাহাকার-আক্ষেপও। অপ্রাপ্তি আর ভাগ্য বিড়ম্বনার বেদনা কখনো জলের ধারা হয়ে নামে বোমাং রাজজন্যার চোখে। পরক্ষণেই অশ্রুর বেগজয়ী চোখে ফুটে ওঠে রাজপরিবারের ঐতিহ্য ধরে রাখার দৃঢ় প্রত্যয়। ফাঁকে ফাঁকে রাজপরিবারের জনহিতৈষী কাজের নাতিদীর্ঘ ফিরিশতিও তুলে ধরেন তিনি।
সাক্ষাৎকারটি নেন আসিফ আজিজ ও মীর সানজিদা আলম। ছবি তোলেন স্টাফ ফটো করেসপন্ডেন্ট নূর এ আলম।
পাঠকদের সুবিধার জন্য দীর্ঘ সাক্ষাতকারটির প্রথম পর্ব ছাপা হলো শুক্রবার।
আপনার পরিবার, রাজপরিবারের ইতিহাস সম্পর্কে কিছু বলুন।
নেলী: মা-নানীদের কাছে শোনা, আমার দাদু বোমাংগ্রী ক্যজসাইন ছিলেন রাজার মতো রাজা। তিনি ছিলেন আমাদের বংশের ১৩তম রাজা। তার সৈন্য ছিল, কারাগার ছিল। তিনি শাসন করতেন, বিচার করতেন। ডিসি-কমিশনার কখনো ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে কোন কাজে বাধ্য করতে পারে নি।
তার বোমাং সার্কেল নিজের ইচ্ছামাফিক সাজানোর সব ক্ষমতাই হাতে রাখতেন তিনি। সে যুগে যখন কোনো রাস্তা-ঘাট ছিল না, তখনো বৃটিশ কুইনদের সঙ্গে, জাপান কিংদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তার।
দাদু মারা যাওয়া পরে তার কাজিন মংশৈ প্রু রাজা হন। আইয়ুব খানের আমলে তিনি ছিলেন মিনিস্টার। স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারের আমলেও মিনিস্টার হয়েছিলেন। এ আমলকে আমি পেয়েছি। ওই আমলেও আমি দেখেছি যে তার অনেক পাওয়ার ছিল। সরকারকে সঙ্গে রেখেই তিনি তার মতো করে চলতে পারতেন।
দাদুর পরে ১৫তম রাজা হন আমার মামা অগাতা অংশু প্রু বোমাংগ্রী। তার সময় থেকে দেখেছি অনেক পাওয়ার লেস হয়ে যাচ্ছে। এখন ডিসির যতখানি পাওয়ার, ততখানি পাওয়ারও রাজার নেই। নামে রাজা, কিন্তু তার ইনকাম সোর্স নেই, নিজস্ব সৈন্য নেই, স্বাধীন অফিসও নেই। নামে মাত্র যে অফিস আছে সেই অফিস ও অফিস সহকারীর বেতনও সরকার টানে না।
রাজপুণ্যাহের সময় ৪০ হাজার টাকাও খাজনা ওঠে না। কিন্তু রাজপুণ্যাহের তিনদিন অনুষ্ঠান চালাতে রাজাকে অনেক টাকা খরচ করতে হয়। অথচ অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা ছাড়া একজন রাজা তো রাজার মতো কাজ করতে পারেন না। তাছাড়া অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল হতে গেলে পুরো পরিবারের একতাবদ্ধ থাকা দরকার।
তাহলে কি রাজপরিবারের একতা নেই বা কমে গেছে বলে মনে করেন?
নেলী: অনেক কমে গেছে। আগে প্রজারা রাজার কথা মতো চলেছে। তার এলাকার পাহাড়ি-বাঙালি কেউই রাজার সার্টিফিকেট ছাড়া কোথাও ভর্তি হতে পারতো না। এখন কিন্তু সেটা নেই। এখন তাদের ডিসি অফিস, আঞ্চলিক পরিষদ কতো দিকে দৌড়াতে হয়! এমন পরিস্থিতিতে তাই যাদের কোনো ক্ষমতা নেই তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বেশি। কিন্তু যখন রাজপ্রথা ছিল তখন ভালো ছিল তারা। তখন মানুষ জানতো রাজার দুয়ারে গেলে একটা রেজাল্ট পাওয়া যাবে।
সুন্দর একটা সিস্টেম রয়েছে রাজপ্রথায়। পাড়ার প্রধান কারবারি যখন কোনো সমস্যার সমাধান দিতে পারেন না, তখন হেডম্যানের কাছে যান। হেডম্যান না পারলে যান রাজার কাছে।
আপনিই তো এখন বোমাং রাজপরিবারের উত্তরাধিকারি ....নিজের সম্পর্কে কিছু বলুন।
নেলী: বাবা রাজা থাকা অবস্থায় খুব কাছাকাছি থেকেছি, তার অধিকাংশ কাজ করেছি। অথচ আমার নাম কিন্তু বেশি জায়গায় খুঁজে পাবেন না। কারণ আমি একজন মেয়ে। আমাদের পরিবারে ছেলেদের গুরুত্ব বেশি।
আপনার বাবার মৃত্যুর পর রাজপরিবারের এখন কি অবস্থা?
নেলী: বোমাং সার্কেলের চিফ নিয়োগ দেয় কিন্তু সরকার। প্রথমে ফ্যামিলি, তারপর সরকার স্বীকৃতি দেবে। সবকিছু বিবেচনা করে ১৯৯৬ সালে সরকার কিন্তু আমার বাবাকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। কিছুদিন আগে বাবার কাগজপত্র ঘাটতে গিয়ে সরকারি প্রজ্ঞাপনের কপি পেয়েছি। বাবার শুধু অভিষেক অনুষ্ঠানটা হয়নি। তড়িঘড়ি করে অভিষেক অনুষ্ঠান করেন নি তিনি। বাবা বলতেন- রাজা হবো তো রাজার মতো হবো।
আমি শুনেছি, বাবা সাত বছর পর্যন্ত মাটিতে পা রাখেন নি। কাঁধে চড়ে বেরুতেন, বেড়াতেন। ঘোড়ার পিঠে চড়ে জঙ্গলে ঘুরতেন। কচ্ছপ গাড়ি চালাতেন। এসব আমার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হয়।
আমার বাবা একটু সময় নিচ্ছিলেন। কিন্তু মাঝ থেকে আমার মামা অংশৈপ্রু চৌধুরী ঢুকে গেলেন। দুই পরিবার অনেকটা আলাদা হয়ে গেল। একদল বিএনপি, একদল আওয়ামী লীগ। আমার মামা বিএনপি করতেন। তারপর কেস শুরু হলো। উনি কেস ঠুকে দিলেন ঠিক বাবার অভিষেকের আগে। কেস চলতে থাকলো।
আমাদের পক্ষে তো ড. কামাল হোসেন ছিলেন। তখন আমি আর আমার ছোট ভাই এটা নিয়ে ফাইট করছিলাম। দু’তিন বছর পর দেখলাম বাংলাদেশের প্রশাসন, রাজার ইস্যুটাকে রাজনৈতিকভাবে নিয়ে নিলো। আমাদের উত্তরাধিকারের মামলা পরিণত হলো আওয়ামী লীগ ও বিএনপির লড়াইয়ে। আমাদের মধ্যে বিভাজন বাড়লো। আমরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলাম। আমার বাবা সবসময়ই সেক্রিফাইস করতেন। এক সময় তিনি বললেন- ঠিক আছে, আমি আর কেস চালাবো না, দাদাই রাজা হোক।
আমার বাবা কেস স্টপ করেছিলেন বলেই মামা তের বছর রাজত্ব করতে পেরেছেন। বাবা উল্টো কেস ঠুকলে মামা কিন্তু রাজা হতে পারতেন না। কেস চললে রাজপরিবার রাজাবিহীন থাকতো। কিন্তু বাবা রাজপরিবারের কথা চিন্তা করে, জনসাধারণের কথা চিন্তা করে বৃহত্তর স্বার্থে সেক্রিফাইস করেছেন।
আমার বাবারা ৩২ ভাইবোন। পাঁচ মা। আমার দাদুর রূপকথার মতো পাঁচ রানী ছিল। প্রত্যেক রানির পেছনেই ছিল নির্দিষ্ট সংখ্যক দাসী-বান্দি। আমার বাবা তিন নম্বর রানীর ছেলে। বাবারা তিন ভাইবোন। আমার বাবার জন্মের সময় দাদু নাকি খুশিতে কামান দিয়ে তোপধ্বনি করেছিলেন। আর কোনো সন্তানের সময় নাকি এরকম হয়নি। দাদু নিজেই দাঁড়িয়ে থেকে নাকি সৈন্য সামন্তদের বলেছিলেন- এই তোপধ্বনি কর, আমার ছেলে হয়েছে।
এটার কি কোনো বিশেষ কারণ ছিল?
নেলী: আমার দাদী ছিলেন দাদুর খুব প্রিয়। আমার বাবার জন্মটা নাকি খুব লাকি ছিল দাদুর জন্য। বাবা যখন ছোট থেকে বড় হচ্ছিলেন বাবাকে দাদু সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতেন। পড়াশুনায় ভালো, কথা শুনতেন, দেখতে রাজপুত্রের মতো। সবকিছু মিলিয়ে বাবাকে খুব পছন্দ করতেন দাদু।
তখন মানুষ কষ্টি গণনায় বিশ্বাস করতো। গণক দাদাকে নাকি বলেছিল- এই ছেলে তোমার জায়গায় বসবে, মানে রাজা হবে। এ জন্য আমি জন্মের পর থেকে শুনছি আমার বাবা রাজা হবে। আমিও জানতাম আমার বাবা যদি রাজা হন আমি প্রিন্সেস হবো। এটা ভাগ্যেও ব্যাপার। এই বিশ্বাসটাই কিন্তু সৃষ্টকর্তা দেখিয়ে দিলেন। রাজা হওয়ার পর বাবা পাঁচমাস বেঁচে ছিলেন। এখন মনে হয় বাবা শুধু রাজা হবার জন্যই বেঁচে ছিলেন। তিনি খুব শান্তিতে মারা গেছেন। দেশের অবস্থা দেখে খুব কষ্ট পেতেন বাবা।
বাবার কথা বলতে বলতে জলের বান ডাকে রাজকন্যার দু’চোখে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন-আমার বিদ্রোহটা অন্যরকম। মামা রাজা হওয়ার পর টানা তিনটা বছর বান্দরবানে থাকিনি। রাজপুণ্যাহর আওয়াজটা সহ্য হতো না। রাজা তো আমার বাবার হওয়ার কথা ছিল।
বাবার যেদিন অভিষেক হবে, সেদিন সব রেডি। কমিশনার রওয়ানা দিয়েছেন চিটাগাং থেকে। রোজার মাস ছিল। আমরা ইফতারির আয়োজন করেছি। অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য খাবারের আয়োজন করেছি। বাবা রাজার পোশাক পরেছেন .... এটা আসলে অনেক কষ্টকর।
ফের কান্নার তোড়ে কথা ভেসে যায় রাজকন্যার। কান্নার দমক সামলে ফের হাতড়ান স্মৃতির পাতা। কান্নাজড়িত কণ্ঠে আউড়ান-আমি ছিলাম বাবার পাশে ১৪ বছর আগে। আমার ছোট বোনের বিয়ে হয়নি তখন। ও ফিট হয়ে পড়ে গেলো। আমি তখন বাবাকে সাহস দেওয়ার চেষ্টা করলাম। বললাম- বাবা আজ তোমার অভিষেক হয়নি কাল হবে। বাবা বললেন- লোকজনকে কীভাবে সামলাবি।
তারপর আমরা মানুষকে কিছু বুঝতে না দিয়ে ভেতরে কষ্ট চেপে রেখে আপ্যায়ন করেছি। এরপর তের বছর আমি কখনো ভালোভাবে মন থেকে রাজপুণ্যাহ উদযাপন করতে পারি নি।
মামা তো মারা গেলেন বাবা মারা যাওয়ার পাঁচ মাস আগে। তো মারা যাওয়ার আগে মামা বাবাকে ডেকে পাঠালেন। এতো কিছুর পরও বাবা যখন রেডি হয়ে বের হচ্ছেন তখন মা বললেন- কোথায় যাচ্ছ? বাবা বললেন- দাদা আমাকে ডেকেছে। এক দৌড়ে উনি চলে গেলেন। আমরা শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম।
পরবর্তী রাজা কে হবেন?
নেলী: আসলে আমার বাবা সব কিছু শান্তিতে করে গেছেন। বাবার পর রাজা হওয়া নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। বাবা সব কিছু ঠিক করে গেছেন। বাবার পর নয়জন পর্যন্ত রাজা পর্যায়ক্রমে কে কে হবে তা সব ঠিক করা আছে।
এরা সবাই কি আপনাদের ফ্যামিলি মেম্বার?
নেলী: এরা সবাই রাজ পরিবারের। সবাই রয়েল ব্লু ব্লাড। পর্যায়ক্রমে সবাই রাজা হবেন। আমার বাবা খুব দুর্ভাগা যে তাকে রাজা হওয়ার জন্য ১৩ বছর ফাইট করতে হয়েছে। অর্থনৈতিক ও মানসিকভাবে অনেক প্রেসার গেছে। শুধু তলোয়ারটা হাতে নেওয়ার জন্য, অভিষেকের জন্য আমার বাবাকে ১৩টা বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। কিন্তু বাবার পরে ৯ জন পর্যায়ক্রমে রাজা হবেন।
ওদিক দিয়ে আমার বাবার বড় ভাইয়ের ছেলে ইঞ্জিনিয়ার উ চ প্রু রাজা হবেন। তিনি আমাদের পরিবারের পুরুষদের মধ্যে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ। লন্ডনে পড়াশুনা করেছেন। অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালী, অনেক এডুকেটেড।
উত্তরসূরীদের গল্প বলার ফাঁকে হঠাৎ করেই ফের বাবার স্মৃতিচারণে ফিরে যান নেলী।
বাবার মৃত্যুর পর আমি ১৬ দিন তার তলোয়ারটা পাহারা দিয়েছি। হাত দিয়ে ধরে অনুভব করেছি আমাদের পরিবারের তিনশ’ বছরের ঐতিহ্য। ৩শ’ বছর আগে আমাদের পরিবারে এ তলোয়ারটা এসেছে। অথচ তলোয়ারটা কিন্তু আহামরি কিছু না। এ তলোয়ারটা হাতে নিতে পারেন নি বলে কিন্তু বাবা ১৩ বছর সাফার করেছেন।
কমিশনার এ তলোয়ারটা হ্যান্ডওভার করেন। দাদার ক্ষেত্রে তা অনেক ইজি। শেখ হাসিনা বাবার উইলে সিগনেচার করেছেন ৫ মাসও হয়নি।
আপনাদের এই রাজ প্রথা কি বিলুপ্ত হয়ে যাবে বলে মনে করেন?
নেলী: আসলে রাজপ্রথা এখন অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে। কিন্তু এ রাজ পরিবারের সদস্য হিসেবে বা একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমি কখনো চাই না রাজপ্রথা বিলুপ্ত হয়ে যাক। এখন অন্তত একটা জমি কিনতে গেলে রাজার সার্টিফিকেট লাগে। স্কুল কলেজ, ভার্সিটিতে পড়তে গেলে রাজার সার্টিফিকেট লাগে। তবে প্রথাটা ধরে রাখাও খুব টাফ। এজন্য আমাদের রয়েল ফ্যামিলিকে একজোট থাকতে হবে। আর পাঁচমাস বাবার পাশে থেকে বুঝেছি রাজা হতে গেলে এখন অনেক টাকা লাগে।
বোমাং রাজপরিবারের আয়ের উৎস আসলে কি?
নেলী: রাজাদের কোনো আয়ের উৎস নেই। শুনতে হাস্যকর লাগে- যে খাজনাটা আমরা পাই তা ১ লাখের উপর যায় না। কিন্তু আমার বাবার অভিষেক আর রাজপুণ্যাহতে অনেক টাকা খরচ হয়েছে।
রাজা হওয়ার পর কি আপনার দাদা সঙ্গে আপনি থাকবেন? যেহেতু আপনি আপনার বাবার কাজে অনেক সহযোগিতা করেছেন?
নেলী: হ্যাঁ। দাদা যদি চান, আমরা অবশ্যই সহযোগিতা করবো। অলরেডি সচিবালয়ে কিভাবে কাগজপত্র পাঠাতে হয়, সব ক্ষেত্রে দাদাকে সহযোগিতা করেছি। আমি তাদের বলেছি বাবার সময় তো আমি দৌড়েছি, এখন আমার দাদা রাজা হবেন।
রাজবাড়িটা বোধহয় ১৯৩৪ সালের দিকে নির্মিত, এর আগে রাজবাড়ি কোথায় ছিলো?
নেলী: আপনারা এমন সময় এসেছেন যে আমি আপনাদের রাজবাড়িটা দেখাতে পারবো না, কারণ রাজবাড়িটাকে ভেঙে ফেলা হয়েছে।
কেন ভেঙে ফেলা হলো?
নেলী: এটা আসলে অনেক কষ্টের কথা। আমার দাদুর মোট ৩২ জন ছেলে মেয়ে ছিলো। এর মধ্যে বেঁচে ছিলেন আমার বাবা, আর বার্মায় কয়েকজন আছেন। তো সম্পত্তি ভাগাভাগির বিষয়টাতো আসেই। তাছাড়া অনেক পুরানো হয়েছিলো, এমনিতেই ধ্বংস হয়ে যেতো।
কত দিন হয় ভেঙে ফেলা হয়েছে?
নেলী: সাত মাস।
কিন্তু এটাতো একটা ঐতিহ্য?
নেলী: আসলে আমরাও চেয়েছিলাম দাদুর বাড়িটা থাকুক। আমার দাদুর যদি ১ রানী হতো তাহলে ছেলে-মেয়ে একমুঠো হতো। আমার দাদুর ছিলো ৫ রানী, এদের ৩২ জন ছেলে-মেয়ে। বাড়িটা যদি বাবার নামে থাকত তাহলে আমাদের ইচ্ছা ছিলো মিউজিয়াম বানানোর। বাবার ভাগে পড়েছিলো বারান্দাটা। সেটাতো আর রেখে দেওয়া যায় না। আমার বাবা, আমি অনেক কেঁদেছি এজন্য।
তাহলে এর পর কোনটা রাজবাড়ি হবে? আবার কি নতুন করে তৈরি করা হবে?
নেলী: আসলে এর পর আর কোনো রাজবাড়ি নেই । এর পর যে রাজা হবে তার বাড়িই রাজবাড়ি। আমাদের বোমাং সার্কেলের একটা প্রথা আমি অনার করি, বাট...। রাজা দেবাশিষ জানেন, তার পর তার ছেলে রাজা হবে, কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে তেমন নয়। তাই রাজবাড়ি দেখার কিছু নেই। আমরা একটা প্রাসাদ উঠাচ্ছিলাম এটাই হতো রাজবাড়ি। কিন্তু শেষ করতে পারি নি। এর মধ্যে বাবা চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে।
বাবা চলে যাবেন বলেই বোধ হয়, রাজপুণ্যাহ হওয়ার ২ দিন আগে বাবাকে রাজকীয় ড্রেস পরিয়ে মডেল করে ছবি তুলেছি। দাদুর ছবি দেখে সেই ড্রেসের মতো সে ধরনের গহনার মতো গহনা আমরা তৈরি করেছি। বাবার কোমরের বেল্টটা ছিলো দাদুর, তলোয়ারটাও দাদুর।
বাবা মারা যাওয়ার আগে আমাকে ম্যাসেজ দিয়ে গেছেন। বাবা একেবারেই শান্তিতে মারা গেছেন। বাবা মারা যান ভোর সাড়ে তিনটার দিকে। সেদিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে আমাকে ডেকে বললেন, আমাকে তো ছবি দেখালি না। আমি বললাম বাবা আমিতো দেখিয়েছি। বললেন আমাকে ছবি ওয়াশ করিয়ে দাও। অনেক জায়গায় আমার ছবি দিতে হবে। এখন বুঝি বাবা আমাকে আসলে ম্যাসেজ দিয়ে গেছেন। অনেক জায়গায় বাবার ছবি টাঙিয়ে দিতে হয়। বাবার স্কুল, বাবার আশ্রম অনেক জায়গায়।
প্রয়াত রাজার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে কিছু বলুন?
নেলী: বাবার একটা বৌদ্ধ অনাথালয় আছে। বাবার নিজ হাতে গড়া। সেখানে ১২০ জন বাচ্চা আছে। আগে তো বাবা দেখতেন। আমি জানি না যে এখন এ অনাথালয় আমি কীভাবে চালাবো। ১২০ জন বাচ্চার থাকা, খাওয়া, তাদের পড়াশুনা ....। তবে আমি ভাঙতে দেব না।
বাবা মরে যাওয়ার আগে একদিন আমাকে বলেন, মা রে অনাথালয়ের এ ১২০ জন বাচ্চাকে তোর দেখতে হবে। এ বাচ্চাগুলোকে তুই কখনো না খাইযে রাখবি না। বাবা কিন্তু আমাকে আগে থেকেই ম্যাসেজ দিয়ে গেছেন।
বাবা মারা যাওয়ায় বাচ্চাগুলো অনেক অসহায় হয়ে গেছে। ওরা ভাবছে যে কোনো সময় এটা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বাট আমি বন্ধ হতে দেব না। আমি ওদের দেখবো।
আপনার নিজের পরিবার থেকে কি কেউ রাজা হওয়ার সম্ভাবনা আছে?
নেলী: আসলে আমার ছোট ভাইরা অনেক ছোট? যেহেতু রাজা হওয়াটা বয়স এবং অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে। যদি রাজপ্রশাসন থাকে তাহলে আমার সবার ছোটোভাই রাজা হবে।
বোমাং রাজপরিবারের ইতিহাস সংক্ষেপ
১৭২৭ সালে বোমাংগ্রী (মহাসেনাপতি) কাংহ্লাপ্রু তার অনুসারীদের নিয়ে সাঙ্গুনদীর তীরবর্তী বান্দরবানে বসতি গড়ে তোলেন। ১৮৭৫ সাল পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে শাসন পরিচালনা করেন পাঁচজন বোমাংগ্রী। ১৯০০ সালে বোমাংগ্রী সানাইঞোর আমল ‘চিটাগাং হিলট্রাক্টস রেগুলেশন ১৯০০’ প্রণয়নের মাধ্যমে ডেপুটি কমিশনারের পাশাপাশি সার্কেল চিফ, মৌজা হেডম্যান, কারবারি, রোয়াজা ইত্যাদি পদ সৃষ্টি করে রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব সার্কেল চিফকে দেওয়া হয়।
বান্দরবান ও রাঙামাটির কিছু অংশ নিয়ে বোমাং সার্কেল, রাঙামাটিতে চাকমা সার্কেল এবং খাগড়াছড়ি জেলায় মং সার্কেল গঠন করা হয়। তখন থেকে সার্কেল চিফরা রাজা হিসেবে পরিচিত। রাজারা নিজ এলাকার মানুষের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সম্মানিত ব্যক্তি।
২০১৩ সাল পর্যন্ত বোমাং সার্কেলে দায়িত্ব পালন করেছেন ১৬ জন রাজা। সর্বশেষ রাজা ছিলেন সদ্যপ্রয়াত ক্য সাইন প্রু চৌধুরী। রাজা অং শৈ প্রু চৌধুরী মারা যাওয়ার পর ২০১২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর রাজকীয় অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে রাজা ক্য সাইন প্রু চৌধুরী দায়িত্ব নেন বান্দরবান বোমাং সার্কেলের ১৬তম রাজা হিসেবে। গত ৬ ফেব্রুয়ারি নিজ বাসভবনে ১৬তম এ রাজা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
বোমাং সার্কেল এখন ১৭তম রাজার অভিষেকের অপেক্ষায়। ১৬তম এবং সর্বশেষ বোমাং রাজা ক্য সাইন প্রু চৌধুরীর (কেএস প্রু) কন্যা ডনাই প্রু নেলীর চাচাত ভাই ইঞ্জিনিয়ার উ চ প্রু-র অভিষেক অনুষ্ঠিত হবে আগামী ২৪ এপ্রিল।
সূত্র, বাংলানিউজ : এপ্রিল ১৮, ২০১৩
আমি কমিনিস্ট বা নাস্তিক নই : শাহ আব্দুল করিম
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : সৈয়দ মবনু
সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই থানার ধল গ্রামে ১৩২৮ বাংলার ফাল্গুন মাসের প্রথম মঙ্গলবার ( মোতাবেক ১৯১৬খ্রিস্টাব্দের ফেব্র“য়ারী) শাহ আব্দুল করিমের জন্ম। পিতা ইব্রাহীম আলী মরহুম, গ্রামের এক দরিদ্র কৃষক ছিলেন। দারিদ্রতার কারণে আব্দুল করিম যে বয়সে স্কুলে যাওয়ার কথা সেই বয়সে গেলেন গরু রাখালীর চাকুরীতে। তিনি নিজেই লিখেছেন-- ‘ গরীব কুলে জন্ম আমার আজও মনে পড়ে/ ছোটবেলা বাস করিতাম ছোট্ট এক কুড়ে ঘরে।’ এই যে কুড়ে ঘরের কথা শাহ আব্দুল করিম তাঁর গানে বলেছেন, এর অবস্থা এতোই করুন ছিলো যে, বৃষ্টির দিনে মাঝেমধ্যে ঘরের ভেতর ছাতা ব্যাবহার করতে হতো। শাহ করিম তাঁর প্রথম জীবনে গরু রাখালীর চাকুরীর কথা প্রায়-ই বলেন; গানে এবং ব্যক্তিগত আলাপচারিতায়। গানের ভাষায় আমরা তাঁর কাছ থেকে শোনতে পারি এই কথাটা। তিনি ‘ভাটির চিঠি’ গানে লিখেছেন-- ‘ ছেলেরা মাঠে চড়াইতো গরুর পাল।/ আজও আমার মনে পড়ে সে জমানার হাল।।/ রাখাল বাজাইতো বাঁশি আনন্দে তখন।/ সে রাখালদের মধ্যে ছিলাম আমিও একজন।।’ তখন ছিলো বৃটিশ শাসন। বৃটিশদের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে নাইট স্কুল গড়ে উঠলো, আব্দুল করিম তাতে ভর্তি হলেন। বর্ণ অক্ষর শিখলেন, যুক্ত অক্ষর লেখাপড়া শিখলেন। এর মধ্যে ছাত্রের অভাবে স্কুল বন্ধ হয়ে গেলো। আব্দুল করিমের একাডেমিক লেখাপড়া এখানেই ইতি। এরপর গানের জগতে পদযাত্রা। বৃটিশ ভারতে জন্ম নিয়ে শাহ আব্দুল করিম গানের জগতে হাটতে হাটতে পাকিস্তান হয়ে ১৯৭১খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশকে পেয়ে যান। না, তিনি ক্লান্ত হয়ে বসে থাকেননি, বাংলাদেশেও হাটতে থাকেন দারিদ্রতার সাথে যুদ্ধ করে নিজের কক্ষপথে। তবে দারিদ্রতার অজুহাতে শাহ আব্দুল করিম বিবেকের সাথে প্রতারণা করে আপোষ করেননি কোনো ক্ষমতাবান কিংবা বিত্তশালীর সাথে। তাঁর ভেতরে অহম ছিলো, আত্ম-মর্যদাবোধ ছিলো অত্যন্ত প্রখর। তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন দারিদ্রতার সাথে কিন্তু কারো করুনার লোভে কিংবা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির আশায় কাতরস্পর্শী হোননি। তাঁর আত্ম-বিশ্বাস ছিলো নিজের প্রতিভা ও প্রভুর প্রতি¬। তিনি নিজেই লিখেছেন-- ‘রহমান-রহিম তুমি বন্ধুরে, ও বন্ধু, গফুর ও রহিম।/ তোমার কাছে পানাহ চায়, বাউল করিম--দ্বীনবন্ধুরে।।’ আর প্রতিভার স্বাক্ষরতো আমরা দেখতে পাই তাঁর জারি, সারি, মারফতি, মুর্শিদি, মরমি, গণসঙ্গিত, ভক্তিমূলক গান সমূহে। ইতোমধ্যে তাঁর গান বৃহত্তর সিলেটের গ্রামগুলো ডিঙিয়ে বাংলাদেশের শহরগুলোতেও অনেক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। কালনীর ঢেউ, কালনীর কূল, আফতাব সঙ্গীত, গণসঙ্গীত, ভাটির চিঠি, ধলমেলা ইত্যাদি নামে তাঁর বেশ কিছু গানের বই বাজারে রয়েছে। বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের যে গানের হিসাব ইতোমধ্যে পাওয়া গিয়েছে তা সংখ্যায় প্রায় দুই হাজার। শাহ করিম শুধু সংখ্যায় নয়, বিষয়, বর্ণনা, শৈল্পিকতা, স্বচ্ছতা এবং স্বাতন্ত্রতায় সত্যই আমাদের স্বদেশী সুরের গানের জগতে এক ক্ষণজন্মা সম্রাট। তাঁর গানে দেশ, জাতি, সমাজ, রাজনীতি, ইতিহাস, মানুষের সুখ-দুঃখ, দেশ-বিদেশে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা অত্যন্ত সরল-সহজ এবং শৈল্পিকভাবে প্রস্ফূটিত হয়ে আছে। তিনি আধ্যাত্মিক পুরুষ ছিলেন বলেই লিখেছেন-- ‘ আশিকের রাস্তা সোজা/ আশিক থাকে মাশুক ধ্যানে/ এই তার নামাজ এই তার রোজা।’ তবে তিনি সমাজ, রাজনীতি, পরিবার বিমূখি ‘ফানাফিল্লায় ’ নয়, তিনি ছিলেন উর্দু সাহিত্যের কবি সম্রাট ইকবালের মতো ‘বাকিবিল্লায় ’। অনেক বাউল--সন্যাসীরা রোমান ক্যাথলিক সন্ন্যাসীদের ‘রুহবানিয়াত’ ( ইহকাল বিমূখতা) গ্রহণ করলেও আমরা বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের গানে ইসলামের ‘রাব্বানী’ ( ইহকাল এবং পরকাল) দর্শনের প্রচণ্ড প্রভাব দেখতে পাই। তাঁর গানে আছে সমাজ ও রাজনীতির সমসাময়িক বিষয়গুলো স্পষ্ট। তিনি মাওলানা ভাসানীর ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনে এবং সুনামগঞ্জে শহিদ হোসেন সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মঞ্চে সমসাময়িক বিষয়ে স্বরচিত গান গেয়ে সকলের প্রশংসা অর্জন করেছেন। তবে শাহ আব্দুল করিম কোনো প্রকার দলীয় রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন না। তিনি আজীবন মজলুম মানুষের মুক্তির স্বপ্নে নিজের বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থেকে গান লিখেছেন, গান গেয়েছেন। স্বাধীনতার স্বপ্নে, মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির কাকুতি নিয়ে শাহ আব্দুল করিম বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মঞ্চে গিয়ে গান গাইলেও তিনি শেষ পর্যন্ত নেতাদের-- রাষ্ট্রীয় কর্তাদের লুটপাট, চুরি, বাটপাড়িতে হতাশ হয়ে লিখেছেন--‘ করি ভাবনা সেদিন কি পাব না/ ছিল বাসনা সুখী হইতাম/ দিন হতে দিন আসে যে কঠিন-/ করিম দীনহীন কোন পথে যাইতাম।’ অন্য একটি গানে তিনি বলেছেন-- ‘মজুতদার কালোবাজারী কেউ করে ইজারাদারী কেউ করে / রিলিফ চুরি আমলাতন্ত্রের আশ্রয় ধরে/ এই যুগে আর বাঁচবেনা মান করিম বলে গাটুরী বাঁন্দ/ আসিবে আজলী তুফান দোহাই দিলে মানবেনারে।’ মোটকথা শাহ আব্দুল করিমের গানে সর্বশ্রেণির মানুষের সুখ-দুঃখ, আশা-হতাশা, প্রতিবাদ-সংগ্রাম সবই এসেছে। শাহ করিম অনেক গানে রঙতামশা করেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে দিয়েছেন। যেমন তাঁর নৌকা বাইছের সারী গান আমাদেরকে প্রায় কাতর করে ফেলে। যদিও তিনি গানটি লিখেছেন নৌকা দৌড়ের খেলোয়াড়ীদের জন্য, কিন্তু প্রচন্ড রকমের আধ্যাত্মিক চিন্তা এর ভেতরে আমরা দেখতে পাই। তিনি বলছেন--‘ কোন মেস্তরী নাও বানাইলো কেমন দেখা যায়/ ঝিলমিল ঝিলমিল করেরে ময়ূর পংখী নায়/ চন্দ্র সূর্য বান্ধা আছে নায়েরই আগায়/ দূর্বিনে দেখিয়া পথ মাঝি মাল্লাহর বায়/ রঙে বে-রঙের কত নৌকা ভবের থলায় আয়/ হারা জিতা ছুবের মাঝে কার পানে কে চায়/ মদন মাঝি ভারি পাজি কত নাও ডুবায়/ বাউল আব্দুল করিম কয় বুঝা ভীষম দায়/ কোথায় থাইক্যা আইসা নাও কোথায় চইলা যায়/ ঝিলমিল ঝিলমিল করেরে ময়ূর পংখী নায়।’ এই গানে শাহ আব্দুল করিম নৌকা দৌঁড়ের বর্ণনার মধ্যদিয়ে একটা বিশাল জীবনকে বর্ণনা করে দিয়েছেন। শাহ করিমের ঝিলমিল ঝিলমিল করা ময়ূর পংখী নৌকা হলো মাটির মানুষ। নৌকা দৌঁড়টা হলো জীবন সংগ্রামের ব্যস্ততা--প্রতিদিনের প্রতিযোগিতা। এখানে কেউ বিজয়ী হয়, আবার কেউ পরাজিত। ‘মদন মাঝি ভারি পাজি কত নাও ডুবায়’ এখানে তিনি বিলাসী-নফসের কথা বলেছেন। ‘কোথায় থাইক্যা আইসা নাও কোথায় চইলা যায়’ মানুষ পৃথিবীতে আসে কোথায় থেকে এবং মৃত্যুর পরে যায় কোথায়? এই প্রশ্নেই শাহ আব্দুল করিম তাঁর ভাবনাকে একটা দার্শনিক চিন্তার মধ্যে নিয়ে গেছেন।
শাহ করিম প্রায়ই আসেন আমাদের বাসায়। আমার বড়চাচা সৈয়দ আব্দুর রহমানের সাথে তাঁর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। এই সূত্রে আমি খুব ছোটবেলা থেকে তাঁকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। আমাদের বাসায় রহমান চাচা ছাড়া শাহ আব্দুল করিমের মূল্য আর কারো কাছে তেমন ছিলো না। রহমান চাচার মতে--‘শাহ আব্দুল করিম সাক্ষাৎ আল্লাহর খাস লোক’, যাকে আমরা আল্লাহর ওলী বলে থাকি। তাঁর যুক্তি হলো-- ‘আল্লাহর সাথে খাস সম্পর্ক না থাকলে করিম শাহ এতো উচুঁ মার্গের আধ্যাত্মিক গান রচনা করতে পারতেন না। তা ছাড়া শাহ আব্দুল করিমের সম্পদের লোভ, খ্যাতির মোহ এবং হিংসা-বিদ্ধেষ নেই।’ বেশ আগে সিলেট থেকে প্রকাশিত ‘খোয়াব’ লিটলম্যাগে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়, যা পাঠকদের একটি গ্র“পকে কিছুটা ক্ষুব্ধ করে দেয়। কোনো কোনো ভক্ত মনঃক্ষুণœ হলেন। সিলেটের লেখক-সাহিত্যিকদের একটি গ্র“প ১৪০৭ বাংলার পহেলা বৈশাখ নববর্ষ উদযাপনে শহর থেকে দূরে-ঐতিহ্যবাহী সৈয়দপুর গ্রামে যাবে। উৎসব হবে মরমী কবি পির মজির উদ্দিনের বাড়িতে। তাই অনেকের প্রস্তাব একজন বাউল বা মরমী গায়ক সাথে নিলে ভালো হয়। আমি শাহ আব্দুল করিমের নাম প্রস্তাব করলাম। সবাই একবাক্যে আনন্দ প্রকাশ করলেও কেউ কেউ ‘খোয়াব’ এর সাক্ষাতকারের কথা উপস্থাপন করেন। আমি কিছুটা সত্য-মিথ্যা নিয়ে বিভ্রান্ত হলাম। স্মরণহলো আল্লামা ইকবালের কথা। ইকবাল শেকওয়া লিখলে ভারতবর্ষের একদল আলেম তাকে কাফের ফতোয়া দিলেন। কিন্তু দারুল উলূম দেওবন্দের শায়খুল হাদিস মাওলানা আনোয়ার শাহ কাশমীরী এই ফতোয়ায় স্বাক্ষর না দিয়ে সোজা লাহোরে এসে ইকবালের বাড়িতে মেহমান হলেন। ইকবালের সাথে শেকওয়া নিয়ে আলোচনা করলেন। স্বয়ং ইকবাল নিজে জোয়াবে শেকওয়া লিখলেন। কাদিয়ানীদের প্রতি ইকবালের কিছুটা দুর্বলতা ছিলো। আল্লাহমা আনোয়ার শাহ কাশমীরীর সংস্পর্শে আল্লামা ইকবাল সঠিক ভাবে কাদিয়ানীদের স্বরূপ উন্মোচন করতে সক্ষম হলেন। মুসলমানদের মধ্য থেকে ইকবাল সম্পর্কে ভুল বুঝাবুঝির অবসান হলো। ইকবাল ছিলেন কবি সম্রাট-বিশ্বকবি। শাহ আব্দুল করিম লেখাপড়া না জেনেও বাউল সম্রাট-স্বভাব কবি। তাই ভাবলাম শাহ আব্দুল করিমের সাথে তা নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন। বৃষ্টিঝড়া এক সকালের কথা। বাতাসে হালকা শীত। আমাদের শাহী ঈদগাস্থ বাসায় শাহ আব্দুল করিম বসে আছেন। চা-নাস্তা পর্ব আগেই শেষ। আমি গিয়ে বসি পাশাপাশি। জানতে চাই-- চাচা কেমন আছেন?
শাহ করিম: আল্লাহর মনশা।
মবনু: আপনার সাথে কিছু কথা বলতে চাই?
শাহ করিম : বলুন।
মবনু : কিছুদিন আগে ‘খোয়াব’ লিটল ম্যাগ ওয়ালারা আপনার সাক্ষাৎকার নিয়ে তৃতীয় সংখ্যায় প্রকাশ করেছে। আমার কথাগুলো সেই সাক্ষাৎকারের গর্ভ থেকেই জন্ম। আপনি স্বীকার করেছেন রাখাল থেকে গায়ক হওয়ার কথা। গানের পথে আসতে গিয়ে কিভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছেন?
শাহ করিম : আমার এক দাদা ছিলেন। নাম তাঁর নসিবুল্লাহ। জীবনে শাদী করেননি। আমার একটা গান আছে-
জন্ম নিয়ে একজনের সান্নিধ্য পাইলাম
পিতামহের ছোট ভাই নসিবুল্লাহ নাম
ফকির ছিলেন, করতেন সদা আল্লাহরজিকির
ফকিরী বিনে ছিলো না অন্য ফিকির
আসতনে কাছে ফকির সাধু হিন্দু-মুসলমান
লাউ বাজাইয়া গাইতেন তখন ভক্তিমূলক গান
গানের একটি কলি আমার আজো মনে পরে
‘ভাবিয়া দেখ মাটির সারিন্দারে বাজায় কোন জনে’।
এই কলিটাই আমার জীবনের প্রথম মনে চিত্র অঙ্কন করে। দাদা মারা গেলেন। তারপর এই কলি থেকে আমার উৎপত্তি। আরেকজন ছিলেন করম উদ্দিন। সম্পর্কে নানা। আমার মায়ের মামা। তিনি দুতারা বাজিয়ে গান গাইতেন। তাঁর পাশে বসে আমিও গাইতাম। এই থেকেই আমার আরম্ভ। তারপর আমি গান শিখতে নেত্রকোনায় রশিদ উদ্দিন সাধকের কাছে যাই। উদ্দেশ্য তাঁর সামনে কিছু সামনে গান গাওয়া। এভাবেই আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি।
মবনু : প্রত্যেক শিল্পীর প্রেরণার কিছু কিংবা একটি উৎস থাকে। আপনার সেই উৎস কি?
শাহ করিম : আমারও উৎস আছে। আমি তো গানে আমার নিজের কথা বলি। তাই আমার মতো মানুষ যারা ওদের কথা আমার গানে এসে যায়। আমি শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলি। আমরা এই সমাজের শোষিত, বঞ্চিত, নির্যাতীত মানুষ। আমরা দুঃখ-কষ্টে আছি। আমার কথা বলতে গিয়েই এই শ্রেণীর সবার কথা এসে যায়। এটা-ই আমার গানের উৎস।
মবনু : ‘খোয়াব’ লিটল ম্যাগের তৃতীয় সংখ্যায় এক প্রশ্নের উত্তরে আপনি নিজ স্ত্রী আপ্তাবুন্নেসাকে মুর্শিদ বলে সম্বোধন করেছেন, কারণ ব্যাখ্যা করবেন কি?
শাহ করিম : ওনি এমন এক লোক যাকে আমার সঙ্গীনী না পেলে আমি করিম হতে পারতাম না। তিনি যে ধৈর্য্যসহকারে আমার সেবা যতœ করেছেন তা বলার মতো নয়। আমি বছরে এগারো মাসই বাড়িতে থাকতাম না। এই সময় তিনি অর্ধাহার-অনাহারে থেকেও জীবনে কোনদিন বিরক্তি প্রকাশ করেননি। তাই তাকে মুর্শিদ সম্বোধন করেছি এবং আমার আপ্তাব সঙ্গীত গ্রন্থটি তারই নামানুসারে নামকরণ করেছি।
মবনু : আপনাদের বিয়ে কি প্রেম ঘটিত?
শাহ করিম : না, না। প্রেম ঘটিত নয়। আমাদের বিয়ে পারিবারিক।
মবনু : ‘খোয়াব’ এর অন্য এক প্রশ্নের উত্তরে আপনি বলেছেন, ‘আসমানী খোদা কে মানি না’ তাহলে আপনি কি নাস্তিক?
শাহ করিম : না, আমি নাস্তিক নই। আমি বলেছি আকাশে নয়, পাতালে নয়, খোদা মানুষের অন্তরে। রাসুল (সা.) বলেছেন- ‘কুলুবুল মু’মিনিনা আসিল¬াহী তা’য়ালা।’
আল¬াহ ও যে বলেছেন, নাহনু আকরাবু ইলাইহী মিন হাবলিল ওয়ারিদ।
তাই আমি বিশ্বাস করি আল্লাহ আমার শাহ রগ থেকে আরো কাছে। আকাশে খোদা এতো দূর আমি মনে করি না। আমি খোদাকে কাছে বিশ্বাস করি। আমি বলেছিলাম আকাশে খোদা মানি না। ওরা অর্থ উঠিয়েছে আকাশের খোদা মানি না।
মবনু : আরেক প্রশ্নের উত্তরে দেখলাম আপনি বেহেস্ত, দোজখ, দু’কান্ধের ফেরেস্তা অস্বীকার করছেন। অথচ পবিত্র কুরআন-হাদিসের দ্বারা এগুলো সত্য বলে প্রমাণিত। আপনি কি কোরআন-হাদিস মানেন না?
শাহ করিম : দেখো কোরআন আল্লাহর বাণী তা আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু তার অপব্যাখ্যা কিংবা সুবিধাবাদী ব্যাখ্যা আমি মানি না। বেহেস্ত-দোজখতো দুনিয়াতেই আছে। যারা দুঃখী তারা কষ্ট পাচ্ছে। আর যারা সুখী তারা বেহেস্তের মতো আছে। পরকালেও বেহেস্ত-দোজখ আছে তা আমি বিশ্বাস করি। যারা আল্লাহ-রাসুলের প্রতি বিশ্বাস রেখে সুকাজ করে তারা পরকালে বেহেস্তে যাবে। এবং যারা মন্দকাজ করে তারা দোজখে যাবে। এটাই আমার বিশ্বাস।
মবনু : আপনাকে অনেকে বাম, নাস্তিক বা কমিউনিস্ট করতে চায়। এ সম্পর্কে আপনার প্রতিক্রিয়া কি?
শাহ করিম : তারা যাই বলেন, আমি কিন্তু নাস্তিক নই। আমি আল্লাহ বিশ্বাসী এবং সর্বদা প্রার্থনা করি আমার শেষ নিঃশ্বাস যেনো ত্যাগ হয় আল্লাহ আল্লাহ বলে। এটাই আমার শেষ কথা। তারা আমায় নাস্তিক কিংবা যাই বলুক। আমি যে শোষণের বিরুদ্ধে বলি তাই অনেকে ভাবে কমিউনিস্ট। আমি কমিউনিস্ট বা নাস্তিক নয়। আমি আমার প্রভুর বিশ্বাসী। যারা আমাদের উপর অন্যায় করে আমি তাদের বিরুদ্ধে বলি। এটা আমার চরিত্র। এটা ইসলামের বৈশিষ্ট্য।
মবনু : আপনি ‘খোয়াব’ এর অন্য এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন-‘আমার দীর্ঘ জীবনে রকীব শাহ নামের কোনো ফকিরের গান তো দূরের কথা নাম পর্যন্ত কানে আসেনি। হঠাৎ রেডিও টেলিভিশনে তার গান শোনে বিস্মিত হই।’ আমাদের প্রশ্ন আজ যেসব গান রকিব শাহ-এর বলে প্রচারিত তা কি অন্যকারো?
শাহ করিম : হতে পারে এগুলো রকীব শাহ এর। কিন্তু আমার জীবনে সৈয়দ শাহনূর, শিতালং শাহ, আরকুম শাহ, জালাল উদ্দিন, লালন শাহ, রাধারমন, হাসন রাজা প্রমুখের গান ছোট বেলা থেকেই গেয়ে এবং শোনে আসলেও রকীব শাহ-এর কোন গান পাইনি, শোনিনি, গাইনি। রকীব শাহ হতে পারেন মহাজন, ফকীর কিংবা পীর কিন্তু আমি আমার দীর্ঘ জীবনে তাঁর কোনো গান পাইনি-গাইনি এবং কাউকে গাইতেও শোনিনি। এই কিছু দিন থেকে শোনা যাচ্ছে রকীব শাহ নামক একজন লেখক ছিলেন, তাঁর প্রচুর গান রয়েছে এবং সেগুলো তার বিত্তশালী ছেলে প্রচার করতেছেন। আমি কিন্তু তাকে অমান্য করছি না। তবে আমরা পাইনি তাঁর গান।
মবনু : সৈয়দপুরের মরমী কবি পীর মজীর উদ্দিন সম্পর্কে আপনার কোন ধারণা আছে কি?
শাহ করিম : ওনির সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। তাঁর কথাবার্তা শোনেছি। তার প্রতি আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধা আছে। আমার দিরাইতেও তাঁর প্রচুর শিষ্যভক্ত রয়েছেন। দিরাই হয়ে তিনি ময়মনসিংহ পর্যন্ত যেতেন। দিরাইতে আমার এক শিষ্য ছিল ‘তখবুল’ তার নাম। তখবুলের বাপ-দাদা সবাই তিনির শিষ্য ছিলেন। তখবুলরা খুব গরীব লোক হলেও তাদেরকে তিনি খুব স্নেহ করতেন। সেই বাড়িতে আমি তাকে দেখেছি। তিনি আমায় খুব স্নেহ করতেন। প্রতি বর্ষাকালে তিনি দিরাই হয়ে ময়মনসিংহ যেতেন। দিরাইতে তাঁর সাথে প্রায়ই দেখা হতো।
মবনু : সিলেটে আপনার প্রিয় বাউল বা মরমী কবি কারা?
শাহ করিম : অনেক আছেন। যেমন মনে করেন মরমী কবিদের মধ্যে আরকুম শাহ, সৈয়দ শাহনুর, শিতালং শাহ। আর বাউলদের মধ্যে হাসন রাজা, কালাশাহ, সৈয়দ ইসাক শাহ প্রমুখ। ওদের গান পেয়েছি এবং গেয়েছি। রকীব শাহ-এর পাইনি এবং গাইনি।
মবনু : বাউল-মরমী-মালজুরার মধ্যে ব্যবধান কি?
শাহ করিম : বাউল হলো এই যে আমরা রাই-শ্যাম ইত্যাদি নিয়ে গেয়ে থাকি। মরমী হলো ভক্তিমূলক ভাবে মনের কথা গানের ভাষায় প্রকাশ। আর মালজুরা হলো একটি বিষয় নিয়ে প্রশ্ন-উত্তরের মাধ্যমে গান গাওয়া।
মবনু : আপনার জীবনে সব চাইতে আশ্চর্যজনক ঘটনা কি?
শাহ করিম : জীবনের একেক অবস্থায় একেকটি আশ্চর্যজনক ঘটনা। বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রতিটি ঘটনাই আশ্চর্যজনক। রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজ নীতি সব ব্যাপারেই আশ্চর্য হতে হয়।
মবনু : তা হলে বলুন সব চাইতে আনন্দদায়ক ঘটনা?
শাহ করিম : (একটু হাসলেন) আমরা আনন্দ গান গেয়েই পেয়ে থাকি। তাছাড়া যারা মানুষের সেবা করে তাদেরকে দেখলে আমি আনন্দ পাই।
মবনু : দুঃখজনক ঘটনা?
শাহ করিম : মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখা হচ্ছে না। মানুষ তার প্রকৃত মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মানুষের আজ এই সমাজে বেঁচে থাকার অধিকার নেই। জান-মাল-ইজ্জতের নিরাপত্তা নেই। এগুলো দেখলেই দুঃখ পাই।
মবনু : আধুনিক গান ও কবিতা সম্পর্কে আপনার ধারণা কি?
শাহ করিম : আধুনিকতা আমি তেমন বুঝি না। দেখুন রবীন্দ্রনাথ যদি বিশ্বকবিও হয়ে যান কিন্তু এদেশের সাধারণ মানুষ তার গান বুঝে না। কিন্তু লালন-হাসন রাজার গানে আমরা খুব আনন্দ পাই। আমি মনে করি রবীন্দ্রনাথের গান যদি খুব ভালোও হয় তবু আমাদের সাধারণ মানুষের মন স্পর্শ করে না। হতে পারে তা আমাদের না বুঝার কারণে। তবে যা বুঝি না বা মন স্পর্শ করে না, তা নিয়ে আমাদের সুখ-দুঃখের কি আছে? কবিতার ক্ষেত্রেও একই কথা।
মবনু : আপনি কোনো আধুনিক গান পড়েছেন বা গেয়েছেন?
শাহ করিম : আমি তো লেখা পড়া করিনি। বৃটিশ সময়ে আমাদের অঞ্চলে নাইট স্কুল হয়েছিলো। আমি তখন গরু-রাখালী করতাম। একজন আমায় সেই স্কুলের কথা বললে আমি ভর্তি হই। কিন্তু লোকের ধারণা যখন জন্ম নিলো নাইট স্কুলে পড়লে বৃটিশ সৈন্যদের সাথে গিয়ে জার্মানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে তখন ছাত্ররা পালাতে লাগলো। ফলে নাইট স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে সামান্য লেখাপড়া শিখেছি। তাই আধুনিক কবিতা বা গান আমার হৃদয় স্পর্শ করে না। তা ছাড়া আধুনিকতার লালনকারীরা মানুষকে মানুষের মতো করে দেখতে পারে না। ওরা সব কিছুকে বস্তুর মতো দেখে। কিছু দিন আগে বাংলাদেশ টেলিভিশনে আমার একটি গান দিয়েছে। একজন লোকের মাধ্যমে হুমায়ূন আহমদ আমাকে নিয়েছিলেন। আমার গান রেকর্ড হলো। অথচ হুমায়ূন আহমদ আমাকে দেখা দিলেন না। তিনি আমায় মানুষ হিসেবেই গণ্য করলেন না। আমাকে সামান্য টাকা দিয়ে একজন লোক বললোÑস্যার এখন দেখা করতে পারবে না। আমি কি তার কাছে টাকার জন্য গিয়েছিলাম। আব্দুল করিম টাকার জন্য গান গায় না। আব্দুল করিম টেলিভিশনে গান গাওয়ার জন্যও প্রত্যাশী নয়। আব্দুল করিম গরীব হতে পারে কিন্তু আত্মমর্যাদাহীন নয়। ছিঃ ছিঃ আধুনিকতা। যেখানে মানুষের কোন মূল্য নেই সেখানে আব্দুল করিম ও নেই।
মবনু : ধন্যবাদ আপনি আমায় কিছু সময় দেয়ার জন্য।
শাহ করিম : তোমাকেও ধন্যবাদ।
...... ........
কিছুদিন আগে সুনামগঞ্জের একটি ছেলে আমার কাছে বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম সম্পর্কে লেখা চাইলে ‘আমি নাস্তিক নই’ শিরোনামের লেখাটি তাকে দিয়ে ছিলাম। আমার এক বন্ধু শাহেদ হোসেন, যার গ্রামের বাড়ি করিম সাহেবের গ্রামে, সে একদিন আমাকে এসে জানালো, ঐ ছেলে নাকি তাকে বলেছেÑ‘আমি নাস্তিক নই’ এ কথা বাদ না দিলে লেখাটা তার স্মারকে যাচ্ছে না। আমি স্পষ্ট বলে দিলাম, না গেলে নাই। পরে ঐ ছেলেটি একদিন আমার সাথে দেখা করে বললো- তার গুরুরা নাকি বলেছেন ‘আমি নাস্তিক নই’ শিরোনামে লেখা যাবে না। তাদের কথা হলো শাহ আব্দুল করিম এমন কথা বলতে পারেন না। তাই যদি আমি এই বাক্যটি কেটে দেই, তিনি কৃতজ্ঞ হবেন। আমি তাকে জানিয়ে দিলাম-- আমি কাউকে খুশি করার জন্য লেখালেখি করি না। শাহ করিম যে নাস্তিক নয়, এটাতো প্রকাশিত এবং সত্য কথা, আমি কাটতে পারবো না। সে জানালো যারা তার সাইবোর্ডের পিছনে দাঁড়িয়ে তার স্মারকের জন্য কাজ করছেন তারা ‘আমি নাস্তিক নই’ কথা মেনে নিতে পারছেন না। আমি ছেলেটিকে বললাম-- করিম চাচা তো এখনো বেঁচে আছেন, তোমরা যাও, তাঁর কাছ থেকে জেনে নাওÑতিনি নাস্তিক কি না? সে আমায় জানালো-তারা গিয়েছিলো। করিম চাচা তাদেরকে ধমক দিয়েছেন। তার মন্তব্য হলো-করিম সাহেবের এখন ‘হুশ-বুদ্ধি জায়গায় নেই’। আমি আর প্রতিবাদ করিনি। গত ৬ জুন ০৭ শাহ আব্দুল করিম সিলেট আসলে প্রথমে দু-রাত আমাদের বাসায় থাকেন। আমার ক্যাসেট রেকর্ডার সাথে না থাকায় আমি করিম চাচার সাথে এ বিষয়টি আলোচনায় যাইনি। আমাদের বাসায় দু-দিন থেকে করিম চাচা ‘ইসলামপুর চলে যান। ৮ জুন সন্ধ্যায় ক্যাসেট রেকর্ডার সাথে নিয়ে আমি আর তরুণ কণ্ঠশিল্পী এম. কাওসার ইসলামপুরে শাহ আব্দুল করিমের সাথে দেখা করি। দীর্ঘ কথা হয়। কথাটা প্রথমে শুরু করে দেন বাবুল ভাই, অর্থাৎ করিম চাচার একমাত্র ছেলে নূর জালাল।
নূর জালাল: বাবা, বেশ কিছুদিন আগে সিলেট থেকে একটা ম্যাগাজিন বেরিয়েছিলো, এতে বিভিন্ন কথা এনেছে যে, আপনি আল্লাহ মানেন না, রাসুল মানেন না, বেহেস্ত দোজখ মানেন না-এই সেই নানা হাবিজাবি?
মবনু: এটা নূর জালার ভাইও দেখেছেন যে, একটি ম্যাগাজিন তা লিখেছে। এই বিষয় নিয়ে আপনার সাথে আমার আগে একবার আলোচনা হয়েছে, আমি দেখেছি যে, আপনি গানের মধ্যেও বারবার আল্লাহ রাসুলের কথা বলেছেন। আধ্যাত্মিক অনেক বিষয় আপনার গানে স্পষ্ট এসেছে।
শাহ করি : (হাসেন, শব্দ করেই হাসেন) আল্লাহ-রাসুলের কথা না বলে আপনি পির সাহেব, চুর সাহেব, ডাকাত সাহেব, মোটকথা কিছুই হতে পারবেন না। আপনি আল্লাহর পক্ষে, রাসুলের পক্ষে, আশিকের পক্ষে, বুজুর্গানের পক্ষে কথা বলতে হবে, বুঝতে হবে এবং নিজে মানতেও হবে। অন্যজন মানুক কিংবা নাই মানুক-আপনাকে অবশ্যই মানতে হবে। আমাকেও অবশ্যই মানতে হবে।
মবনু : খোয়াব নামক ম্যাগাজিনে যে তারা লিখলো, নূর জালাল ভাইয়ের ভাষ্যমতে তিনিও ছিলেন যখন তারা সাক্ষাৎকার নিয়েছে, তার বক্তব্য হলো আপনি এমন কোনো কথা বলেননি। তারা তাদের মনের ইচ্ছে মতো এ কথাগুলো তৈরি করেছে। আমি এই কথাগুলোর প্রতিবাদ করেছিলাম ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে আপনার সাক্ষাৎকার নিয়ে। এই যে আপনার সামনে গ্রন্থখানা, তারা আমার কাছে আপনার সম্পর্কে একটা লেখা চেয়েছিলো, আমি এই লেখাটি দিয়েছিলাম। এই বইয়ের সম্পাদক আমায় বললো, তার আড়ালে যারা বইটির জন্য মূলে কাজ করছেন তারা নাকি বলেছেন-করিম সাহেব এমন কথা বলেননি। আমি তাদেরকে বললাম-তিনি নিজে আমায় এ কথাটি বলেছেন।
শাহ আব্দুল করিম : (শব্দ করে আবার হাসেন) নাস্তিক হয়ে তুমি যাবে কোথায়? নাস্তিক হলে তো তুমি আল্লাহ বিরোধী, রাসুল বিরোধী, ধর্ম বিরোধী হয়ে গেলে। নাস্তিক হইবে না। (শাহ আব্দুর করিম তার অভ্যাস মতো জিকির করেন-ইয়া আল্লাহ, মুর্শিদ, মাওলা)।
মবনু : আমার মনে হচ্ছে আপনি এ কথা বলেননি যে আপনি নাস্তিক, ওরা তা বানিয়ে বলেছে?
শাহ করিম : হাসতে হাসতে তিনি বলেন-হ্যাঁ, বানিয়ে লিখেছে। আসল কথা হলো-তারা কিছু কথা আমার কাছ থেকে নিয়েছে, বাকি তারা বানিয়ে ফেলেছে। (তিনি আবার শব্দ করে হাসেন)
মবনু : যাই হোক, ব্যক্তিগত বিষয়ে আসি। বর্তমানে আপনার সময় কীভাবে যাচ্ছে?
শাহ করিম : সময় আল্লাহ যেমন চাচ্ছেন তেমন চলছে।
মবনু : শোননাম লন্ডন যাচ্ছেন।
শাহ করিম : লন্ডন যেতে পারি। অন্য কোথাও যেতে পারি, আল্লাহ যেখানে ইচ্ছা সেখানে নেবেন।
মবনু : আব্দুর রহমান চাচা বললেন, তিনি এবং আপনি লন্ডন যাচ্ছেন?
শাহ করিম : হ্যাঁ, আব্দুর রহমান সাহেব আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন এবং মত করছিলেন যাবেন, আমিও যাবো। অতঃপর তিনিও যাননি, আমিও যাইনি। আমি গেলে তিনিকে নিয়ে যেতাম এবং তিনি গেলে আমাকে নিয়ে যেতেন।
মবনু : শরীরের অবস্থা কেমন?
শাহ করিম : দুর্বল।
মবনু : আগামী দিনের প্রজন্মের প্রতি আপনার কোনো অসিহত-নসিহত।
শাহ করিম : থাকবে-ই তো, তাদের প্রতি কিছু অসিহত-নসিহত থাকবেই। আমার মুর্শিদের, আমার বাপের অসিহত-নসিহত যেমন আমার উপর আছে তেমনি আমার ছেলের উপর, আমার শিষ্যের উপর আমার কিছু থাকবেই।
মবনু : শিষ্য ছাড়াও আমারা যারা ভক্ত আছি তাদের সম্পর্কে?
শাহ করিম : ভক্তরা এক প্রকারের শিষ্য।
মবনু : তা হলে কষ্ট করে বলুন সবার জন্য কিছু কথা?
শাহ করিম বেশ কিছু সময় চিন্তায় হারিয়ে গেলেন। হয়তো ভাবছেন বিশেষ কিছু। আমি তাকে জিজ্ঞাস করলাম-কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে কি?
শাহ করিম : না, কষ্ট হচ্ছে না, অসিহত-নসিহত এতটুকুই আমরা যে যতটুকু বুঝি তা যেনো অন্যকে বুঝানোর চেষ্টা করি।
মবনু : আপনার গান বর্তমানে অনেকগুলো সুরে প্রচার হচ্ছে। আপনার নিজস্ব সুর ও কেউ কেউ বাদ দিয়ে গেয়ে যাচ্ছেন, আপনি শোনেছেন কি-না?
শাহ করিম : শোনেছি।
মবনু : কেমন লাগে আপনার কাছে।
শাহ করিম : যারা যেমন খুশি গাইতে থাকুক। আমার কোনো আপত্তি নেই।
‘বাবার কথা হলো’ বলে নূর জালাল এসে প্রবেশ করেন কথার ফাঁকে। তিনি বলতে থাকেন-- বাবার গান হলো কথা প্রধান। বাবার কথা হলো, কথা ঠিক রেখে যে সুর দিয়ে যে কেউ তার ইচ্ছে মতো যেটা মানুষ গ্রহণ করে করুক। তবে কথা যেন না পাল্টায়। তারা তো অনেকে কথাকে পাল্টিয়ে ফেলে, নাম বাদ দিয়ে দেয়, নাম বলে না, বাবার কথা হলো যে কোনোভাবে গাউক আমার কথা যেনো ঠিক থাকে, গানের ব্যাপারে বাবার এটাই মত।
মবনু : আপনাকে কি তারা কোনো রয়েলিটি দিয়ে থাকে, যারা গানগুলো বিভিন্ন স্থানে গেয়ে থাকে?
শাহ করিম : আমাকে কি দেবে, আমি গান দিয়েছি, আমরাই তো তাদেরকে দেওয়ার কথা। সে আমার গান গেয়ে জনতার কাছে প্রচার করছে। আমি তাদেরকে পুরস্কার দেওয়ার কথা।
মবনু : তারা তো এই গান দিয়ে ব্যবসা করছে, উচিত ছিলো আপনাকে রয়েলিটি দেওয়া।
শাহ করিম : আচ্ছা, ব্যবসাই করুক। (তিনি হাসেন)
নূর জালাল : দেয় বাবা, অনেকেই দেয়। এটা নিয়ম দেওয়া। রেডিও-তে যারা গান গায় সেখানে একটা গানে পাঁচ টাকা কেটে রাখা হয় সরকারিভাবে। যেমন সাউন্ড মিশিন একটা ক্যাসেট করেছে আমাদের অনুমতি নিয়ে। তারা আমাদেরকে প্রায় ত্রিশ-চলি¬শ হাজার টাকা দিয়েছে। আপনি গীতিকার হিসেবে এটা নিয়ম, আমাদেরকে টাকা দেওয়া। যে শিল্পীরা গায়, তারা যদি আমাদের হক্ব অনুযায়ী কিছু কিছু দিতো তবে আমাদের অর্থনৈতিক অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো।
মবনু : আপনাদের পারিবারে অর্থনৈতিক অনেক সমস্যা আছে, নূরজালাল ভাই তো আর কাজেও নয়। তিনি আপনার খেদমতে আছেন। টাকা পয়সার প্রয়োজন আছে না, পৃথিবীতে তো কিছুই টাকা ছাড়া হয় না। আপনার মতো সবাই তো আর দরবেশী জীবন কাটাতে পারবে না। এটার জন্য টাকার প্রয়োজন। আপনি যদি এভাবে বলেন যে, দিলে দেউক-নাইলে না, তবে চলবে কীভাবে?
নূর জালাল : বাবা যে সময়ের মানুষ সেই সময়ের মতো কথা বলছেন। ইদানিং কিছু দিন যাবৎ এই অবস্থা এসেছে যে, রয়েলিটি দিতে হয়। এরপূর্বে বাবা কেনো, আরও যত আছেন বাউল, তারা কেউই রয়েলিটির কথা ভাবতে পারেননি। তারা অনেকে জানতেনও না, বুঝতেনও না। তারা মনে করতেন, ওরা যে আমার গান গাচ্ছে-তাই ভালো। বাবাতো বলতে বলতে এমনও উদার কথা বলেন যে, তারা করিমের বদলে রহীম বললেও আমার কোনো আপত্তি নেই। বাবাতো সাগর।
মবনু : সেদিন গিয়েছিলাম ছেলে-মেয়ে-বউসহ ঢাকার নন্দন পার্কে। ভেতরে গিয়েই শোনলাম আপনার গান চলছে ক্যাসেটে। আমার ছেলে-মেয়েরা আপনাকে আমাদের বাসায় তো অনেক দেখেছে। আমি তাদেরকে আপনার গানের কথা শোনালাম। তারা খুব মন দিয়ে শোনলো। আমরা আরও অনেক জায়গায় দেখেছি, এখন আপনার গানের ব্যবসা জমজমাট। আমার প্রশ্ন হলো আপনি তার বিনিময়ে কি পাচ্ছেন?
নূর জালাল : এই যে ক্যাসেট (এম. কাওসারের ক্যাসেট) তার নামই আপনার গান দিয়ে-বসন্ত। এখানে আপনার ছবি দেখেই অনেক ভক্ত এই ক্যাসেট খরিদ করে নিবে। যে শিল্পী গেয়েছেন তিনি কিন্তু টাকা নিয়ে গেয়েছেন। যারা তা বের করেছে তারা কিন্তু ব্যবসা করছে। নিয়ম গীতিকারকেও একটা সম্মানী দেওয়া। এটার উপর যদি আমি এখন মামলা করি তবে তা বন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের অনুমতি নিয়ে গান গাওয়া উচিত ছিলো। যারা এমনি গায় তাদের কাছে আমাদের কোনো দাবি নেই। কিন্তু যারা টাকা পাচ্ছে তাদের উচিত আমাদেরকে রয়েলিটি দেওয়া।
মবনু : চাচা, আপনার কি মত এ ব্যাপারে?
শাহ করিম : (হাসেন) আমার আবার মত কী? আমি তো বাজারে ছেড়ে দিয়েছি। এটাকে আপনি গাইবেন খুব সুন্দর করে, আরেকজনে গাইবে বেসুন্দর করে, আরেকজন গাইবে শুদ্ধতা করে, আকেরজনে গাইবে সত্য-মিথ্যা লাগিয়ে, আমি কিতা তারার লগে খাইজ্জা করতামনি?
মবনু : খাইজ্জা করার কথা বলছি না, কিন্তু আইনের ব্যাপরটা?
শাহ করিম : আইন আমি কার বাড়িতে গিয়ে কি খাটাবো? আমার গান যে গাইবে সে গান বুঝে। বুঝে যদি কেউ গায় এবং অন্য দু-জন শোনে যদি সন্তুষ্ট হয়, তবে সে আমার গান গাইবে।
মবনু : আপনি গান কোন উদ্দেশ্যে লিখেছেন, আপনার উদ্দেশ্য কী মানুষের গাওয়াটা?
শাহ করিম : আসলে আমি মূলত নিজে গাওয়ার জন্য গান লিখেছিলাম।
মবনু : আপনি নিজে গাওয়ার জন্য?
শাহ করিম : আমি গাইলে যদি আপনি শোনে একটা গেয়ে ফেলেন, ওনিও একটা গেয়ে ফেললেন, মোটকথা সবাই যদি গায় তবে ভালো। আমি তো সবাই গাওয়ার জন্য লিখেছি।
মবনু : তা হলে আপনার কোনো দাবি নেই?
শাহ করিম : না, আমার কোনো দাবি নেই।
নূর জালাল : আমি একটু কথা বলি বাবা, বাবা তো সত্যই বাদশা, সম্রাট, ঠিক না-তিনি সম্রাট? কিন্তু বাবার সৃষ্টিটা বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমার টাকার প্রয়োজন। আমার খুব ইচ্ছে ছিলো শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্র একটা প্রকাশের। আমি শাহ আব্দুল করিম স্মৃতি সংসদ করার বিষয়েও চিন্তা করছি। বাড়িতে আছে একটা শাহ আব্দুল করিম সঙ্গীতালয়, এটার অনেক কাজ অসমাপ্ত অবস্থায় আছে। এখানে বি-বাড়িয়া, ময়মনসিংহ এবং ভাটি এলাকা থেকে অনেক লোক আসে গান শিখতে। কিন্তু আমি তাদের জন্য কোনো সুব্যবস্থা করতে পারছি না। একটু সুব্যবস্থা করতে পারলে অনেক ছাত্র আসতো এবং এখান থেকে গান শিখে শুদ্ধ সুরে প্রচার করতো। অনেক শিল্পীই বাবার গান গাচ্ছে ভুল।
শাহ করিম প্রায়ই আসেন আমাদের বাসায়। আমার বড়চাচা সৈয়দ আব্দুর রহমানের সাথে তাঁর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। এই সূত্রে আমি খুব ছোটবেলা থেকে তাঁকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। আমাদের বাসায় রহমান চাচা ছাড়া শাহ আব্দুল করিমের মূল্য আর কারো কাছে তেমন ছিলো না। রহমান চাচার মতে--‘শাহ আব্দুল করিম সাক্ষাৎ আল্লাহর খাস লোক’, যাকে আমরা আল্লাহর ওলী বলে থাকি। তাঁর যুক্তি হলো-- ‘আল্লাহর সাথে খাস সম্পর্ক না থাকলে করিম শাহ এতো উচুঁ মার্গের আধ্যাত্মিক গান রচনা করতে পারতেন না। তা ছাড়া শাহ আব্দুল করিমের সম্পদের লোভ, খ্যাতির মোহ এবং হিংসা-বিদ্ধেষ নেই।’ বেশ আগে সিলেট থেকে প্রকাশিত ‘খোয়াব’ লিটলম্যাগে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়, যা পাঠকদের একটি গ্র“পকে কিছুটা ক্ষুব্ধ করে দেয়। কোনো কোনো ভক্ত মনঃক্ষুণœ হলেন। সিলেটের লেখক-সাহিত্যিকদের একটি গ্র“প ১৪০৭ বাংলার পহেলা বৈশাখ নববর্ষ উদযাপনে শহর থেকে দূরে-ঐতিহ্যবাহী সৈয়দপুর গ্রামে যাবে। উৎসব হবে মরমী কবি পির মজির উদ্দিনের বাড়িতে। তাই অনেকের প্রস্তাব একজন বাউল বা মরমী গায়ক সাথে নিলে ভালো হয়। আমি শাহ আব্দুল করিমের নাম প্রস্তাব করলাম। সবাই একবাক্যে আনন্দ প্রকাশ করলেও কেউ কেউ ‘খোয়াব’ এর সাক্ষাতকারের কথা উপস্থাপন করেন। আমি কিছুটা সত্য-মিথ্যা নিয়ে বিভ্রান্ত হলাম। স্মরণহলো আল্লামা ইকবালের কথা। ইকবাল শেকওয়া লিখলে ভারতবর্ষের একদল আলেম তাকে কাফের ফতোয়া দিলেন। কিন্তু দারুল উলূম দেওবন্দের শায়খুল হাদিস মাওলানা আনোয়ার শাহ কাশমীরী এই ফতোয়ায় স্বাক্ষর না দিয়ে সোজা লাহোরে এসে ইকবালের বাড়িতে মেহমান হলেন। ইকবালের সাথে শেকওয়া নিয়ে আলোচনা করলেন। স্বয়ং ইকবাল নিজে জোয়াবে শেকওয়া লিখলেন। কাদিয়ানীদের প্রতি ইকবালের কিছুটা দুর্বলতা ছিলো। আল্লাহমা আনোয়ার শাহ কাশমীরীর সংস্পর্শে আল্লামা ইকবাল সঠিক ভাবে কাদিয়ানীদের স্বরূপ উন্মোচন করতে সক্ষম হলেন। মুসলমানদের মধ্য থেকে ইকবাল সম্পর্কে ভুল বুঝাবুঝির অবসান হলো। ইকবাল ছিলেন কবি সম্রাট-বিশ্বকবি। শাহ আব্দুল করিম লেখাপড়া না জেনেও বাউল সম্রাট-স্বভাব কবি। তাই ভাবলাম শাহ আব্দুল করিমের সাথে তা নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন। বৃষ্টিঝড়া এক সকালের কথা। বাতাসে হালকা শীত। আমাদের শাহী ঈদগাস্থ বাসায় শাহ আব্দুল করিম বসে আছেন। চা-নাস্তা পর্ব আগেই শেষ। আমি গিয়ে বসি পাশাপাশি। জানতে চাই-- চাচা কেমন আছেন?
শাহ করিম: আল্লাহর মনশা।
মবনু: আপনার সাথে কিছু কথা বলতে চাই?
শাহ করিম : বলুন।
মবনু : কিছুদিন আগে ‘খোয়াব’ লিটল ম্যাগ ওয়ালারা আপনার সাক্ষাৎকার নিয়ে তৃতীয় সংখ্যায় প্রকাশ করেছে। আমার কথাগুলো সেই সাক্ষাৎকারের গর্ভ থেকেই জন্ম। আপনি স্বীকার করেছেন রাখাল থেকে গায়ক হওয়ার কথা। গানের পথে আসতে গিয়ে কিভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছেন?
শাহ করিম : আমার এক দাদা ছিলেন। নাম তাঁর নসিবুল্লাহ। জীবনে শাদী করেননি। আমার একটা গান আছে-
জন্ম নিয়ে একজনের সান্নিধ্য পাইলাম
পিতামহের ছোট ভাই নসিবুল্লাহ নাম
ফকির ছিলেন, করতেন সদা আল্লাহরজিকির
ফকিরী বিনে ছিলো না অন্য ফিকির
আসতনে কাছে ফকির সাধু হিন্দু-মুসলমান
লাউ বাজাইয়া গাইতেন তখন ভক্তিমূলক গান
গানের একটি কলি আমার আজো মনে পরে
‘ভাবিয়া দেখ মাটির সারিন্দারে বাজায় কোন জনে’।
এই কলিটাই আমার জীবনের প্রথম মনে চিত্র অঙ্কন করে। দাদা মারা গেলেন। তারপর এই কলি থেকে আমার উৎপত্তি। আরেকজন ছিলেন করম উদ্দিন। সম্পর্কে নানা। আমার মায়ের মামা। তিনি দুতারা বাজিয়ে গান গাইতেন। তাঁর পাশে বসে আমিও গাইতাম। এই থেকেই আমার আরম্ভ। তারপর আমি গান শিখতে নেত্রকোনায় রশিদ উদ্দিন সাধকের কাছে যাই। উদ্দেশ্য তাঁর সামনে কিছু সামনে গান গাওয়া। এভাবেই আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি।
মবনু : প্রত্যেক শিল্পীর প্রেরণার কিছু কিংবা একটি উৎস থাকে। আপনার সেই উৎস কি?
শাহ করিম : আমারও উৎস আছে। আমি তো গানে আমার নিজের কথা বলি। তাই আমার মতো মানুষ যারা ওদের কথা আমার গানে এসে যায়। আমি শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলি। আমরা এই সমাজের শোষিত, বঞ্চিত, নির্যাতীত মানুষ। আমরা দুঃখ-কষ্টে আছি। আমার কথা বলতে গিয়েই এই শ্রেণীর সবার কথা এসে যায়। এটা-ই আমার গানের উৎস।
মবনু : ‘খোয়াব’ লিটল ম্যাগের তৃতীয় সংখ্যায় এক প্রশ্নের উত্তরে আপনি নিজ স্ত্রী আপ্তাবুন্নেসাকে মুর্শিদ বলে সম্বোধন করেছেন, কারণ ব্যাখ্যা করবেন কি?
শাহ করিম : ওনি এমন এক লোক যাকে আমার সঙ্গীনী না পেলে আমি করিম হতে পারতাম না। তিনি যে ধৈর্য্যসহকারে আমার সেবা যতœ করেছেন তা বলার মতো নয়। আমি বছরে এগারো মাসই বাড়িতে থাকতাম না। এই সময় তিনি অর্ধাহার-অনাহারে থেকেও জীবনে কোনদিন বিরক্তি প্রকাশ করেননি। তাই তাকে মুর্শিদ সম্বোধন করেছি এবং আমার আপ্তাব সঙ্গীত গ্রন্থটি তারই নামানুসারে নামকরণ করেছি।
মবনু : আপনাদের বিয়ে কি প্রেম ঘটিত?
শাহ করিম : না, না। প্রেম ঘটিত নয়। আমাদের বিয়ে পারিবারিক।
মবনু : ‘খোয়াব’ এর অন্য এক প্রশ্নের উত্তরে আপনি বলেছেন, ‘আসমানী খোদা কে মানি না’ তাহলে আপনি কি নাস্তিক?
শাহ করিম : না, আমি নাস্তিক নই। আমি বলেছি আকাশে নয়, পাতালে নয়, খোদা মানুষের অন্তরে। রাসুল (সা.) বলেছেন- ‘কুলুবুল মু’মিনিনা আসিল¬াহী তা’য়ালা।’
আল¬াহ ও যে বলেছেন, নাহনু আকরাবু ইলাইহী মিন হাবলিল ওয়ারিদ।
তাই আমি বিশ্বাস করি আল্লাহ আমার শাহ রগ থেকে আরো কাছে। আকাশে খোদা এতো দূর আমি মনে করি না। আমি খোদাকে কাছে বিশ্বাস করি। আমি বলেছিলাম আকাশে খোদা মানি না। ওরা অর্থ উঠিয়েছে আকাশের খোদা মানি না।
মবনু : আরেক প্রশ্নের উত্তরে দেখলাম আপনি বেহেস্ত, দোজখ, দু’কান্ধের ফেরেস্তা অস্বীকার করছেন। অথচ পবিত্র কুরআন-হাদিসের দ্বারা এগুলো সত্য বলে প্রমাণিত। আপনি কি কোরআন-হাদিস মানেন না?
শাহ করিম : দেখো কোরআন আল্লাহর বাণী তা আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু তার অপব্যাখ্যা কিংবা সুবিধাবাদী ব্যাখ্যা আমি মানি না। বেহেস্ত-দোজখতো দুনিয়াতেই আছে। যারা দুঃখী তারা কষ্ট পাচ্ছে। আর যারা সুখী তারা বেহেস্তের মতো আছে। পরকালেও বেহেস্ত-দোজখ আছে তা আমি বিশ্বাস করি। যারা আল্লাহ-রাসুলের প্রতি বিশ্বাস রেখে সুকাজ করে তারা পরকালে বেহেস্তে যাবে। এবং যারা মন্দকাজ করে তারা দোজখে যাবে। এটাই আমার বিশ্বাস।
মবনু : আপনাকে অনেকে বাম, নাস্তিক বা কমিউনিস্ট করতে চায়। এ সম্পর্কে আপনার প্রতিক্রিয়া কি?
শাহ করিম : তারা যাই বলেন, আমি কিন্তু নাস্তিক নই। আমি আল্লাহ বিশ্বাসী এবং সর্বদা প্রার্থনা করি আমার শেষ নিঃশ্বাস যেনো ত্যাগ হয় আল্লাহ আল্লাহ বলে। এটাই আমার শেষ কথা। তারা আমায় নাস্তিক কিংবা যাই বলুক। আমি যে শোষণের বিরুদ্ধে বলি তাই অনেকে ভাবে কমিউনিস্ট। আমি কমিউনিস্ট বা নাস্তিক নয়। আমি আমার প্রভুর বিশ্বাসী। যারা আমাদের উপর অন্যায় করে আমি তাদের বিরুদ্ধে বলি। এটা আমার চরিত্র। এটা ইসলামের বৈশিষ্ট্য।
মবনু : আপনি ‘খোয়াব’ এর অন্য এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন-‘আমার দীর্ঘ জীবনে রকীব শাহ নামের কোনো ফকিরের গান তো দূরের কথা নাম পর্যন্ত কানে আসেনি। হঠাৎ রেডিও টেলিভিশনে তার গান শোনে বিস্মিত হই।’ আমাদের প্রশ্ন আজ যেসব গান রকিব শাহ-এর বলে প্রচারিত তা কি অন্যকারো?
শাহ করিম : হতে পারে এগুলো রকীব শাহ এর। কিন্তু আমার জীবনে সৈয়দ শাহনূর, শিতালং শাহ, আরকুম শাহ, জালাল উদ্দিন, লালন শাহ, রাধারমন, হাসন রাজা প্রমুখের গান ছোট বেলা থেকেই গেয়ে এবং শোনে আসলেও রকীব শাহ-এর কোন গান পাইনি, শোনিনি, গাইনি। রকীব শাহ হতে পারেন মহাজন, ফকীর কিংবা পীর কিন্তু আমি আমার দীর্ঘ জীবনে তাঁর কোনো গান পাইনি-গাইনি এবং কাউকে গাইতেও শোনিনি। এই কিছু দিন থেকে শোনা যাচ্ছে রকীব শাহ নামক একজন লেখক ছিলেন, তাঁর প্রচুর গান রয়েছে এবং সেগুলো তার বিত্তশালী ছেলে প্রচার করতেছেন। আমি কিন্তু তাকে অমান্য করছি না। তবে আমরা পাইনি তাঁর গান।
মবনু : সৈয়দপুরের মরমী কবি পীর মজীর উদ্দিন সম্পর্কে আপনার কোন ধারণা আছে কি?
শাহ করিম : ওনির সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। তাঁর কথাবার্তা শোনেছি। তার প্রতি আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধা আছে। আমার দিরাইতেও তাঁর প্রচুর শিষ্যভক্ত রয়েছেন। দিরাই হয়ে তিনি ময়মনসিংহ পর্যন্ত যেতেন। দিরাইতে আমার এক শিষ্য ছিল ‘তখবুল’ তার নাম। তখবুলের বাপ-দাদা সবাই তিনির শিষ্য ছিলেন। তখবুলরা খুব গরীব লোক হলেও তাদেরকে তিনি খুব স্নেহ করতেন। সেই বাড়িতে আমি তাকে দেখেছি। তিনি আমায় খুব স্নেহ করতেন। প্রতি বর্ষাকালে তিনি দিরাই হয়ে ময়মনসিংহ যেতেন। দিরাইতে তাঁর সাথে প্রায়ই দেখা হতো।
মবনু : সিলেটে আপনার প্রিয় বাউল বা মরমী কবি কারা?
শাহ করিম : অনেক আছেন। যেমন মনে করেন মরমী কবিদের মধ্যে আরকুম শাহ, সৈয়দ শাহনুর, শিতালং শাহ। আর বাউলদের মধ্যে হাসন রাজা, কালাশাহ, সৈয়দ ইসাক শাহ প্রমুখ। ওদের গান পেয়েছি এবং গেয়েছি। রকীব শাহ-এর পাইনি এবং গাইনি।
মবনু : বাউল-মরমী-মালজুরার মধ্যে ব্যবধান কি?
শাহ করিম : বাউল হলো এই যে আমরা রাই-শ্যাম ইত্যাদি নিয়ে গেয়ে থাকি। মরমী হলো ভক্তিমূলক ভাবে মনের কথা গানের ভাষায় প্রকাশ। আর মালজুরা হলো একটি বিষয় নিয়ে প্রশ্ন-উত্তরের মাধ্যমে গান গাওয়া।
মবনু : আপনার জীবনে সব চাইতে আশ্চর্যজনক ঘটনা কি?
শাহ করিম : জীবনের একেক অবস্থায় একেকটি আশ্চর্যজনক ঘটনা। বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রতিটি ঘটনাই আশ্চর্যজনক। রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজ নীতি সব ব্যাপারেই আশ্চর্য হতে হয়।
মবনু : তা হলে বলুন সব চাইতে আনন্দদায়ক ঘটনা?
শাহ করিম : (একটু হাসলেন) আমরা আনন্দ গান গেয়েই পেয়ে থাকি। তাছাড়া যারা মানুষের সেবা করে তাদেরকে দেখলে আমি আনন্দ পাই।
মবনু : দুঃখজনক ঘটনা?
শাহ করিম : মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখা হচ্ছে না। মানুষ তার প্রকৃত মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মানুষের আজ এই সমাজে বেঁচে থাকার অধিকার নেই। জান-মাল-ইজ্জতের নিরাপত্তা নেই। এগুলো দেখলেই দুঃখ পাই।
মবনু : আধুনিক গান ও কবিতা সম্পর্কে আপনার ধারণা কি?
শাহ করিম : আধুনিকতা আমি তেমন বুঝি না। দেখুন রবীন্দ্রনাথ যদি বিশ্বকবিও হয়ে যান কিন্তু এদেশের সাধারণ মানুষ তার গান বুঝে না। কিন্তু লালন-হাসন রাজার গানে আমরা খুব আনন্দ পাই। আমি মনে করি রবীন্দ্রনাথের গান যদি খুব ভালোও হয় তবু আমাদের সাধারণ মানুষের মন স্পর্শ করে না। হতে পারে তা আমাদের না বুঝার কারণে। তবে যা বুঝি না বা মন স্পর্শ করে না, তা নিয়ে আমাদের সুখ-দুঃখের কি আছে? কবিতার ক্ষেত্রেও একই কথা।
মবনু : আপনি কোনো আধুনিক গান পড়েছেন বা গেয়েছেন?
শাহ করিম : আমি তো লেখা পড়া করিনি। বৃটিশ সময়ে আমাদের অঞ্চলে নাইট স্কুল হয়েছিলো। আমি তখন গরু-রাখালী করতাম। একজন আমায় সেই স্কুলের কথা বললে আমি ভর্তি হই। কিন্তু লোকের ধারণা যখন জন্ম নিলো নাইট স্কুলে পড়লে বৃটিশ সৈন্যদের সাথে গিয়ে জার্মানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে তখন ছাত্ররা পালাতে লাগলো। ফলে নাইট স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে সামান্য লেখাপড়া শিখেছি। তাই আধুনিক কবিতা বা গান আমার হৃদয় স্পর্শ করে না। তা ছাড়া আধুনিকতার লালনকারীরা মানুষকে মানুষের মতো করে দেখতে পারে না। ওরা সব কিছুকে বস্তুর মতো দেখে। কিছু দিন আগে বাংলাদেশ টেলিভিশনে আমার একটি গান দিয়েছে। একজন লোকের মাধ্যমে হুমায়ূন আহমদ আমাকে নিয়েছিলেন। আমার গান রেকর্ড হলো। অথচ হুমায়ূন আহমদ আমাকে দেখা দিলেন না। তিনি আমায় মানুষ হিসেবেই গণ্য করলেন না। আমাকে সামান্য টাকা দিয়ে একজন লোক বললোÑস্যার এখন দেখা করতে পারবে না। আমি কি তার কাছে টাকার জন্য গিয়েছিলাম। আব্দুল করিম টাকার জন্য গান গায় না। আব্দুল করিম টেলিভিশনে গান গাওয়ার জন্যও প্রত্যাশী নয়। আব্দুল করিম গরীব হতে পারে কিন্তু আত্মমর্যাদাহীন নয়। ছিঃ ছিঃ আধুনিকতা। যেখানে মানুষের কোন মূল্য নেই সেখানে আব্দুল করিম ও নেই।
মবনু : ধন্যবাদ আপনি আমায় কিছু সময় দেয়ার জন্য।
শাহ করিম : তোমাকেও ধন্যবাদ।
...... ........
কিছুদিন আগে সুনামগঞ্জের একটি ছেলে আমার কাছে বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম সম্পর্কে লেখা চাইলে ‘আমি নাস্তিক নই’ শিরোনামের লেখাটি তাকে দিয়ে ছিলাম। আমার এক বন্ধু শাহেদ হোসেন, যার গ্রামের বাড়ি করিম সাহেবের গ্রামে, সে একদিন আমাকে এসে জানালো, ঐ ছেলে নাকি তাকে বলেছেÑ‘আমি নাস্তিক নই’ এ কথা বাদ না দিলে লেখাটা তার স্মারকে যাচ্ছে না। আমি স্পষ্ট বলে দিলাম, না গেলে নাই। পরে ঐ ছেলেটি একদিন আমার সাথে দেখা করে বললো- তার গুরুরা নাকি বলেছেন ‘আমি নাস্তিক নই’ শিরোনামে লেখা যাবে না। তাদের কথা হলো শাহ আব্দুল করিম এমন কথা বলতে পারেন না। তাই যদি আমি এই বাক্যটি কেটে দেই, তিনি কৃতজ্ঞ হবেন। আমি তাকে জানিয়ে দিলাম-- আমি কাউকে খুশি করার জন্য লেখালেখি করি না। শাহ করিম যে নাস্তিক নয়, এটাতো প্রকাশিত এবং সত্য কথা, আমি কাটতে পারবো না। সে জানালো যারা তার সাইবোর্ডের পিছনে দাঁড়িয়ে তার স্মারকের জন্য কাজ করছেন তারা ‘আমি নাস্তিক নই’ কথা মেনে নিতে পারছেন না। আমি ছেলেটিকে বললাম-- করিম চাচা তো এখনো বেঁচে আছেন, তোমরা যাও, তাঁর কাছ থেকে জেনে নাওÑতিনি নাস্তিক কি না? সে আমায় জানালো-তারা গিয়েছিলো। করিম চাচা তাদেরকে ধমক দিয়েছেন। তার মন্তব্য হলো-করিম সাহেবের এখন ‘হুশ-বুদ্ধি জায়গায় নেই’। আমি আর প্রতিবাদ করিনি। গত ৬ জুন ০৭ শাহ আব্দুল করিম সিলেট আসলে প্রথমে দু-রাত আমাদের বাসায় থাকেন। আমার ক্যাসেট রেকর্ডার সাথে না থাকায় আমি করিম চাচার সাথে এ বিষয়টি আলোচনায় যাইনি। আমাদের বাসায় দু-দিন থেকে করিম চাচা ‘ইসলামপুর চলে যান। ৮ জুন সন্ধ্যায় ক্যাসেট রেকর্ডার সাথে নিয়ে আমি আর তরুণ কণ্ঠশিল্পী এম. কাওসার ইসলামপুরে শাহ আব্দুল করিমের সাথে দেখা করি। দীর্ঘ কথা হয়। কথাটা প্রথমে শুরু করে দেন বাবুল ভাই, অর্থাৎ করিম চাচার একমাত্র ছেলে নূর জালাল।
নূর জালাল: বাবা, বেশ কিছুদিন আগে সিলেট থেকে একটা ম্যাগাজিন বেরিয়েছিলো, এতে বিভিন্ন কথা এনেছে যে, আপনি আল্লাহ মানেন না, রাসুল মানেন না, বেহেস্ত দোজখ মানেন না-এই সেই নানা হাবিজাবি?
মবনু: এটা নূর জালার ভাইও দেখেছেন যে, একটি ম্যাগাজিন তা লিখেছে। এই বিষয় নিয়ে আপনার সাথে আমার আগে একবার আলোচনা হয়েছে, আমি দেখেছি যে, আপনি গানের মধ্যেও বারবার আল্লাহ রাসুলের কথা বলেছেন। আধ্যাত্মিক অনেক বিষয় আপনার গানে স্পষ্ট এসেছে।
শাহ করি : (হাসেন, শব্দ করেই হাসেন) আল্লাহ-রাসুলের কথা না বলে আপনি পির সাহেব, চুর সাহেব, ডাকাত সাহেব, মোটকথা কিছুই হতে পারবেন না। আপনি আল্লাহর পক্ষে, রাসুলের পক্ষে, আশিকের পক্ষে, বুজুর্গানের পক্ষে কথা বলতে হবে, বুঝতে হবে এবং নিজে মানতেও হবে। অন্যজন মানুক কিংবা নাই মানুক-আপনাকে অবশ্যই মানতে হবে। আমাকেও অবশ্যই মানতে হবে।
মবনু : খোয়াব নামক ম্যাগাজিনে যে তারা লিখলো, নূর জালাল ভাইয়ের ভাষ্যমতে তিনিও ছিলেন যখন তারা সাক্ষাৎকার নিয়েছে, তার বক্তব্য হলো আপনি এমন কোনো কথা বলেননি। তারা তাদের মনের ইচ্ছে মতো এ কথাগুলো তৈরি করেছে। আমি এই কথাগুলোর প্রতিবাদ করেছিলাম ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে আপনার সাক্ষাৎকার নিয়ে। এই যে আপনার সামনে গ্রন্থখানা, তারা আমার কাছে আপনার সম্পর্কে একটা লেখা চেয়েছিলো, আমি এই লেখাটি দিয়েছিলাম। এই বইয়ের সম্পাদক আমায় বললো, তার আড়ালে যারা বইটির জন্য মূলে কাজ করছেন তারা নাকি বলেছেন-করিম সাহেব এমন কথা বলেননি। আমি তাদেরকে বললাম-তিনি নিজে আমায় এ কথাটি বলেছেন।
শাহ আব্দুল করিম : (শব্দ করে আবার হাসেন) নাস্তিক হয়ে তুমি যাবে কোথায়? নাস্তিক হলে তো তুমি আল্লাহ বিরোধী, রাসুল বিরোধী, ধর্ম বিরোধী হয়ে গেলে। নাস্তিক হইবে না। (শাহ আব্দুর করিম তার অভ্যাস মতো জিকির করেন-ইয়া আল্লাহ, মুর্শিদ, মাওলা)।
মবনু : আমার মনে হচ্ছে আপনি এ কথা বলেননি যে আপনি নাস্তিক, ওরা তা বানিয়ে বলেছে?
শাহ করিম : হাসতে হাসতে তিনি বলেন-হ্যাঁ, বানিয়ে লিখেছে। আসল কথা হলো-তারা কিছু কথা আমার কাছ থেকে নিয়েছে, বাকি তারা বানিয়ে ফেলেছে। (তিনি আবার শব্দ করে হাসেন)
মবনু : যাই হোক, ব্যক্তিগত বিষয়ে আসি। বর্তমানে আপনার সময় কীভাবে যাচ্ছে?
শাহ করিম : সময় আল্লাহ যেমন চাচ্ছেন তেমন চলছে।
মবনু : শোননাম লন্ডন যাচ্ছেন।
শাহ করিম : লন্ডন যেতে পারি। অন্য কোথাও যেতে পারি, আল্লাহ যেখানে ইচ্ছা সেখানে নেবেন।
মবনু : আব্দুর রহমান চাচা বললেন, তিনি এবং আপনি লন্ডন যাচ্ছেন?
শাহ করিম : হ্যাঁ, আব্দুর রহমান সাহেব আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন এবং মত করছিলেন যাবেন, আমিও যাবো। অতঃপর তিনিও যাননি, আমিও যাইনি। আমি গেলে তিনিকে নিয়ে যেতাম এবং তিনি গেলে আমাকে নিয়ে যেতেন।
মবনু : শরীরের অবস্থা কেমন?
শাহ করিম : দুর্বল।
মবনু : আগামী দিনের প্রজন্মের প্রতি আপনার কোনো অসিহত-নসিহত।
শাহ করিম : থাকবে-ই তো, তাদের প্রতি কিছু অসিহত-নসিহত থাকবেই। আমার মুর্শিদের, আমার বাপের অসিহত-নসিহত যেমন আমার উপর আছে তেমনি আমার ছেলের উপর, আমার শিষ্যের উপর আমার কিছু থাকবেই।
মবনু : শিষ্য ছাড়াও আমারা যারা ভক্ত আছি তাদের সম্পর্কে?
শাহ করিম : ভক্তরা এক প্রকারের শিষ্য।
মবনু : তা হলে কষ্ট করে বলুন সবার জন্য কিছু কথা?
শাহ করিম বেশ কিছু সময় চিন্তায় হারিয়ে গেলেন। হয়তো ভাবছেন বিশেষ কিছু। আমি তাকে জিজ্ঞাস করলাম-কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে কি?
শাহ করিম : না, কষ্ট হচ্ছে না, অসিহত-নসিহত এতটুকুই আমরা যে যতটুকু বুঝি তা যেনো অন্যকে বুঝানোর চেষ্টা করি।
মবনু : আপনার গান বর্তমানে অনেকগুলো সুরে প্রচার হচ্ছে। আপনার নিজস্ব সুর ও কেউ কেউ বাদ দিয়ে গেয়ে যাচ্ছেন, আপনি শোনেছেন কি-না?
শাহ করিম : শোনেছি।
মবনু : কেমন লাগে আপনার কাছে।
শাহ করিম : যারা যেমন খুশি গাইতে থাকুক। আমার কোনো আপত্তি নেই।
‘বাবার কথা হলো’ বলে নূর জালাল এসে প্রবেশ করেন কথার ফাঁকে। তিনি বলতে থাকেন-- বাবার গান হলো কথা প্রধান। বাবার কথা হলো, কথা ঠিক রেখে যে সুর দিয়ে যে কেউ তার ইচ্ছে মতো যেটা মানুষ গ্রহণ করে করুক। তবে কথা যেন না পাল্টায়। তারা তো অনেকে কথাকে পাল্টিয়ে ফেলে, নাম বাদ দিয়ে দেয়, নাম বলে না, বাবার কথা হলো যে কোনোভাবে গাউক আমার কথা যেনো ঠিক থাকে, গানের ব্যাপারে বাবার এটাই মত।
মবনু : আপনাকে কি তারা কোনো রয়েলিটি দিয়ে থাকে, যারা গানগুলো বিভিন্ন স্থানে গেয়ে থাকে?
শাহ করিম : আমাকে কি দেবে, আমি গান দিয়েছি, আমরাই তো তাদেরকে দেওয়ার কথা। সে আমার গান গেয়ে জনতার কাছে প্রচার করছে। আমি তাদেরকে পুরস্কার দেওয়ার কথা।
মবনু : তারা তো এই গান দিয়ে ব্যবসা করছে, উচিত ছিলো আপনাকে রয়েলিটি দেওয়া।
শাহ করিম : আচ্ছা, ব্যবসাই করুক। (তিনি হাসেন)
নূর জালাল : দেয় বাবা, অনেকেই দেয়। এটা নিয়ম দেওয়া। রেডিও-তে যারা গান গায় সেখানে একটা গানে পাঁচ টাকা কেটে রাখা হয় সরকারিভাবে। যেমন সাউন্ড মিশিন একটা ক্যাসেট করেছে আমাদের অনুমতি নিয়ে। তারা আমাদেরকে প্রায় ত্রিশ-চলি¬শ হাজার টাকা দিয়েছে। আপনি গীতিকার হিসেবে এটা নিয়ম, আমাদেরকে টাকা দেওয়া। যে শিল্পীরা গায়, তারা যদি আমাদের হক্ব অনুযায়ী কিছু কিছু দিতো তবে আমাদের অর্থনৈতিক অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো।
মবনু : আপনাদের পারিবারে অর্থনৈতিক অনেক সমস্যা আছে, নূরজালাল ভাই তো আর কাজেও নয়। তিনি আপনার খেদমতে আছেন। টাকা পয়সার প্রয়োজন আছে না, পৃথিবীতে তো কিছুই টাকা ছাড়া হয় না। আপনার মতো সবাই তো আর দরবেশী জীবন কাটাতে পারবে না। এটার জন্য টাকার প্রয়োজন। আপনি যদি এভাবে বলেন যে, দিলে দেউক-নাইলে না, তবে চলবে কীভাবে?
নূর জালাল : বাবা যে সময়ের মানুষ সেই সময়ের মতো কথা বলছেন। ইদানিং কিছু দিন যাবৎ এই অবস্থা এসেছে যে, রয়েলিটি দিতে হয়। এরপূর্বে বাবা কেনো, আরও যত আছেন বাউল, তারা কেউই রয়েলিটির কথা ভাবতে পারেননি। তারা অনেকে জানতেনও না, বুঝতেনও না। তারা মনে করতেন, ওরা যে আমার গান গাচ্ছে-তাই ভালো। বাবাতো বলতে বলতে এমনও উদার কথা বলেন যে, তারা করিমের বদলে রহীম বললেও আমার কোনো আপত্তি নেই। বাবাতো সাগর।
মবনু : সেদিন গিয়েছিলাম ছেলে-মেয়ে-বউসহ ঢাকার নন্দন পার্কে। ভেতরে গিয়েই শোনলাম আপনার গান চলছে ক্যাসেটে। আমার ছেলে-মেয়েরা আপনাকে আমাদের বাসায় তো অনেক দেখেছে। আমি তাদেরকে আপনার গানের কথা শোনালাম। তারা খুব মন দিয়ে শোনলো। আমরা আরও অনেক জায়গায় দেখেছি, এখন আপনার গানের ব্যবসা জমজমাট। আমার প্রশ্ন হলো আপনি তার বিনিময়ে কি পাচ্ছেন?
নূর জালাল : এই যে ক্যাসেট (এম. কাওসারের ক্যাসেট) তার নামই আপনার গান দিয়ে-বসন্ত। এখানে আপনার ছবি দেখেই অনেক ভক্ত এই ক্যাসেট খরিদ করে নিবে। যে শিল্পী গেয়েছেন তিনি কিন্তু টাকা নিয়ে গেয়েছেন। যারা তা বের করেছে তারা কিন্তু ব্যবসা করছে। নিয়ম গীতিকারকেও একটা সম্মানী দেওয়া। এটার উপর যদি আমি এখন মামলা করি তবে তা বন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের অনুমতি নিয়ে গান গাওয়া উচিত ছিলো। যারা এমনি গায় তাদের কাছে আমাদের কোনো দাবি নেই। কিন্তু যারা টাকা পাচ্ছে তাদের উচিত আমাদেরকে রয়েলিটি দেওয়া।
মবনু : চাচা, আপনার কি মত এ ব্যাপারে?
শাহ করিম : (হাসেন) আমার আবার মত কী? আমি তো বাজারে ছেড়ে দিয়েছি। এটাকে আপনি গাইবেন খুব সুন্দর করে, আরেকজনে গাইবে বেসুন্দর করে, আরেকজন গাইবে শুদ্ধতা করে, আকেরজনে গাইবে সত্য-মিথ্যা লাগিয়ে, আমি কিতা তারার লগে খাইজ্জা করতামনি?
মবনু : খাইজ্জা করার কথা বলছি না, কিন্তু আইনের ব্যাপরটা?
শাহ করিম : আইন আমি কার বাড়িতে গিয়ে কি খাটাবো? আমার গান যে গাইবে সে গান বুঝে। বুঝে যদি কেউ গায় এবং অন্য দু-জন শোনে যদি সন্তুষ্ট হয়, তবে সে আমার গান গাইবে।
মবনু : আপনি গান কোন উদ্দেশ্যে লিখেছেন, আপনার উদ্দেশ্য কী মানুষের গাওয়াটা?
শাহ করিম : আসলে আমি মূলত নিজে গাওয়ার জন্য গান লিখেছিলাম।
মবনু : আপনি নিজে গাওয়ার জন্য?
শাহ করিম : আমি গাইলে যদি আপনি শোনে একটা গেয়ে ফেলেন, ওনিও একটা গেয়ে ফেললেন, মোটকথা সবাই যদি গায় তবে ভালো। আমি তো সবাই গাওয়ার জন্য লিখেছি।
মবনু : তা হলে আপনার কোনো দাবি নেই?
শাহ করিম : না, আমার কোনো দাবি নেই।
নূর জালাল : আমি একটু কথা বলি বাবা, বাবা তো সত্যই বাদশা, সম্রাট, ঠিক না-তিনি সম্রাট? কিন্তু বাবার সৃষ্টিটা বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমার টাকার প্রয়োজন। আমার খুব ইচ্ছে ছিলো শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্র একটা প্রকাশের। আমি শাহ আব্দুল করিম স্মৃতি সংসদ করার বিষয়েও চিন্তা করছি। বাড়িতে আছে একটা শাহ আব্দুল করিম সঙ্গীতালয়, এটার অনেক কাজ অসমাপ্ত অবস্থায় আছে। এখানে বি-বাড়িয়া, ময়মনসিংহ এবং ভাটি এলাকা থেকে অনেক লোক আসে গান শিখতে। কিন্তু আমি তাদের জন্য কোনো সুব্যবস্থা করতে পারছি না। একটু সুব্যবস্থা করতে পারলে অনেক ছাত্র আসতো এবং এখান থেকে গান শিখে শুদ্ধ সুরে প্রচার করতো। অনেক শিল্পীই বাবার গান গাচ্ছে ভুল।
হেমিংওয়ের প্রিয় বই
ওয়াহিদ সুজন
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে (২১ জুলাই, ১৮৯৯ - ২ জুলাই, ১৯৬১) তার ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দি সী’, ‘ফর হুম দ্য বেল টলস’ ও ‘ফেয়ারওয়েল টু আর্মস’-র মতো উপন্যাসের জন্য সমাধিক পরিচিত। আরো বইয়ের জন্য তিনি আছেন বিশ্বের অগণিত বইপ্রেমীর পছন্দের তালিকায়। নোবেলজয়ী হেমিংওয়ে ১৯৩৫ সালে এসকুয়ার ম্যাগাজিনে তার কিছু প্রিয় বইয়ের নাম প্রকাশ করেন। এর মধ্যে অতিপরিচিত ‘আন্না ক্যারেনিনা’, ‘ওয়ার এণ্ড পিস’ ও ‘হাকলবেরি ফিন’-এর মতো বই যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে এমন কিছু বই যা আধুনিক পাঠকদের একদম অজানা।
‘রিমেম্বারিং শুটিং-ফ্লাইং : এ কী ওয়েস্ট লেটার’ শিরোনামের লেখায় তিনি বলেন যদি আবারও বইগুলোর কোন একটি প্রথমবারের মতো পড়ার সুযোগ পান তা হবে বাৎসারিক এক মিলিয়ন ডলার আয়ের মতো।
তালিকার ১৭টি বই হলো
আন্না কারেনিনা – লিও তলস্তয়
ফার আওয়ে অ্যান্ড লং এগো – ডব্লিউ এইচ হাডসন
বাডেনব্রুকস – টমাস মান
ওয়েদারিং হাইটস – এমিলি ব্রন্ট
মাদাম বোভারি – গুস্তাভ ফ্লোবেয়ার
ওয়ার অ্যান্ড পিস- লিও তলস্তয়
আ স্পোর্টস ম্যান স্কেচস – আইভান তুগার্নেভ
দি ব্রাদার্স কারামজভ – ফিওদর দস্তয়ভস্কি
হাইল অ্যান্ড ফেয়ারওয়েল – জর্জ মুর
হাকলবেরি ফিন – মার্ক টোয়েন
উইনসবুর্গ ওহাইও – শেরউড এন্ডারসন
লা রেইনে মার্গট – আলেকজান্দার দ্যুমা
লা মেইসন টলিয়ার – গাই দে মোপাসাঁ
লে রুজ এট নে নায়ার – স্তাদাঁল
লা চার্টেরুজে দে পার্মে- স্তাদাঁল
ডাবলিনার্স – জেমস জয়েস
অটোবায়োগ্রাফিস – ডব্লিউ বি ইয়েস
আগেই বলা হয়েছে তালিকায় থাকা কয়েকটি বই আধুনিক পাঠকদের বড় অংশের কাছে একদম অজানা। কিন্তু লেখক ও লেখনির দিক থেকে বইগুলো খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। যা হেমিংওয়েকে আরো জানতে সাহায্য করে। বুঝিয়ে দেয় তার মনোগটন। সেই সূত্র ধরে নিচে তেমন কিছু বই নিয়ে বলা হল–
যেমন টমাস মানের ‘বাডেনব্রুকস’। ১৯০১ সালে প্রকাশিত বইটির কাহিনিতে উঠে এসেছে উত্তর জার্মানির এক বুজোর্য়া পরিবারের চার প্রজন্মের কথা। তারা আধুনিক পৃথিবীর শুরুর সময়টা মোকাবেলা করছিল। যে সময়ে মানুষের অনিশ্চিত এক গন্তব্য ঠিক হয়ে গেছে। যেখানে পুরানা পরিবারিক বন্ধন ও প্রথাগুলো আস্তে আস্তে আলগা হয়ে আসছে। নোবেলজয়ী জার্মানির এই ঔপন্যাসিক, ছোট গল্পকার, লোকহৈতেষী, সমাজ সমালোচক ও প্রবন্ধকার বইটিতে তার নিজের পরিবারের গল্প বলেছেন।
আইভান তুর্গানেভের ‘আ স্পোর্টসম্যান স্কেচস’ ‘ফ্রম আ হান্টার্স অ্যালবাম’ নামেও পরিচিত। বইটি ১৯৫২ সালে প্রকাশিত হয়। এখানে উল্লেখ করা যায় হেমিংওয়ে নিজেও শিকার ও মাছ ধরতে পছন্দ করতেন। মৎস্যশিকারিদের সাথে তার বন্ধুত্বের প্রতিদান পাওয়া যায় ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী’ বইতে। তুর্গানেভের বইটিতে তার মায়ের এস্টেটে শিকারের অভিজ্ঞতা স্থান পেয়েছে। যেখানে তিনি অারো অনেক কিছু শিখেন। তিনি দেখতে পান রাশিয়ায় কি করে ছোট কৃষকদের জোর-জুলুম করে কাজ করানো হয়। এই ছোটগল্পের সংকলনটি ছাড়াও রাশিয়ান এই ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার ও নাট্যকারের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বই হলো ‘ফাদার্স অ্যান্ড সনস’। এই বইটির জন্য তিনি আধুনিক পাঠকদের কাছে বেশি পরিচিত।
আইরিশ ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, কবি, নাট্যব্যক্তিত্ব ও শিল্পসমালোচক জর্জ মুরের ‘হাইল অ্যান্ড ফেয়ারওয়েল’ বইটি প্রকাশিত হয় ১৯১১ সালে। এটি তার বিখ্যাত তিনখণ্ডের আধা আত্মজৈবনিক রচনা। যেটি আইল্যান্ডের চমকপ্রদ অভিজ্ঞতার বর্ণনার জন্য পরিচিত।
ফরাসি দেশি লেখক আলেকজান্দার দ্যুমা অধিক পরিচিত ‘কাউন্ট অভ মন্টিক্রিস্টো’, ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার’ বা ‘মেন ইন দ্যা আয়রন মাস্ক’-র মতো ইতিহাস নির্ভর উপন্যাসের জন্য। প্রায় অখ্যাত ‘লা রেইনে মার্গট’ প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালে। এই বইটিও ঐতিহাসিক উপাদানের বাইরে নয়। এতে আছে গণগত্যা, ষড়যন্ত্র, গোপন চুক্তি, বিপদজনক পলায়ন ও ডুয়েলসহ উত্তেজনাকর অনেক উপাদান। প্রেক্ষাপটও বরাবরের মতো ষোল শতকের ফ্রান্সের রাজ পরিবার।
ফরাসি দেশি গাই দ্য মোপাসাঁকে ধরা হয় হয় আধুনিক ছোটগল্পের জনক। হেমিংওয়ে তার ‘লা মেইসন টেলিয়র’ বইটি পছন্দ করেন। এটি মূলত বিভিন্ন ধরনের ছোট গল্পের সংকলন। প্রকাশিত হয় ১৮৮১ সালে।
উনিশ শতকের ফরাসি বাস্তববাদী ঘরানার লেখক স্তাদাঁল তার মনোস্তত্ত্ব বিশ্লেষণাত্মক গল্পের জন্য বিখ্যাত। ‘লা চার্টেরুজে দে পার্মে’ প্রকাশিত হয় ১৮৩৯ সালে। এই বইটিতে আছে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ও ইরোটিক দুর্ভাবনার মিশেলে মহাকাব্যিক বয়ান। যা লেখকের নিজের সময়ে পার্মা নামের রাজপুরুষের বিচারালয়ের দীর্ঘ কাল্পনিক বর্ণনা। এছাড়া তার ‘লে রুজ এট নে নায়ার’ বইটিও হেমিংওয়ের পছন্দের তালিকায় রয়েছে।
স্পার্কস
চেতন ভাগত
["থ্রি ইডিয়টস" মুভিটা দেখেন নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। "ফাইভ পয়েন্ট সামওয়ান" নামে যে বইটা থেকে তৈরি হয়েছে এই মুভি, তার লেখক চেতন ভাগত। নিউইয়র্ক টাইমসের ভাষ্যমতে ভারতের ইতিহাসে ইংরেজি ভাষায় লেখা সবচাইতে বেশি বিক্রিত বইয়ের এই লেখক একই সাথে দারুণ একজন বক্তাও বটে! একটা বিজনেস স্কুলের এমবিএ-র ওরিয়েনটেশন অনুষ্ঠানে নতুন ব্যাচের ছাত্রদের জন্য দেয়া তার বক্তৃতার অনুবাদ এটা।]
শুভ সকাল। আমাকে কথা বলার সুযোগ দেয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। আজকের দিনটা তোমাদের নিয়ে; তোমরা, যারা নিজেদের ঘরের স্বাচ্ছন্দ্যের (কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে তার অভাবের) জীবন ছেড়ে জীবনে কিছু না কিছু হবার জন্য এখানে এসেছো। নিশ্চয়ই তোমরা আজ উত্তেজিত। মানুষের জীবনে এমন দিন খুব কমই আসে যখন সে সত্যিকার অর্থেই রোমাঞ্চিত হয়, কলেজের প্রথম দিন তার মাঝে একটি। আজ এখানে আসার আগে তোমরা হয়তো বারবার শিহরিত হচ্ছিলে – অডিটোরিয়ামটা কেমন হবে, টীচাররা কেমন হবেন, ক্লাসমেট কারা হবে…কৌতূহল জাগানোর মত উপকরণের অন্ত নেই। এর নামই রোমাঞ্চ, তোমার ভেতরের সেই স্ফুলিঙ্গ যা আজ তোমাকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে। এই স্ফুলিঙ্গকে কেমন করে জিইয়ে রাখা যায়, তাই নিয়েই আজ কথা বলবো আমি। অন্যভাবে বলতে গেলে, কেমন করে ‘সবসময়’ না হলেও, ‘সবচাইতে’ সুখী হওয়া যায় – তাই নিয়ে।
এই স্ফুলিঙ্গের শুরু কোথায়? আমাদের জন্ম থেকেই – আমার অন্তত তাই ধারণা। আমার তিন বছরের যমজ ছেলেদের মাঝে হাজারো স্ফুলিঙ্গ। সামান্য একটা স্পাইডারম্যানের খেলনা পেয়েই তারা আনন্দে লাফাতে থাকে। পার্কের নড়বড়ে দোলনা কিংবা বাবার মুখের গল্পই যথেষ্ট তাদেরকে খুশি করার জন্য। জন্মদিনের কেক কবে কাটতে পারবে, তার জন্য কয়েক মাস আগ থেকেই ওরা দিন গুণতে শুরু করে।
তোমাদের মত ছেলেমেয়েদের মাঝেও আমি কিছুটা স্ফুলিঙ্গের রেশ পাই। কিন্তু আরেকটু বয়স বাড়লেই, সেই মানুষদের মাঝে এটা খুঁজে পাওয়া কঠিন। এর অর্থ কী দাঁড়াচ্ছে? বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই স্ফুলিঙ্গ ম্লান হয়ে যায়। এমন হলে সে মানুষ একঘেয়ে, বিষণ্ন, উদ্দেশ্যহীন আর তিক্ত হয়ে পড়ে। ‘Jab we met’এর প্রথম আর শেষ অংশে কারিনাকে মনে পড়ে? স্ফুলিঙ্গ ম্লান হয়ে গেলে ঠিক তেমনটাই হয়। এটাকে কীভাবে রক্ষা করা যায়?
স্ফুলিঙ্গটাকে ধরে নাও একটা প্রদীপের শিখার মত। প্রথম কাজ হচ্ছে এতে অনবরত ইন্ধন যোগানো – শিখাটাকে জিইয়ে রাখা। পরবর্তী কাজ – একে ঝড়-ঝঞ্ঝা থেকে বাঁচানো।
স্ফুলিঙ্গ জিইয়ে রাখার জন্য লক্ষ্যস্থির করাটা জরুরি। মানুষের স্বভাবই হচ্ছে চেষ্টা করা, এগিয়ে যাওয়া আর নিজের সবটুকু সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো। এর নামই সাফল্য, সর্বোচ্চ এতখানিই আমাদের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব। সাফল্যের কোন বাহ্যিক মাপকাঠি নেই যেটা চাকরির বেতনভাতা কিংবা কোন বিশেষ গাড়ি অথবা বাড়ি দ্বারা মাপা যাবে।
আমরা বেশিরভাগই এসেছি মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। স্বাভাবিকভাবেই, আমাদের কাছে সাফল্যের প্রথম সংজ্ঞা হল বৈষয়িক লক্ষ্য অর্জন। যখন আমরা বেড়ে উঠেছি এমন পরিস্থিতিতে যেখানে আর্থিক সীমাবদ্ধতা প্রতিদিনকার পাওয়া-না পাওয়াগুলোকে নির্ধারণ করে, অর্থনৈতিক মুক্তি সেখানে অনেক বড় অর্জন। কিন্তু এ অর্জন জীবনের লক্ষ্য হতে পারে না। যদি তাই হত, তবে মি: আম্বানী আর কখনো কাজে আসতেন না। শাহ্রুখ খান অভিনয় ছেড়ে দিয়ে ঘরে বসে থাকতেন। স্টীভ জবস আরো ভাল আইফোন বানানোর জন্য এত চেষ্টা করতেন না, কারণ পিক্সার থেকে তিনি ইতোমধ্যেই কয়েক বিলিয়ন ডলার আয় করে ফেলেছেন। তারা তাহলে এসব কেন করেন? কী সেই কারণ যা তাদের কাজ করতে উৎসাহ দেয়? কারণ এগুলো তাদের আনন্দ দেয়, এসবের মাঝে তারা প্রাণ খুঁজে পান। বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাই ভাল লাগার জন্য যথেষ্ট। প্রচুর পড়াশোনা করলে তোমার ফলাফল ভাল হবে। মানুষের সাথে বেশি মিশলে তুমি ইন্টারভিউতে ভাল করতে পারবে। অনেক অনুশীলন করলে তুমি আরো ভাল ক্রিকেট খেলতে পারবে। তখন যদি এও জানতে পারো যে, তুমি টেন্ডুলকার হতে পারবে না, তবু তুমি এক ধাপ সামনে আগাবে। এই পরবর্তী ধাপের জন্য চেষ্টা করাটা গুরুত্বপূর্ণ।
প্রকৃতির একটা ছকে বাঁধা নিয়মের মাঝে আমাদের জন্ম। সুখী হওয়ার জন্য যা দরকার তা হল এ নিয়মকে মেনে নিয়ে একে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানো। তোমরা কী তাই করছো? লক্ষ্যস্থির করাটা এক্ষেত্রে তোমাদের জন্য জরুরি। কিন্তু শুধু ক্যারিয়ার কিংবা পড়াশোনার জন্য নয়; একটা ভারসাম্যপূর্ণ, সফল জীবনের জন্য লক্ষ্যস্থির করবে। আমি ‘সফল’এর আগে ‘ভারসাম্যপূর্ণ’ কথাটা বললাম। এর অর্থ তোমার স্বাস্থ্য, সম্পর্ক, মানসিক শান্তি – এর সবই যেন ঠিকঠাক থাকে তা নিশ্চিত করা।
তোমার সম্পর্ক ভাঙার দিনে চাকরিতে পদোন্নতি পেলে সেটাকে অর্থহীন মনে হবে। ঠিক যেমন হয় পিঠে ব্যথা নিয়ে গাড়ি চালানোর সময়, কিংবা দুশ্চিন্তাভরা মন নিয়ে শপিং করতে গেলে।
তোমরা হয়তো এমন অনেক উক্তি শুনেছো – জীবন একটা কঠিন প্রতিযোগিতা, এটা একটা ম্যারাথন অথবা এরকম কিছু। আমার চোখে জীবন হল নার্সারী স্কুলের সেই প্রতিযোগিতা, যেখানে চামচে মার্বেল মুখে নিয়ে দৌড়াতে হত। চামচ থেকে মার্বেল পড়ে গেলে দৌড়ে প্রথম হওয়াটা যেমন অর্থহীন, ঠিক তেমনি জীবনে নিজের স্বাস্থ্য আর অন্যদের সাথে সম্পর্ক ঠিক রাখতে পারলে তবেই কেবল তোমার সাফল্যের মূল্য থাকবে। তা না করলে সফল হলেও তোমার মাঝের এই স্ফুলিঙ্গ, এই রোমাঞ্চ আর প্রাণবন্ততা মিইয়ে আসবে।
স্ফুলিঙ্গটাকে জিইয়ে রাখা নিয়ে শেষ কথা – জীবনটাকে সিরিয়াসলি নিও না। আমার এক ইয়োগা টীচার ক্লাসে ছেলেমেয়েদের হাসাতেন। এক ছাত্র তাকে জিজ্ঞেস করলো – এসব কৌতুক আমাদের অনুশীলনের কোন ক্ষতি করবে কিনা। টীচার বললেন – সিরিয়াস হয়ো না, আন্তরিক হও। এই কথাটা তখন থেকে আমার প্রতিটা কাজের পেছনে ভূমিকা রেখেছে – তা আমার লেখা, আমার সম্পর্ক, আমার চাকরি কিংবা অন্য যাই হোক না কেন। আমি প্রতিদিন আমার লেখা নিয়ে হাজারটা মন্তব্য পাই – উচ্ছ্বসিত প্রশংসা থেকে শুরু করে তীব্র সমালোচনা। এর সবই যদি আমি গুরুত্বের সাথে নেই, তবে আমি লিখব কী করে? বাঁচবো কী করে? জীবন সিরিয়াসলি নেয়ার মত কিছু নয়, কারণ এখানে আমরা ক্ষণস্থায়ী। আমরা অনেকটা সীমিত সময়ের প্রিপেইড কার্ডের মত। ভাগ্য ভাল থাকলে আমরা আর বড়জোর ৫০ বছর – মানে মাত্র ২,৫০০ সপ্তাহ বাঁচবো। আমাদের কি আসলেই এত চিন্তিত হবার কিছু আছে? মাঝে মাঝে ক্লাস ফাঁকি দাও, কিছু বাজে ইন্টারভিউ দাও, প্রেমে পড়ো – এর সবই স্বাভাবিক। আমরা মানুষ, প্রোগ্রাম করা যন্ত্র নই।
স্ফুলিঙ্গ জিইয়ে রাখার জন্য আমি তোমাদের তিনটা জিনিসের কথা বললাম – অর্থপূর্ণ লক্ষ্য, ভারসাম্য আর জীবনকে সিরিয়াসলি না নেয়া। কিন্তু জীবনে এমন চারটা ঝড় আসবে যা এই শিখাকে একেবারে নিভিয়ে দিতে চাইবে। হতাশা, ব্যর্থতা, বেইনসাফি আর একাকীত্ব – এগুলোর বিরুদ্ধে সতর্ক থাকাটা জরুরি।
তুমি যখন চেষ্টা করেও কোন কিছু থেকে আশানুরূপ ফল পাবে না, তখনই হতাশা আসবে; যখন সব কিছু তোমার পরিকল্পনামত চলবে না, কিংবা তুমি ব্যর্থ হবে। ব্যর্থতা মোকাবেলা করাটা কঠিন, কিন্তু করতে পারলে সেটা খুব কাজে দেয়। তোমাকে প্রশ্ন করতে হবে, এই ব্যর্থতা আমাকে কী শেখালো? তোমার অসহায় লাগবে। তোমার ইচ্ছে হবে সব ছেড়েছুড়ে দিতে, যেমনটা আমার হয়েছিলো যখন ৯ জন প্রকাশক আমার প্রথম বই প্রকাশ করতে আপত্তি জানায়। কিছু আইআইটিয়ান খারাপ ফলাফলের জন্য আত্মহত্যা করে – এটা কত বড় বোকামি? কিন্তু ব্যর্থতা তোমাকে খুব বেশি হলে এতখানি কষ্টই দিতে পারে। জীবনটা এমনই। সব চ্যালেঞ্জই যদি সবসময় জয় করা যেত, তবে তা আর চ্যালেঞ্জ থাকত না। আর মনে রাখবে – কোন কিছুতে ব্যর্থ হবার অর্থ তুমি তোমার সাধ্যের সীমায় পৌঁছে গেছো; সেখানে, যেখানে তুমি পৌঁছাতে চাও।
ব্যর্থতার জাতভাই হল হতাশা, দ্বিতীয় বাধা। তোমাদের কি এর অভিজ্ঞতা আছে? এমনটা হয় যখন সবকিছু থমকে দাঁড়ায়, যা ভারতের বেলায় খুবই খাটে। ট্রাফিক জ্যাম থেকে শুরু করে তোমার উপযুক্ত চাকরি – মাঝে মাঝে এর সবকিছুই এত সময়সাপেক্ষ হয়ে পড়ে যে তুমি ভাবতে শুরু করবে তোমার লক্ষ্যগুলো আদৌ ঠিক আছে কিনা। বই লেখার পর আমি ঠিক করলাম বলিউডের জন্য লিখব, কারণ আমার মনে হয়েছিল তাদের লেখক দরকার। ছবি মুক্তি পাবার জন্য আমাকে পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে, অথচ আমাকে প্রচণ্ড ভাগ্যবান বলা হয় এ ব্যাপারে। হতাশা উৎসাহকে দমিয়ে দেয়, আর তোমার ভেতরের শক্তিকে নেতিবাচক কিছুতে পালটে দিয়ে তোমাকে তিক্ত করে তোলে। এর সাথে আমি কীভাবে মানিয়ে নিয়েছি? সে সময়টার একটা বাস্তবসম্মত বিশ্লেষণ – ছবি তাড়াতাড়ি দেখা হয়ে গেলেও তা বানাতে অনেক সময় নেয়, এজন্য হয়তো আমার কাজটা সময়সাপেক্ষ; ফলাফলের চাইতে প্রক্রিয়ার মাঝে আনন্দ খোঁজার চেষ্টা – আমি অন্ততপক্ষে স্ক্রিপ্ট লিখতে তো শিখছিলাম; পাশাপাশি অন্য পরিকল্পনা – আমার তৃতীয় বই লেখা; এমনকি বন্ধুবান্ধব, খাবার, ভ্রমণের মত জীবনের সামান্য আনন্দঘন উপকরণগুলোও তোমাকে এমন অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করবে। মনে রাখবে, কোন কিছুই সিরিয়াসলি নিতে নেই। হতাশ হবার অর্থ তুমি কোন না কোন সময় ঠিক তাই করেছো।
বেইনসাফির(unfairness) সাথে মানিয়ে নেয়াটা সবচাইতে কঠিন, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশটা এভাবেই চলে। যাদের বেশি চেনাজানা মানুষ আছে, কিংবা ধনী বাবা, সুন্দর মুখ, বংশমর্যাদা আছে তাদের জন্য সবকিছু পাওয়াই সহজ – শুধু বলিউডে না, সবখানেই। আর কখনো কখনো তোমার যা লাগবে তা হচ্ছে শুধু ভাগ্য। ভারতে এত কম সুযোগ আছে যে কিছু পেতে হলে তোমার ভাগ্য অসম্ভব রকমের প্রসন্ন হতে হবে। তবে মেধা আর পরিশ্রম আপাতত সাফল্য এনে দিতে না পারলেও, শেষ পর্যন্ত এগুলো কাজে লাগেই। কিন্তু একটা কথা মনে রাখবে, কিছু মানুষ থাকবেই যারা তোমার চাইতে ভাগ্যবান। সত্যি কথা বলতে গেলে, তোমার যেহেতু কলেজে যাওয়ার সুযোগ আর এই বক্তব্য ইংরেজিতে বুঝতে পারার ক্ষমতা আছে – এর অর্থই দাঁড়াচ্ছে তুমি বেশির ভাগ ভারতীয়ের তুলনায় ভাগ্যবান। আমরা যা সেজন্য কৃতজ্ঞ হওয়া আর যা নই তা মেনে নেয়ার মত দৃঢ়তা আমাদের থাকা উচিত। আমি আমার পাঠকদের থেকে যে কত বেশি ভালবাসা পাই তা অন্য অনেক লেখক কল্পনাও করতে পারবেন না। কিন্তু আমার লেখার সাহিত্যমান প্রশংসা পায় না। আমি তা মেনে নিয়েছি। আমি দেখতে ঐশ্বরিয়া রাইয়ের মত নই, কিন্তু আমার দুই ছেলেকে আমার চোখে তার চাইতেও সুন্দর লাগে। এটা হতেই পারে। বেইনসাফিকে কখনো তোমার স্ফুলিঙ্গ নিভিয়ে দিতে দিও না।
শেষ যে জিনিসটা তোমাদের স্ফুলিঙ্গকে ম্লান করে দিতে পারে তা হচ্ছে একাকীত্ব। বয়স যত বাড়বে, ততই তোমরা আবিষ্কার করবে যে তোমরা আলাদা। যখন তুমি ছোট্ট ছিলে, তখন সব বাচ্চাই আইসক্রিম আর স্পাইডারম্যান চাইত। এরপর আরেকটু বড় হয়ে যখন কলেজে এলে, তখনো তুমি অনেকটাই তোমার বন্ধুদের মতন। কিন্তু আর দশটা বছর যেতে দাও, দেখবে যে তুমি আলাদা। তুমি কী চাও, কিসে বিশ্বাস করো, কোন্ ব্যাপারটা তোমাকে নাড়া দেয় – এসব তোমার সবচেয়ে কাছের মানুষ থেকেও আলাদা হতে পারে। অন্যদের সাথে তখন বিরোধ দেখা দিতে পারে, যখন তোমার লক্ষ্য তাদেরগুলোর সাথে মিলবে না। তখন হয়তো বা তুমি কোন কোন লক্ষ্য থেকে সরে আসবে। কলেজের বাস্কেটবল ক্যাপ্টেনরা দ্বিতীয় সন্তান হতে না হতেই খেলা ছেড়ে দেয়, যা একসময় তাদের কাছে অনেক বড় কিছু ছিল। তারা এটা করে পরিবারের জন্য। কিন্তু এর জন্য তাদের স্ফুলিঙ্গ নিভে যায়। কক্ষনো এমন ধরনের আপোষ করবে না। আগে নিজেকে ভালবাসবে, তারপর অন্যদের।
এই তো। আমি তোমাদের চারটা বাধার কথা বললাম – ব্যর্থতা, হতাশা, বেইনসাফি আর একাকীত্ব। তোমরা কখনো এগুলোকে এড়াতে পারবে না, বর্ষার দিনের মতই নির্দিষ্ট সময় পর পর তোমাদেরকে এগুলোর মুখোমুখি হতে হবে। তখন শুধু রেইনকোটটা হাতের কাছে রাখতে হবে, দীপের শিখা যেন নিভে না যায়।
জীবনের সুন্দরতম বছরগুলোতে তোমাদেরকে আবারো স্বাগতম। আমাকে যদি কেউ ফেলে আসা সময়ে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দিত, আমি নিশ্চিতভাবেই কলেজজীবনে ফিরে যেতাম। কিন্তু আমি আরো আশা করি, আজ থেকে দশ বছর পরও তোমাদের চোখের দীপ্তি আজ যেমন আছে, ঠিক তেমনই থাকবে। আশা করি যে, শুধু কলেজের সময়টুকুতেই নয়, জীবনের বাকি ২৫০০ সপ্তাহ জুড়েই তোমরা এই স্ফুলিঙ্গকে জিইয়ে রাখবে। শুধু তোমরা নও, আমি চাই আমার দেশের সব মানুষ একে জিইয়ে রাখুক, যেটা অতীতের যে কোন সময়ের চাইতেই এখন আমাদের জন্য বেশি জরুরি। আর এ কথাটা বলতে পারাটাই তো একটা চমৎকার ব্যাপার যে, আমি শত কোটি দীপশিখার দেশের মানুষ।
‘রিমেম্বারিং শুটিং-ফ্লাইং : এ কী ওয়েস্ট লেটার’ শিরোনামের লেখায় তিনি বলেন যদি আবারও বইগুলোর কোন একটি প্রথমবারের মতো পড়ার সুযোগ পান তা হবে বাৎসারিক এক মিলিয়ন ডলার আয়ের মতো।
তালিকার ১৭টি বই হলো
আন্না কারেনিনা – লিও তলস্তয়
ফার আওয়ে অ্যান্ড লং এগো – ডব্লিউ এইচ হাডসন
বাডেনব্রুকস – টমাস মান
ওয়েদারিং হাইটস – এমিলি ব্রন্ট
মাদাম বোভারি – গুস্তাভ ফ্লোবেয়ার
ওয়ার অ্যান্ড পিস- লিও তলস্তয়
আ স্পোর্টস ম্যান স্কেচস – আইভান তুগার্নেভ
দি ব্রাদার্স কারামজভ – ফিওদর দস্তয়ভস্কি
হাইল অ্যান্ড ফেয়ারওয়েল – জর্জ মুর
হাকলবেরি ফিন – মার্ক টোয়েন
উইনসবুর্গ ওহাইও – শেরউড এন্ডারসন
লা রেইনে মার্গট – আলেকজান্দার দ্যুমা
লা মেইসন টলিয়ার – গাই দে মোপাসাঁ
লে রুজ এট নে নায়ার – স্তাদাঁল
লা চার্টেরুজে দে পার্মে- স্তাদাঁল
ডাবলিনার্স – জেমস জয়েস
অটোবায়োগ্রাফিস – ডব্লিউ বি ইয়েস
আগেই বলা হয়েছে তালিকায় থাকা কয়েকটি বই আধুনিক পাঠকদের বড় অংশের কাছে একদম অজানা। কিন্তু লেখক ও লেখনির দিক থেকে বইগুলো খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। যা হেমিংওয়েকে আরো জানতে সাহায্য করে। বুঝিয়ে দেয় তার মনোগটন। সেই সূত্র ধরে নিচে তেমন কিছু বই নিয়ে বলা হল–
যেমন টমাস মানের ‘বাডেনব্রুকস’। ১৯০১ সালে প্রকাশিত বইটির কাহিনিতে উঠে এসেছে উত্তর জার্মানির এক বুজোর্য়া পরিবারের চার প্রজন্মের কথা। তারা আধুনিক পৃথিবীর শুরুর সময়টা মোকাবেলা করছিল। যে সময়ে মানুষের অনিশ্চিত এক গন্তব্য ঠিক হয়ে গেছে। যেখানে পুরানা পরিবারিক বন্ধন ও প্রথাগুলো আস্তে আস্তে আলগা হয়ে আসছে। নোবেলজয়ী জার্মানির এই ঔপন্যাসিক, ছোট গল্পকার, লোকহৈতেষী, সমাজ সমালোচক ও প্রবন্ধকার বইটিতে তার নিজের পরিবারের গল্প বলেছেন।
আইভান তুর্গানেভের ‘আ স্পোর্টসম্যান স্কেচস’ ‘ফ্রম আ হান্টার্স অ্যালবাম’ নামেও পরিচিত। বইটি ১৯৫২ সালে প্রকাশিত হয়। এখানে উল্লেখ করা যায় হেমিংওয়ে নিজেও শিকার ও মাছ ধরতে পছন্দ করতেন। মৎস্যশিকারিদের সাথে তার বন্ধুত্বের প্রতিদান পাওয়া যায় ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী’ বইতে। তুর্গানেভের বইটিতে তার মায়ের এস্টেটে শিকারের অভিজ্ঞতা স্থান পেয়েছে। যেখানে তিনি অারো অনেক কিছু শিখেন। তিনি দেখতে পান রাশিয়ায় কি করে ছোট কৃষকদের জোর-জুলুম করে কাজ করানো হয়। এই ছোটগল্পের সংকলনটি ছাড়াও রাশিয়ান এই ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার ও নাট্যকারের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বই হলো ‘ফাদার্স অ্যান্ড সনস’। এই বইটির জন্য তিনি আধুনিক পাঠকদের কাছে বেশি পরিচিত।
আইরিশ ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, কবি, নাট্যব্যক্তিত্ব ও শিল্পসমালোচক জর্জ মুরের ‘হাইল অ্যান্ড ফেয়ারওয়েল’ বইটি প্রকাশিত হয় ১৯১১ সালে। এটি তার বিখ্যাত তিনখণ্ডের আধা আত্মজৈবনিক রচনা। যেটি আইল্যান্ডের চমকপ্রদ অভিজ্ঞতার বর্ণনার জন্য পরিচিত।
ফরাসি দেশি লেখক আলেকজান্দার দ্যুমা অধিক পরিচিত ‘কাউন্ট অভ মন্টিক্রিস্টো’, ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার’ বা ‘মেন ইন দ্যা আয়রন মাস্ক’-র মতো ইতিহাস নির্ভর উপন্যাসের জন্য। প্রায় অখ্যাত ‘লা রেইনে মার্গট’ প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালে। এই বইটিও ঐতিহাসিক উপাদানের বাইরে নয়। এতে আছে গণগত্যা, ষড়যন্ত্র, গোপন চুক্তি, বিপদজনক পলায়ন ও ডুয়েলসহ উত্তেজনাকর অনেক উপাদান। প্রেক্ষাপটও বরাবরের মতো ষোল শতকের ফ্রান্সের রাজ পরিবার।
ফরাসি দেশি গাই দ্য মোপাসাঁকে ধরা হয় হয় আধুনিক ছোটগল্পের জনক। হেমিংওয়ে তার ‘লা মেইসন টেলিয়র’ বইটি পছন্দ করেন। এটি মূলত বিভিন্ন ধরনের ছোট গল্পের সংকলন। প্রকাশিত হয় ১৮৮১ সালে।
উনিশ শতকের ফরাসি বাস্তববাদী ঘরানার লেখক স্তাদাঁল তার মনোস্তত্ত্ব বিশ্লেষণাত্মক গল্পের জন্য বিখ্যাত। ‘লা চার্টেরুজে দে পার্মে’ প্রকাশিত হয় ১৮৩৯ সালে। এই বইটিতে আছে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ও ইরোটিক দুর্ভাবনার মিশেলে মহাকাব্যিক বয়ান। যা লেখকের নিজের সময়ে পার্মা নামের রাজপুরুষের বিচারালয়ের দীর্ঘ কাল্পনিক বর্ণনা। এছাড়া তার ‘লে রুজ এট নে নায়ার’ বইটিও হেমিংওয়ের পছন্দের তালিকায় রয়েছে।
স্পার্কস
চেতন ভাগত
["থ্রি ইডিয়টস" মুভিটা দেখেন নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। "ফাইভ পয়েন্ট সামওয়ান" নামে যে বইটা থেকে তৈরি হয়েছে এই মুভি, তার লেখক চেতন ভাগত। নিউইয়র্ক টাইমসের ভাষ্যমতে ভারতের ইতিহাসে ইংরেজি ভাষায় লেখা সবচাইতে বেশি বিক্রিত বইয়ের এই লেখক একই সাথে দারুণ একজন বক্তাও বটে! একটা বিজনেস স্কুলের এমবিএ-র ওরিয়েনটেশন অনুষ্ঠানে নতুন ব্যাচের ছাত্রদের জন্য দেয়া তার বক্তৃতার অনুবাদ এটা।]
শুভ সকাল। আমাকে কথা বলার সুযোগ দেয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। আজকের দিনটা তোমাদের নিয়ে; তোমরা, যারা নিজেদের ঘরের স্বাচ্ছন্দ্যের (কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে তার অভাবের) জীবন ছেড়ে জীবনে কিছু না কিছু হবার জন্য এখানে এসেছো। নিশ্চয়ই তোমরা আজ উত্তেজিত। মানুষের জীবনে এমন দিন খুব কমই আসে যখন সে সত্যিকার অর্থেই রোমাঞ্চিত হয়, কলেজের প্রথম দিন তার মাঝে একটি। আজ এখানে আসার আগে তোমরা হয়তো বারবার শিহরিত হচ্ছিলে – অডিটোরিয়ামটা কেমন হবে, টীচাররা কেমন হবেন, ক্লাসমেট কারা হবে…কৌতূহল জাগানোর মত উপকরণের অন্ত নেই। এর নামই রোমাঞ্চ, তোমার ভেতরের সেই স্ফুলিঙ্গ যা আজ তোমাকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে। এই স্ফুলিঙ্গকে কেমন করে জিইয়ে রাখা যায়, তাই নিয়েই আজ কথা বলবো আমি। অন্যভাবে বলতে গেলে, কেমন করে ‘সবসময়’ না হলেও, ‘সবচাইতে’ সুখী হওয়া যায় – তাই নিয়ে।
এই স্ফুলিঙ্গের শুরু কোথায়? আমাদের জন্ম থেকেই – আমার অন্তত তাই ধারণা। আমার তিন বছরের যমজ ছেলেদের মাঝে হাজারো স্ফুলিঙ্গ। সামান্য একটা স্পাইডারম্যানের খেলনা পেয়েই তারা আনন্দে লাফাতে থাকে। পার্কের নড়বড়ে দোলনা কিংবা বাবার মুখের গল্পই যথেষ্ট তাদেরকে খুশি করার জন্য। জন্মদিনের কেক কবে কাটতে পারবে, তার জন্য কয়েক মাস আগ থেকেই ওরা দিন গুণতে শুরু করে।
তোমাদের মত ছেলেমেয়েদের মাঝেও আমি কিছুটা স্ফুলিঙ্গের রেশ পাই। কিন্তু আরেকটু বয়স বাড়লেই, সেই মানুষদের মাঝে এটা খুঁজে পাওয়া কঠিন। এর অর্থ কী দাঁড়াচ্ছে? বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই স্ফুলিঙ্গ ম্লান হয়ে যায়। এমন হলে সে মানুষ একঘেয়ে, বিষণ্ন, উদ্দেশ্যহীন আর তিক্ত হয়ে পড়ে। ‘Jab we met’এর প্রথম আর শেষ অংশে কারিনাকে মনে পড়ে? স্ফুলিঙ্গ ম্লান হয়ে গেলে ঠিক তেমনটাই হয়। এটাকে কীভাবে রক্ষা করা যায়?
স্ফুলিঙ্গটাকে ধরে নাও একটা প্রদীপের শিখার মত। প্রথম কাজ হচ্ছে এতে অনবরত ইন্ধন যোগানো – শিখাটাকে জিইয়ে রাখা। পরবর্তী কাজ – একে ঝড়-ঝঞ্ঝা থেকে বাঁচানো।
স্ফুলিঙ্গ জিইয়ে রাখার জন্য লক্ষ্যস্থির করাটা জরুরি। মানুষের স্বভাবই হচ্ছে চেষ্টা করা, এগিয়ে যাওয়া আর নিজের সবটুকু সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো। এর নামই সাফল্য, সর্বোচ্চ এতখানিই আমাদের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব। সাফল্যের কোন বাহ্যিক মাপকাঠি নেই যেটা চাকরির বেতনভাতা কিংবা কোন বিশেষ গাড়ি অথবা বাড়ি দ্বারা মাপা যাবে।
আমরা বেশিরভাগই এসেছি মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। স্বাভাবিকভাবেই, আমাদের কাছে সাফল্যের প্রথম সংজ্ঞা হল বৈষয়িক লক্ষ্য অর্জন। যখন আমরা বেড়ে উঠেছি এমন পরিস্থিতিতে যেখানে আর্থিক সীমাবদ্ধতা প্রতিদিনকার পাওয়া-না পাওয়াগুলোকে নির্ধারণ করে, অর্থনৈতিক মুক্তি সেখানে অনেক বড় অর্জন। কিন্তু এ অর্জন জীবনের লক্ষ্য হতে পারে না। যদি তাই হত, তবে মি: আম্বানী আর কখনো কাজে আসতেন না। শাহ্রুখ খান অভিনয় ছেড়ে দিয়ে ঘরে বসে থাকতেন। স্টীভ জবস আরো ভাল আইফোন বানানোর জন্য এত চেষ্টা করতেন না, কারণ পিক্সার থেকে তিনি ইতোমধ্যেই কয়েক বিলিয়ন ডলার আয় করে ফেলেছেন। তারা তাহলে এসব কেন করেন? কী সেই কারণ যা তাদের কাজ করতে উৎসাহ দেয়? কারণ এগুলো তাদের আনন্দ দেয়, এসবের মাঝে তারা প্রাণ খুঁজে পান। বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাই ভাল লাগার জন্য যথেষ্ট। প্রচুর পড়াশোনা করলে তোমার ফলাফল ভাল হবে। মানুষের সাথে বেশি মিশলে তুমি ইন্টারভিউতে ভাল করতে পারবে। অনেক অনুশীলন করলে তুমি আরো ভাল ক্রিকেট খেলতে পারবে। তখন যদি এও জানতে পারো যে, তুমি টেন্ডুলকার হতে পারবে না, তবু তুমি এক ধাপ সামনে আগাবে। এই পরবর্তী ধাপের জন্য চেষ্টা করাটা গুরুত্বপূর্ণ।
প্রকৃতির একটা ছকে বাঁধা নিয়মের মাঝে আমাদের জন্ম। সুখী হওয়ার জন্য যা দরকার তা হল এ নিয়মকে মেনে নিয়ে একে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানো। তোমরা কী তাই করছো? লক্ষ্যস্থির করাটা এক্ষেত্রে তোমাদের জন্য জরুরি। কিন্তু শুধু ক্যারিয়ার কিংবা পড়াশোনার জন্য নয়; একটা ভারসাম্যপূর্ণ, সফল জীবনের জন্য লক্ষ্যস্থির করবে। আমি ‘সফল’এর আগে ‘ভারসাম্যপূর্ণ’ কথাটা বললাম। এর অর্থ তোমার স্বাস্থ্য, সম্পর্ক, মানসিক শান্তি – এর সবই যেন ঠিকঠাক থাকে তা নিশ্চিত করা।
তোমার সম্পর্ক ভাঙার দিনে চাকরিতে পদোন্নতি পেলে সেটাকে অর্থহীন মনে হবে। ঠিক যেমন হয় পিঠে ব্যথা নিয়ে গাড়ি চালানোর সময়, কিংবা দুশ্চিন্তাভরা মন নিয়ে শপিং করতে গেলে।
তোমরা হয়তো এমন অনেক উক্তি শুনেছো – জীবন একটা কঠিন প্রতিযোগিতা, এটা একটা ম্যারাথন অথবা এরকম কিছু। আমার চোখে জীবন হল নার্সারী স্কুলের সেই প্রতিযোগিতা, যেখানে চামচে মার্বেল মুখে নিয়ে দৌড়াতে হত। চামচ থেকে মার্বেল পড়ে গেলে দৌড়ে প্রথম হওয়াটা যেমন অর্থহীন, ঠিক তেমনি জীবনে নিজের স্বাস্থ্য আর অন্যদের সাথে সম্পর্ক ঠিক রাখতে পারলে তবেই কেবল তোমার সাফল্যের মূল্য থাকবে। তা না করলে সফল হলেও তোমার মাঝের এই স্ফুলিঙ্গ, এই রোমাঞ্চ আর প্রাণবন্ততা মিইয়ে আসবে।
স্ফুলিঙ্গটাকে জিইয়ে রাখা নিয়ে শেষ কথা – জীবনটাকে সিরিয়াসলি নিও না। আমার এক ইয়োগা টীচার ক্লাসে ছেলেমেয়েদের হাসাতেন। এক ছাত্র তাকে জিজ্ঞেস করলো – এসব কৌতুক আমাদের অনুশীলনের কোন ক্ষতি করবে কিনা। টীচার বললেন – সিরিয়াস হয়ো না, আন্তরিক হও। এই কথাটা তখন থেকে আমার প্রতিটা কাজের পেছনে ভূমিকা রেখেছে – তা আমার লেখা, আমার সম্পর্ক, আমার চাকরি কিংবা অন্য যাই হোক না কেন। আমি প্রতিদিন আমার লেখা নিয়ে হাজারটা মন্তব্য পাই – উচ্ছ্বসিত প্রশংসা থেকে শুরু করে তীব্র সমালোচনা। এর সবই যদি আমি গুরুত্বের সাথে নেই, তবে আমি লিখব কী করে? বাঁচবো কী করে? জীবন সিরিয়াসলি নেয়ার মত কিছু নয়, কারণ এখানে আমরা ক্ষণস্থায়ী। আমরা অনেকটা সীমিত সময়ের প্রিপেইড কার্ডের মত। ভাগ্য ভাল থাকলে আমরা আর বড়জোর ৫০ বছর – মানে মাত্র ২,৫০০ সপ্তাহ বাঁচবো। আমাদের কি আসলেই এত চিন্তিত হবার কিছু আছে? মাঝে মাঝে ক্লাস ফাঁকি দাও, কিছু বাজে ইন্টারভিউ দাও, প্রেমে পড়ো – এর সবই স্বাভাবিক। আমরা মানুষ, প্রোগ্রাম করা যন্ত্র নই।
স্ফুলিঙ্গ জিইয়ে রাখার জন্য আমি তোমাদের তিনটা জিনিসের কথা বললাম – অর্থপূর্ণ লক্ষ্য, ভারসাম্য আর জীবনকে সিরিয়াসলি না নেয়া। কিন্তু জীবনে এমন চারটা ঝড় আসবে যা এই শিখাকে একেবারে নিভিয়ে দিতে চাইবে। হতাশা, ব্যর্থতা, বেইনসাফি আর একাকীত্ব – এগুলোর বিরুদ্ধে সতর্ক থাকাটা জরুরি।
তুমি যখন চেষ্টা করেও কোন কিছু থেকে আশানুরূপ ফল পাবে না, তখনই হতাশা আসবে; যখন সব কিছু তোমার পরিকল্পনামত চলবে না, কিংবা তুমি ব্যর্থ হবে। ব্যর্থতা মোকাবেলা করাটা কঠিন, কিন্তু করতে পারলে সেটা খুব কাজে দেয়। তোমাকে প্রশ্ন করতে হবে, এই ব্যর্থতা আমাকে কী শেখালো? তোমার অসহায় লাগবে। তোমার ইচ্ছে হবে সব ছেড়েছুড়ে দিতে, যেমনটা আমার হয়েছিলো যখন ৯ জন প্রকাশক আমার প্রথম বই প্রকাশ করতে আপত্তি জানায়। কিছু আইআইটিয়ান খারাপ ফলাফলের জন্য আত্মহত্যা করে – এটা কত বড় বোকামি? কিন্তু ব্যর্থতা তোমাকে খুব বেশি হলে এতখানি কষ্টই দিতে পারে। জীবনটা এমনই। সব চ্যালেঞ্জই যদি সবসময় জয় করা যেত, তবে তা আর চ্যালেঞ্জ থাকত না। আর মনে রাখবে – কোন কিছুতে ব্যর্থ হবার অর্থ তুমি তোমার সাধ্যের সীমায় পৌঁছে গেছো; সেখানে, যেখানে তুমি পৌঁছাতে চাও।
ব্যর্থতার জাতভাই হল হতাশা, দ্বিতীয় বাধা। তোমাদের কি এর অভিজ্ঞতা আছে? এমনটা হয় যখন সবকিছু থমকে দাঁড়ায়, যা ভারতের বেলায় খুবই খাটে। ট্রাফিক জ্যাম থেকে শুরু করে তোমার উপযুক্ত চাকরি – মাঝে মাঝে এর সবকিছুই এত সময়সাপেক্ষ হয়ে পড়ে যে তুমি ভাবতে শুরু করবে তোমার লক্ষ্যগুলো আদৌ ঠিক আছে কিনা। বই লেখার পর আমি ঠিক করলাম বলিউডের জন্য লিখব, কারণ আমার মনে হয়েছিল তাদের লেখক দরকার। ছবি মুক্তি পাবার জন্য আমাকে পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে, অথচ আমাকে প্রচণ্ড ভাগ্যবান বলা হয় এ ব্যাপারে। হতাশা উৎসাহকে দমিয়ে দেয়, আর তোমার ভেতরের শক্তিকে নেতিবাচক কিছুতে পালটে দিয়ে তোমাকে তিক্ত করে তোলে। এর সাথে আমি কীভাবে মানিয়ে নিয়েছি? সে সময়টার একটা বাস্তবসম্মত বিশ্লেষণ – ছবি তাড়াতাড়ি দেখা হয়ে গেলেও তা বানাতে অনেক সময় নেয়, এজন্য হয়তো আমার কাজটা সময়সাপেক্ষ; ফলাফলের চাইতে প্রক্রিয়ার মাঝে আনন্দ খোঁজার চেষ্টা – আমি অন্ততপক্ষে স্ক্রিপ্ট লিখতে তো শিখছিলাম; পাশাপাশি অন্য পরিকল্পনা – আমার তৃতীয় বই লেখা; এমনকি বন্ধুবান্ধব, খাবার, ভ্রমণের মত জীবনের সামান্য আনন্দঘন উপকরণগুলোও তোমাকে এমন অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করবে। মনে রাখবে, কোন কিছুই সিরিয়াসলি নিতে নেই। হতাশ হবার অর্থ তুমি কোন না কোন সময় ঠিক তাই করেছো।
বেইনসাফির(unfairness) সাথে মানিয়ে নেয়াটা সবচাইতে কঠিন, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশটা এভাবেই চলে। যাদের বেশি চেনাজানা মানুষ আছে, কিংবা ধনী বাবা, সুন্দর মুখ, বংশমর্যাদা আছে তাদের জন্য সবকিছু পাওয়াই সহজ – শুধু বলিউডে না, সবখানেই। আর কখনো কখনো তোমার যা লাগবে তা হচ্ছে শুধু ভাগ্য। ভারতে এত কম সুযোগ আছে যে কিছু পেতে হলে তোমার ভাগ্য অসম্ভব রকমের প্রসন্ন হতে হবে। তবে মেধা আর পরিশ্রম আপাতত সাফল্য এনে দিতে না পারলেও, শেষ পর্যন্ত এগুলো কাজে লাগেই। কিন্তু একটা কথা মনে রাখবে, কিছু মানুষ থাকবেই যারা তোমার চাইতে ভাগ্যবান। সত্যি কথা বলতে গেলে, তোমার যেহেতু কলেজে যাওয়ার সুযোগ আর এই বক্তব্য ইংরেজিতে বুঝতে পারার ক্ষমতা আছে – এর অর্থই দাঁড়াচ্ছে তুমি বেশির ভাগ ভারতীয়ের তুলনায় ভাগ্যবান। আমরা যা সেজন্য কৃতজ্ঞ হওয়া আর যা নই তা মেনে নেয়ার মত দৃঢ়তা আমাদের থাকা উচিত। আমি আমার পাঠকদের থেকে যে কত বেশি ভালবাসা পাই তা অন্য অনেক লেখক কল্পনাও করতে পারবেন না। কিন্তু আমার লেখার সাহিত্যমান প্রশংসা পায় না। আমি তা মেনে নিয়েছি। আমি দেখতে ঐশ্বরিয়া রাইয়ের মত নই, কিন্তু আমার দুই ছেলেকে আমার চোখে তার চাইতেও সুন্দর লাগে। এটা হতেই পারে। বেইনসাফিকে কখনো তোমার স্ফুলিঙ্গ নিভিয়ে দিতে দিও না।
শেষ যে জিনিসটা তোমাদের স্ফুলিঙ্গকে ম্লান করে দিতে পারে তা হচ্ছে একাকীত্ব। বয়স যত বাড়বে, ততই তোমরা আবিষ্কার করবে যে তোমরা আলাদা। যখন তুমি ছোট্ট ছিলে, তখন সব বাচ্চাই আইসক্রিম আর স্পাইডারম্যান চাইত। এরপর আরেকটু বড় হয়ে যখন কলেজে এলে, তখনো তুমি অনেকটাই তোমার বন্ধুদের মতন। কিন্তু আর দশটা বছর যেতে দাও, দেখবে যে তুমি আলাদা। তুমি কী চাও, কিসে বিশ্বাস করো, কোন্ ব্যাপারটা তোমাকে নাড়া দেয় – এসব তোমার সবচেয়ে কাছের মানুষ থেকেও আলাদা হতে পারে। অন্যদের সাথে তখন বিরোধ দেখা দিতে পারে, যখন তোমার লক্ষ্য তাদেরগুলোর সাথে মিলবে না। তখন হয়তো বা তুমি কোন কোন লক্ষ্য থেকে সরে আসবে। কলেজের বাস্কেটবল ক্যাপ্টেনরা দ্বিতীয় সন্তান হতে না হতেই খেলা ছেড়ে দেয়, যা একসময় তাদের কাছে অনেক বড় কিছু ছিল। তারা এটা করে পরিবারের জন্য। কিন্তু এর জন্য তাদের স্ফুলিঙ্গ নিভে যায়। কক্ষনো এমন ধরনের আপোষ করবে না। আগে নিজেকে ভালবাসবে, তারপর অন্যদের।
এই তো। আমি তোমাদের চারটা বাধার কথা বললাম – ব্যর্থতা, হতাশা, বেইনসাফি আর একাকীত্ব। তোমরা কখনো এগুলোকে এড়াতে পারবে না, বর্ষার দিনের মতই নির্দিষ্ট সময় পর পর তোমাদেরকে এগুলোর মুখোমুখি হতে হবে। তখন শুধু রেইনকোটটা হাতের কাছে রাখতে হবে, দীপের শিখা যেন নিভে না যায়।
জীবনের সুন্দরতম বছরগুলোতে তোমাদেরকে আবারো স্বাগতম। আমাকে যদি কেউ ফেলে আসা সময়ে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দিত, আমি নিশ্চিতভাবেই কলেজজীবনে ফিরে যেতাম। কিন্তু আমি আরো আশা করি, আজ থেকে দশ বছর পরও তোমাদের চোখের দীপ্তি আজ যেমন আছে, ঠিক তেমনই থাকবে। আশা করি যে, শুধু কলেজের সময়টুকুতেই নয়, জীবনের বাকি ২৫০০ সপ্তাহ জুড়েই তোমরা এই স্ফুলিঙ্গকে জিইয়ে রাখবে। শুধু তোমরা নও, আমি চাই আমার দেশের সব মানুষ একে জিইয়ে রাখুক, যেটা অতীতের যে কোন সময়ের চাইতেই এখন আমাদের জন্য বেশি জরুরি। আর এ কথাটা বলতে পারাটাই তো একটা চমৎকার ব্যাপার যে, আমি শত কোটি দীপশিখার দেশের মানুষ।