এক মুঠো খেজুরমূল : তায়্যিব সালেহ
অনুবাদ : বিদ্যুত খোশনবীশ
আমি তখন খুব ছোট। বয়স কত ছিল তাও ঠিক মনে নেই। সে সময় লোকজন আমাকে শুধু দাদার সাথেই দেখতো। তারা আমার মাথা চাপড়ে দিতো আর থুতনী ধরে আদর করতো। অবশ্য বলার অপেক্ষা রাখে না, দাদার সাথে কেউ এমন করতো না। মজার ব্যাপার হলো, সে সময় আমি বাবার সাথে খুব একটা বাইরে বেরুতাম না, বরং দাদাই আমাকে সব জায়গায় নিয়ে যেতেন। তিনি যেখানেই যেতেন আমি সাথে থাকতাম। শুধু ভোর বেলাতে এর ব্যতিক্রম হতো। কারণ ভোরে কোরান শিখতে আমাকে মসজিদে যেতে হতো। মসজিদ, নদী আর খোলা মাঠ- এগুলোই ছিল আমার জীবনের সীমানা। সে সময় আমার বয়সী ছেলে-মেয়েরা মসজিদে যেতে পীড়া বোধ করলেও আমি এই যাত্রাকে ভালোবাসতাম। যে কোন পড়া হৃদয়ঙ্গম করতে আমি ছিলাম পারদর্শী- এটাই মূল কারণ। মসজিদে কোন অতিথি এলে শেখ সাহেব প্রতিবারই আমাকে দাঁড়িয়ে সুরা আর রাহমান তেলাওয়াত করতে বলতেন। তেলাওয়াত শুনে অতিথিরা আমার মাথা চাপড়ে দিতেন আর থুতনী ধরে আদর করতেন, ঠিক যেমনটা দাদার সাথে বাইরে বেরুলে ঘটতো।
হ্যাঁ, আমি মসজিদ ভালোবাসতাম; ভালোবাসতাম নদীও। কোরান পাঠ শেষ হওয়া মাত্রই স্লেটটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে রূপকথার জিনের মত চোখের পলকেই মায়ের কাছে চলে যেতাম। তারপর পেটে কিছু একটা চালান করেই ছুটে যেতাম নদীর কাছে, ঝাঁপ দেব বলে। সাঁতরাতে সাঁতরাতে যখন হাত-পা অবশ হয়ে আসতো তখন তীরে বসে বিশ্রাম নিতাম, পলকহীন চেয়ে থাকতাম পুবে ছুটেচলা প্রিয় স্রোতস্বিনীর আঁকাবাঁকা পথের দিকে। চলতে চলতে সে হারিয়ে যেত অ্যাকাশিয়ার গভীর অরণ্যে। আর আমিও ছেড়ে দিতাম আমার কল্পনার লাগাম। নিজেকে সেই অরণ্যের দেও-দানব ভাবতে আমার বেশ ভাল লাগতো- বিশাল সরু দেহ, চোখা নাক আর মুখে লম্বা সাদা দাড়ি। অনেকটা আমার দাদার মত। দাদা তার জীবনে আমার অনেক প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। তবে জবাব দেবার আগে প্রতিবারই তিনি আঙুল দিয়ে তার চোখা নাক ঘষে নিতেন আর দাড়িতে হাত বুলাতেন। তার দাড়ি ছিল তুলতুলে, বিলাসী আর ধবধবে সাদা। আমার জীবনে এতো বিশুদ্ধ সাদা কিংবা তুলোনারহিত সৌন্দর্য আমি আর কখনও দেখিনি। দাদা ছিলেন খুব লম্বা মানুষ। তার সাথে কথা বলার সময় ঘাড় বাঁকিয়ে উপর দিকে তাকাতে হয়নি এমন কাউকেই আমাদের এলাকায় কখনও দেখিনি। কিংবা কোন ঘরে ঢুকবার সময় দাদা তার ঘাড় আর পিঠ বাঁকা করেননি এমন দৃশ্যও আমার চোখে কখনও পড়েনি। তার শরীর বাঁকিয়ে ঘরে ঢুকার দৃশ্য দেখলেই আমার ঐ আঁকাবাঁকা নদীটির কথা মনে পড়ে যেত। দাদাকে আমি প্রচন্ড ভালোবাসতাম। বড় হয়ে আমি তার মতই চিকন আর লম্বা হবো, বড় বড় কদমে এদিক ওদিক হেঁটে বেড়াবো- এমন দৃশ্য ভাবতে আমার খুব ভাল লাগতো।
আমার বিশ্বাস, আমিই ছিলাম আমার দাদার সবচেয়ে প্রিয় নাতি। কারণ আমার চাচাতো ভাইয়েরা ছিল একদল আহাম্মক; আর তাদের ভাষায় আমি ছিলাম প্রচন্ড বুদ্ধিমান এক বালক। আমি জানতাম, দাদার সামনে আমাকে ঠিক কখন হাসতে হবে আর কখন নিরব থাকতে হবে। তার নামাজের সময় সম্পর্কে আমার পাঁকা ধারণা ছিল। তাই তিনি বলবার আগেই আমি তার জন্য জায়নামাজ আর জগ ভর্তি করে ওজুর পানি নিয়ে হাজির হতাম। দাদার যখন কিছুই করার থাকতো না তখন ললিত সুরে আমি তাকে কোরান তেলাওয়াত করে শুনাতাম। তার মুখ দেখেই বুঝতে পারতাম তিনি আপ্লুত হচ্ছেন।
একদিন দাদাকে আমি আমাদের প্রতিবেশী মাসুদ চাচা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। বললাম: আমার মনে হয় তুমি মাসুদ চাচাকে খুব একটা পছন্দ কর না।
নিজের চোখা নাকটা আঙুল দিয়ে ঘষে তিনি উত্তর দিলেন: ও একটা অপদার্থ, অকর্মন্য। আমি এ ধরনের মানুষ মোটেই পছন্দ করিনা।
আমি বললাম: অকর্মন্য মানুষ আবার কেমন হয়?
মাথা নিচু করে দাদা কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। তারপর সামনের বিস্তৃত মাঠের দিকে তাকিয়ে বললেন: মরুভূমির শেষ প্রান্ত থেকে নীল নদের তীর পর্যন্ত ঐ বিশাল জমিন দেখছিস তো? একশ একর। আর ঐ যে খেজুর বাগান? সারি সারি বৃক্ষ? ওগুলো একদিন মাসুদের ছিলÑ উত্তরাধীকার সূত্রে সে তার বাবার কাছ থেকে পেয়েছিল এসব। দাদা আরো কিছুক্ষণ নিরব রইলেন। তার এই নিরবতার সুযোগে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের দিকে আমি কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। নিজেকে বলতে থাকলাম: এই খেজুর বাগান, এই বৃক্ষরাজি কিংবা এই এবড়ো-থেবড়ো জমির মালিক যেই হোক না কেন আমি তার তোয়াক্কা করিনা। এই জমিন আমার খেলার মাঠ, আমার স্বপ্ন।
কিছুক্ষণ পর নিরবতা ভেঙ্গে দাদা বললেন: হ্যাঁ দাদু, চল্লিশ বছর আগে এসবই মাসুদের ছিল। কিন্তু আজ এসবের বারো আনাই আমার।
দাদার এই কথাগুলো আমার কাছে একেবারেই নতুন ছিল। কারণ আমার ধারণা ছিল, দুনিয়া সৃষ্টির পর থেকেই এই সব জমির মালিক আমার দাদা।
‘এ গায়ে আমি যখন প্রথম আসি তখন আমার এক বিঘা জমিও ছিল না। এই সব সম্পদের মালিক ছিল মাসুদ। কিন্তু অবস্থা এখন বদলে গেছে। আর আমার ধারণা, আল্লাহপাক আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে যাবার আগেই বাকি চার আনার মালিকও আমি হয়ে যাব।’
আমি বলতে পারবো না, এই কথা শুনার পর কেন আমি ভয় পেয়ে গেলাম আর মাসুদ চাচার জন্য কেনই বা আমার মায়া হলো। কেন যেন মনে হল, দাদা যা বললেন তা করার সুযোগ যেন তিনি না পান। আমার স্মৃতিপটে ভেসে উঠল সুরেলা কন্ঠে মাসুদ চাচার গান গাওয়ার দৃশ্য। তার চমৎকার কন্ঠ আর আকর্ষনীয় হাসি যেন বয়ে চলা নদীর কুলকুল ধ্বনি। অথচ দাদাকে আমি কখনও হাসতে দেখিনি।
আমি দাদার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, মাসুদ চাচা কেন তার জমি বিক্রি করে দিয়েছিল।
‘নারী।’ দাদার মুখে নারী শব্দটা শুনে আমার মনে হয়েছিল এ যেন ভয়ানক একটা কিছু। তিনি বললেন, মাসুদ জীবনে বহুবার বিয়ে করেছে। আর বিয়ের খরচ জোগাতে প্রতিবারই দুই-এক একর করে প্রায় সব জমিই ও আমার কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। দাদার কথা শুনেই আমি চট করে একটা হিসেব কষে ফেললাম। এ কথা যদি সত্য হয় তবে মাসুদ চাচার তো এতোদিনে নব্বইটা বিয়ে করার কথা! আমার তখন মনে পড়ে গেল তার তিন স্ত্রী, মলিন চেহারা, হাতা ছেড়া জোব্বা, তার খোড়া গাধা ও সেটার এবড়ো-থেবড়ো জীনের কথা। কিন্তু আমার মনের দুয়ারে ভিড় করা এসব দৃশ্য চট করেই উবে গেল যখন দেখলাম মাসুদ চাচা আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছেন। হঠাৎ তাকে আসতে দেখে আমি আর দাদা মুখ চাওয়া-চাওয়ী করলাম।
মাসুদ চাচা দাদাকে বললেন, আমারা আজকে গাছ থেকে খেজুর পাড়বো। আপনি থাকবেন না?
যদিও আমার মনে হচ্ছিল, তিনি মন থেকে চাচ্ছেন না দাদা সেখানে যাক। কিন্তু দাদা ধপ করে উঠে দাঁড়ালেন। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম, তার চোখযুগল প্রচন্ড উজ্জ্বল হয়ে ওঠেছে। দাদা আমার হাত ধরে টান দিলেন; আমরা মাসুদে চাচার খেজুর বাগানের দিকে এগিয়ে চললাম।
বাগানে যাবার পর কেউ একজন দাদাকে একটা মরিচা ধরা টুল এগিয়ে দিল। দাদা বসলেন আর আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। সেখানে অনেক লোক ছিল। তাদের প্রায় সবাইকেই আমি চিনতাম। কিন্তু কোন এক কারণে সবকিছু বাদ দিয়ে আমি মাসুদ চাচার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ভিড় থেকে খানিক দূরে তিনি এমন নিস্পৃহভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন যেন তার কিছুই করার নেই। অথচ যে বাগান থেকে খেজুর পেড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেটা তার! তবে হঠাৎ খেজুরের বড় কোন কাদি পড়ার শব্দ হলেই তিনি সেদিকে দৃষ্টি ফেরাতেন। একবার এক বাচ্চা ছেলেকে লক্ষ্য করে বেশ উঁচু গলাতেই তিনি বললেন: সাবধান! গাছের হৃদয়টা আবার কেটে ফেলনা যেন। কিন্তু আশ্চর্য, ছেলেটা তার কথায় কান-ই দিলনা। ধারালো কাস্তে দিয়ে সে আগের মতই একের পর এক খেজুরের কাদি কেটে চলল। গাছ থেকে অঝোরে খেজুর পড়া দেখে আমার মনে হলো, যেন আসমান থেকে পড়ছে।
সে যাই হোক, অন্য সব কিছু বাদ দিয়ে আমি মাসুদ চাচার শব্দটা নিয়ে ভাবতে শুরু করলামÑ গাছের হৃদয়! আমি এমন এক খেজুর গাছ কল্পনা করলাম যার অনুভূতি আছে, যার হৃদয় আছে, যে হৃদয়ের স্পন্দন আছে। এসব ভাবতে গিয়ে মাসুদ চাচার আরো একটি কথা আমার স্মৃতিতে কড়া নাড়লো। একবার ছোট একটা খেজুর গাছের ডাল ভেঙ্গে আমাকে খেলা করতে দেখে তিনি বলেছিলেন: ‘শোন বাবা! খেজুর গাছও মানুষের মত। তাদেরও সুখ আছে, যন্ত্রণা আছে।’ মাসুদ চাচার এই কথা শুনে আমি বেশ বিব্রত বোধ করেছিলাম।
হৃদয়ের অন্তঃপুর থেকে নিজেকে মুক্ত করে আমি আবারো সামনের খোলা প্রান্তরের দিকে ফিরে তাকালাম। আমার খেলার সাথীরা পিপড়ের মত খেজুর গাছের নিচে ভিড় করে আছে। কুড়িয়ে পাওয়া খেজুরগুলো বেশ মজা করেই খাচ্ছিল ওরা। এরইমধ্যে গাছ থেকে পেড়ে আনা সব খেজুর টিলার মত ¯তূপ করে রাখা হয়েছিল। একটি টিনের কৌটা দিয়ে মেপে মেপে বেশ কয়েকজন খেজুরগুলো বস্তায় ভরছিল। মোট তিরিশটি বস্তা ছিল। খানিক বাদেই একে একে প্রায় সবাই চলে গেল। আমাদের সাথে শুধু থেকে গেল ব্যবসায়ী হুসেন আর মুসা নামক একজনÑ পুব দিকে আমাদের জমি ঘেষেই তার কিছু জমি আছে। আরো দু’জন লোক ছিল তবে এর আগে আমি তাদের কখনও দেখিনি।
হঠাৎই মৃদু শিস ধ্বনি কানে এলো। লক্ষ্য করে দেখলাম, দাদা বসে বসেই ঘুমাচ্ছেন। আর মাসুদ চাচার একলা দাঁড়িয়ে থাকার মধ্যেও কোন পরিবর্তন হয়নি। তবে এই ক্ষণে তিনি খেজুরের একটি ডাল মুখে দিয়ে আনমনে চিবাচ্ছেন। মনে হচ্ছিল, মুখভর্তি এই খাবার দিয়ে তিনি কী করবেন তা ঠিক বুঝতে পারছেন না।
দাদা হুট করে জেগে উঠলেন। আগের মত ধপ করে দাঁড়িয়েই তিনি খেজুরের বস্তার দিকে হাঁটা শুরু করলেন। তার পিছু পিছু হুসেন, মুসা আর সেই দুই আগন্তুক বস্তার দিকে এগিয়ে গেল। মাসুদ চাচা কী করেন তা দেখতে তার দিকে মুখ ফিরালাম। তিনি খুব ধীরে ধীরে দাদার দিকে এগিয়ে গেলেন। তার এই পথচলা দেখে আমার মনে হলো, তিনি এমন একজন মানুষ যিনি পিছু হটতে চান কিন্তু তার পা দুটো তাকে টেনে সামনে নিয়ে যায়। সবাই বস্তাগুলোর চারিদিকে গোল হয়ে দাঁড়ালো। কেউ কেউ দু’ একটা খেজুর খাবার জন্যে হাতে তুলে নিলো। বস্তা থেকে এক মুঠ খেজুর তুলে দাদা আমাকে দিলেন। আমি মজা করে সেগুলো চিবুতে থাকলাম। আর মাসুদ চাচা তার দুই হাত ভরে খেজুর তুলে সেগুলোর ঘ্রাণ নিলেন। তারপর এমনভাবে বস্তায় রেখে দিলেন, যেন এর চেয়ে বেশি কিছু করার অধিকার তার নেই।
বস্তাগুলো ভাগ করা হলো। হুসেন নিল দশটি, দুই আগন্তুক আর মুসাকে দেয়া হলো পাঁচটি করে। আর দাদা নিলেন বাকি পাঁচটি। কিছু বুঝতে না পেরে আমি মাসুদ চাচার দিকে তাকালাম। তার চোখ দুটো এমনভাবে ডানে-বামে নড়াচড়া করছিল যেন পথহারা দুটি ইঁদুর।
মাসুদ চাচাকে দাদা বললেন, ‘তোমার কাছে আরো পঞ্চাশ পাউন্ড খেজুর পাওনা রইলো। আমরা পরে এ নিয়ে কথা বলবো।’
হুসেন তার লোকজনকে ডাক দিতেই তারা কতগুলো গাধা নিয়ে হাজির হলো। আর আগন্তুক দুজন তাদের উটের পিঠে নিজ নিজ বস্তাগুলো তুলে দিলো। একটা গাধার কর্কশ চিৎকারে উটগুলো এমনভাবে মুখে ফেনা তুললো যেন তারা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে। আমি লক্ষ্য করলাম, নিজের অজান্তেই আমি মাসুদ চাচার কাছে এগিয়ে যাচ্ছি। আমার হাত তার দিকে এমনভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল যেন আমি তার জোব্বার ঝুলন্ত হাতা স্পর্শ করতে চাচ্ছি। তার গলায় ঘড়ঘড় শব্দ হলো, সাধারণত ভেড়া জবাই করলে যেমনটা হয়। কোন এক অজানা কারণে আমি বুকে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করলাম।
আমি দৌড়ে অনেকখানি দূরে চলে এলাম। পেছন থেকে দাদার ডাক শুনে কিছুটা দ্বিধান্বিত হলেও আমি দৌড় থামালাম না। ঐ মুহূর্তে আমার মনে হলো, আমি দাদাকে ঘৃণা করি। আমি এতো জোড়ে দৌড়াচ্ছিলাম, যেন কেউ একজন আমার ঘাড়ে প্রচন্ড ভারি এক বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে আর আমি তা থেকে মুক্তি চাইছি। দৌড়াতে দৌড়াতে আমি আমার প্রিয় নদীর সেই বাঁকের কাছে এসে দঁড়ালাম যেখান থেকে অ্যাকাশিয়ার অরণ্যে সে হারিয়ে গেছে। গলায় আঙুল ঢুকিয়ে আমি বমি করলাম, দাদার দেয়া যে খেজুর আমি খেয়েছিলাম তার সবটুকু পেট থেকে বেড় হয়ে গেল। কিন্তু আমি কেন এমন করলাম সে প্রশ্নের জবাব আমার জানা নেই।
লেখক পরিচিতি: আল তায়্যিব সালেহ এর জন্ম উত্তর সুদানের কারমকল নামক স্থানে ১৯২৯ সালের ১২ জুলাই। তার বহুল পঠিত ও বহুল আলোচিত উপন্যাস ‘মাইগ্রেশন টু দ্য নর্থ’ প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালে যা প্রকাশিত হবার পরপরই অনূদিত হয় ৩০টিরও বেশি ভাষায়। মূলত এই উপন্যাসের মাধ্যমেই তিনি আরোহণ করেন খ্যাতির স্বর্ণচূড়ায়। ২০০১ সালে ‘আরব লিটারারি সোসাইটি’ এই উপন্যাসকে আখ্যায়িত করে ‘বিংশ শতকের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস’ হিসেবে। শুধু তাই নয়, ২০০২ সালে ‘নরওয়েজিয়ান বুকস্ ক্লাব’ কর্তৃক প্রকাশিত ‘বিংশ শতকের ১০০টি সেরা উপন্যাস’ এর তালিকাতেও স্থান করে নেয় তায়্যিব সালেহর ‘মাইগ্রেশন টু দ্য নর্থ’। তার ছোটগল্প ‘দ্য ওয়েডিং অব জেইন’ অবলম্বনে নির্মিত চলচিত্র ১৯৭৬ সালে লাভ করে ‘কান ফিল্ম ফেস্টিভাল অ্যাওয়ার্ড’। তায়্যিব সালেহ এর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ছোটগল্প হলো: দোমা ওয়াদ হামাদ, দাও আল বাইয়াত, সিপ্রিয়েট ম্যান এবং বান্দারশাহ। অনূদিত এই গল্পটি আরবি ভাষায় প্রকাশিত হয় ১৯৬৪ সালে।
তায়্যিব সালেহর মুত্যু ২০০৯ সালের ১৮ ফেব্র“য়ারি লন্ডনে।
হ্যাঁ, আমি মসজিদ ভালোবাসতাম; ভালোবাসতাম নদীও। কোরান পাঠ শেষ হওয়া মাত্রই স্লেটটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে রূপকথার জিনের মত চোখের পলকেই মায়ের কাছে চলে যেতাম। তারপর পেটে কিছু একটা চালান করেই ছুটে যেতাম নদীর কাছে, ঝাঁপ দেব বলে। সাঁতরাতে সাঁতরাতে যখন হাত-পা অবশ হয়ে আসতো তখন তীরে বসে বিশ্রাম নিতাম, পলকহীন চেয়ে থাকতাম পুবে ছুটেচলা প্রিয় স্রোতস্বিনীর আঁকাবাঁকা পথের দিকে। চলতে চলতে সে হারিয়ে যেত অ্যাকাশিয়ার গভীর অরণ্যে। আর আমিও ছেড়ে দিতাম আমার কল্পনার লাগাম। নিজেকে সেই অরণ্যের দেও-দানব ভাবতে আমার বেশ ভাল লাগতো- বিশাল সরু দেহ, চোখা নাক আর মুখে লম্বা সাদা দাড়ি। অনেকটা আমার দাদার মত। দাদা তার জীবনে আমার অনেক প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। তবে জবাব দেবার আগে প্রতিবারই তিনি আঙুল দিয়ে তার চোখা নাক ঘষে নিতেন আর দাড়িতে হাত বুলাতেন। তার দাড়ি ছিল তুলতুলে, বিলাসী আর ধবধবে সাদা। আমার জীবনে এতো বিশুদ্ধ সাদা কিংবা তুলোনারহিত সৌন্দর্য আমি আর কখনও দেখিনি। দাদা ছিলেন খুব লম্বা মানুষ। তার সাথে কথা বলার সময় ঘাড় বাঁকিয়ে উপর দিকে তাকাতে হয়নি এমন কাউকেই আমাদের এলাকায় কখনও দেখিনি। কিংবা কোন ঘরে ঢুকবার সময় দাদা তার ঘাড় আর পিঠ বাঁকা করেননি এমন দৃশ্যও আমার চোখে কখনও পড়েনি। তার শরীর বাঁকিয়ে ঘরে ঢুকার দৃশ্য দেখলেই আমার ঐ আঁকাবাঁকা নদীটির কথা মনে পড়ে যেত। দাদাকে আমি প্রচন্ড ভালোবাসতাম। বড় হয়ে আমি তার মতই চিকন আর লম্বা হবো, বড় বড় কদমে এদিক ওদিক হেঁটে বেড়াবো- এমন দৃশ্য ভাবতে আমার খুব ভাল লাগতো।
আমার বিশ্বাস, আমিই ছিলাম আমার দাদার সবচেয়ে প্রিয় নাতি। কারণ আমার চাচাতো ভাইয়েরা ছিল একদল আহাম্মক; আর তাদের ভাষায় আমি ছিলাম প্রচন্ড বুদ্ধিমান এক বালক। আমি জানতাম, দাদার সামনে আমাকে ঠিক কখন হাসতে হবে আর কখন নিরব থাকতে হবে। তার নামাজের সময় সম্পর্কে আমার পাঁকা ধারণা ছিল। তাই তিনি বলবার আগেই আমি তার জন্য জায়নামাজ আর জগ ভর্তি করে ওজুর পানি নিয়ে হাজির হতাম। দাদার যখন কিছুই করার থাকতো না তখন ললিত সুরে আমি তাকে কোরান তেলাওয়াত করে শুনাতাম। তার মুখ দেখেই বুঝতে পারতাম তিনি আপ্লুত হচ্ছেন।
একদিন দাদাকে আমি আমাদের প্রতিবেশী মাসুদ চাচা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। বললাম: আমার মনে হয় তুমি মাসুদ চাচাকে খুব একটা পছন্দ কর না।
নিজের চোখা নাকটা আঙুল দিয়ে ঘষে তিনি উত্তর দিলেন: ও একটা অপদার্থ, অকর্মন্য। আমি এ ধরনের মানুষ মোটেই পছন্দ করিনা।
আমি বললাম: অকর্মন্য মানুষ আবার কেমন হয়?
মাথা নিচু করে দাদা কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। তারপর সামনের বিস্তৃত মাঠের দিকে তাকিয়ে বললেন: মরুভূমির শেষ প্রান্ত থেকে নীল নদের তীর পর্যন্ত ঐ বিশাল জমিন দেখছিস তো? একশ একর। আর ঐ যে খেজুর বাগান? সারি সারি বৃক্ষ? ওগুলো একদিন মাসুদের ছিলÑ উত্তরাধীকার সূত্রে সে তার বাবার কাছ থেকে পেয়েছিল এসব। দাদা আরো কিছুক্ষণ নিরব রইলেন। তার এই নিরবতার সুযোগে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের দিকে আমি কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। নিজেকে বলতে থাকলাম: এই খেজুর বাগান, এই বৃক্ষরাজি কিংবা এই এবড়ো-থেবড়ো জমির মালিক যেই হোক না কেন আমি তার তোয়াক্কা করিনা। এই জমিন আমার খেলার মাঠ, আমার স্বপ্ন।
কিছুক্ষণ পর নিরবতা ভেঙ্গে দাদা বললেন: হ্যাঁ দাদু, চল্লিশ বছর আগে এসবই মাসুদের ছিল। কিন্তু আজ এসবের বারো আনাই আমার।
দাদার এই কথাগুলো আমার কাছে একেবারেই নতুন ছিল। কারণ আমার ধারণা ছিল, দুনিয়া সৃষ্টির পর থেকেই এই সব জমির মালিক আমার দাদা।
‘এ গায়ে আমি যখন প্রথম আসি তখন আমার এক বিঘা জমিও ছিল না। এই সব সম্পদের মালিক ছিল মাসুদ। কিন্তু অবস্থা এখন বদলে গেছে। আর আমার ধারণা, আল্লাহপাক আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে যাবার আগেই বাকি চার আনার মালিকও আমি হয়ে যাব।’
আমি বলতে পারবো না, এই কথা শুনার পর কেন আমি ভয় পেয়ে গেলাম আর মাসুদ চাচার জন্য কেনই বা আমার মায়া হলো। কেন যেন মনে হল, দাদা যা বললেন তা করার সুযোগ যেন তিনি না পান। আমার স্মৃতিপটে ভেসে উঠল সুরেলা কন্ঠে মাসুদ চাচার গান গাওয়ার দৃশ্য। তার চমৎকার কন্ঠ আর আকর্ষনীয় হাসি যেন বয়ে চলা নদীর কুলকুল ধ্বনি। অথচ দাদাকে আমি কখনও হাসতে দেখিনি।
আমি দাদার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, মাসুদ চাচা কেন তার জমি বিক্রি করে দিয়েছিল।
‘নারী।’ দাদার মুখে নারী শব্দটা শুনে আমার মনে হয়েছিল এ যেন ভয়ানক একটা কিছু। তিনি বললেন, মাসুদ জীবনে বহুবার বিয়ে করেছে। আর বিয়ের খরচ জোগাতে প্রতিবারই দুই-এক একর করে প্রায় সব জমিই ও আমার কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। দাদার কথা শুনেই আমি চট করে একটা হিসেব কষে ফেললাম। এ কথা যদি সত্য হয় তবে মাসুদ চাচার তো এতোদিনে নব্বইটা বিয়ে করার কথা! আমার তখন মনে পড়ে গেল তার তিন স্ত্রী, মলিন চেহারা, হাতা ছেড়া জোব্বা, তার খোড়া গাধা ও সেটার এবড়ো-থেবড়ো জীনের কথা। কিন্তু আমার মনের দুয়ারে ভিড় করা এসব দৃশ্য চট করেই উবে গেল যখন দেখলাম মাসুদ চাচা আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছেন। হঠাৎ তাকে আসতে দেখে আমি আর দাদা মুখ চাওয়া-চাওয়ী করলাম।
মাসুদ চাচা দাদাকে বললেন, আমারা আজকে গাছ থেকে খেজুর পাড়বো। আপনি থাকবেন না?
যদিও আমার মনে হচ্ছিল, তিনি মন থেকে চাচ্ছেন না দাদা সেখানে যাক। কিন্তু দাদা ধপ করে উঠে দাঁড়ালেন। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম, তার চোখযুগল প্রচন্ড উজ্জ্বল হয়ে ওঠেছে। দাদা আমার হাত ধরে টান দিলেন; আমরা মাসুদে চাচার খেজুর বাগানের দিকে এগিয়ে চললাম।
বাগানে যাবার পর কেউ একজন দাদাকে একটা মরিচা ধরা টুল এগিয়ে দিল। দাদা বসলেন আর আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। সেখানে অনেক লোক ছিল। তাদের প্রায় সবাইকেই আমি চিনতাম। কিন্তু কোন এক কারণে সবকিছু বাদ দিয়ে আমি মাসুদ চাচার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ভিড় থেকে খানিক দূরে তিনি এমন নিস্পৃহভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন যেন তার কিছুই করার নেই। অথচ যে বাগান থেকে খেজুর পেড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেটা তার! তবে হঠাৎ খেজুরের বড় কোন কাদি পড়ার শব্দ হলেই তিনি সেদিকে দৃষ্টি ফেরাতেন। একবার এক বাচ্চা ছেলেকে লক্ষ্য করে বেশ উঁচু গলাতেই তিনি বললেন: সাবধান! গাছের হৃদয়টা আবার কেটে ফেলনা যেন। কিন্তু আশ্চর্য, ছেলেটা তার কথায় কান-ই দিলনা। ধারালো কাস্তে দিয়ে সে আগের মতই একের পর এক খেজুরের কাদি কেটে চলল। গাছ থেকে অঝোরে খেজুর পড়া দেখে আমার মনে হলো, যেন আসমান থেকে পড়ছে।
সে যাই হোক, অন্য সব কিছু বাদ দিয়ে আমি মাসুদ চাচার শব্দটা নিয়ে ভাবতে শুরু করলামÑ গাছের হৃদয়! আমি এমন এক খেজুর গাছ কল্পনা করলাম যার অনুভূতি আছে, যার হৃদয় আছে, যে হৃদয়ের স্পন্দন আছে। এসব ভাবতে গিয়ে মাসুদ চাচার আরো একটি কথা আমার স্মৃতিতে কড়া নাড়লো। একবার ছোট একটা খেজুর গাছের ডাল ভেঙ্গে আমাকে খেলা করতে দেখে তিনি বলেছিলেন: ‘শোন বাবা! খেজুর গাছও মানুষের মত। তাদেরও সুখ আছে, যন্ত্রণা আছে।’ মাসুদ চাচার এই কথা শুনে আমি বেশ বিব্রত বোধ করেছিলাম।
হৃদয়ের অন্তঃপুর থেকে নিজেকে মুক্ত করে আমি আবারো সামনের খোলা প্রান্তরের দিকে ফিরে তাকালাম। আমার খেলার সাথীরা পিপড়ের মত খেজুর গাছের নিচে ভিড় করে আছে। কুড়িয়ে পাওয়া খেজুরগুলো বেশ মজা করেই খাচ্ছিল ওরা। এরইমধ্যে গাছ থেকে পেড়ে আনা সব খেজুর টিলার মত ¯তূপ করে রাখা হয়েছিল। একটি টিনের কৌটা দিয়ে মেপে মেপে বেশ কয়েকজন খেজুরগুলো বস্তায় ভরছিল। মোট তিরিশটি বস্তা ছিল। খানিক বাদেই একে একে প্রায় সবাই চলে গেল। আমাদের সাথে শুধু থেকে গেল ব্যবসায়ী হুসেন আর মুসা নামক একজনÑ পুব দিকে আমাদের জমি ঘেষেই তার কিছু জমি আছে। আরো দু’জন লোক ছিল তবে এর আগে আমি তাদের কখনও দেখিনি।
হঠাৎই মৃদু শিস ধ্বনি কানে এলো। লক্ষ্য করে দেখলাম, দাদা বসে বসেই ঘুমাচ্ছেন। আর মাসুদ চাচার একলা দাঁড়িয়ে থাকার মধ্যেও কোন পরিবর্তন হয়নি। তবে এই ক্ষণে তিনি খেজুরের একটি ডাল মুখে দিয়ে আনমনে চিবাচ্ছেন। মনে হচ্ছিল, মুখভর্তি এই খাবার দিয়ে তিনি কী করবেন তা ঠিক বুঝতে পারছেন না।
দাদা হুট করে জেগে উঠলেন। আগের মত ধপ করে দাঁড়িয়েই তিনি খেজুরের বস্তার দিকে হাঁটা শুরু করলেন। তার পিছু পিছু হুসেন, মুসা আর সেই দুই আগন্তুক বস্তার দিকে এগিয়ে গেল। মাসুদ চাচা কী করেন তা দেখতে তার দিকে মুখ ফিরালাম। তিনি খুব ধীরে ধীরে দাদার দিকে এগিয়ে গেলেন। তার এই পথচলা দেখে আমার মনে হলো, তিনি এমন একজন মানুষ যিনি পিছু হটতে চান কিন্তু তার পা দুটো তাকে টেনে সামনে নিয়ে যায়। সবাই বস্তাগুলোর চারিদিকে গোল হয়ে দাঁড়ালো। কেউ কেউ দু’ একটা খেজুর খাবার জন্যে হাতে তুলে নিলো। বস্তা থেকে এক মুঠ খেজুর তুলে দাদা আমাকে দিলেন। আমি মজা করে সেগুলো চিবুতে থাকলাম। আর মাসুদ চাচা তার দুই হাত ভরে খেজুর তুলে সেগুলোর ঘ্রাণ নিলেন। তারপর এমনভাবে বস্তায় রেখে দিলেন, যেন এর চেয়ে বেশি কিছু করার অধিকার তার নেই।
বস্তাগুলো ভাগ করা হলো। হুসেন নিল দশটি, দুই আগন্তুক আর মুসাকে দেয়া হলো পাঁচটি করে। আর দাদা নিলেন বাকি পাঁচটি। কিছু বুঝতে না পেরে আমি মাসুদ চাচার দিকে তাকালাম। তার চোখ দুটো এমনভাবে ডানে-বামে নড়াচড়া করছিল যেন পথহারা দুটি ইঁদুর।
মাসুদ চাচাকে দাদা বললেন, ‘তোমার কাছে আরো পঞ্চাশ পাউন্ড খেজুর পাওনা রইলো। আমরা পরে এ নিয়ে কথা বলবো।’
হুসেন তার লোকজনকে ডাক দিতেই তারা কতগুলো গাধা নিয়ে হাজির হলো। আর আগন্তুক দুজন তাদের উটের পিঠে নিজ নিজ বস্তাগুলো তুলে দিলো। একটা গাধার কর্কশ চিৎকারে উটগুলো এমনভাবে মুখে ফেনা তুললো যেন তারা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে। আমি লক্ষ্য করলাম, নিজের অজান্তেই আমি মাসুদ চাচার কাছে এগিয়ে যাচ্ছি। আমার হাত তার দিকে এমনভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল যেন আমি তার জোব্বার ঝুলন্ত হাতা স্পর্শ করতে চাচ্ছি। তার গলায় ঘড়ঘড় শব্দ হলো, সাধারণত ভেড়া জবাই করলে যেমনটা হয়। কোন এক অজানা কারণে আমি বুকে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করলাম।
আমি দৌড়ে অনেকখানি দূরে চলে এলাম। পেছন থেকে দাদার ডাক শুনে কিছুটা দ্বিধান্বিত হলেও আমি দৌড় থামালাম না। ঐ মুহূর্তে আমার মনে হলো, আমি দাদাকে ঘৃণা করি। আমি এতো জোড়ে দৌড়াচ্ছিলাম, যেন কেউ একজন আমার ঘাড়ে প্রচন্ড ভারি এক বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে আর আমি তা থেকে মুক্তি চাইছি। দৌড়াতে দৌড়াতে আমি আমার প্রিয় নদীর সেই বাঁকের কাছে এসে দঁড়ালাম যেখান থেকে অ্যাকাশিয়ার অরণ্যে সে হারিয়ে গেছে। গলায় আঙুল ঢুকিয়ে আমি বমি করলাম, দাদার দেয়া যে খেজুর আমি খেয়েছিলাম তার সবটুকু পেট থেকে বেড় হয়ে গেল। কিন্তু আমি কেন এমন করলাম সে প্রশ্নের জবাব আমার জানা নেই।
লেখক পরিচিতি: আল তায়্যিব সালেহ এর জন্ম উত্তর সুদানের কারমকল নামক স্থানে ১৯২৯ সালের ১২ জুলাই। তার বহুল পঠিত ও বহুল আলোচিত উপন্যাস ‘মাইগ্রেশন টু দ্য নর্থ’ প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালে যা প্রকাশিত হবার পরপরই অনূদিত হয় ৩০টিরও বেশি ভাষায়। মূলত এই উপন্যাসের মাধ্যমেই তিনি আরোহণ করেন খ্যাতির স্বর্ণচূড়ায়। ২০০১ সালে ‘আরব লিটারারি সোসাইটি’ এই উপন্যাসকে আখ্যায়িত করে ‘বিংশ শতকের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস’ হিসেবে। শুধু তাই নয়, ২০০২ সালে ‘নরওয়েজিয়ান বুকস্ ক্লাব’ কর্তৃক প্রকাশিত ‘বিংশ শতকের ১০০টি সেরা উপন্যাস’ এর তালিকাতেও স্থান করে নেয় তায়্যিব সালেহর ‘মাইগ্রেশন টু দ্য নর্থ’। তার ছোটগল্প ‘দ্য ওয়েডিং অব জেইন’ অবলম্বনে নির্মিত চলচিত্র ১৯৭৬ সালে লাভ করে ‘কান ফিল্ম ফেস্টিভাল অ্যাওয়ার্ড’। তায়্যিব সালেহ এর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ছোটগল্প হলো: দোমা ওয়াদ হামাদ, দাও আল বাইয়াত, সিপ্রিয়েট ম্যান এবং বান্দারশাহ। অনূদিত এই গল্পটি আরবি ভাষায় প্রকাশিত হয় ১৯৬৪ সালে।
তায়্যিব সালেহর মুত্যু ২০০৯ সালের ১৮ ফেব্র“য়ারি লন্ডনে।
নিজার কাব্বানি এর কবিতাঅনুবাদ : বিদ্যুত খোশনবীশ
[নিজার কাব্বানি (আমাদের দেশীয় উচ্চারণ নাজির কাব্বানি) প্রখ্যাত সিরিয়ান কবি ও কূটনীতিক। জন্ম দামেস্কের এক বণিক পরিবারে ১৯২৩ সালে। ব্যবসা-বাণিজ্য তাঁদের পারিবারিক পেশা হলেও দাদা বিখ্যাত নাট্যকার আবু খলিল আল-কাব্বানির প্রভাবে ছোট বেলা থেকেই কাব্য চর্চার সুযোগ ঘটে তাঁর। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় ১৯৪২ সালে ১৯ বছর বয়সে কাব্বানি প্রকাশ করেন তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘শ্যামা বলেছিল’। নারী দেহের বর্ণনায় পরিপূর্ণ এই গ্রন্থটি সে সময় রক্ষণশীল সিরিয়ায় প্রচন্ড আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। গ্রন্থটির কারণে কাব্বানি তরুণ প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। পরবর্তীতে নারী স্বাধীনতা, প্রেম, যৌনতা আর রাজনীতি হয়ে ওঠে তাঁর লেখার মূল উপজীব্য। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বাঁধা ডিঙিয়ে নারী মুক্তির পক্ষে তিনি ছিলেন উচ্চকন্ঠ। ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত ‘স্তনের শৈশব’ কাব্যগ্রন্থটি তাঁর খ্যাতি আরো বাড়িয়ে দেয়। তাঁর বহু কবিতা সঙ্গীত হিসেবে জনপ্রিয়তা পায় সিরিয়া, লেবানন ও অন্যান্য আরব রাষ্ট্রগুলোতে। আরবদের অসচেতন ও হেয়ালীপূর্ণ জীবনধারার বিরুদ্ধে নিজার কাব্বানির ছিল সুস্পষ্ট অবস্থান। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই রাষ্ট্রদূত থাকাকালীন তিনি রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘রুটি, হাশিশ ও চাঁদ’। প্রতিক্রিয়ায় সরকার তাঁর পদমর্যাদা হ্রাস করলে রাষ্ট্রদূতের চাকরি হারাতে হয় তাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালে চাকরি থেকে অবসর নেবার পর তিনি নিজেকে সম্পৃক্ত করেন প্রকাশনা ব্যবসায়। ১৯৮১ সালে এক বোমা হামলায় স্ত্রী বিলকিস নিহত হবার পর কাব্বানি চলে যান প্যারিসে ও পরে লন্ডনে। ১৯৯৮ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লন্ডনেই তিনি অতিবাহিত করেন জীবনের ১৫টি বছর।
৭৫ বছরের দীর্ঘ জীবনে নিজার কাব্বানি রচনা করেছিলেন ৩৪টি কাব্যগ্রন্থসহ পঞ্চাশটিরও বেশি গ্রন্থ। স্তনের শৈশব (১৯৪৮), সাম্বা (১৯৪৯), ক্রুদ্ধ কবিতা (১৯৭০), ১০০টি প্রেমপত্র (১৯৭০), প্রেমিকের অভিধান (১৯৮১) তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ।]
জেরুজালেম
জেরুজালেম: পয়গম্বরের আলোকোজ্জ্বল নগরী,
স্বর্গ ও পৃথিবীর সংক্ষিপ্ত সেতুবন্ধ!
জেরুজালেম: হে অগণন মিনারের নগরী,
তুমি আজ আঙুল পোড়া অপরূপ কিশোরী।
হে কুমারীর নগরী, তোমার চোখযুগল আজ বিমর্ষ।
তোমার ছায়াচ্ছন্ন মরুদ্যানÑ যেখান দিয়ে অতিক্রম করেছিলেন পয়গম্বর,
আর পথের পাথরগুলোও আজ বিমর্ষ।
তোমার মসজিদের মিনারগুলো আনত, অবসাদগ্রস্ত।
তুমি আজ আঁধারাবৃত বিরানভূমি,
পুণ্যসমাধিতে কে বাজাবে ঘন্টা রোববার সকালে?
বড়দিনের আগে শিশুদের হাতে কে তুলে দেবে খেলনা?
হে বিষাদের নগরী, তোমার চোখের কোণে
এক বিশাল অশ্র“বিন্দু কেঁপে কেঁপে ওঠছে।
কে রক্ষা করবে বাইবেল?
কে রক্ষা করবে কোরান?
কে রক্ষা করবে যিশুকে, মানবসত্তাকে?
হে জেরুজালেম, আমার প্রাণপ্রিয় নগরী,
আগামীকাল তোমার লেবু গাছগুলোতে ফুল ফুটবে।
তোমার শস্যের সবুজ ডাটা আর বৃক্ষের ডালপালা
জেগে ওঠবে সানন্দে, হেসে ওঠবে তোমার বিমর্ষ চোখযুগল।
অভিবাসী কবুতর ফিরে আসবে তোমার পবিত্র গৃহ-চূড়ায়,
শিশুরা ফিরে যাবে খেলার মাঠে।
তোমার মা, তোমার পিতা আর তোমার শিশুদের
একসাথে চোখে পড়বে মুক্ত রাজপথে।
হে জেরুজালেম,
হে আমার নগরী,
হে জলপাই ও শান্তির নগরী।
যখন প্রেম করি
যখন প্রেম করি
মনে হয়, আমিই এ কালের মহারাজা।
পৃথিবী আর তার সবকিছু আমারই করায়ত্তে,
আমি দুরন্ত ঘোড়া ছুঁটাই সূর্যের দিকে।
যখন প্রেম করি
হয়ে ওঠি নির্মল অদৃশ্য আলো।
আর ডায়েরির কবিতাগুলো হয়ে ওঠে
থোকা থোকা মিমোসা আর পপির বাগান।
যখন প্রেম করি
আমার আঙুল চিরে জলের উচ্ছ্বাস ছোটে,
জিভে জন্মায় ঘাস।
যখন প্রেম করি
হয়ে উঠি সময়-ছিন্ন এক সময়।
যখন নারীর সাথে প্রেম করি
নগ্ন পায়ে আমার দিকে ছুটে আসে
পৃথিবীর সমস্ত বৃক্ষ।
আমি জানতাম
আমি জানতাম,
আমরা যখন একত্রে স্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিলাম
তুমি অন্য এক পুরুষের জন্য অপেক্ষা করছিলে।
তোমার ব্যাগগুলো যখন বয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম
আমি জানতাম,
তুমি অন্য এক পুরুষের সাথে ভ্রমণ করবে।
আমি জানতাম,
গ্রীষ্মের খরতাপ থেকে বাঁচার জন্য
তোমার ঐ পরিবর্তনশীল চীনা হাতপাখার চেয়ে
আমার মূল্য এখন খুব একটা বেশি নয়।
আমার আরো জানা ছিল,
তোমাকে লেখা আমার প্রেমপত্রগুলো
তোমার অহংকার প্রতিফলিত করার আয়নার চেয়ে
বেশি কিছু নয়।
তা সত্বেও,
আমি বয়ে নিয়ে যাব তোমার
এবং তোমার প্রেমিক পুরুষের ভারি ব্যাগগুলো।
কারণ আমি সেই নারীকে চপেটাঘাত করতে পারি না
যে তার সাদা হাতব্যাগে এখনও বহন করছে
আমার জীবনের মধুর দিনগুলো।
লন্ঠনের চেয়ে আলোর মূল্য বেশি
লন্ঠনের চেয়ে আলোর মূল্য ঠের বেশি,
কবিতার খাতা নয়, মূল্য বেশি কবিতার,
আর ঠোঁটের চেয়ে মূল্যবান তার চুম্বন।
তোমাকে লেখা আমার চিঠিগুলো
আমাদের দু’জনের চেয়েও বেশি মূল্যবান।
এগুলোই একমাত্র দলিল,
যেখানে অন্যেরা খুঁজে পাবে
তোমার সৌন্দর্য
আর আমার পাগলামী।
পঙতি
১.
বন্ধুগণ!
পুরনো শব্দের মৃত্যু হয়েছে।
মৃত্যু হয়েছে পুরনো গ্রন্থগুলোর।
ছেড়া জুতোর মত আমাদের কথামালাও এখন মৃত।
যে হৃদয় আমাদের টেনে নিয়েছিল পরাজয়ের দিকে
মৃত্যু হয়েছে তারও।
২.
আমাদের কবিতা পচে গেছে।
পচে গেছে নারীর চুল, রাত্রি, পর্দা ও সোফাগুলোও
সবকিছুই পচে গেছে।
৩.
হে আমার দুখী দেশ!
পলকেই তুমি বদলে দিয়েছ আমাকে,
যে আমি এক সময় প্রেমের কবিতা লিখতাম
সেই আমি এখন কবিতা লিখি চাকু দিয়ে।
৪.
আমাদের অনুভূতি প্রকাশের সামর্থ্য শব্দেরও নেই:
এমন কবিতার জন্য আমাদের লজ্জিত হওয়া উচিত।
৫.
প্রাচ্যের ফাঁকা বুলি
আর সদম্ভ আস্ফালনে উত্তেজিত হয়ে আমারা যুদ্ধে গিয়েছিলাম,
অথচ এগুলো কখনো একটি মাছিও হত্যা করেনি।
আমরা যুদ্ধে গিয়েছিলাম
কিছু বাদ্যযন্ত্র আর দামামার উত্তেজনায়
এবং পরাজিত হয়েছিলাম।
৬.
আমাদের চিৎকার ধ্বনি আমাদের কর্মের চেয়েও উচ্চতর।
আমাদের তরবারি দৈর্ঘ্যে আমাদের চেয়েও বড়।
এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য।
৭.
এক কথায়,
আমরা পরিধান করি সভ্যতার অন্তরীপ
অথচ আমাদের আত্মা বাস করে প্রস্তর যুগে।
৮.
সামান্য একটি ফাঁপা নল এবং বাঁশি দিয়ে
তুমি যুদ্ধে জয়ী হতে পারনা।
৯.
আমাদের অধৈর্যের খেসারত
পঞ্চাশ হাজার নতুন তাবু।
১০.
বিধাতা যদি তোমাকে পরিত্যাগ করে
তবে তুমি তাকে অভিশাপ দিও না।
তুমি পরিস্থিতিকে অভিশাপ দিও না,
ঈশ্বর যাকে ইচ্ছা তাকেই বিজয়ী করেন।
ঈশ্বর তো আর কামার নন যে তিনি তোমাকে তরবারি গড়ে দেবেন।
১২.
শত্র“রা আমাদের সীমান্ত অতিক্রম করেনি।
আমাদের দুর্বলতা দিয়ে তারা পিপড়ের মত সংগোপনে প্রবেশ করেছিল।
১৩.
পাঁচ হাজার বছর গুহাবাসে
আমাদের দাড়ি গজিয়ে গেছে।
আমাদের প্রচলিত জীবন এখনো অজানা।
আমাদের চোখগুলো মাছিদের স্বর্গরাজ্য।
বন্ধুগণ,
দরজা ভেঙ্গে ফেল,
তোমাদের মস্তিস্ক পরিস্রুত কর,
তোমাদের পোশাক ধৌত কর।
বন্ধুগণ,
বই পড়,
বই লিখ,
শব্দের আবাদ কর, আবাদ কর ডালিম আর আঙুর।
পাড়ি জমাও তুষার আর কুয়াশার রাজ্যে।
গুহার ভেতর তোমাদের অস্তিত্বের খবর কেউ জানেনা।
মানুষ তোমাদের সংকর জাতের কুকুর জ্ঞান করে।
১৪.
শূন্য আত্মার মোটা চামড়ার মানুষ আমরা ।
আমরা দিন গুজরান করি ডাকিনী চর্চায়,
ঘুমিয়ে আর দাবা খেলে।
আমরাই কি সেই জাতি,
‘ঈশ্বর যাদের প্রেরণ করেছিলেন মানব জাতির আশীর্বাদ স্বরূপ?’
১৫.
আমাদের মরুভূমির তেল হতে পারতো
আগুনের খঞ্জর।
আমরাই আমাদের সম্ভ্রান্ত পূর্ব পুরুষের লজ্জা:
আমরাই আমাদের তেলকে প্রবাহিত হতে দিয়েছি
বেশ্যার পায়ের আঙুলের ফাঁক দিয়ে।
১৭.
ক্ষতির আশঙ্কা নেই জানলে
এবং সুলতানের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পেলে
আমি তাকে বলতাম:
‘সুলতান!
আপনার বন্য কুকুরগুলো আমার কাপড় ছিড়ে ফেলেছে,
আপনার গুপ্তচরেরা আমাকে অনুসরণ করেছ,
ওদের চোখ আমাকে অনুসরণ করেছে,
ওদের নাখ আমাকে অনুসরণ করেছে,
ওদের পা আমাকে অনুসরণ করেছে,
ওরা আমাকে অনুসরণ করেছে নিয়তির মত।
ওরা আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে,
আমার বন্ধুদের নাম লিখে নিয়েছে।
সুলতান!
আপনার প্রাসাদ প্রাচীরের কাছে দাঁড়িয়ে
আমি যখন আমার যন্ত্রণার কথা বলেছিলাম
আপনার সৈন্যরা আমাকে বুট দিয়ে আঘাত করেছে,
আমাকে জুতো কামড়ে খেতে বাধ্য করেছে।
সুলতান!
আপনি দু’টি যুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন।
সুলতান!
আমাদের অর্থেক জনতার জিভ নেই,
জিভহীন জনতার কী মূল্য আছে?
আমাদের অর্ধেক জনতা পিপড়া আর ইঁদুরের মত
দুই দেয়ালের মাঝে বন্দি।’
যদি জানতাম আমার কোন ক্ষতি হবে না,
তবে বলতাম:
‘আপনি দু’টি যুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন।
আপনি শিশুদের স্পর্শ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।’
২০.
আরব শিশুগণ,
তোমরাই ভবিষ্যতের মঞ্জরি।
তোমরাই শিকল ভাঙ্গবে,
তোমরাই নাশ করবে আমাদের মস্তিস্কের আফিম,
আমাদের ভ্রান্তি।
আরব শিশুগণ,
এই শ্বাসরুদ্ধ প্রজন্মের ইতিহাস পাঠ করো না,
আমরা এক আশাহীন অনুষঙ্গ।
তরমুজের খোসার মতই আমরা মূল্যহীন।
আমাদের বৃত্তান্ত পাঠ করো না।
আমাদের অনুকরণ করো না,
আমাদের গ্রহণ করো না,
গ্রহণ করো না আমাদের চিন্তাকে।
আমরা কপোট ও বাজিকরের জাতি।
আরব শিশুগণ,
বৃষ্টি ঝরাও।
ও হে ভবিষ্যতের মঞ্জরি,
তোমরাই সেই প্রজন্ম
যারা পরাজয়কে পরাভূত করবে।
ফুয়াদ রিফকার কবিতা
অনুবাদ : বিদ্যুত খোশনবীশ
ভূমিকা ও অনুবাদ: বিদ্যুত খোশনবীশ
গেল শতকের পঞ্চাশের দশকে বৃহত্তর আরব ভূখন্ডে চলছিল ভৌগলিক স্বাধিনতা প্রাপ্তি কিংবা অর্জনের সংগ্রাম। আর এই সংগ্রামের পাশাপাশি শুরু হয়েছিল বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধিনতা অর্জনের বিলম্বিত প্রয়াস। সূত্রপাত হয়েছিল স্থবির আরবি সাহিত্যের নতুন গতিপথ নির্ধারণের দুস্তর প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে। এই প্রচেষ্টায় লেবানিজ কবি ইউসিফ আল-খাল এবং সিরিয়ান কবি অ্যাডোনিসের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন আরো একজন মহানায়কÑ তিনি ফুয়াদ রিফকা। এঁদের হাত দিয়েই উন্মোচিত হয় আরবি সাহিত্যের নতুন দিগন্ত।
ফুয়াদ রিফকার জন্ম সিরিয়ার প্রত্যন্ত এক গ্রাম কাফরুনে, ১৯৩০ সালে। পরবর্তীতে পরিবারের সাথে তিনি স্থানান্তরিত হন লেবাননে। বৈরুত বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন অধ্যয়নের পর মার্টিন হাইডেগারের উপর গবেষণার জন্যে জার্মানীর তুবেনজেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৬৫ সালে। ১৯৬৬ সাল থেকে দর্শনের অধ্যাপক হিসেবে তিনি কর্মরত রয়েছেন বৈরুতের লেবানিজ-আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে। রিফকার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৬১ সালে। এযাবৎ তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ১৩। এছাড়াও, জার্মান ও ইংরেজি ভাষার বহু মূল্যবান গ্রন্থ আরবিতে অনুবাদ করে আরবি সাহিত্যকে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন।
তত্ত্ব
সে খুলে দেয় মস্তিস্কের জানালা
ঈশ্বর অপসৃত হন দূরে,
হয়ে ওঠেন শুকনো মেঘ।
সে খুলে দেয় হৃদয়ের জানালা
নিকটবর্তী হন ঈশ্বর।
ছুঁয়ে দেন তার চোখের পাপরি;
বিষণœ চোখে জ্বেলে দেন লন্ঠন,
স্থিত হন অনন্ত জাগরণে।
অবিরাম সূর্যোদয়
এখানে রাত্রিবেলায়
সূর্য আলোকিত করে ককেসাসকে।
ককেসাসে রাত্রিবেলায়
সূর্য আলোকিত করে আলাস্কাকে।
আলাস্কাতে রাত্রিবেলায়
সূর্য আলোকিত করে হিমালয়কে।
হিমালয়ে রাত্রিবেলায়
সূর্য আলোকিত করে অলিম্পাসকে।
অলিম্পাসে রাত্রিবেলায়
সূর্য আলোকিত করে সিনাইকে।
প্রতিটি রাত্রে
অবিরাম চলে সূর্যোদয়।
দ্যুতি
উপত্যকার অন্ধকারে
অগভীর স্রোতস্বিনী নিবুনিবু জ্বলে।
শিকরের অন্ধকারে
বৃক্ষের ফল ঝলমল করে।
গুহার অন্ধকারে
ঝলসে ওঠে লন্ঠন।
জখমের অন্ধকারে
আমাদের বন্দনাগীত দ্যুতি ছড়ায়।
উপগ্রহ
ক্ষুধার্ত দেহ
কোথাও নেই গমের ডাটা।
তৃষ্ণার্ত দেহ
কোথাও নেই জলের ফিসফিস।
নগ্ন দেহ
ডুমুর গাছে নেই কোন পাতা।
শীতল দেহ
এক টুকরোও কাঠ নেই উনুনে।
উপগ্রহের জানালা থেকে দৃশ্যগত:
ধূলা আঘাত হানছে নক্ষত্রের দেহে।
কানে কানে
পথিককে
কানে কানে বলে নদী:
আমিই পর্যটন।
নদীকে
কানে কানে বলে সমুদ্র:
আমিই তরি।
সমুদ্রকে
কানে কানে বলে দূর:
আমিই কাপ্তান।
বিষণœতা
তার ডান হাতে চঞ্চল হয়ে উঠে সূর্য
বাম হাতে চাঁদ হয়ে উঠে সবুজ।
আর হৃদয়ে,
থিতু হয়েছে প্রেমের রাজকন্যা।
কিন্তু এই বিষণœতা,
কালো পাতার মত বিষণœতা!
কেন?
কোথা থেকে?
তীর
পৃথিবীর অন্ধকার থেকে
বাতাস ভেদ করে ছুটে চলে একটি তীর।
পথেই শুরু হয় কাঁপন,
জ্বলে উঠে অগ্নিশিখা,
এরপর দহন।
শেষতক শুধুই ছাই-ভস্ম।
তীর ও তার মধ্যে তবুও থেকে যায়
একটি সম্পর্কের জলছাপÑ পুরোনো বন্ধুত্ব।
সুখতারা
রাতের উপসংহার পর্বে
সে দৃষ্টিকে তুলে ধরে সুখতারার দিকে।
জানালা আলোকিত করে
তার দৃষ্টি বাকি রাতটুকু পার করে
একাকিত্বের সাথে।
আর সে, জানালা খোলা রেখে।
ওরা দু’জনেই বন্ধু,
মাঝে পুরো আকাশটা দাঁড়িয়ে।
মেঘ
এক টুকরো সাদা মেঘÑ আকাশে।
সে ভীতÑ জমিনে;
যদি মেঘটা ভেঙে পড়ে নিচে!
মেঘটা কি সত্যিই ভেঙ্গে পড়বে?
নাকি বাতাস তাকে তাড়িয়ে দেবে দূরে?
পৃথিবীর কোন এক নাম না জানা কোণে।
মেঘটি তাকে চেনে,
বন্ধ করে দেয় তার চোখ,
বন্ধ করে দেয় ঘরের দরজা।
ইচ্ছা
ক্ষুধার্তদের জন্য
এই কবিতাটি হয়ে উঠুক রুটি ও তেল,
তৃষ্ণার্তদের জন্যÑ ঠান্ডা জল।
পথিকের জন্য
কবিতাটি হয়ে উঠুক ঘর ও বাতি।
আর জীবনের জন্য,
এ কবিতা হয়ে উঠুক পদ্ম ও শিশির
কিংবা ফসলের স্তুপ।
কিনারা
অস্তিত্বের কিনারায় দাঁড়িয়ে
কেটে গেছে পুরো জীবনটা।
পকেটে একটি টিকেট।
সে জাহাজের অপেক্ষায়,
অপেক্ষায় সবুজ ইশারার।
বিস্ময়
বসন্তের রাত।
আকাশে হৃষ্টপুষ্ট চাঁদ,
নিচে একটি উৎফুল্ল পাথর ও
সরু স্রোতস্বিনীর মৃদু গুঞ্জন।
অথচ কী বিস্ময়কর প্রশ্ন ওদের:
‘‘কী হলো তোমার?’’
‘‘কিছু বলছো না কেন?’’
বিয়ে
জীবনের শীতল ঋতুতে
জানালার পাশে সে বসেছিল চেয়ারে।
ফাঁক গলিয়ে এ রাশ তুষার
জড়ো হয় তার পায়ে,
হামাগুড়ি দিয়ে শেষতক কোমর ও গ্রিবাদেশে।
অসহায় দেহটি তার থেমে আছে।
সে জানে, বড্ড দেরি হয়ে গেছে
বিয়ের ঋতুটা পড়ে আছে পেছনে।
রাত
সে জাল ফেলে তিমিদের গুহায়
তুলে দেয় পাল, জ্বেলে দেয় লন্ঠন।
তারপর,
ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়
এই পৃথিবীর রাতের নিস্তব্ধতায়।
দৃষ্টি
পুরোটা দিন
আকাশে উড়ে পাখি।
বিরাম কোথায়?
“বৃক্ষে”
বৃক্ষ কোথায়?
“মাঠে”
মাঠ কোথায়?
“অরণ্যের উত্তরে”
অরণ্য কোথায়?
“পর্বতের পুবে”
পর্বত কোথায়?
“আরে অন্ধ! ঐ তো ওখানে, দেখছিস না?”
হ্যাঁ, দেখছি তো।
আমি দেখছি প্রত্যাখ্যানের পর্বত,
যার ধোঁয়া ছড়ায় মাঠ আর বৃক্ষের ঘ্রাণ।
(বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্ত থেকে এক কন্ঠস্বর বলে):
“এই সমাগত বাতাস এক পূর্বাভাস। ঐ দিন নক্ষত্রলোকে,
মা স্মরণ করবে না তার সন্তানকে,
কিংবা আকাশ তার নক্ষত্রকে,
আর দুই ঋতুর মধ্যখানে,
সময় হবেনা পারাপারের।”
গেল শতকের পঞ্চাশের দশকে বৃহত্তর আরব ভূখন্ডে চলছিল ভৌগলিক স্বাধিনতা প্রাপ্তি কিংবা অর্জনের সংগ্রাম। আর এই সংগ্রামের পাশাপাশি শুরু হয়েছিল বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধিনতা অর্জনের বিলম্বিত প্রয়াস। সূত্রপাত হয়েছিল স্থবির আরবি সাহিত্যের নতুন গতিপথ নির্ধারণের দুস্তর প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে। এই প্রচেষ্টায় লেবানিজ কবি ইউসিফ আল-খাল এবং সিরিয়ান কবি অ্যাডোনিসের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন আরো একজন মহানায়কÑ তিনি ফুয়াদ রিফকা। এঁদের হাত দিয়েই উন্মোচিত হয় আরবি সাহিত্যের নতুন দিগন্ত।
ফুয়াদ রিফকার জন্ম সিরিয়ার প্রত্যন্ত এক গ্রাম কাফরুনে, ১৯৩০ সালে। পরবর্তীতে পরিবারের সাথে তিনি স্থানান্তরিত হন লেবাননে। বৈরুত বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন অধ্যয়নের পর মার্টিন হাইডেগারের উপর গবেষণার জন্যে জার্মানীর তুবেনজেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৬৫ সালে। ১৯৬৬ সাল থেকে দর্শনের অধ্যাপক হিসেবে তিনি কর্মরত রয়েছেন বৈরুতের লেবানিজ-আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে। রিফকার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৬১ সালে। এযাবৎ তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ১৩। এছাড়াও, জার্মান ও ইংরেজি ভাষার বহু মূল্যবান গ্রন্থ আরবিতে অনুবাদ করে আরবি সাহিত্যকে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন।
তত্ত্ব
সে খুলে দেয় মস্তিস্কের জানালা
ঈশ্বর অপসৃত হন দূরে,
হয়ে ওঠেন শুকনো মেঘ।
সে খুলে দেয় হৃদয়ের জানালা
নিকটবর্তী হন ঈশ্বর।
ছুঁয়ে দেন তার চোখের পাপরি;
বিষণœ চোখে জ্বেলে দেন লন্ঠন,
স্থিত হন অনন্ত জাগরণে।
অবিরাম সূর্যোদয়
এখানে রাত্রিবেলায়
সূর্য আলোকিত করে ককেসাসকে।
ককেসাসে রাত্রিবেলায়
সূর্য আলোকিত করে আলাস্কাকে।
আলাস্কাতে রাত্রিবেলায়
সূর্য আলোকিত করে হিমালয়কে।
হিমালয়ে রাত্রিবেলায়
সূর্য আলোকিত করে অলিম্পাসকে।
অলিম্পাসে রাত্রিবেলায়
সূর্য আলোকিত করে সিনাইকে।
প্রতিটি রাত্রে
অবিরাম চলে সূর্যোদয়।
দ্যুতি
উপত্যকার অন্ধকারে
অগভীর স্রোতস্বিনী নিবুনিবু জ্বলে।
শিকরের অন্ধকারে
বৃক্ষের ফল ঝলমল করে।
গুহার অন্ধকারে
ঝলসে ওঠে লন্ঠন।
জখমের অন্ধকারে
আমাদের বন্দনাগীত দ্যুতি ছড়ায়।
উপগ্রহ
ক্ষুধার্ত দেহ
কোথাও নেই গমের ডাটা।
তৃষ্ণার্ত দেহ
কোথাও নেই জলের ফিসফিস।
নগ্ন দেহ
ডুমুর গাছে নেই কোন পাতা।
শীতল দেহ
এক টুকরোও কাঠ নেই উনুনে।
উপগ্রহের জানালা থেকে দৃশ্যগত:
ধূলা আঘাত হানছে নক্ষত্রের দেহে।
কানে কানে
পথিককে
কানে কানে বলে নদী:
আমিই পর্যটন।
নদীকে
কানে কানে বলে সমুদ্র:
আমিই তরি।
সমুদ্রকে
কানে কানে বলে দূর:
আমিই কাপ্তান।
বিষণœতা
তার ডান হাতে চঞ্চল হয়ে উঠে সূর্য
বাম হাতে চাঁদ হয়ে উঠে সবুজ।
আর হৃদয়ে,
থিতু হয়েছে প্রেমের রাজকন্যা।
কিন্তু এই বিষণœতা,
কালো পাতার মত বিষণœতা!
কেন?
কোথা থেকে?
তীর
পৃথিবীর অন্ধকার থেকে
বাতাস ভেদ করে ছুটে চলে একটি তীর।
পথেই শুরু হয় কাঁপন,
জ্বলে উঠে অগ্নিশিখা,
এরপর দহন।
শেষতক শুধুই ছাই-ভস্ম।
তীর ও তার মধ্যে তবুও থেকে যায়
একটি সম্পর্কের জলছাপÑ পুরোনো বন্ধুত্ব।
সুখতারা
রাতের উপসংহার পর্বে
সে দৃষ্টিকে তুলে ধরে সুখতারার দিকে।
জানালা আলোকিত করে
তার দৃষ্টি বাকি রাতটুকু পার করে
একাকিত্বের সাথে।
আর সে, জানালা খোলা রেখে।
ওরা দু’জনেই বন্ধু,
মাঝে পুরো আকাশটা দাঁড়িয়ে।
মেঘ
এক টুকরো সাদা মেঘÑ আকাশে।
সে ভীতÑ জমিনে;
যদি মেঘটা ভেঙে পড়ে নিচে!
মেঘটা কি সত্যিই ভেঙ্গে পড়বে?
নাকি বাতাস তাকে তাড়িয়ে দেবে দূরে?
পৃথিবীর কোন এক নাম না জানা কোণে।
মেঘটি তাকে চেনে,
বন্ধ করে দেয় তার চোখ,
বন্ধ করে দেয় ঘরের দরজা।
ইচ্ছা
ক্ষুধার্তদের জন্য
এই কবিতাটি হয়ে উঠুক রুটি ও তেল,
তৃষ্ণার্তদের জন্যÑ ঠান্ডা জল।
পথিকের জন্য
কবিতাটি হয়ে উঠুক ঘর ও বাতি।
আর জীবনের জন্য,
এ কবিতা হয়ে উঠুক পদ্ম ও শিশির
কিংবা ফসলের স্তুপ।
কিনারা
অস্তিত্বের কিনারায় দাঁড়িয়ে
কেটে গেছে পুরো জীবনটা।
পকেটে একটি টিকেট।
সে জাহাজের অপেক্ষায়,
অপেক্ষায় সবুজ ইশারার।
বিস্ময়
বসন্তের রাত।
আকাশে হৃষ্টপুষ্ট চাঁদ,
নিচে একটি উৎফুল্ল পাথর ও
সরু স্রোতস্বিনীর মৃদু গুঞ্জন।
অথচ কী বিস্ময়কর প্রশ্ন ওদের:
‘‘কী হলো তোমার?’’
‘‘কিছু বলছো না কেন?’’
বিয়ে
জীবনের শীতল ঋতুতে
জানালার পাশে সে বসেছিল চেয়ারে।
ফাঁক গলিয়ে এ রাশ তুষার
জড়ো হয় তার পায়ে,
হামাগুড়ি দিয়ে শেষতক কোমর ও গ্রিবাদেশে।
অসহায় দেহটি তার থেমে আছে।
সে জানে, বড্ড দেরি হয়ে গেছে
বিয়ের ঋতুটা পড়ে আছে পেছনে।
রাত
সে জাল ফেলে তিমিদের গুহায়
তুলে দেয় পাল, জ্বেলে দেয় লন্ঠন।
তারপর,
ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়
এই পৃথিবীর রাতের নিস্তব্ধতায়।
দৃষ্টি
পুরোটা দিন
আকাশে উড়ে পাখি।
বিরাম কোথায়?
“বৃক্ষে”
বৃক্ষ কোথায়?
“মাঠে”
মাঠ কোথায়?
“অরণ্যের উত্তরে”
অরণ্য কোথায়?
“পর্বতের পুবে”
পর্বত কোথায়?
“আরে অন্ধ! ঐ তো ওখানে, দেখছিস না?”
হ্যাঁ, দেখছি তো।
আমি দেখছি প্রত্যাখ্যানের পর্বত,
যার ধোঁয়া ছড়ায় মাঠ আর বৃক্ষের ঘ্রাণ।
(বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্ত থেকে এক কন্ঠস্বর বলে):
“এই সমাগত বাতাস এক পূর্বাভাস। ঐ দিন নক্ষত্রলোকে,
মা স্মরণ করবে না তার সন্তানকে,
কিংবা আকাশ তার নক্ষত্রকে,
আর দুই ঋতুর মধ্যখানে,
সময় হবেনা পারাপারের।”
ইরানের কবি
ফরুঘ ফারুখজাদ এর কবিতা
অনুবাদ: বিদ্যুত খোশনবীশ
বিংশশতকে ইরানের সর্বাধিক আলোচিত ও প্রভাবশালী নারী কবি ও চলচিত্র নির্মাতা ফরুঘ ফারুখজাদ এর জন্ম তেহরানের একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে ১৯৩৫ সালে। তিনি ছিলেন নারীবাদী ও প্রথাবিরোধী। রক্ষণশীল ইরানি সমাজে এমন দৃষ্টিভঙ্গি তাকে করে তুলেছিল নিঃসঙ্গ ও বিতর্কিত, যা তার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনকে প্রভাবিত করেছিল মারাত্মভাবে।
ফরুঘ ফারুখজাদ ১৬ বছর বয়সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন লেখক পারভেজ শাপুর এর সাথে। কিন্তু মাত্র দুই বছর বাদেই বিচ্ছেদ ঘটে তাদের এবং আইনি লড়াইয়ে পরাজিত হয়ে একমাত্র পুত্র সন্তানের অভিভাবকত্বও ছেড়ে দিতে হয় তাকে। এই বিষাদময় ঘটনার এক বছর পর ১৯৫৫ সালে প্রকাশি হয় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বন্দী।’ জীবনের পরবর্তী অধ্যায়ে তিনি পরিচিত হন বিখ্যাত চলচিত্র নির্মাতা ইব্রাহিম গুলিস্তান এর সাথে। মূলত তার অনুপ্রেরণা এবং সহযোগিতাতেই ফরুঘ প্রবেশ করেন চলচিত্র জগতে। ১৯৬২ সালে তার নির্মিত ডুকুমেন্টারি ফিল্ম ‘দ্য হাউজ অব ব্ল্যাক’ অর্জন করে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক চলচিত্র পুরস্কার। ১৯৬৫ সালে ইউনেস্কো তার অনবদ্য জীবন ও সাহসী কর্মের স্বীকৃতি সরূপ নির্মান করে ১৫ মিনিটের একটি ডকুমেন্টারি। তাছাড়া তার উপর নির্মিত হয়েছে আরো বেশ কয়েকটি ডুকুমেন্টারি ফিল্ম।
ফরুঘ ফারুখজাদের মৃত্যু হয় ১৯৬৭ সালে একটি সড়ক দুর্ঘটনায়। তার এই স্বল্পদৈর্ঘ্য জীবনে তিনি রচনা করেছিলেন বেশ কয়েকটি আলোচিত ও সমালোচিত কাব্যগ্রন্থ যেগুলোর মধ্যে বন্দী (১৯৫৫), দেয়াল (১৯৫৬), বিদ্রোহ (১৯৫৭), আরেক জন্ম (১৯৫৯, মৃত্যুর পর প্রকাশিত) এবং পাপ উল্লেখযোগ্য।
শুক্রবার
নির্বাক শুক্রবার,
নিঃসঙ্গ শুক্রবার,
ধূলিধূসর পরিত্যাক্ত গলির মত দুখী
আমার শুক্রবার।
শুক্রবার,
রুগ্ন ও অলস চিন্তার শীতল একটি দিন;
সীমাহীন ও নিষ্ঠুর বিরক্তির স্যাঁতসেঁতে একটি দিন।
আমার শুক্রবার, দুঃখে পরিপূর্ণ,
আমার বিবর্ণ বিশ্বাস ও নিস্ফল প্রত্যাশার
শোকে কাতর একটি দিন।
আমার শুক্রবার…
দূরে বিলীয়মান একটি দিন।
শূন্য ঘর,
বিষণ্ন গৃহ!
এই আলোনিরোধক দেয়ালগুলো
আমাকে বিচ্ছিন্ন করেছে যৌবনের আঘাত থেকে।
এই পতনউন্মুখ ছাদ এখনো ঝুলন্ত
আমার আলোকস্পর্শী স্বল্পদৈর্ঘ্য দিবাস্বপ্নের উপর।
নিঃসঙ্গতা, স্মৃতি আর সন্দেহ ভরা এই ঘর,
রঙ, রূপ আর ইশারায় ঘেরা এই ঘর,
এরা প্রত্যেকেই এ ঘরের অপরাজেয় শূন্যতার কথা বলে।
আমার জীবন, রহস্যময় এক নদীর মত প্রবাহিত
ঐ নির্বাক, নিঃসঙ্গ দিনগুলোতে,
দারুণ এক নিরবতায়, প্রচন্ড অহংকার নিয়ে।
আমার জীবন, রহস্যময় এক নদীর মত প্রবাহিত
ঐ শূন্য, বিষণ্ন ঘরে,
দারুণ এক নিরবতায়, প্রচন্ড অহংকার নিয়ে।
বন্দী
না, তোমাকে আলিঙ্গন করতে পারবো না
তবুও তোমাকেই আমি কামনা করি।
তোমার বুক উজ্জ্বল নীলাকাশ
আর আমি খাঁচায় বন্দী এক পাখি।
নিরুত্তাপ এই বন্দীশালা থেকে
আলিঙ্গনের প্রচন্ড আকাক্সক্ষা নিয়ে আমি তোমাকে দেখি,
আর আশায় বুক বেধে থাকি,
হয়তো কোন একদিন একটি হাত
আমাকে মুক্তি দেবে তোমাকে পাবার জন্যে।
কোন এক অসতর্ক মুহূর্তে
আমি উড়াল দেব এই নিঝুম খাঁচা ছেড়ে
আর ছুড়ে দেব তাচ্ছিল্যের হাসি রক্ষীর সতর্ক চোখে।
তারপর, আমি তো তোমার পাশেই আছি।
এমন চিন্তাই অবিরত ঘুরপাক খায় মাথায়,
যদিও খাঁচা ছেড়ে পালাবার ইচ্ছাশক্তি আমার লোপ পেয়েছে,
এমনকি, খাঁচার রক্ষী যদি পালাবার পথ করে দেয়
উড়াল দেবার শক্তিটুকুও আমার অবশিষ্ট নেই।
প্রতিটি সকালে একটি শিশু
তার হাসি দিয়ে বরণ করে নেয় আমাকে,
বিনিময়ে আমি যখন গেয়ে উঠি
ওর কুঞ্চিত ঠোট আমাকে চুমু দিয়ে যায়।
হে ঈশ্বর! এই নিঃশব্দ খাঁচা ছেড়ে উড়াল দিলে
ওর কান্নার জবাবে আমি কী বলবো?
খাঁচার পাখিকে খাঁচাতেই মানায়।
মোমবাতির মত নিজের সত্তাকেই গিলে খাচ্ছি আমি
আর আলোকিত করছি আমার এই বন্দীশালাকে।
আর, আর আমার এই দহন যদি থেমে যায়!
তবে এ খাঁচার ধ্বংস অনিবার্য।
সেই দিনগুলো
নীল আকাশের চকচকে বুকে
উড়াল দেবার সেই দিনগুলি …
দেবদারু বনের সবুজ ঢেউ-এ দোল খাওয়ার দিনগুলি…
সেই রূপসী দিনগুলি, আফসোস, হারিয়ে গেছে।
তুষারঝরা বিষণ্ন দিনগুলি,
একাকী জানালায় বসে সাদা তান্ডব দেখার দিনগুলি…
আর আমার ভেতর থেকেও
ঝরে পড়তো নরম, রেশমী তুষার
পুরনো মইয়ের ওপর, কাপড় শুকোবার নরম দড়ির ওপর,
দেবদারুর নগ্ন ডালের ওপর,
ধীরে, খুব ধীরে ধীরে।
আর আমি আগামীকালের কথা ভাবতাম।
আহ! আগামীকাল…
জানি, ওটা শুরু হবে আমার মায়ের পায়ের শব্দের আহ্বানে,
ওই রূঢ় শব্দের উপদ্রব নিস্তেজ, নিস্তব্ধ ভোরের আলোকে
আরো একটু জীবন্ত করে তুলবে।
ওই দিনগুলিতে,
দ্বিধার পর্দা সরে যেতেই স্পষ্ট হতো
রঙিন দৃশ্যপটে বাকি রাতটুকুর তলিয়ে যাবার দৃশ্য।
আমি জানতাম, ওটাই সেই আগামীকাল।
আহ! আগামীকাল…
পাখিটা মরে যেতে পারে
আমি দুঃখিত,
আমি বিমর্ষ।
ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে নিরুত্তাপ আঙুলগুলো দিয়ে
ঘষে দিচ্ছি বোবা রাতের মসৃন খোলসটিকে।
রাস্তার বাতিগুলো নিভে আছে,
প্রতিটি গলিপথ অবরুদ্ধ।
কেউ আমাকে সূর্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে না,
কেউ আমাকে নিয়ে যাবে না ঝাঁকবাধা কুবুতরের কাছে।
উড়ালের ইতিহাস তাই অন্তরেই গেঁথে রেখো,
পাখিটা মরে যেতে পারে।
তেনজিন সুন্দু এর কবিতা
অনুবাদ: বিদ্যুত খোশনবীশ
কবি তেনজিন সুন্দু একজন তিব্বতি। জন্ম উত্তর ভারতের কোন এক উদ্বাস্তু শিবিরে। তাই তার জন্ম তারিখ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য নেই। তবে ভারতের বিভিন্ন সরকারী দপ্তরে তার তিনটি জন্ম তারিখ লিপিবদ্ধ আছে। ১৯৫৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ব্যর্থ হবার পর আরো হাজারো তিব্বতির মত সুন্দুর বাবা-মা পালিয়ে চলে আসেন ভারতে। মাসুমারি, বীর এবং মানালিতে পার্বত্য সড়ক নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে তারা কাজ করেন দীর্ঘ দিন। কিন্তু ভারতের বৈরী উষ্ণ আবহাওয়ায় শত শত তিব্বতির মৃত্যু হলে তার বাবা-মা শিশু সুন্দুকে নিয়ে চলে আসেন ধর্মশালায়। এখানেই শুরু হয় সুন্দুর স্কুল জীবন। পরবর্তীতে তিনি অধ্যয়ন করেন চেন্নাই ও মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন সহপাঠীদের কাছ থেকে অর্থ ধার করে তিনি প্রকাশ করেন তার প্রথম কাব্য ‘ক্রসিং দ্য বর্ডার’। এই গ্রন্থটির কারণেই আন্তর্জাতিক সমাজ ও নির্বাসিত তিব্বতিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন তিনি। তিব্বতের স্বাধীনতা প্রত্যাশী এই কবির দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘কোরা’ প্রকাশিত হবার পর তিনি হয়ে ওঠেন স্বাধীনতাকামী তিব্বতিদের অন্যতম মুখপাত্র। তিব্বতের স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে লেখা বিভিন্ন প্রবন্ধ নিয়ে সুন্দু তার তৃতীয় গ্রন্থ ‘শেমশুক’ প্রকাশ করেন ২০০৭ সালে।
তেনজিন সুন্দুর প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা তিনটি হলেও তার লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হয় ইন্টারন্যাশনাল পেন, ইন্ডিয়ান পেন, দি ইন্ডিয়ান লিটারারি প্যানারমা, আউটলুক, দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া, হিন্দুস্তান টাইমস, দ্য লিটল ম্যাগাজিন ও দি ইকোনোমিক টাইমস-এ। তেনজিন সুন্দু তার চমৎকার সাহিত্য দক্ষতার জন্য নন-ফিকশন ক্যাটাগরিতে ‘আউটলুক-পিকাডোর পুরস্কার’ লাভ করেন ২০০১ সালে। তাছাড়া ২০০৫ সালে নয়া দিল্লীতে অনুষ্ঠিত ‘দ্বিতীয় দক্ষিণ এশিয় সাহিত্য সম্মেলন’ এ তিনি তিব্বতের প্রতিনিধিত্ব করেন। কবি তেনজিন সুন্দু ‘ফ্রেইন্ডস অব তিব্বত’ এর ভারত শাখার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ১৯৯৯ সাল থেকে।
দিগন্ত
ঘর থেকে
তুমি পৌঁছে গেছ এই দিগন্ত পর্যন্ত।
এখান থেকেও তুমি চলে যাবে
অন্য দিগন্তে।
সেখান থেকে আরেক দিগন্তে,
দিগন্ত থেকে দিগন্তে।
তোমার প্রতিটি পদক্ষেপই দিগন্ত।
প্রতিটি পদক্ষেপ গুনে গুনে
মনে রেখো চূড়ান্ত সংখ্যাটি।
তুলে নিও সাদা নুড়ি পাথর আর
অদ্ভুত পাতাগুলো।
পথের প্রতিটি বাঁক চিহ্নিত করো,
সাথে পাহাড়ের চূড়াগুলোও।
ঘরে ফিরতে
হয়তো প্রয়োজন হবে এগুলো।
বেপরোয়া বয়স
আমার দালাই লামাকে হত্যা করো
যাতে আমি আর তাকে বিশ্বাস না করি।
আমার মুণ্ডুটা পুতে ফেল
আঘাত করো।
আমাকে নগ্ন করো
শৃঙ্খলিত করো।
তবে আমাকে মুক্ত হতে দিও না।
জেলখানার সীমানায়
এই দেহটা তোমাদের।
কিন্তু এই দেহের সীমানায়
আমার বিশ্বাস শুধুই আমার।
চাও এসব?
আমাকে এখানেই হত্যা করোÑ নিঃশব্দে।
নিশ্চিত হও, আমার দেহে
নিঃশ্বাসের ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই।
তবুও আমাকে মুক্ত হতে দিও না।
যদি চাও
তবে একই কাজ বার বার করো।
একদম প্রথম থেকে শুরু করো :
আমাকে নিয়মানুবর্তী করো
নতুন করে শিক্ষিত করো
তোমাদের আদর্শে দীক্ষিত করো,
হাজির করো সাম্যবাদের ছলাকলা।
কিন্তু তবুও আমাকে মুক্ত হতে দিও না।
আমার দালাই লামাকে হত্যা করো,
আমি আর তাকে বিশ্বাস করবো না।
তিব্বতি সত্তা
ঊনচল্লিশটি বছর আমি নির্বাসনে।
আজতক কোন রাষ্ট্রই সমর্থন করেনি আমাদের।
একটি রাষ্ট্রও নয়।
আমরা উদ্বাস্তু।
এক নিখোঁজ দেশের জনতা।
আমরা নাগরিক নই কোন দেশের।
তিব্বতিরা এখন বিশ্বের দরদের ভান্ডার।
শান্তিপ্রিয় ভিক্ষু আর স্থূল ঐতিহ্যবাদী;
সংখ্যায় যারা এক লাখ কিংবা কয়েক হাজার বেশি,
চমৎকার মিশে গেছে
নানান সুপাচ্য সাংস্কৃতিক আধিপত্যে।
প্রতিটি চেকপোস্ট ও দপ্তরে
আমার পরিচয় ‘ভারতীয়-তিব্বতি’।
আমার নিবন্ধন সনদ প্রতিবছর
আমি নবীকৃত করি সালামের বিনিময়ে।
যেন ভারতে জন্ম নেয়া এক বিদেশী আমি।
আমার এই নাদুশনুদুশ তিব্বতি চেহারার কথা বাদ দিলে
ভারতীয় হিসেবে কোন অংশেই কম নই আমি।
“নেপালি?” “থাই?” “জাপানি?”
“চীনা?” “নাগা?” “মনিপুরি?”
কিন্তু কখনোই কেউ প্রশ্ন করেনাÑ “আপনি কি তিব্বতি?”
আমি তিব্বতি।
যদিও তিব্বত থেকে আমি আসিনি।
সেখানে ছিলামও না কখনও।
আমি এখনও স্বপ্ন দেখি
তিব্বতেই মৃত্যু হবে আমার।
প্রতারণা
আমার বাবার মৃত্যু হয়েছিল
আমাদের ঘর, গ্রাম আর
দেশকে রক্ষা করতে গিয়ে।
আমিও চেয়েছিলাম লড়াই করতে।
কিন্তু আমরা যে বৌদ্ধ।
লোকে বলে, শান্তিকামী
আর অহিংস হওয়াই আমাদের জন্য শ্রেয়।
তাই শত্র“কে আমি ক্ষমা করে দিয়েছি।
তবুও কখনো কখনো আমার মনে হয়
বাবার সাথে আমি প্রতারণা করেছি।
আমি ক্লান্ত
আমি ক্লান্ত;
১০ মার্চের আনুষ্ঠানিকতা পালন আর
ধর্মশালার পাহাড়ে দাঁড়িয়ে আর্তনাদ করতে করতে আমি ক্লান্ত।
আমি ক্লান্ত;
রাস্তার পাশে সোয়েটার বিক্রি আর ৪০টি বছর
ধূলা ও থুথুর মধ্যে অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে আমি ক্লান্ত।
আমি ক্লান্ত;
ডাল-ভাত খেতে খেতে আর
কর্ণাটকের জঙ্গলে গরু চরাতে চরাতে আমি ক্লান্ত।
আমি ক্লান্ত;
মানজু টিলার ধূলিভরা পথে
পড়নের ধুতি টানতে টানতে আমি ক্লান্ত।
আমি ক্লান্ত;
যে দেশকে কখনো দেখিনি
তার জন্য লড়াই করতে করতে আমি ক্লান্ত।
নির্বাসিত ঘর
আমাদের টালিকরা ছাদ দিনকে দিন
জলের ফোটার মত খসে পড়ছিল।
ঘরের চার দেয়ালও হুমকী দিয়েছিল
পুরনো বন্ধন ছিন্ন করে হঠাৎ ধসে পড়ার।
তারপরও তাড়াহুড়ো করেই ঘরে ফিরতে হতো আমাদের।
ঘরের সামনে আমরা পেঁপে গাছ লাগিয়েছিলাম
আর বাগানে কাঁচা লঙ্কা।
চাঙমার বেড়ায় ঘিরে দিয়েছিলাম পুরো বাড়ি।
গোয়াল ঘরের চাল বেয়ে ঝুলে পড়েছিল কুমড়ো লতা,
দুরন্ত বাছুরগুলো লাফিয়ে বেড়াতো চাড়ির আশেপাশে।
ঘরের ছাদে অবাধে বেড়ে উঠেছিল ঘাস,
মাচা ছাড়িয়ে শিমগাছগুলো ঝুলে পড়েছিল নিচে।
আর ওদিকে জানালা আকড়ে ধরেছিল লতানো মানিপ্ল্যান্ট।
এসব দেখে মনে হবে, আমাদের ঘরের শিকর গজিয়ে গেছে।
চাঙমার বেড়া এখন এক জঙ্গল।
আমি কিভাবে আমার সন্তানদের বলব,
আমারা কোথা থেকে এসেছিলাম?
** চাঙমা : এক ধরনের দ্রুত বর্ধনশীল গাছ। সাধারণত বাড়ির চারিদিকে বেড়া হিসেবে লাগানো হয়।
পেড্রোর বাঁশি
পেড্রো! পেড্রো!
তোমার ঐ বাঁশিতে কী আছে?
সেই মা হারা ছোট্ট ছেলেটি,
সারা শহরেই এখন যার ভবঘুরে উপস্থিতি,
যার নগ্ন পা আঘাত করে শহুরে পথের স্যাঁতস্যাঁতে খোয়াগুলোকে,
তোমার বাঁশিতে সে আছে কী?
পেড্রো! পেড্রো!
আমাকে বল, তোমার ঐ বাঁশিতে কী আছে?
১৬ বছরের গর্ভবতী বালিকার চাপা আর্তনাদ,
যাকে ঘর থেকে ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে,
উদ্যানের টয়লেটের পেছনে যে এখন নিঃসঙ্গ সংসার করে,
তোমার বাঁশিতে সে আছে কী?
সামান্য একটি প্লাস্টিকের নলে
কি বিস্ময়কর তোমার ফুঁ দেবার শিল্প!
কি বিস্ময়কর, বাঁশিতে তার জীবন্ত সঞ্চারণ!
একটি বাঁশি : চোখ নেই, কান নেই, মুখ নেই
অথচ ধ্বনি করে,
কান্না করে, গেয়ে চলে গান।
তার সুর হয়ে ওঠে ছোট ছোট সুচাগ্র তীর,
যে তীর বিদ্ধ হয়,
এমনকি বিদ্ধ হয় পেঁচাদের হৃৎপিন্ডে।
যে পেঁচাদের কান লোমে আবৃত।
পেড্রো! পেড্রো!
আমাকে বল, তোমার ঐ বাঁশিতে কী আছে?
তবে কি জানালার কব্জার ঐ শিস ধ্বনি
সেই গর্ভবতী বালিকার কান্না?
নাকি সেই ছোট্ট ছেলেটির শ্বাস-প্রশ্বাস
যে এখন ক্লান্ত; হাজতখানায় ঘুমন্ত?
পেড্রো! পেড্রো!
আমাকে বল, তোমার ঐ বাঁশিতে কী আছে?
তেনজিন সুন্দুর প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা তিনটি হলেও তার লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হয় ইন্টারন্যাশনাল পেন, ইন্ডিয়ান পেন, দি ইন্ডিয়ান লিটারারি প্যানারমা, আউটলুক, দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া, হিন্দুস্তান টাইমস, দ্য লিটল ম্যাগাজিন ও দি ইকোনোমিক টাইমস-এ। তেনজিন সুন্দু তার চমৎকার সাহিত্য দক্ষতার জন্য নন-ফিকশন ক্যাটাগরিতে ‘আউটলুক-পিকাডোর পুরস্কার’ লাভ করেন ২০০১ সালে। তাছাড়া ২০০৫ সালে নয়া দিল্লীতে অনুষ্ঠিত ‘দ্বিতীয় দক্ষিণ এশিয় সাহিত্য সম্মেলন’ এ তিনি তিব্বতের প্রতিনিধিত্ব করেন। কবি তেনজিন সুন্দু ‘ফ্রেইন্ডস অব তিব্বত’ এর ভারত শাখার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ১৯৯৯ সাল থেকে।
দিগন্ত
ঘর থেকে
তুমি পৌঁছে গেছ এই দিগন্ত পর্যন্ত।
এখান থেকেও তুমি চলে যাবে
অন্য দিগন্তে।
সেখান থেকে আরেক দিগন্তে,
দিগন্ত থেকে দিগন্তে।
তোমার প্রতিটি পদক্ষেপই দিগন্ত।
প্রতিটি পদক্ষেপ গুনে গুনে
মনে রেখো চূড়ান্ত সংখ্যাটি।
তুলে নিও সাদা নুড়ি পাথর আর
অদ্ভুত পাতাগুলো।
পথের প্রতিটি বাঁক চিহ্নিত করো,
সাথে পাহাড়ের চূড়াগুলোও।
ঘরে ফিরতে
হয়তো প্রয়োজন হবে এগুলো।
বেপরোয়া বয়স
আমার দালাই লামাকে হত্যা করো
যাতে আমি আর তাকে বিশ্বাস না করি।
আমার মুণ্ডুটা পুতে ফেল
আঘাত করো।
আমাকে নগ্ন করো
শৃঙ্খলিত করো।
তবে আমাকে মুক্ত হতে দিও না।
জেলখানার সীমানায়
এই দেহটা তোমাদের।
কিন্তু এই দেহের সীমানায়
আমার বিশ্বাস শুধুই আমার।
চাও এসব?
আমাকে এখানেই হত্যা করোÑ নিঃশব্দে।
নিশ্চিত হও, আমার দেহে
নিঃশ্বাসের ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই।
তবুও আমাকে মুক্ত হতে দিও না।
যদি চাও
তবে একই কাজ বার বার করো।
একদম প্রথম থেকে শুরু করো :
আমাকে নিয়মানুবর্তী করো
নতুন করে শিক্ষিত করো
তোমাদের আদর্শে দীক্ষিত করো,
হাজির করো সাম্যবাদের ছলাকলা।
কিন্তু তবুও আমাকে মুক্ত হতে দিও না।
আমার দালাই লামাকে হত্যা করো,
আমি আর তাকে বিশ্বাস করবো না।
তিব্বতি সত্তা
ঊনচল্লিশটি বছর আমি নির্বাসনে।
আজতক কোন রাষ্ট্রই সমর্থন করেনি আমাদের।
একটি রাষ্ট্রও নয়।
আমরা উদ্বাস্তু।
এক নিখোঁজ দেশের জনতা।
আমরা নাগরিক নই কোন দেশের।
তিব্বতিরা এখন বিশ্বের দরদের ভান্ডার।
শান্তিপ্রিয় ভিক্ষু আর স্থূল ঐতিহ্যবাদী;
সংখ্যায় যারা এক লাখ কিংবা কয়েক হাজার বেশি,
চমৎকার মিশে গেছে
নানান সুপাচ্য সাংস্কৃতিক আধিপত্যে।
প্রতিটি চেকপোস্ট ও দপ্তরে
আমার পরিচয় ‘ভারতীয়-তিব্বতি’।
আমার নিবন্ধন সনদ প্রতিবছর
আমি নবীকৃত করি সালামের বিনিময়ে।
যেন ভারতে জন্ম নেয়া এক বিদেশী আমি।
আমার এই নাদুশনুদুশ তিব্বতি চেহারার কথা বাদ দিলে
ভারতীয় হিসেবে কোন অংশেই কম নই আমি।
“নেপালি?” “থাই?” “জাপানি?”
“চীনা?” “নাগা?” “মনিপুরি?”
কিন্তু কখনোই কেউ প্রশ্ন করেনাÑ “আপনি কি তিব্বতি?”
আমি তিব্বতি।
যদিও তিব্বত থেকে আমি আসিনি।
সেখানে ছিলামও না কখনও।
আমি এখনও স্বপ্ন দেখি
তিব্বতেই মৃত্যু হবে আমার।
প্রতারণা
আমার বাবার মৃত্যু হয়েছিল
আমাদের ঘর, গ্রাম আর
দেশকে রক্ষা করতে গিয়ে।
আমিও চেয়েছিলাম লড়াই করতে।
কিন্তু আমরা যে বৌদ্ধ।
লোকে বলে, শান্তিকামী
আর অহিংস হওয়াই আমাদের জন্য শ্রেয়।
তাই শত্র“কে আমি ক্ষমা করে দিয়েছি।
তবুও কখনো কখনো আমার মনে হয়
বাবার সাথে আমি প্রতারণা করেছি।
আমি ক্লান্ত
আমি ক্লান্ত;
১০ মার্চের আনুষ্ঠানিকতা পালন আর
ধর্মশালার পাহাড়ে দাঁড়িয়ে আর্তনাদ করতে করতে আমি ক্লান্ত।
আমি ক্লান্ত;
রাস্তার পাশে সোয়েটার বিক্রি আর ৪০টি বছর
ধূলা ও থুথুর মধ্যে অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে আমি ক্লান্ত।
আমি ক্লান্ত;
ডাল-ভাত খেতে খেতে আর
কর্ণাটকের জঙ্গলে গরু চরাতে চরাতে আমি ক্লান্ত।
আমি ক্লান্ত;
মানজু টিলার ধূলিভরা পথে
পড়নের ধুতি টানতে টানতে আমি ক্লান্ত।
আমি ক্লান্ত;
যে দেশকে কখনো দেখিনি
তার জন্য লড়াই করতে করতে আমি ক্লান্ত।
নির্বাসিত ঘর
আমাদের টালিকরা ছাদ দিনকে দিন
জলের ফোটার মত খসে পড়ছিল।
ঘরের চার দেয়ালও হুমকী দিয়েছিল
পুরনো বন্ধন ছিন্ন করে হঠাৎ ধসে পড়ার।
তারপরও তাড়াহুড়ো করেই ঘরে ফিরতে হতো আমাদের।
ঘরের সামনে আমরা পেঁপে গাছ লাগিয়েছিলাম
আর বাগানে কাঁচা লঙ্কা।
চাঙমার বেড়ায় ঘিরে দিয়েছিলাম পুরো বাড়ি।
গোয়াল ঘরের চাল বেয়ে ঝুলে পড়েছিল কুমড়ো লতা,
দুরন্ত বাছুরগুলো লাফিয়ে বেড়াতো চাড়ির আশেপাশে।
ঘরের ছাদে অবাধে বেড়ে উঠেছিল ঘাস,
মাচা ছাড়িয়ে শিমগাছগুলো ঝুলে পড়েছিল নিচে।
আর ওদিকে জানালা আকড়ে ধরেছিল লতানো মানিপ্ল্যান্ট।
এসব দেখে মনে হবে, আমাদের ঘরের শিকর গজিয়ে গেছে।
চাঙমার বেড়া এখন এক জঙ্গল।
আমি কিভাবে আমার সন্তানদের বলব,
আমারা কোথা থেকে এসেছিলাম?
** চাঙমা : এক ধরনের দ্রুত বর্ধনশীল গাছ। সাধারণত বাড়ির চারিদিকে বেড়া হিসেবে লাগানো হয়।
পেড্রোর বাঁশি
পেড্রো! পেড্রো!
তোমার ঐ বাঁশিতে কী আছে?
সেই মা হারা ছোট্ট ছেলেটি,
সারা শহরেই এখন যার ভবঘুরে উপস্থিতি,
যার নগ্ন পা আঘাত করে শহুরে পথের স্যাঁতস্যাঁতে খোয়াগুলোকে,
তোমার বাঁশিতে সে আছে কী?
পেড্রো! পেড্রো!
আমাকে বল, তোমার ঐ বাঁশিতে কী আছে?
১৬ বছরের গর্ভবতী বালিকার চাপা আর্তনাদ,
যাকে ঘর থেকে ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে,
উদ্যানের টয়লেটের পেছনে যে এখন নিঃসঙ্গ সংসার করে,
তোমার বাঁশিতে সে আছে কী?
সামান্য একটি প্লাস্টিকের নলে
কি বিস্ময়কর তোমার ফুঁ দেবার শিল্প!
কি বিস্ময়কর, বাঁশিতে তার জীবন্ত সঞ্চারণ!
একটি বাঁশি : চোখ নেই, কান নেই, মুখ নেই
অথচ ধ্বনি করে,
কান্না করে, গেয়ে চলে গান।
তার সুর হয়ে ওঠে ছোট ছোট সুচাগ্র তীর,
যে তীর বিদ্ধ হয়,
এমনকি বিদ্ধ হয় পেঁচাদের হৃৎপিন্ডে।
যে পেঁচাদের কান লোমে আবৃত।
পেড্রো! পেড্রো!
আমাকে বল, তোমার ঐ বাঁশিতে কী আছে?
তবে কি জানালার কব্জার ঐ শিস ধ্বনি
সেই গর্ভবতী বালিকার কান্না?
নাকি সেই ছোট্ট ছেলেটির শ্বাস-প্রশ্বাস
যে এখন ক্লান্ত; হাজতখানায় ঘুমন্ত?
পেড্রো! পেড্রো!
আমাকে বল, তোমার ঐ বাঁশিতে কী আছে?