ক্যামেরাকে আমি প্রাণময় সত্তা হিসেবে দেখি
----- নাসির আলী মামুন
বাংলাদেশের কিংবদন্তীতুল্য আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন। আগামী বছর তার ফটোগ্রাফির ৪০ বছর হতে যাচ্ছে। তিনি দেশ-বিদেশের এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চার হাজার বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের ছবি তুলেছেন।
এসব ব্যক্তিত্বদের মধ্যে রয়েছেন বিশ্ববিখ্যাত লেখক, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, রাজনীতিবিদ, বিজ্ঞানীসহ বিভিন্ন সেক্টরের সেরা সেরা ব্যক্তিরা। তার তোলা ছবিতে আলো ছায়ার মিলনে থাকে রহস্যময় শিল্পের খেলা।
৫ জানুয়ারি ২০১১ নাসির আলী মামুনের সাভার জোরপুরের বাসায় তার সাথে দীর্ঘ আড্ডা হয়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন : ফেরদৌস মাহমুদ
ফেরদৌস মাহমুদ : মামুন ভাই, ক্যামেরার প্রেমে পড়লেন কবে?
নাসির আলী মামুন : অন্ধকার কালো বাক্সের জন্য একটা বন্য আকর্ষণ আমার ছিল ছোটবেলা থেকেই। তখন তো আর কেউ ক্যামেরা দিত না, আমার ক্যামেরাও ছিল না। তখন আমি বিভিন্ন খবরের কাগজে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, কোনো বিখ্যাত লেখক, কবি বা কোনো ব্যক্তির ছবি দেখতাম আর কাটতাম। অনেক সময় আব্বা ওই খবরের কাগজ পড়ার আগে আমি কাইটা ফেলতাম। এইজন্য আব্বার হাতে অনেক মাইরও খাইছি। কাটতাম এই কারণে যে, কাইটা ওইটা নিয়া বসতাম, ধ্যানের মতো করে। ভাবতাম এইটাতো ক্যামেরা দিয়েই তোলা হয়েছে। এই ছবিটা কে তুলছে, কিভাবে তুলছে। এই যে বিখ্যাত লোকটা তার সামনে কিভাবে বসছে, তার সাথে কী কথা হইছে, কিভাবে তার সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করছে-- এগুলি নিয়ে নানা রকম প্রশ্ন করতাম মনে মনে। এইভাবে প্রশ্ন করতে করতে কিন্তু আমি ব্যক্তিত্বের ভক্ত হয়ে গেছি।
যেহতু ঢাকার শহরেই আমার জন্ম ১৯৫৩ সালের ১ জুলাই। পুরোনো ঢাকার মৌলভি বাজারে। কাজেই প্রকৃতি বা গ্রাম আমি ছোটবেলা থেকে দেখি নাই। ভাড়া বাড়িতে পুরোনো একটা গলিতে থাকতাম, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের উল্টাদিকে।
এই লোহা-কাঠ-সিমেন্ট-পাথর শুকনা জায়গা এইগুলি আমি দেখছি। আমার প্রকৃতি ছিল ওই টবের মধ্যে বা মাটির মালসার মধ্যে থাকা ছোট গাছ...। কাজেই প্রকৃতির প্রতি আমার আকর্ষণ কোনো কালেই ছিল না। আমি দেখেছি মানুষ। থাকতাম মৌলভি বাজারে দোতলা পুরোনো একটা চিপা ছোট্ট বাসায়। রেলিং ধইরা দাঁড়ালেই দেখতাম নানা ধরণের পণ্য নিয়া মানুষ মাথায় কইরা যাইতাছে, ভ্যানে কইরা নিয়া যাইতাছে, সাইকেলে কইরা যাইতাছে। অথচ কাছেই কিন্তু বুড়িগঙ্গা নদী, ওইপারে বিরাট প্রকৃতি, সুন্দর... ওইগুলি কিন্তু আমারে টানত না।
ফেরদৌস মাহমুদ : প্রথম দিকে কী ধরণের ক্যামেরা ব্যবহার করতেন? ক্যামেরার সাথে ধীরে ধীরে আপনার স্থায়ী সম্পর্কটা কিভাবে গড়ে উঠল?
নাসির আলী মামুন : প্রথম প্রথম নানা জাতের নানা দেশের বিভিন্ন রকমের ক্যামেরা ব্যবহার করেছি। এত ক্যামেরা ব্যবহার করেছি, কারন : নিজের কোনো ক্যামেরা ছিল না। নিজের ক্যামেরা থাকলে তো একটা বা দু’টাই ক্যামেরা ব্যবহারের সুযোগ থাকতো। যেহেতু নিজের কোনো ক্যামেরা ছিল না, তাই সততার বিনিময়ে আমি ক্যামেরা ধার করতাম। কাদের কাছ থেকে করতাম, যারা আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু তাদের কাছ থেকে। আমার কয়েকজন আত্মীয়স্বজনের কাছে ক্যামেরা ছিল, কিন্তু তারা ওই ক্যামেরা ধরতেও দিত না। আমার বন্ধুবান্ধব যাদের সাথে স্কুলে পড়তাম, তখন আমি খোঁজ নিলাম কাদের কাছে ক্যামেরা আছে। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু নাম হচ্ছে হারেস, ওর বোন একবার ওরে লন্ডন থেকে একটা বড় প্যাকেট দিলো। তার মধ্যে অনেকগুলো খেলনা, গাড়ি ছিল, তার মধ্যে একটা প্লাস্টিকের ক্যামেরা ছিল। সময়টা সম্ভবত ১৯৬৬ সাল। ক্যামেরাটা ছিল ফিক্সড ফোকাস... কোনো ডিউ ফাইন্ডার ছিল না। কিভাবে দেখব এটা ছিল না। আন্দাজ করে ছবি তুলতে হতো। ফলে অনেক সময় পা কাটা যেত, মাথা কাটা যেত-- তবে ওই ক্যামেরায় ছবি তুলতে তুলতে একসময় বুঝে গেলাম কিভাবে অনুমানের উপর ক্যামেরা ধরলে পুরোপুরি ছবিটা আসবে।
তখন তো আর পোট্রেইট বুঝতাম না। বুঝতাম, এই জিনিসটা দিয়ে ছবি তোলা যায় যা দেখতে হুবহু সেরকম ছবি আসে। সেটা যাই-ই তুলি না কেন গাছের, বানরের আর মানুষের...। ১৯৬৬ সালের কথা বলছি।
তখন আমাদের একটা ক্লাব ছিল ‘নবারুণ কিশোর সংঘ’। সেই ক্লাবটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৬৪ সালে। ক্লাবটা ছিল ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত। সেই ক্লাবে আমাদের যারা সিনিয়র তারাও খেলত। তাদের মধ্যে একজন হচ্ছেন আবদুল আজিজ। উনি ঢাকা সিটি মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ডার ছিলেন এবং ঢাকা কলেজের ছাত্র সংসদের সভাপতি ছিলেন। উনি আমাদের বড় ভাই, মুরব্বি...। ছিলেন লেফটেনেন্ট বাবুল, উনি বীর উত্তম খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মারা গেছেন। উনিও আমাদের ক্লাবে খেলতেন।
আমাদের ক্লাবটা বন্ধ হয় ১৯৭৩ সালে, তখন আমরা ওই এলাকা ছেড়ে চলে আসলাম। আমাদের ক্লাবের আসলে ভাঙনের শুরু হয় ১৯৭১ সালে। কারণ আমাদের ক্লাবে কয়েকজন বন্ধু ছিল বিহারি। ওরা অনেকে পাকিস্তানে চলে গেল, লাহোরে চলে গেল। আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম।
ওদেরও আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে ক্যামেরা ধার নিতাম। যারা বনেদি বিহারী ছিল ওই সময় তাদের কারও কারও ক্যামেরা ছিল। ধানমন্ডি স্কুলে পড়তাম আমি। তার মধ্যে একজন ওর দাদার ক্যামেরা ধার দিত আমাকে।
একটা ঘটনার কথা বলি-- ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, যেদিন পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করলো, ভারতের যুগ্মকমান্ডের কাছে সেদিন সকাল থেকেই দেখছি অনেক পাকিস্তানি আর্মি, এক পায়ে জুতা আছে তো আরেক পায়ে নেই, জামা ছেঁড়া, গায়ে রক্ত, হাত তুলে বিডিয়ার ক্যাম্পের দিকে যাচ্ছে। সেদিন ওই ছবি তোলার জন্য অনেকের কাছে ক্যামেরা চেয়েছি কিন্তু কেউ দেয়নি। যদি দিত তাহলে হয়ত আমার কাছে ওই সময়ের অনেক ছবি থাকতো। এসব ছবি এখন দেখা যায় না, রক্তাত্ব অবস্থায় পাকিস্তানি আর্মি। চারদিকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। যে পাকিস্তান আর্মিরা তার আগের দিন আমাদের পাখির মত গুলি করে মারছে, রেইপ করছে তারা অসহায় অবস্থায় মাথানত করে যাচ্ছে ওটা দেখার মত দৃশ্য না! ওটা তো একটা দলিল।
ফেরদৌস মাহমুদ : ছবি তোলার জন্য আপনি কত ধরনের ক্যামেরা ব্যবহার করেছেন?
নাসির আলী মামুন : ক্যামেরার আবিষ্কারক কে, এটা নিয়ে একজন কারও নাম বলা যাবে না। বই পইড়া, ক্যামেরা টিপতে টিতে, বিভিন্নজনরে প্রশ্ন করতে করতে আমি ক্যামেরা চলানো শিখছি। ক্যামেরা আবিস্কারের গল্পের মতো আমার ক্যামেরা হাতে নেওয়া। ক্যামেরা বিভিন্নজনের কাছ থেকে নিয়েছি।
আমি অনেক প্রবীণ ফটোগ্রাফারকে জিজ্ঞেস করেছি কয়টা ব্যবহার করেছেন। অনেকে বলছে ৫টা ৬টা, কেউ বলছে ১০টা ১২টা। কিন্তু আমার হিসেবে এই যাবত আমি প্রায় ৭০টার উপরে ক্যামেরা ব্যবহার করেছি। তার মধ্যে থারটি ফাইভ ক্যামেরাই বেশি। ওয়ান টুয়েন্টি ছিল অনেক। এমন ক্যামেরাও আমি ব্যবহার করেছি যা ১৯২২ সালের ক্যামেরা। ওইটা আমার এক স্কুলের বন্ধু চুরি কইরা আইনা দিছিল। ক্যামেরাটা ছিল আমার ওই বন্ধুর দাদার। দাদা হইল ব্রিটিশ আমলের দারোগা। ৭২ সালে সে দাদার বয়স ৯৪-৯৫ বছর। সেই লোক ক্যামেরা একটা মখমলের লাল কাপড় দিয়া মোড়াইয়া রাখতো।
ফেরদৌস মাহমুদ : আপনি ওই সময় কি ধরণের ছবি তুলতেন?
নাসির আলী মামুন : পোট্রেট। আমি তো ৭২ সাল থেকে শুরু করি পোট্রেট ছবি তোলা। আমি দেখলাম যে, বাংলাদেশের আলোকচিত্রে তখন প্রধানত প্রকৃতি নির্ভর ছবি। প্রকৃতি বা ন্যাচারকে বিষয়বস্তু করে বাংলাদেশের সমস্ত ফটোগ্রাফাররা আলোকচিত্র চর্চা করে। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি এমন একটা দিকে যাবো যেদিকে নতুন একটা পথের সূচনা হবে। এই পোট্রেট ফটোগ্রাফির সূচনা করলাম ৭২ সালে।
পোট্রেট ছবি তুলতে গিয়ে যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সৃজনশীল, বিখ্যাত ওদের ছবি তুলতে শুরু করলাম। ধার করা ক্যামেরা দিয়ে আমি ওইসব ছবি তুলেছি। প্রথম ছয় বছর আমার কোনো নিজস্ব ক্যামেরা ছিল না। কিন্তু এই ছয় বছরের মধ্যে আমি দুইটা ক্যামেরা কিনেছি। একটা ক্যামেরা কিনছিলাম, ওইটা এক বছর ছিল। ওই ক্যামেরাটার নাম ‘ক্যাওয়া’। জাপানি ক্যামেরা। ৩২ বার নষ্ট হয়েছিল। ৩৩ বার যখন নষ্ট হয়েছিল তখন ওইটা আর দোকান থেকে ফেরত আনিনি। ওই দোকানেই ছিল, ওটা পরে কি হয়েছিল জানি না। ওই ক্যামেরা দিয়ে আমি শামসুর রাহমান, আহসান হাবীব, আবুল হোসেন, কমরেড মনি সিং এর ছবি তুলেছি, আরও বহু মানুষের।
ক্যামেরার সাথে আমার এমন একটা সম্পর্ক, ক্যামেরাকে আমি প্রাণময় সত্তা হিসেবে দেখি। আমি মনে করি ক্যামেরার প্রাণ আছে। ক্যামেরার চোখ আছে, হার্ট আছে। ক্যামেরা সব কিছুই বোঝে তা না হলে এত ভালো ভালো ছবি তোলে কিভাবে। ক্যামেরার সঙ্গে যে কমিউনিকেট করতে পারবে না তার ছবি ভালো হবে না।
ফেরদৌস মাহমুদ : ছবি তোলার এত সাবজেক্ট থাকতে আপনি কেবল মানুষ বেছে নিয়েছেন, তাও বিখ্যাত মানুষ। আপনি বিখ্যাত লোকের ছবি তোলার দিকেই বা আগ্রহী হলেন কেন?
নাসির আলী মামুন : মানুষ হলো...মানুষ পৃথিবীতে আসছে অল্প সময়ের জন্য। যারা সৃজনশীল মানুষ তারা কাজ করে ২০ বছর ৩০ বছর ৪০ বছর, তারপর হারিয়ে যায়। তাদেরকে এরপর আর পাওয়া যায় না, ক্যামেরার সামনে তাদের আর পাওয়া যায় না।
কিন্তু ফুল-পাখি-নিসর্গ এই যে প্রকৃতি, প্রকৃতির মধ্যে এত রূপ এত রঙ এগুলি কিন্তু সারা পৃথিবীতেই আছে। যেমন-বট গাছ সারা পৃথিবীতে আছে, চড়–ই পাখি সব দেশে আছে, কবুতর সব দেশে আছে। এই যে প্রকৃতির মধ্যে যেসব জিনিসপত্র গাছপালা পশুপাখি তা প্রায় সব দেশেই আছে, কোথাও না কোথাও পাওয়া যায় এবং একই চেহার। আমি দেখলাম আমার দেশের এসএম সুলতান, কবি শামসুর রাহমান, প্রফেসর ইউনুস তারা কিন্তু একটাই। এরা শুধু এদেশেই আছে, এদেরকে অন্য কোথাও গেলে পাওয়া যাবে না। তাদের ভাষা আলাদা, তাদের পোশাক আলাদা, খাদ্যাভ্যাস আলাদা। নিয়ম কানুন আলাদা। আমি এই কারণে দেখলাম যে যারা বুদ্ধিমান, সৃজনশীল তারা অনেক কাজ করে একসময় উধাও হয়ে যায়। আর ফেরে না। এইসব মানুষদের ধরে রাখা, তাদের কষ্ট তাদের দুঃখ তাদের যন্ত্রণা ক্যামেরায় ধরে রাখা যায় কিনা, আমি এসব ধরে রাখার চেষ্টা করেছি ক্যামেরায়।
ফেরদৌস মাহমুদ : আপনার ছবি সাধারণত শাদা-কালো হয়, একটা আলো ছায়ার খেলা থাকে। বেশ একটা রহস্যময় ব্যপার যেন। কিন্তু মুখের পূর্ণ অবয়বটা থাকে না, এটা কেন?
নাসির আলী মামুন : যে জিনিস তুমি সব সময় দেখবা, কানে শুনবা, খুব সহজে পাবা সেটার কিন্তু কোনো মূল্য নাই। সেটাকে কিন্তু এন্টিক বলা যাবে না কখনো।
যেমন, বাংলাদেশের একটা মাটির বদনা সেটা কি অ্যান্টিক? যে কোনো বাজারে গেলেই ১০-১৫ টাকায় কিনতে পারবা। কিন্তু তুমি যখন পাশ্চাত্যে যাবা। মনে করো আমেরিকায় গিয়েছো, সেখানে বাংলাদেশের মাটির বদনা একটা কিনোতো, এইখান থেকে ১২ হাজার মাইল দূরে নিউইয়র্কে, দেখবা পাবা না। ওইখানে এইটা কিন্তু এন্টিক।
সেইরকম প্রকৃতির মধ্যে এত আলো, এই হাজার রকমের কালারগুলা, এর মধ্যে শাদা আর কালো দুইটা কালার। সেই কারণে এইটা একটা এন্টিক, আমি ছবি তুলি শাদা কালোতে। এত রঙ থাকতে রঙের ব্যবহার আমি করি না। রঙের মধ্যে রঙহীন জিনিস নিয়া আমি কাজ করি।
আমরা সাধারণত যারা সাধারণ মানুষ তারা খুব স্পষ্ট, স্বচ্ছ, পরিস্কার জিনিস দেখতে পছন্দ করি। খুব কম লোকই আছে যারা আলো-আধারি-অন্ধকার, অন্ধকারের মধ্যে রহস্যময় একটা কিছু... খুব কম লোকই এত কষ্ট করে দেখতে চায়। সে কারণেও অন্ধকারের মধ্য থেকে আলোটারে দেখাতে চাই আমি। মূল জিনিসটা অন্ধকার, এর মধ্যে একটু আলো।
ওর মধ্যে কি আছে, ওর মধ্যে তার কতটুকু কান্না, ওর মধ্যে তার কতটুকু যন্ত্রণা এটা পাল্লা দিয়ে মাপা যায় কিনা, সে চেষ্টা আমি করি লেন্সের মধ্য দিয়ে, ক্যামেরার মধ্য দিয়ে, আলোকচিত্রের মধ্য দিয়ে। এবং চেষ্টা করি যে একটা নির্জীব খসখসে কাগজের মধ্যে প্রাণময় কোনো সত্তা গুজে দেওয়া যায় কিনা। সেটা পারছি কিনা আমি জানি না।
আমার বেশিরভাগ ছবির মধ্যে মিনিমাম ফিফটি পার্সেন্ট অন্ধকার থাকে। এটা যে আমি খুব পরিকল্পিতভাবে করেছি তা না। আমি যে অনেকের ছবি দেখে করেছি তা না। আমি এখন দেখছি যে, ৭০-৮০ বছর আগে, বা আরও আগে পৃথিবীর অনেক দেশে এই কাজ হয়ে গেছে। ভারত উপমহাদেশে এটা হয়নি, এই যে আলো আধারি দিয়ে এরকম পোট্রেইট তৈরি করা এটা ইন্ডিয়ান সাবকনটেন্টে হয়নি। কিন্তু ৭০-৮০-৯০ বছর আগে পশ্চিমা দেশে ইউরোপে-আমেরিকায় এই ধরনের কাজ হয়ে গেছে। এতকাল পরে দেখছি। আমি যখন ছবি তোলা শুরু করি, তখন যদি এইসব দেখতাম আমার মনে হয় আমি ওইসব দ্বারা ইনফ্লুয়েন্স হয়ে যাইতাম।
আমি মনে করি, কোনো ছবি না দেখে এটা যে শুরু করেছি তা সরলভাবেই করেছি... আলো ছায়ার এই ব্যপারটা। আমি দেখছি যে শাদাকালো ছবিতে ফ্লাট রাখলে মানুষের চোখ কোনো একটা সেন্ট্রাল জিনিসের মধ্যে পড়ে না। আমি মনে করি ছবির মধ্যে আলো ছায়ার অনেক বাক্য থাকে, সেগুলিকে সাজায়ে একটা ছিবি নির্মাণ, একটা ছবি তৈরি করা, একটি ছবি চূড়ান্ত করা, তারপরই একটা সার্থক ছবি বা পোট্রেইট হয়। বুঝতে হবে কতটুকু আলো রাখতে হবে, কতটুকু ছায়া রাখতে হবে। তার বেদনার পরিমাণটা বোঝানোর জন্য কতটুকু ছায়ার মধ্যে তাকে রাখতে হবে।
ফেরদৌস মাহমুদ : ছবি তুলতে গেলে আপনি সাধারণত নির্দিষ্ট মানুষের নানা মহূর্তকে, নানা ভঙ্গিকে সেলেক্ট করেন। এর কারন কি?
নাসির আলী মামুন : আমি ছোটবেলায় যখন এদের ছবি দেখতাম, বইতে পড়তাম, বিভিন্ন লাইব্রেরিতে দেখতাম- আমি পাকিস্তান আমলের কথা বলছি... দেখতাম সবই পাসপোর্ট সাইজের ছবি। পরে যখন কাউকে কাউকে সামনা সামনি দেখতাম অবাক হতাম আরে এই মানুষের সাথে তো ছবির মিল নাই। তার তো মুখে অনেক দাগ, গালভাঙা। ছবিতেতো দেখছি গালফোলা। পরে বুঝলাম এইসব ছবি স্টুডিওতে তোলা বলে ছবিগুলির এই অবস্থা। স্টুডিওর ছবি তো আর শিল্প না। তারা প্রফেশনালি যেভাবে মানুষ চায় সেভাবেই তুলে দেয়। কাজেই ওই ধরণের ছবি আসলে ছবি না।
আমি দেখলাম এমন ছবি তুলবো তার প্রকৃত চেহারাটা অন্তত ধরা পড়বে, তার মুখের দাগগুলি ধরা পড়বে। শুধু তাই না তার অন্তরের কথাও যাতে বোঝা যায়। ভবিষ্যতে কোনো প্রজন্ম যাতে তার ছবি নিয়ে আলোচনা করতে পারে। গবেষণা করতে পারে। এই ধরণের ছবি আমি তোলার চেষ্টা করেছি।
এটার একটা স্থায়ী মূল্য আছে, শিল্প মূল্য আছে, আর্কাইভাল মূল্য আছে। এইগুলি আমার কাজে লাগবে, দেশের কাজে লাগবে, মানুষের কাজে লাগবে, প্রকাশনার কাজে লাগবে, মিডিয়ার কাজে লাগবে।
আমি ওই সময় আমার ছবি ছাপানো জন্য লেখকদের বুঝাইতাম। বলতাম স্টুডিওর ছবি ছাইপেন না। এমনও হইছে লেখকদের বইয়ে আমার ছবি ছাপানোর জন্য প্রেসে পর্যন্ত গেছি।
সৈয়দ শামসুল হকের এক বইতে একটা টাক মাথা ছবি আছে না, পুরোপুরি টাকমাথা। বইটার নাম ‘প্রাচীন বংশের নিস্ব সন্তান’। ওই ছবিটারে প্রচ্ছদ হিসেবে ব্যবহারের জন্য হক ভাইরে আমিই কইছিলাম। হক ভাই পরে আমার কথা রেখেছিল।
ফেরদৌস মাহমুদ : আপনি যাদের ছবি তুলেছেন, নিশ্চয়ই সব ছবিই খুব সহজে তোলা হয়নি। কোনো কোনো ছবি তুলতে গিয়ে অনেক বিড়ম্বনার মুখোমুখিও হয়েছেন। দেখা গেছে কোনো কোনো ছবি হয়ত দূর থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে নিতে হয়েছে। কিংবা ছবি তুলতে অনেকবারই যেতে হয়েছে। বিড়ম্বনার স্বিকার হয়েছেন এরকম কিছু ঘটনার কথা শুনতে চাচ্ছি।
নাসির আলী মামুন : ১৯৮৬ সালের ২ডিসেম্বর যখন জার্মান-লেখক গুন্টার গ্রাস ঢাকায় এসেছিলেন, তখন তার ছবি তোলার জন্য জার্মান কালচারাল সেন্টারের ডিরেক্টর পিটার ডেভিড গোপণীয়ভাবে আমাকেই সিলেক্ট করলেন। উনি ঠিক করলেন কবি বেলাল চৌধুরী তার গাইড থাকবে আর আমি তুলবো ছবি। কিন্তু এদিকে গুন্টার গ্রাস আগেই না করে দিয়েছিল কোনো সাংবাদিক যাতে তার সাথে না থাকে, তিনি কাউকে ইন্টারভিউ দেবেন না এবং ছবি তুলতে দিবেন না।
ফেরদৌস মাহমুদ : আপনি তো গুন্টার গ্রাসের অনেক ছবি তুলে ছিলেন, এই নিষেধাজ্ঞার পরও এটা কিভাবে সম্ভব হলো ?
নাসির আলী মামুন : আমাকে ব্রিফ করা হয়েছিল খুব কৌশলে কাজ করতে হবে। তবে তিনি যদি ‘না’ করেন তবে ছবি তোলা যাবে না, পুরো ব্যপারটাই নির্ভর করছে আমার উপর। আমি খুব আতঙ্কে ছিলাম। ২ ডিসেম্বর ১৯৮৬ গুন্টার গ্রাস এবং তার স্ত্রি উটার গ্রাস যখন কলকাতা থেকে বিমানে এসে নামলেন এয়ারপোর্টে তখন প্রায় ৩০ ফিট দূর থেকে তাদের দুজনের একটি ছবি তুলেছিলাম। তারা ট্রলি ঠেলে নিয়ে আসছিল। ওই সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন বেলাল চৌধুরী, রফিক আজাদ, ত্রিদিব দস্তিদার, রবিউল হুসাইন, আহমদ ছফা এরকম আরও বেশ কয়েকজন। তুলেই আমি তাদের ভিড়ের মধ্যে ক্যামেরাটা আড়াল করে রাখলাম। সবাই যখন ফুল দিচ্ছিল আমি তখন দ্রুত দু’তিনটা ছবি তুলে ফেললাম তাও দূর থেকে। তারপর মাইক্রোবাসে উঠলাম গুন্টার গ্রাসের সাথে।
পরে রাতে গুন্টার গ্রাসের আগমন উপলক্ষে ডিনারের ব্যবস্থা করা হলে, আমি তার উল্টাদিকে বসেছিলাম কায়দা করে। সেখানে আমি তার কয়েকটা ছবি তুলি, দেখি যে গ্রাস কিছু বললেন না। পরের দিন আমরা রওয়ানা দিলাম লালবাগের কেল্লার উদ্দেশ্যে রিক্সায়। রিক্সায় ওঠার সাথে সাথে গুন্টার গ্রাস তার চিরচেনা পাইপটায় আগুন ধরালো, পাশেই হাস্যজ্জল তার স্ত্রী উটার গ্রাস। তারা দুজন রিক্সায় বসা ঢাকার রাস্তায়, আমি ওই ছবি তুলি। তারপর আমি আর বেলাল চৌধুরী সামনের রিক্সায় গিয়ে উঠলাম। তাদের রিক্সা আমাদের ফলো করলো লালবাগের উদ্দেশ্যে। মজার ব্যাপার হলো, লালবাগেও আমি তার ছবি তুললাম। বুঝলাম যে তার মনের মধ্যে আমার ব্যাপারে কোনো সংশয় নাই। সে আমাকে নিরাপদই মনে করেছে। তারপর তো সাতদিন তার ছবি তুলেছি কোনো সমস্যা হয়নি। এরকম আরও অনেক ঘটনা ঘটেছে।
ফেরদৌস মাহমুদ : মাদার তেরেসা বা বিসমিল্লাহ খাঁর ছবি তুলতেও নাকি আপনাকে অনেক ঝামেলা করতে হয়েছিল...
নাসির আলী মামুন : মাদার তেরেসা যখন আসলো ১৯৮১ সালের জানুয়ারিতে, তখন তো তিনি শান্তিতে নোবেল জয়ী। এত বড় মহিয়সী মহিলা মাদার তেরেসা কিন্তুু কোনো প্রেস এলাউ করছিলেন না। কোথায় তার কী অনুষ্ঠান কিছুই জানা যাচ্ছিল না। শুধু শুনেছিলাম তেজগাঁও চার্চে তিনি আসবেন। আমি ওই চার্চের গেটে দাঁড়িয়ে থাকলাম। তখন তিনি ওই চার্চে আছেন।
কিছুক্ষণ পরই দেখি তিনজন নান আর সাথে মাদার তেরেসা চার্চ থেকে বেরিয়ে মাইক্রোতে উঠছেন, তিনি যাবেন পুরনো ঢাকায়। আমি তার গতিরোধ করলাম, আমার সাথে ছিল ওই সময়ের ইত্তেফাকের এক সাংবাদিক নাজিমউদ্দিন মস্তান। আমি বললাম যে ছবি তুলতে দিতেই হবে। মাদার তেরেসা খুবই ক্ষুব্ধ হলেন।
উনি বললেন যে, আমাকে তোমরা আটকাইলা, তোমরা কি জানো অনেক শিশু আমার জন্য অপেক্ষা করতেছে। তোমরা কি অনুতপ্ত না। আমি তার কাছে ক্ষমা চাইলাম। পরে মাদার তেরেসা ছবি তুলতে দিলো। অনেকগুলি ছবি তুললাম তার।
ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খাঁ যখন ঢাকায় আসছিলেন, সম্ভবত ২০০০ সালে। গেলাম তার ছবি তুলতে। তার লেবেলের এত বড় আর্টিস্ট এর আগে আসে নাই ঢাকাতে। যে লোক এত বড় শিল্পী, ভারত বিখ্যাত, পৃথবী বিখ্যাত শিল্পী... সানাই বাজিয়ে লক্ষ লক্ষ লোককে সে কাদায়, আবার আনন্দ দেয়। অনেকে বলে তার সানাই ছাড়া বিয়ে হয় না। ভাবছিলাম কিভাবে তার বেদনাটা ক্যামেরায় বন্দি করা যায়। তার বেদনাটা কী। শুধু চেহারা ধরার জন্য আমি তার ছবি তুলতে যাই নাই। তিনি যে কয়দিন ঢাকাতে ছিলেন প্রতিদিনই আমি চেষ্টা করছিলাম তার পোট্রেট ছবি তোলার কিন্তু সম্ভব হচ্ছিল না।
পরে যেদিন তিনি ঢাকা ছাড়বেন সেদিন তার বড় ছেলেকে গিয়ে বললাম আমার মা তো ‘শিয়া’। বললাম, তোমরা তো শিয়া, এখানে তো শিয়া কম, একটা ছবি যদি না তুলি তাহলে কেমন হয় ব্যপারটা। শিয়া বলার পর দেখলাম, মহূর্তের মধ্যে তার বড় ছেলে কেমন যেন হয়ে গেল। সে বলল, কোনো চিন্তা করো না, আমার বাবার কাছে তোমাকে নিয়ে যাবো। তার ছেলে আমাকে ভিতরে নিয়ে যাওয়ার পর আমার সাথে তার পরিচয় করিয়ে দিলো। বিসমিল্লাহ খাঁ সবসময় অজু করা অবস্থায় থাকতেন। আমি তার সাথে কিছু কথা বললাম। কিছু ছবি তুললাম।
ফেরদৌস মাহমুদ : স্রেফ শিয়া বলার কারণে আপানাকে এ সুযোগ দেওয়া হলো!
নাসির আলী মামুন : আসলে ওটা ছিল আমার একটা টেকনিক। আমি ওনার ছেলেদের পায়ে ধরেও সালাম করেছিলাম। একটা ছেলে ছিল প্রায় আমার সমানই বয়স, তবলাবাদক, তবু আমি তার পা ধরে সালাম করলাম। আমার এত কিছু করার উদ্দেশ্য তো একটাই বিসমিল্লাহ খাঁর সামনে যাওয়া, সেটা গেছি...ছবি তুলে নিয়ে এসেছি।
ফেরদৌস মাহমুদ : অ্যালেন গিন্সবার্গের সাথে সাক্ষাৎ নিয়ে বলুন...
নাসির আলী মামুন : মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ যার নাম আমি বহু আগে থেকেই জানি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা লেখায় তার সম্পর্কে আমি পড়েছিলাম এবং তার ছবি দেখেছিলাম।
সামনাসামনি গিন্সবার্গের দেখা আমি পাই আমেরিকায় এখন থেকে একুশ বছর আগে ১৯৮৯ সালে। তখন নিউইয়র্কের টমকিন স্কয়ার পার্কে একটি অনুষ্ঠান হচ্ছিল, মে দিবসের অনুষ্ঠান। পৃথিবীর সম্ভবত একমাত্র দেশ আমেরিকা, যেখানে মে দিবসের কোনো ছুটি নাই। অথচ মে দিবসের ঘটনাটা আমেরিকাতেই ঘটেছিল।
তো ওই পার্কে আমি ঘোরাঘুরি করতেছি, আমার সাথে আমার বন্ধুরা আছে কয়েকজন। হঠাৎ দেখি যে দাড়িওয়ালা এক লোক ছবি তুলতেছে হোমলেসদের... কাছে গিয়ে দেখলাম হোমলেসরা পিসবোর্ডের বাক্সের মধ্যে কেউ শুয়ে রয়েছে, কেউ গান গাইতাছে, কেউ ঘাসে শুয়ে রয়েছে... টুক টুক করে সে ছবি তুলতেছে। আমি লোকটার দিকে তাকালাম, তাকাইয়া হঠাৎ মনে হলো এই লোকটার ছবি তো আমি ‘দেশ’ পত্রিকাতে দেখেছি। এটা তো অ্যালেন গিন্সবার্গ। গিন্সবার্গ তো নিউইয়র্কেই থাকে...ভেনিজুয়েলারে।
ছবি তুইলা সে আগাইয়া যাইতেছে। ওদিকে মে দিবসের অনুষ্ঠান উপলক্ষে চলছে বিকট ড্রামের আওয়াজ, গানের আওয়াজ... খুব ইনফরমাল ওয়েতে অনুষ্ঠান হচ্ছে...।
আমার সঙ্গে ছিল হাসান ফেরদৌস, আলম খোরশেদ। আমি ওদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এসে ওই দাড়িওয়লা লোকটার পিছু নিলাম। পার্ক থেকে বের হয়ে উনি একটা গলির মধ্যে ঢুকলো, পুরোনো দেওয়াল, ভাঙা... আমার কাছে খুব অবাক লাগলো, পৃথিবীর সব বড় বড় ধন কুবেররা থাকে... কোটিপতিরা থাকে এই এলাকা এরকম কেন? কেমন পুরোনো একেকটা দেওয়ালঅলা দালানসব। অনেকটা আমাদের দেশের পুরোনো শহরের মতো।
আমি গিন্সবার্গকে জিজ্ঞেস করলাম ‘এক্সকিউজ মি, আর ইউ অ্যালেন গিন্সবার্গ’? আমার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে সে আরও জোড়ে হাঁটা ধরলো। তারপর আমি তার পিছে পিছে হেঁটে তাকে জিজ্ঞেস করলাম ‘ডু ইউ নো সুনীল? আই অ্যাম ফরম ক্যালকাটা, হি ইজ মাই ভেরি গুড ফ্রেইন্ড’। গিন্সবার্গ আমার মুখের দিকে তাকালো। লম্বা-টম্বা...গিন্সবার্গ মোটাসোটা... দাড়ি আছে...সঙ্গে ক্যামেরা।
গিন্সবার্গ আমাকে বললো, ‘হ্যাঁ সুনীলরে তো আমি চিনি। সুনীল কেমন আছে?’ আমি বললাম, ভাল আছে। আসলে ওটা ছিল মিথ্যা কথা। সুনীলদার সাথে আমার দেখা হয় না তখন অনেক দিন। পরে অবশ্য সুনীল দারে আমি এই ঘটনাটা বলছি।
একসময় গিন্সবার্গ রাস্তা ছেড়ে ফুটপাতে গেল, সেখানে দেখি সে পুরনো বই ঘাটতেছে। ছোট্ট একটা মিনোস ক্যামেরা তখন আমার হাতে। ৭২টা এক্সপোজার হয়। সেই ক্যামেরাটা আমি কিনছিলাম বাংলাদেশের খুব প্রবীন আলোকচিত্রী গোলাম কাসেম ড্যাডিকে উপহার দেওয়ার জন্য। কেনার পরে আমি দুই-তিনটা রিল ছবিও তুলছি।
ওই ক্যামেরা দিয়ে আমি গিন্সবার্গের কয়েকটা ছবি তুললাম, বই কিনতেছে...বই ঘাটতেছে। গিন্সবার্গ যেখান থেকে বই কিনতেছিল সেখানে বিক্রেতা ছিলো একজন কালো, ব্লাক আমেরিকান। ফুটপাতে শুয়ে থাকে আর ওইখানেই বই বিক্রি করে।
খুব ইচ্ছে হলো গিন্সবার্গের সাথে আমার ছবি তোলার। এই যে গিন্সবার্গের সাথে দেখা হলো এটা তো কেউ বিশ্বাস করবে না। আমি ক্যামেরাটা ওই যে বইবিক্রেতা কালো ওর হাতে দিলাম... গিন্সবার্গের সাথে আমার ছবি তোলার জন্য। ও হয়ত সারারাত মদ পান করে... দেখলাম টলতেছে। ও আমার ছবি তুলল।
পরে অবশ্য গিন্সবার্গের সাথে আমার অনেক ভালো সম্পর্ক হয়েছিল। সে আমার একরকমের গুরু হয়েছিল, বন্ধুর মতো সম্পর্ক হয়েছিল। গিন্সবার্গ আমার একটা ছবি এঁকে দিয়েছিলো। ওই ছবি আমি ফেইসবুকে দিছি, ওইখানে গেলেই দেখতে পাবা।
ফেরদৌস মাহমুদ : আপনার সাথে তো স্টিফেন ডব্লিউ হকিংয়ের দেখা হয়েছিল...
নাসির আলী মামুন : স্টিফেন হকিংয়ের ছবি তোলাও একটা নাটকের মতো। ২০০৯ সালের ১২ আগস্ট নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. মুহম্মদ ইউনুসের সাথে আমি গিয়েছিলাম হোয়াইট হাউসে। হোয়াইট হাউসের ‘প্রেসিডেন্টশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম’ দেবেন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, সেই অনুষ্ঠান কাভার করার জন্য।
আমরা রিসিপসনের পাশে বসে আছি, অপেক্ষা করাতাছি। তখন দেখলাম যে অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর থেকে কাচের ভেতর দিয়ে স্টিফেন হকিং। আমি ড.ইউনুসকে বললাম যে, স্যার স্টিফেন হকিং, তার যদি একটা ছবি তোলা যায়। আমরা রুম থেকে বের হয়ে হকিংয়ের সামনে গেলাম।
আমি হকিংয়ের হাস্যোজ্জল ছবি তুললাম। দেখলাম, যখন ছবি তুলছিলাম তখন তার মেয়ে দূরে সরে গেল। তার মেয়ের নাম লুসিয়া হকিং। তিনিও নাকি বিখ্যাত লোক। লুসিয়া আমাকে পরে কানে কানে বলল, প্রফেসর ইউনুস সাহেবের সাথে যদি আমার একটা ছবি তুলে দাও। আমার খুব অবাক লাগলো, হকিংয়ের কাছে গেছি আর তার মেয়ে বলছে ড. ইউনুসের সাথে ছবি তুলতে!
এই সুযোগে আমি হকিংয়ের সাথে ছবি তুললাম। স্টিফেন হকিংয়ের শরীরে হাত দিয়ে ধরলাম, নরম একটা শরীর। নীর্জিব, নিস্প্রাণ...লাশের মতো। শুধু মাথটা কাজ করে, কথা বলতে পারেন না।
ভয়েজ সিন্টোফাইজার নামে একটা মেশিন আছে, ওইটার মাধ্যমে সে কথা বলে। স্পেশালি তার জন্য ওইটা তৈরি করা হয়েছে। সম্ভবত আইবিএম কোম্পানি তার ওই মেশিনটা, কম্পিউটারটা বানিয়ে দিছে, সারাক্ষণ ওইটা তার হুইল চেয়ারের সঙ্গেই থাকে। সারাক্ষণ ওইটা টিক টিক করতে থাকে।
ফেরদৌস মাহমুদ : হকিংকে তো নোবেল দেওয়া হলো না। এর কারণ কি মনে হয় আপনার?
নাসির আলী মামুন : আমি যতটুকু শুনেছি বা জেনেছি তারে নোবেল দিতে অন্তরায় হলো সৌরজগতের যেসব সৃষ্টিরহস্য নিয়ে উনি কাজ করেন, উনি যে সব বিষয়ে রিসার্চ করছেন, প্রবন্ধ লিখছেন সেগুলি প্রমাণ করা নাকি সম্ভব হচ্ছে না। এই কারণে তাকে বিজ্ঞানে নোবেল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তিনি নোবেল পাওয়ার যোগ্যতো অবশ্যই। পৃথিবীর অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী, এই মুহূর্তে তার চেয়ে সেরা বিজ্ঞানী আর নেই।
ফেরদৌস মাহমুদ : হকিং তো এই মাসখানেক আগেই বলল, ভিনগ্রহে প্রাণ আছে। তারা পৃথিবীতে যদি আসে ওটা আমাদের জন্য একটা আতঙ্কের বিষয়। এটা অবশ্য প্রমাণ করা চাইলেই সম্ভব না...
নাসির আলী মামুন : হ্যাঁ, উনি বলতেছেন ভিন গ্রহে প্রাণ আছে। যেখানে আমাদের যাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি, তবে ওরা হয়ত আসতে পারবে। তার সেই বিখ্যাত বই ‘দ্য ব্রিফ হিস্টরি অব টাইম’। এত সরল লেখা, বিশ্বমানের এত বড় একজন লেখক, হাত দিয়ে তার শরীর স্পর্শ করাটা আমার জন্য বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল। তার একটু ভিডিও আমি করেছি। সারাক্ষণ দেখি তার মুখ থেকে লালা ঝরতেছে। দেখলাম এত আকাশচুম্বি, এত বিখ্যাত একজন মানুষ কি অসহায় হতে পারে।
ভয়ংকর বেদনার্ত লোক সে। অসম্ভব নিঃসঙ্গ একজন লোক। সে চাইলে কি না পায়। সে যদি চায় শত শত সুন্দরী তাকে ঘিরে রাখতে পারে।
তার মেয়ে বলল এখন তো তার বাবা বিখ্যাত হইছে তার যে কোনো জায়গায় প্রবেশাধিকার আছে। আগে যখন সে বিখ্যাত ছিল না, তখন লন্ডনে কোনো রেষ্ট্রুরেন্টে তাকে নিয়ে ঢুকলে বের করে দিত। ওরা বলত বাচ্চারা তাকে দেখলে ভয় পায়। অথচ এখন সে ঢুকলে তার জন্য আলাদা জায়গা করে দেয়। বলা যায় ওইটা একটা বিজ্ঞাপন হয়ে যায়।
ফেরদৌস মাহমুদ : জসীমউদদীন তো আপনার ফুপা। তার সাথে আপনার সম্পর্ক নিয়ে কিছু বলুন।
নাসির আলী মামুন : জসীমউদদীনের সাথে আত্মীয়তার কারণে ঠিক না, এমনিতেই আমি যেহেতু বিভিন্ন সৃজনশীল মানুষের ছবি তুলতাম এ কারণেও তার সাথে আমার ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়। তার স্ত্রী সে সময়ের অসাধারণ একজন মহিলা, আমার ফুফু অসাধারণ একজন মহিলা। ২০০৩ সালে জসীমউদদীনের শতবর্ষ উপলক্ষে ফরিদপুর সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে আমি সম্পাদনা করি জসীমউদদীন স্মারক গ্রন্থ। বাংলা একাডেমী তাকে নিয়ে স্মারকগ্রন্থ করেছে এরও দুই বছর পর। তাও সেখানকার অর্ধেক লেখাই নাকি রিপ্রিন্ট। আমার মধ্যে জসীমউদদীন বাস করতো বলেই আমি এ কাজটি করতে পেরেছিলাম। তার পরিবারের পক্ষ থেকেও এরকম একটি কাজ করা সম্ভব হয়নি।
আমি প্রথম যখন কবি দেখি ছোটবেলায় জসীমউদদীনকে দেখি। কাজেই আমার চোখ অনেক বড়। আমার মনের ভিতরে যে হার্ডড্রাইভ আছে সেটা অনেক বড়, কেননা জসীমউদদীনের মত একজন মানুষকে আমাকে ধারণ করতে হয়েছে, কত গিগাবাইট জায়গা লাগছে তখন ওই শিশুবয়সে। তখনই তো সে অনেক বড় কবি। তার রচনা বিপুল বিশাল। তখনই তিনি বিরাট কবি। ট্র্যাকের বাইরে গিয়ে গ্রামের মানুষ নিয়ে সাধু ভাষায় লিখছে। তার লেখা সাধু ভাষা অনেকেই চেইঞ্জ করে চলতি ভাষায় লিখতে বলছে কিন্তু তিনি চেইঞ্জ করেননি। বিরাট সাহসের কাজ করেছেন তিনি।
ফেরদৌস মাহমুদ : একটি জাতীয় দৈনিকে আপনি ‘ঘর নাই’ শিরোনামে ছিন্নমূলদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। এটার নাম ‘ঘর নাই’ কেন? এই সাক্ষাৎকারগুলি নিয়ে এবারের একুশে মেলায় বই প্রকাশ হওয়ার কথা, এ বিষয়ে কিছু বলুন।
নাসির আলী মামুন : আমি সাধারণত বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা সেলিব্রেটি তাদের পোট্রেট করি। করতে করতে দেখলাম যে আমাদের কারণে যারা ফুটপাতে পড়ে গেছে, রাস্তায় পড়ে গেছে তাদের মনের অবস্থা কি? কিছুদিন কিছুকাল তাদের দিকে যদি চোখ ফেরাই তাহলে কেমন হয়? আমি কাওরান বাজার যেখানে অফিস করতাম, সেখানে আশপাশে রাস্তায়-ফুটপাতে অনেককেই দেখতাম ঘুরে বেড়াতে। এদের মধ্য থেকে যারা হোমলেস, যাদের ঠিকানা নাই, ঘরবাড়ি নাই ভাবলাম তাদের কি অবস্থা? এরা কিন্তু মাইনোরিটি। ভিক্ষা করে, চুরি করে, নানা রকমের ছোটখাট ক্রাইমও করে তারা। এরা বেশির ভাগই কিন্তু থাকে বস্তিতে। গ্রামে কোনো না কোনো জায়গায় তাদের একটা ছোট্ট ঠিকানা আছে। নড়বড়ে ঠিকানা। এরমধ্যে খুব মাইনোরিটি একটা গ্রুপ আছে যাদের গ্রামেও কোনো ঠিকানা নাই। তারা ফুটপাতের মধ্যেই থাকে, রেললাইনের কাছে থাকে। তখন আমি শুরু করলাম এদের ইন্টারভিউ করা। প্রথমে চারটি ইন্টারভিউ করলাম আমি, অসাধারণ সব ব্যপার। ওদের সম্পর্কে আমার ধারণা পাল্টাইয়া গেল। একটি জাতীয় দৈনিকে প্রায় ৫ বছর যাবত ছাপা হয়েছে আমার এই সাক্ষাৎকারগুলো।
এইসব সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে ওদের এমনও প্রশ্ন করছি ‘ঘর কেমন ক দেখি’। দেখলাম কইতে পারে না। কেননা এরা কখনো ঘরেই থাকে নাই। যখন জিগাইলাম ‘বাথরুম কি রকম’? দেখলাম কইতে পারে না, কেননা এ সম্পর্কে ওদের কোনো ধারণাই নেই। বিচিত্র সব জীবন আমি দেখলাম।
কিন্তু এই যে একটা শ্রেনী যাদের কোনো ঘর নাই, তাদের আমরা কাজ দেই না। ফলে ওরা অনেক ছোটখাট ক্রাইম করে। কি করব? বাঁচতে তো হইবো। আমি দেখছি ওদের মধ্যে অনেক মানবিকতাও আছে। আমি একজনও পাই নাই যে আসলে ভিক্ষা করতে চায়, ওরা আসলে চায় কাজ করতে। কিন্তু ওদের আমরা কাজ দেই না। রেফারেন্স ছাড়া তো আমরা সাধারণত কাউকে বাসায় কাজ দেই না।
ফেরদৌস মাহমুদ : এই সাক্ষাৎকারগুলি করতে আপনাকে কোথায় কোথায় ঘুরতে হয়েছে?
নাসির আলী মামুন : আমি ইন্টারভিউ করতাম ঢাকার শহরের বিশেষ কয়েকটি স্পটে, যে স্পটগুলিতে এই গৃহহীন মানুষদের আনাগোনা। সেটা কমলাপুর রেলস্টেশন, গুলিস্তান, পল্টন, বাইতুল মোকাররম, ফার্মগেইট, সদরঘাট টার্মিনাল যেখানে ওদের জন্য সামান্য খাদ্যের ব্যবস্থা আছে। সামান্য কাজাটাজ করলে ওরা খাইতে পারে। এই জায়গাগুলিতে আমি ছোট্ট টেপরেকর্ডার আর ক্যামেরা নিয়ে ঘুরতাম আর ঘুইরা ঘুইরা ইন্টারভিউ করতাম। ভুল উচ্চারণে ভুল ব্যকরণে ওরা যা বলত ওইভাবেই আমি ছাপতাম। ওই লেখাগুলোর মধ্যে কোনো চন্দ্রবিন্দু ছিল না। অনেকেই বলত যে আপনি এটা করেন কেন? আমি বলতাম, যে শ্রেনীর সাথে আমি কথা বলি সেখানে আমার মনে হয় চন্দ্রবিন্দুর কোনো দরকার পড়ে না। এইগুলি যে পাঠকরা পড়ে তারা ওইরকমের মাইন্ডসেট হইয়াই পড়ে, এইখানে ব্যাকরণের কোনো দরকারও নাই। কোনো পাঠক অবশ্য এ বিষয়ে অভিযোগ করেনি, করেছে দু’চারজন পণ্ডিত। আমি তাদের বলেছি, এই শ্রেনীর কথ্যভাষার ফ্লেভার আনার জন্য আমি এইভাবে কাজটা করছি। বিপুল পাঠক এইটা সমাদৃত করছে।
২০০০ সালে মাওলা ব্রাদার্স ৪০টা ইন্টারভিউ নিয়ে ‘ঘর নাই’ বই ছেপেছে। বই সবই বিক্রি হয়ে গেছে।
এই ইন্টারভিউ করতে গিয়ে এমনও লোক পাইছি, যে বলতেছে ‘রাজধানীর সব লোকরা দোজখে যাবে।’ সে নিশ্চিত। কী কারণে সেটাও সে বলতেছে ‘রাজধানীর লোকেরা বেশি পাপ করে, মিথ্যাবাদী তারা, প্রতারক’।
আরেকজন বয়স্ক ভদ্রলোক, ৭০ বছর বয়সী তারেও পাইছি। তার ঘর নাই। সে একটা ব্যাগভর্তি, আর গলার মধ্যে একটা ক্যাসেট প্লেয়ার আর একটা ব্যাগভর্তি ক্যাসেট... । জিজ্ঞেস করলাম ‘কী এগুলা’। বলল ‘গীত’। এইগুলি বাজারে বাজারে ফেরি করি। আমি বললাম, আপনে বলতেছেন যে গান করা হারাম, আপনিই আবার গান ফেরি করতেছেন। লোকটা বলে যে, ‘এগুলি তো গান না, এগুলি গীত, এগুলিতে কোনো যন্ত্র নাই’। জিজ্ঞেস করলাম, কার গলা। সে বলল ‘কাদেরের গলা’। গানগুলি খালি গলায় গাওয়া ‘নূর নবী মোস্তফা রাস্তা দিয়া হাইটা যায়’ টাইপ।
একজন পাইছিলাম ব্যাংকের অফিসার, কেরানি আর কি...। প্রেসিডেন্ট সাত্তারের আমলে ১২ হাজার কর্মচারি ছাটাই করছিল, ওর মধ্যে উনি পড়ছিল। হোমলেস হইয়া গেছিল। তার দেখা আমি পাইছিলাম মতিঝিলে। বিচিত্র সব ঘটনা এগুলি। এগুলির কোনো শেষ নাই। গল্প-উপন্যাস-নাটক-সিনেমার মত ঘটনা সব। এগুলি বললে শেষ হবে না।
ফেরদৌস মাহমুদ : আপনার এই বইটা কারা করছে?
নাসির আলী মামুন : আমার বন্ধু সাখাওয়াত টিপু এইগুলি নিয়ে দীর্ঘ চার মাস ধরে কাজ করছে। তার সম্পাদনায় বইটা প্রকাশ হচ্ছে। আগামী প্রকাশনী থেকে বইটা ফেব্রুয়ারির মেলায় বের হবে আশা করছি। এই বইটা নিয়ে সে রীতিমত গবেষণা করছে। এখানকার কথ্য ভাষা থেকে অনেকগুলি শব্দ নিয়ে একটা অভিধানের মত সে দাড় করাইছে। এইখানে অনেকগুলি শব্দ আছে যেগুলি বাংলা একাডেমীর অভিধানে নাই। যেমন দিকনেছারা, সলিমুল্লাহ খান এই শব্দটার ব্যাখ্যা করছে। ‘ঘর নাই’ সিরিজে অনেক ইন্টারভিউ করছিলাম, ওইগুলি থেকে ১১০ টা ইন্টারভিউ সিলেক্ট করা হয়েছে।
আমি মনে করি এই লেখার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব ওদেরই, যারা ‘ঘর নাই’ ব্যক্তিত্ব। যারা আমাকে সময় দিছে। আমার প্রশ্নগুলি ইম্পপরটেন্ট কিছুই না। ওদের কথাগুলিই ইম্পরটেন্ট। ওদের ভাষা, ওদের জীবনযাপন পদ্ধতি, ওদের চিন্তা, পেশার প্রকরণ, ওদের গৃহহীণ হওয়ার কারণ সবই লেখাগুলির মধ্যে আছে। এই কাজটার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব ওদেরই। আমি মনে করি এটা একটা উল্লেখযোগ্য বই।
ফেরদৌস মাহমুদ : এই সাক্ষাৎকারগুলি নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ঝামেলার মুখোমুখি হন নাই?
নাসির আলী মামুন : আমি ক্যামেরা লুকাইয়া নিয়া যাইতাম। কারণ ব্যাগ ট্যাগ আর ক্যামেরা দেখলে ওরা ভয় পাইয়া যাইতো। ওরা মনে করতো এনজিওর লোক কিনা, সরকারী লোক কিনা, কিডনি কাইটা নিয়ে যাবে কিনা। নিয়া খারাপ কাজ করবে কিনা। ধইরা নিয়া যাইবো কিনা বর্ডার পার কইরা ইন্ডিয়াতে। নিয়া খারাপ কাজ করবে কিনা। এই জাতীয় ঘটনার মুখোমুখি তো ওরা হয়। তাই অনেকেই বলছে, আপনার সাথে আমরা কথা বলব না। আপনাকে আমরা সন্দেহ করি।
ইন্টারভিউ করতে চাইলে অনেকেই ইন্টারভিউ দেয় নাই। এমনও হইছে যে, ৭/৮ জনরে সিলেক্ট করছি দেখা গেছে ওইখান থেকে হয়ত একজন ইন্টারভিউ দিছে।
আমি মনে করি, এই যে ‘ঘর নাই’ এখানকার সাক্ষাৎকারগুলি নিয়ে ভবিষ্যতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম বিভাগ, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় বা অনেক বেসরকরি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ হবে এবং ছাত্রদের পড়াবে। এই যে এই লেভেলের মানুষের ইন্টারভিউ নিলে তার রেজাল্ট কি, এই লেভেলের মানুষের ইন্টারভিউ কিভাবে করতে হয় এটা তো উপলব্ধির ব্যপার আছে।
ফেরদৌস মাহমুদ : আপনি তো শিল্পী এস এম সুলতানের অনেক ছবি তুলেছেন। তাকে নিয়ে আপনার একটা আলাদা অ্যালবামও আছে। আপনার একটা ছবি আছে না, বেশ রহস্যময় ভঙ্গিতে বিড়াল নিয়ে সুলাতান বসে আছেন। অদ্ভুত ছবিটা। আমি আপনার সাথে সুলতানের সম্পর্ক ও তার ছবি তোলা প্রসঙ্গে শুনতে চাচ্ছি।
নাসির আলী মামুন : সুলতানের ছবি তোলার সময় সুলতান যে কোঅপারেট করছে আমায় তা না। তার চেহারা, জীবনযাপন, তার পরিবেশটা, তার পোশাকটাই ছিল এরকম যা এ ভারত উপমহাদেশে বা এ সাবকনেটেনের মধ্যে কারও ছিল না। ওরকম চুল, কালো আলখাল্লা বলা যায় রহস্যময় জীবনযাপন। কাজেই নিষ্ঠার সঙ্গে সুলতানের ছবি যে তুলতো সেই আলোচনায় আসতো। তবে সুলতান আমার আলোকচিত্রের যথেষ্ট প্রশংসা করেছে, যেগুলি মুখে না লিখিত আকারে। এগুলির ডকুমেন্ট আছে।
সুলতান আমার মোট ৭টি পোট্রেট করছে। সুলতান আমার ছবির খুব উচ্চ মূল্য দিত। আমি মনে করি বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে এধরণের চিত্রশিল্পী আর আসবে না। তার উপর নয় বছর আমি কাজ করেছি।
ফেরদৌস মাহমুদ : সুলতানের সাথে আপনার প্রথম কবে দেখা হয়?
নাসির আলী মামুন : সুলতান সম্পর্কে আমি প্রথম জানলাম, মুনতাসীর মামুনের একটি লেখা থেকে সাপ্তাহিক বিচিত্রায়। লেখাটির শিরোনাম ‘যে জীবন যার’। ১৯৭৬ সালে। সেখানে তার একটা ছবিও ছিল, যে খালি গায়ে ছবি আঁকতেছে সুলতান। ওই লেখাটা পড়ে এত উজ্জিবিত হয়েছি যে, আমি শিল্পকলায় তার ছবি দেখতে যাই, তাকে সেখানে দেখি কিন্তু কথা বলার সাহস হয়নি।
সুলতান সম্পর্কে আগেই শুনেছি সে নাকি মেরে দেয়। তার সাথে নাকি বেজি থাকে, সাপ থাকে। পরে সুলতানের সাথে অবশ্য সখ্যতা গড়ে ওঠে। সুলতান আমাকে পছন্দ করত। সুলতানের ওপর আমি একটি প্রদর্শনী করেছিলাম। এস এম সুলতান আমার দুইটা প্রদর্শনী ওপেন করছে আর তিনটাতে উপস্থিত ছিল। সে বক্তৃতায় বলেছে ‘এই ফটোগ্রাফারের সাথে আমার সেন্টিমেন্টাল এটাস্টমেন্ট আছে’।
ফেরদৌস মাহমুদ : আপনার মুখের পোট্রেট তো মনে হয় অনেক বিখ্যাত আর্টিস্টই করেছেন।
নাসির আলী মামুন : ৫০ জন আর্টিস্ট আমার মুখের পোট্রেট করছে। সুলতান করেছেন আমার ৭টি পোট্রেট, কামরুল হাসান করছেন ২টি। এই ছবিগুলি দিয়ে আসলে একটা বইই হইতে পারে।
ফেরদৌস মাহমুদ : এ পর্যন্ত কত জন বিখ্যাত লোকের ছবি তুলেছেন ?
নাসির আলী মামুন : এ পর্যন্ত দেশ-বিদেশের প্রায় সাড়ে চার হাজার বিখ্যাত ও সৃজনশীল মানুষের ছবি আমি তুলেছি।
এর মধ্যে কাজী নজরুল ইসলাম, মাওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবর রহমান, জসীমউদদীন, জয়নুল আবেদীন, কামরুল হাসান, অমিয় চক্রবর্তী, সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, বিসমিল্লাহ খাঁ, সল বেলো, নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী আবদুস সালাম, অমর্ত্য সেন, ডেরেক ওয়ালকট, বিল ক্লিনটন, মাহতীর মুহম্মদসহ বিভিন্ন অঙ্গনের দেশ-বিদেশের অনেক বিখ্যাত লোকই রয়েছেন।
ফেরদৌস মাহমুদ : মামুন ভাই, এবার ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। আপনার তোলা আলোকচিত্রগুলো নিয়ে কোনো মিউজিয়াম করার ইচ্ছে আছে নাকি?
নাসির আলী মামুন : আমার ছবিগুলি নিয়ে, সংগ্রহকে নিয়ে একটা মিউজিয়াম করার ইচ্ছা আছে ‘ফটোজিয়াম’ নামে। ২০১৩ সালের জুলাইতে আমার ৬০ বছর হবে। আমার উপর আরেকটা ডকুমেন্টারি করতেছে একজন আর একটা বইও করতেছে। ২০১২ তে আমার ফটোগ্রাফির ৪০ বছর হবে।
আমি কিন্তু ছবি তুলেই চলে আসি না। একটা ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তুলি। আজকাল আমি আরেকটা কাজ করি যারা কোনোদিন ছবি আঁকে না, লেখালেখি করে তাদের দিয়ে ছবি আঁকাই।
ডকু জিনিসটা আমার খুব পছন্দের জিনিস। আমি যাদের ছবি তুলছি তাদের মধ্যে অনেককেই আমি যৌবনকালে দেখছি, পরে তাদের বার্ধক্য এবং মৃত্যু পর্যন্ত দেখেছি। যেমন শামসুর রাহমানের কথাই, তাকে প্রথম যখন দেখি ১৯৭৩ সালে কি হ্যানসাম, কি সুশ্রী। এরকম সুশ্রী লোক খুব কমই ছিল। চোখের সামনেই পরে দেখলাম তার বার্ধক্য, ভঙ্গুর স্বাস্থ্য এবং মৃত্যু। এরকম অনেককেই আমি দেখেছি।
ফেরদৌস মাহমুদ : চল্লিশ বছরে আপনি যত বিখ্যাত লোকের ছবি তুলেছেন, তাদের মধ্যে তো অনেকেই এখন নাই। ওই ছবিগুলি দেখলে আপনার কি অনুভূতি হয়।
নাসির আলী মামুন : যাদের ছবি তুলেছি তাদের মধ্যে ৪০০ জনের উপরে মারাই গেছেন। তাদের নেগেটিভ, তাদের ছবি যখন নাড়াচাড়া করি মনে হয় তারা বুঝি এখনই নড়েচড়ে উঠবে। জীবন্ত হয়ে উঠবে, আমার সাথে কথা বলবে, আমি তাদের সাথে গল্প করবো, ছবি তোলার সময় চাইবো, আমি তাদের অনেক মুহূর্ত বন্দি করবো। এরকম মনে হয়। হঠাৎ এখন কবি শামসুর রাহমানের ছবি দেখলে মনে হয় তিনি মারা যাননি।
অ্যালেন গিন্সবার্গের মৃত্যুর পর যতবারই নিউইয়র্কে গেছি মনে হয়েছে গিন্সবার্গহীন নিউইয়র্ক বিষাদময়। গিন্সবার্গ থাকলে নিউইয়র্ক শহর আরও অনেক ঐশ্বর্যমণ্ডিত হতো আমার অনুভূতিতে। এরকম যাদের মৃত্যু হয়, প্রিয়জনদের যাদের ছবি আমি তুলেছি বা যাদের সাথে দীর্ঘদিন যোগাযোগ ছিল, তাদের মৃত্যুতে খুবই খারাপ লাগে। এটা খুব সহজে মেনে নেওয়া যায় না। এদেরে হাতের লেখা, আঁকা ছবি, বইপত্র এইগুলি ঘাটতে ঘাটতেই তো আমার দিন যায়। আমি এগুলি থেকে অনেক কিছু শিখি, দেখি।
আমি প্রত্যেকের ফেইস রিড করি। তাদের চেহারা আমি পাঠ করি। সেই কারণে যাদের ছবি তুলি কেবল ছবিই তুলি না, তাদের হাতের লেখা, পাণ্ডলিপি, চিঠিপত্র, ডায়েরি আমার সংগ্রহে থাকে। জরাসন্ধ থেকে শুরু করে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সাগরময় ঘোষ, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজসহ অনেকের আমার কাছে লেখা চিঠি আছে।
ফেরদৌস মাহমুদ : শুধু মুখোমণ্ডলের ছবি দিয়ে মানুষের প্রকৃতিকে কি ধারণ করা সম্ভব?
নাসির আলী মামুন : খুব ভালোভাবেই সম্ভব। মানুষের মুখটা হলো আয়নার মতো। আয়নায় তাকাইলে তুমি কি দেখো। তোমার নিজেকে কি দেখা যায় না। তুমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাসতে থাকো হাসিটা দেখবা, কাদতে থাকো কান্নাটা দেখবা। সেরকম মানুষের চেহারা আয়নার মতো, চেহারা দেখলে সেই মানুষটাকে মোটামুটি সনাক্ত করা যায়, তার মনের অবস্থাটা বর্ণনা করা যায় যদি তোমার সেরকম মন থাকে, শিক্ষা থাকে।
একটা মানুষের আঙুল দিয়েও প্রমাণ করা যায়, এই লোকটা অমুক। পিছন দিক দিয়ে ছবি তুলেও বলা সম্ভব এটা অমুক। এটা ফটোগ্রাফারের মুন্সিয়ানার উপর নির্ভর করে সে কতদূর শৈল্পিকভাবে, কতটা দক্ষতার সাথে ছবি তুলতে পারছে।
ক্যানাডার যে বিখ্যাত ফটোগ্রাফার ইউসুফ কার্স, তার বিখ্যাত বই আছে কার্স পোট্রেইট। তার একটা ছবি আছে বিশ্ববিখ্যাত কম্পোজার মিউজিশিয়ান পাবলো ক্যাসালোর। ক্যাসালোর ছবি সে তুলেছে পেছন দিক থেকে। ওইটা দেখে তাকে কিভাবে চেনা যায়? পাবলো ক্যাসাল একধরণের ওভারকোট পড়তো, যেটা বেল্টের মতো তার পেছন দিক থেকে তার ওভারকোটের সাথে লাগানো ছিল, ওইটা সে সামনে বাধতো না, পেছন দিক থেকে ছেড়ে দিত। তার টাক মাথা ছিল। দেখলেই বোঝা যেত ওটা কে।
আমার তোলা এস এম সুলতানের একটা ছবি আছে যেখানে কেবল হাত দেখা যায়। দেখলেই বোঝা যায় অত লম্বা লম্বা আঙুল ওই সময় সুলতান ছাড়া আর কারও ছিল না। কালো আলখাল্লা পরা। আমি তো পুরা চেহারা আনি নাই।
আমার তো মনে হয় একটা মানুষের একটা বিশষে অঙ্গ দিয়েও বুঝানো সম্ভব মানুষটা কে? এইগুলি তো কিছু না, একেকটা চিহ্ন, একেকটা সিগনালের মতো। কাজেই তুমি যখন একটা ফেইসের ছবি তুলবা তোমার ঠিকানা, তোমার অন্তর্দৃষ্টি তার মধ্যে ঠিকই থাকবে। বিষয়টা নির্ভর করে ফটোগ্রাফারের দক্ষতার উপর।
ফেরদৌস মাহমুদ : মামুন ভাই, সারা দিনে অনেক কথা হলো। এবার তো উঠতে হবে...
নাসির আলী মামুন : হ্যাঁ... সন্ধ্যা হয়ে গেছে। তোমাকে তো অনেক দূর যেতে হবে।
ফেরদৌস মাহমুদ : আমাকে এভাবে দীর্ঘ সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
নাসির আলী মামুন : এত দূর এসে আমার সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য তোমাকেও ধন্যবাদ।
বাংলানিউজ, এপ্রিল ১৮, ২০১১
এসব ব্যক্তিত্বদের মধ্যে রয়েছেন বিশ্ববিখ্যাত লেখক, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, রাজনীতিবিদ, বিজ্ঞানীসহ বিভিন্ন সেক্টরের সেরা সেরা ব্যক্তিরা। তার তোলা ছবিতে আলো ছায়ার মিলনে থাকে রহস্যময় শিল্পের খেলা।
৫ জানুয়ারি ২০১১ নাসির আলী মামুনের সাভার জোরপুরের বাসায় তার সাথে দীর্ঘ আড্ডা হয়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন : ফেরদৌস মাহমুদ
ফেরদৌস মাহমুদ : মামুন ভাই, ক্যামেরার প্রেমে পড়লেন কবে?
নাসির আলী মামুন : অন্ধকার কালো বাক্সের জন্য একটা বন্য আকর্ষণ আমার ছিল ছোটবেলা থেকেই। তখন তো আর কেউ ক্যামেরা দিত না, আমার ক্যামেরাও ছিল না। তখন আমি বিভিন্ন খবরের কাগজে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, কোনো বিখ্যাত লেখক, কবি বা কোনো ব্যক্তির ছবি দেখতাম আর কাটতাম। অনেক সময় আব্বা ওই খবরের কাগজ পড়ার আগে আমি কাইটা ফেলতাম। এইজন্য আব্বার হাতে অনেক মাইরও খাইছি। কাটতাম এই কারণে যে, কাইটা ওইটা নিয়া বসতাম, ধ্যানের মতো করে। ভাবতাম এইটাতো ক্যামেরা দিয়েই তোলা হয়েছে। এই ছবিটা কে তুলছে, কিভাবে তুলছে। এই যে বিখ্যাত লোকটা তার সামনে কিভাবে বসছে, তার সাথে কী কথা হইছে, কিভাবে তার সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করছে-- এগুলি নিয়ে নানা রকম প্রশ্ন করতাম মনে মনে। এইভাবে প্রশ্ন করতে করতে কিন্তু আমি ব্যক্তিত্বের ভক্ত হয়ে গেছি।
যেহতু ঢাকার শহরেই আমার জন্ম ১৯৫৩ সালের ১ জুলাই। পুরোনো ঢাকার মৌলভি বাজারে। কাজেই প্রকৃতি বা গ্রাম আমি ছোটবেলা থেকে দেখি নাই। ভাড়া বাড়িতে পুরোনো একটা গলিতে থাকতাম, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের উল্টাদিকে।
এই লোহা-কাঠ-সিমেন্ট-পাথর শুকনা জায়গা এইগুলি আমি দেখছি। আমার প্রকৃতি ছিল ওই টবের মধ্যে বা মাটির মালসার মধ্যে থাকা ছোট গাছ...। কাজেই প্রকৃতির প্রতি আমার আকর্ষণ কোনো কালেই ছিল না। আমি দেখেছি মানুষ। থাকতাম মৌলভি বাজারে দোতলা পুরোনো একটা চিপা ছোট্ট বাসায়। রেলিং ধইরা দাঁড়ালেই দেখতাম নানা ধরণের পণ্য নিয়া মানুষ মাথায় কইরা যাইতাছে, ভ্যানে কইরা নিয়া যাইতাছে, সাইকেলে কইরা যাইতাছে। অথচ কাছেই কিন্তু বুড়িগঙ্গা নদী, ওইপারে বিরাট প্রকৃতি, সুন্দর... ওইগুলি কিন্তু আমারে টানত না।
ফেরদৌস মাহমুদ : প্রথম দিকে কী ধরণের ক্যামেরা ব্যবহার করতেন? ক্যামেরার সাথে ধীরে ধীরে আপনার স্থায়ী সম্পর্কটা কিভাবে গড়ে উঠল?
নাসির আলী মামুন : প্রথম প্রথম নানা জাতের নানা দেশের বিভিন্ন রকমের ক্যামেরা ব্যবহার করেছি। এত ক্যামেরা ব্যবহার করেছি, কারন : নিজের কোনো ক্যামেরা ছিল না। নিজের ক্যামেরা থাকলে তো একটা বা দু’টাই ক্যামেরা ব্যবহারের সুযোগ থাকতো। যেহেতু নিজের কোনো ক্যামেরা ছিল না, তাই সততার বিনিময়ে আমি ক্যামেরা ধার করতাম। কাদের কাছ থেকে করতাম, যারা আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু তাদের কাছ থেকে। আমার কয়েকজন আত্মীয়স্বজনের কাছে ক্যামেরা ছিল, কিন্তু তারা ওই ক্যামেরা ধরতেও দিত না। আমার বন্ধুবান্ধব যাদের সাথে স্কুলে পড়তাম, তখন আমি খোঁজ নিলাম কাদের কাছে ক্যামেরা আছে। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু নাম হচ্ছে হারেস, ওর বোন একবার ওরে লন্ডন থেকে একটা বড় প্যাকেট দিলো। তার মধ্যে অনেকগুলো খেলনা, গাড়ি ছিল, তার মধ্যে একটা প্লাস্টিকের ক্যামেরা ছিল। সময়টা সম্ভবত ১৯৬৬ সাল। ক্যামেরাটা ছিল ফিক্সড ফোকাস... কোনো ডিউ ফাইন্ডার ছিল না। কিভাবে দেখব এটা ছিল না। আন্দাজ করে ছবি তুলতে হতো। ফলে অনেক সময় পা কাটা যেত, মাথা কাটা যেত-- তবে ওই ক্যামেরায় ছবি তুলতে তুলতে একসময় বুঝে গেলাম কিভাবে অনুমানের উপর ক্যামেরা ধরলে পুরোপুরি ছবিটা আসবে।
তখন তো আর পোট্রেইট বুঝতাম না। বুঝতাম, এই জিনিসটা দিয়ে ছবি তোলা যায় যা দেখতে হুবহু সেরকম ছবি আসে। সেটা যাই-ই তুলি না কেন গাছের, বানরের আর মানুষের...। ১৯৬৬ সালের কথা বলছি।
তখন আমাদের একটা ক্লাব ছিল ‘নবারুণ কিশোর সংঘ’। সেই ক্লাবটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৬৪ সালে। ক্লাবটা ছিল ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত। সেই ক্লাবে আমাদের যারা সিনিয়র তারাও খেলত। তাদের মধ্যে একজন হচ্ছেন আবদুল আজিজ। উনি ঢাকা সিটি মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ডার ছিলেন এবং ঢাকা কলেজের ছাত্র সংসদের সভাপতি ছিলেন। উনি আমাদের বড় ভাই, মুরব্বি...। ছিলেন লেফটেনেন্ট বাবুল, উনি বীর উত্তম খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মারা গেছেন। উনিও আমাদের ক্লাবে খেলতেন।
আমাদের ক্লাবটা বন্ধ হয় ১৯৭৩ সালে, তখন আমরা ওই এলাকা ছেড়ে চলে আসলাম। আমাদের ক্লাবের আসলে ভাঙনের শুরু হয় ১৯৭১ সালে। কারণ আমাদের ক্লাবে কয়েকজন বন্ধু ছিল বিহারি। ওরা অনেকে পাকিস্তানে চলে গেল, লাহোরে চলে গেল। আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম।
ওদেরও আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে ক্যামেরা ধার নিতাম। যারা বনেদি বিহারী ছিল ওই সময় তাদের কারও কারও ক্যামেরা ছিল। ধানমন্ডি স্কুলে পড়তাম আমি। তার মধ্যে একজন ওর দাদার ক্যামেরা ধার দিত আমাকে।
একটা ঘটনার কথা বলি-- ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, যেদিন পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করলো, ভারতের যুগ্মকমান্ডের কাছে সেদিন সকাল থেকেই দেখছি অনেক পাকিস্তানি আর্মি, এক পায়ে জুতা আছে তো আরেক পায়ে নেই, জামা ছেঁড়া, গায়ে রক্ত, হাত তুলে বিডিয়ার ক্যাম্পের দিকে যাচ্ছে। সেদিন ওই ছবি তোলার জন্য অনেকের কাছে ক্যামেরা চেয়েছি কিন্তু কেউ দেয়নি। যদি দিত তাহলে হয়ত আমার কাছে ওই সময়ের অনেক ছবি থাকতো। এসব ছবি এখন দেখা যায় না, রক্তাত্ব অবস্থায় পাকিস্তানি আর্মি। চারদিকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। যে পাকিস্তান আর্মিরা তার আগের দিন আমাদের পাখির মত গুলি করে মারছে, রেইপ করছে তারা অসহায় অবস্থায় মাথানত করে যাচ্ছে ওটা দেখার মত দৃশ্য না! ওটা তো একটা দলিল।
ফেরদৌস মাহমুদ : ছবি তোলার জন্য আপনি কত ধরনের ক্যামেরা ব্যবহার করেছেন?
নাসির আলী মামুন : ক্যামেরার আবিষ্কারক কে, এটা নিয়ে একজন কারও নাম বলা যাবে না। বই পইড়া, ক্যামেরা টিপতে টিতে, বিভিন্নজনরে প্রশ্ন করতে করতে আমি ক্যামেরা চলানো শিখছি। ক্যামেরা আবিস্কারের গল্পের মতো আমার ক্যামেরা হাতে নেওয়া। ক্যামেরা বিভিন্নজনের কাছ থেকে নিয়েছি।
আমি অনেক প্রবীণ ফটোগ্রাফারকে জিজ্ঞেস করেছি কয়টা ব্যবহার করেছেন। অনেকে বলছে ৫টা ৬টা, কেউ বলছে ১০টা ১২টা। কিন্তু আমার হিসেবে এই যাবত আমি প্রায় ৭০টার উপরে ক্যামেরা ব্যবহার করেছি। তার মধ্যে থারটি ফাইভ ক্যামেরাই বেশি। ওয়ান টুয়েন্টি ছিল অনেক। এমন ক্যামেরাও আমি ব্যবহার করেছি যা ১৯২২ সালের ক্যামেরা। ওইটা আমার এক স্কুলের বন্ধু চুরি কইরা আইনা দিছিল। ক্যামেরাটা ছিল আমার ওই বন্ধুর দাদার। দাদা হইল ব্রিটিশ আমলের দারোগা। ৭২ সালে সে দাদার বয়স ৯৪-৯৫ বছর। সেই লোক ক্যামেরা একটা মখমলের লাল কাপড় দিয়া মোড়াইয়া রাখতো।
ফেরদৌস মাহমুদ : আপনি ওই সময় কি ধরণের ছবি তুলতেন?
নাসির আলী মামুন : পোট্রেট। আমি তো ৭২ সাল থেকে শুরু করি পোট্রেট ছবি তোলা। আমি দেখলাম যে, বাংলাদেশের আলোকচিত্রে তখন প্রধানত প্রকৃতি নির্ভর ছবি। প্রকৃতি বা ন্যাচারকে বিষয়বস্তু করে বাংলাদেশের সমস্ত ফটোগ্রাফাররা আলোকচিত্র চর্চা করে। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি এমন একটা দিকে যাবো যেদিকে নতুন একটা পথের সূচনা হবে। এই পোট্রেট ফটোগ্রাফির সূচনা করলাম ৭২ সালে।
পোট্রেট ছবি তুলতে গিয়ে যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সৃজনশীল, বিখ্যাত ওদের ছবি তুলতে শুরু করলাম। ধার করা ক্যামেরা দিয়ে আমি ওইসব ছবি তুলেছি। প্রথম ছয় বছর আমার কোনো নিজস্ব ক্যামেরা ছিল না। কিন্তু এই ছয় বছরের মধ্যে আমি দুইটা ক্যামেরা কিনেছি। একটা ক্যামেরা কিনছিলাম, ওইটা এক বছর ছিল। ওই ক্যামেরাটার নাম ‘ক্যাওয়া’। জাপানি ক্যামেরা। ৩২ বার নষ্ট হয়েছিল। ৩৩ বার যখন নষ্ট হয়েছিল তখন ওইটা আর দোকান থেকে ফেরত আনিনি। ওই দোকানেই ছিল, ওটা পরে কি হয়েছিল জানি না। ওই ক্যামেরা দিয়ে আমি শামসুর রাহমান, আহসান হাবীব, আবুল হোসেন, কমরেড মনি সিং এর ছবি তুলেছি, আরও বহু মানুষের।
ক্যামেরার সাথে আমার এমন একটা সম্পর্ক, ক্যামেরাকে আমি প্রাণময় সত্তা হিসেবে দেখি। আমি মনে করি ক্যামেরার প্রাণ আছে। ক্যামেরার চোখ আছে, হার্ট আছে। ক্যামেরা সব কিছুই বোঝে তা না হলে এত ভালো ভালো ছবি তোলে কিভাবে। ক্যামেরার সঙ্গে যে কমিউনিকেট করতে পারবে না তার ছবি ভালো হবে না।
ফেরদৌস মাহমুদ : ছবি তোলার এত সাবজেক্ট থাকতে আপনি কেবল মানুষ বেছে নিয়েছেন, তাও বিখ্যাত মানুষ। আপনি বিখ্যাত লোকের ছবি তোলার দিকেই বা আগ্রহী হলেন কেন?
নাসির আলী মামুন : মানুষ হলো...মানুষ পৃথিবীতে আসছে অল্প সময়ের জন্য। যারা সৃজনশীল মানুষ তারা কাজ করে ২০ বছর ৩০ বছর ৪০ বছর, তারপর হারিয়ে যায়। তাদেরকে এরপর আর পাওয়া যায় না, ক্যামেরার সামনে তাদের আর পাওয়া যায় না।
কিন্তু ফুল-পাখি-নিসর্গ এই যে প্রকৃতি, প্রকৃতির মধ্যে এত রূপ এত রঙ এগুলি কিন্তু সারা পৃথিবীতেই আছে। যেমন-বট গাছ সারা পৃথিবীতে আছে, চড়–ই পাখি সব দেশে আছে, কবুতর সব দেশে আছে। এই যে প্রকৃতির মধ্যে যেসব জিনিসপত্র গাছপালা পশুপাখি তা প্রায় সব দেশেই আছে, কোথাও না কোথাও পাওয়া যায় এবং একই চেহার। আমি দেখলাম আমার দেশের এসএম সুলতান, কবি শামসুর রাহমান, প্রফেসর ইউনুস তারা কিন্তু একটাই। এরা শুধু এদেশেই আছে, এদেরকে অন্য কোথাও গেলে পাওয়া যাবে না। তাদের ভাষা আলাদা, তাদের পোশাক আলাদা, খাদ্যাভ্যাস আলাদা। নিয়ম কানুন আলাদা। আমি এই কারণে দেখলাম যে যারা বুদ্ধিমান, সৃজনশীল তারা অনেক কাজ করে একসময় উধাও হয়ে যায়। আর ফেরে না। এইসব মানুষদের ধরে রাখা, তাদের কষ্ট তাদের দুঃখ তাদের যন্ত্রণা ক্যামেরায় ধরে রাখা যায় কিনা, আমি এসব ধরে রাখার চেষ্টা করেছি ক্যামেরায়।
ফেরদৌস মাহমুদ : আপনার ছবি সাধারণত শাদা-কালো হয়, একটা আলো ছায়ার খেলা থাকে। বেশ একটা রহস্যময় ব্যপার যেন। কিন্তু মুখের পূর্ণ অবয়বটা থাকে না, এটা কেন?
নাসির আলী মামুন : যে জিনিস তুমি সব সময় দেখবা, কানে শুনবা, খুব সহজে পাবা সেটার কিন্তু কোনো মূল্য নাই। সেটাকে কিন্তু এন্টিক বলা যাবে না কখনো।
যেমন, বাংলাদেশের একটা মাটির বদনা সেটা কি অ্যান্টিক? যে কোনো বাজারে গেলেই ১০-১৫ টাকায় কিনতে পারবা। কিন্তু তুমি যখন পাশ্চাত্যে যাবা। মনে করো আমেরিকায় গিয়েছো, সেখানে বাংলাদেশের মাটির বদনা একটা কিনোতো, এইখান থেকে ১২ হাজার মাইল দূরে নিউইয়র্কে, দেখবা পাবা না। ওইখানে এইটা কিন্তু এন্টিক।
সেইরকম প্রকৃতির মধ্যে এত আলো, এই হাজার রকমের কালারগুলা, এর মধ্যে শাদা আর কালো দুইটা কালার। সেই কারণে এইটা একটা এন্টিক, আমি ছবি তুলি শাদা কালোতে। এত রঙ থাকতে রঙের ব্যবহার আমি করি না। রঙের মধ্যে রঙহীন জিনিস নিয়া আমি কাজ করি।
আমরা সাধারণত যারা সাধারণ মানুষ তারা খুব স্পষ্ট, স্বচ্ছ, পরিস্কার জিনিস দেখতে পছন্দ করি। খুব কম লোকই আছে যারা আলো-আধারি-অন্ধকার, অন্ধকারের মধ্যে রহস্যময় একটা কিছু... খুব কম লোকই এত কষ্ট করে দেখতে চায়। সে কারণেও অন্ধকারের মধ্য থেকে আলোটারে দেখাতে চাই আমি। মূল জিনিসটা অন্ধকার, এর মধ্যে একটু আলো।
ওর মধ্যে কি আছে, ওর মধ্যে তার কতটুকু কান্না, ওর মধ্যে তার কতটুকু যন্ত্রণা এটা পাল্লা দিয়ে মাপা যায় কিনা, সে চেষ্টা আমি করি লেন্সের মধ্য দিয়ে, ক্যামেরার মধ্য দিয়ে, আলোকচিত্রের মধ্য দিয়ে। এবং চেষ্টা করি যে একটা নির্জীব খসখসে কাগজের মধ্যে প্রাণময় কোনো সত্তা গুজে দেওয়া যায় কিনা। সেটা পারছি কিনা আমি জানি না।
আমার বেশিরভাগ ছবির মধ্যে মিনিমাম ফিফটি পার্সেন্ট অন্ধকার থাকে। এটা যে আমি খুব পরিকল্পিতভাবে করেছি তা না। আমি যে অনেকের ছবি দেখে করেছি তা না। আমি এখন দেখছি যে, ৭০-৮০ বছর আগে, বা আরও আগে পৃথিবীর অনেক দেশে এই কাজ হয়ে গেছে। ভারত উপমহাদেশে এটা হয়নি, এই যে আলো আধারি দিয়ে এরকম পোট্রেইট তৈরি করা এটা ইন্ডিয়ান সাবকনটেন্টে হয়নি। কিন্তু ৭০-৮০-৯০ বছর আগে পশ্চিমা দেশে ইউরোপে-আমেরিকায় এই ধরনের কাজ হয়ে গেছে। এতকাল পরে দেখছি। আমি যখন ছবি তোলা শুরু করি, তখন যদি এইসব দেখতাম আমার মনে হয় আমি ওইসব দ্বারা ইনফ্লুয়েন্স হয়ে যাইতাম।
আমি মনে করি, কোনো ছবি না দেখে এটা যে শুরু করেছি তা সরলভাবেই করেছি... আলো ছায়ার এই ব্যপারটা। আমি দেখছি যে শাদাকালো ছবিতে ফ্লাট রাখলে মানুষের চোখ কোনো একটা সেন্ট্রাল জিনিসের মধ্যে পড়ে না। আমি মনে করি ছবির মধ্যে আলো ছায়ার অনেক বাক্য থাকে, সেগুলিকে সাজায়ে একটা ছিবি নির্মাণ, একটা ছবি তৈরি করা, একটি ছবি চূড়ান্ত করা, তারপরই একটা সার্থক ছবি বা পোট্রেইট হয়। বুঝতে হবে কতটুকু আলো রাখতে হবে, কতটুকু ছায়া রাখতে হবে। তার বেদনার পরিমাণটা বোঝানোর জন্য কতটুকু ছায়ার মধ্যে তাকে রাখতে হবে।
ফেরদৌস মাহমুদ : ছবি তুলতে গেলে আপনি সাধারণত নির্দিষ্ট মানুষের নানা মহূর্তকে, নানা ভঙ্গিকে সেলেক্ট করেন। এর কারন কি?
নাসির আলী মামুন : আমি ছোটবেলায় যখন এদের ছবি দেখতাম, বইতে পড়তাম, বিভিন্ন লাইব্রেরিতে দেখতাম- আমি পাকিস্তান আমলের কথা বলছি... দেখতাম সবই পাসপোর্ট সাইজের ছবি। পরে যখন কাউকে কাউকে সামনা সামনি দেখতাম অবাক হতাম আরে এই মানুষের সাথে তো ছবির মিল নাই। তার তো মুখে অনেক দাগ, গালভাঙা। ছবিতেতো দেখছি গালফোলা। পরে বুঝলাম এইসব ছবি স্টুডিওতে তোলা বলে ছবিগুলির এই অবস্থা। স্টুডিওর ছবি তো আর শিল্প না। তারা প্রফেশনালি যেভাবে মানুষ চায় সেভাবেই তুলে দেয়। কাজেই ওই ধরণের ছবি আসলে ছবি না।
আমি দেখলাম এমন ছবি তুলবো তার প্রকৃত চেহারাটা অন্তত ধরা পড়বে, তার মুখের দাগগুলি ধরা পড়বে। শুধু তাই না তার অন্তরের কথাও যাতে বোঝা যায়। ভবিষ্যতে কোনো প্রজন্ম যাতে তার ছবি নিয়ে আলোচনা করতে পারে। গবেষণা করতে পারে। এই ধরণের ছবি আমি তোলার চেষ্টা করেছি।
এটার একটা স্থায়ী মূল্য আছে, শিল্প মূল্য আছে, আর্কাইভাল মূল্য আছে। এইগুলি আমার কাজে লাগবে, দেশের কাজে লাগবে, মানুষের কাজে লাগবে, প্রকাশনার কাজে লাগবে, মিডিয়ার কাজে লাগবে।
আমি ওই সময় আমার ছবি ছাপানো জন্য লেখকদের বুঝাইতাম। বলতাম স্টুডিওর ছবি ছাইপেন না। এমনও হইছে লেখকদের বইয়ে আমার ছবি ছাপানোর জন্য প্রেসে পর্যন্ত গেছি।
সৈয়দ শামসুল হকের এক বইতে একটা টাক মাথা ছবি আছে না, পুরোপুরি টাকমাথা। বইটার নাম ‘প্রাচীন বংশের নিস্ব সন্তান’। ওই ছবিটারে প্রচ্ছদ হিসেবে ব্যবহারের জন্য হক ভাইরে আমিই কইছিলাম। হক ভাই পরে আমার কথা রেখেছিল।
ফেরদৌস মাহমুদ : আপনি যাদের ছবি তুলেছেন, নিশ্চয়ই সব ছবিই খুব সহজে তোলা হয়নি। কোনো কোনো ছবি তুলতে গিয়ে অনেক বিড়ম্বনার মুখোমুখিও হয়েছেন। দেখা গেছে কোনো কোনো ছবি হয়ত দূর থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে নিতে হয়েছে। কিংবা ছবি তুলতে অনেকবারই যেতে হয়েছে। বিড়ম্বনার স্বিকার হয়েছেন এরকম কিছু ঘটনার কথা শুনতে চাচ্ছি।
নাসির আলী মামুন : ১৯৮৬ সালের ২ডিসেম্বর যখন জার্মান-লেখক গুন্টার গ্রাস ঢাকায় এসেছিলেন, তখন তার ছবি তোলার জন্য জার্মান কালচারাল সেন্টারের ডিরেক্টর পিটার ডেভিড গোপণীয়ভাবে আমাকেই সিলেক্ট করলেন। উনি ঠিক করলেন কবি বেলাল চৌধুরী তার গাইড থাকবে আর আমি তুলবো ছবি। কিন্তু এদিকে গুন্টার গ্রাস আগেই না করে দিয়েছিল কোনো সাংবাদিক যাতে তার সাথে না থাকে, তিনি কাউকে ইন্টারভিউ দেবেন না এবং ছবি তুলতে দিবেন না।
ফেরদৌস মাহমুদ : আপনি তো গুন্টার গ্রাসের অনেক ছবি তুলে ছিলেন, এই নিষেধাজ্ঞার পরও এটা কিভাবে সম্ভব হলো ?
নাসির আলী মামুন : আমাকে ব্রিফ করা হয়েছিল খুব কৌশলে কাজ করতে হবে। তবে তিনি যদি ‘না’ করেন তবে ছবি তোলা যাবে না, পুরো ব্যপারটাই নির্ভর করছে আমার উপর। আমি খুব আতঙ্কে ছিলাম। ২ ডিসেম্বর ১৯৮৬ গুন্টার গ্রাস এবং তার স্ত্রি উটার গ্রাস যখন কলকাতা থেকে বিমানে এসে নামলেন এয়ারপোর্টে তখন প্রায় ৩০ ফিট দূর থেকে তাদের দুজনের একটি ছবি তুলেছিলাম। তারা ট্রলি ঠেলে নিয়ে আসছিল। ওই সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন বেলাল চৌধুরী, রফিক আজাদ, ত্রিদিব দস্তিদার, রবিউল হুসাইন, আহমদ ছফা এরকম আরও বেশ কয়েকজন। তুলেই আমি তাদের ভিড়ের মধ্যে ক্যামেরাটা আড়াল করে রাখলাম। সবাই যখন ফুল দিচ্ছিল আমি তখন দ্রুত দু’তিনটা ছবি তুলে ফেললাম তাও দূর থেকে। তারপর মাইক্রোবাসে উঠলাম গুন্টার গ্রাসের সাথে।
পরে রাতে গুন্টার গ্রাসের আগমন উপলক্ষে ডিনারের ব্যবস্থা করা হলে, আমি তার উল্টাদিকে বসেছিলাম কায়দা করে। সেখানে আমি তার কয়েকটা ছবি তুলি, দেখি যে গ্রাস কিছু বললেন না। পরের দিন আমরা রওয়ানা দিলাম লালবাগের কেল্লার উদ্দেশ্যে রিক্সায়। রিক্সায় ওঠার সাথে সাথে গুন্টার গ্রাস তার চিরচেনা পাইপটায় আগুন ধরালো, পাশেই হাস্যজ্জল তার স্ত্রী উটার গ্রাস। তারা দুজন রিক্সায় বসা ঢাকার রাস্তায়, আমি ওই ছবি তুলি। তারপর আমি আর বেলাল চৌধুরী সামনের রিক্সায় গিয়ে উঠলাম। তাদের রিক্সা আমাদের ফলো করলো লালবাগের উদ্দেশ্যে। মজার ব্যাপার হলো, লালবাগেও আমি তার ছবি তুললাম। বুঝলাম যে তার মনের মধ্যে আমার ব্যাপারে কোনো সংশয় নাই। সে আমাকে নিরাপদই মনে করেছে। তারপর তো সাতদিন তার ছবি তুলেছি কোনো সমস্যা হয়নি। এরকম আরও অনেক ঘটনা ঘটেছে।
ফেরদৌস মাহমুদ : মাদার তেরেসা বা বিসমিল্লাহ খাঁর ছবি তুলতেও নাকি আপনাকে অনেক ঝামেলা করতে হয়েছিল...
নাসির আলী মামুন : মাদার তেরেসা যখন আসলো ১৯৮১ সালের জানুয়ারিতে, তখন তো তিনি শান্তিতে নোবেল জয়ী। এত বড় মহিয়সী মহিলা মাদার তেরেসা কিন্তুু কোনো প্রেস এলাউ করছিলেন না। কোথায় তার কী অনুষ্ঠান কিছুই জানা যাচ্ছিল না। শুধু শুনেছিলাম তেজগাঁও চার্চে তিনি আসবেন। আমি ওই চার্চের গেটে দাঁড়িয়ে থাকলাম। তখন তিনি ওই চার্চে আছেন।
কিছুক্ষণ পরই দেখি তিনজন নান আর সাথে মাদার তেরেসা চার্চ থেকে বেরিয়ে মাইক্রোতে উঠছেন, তিনি যাবেন পুরনো ঢাকায়। আমি তার গতিরোধ করলাম, আমার সাথে ছিল ওই সময়ের ইত্তেফাকের এক সাংবাদিক নাজিমউদ্দিন মস্তান। আমি বললাম যে ছবি তুলতে দিতেই হবে। মাদার তেরেসা খুবই ক্ষুব্ধ হলেন।
উনি বললেন যে, আমাকে তোমরা আটকাইলা, তোমরা কি জানো অনেক শিশু আমার জন্য অপেক্ষা করতেছে। তোমরা কি অনুতপ্ত না। আমি তার কাছে ক্ষমা চাইলাম। পরে মাদার তেরেসা ছবি তুলতে দিলো। অনেকগুলি ছবি তুললাম তার।
ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খাঁ যখন ঢাকায় আসছিলেন, সম্ভবত ২০০০ সালে। গেলাম তার ছবি তুলতে। তার লেবেলের এত বড় আর্টিস্ট এর আগে আসে নাই ঢাকাতে। যে লোক এত বড় শিল্পী, ভারত বিখ্যাত, পৃথবী বিখ্যাত শিল্পী... সানাই বাজিয়ে লক্ষ লক্ষ লোককে সে কাদায়, আবার আনন্দ দেয়। অনেকে বলে তার সানাই ছাড়া বিয়ে হয় না। ভাবছিলাম কিভাবে তার বেদনাটা ক্যামেরায় বন্দি করা যায়। তার বেদনাটা কী। শুধু চেহারা ধরার জন্য আমি তার ছবি তুলতে যাই নাই। তিনি যে কয়দিন ঢাকাতে ছিলেন প্রতিদিনই আমি চেষ্টা করছিলাম তার পোট্রেট ছবি তোলার কিন্তু সম্ভব হচ্ছিল না।
পরে যেদিন তিনি ঢাকা ছাড়বেন সেদিন তার বড় ছেলেকে গিয়ে বললাম আমার মা তো ‘শিয়া’। বললাম, তোমরা তো শিয়া, এখানে তো শিয়া কম, একটা ছবি যদি না তুলি তাহলে কেমন হয় ব্যপারটা। শিয়া বলার পর দেখলাম, মহূর্তের মধ্যে তার বড় ছেলে কেমন যেন হয়ে গেল। সে বলল, কোনো চিন্তা করো না, আমার বাবার কাছে তোমাকে নিয়ে যাবো। তার ছেলে আমাকে ভিতরে নিয়ে যাওয়ার পর আমার সাথে তার পরিচয় করিয়ে দিলো। বিসমিল্লাহ খাঁ সবসময় অজু করা অবস্থায় থাকতেন। আমি তার সাথে কিছু কথা বললাম। কিছু ছবি তুললাম।
ফেরদৌস মাহমুদ : স্রেফ শিয়া বলার কারণে আপানাকে এ সুযোগ দেওয়া হলো!
নাসির আলী মামুন : আসলে ওটা ছিল আমার একটা টেকনিক। আমি ওনার ছেলেদের পায়ে ধরেও সালাম করেছিলাম। একটা ছেলে ছিল প্রায় আমার সমানই বয়স, তবলাবাদক, তবু আমি তার পা ধরে সালাম করলাম। আমার এত কিছু করার উদ্দেশ্য তো একটাই বিসমিল্লাহ খাঁর সামনে যাওয়া, সেটা গেছি...ছবি তুলে নিয়ে এসেছি।
ফেরদৌস মাহমুদ : অ্যালেন গিন্সবার্গের সাথে সাক্ষাৎ নিয়ে বলুন...
নাসির আলী মামুন : মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ যার নাম আমি বহু আগে থেকেই জানি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা লেখায় তার সম্পর্কে আমি পড়েছিলাম এবং তার ছবি দেখেছিলাম।
সামনাসামনি গিন্সবার্গের দেখা আমি পাই আমেরিকায় এখন থেকে একুশ বছর আগে ১৯৮৯ সালে। তখন নিউইয়র্কের টমকিন স্কয়ার পার্কে একটি অনুষ্ঠান হচ্ছিল, মে দিবসের অনুষ্ঠান। পৃথিবীর সম্ভবত একমাত্র দেশ আমেরিকা, যেখানে মে দিবসের কোনো ছুটি নাই। অথচ মে দিবসের ঘটনাটা আমেরিকাতেই ঘটেছিল।
তো ওই পার্কে আমি ঘোরাঘুরি করতেছি, আমার সাথে আমার বন্ধুরা আছে কয়েকজন। হঠাৎ দেখি যে দাড়িওয়ালা এক লোক ছবি তুলতেছে হোমলেসদের... কাছে গিয়ে দেখলাম হোমলেসরা পিসবোর্ডের বাক্সের মধ্যে কেউ শুয়ে রয়েছে, কেউ গান গাইতাছে, কেউ ঘাসে শুয়ে রয়েছে... টুক টুক করে সে ছবি তুলতেছে। আমি লোকটার দিকে তাকালাম, তাকাইয়া হঠাৎ মনে হলো এই লোকটার ছবি তো আমি ‘দেশ’ পত্রিকাতে দেখেছি। এটা তো অ্যালেন গিন্সবার্গ। গিন্সবার্গ তো নিউইয়র্কেই থাকে...ভেনিজুয়েলারে।
ছবি তুইলা সে আগাইয়া যাইতেছে। ওদিকে মে দিবসের অনুষ্ঠান উপলক্ষে চলছে বিকট ড্রামের আওয়াজ, গানের আওয়াজ... খুব ইনফরমাল ওয়েতে অনুষ্ঠান হচ্ছে...।
আমার সঙ্গে ছিল হাসান ফেরদৌস, আলম খোরশেদ। আমি ওদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এসে ওই দাড়িওয়লা লোকটার পিছু নিলাম। পার্ক থেকে বের হয়ে উনি একটা গলির মধ্যে ঢুকলো, পুরোনো দেওয়াল, ভাঙা... আমার কাছে খুব অবাক লাগলো, পৃথিবীর সব বড় বড় ধন কুবেররা থাকে... কোটিপতিরা থাকে এই এলাকা এরকম কেন? কেমন পুরোনো একেকটা দেওয়ালঅলা দালানসব। অনেকটা আমাদের দেশের পুরোনো শহরের মতো।
আমি গিন্সবার্গকে জিজ্ঞেস করলাম ‘এক্সকিউজ মি, আর ইউ অ্যালেন গিন্সবার্গ’? আমার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে সে আরও জোড়ে হাঁটা ধরলো। তারপর আমি তার পিছে পিছে হেঁটে তাকে জিজ্ঞেস করলাম ‘ডু ইউ নো সুনীল? আই অ্যাম ফরম ক্যালকাটা, হি ইজ মাই ভেরি গুড ফ্রেইন্ড’। গিন্সবার্গ আমার মুখের দিকে তাকালো। লম্বা-টম্বা...গিন্সবার্গ মোটাসোটা... দাড়ি আছে...সঙ্গে ক্যামেরা।
গিন্সবার্গ আমাকে বললো, ‘হ্যাঁ সুনীলরে তো আমি চিনি। সুনীল কেমন আছে?’ আমি বললাম, ভাল আছে। আসলে ওটা ছিল মিথ্যা কথা। সুনীলদার সাথে আমার দেখা হয় না তখন অনেক দিন। পরে অবশ্য সুনীল দারে আমি এই ঘটনাটা বলছি।
একসময় গিন্সবার্গ রাস্তা ছেড়ে ফুটপাতে গেল, সেখানে দেখি সে পুরনো বই ঘাটতেছে। ছোট্ট একটা মিনোস ক্যামেরা তখন আমার হাতে। ৭২টা এক্সপোজার হয়। সেই ক্যামেরাটা আমি কিনছিলাম বাংলাদেশের খুব প্রবীন আলোকচিত্রী গোলাম কাসেম ড্যাডিকে উপহার দেওয়ার জন্য। কেনার পরে আমি দুই-তিনটা রিল ছবিও তুলছি।
ওই ক্যামেরা দিয়ে আমি গিন্সবার্গের কয়েকটা ছবি তুললাম, বই কিনতেছে...বই ঘাটতেছে। গিন্সবার্গ যেখান থেকে বই কিনতেছিল সেখানে বিক্রেতা ছিলো একজন কালো, ব্লাক আমেরিকান। ফুটপাতে শুয়ে থাকে আর ওইখানেই বই বিক্রি করে।
খুব ইচ্ছে হলো গিন্সবার্গের সাথে আমার ছবি তোলার। এই যে গিন্সবার্গের সাথে দেখা হলো এটা তো কেউ বিশ্বাস করবে না। আমি ক্যামেরাটা ওই যে বইবিক্রেতা কালো ওর হাতে দিলাম... গিন্সবার্গের সাথে আমার ছবি তোলার জন্য। ও হয়ত সারারাত মদ পান করে... দেখলাম টলতেছে। ও আমার ছবি তুলল।
পরে অবশ্য গিন্সবার্গের সাথে আমার অনেক ভালো সম্পর্ক হয়েছিল। সে আমার একরকমের গুরু হয়েছিল, বন্ধুর মতো সম্পর্ক হয়েছিল। গিন্সবার্গ আমার একটা ছবি এঁকে দিয়েছিলো। ওই ছবি আমি ফেইসবুকে দিছি, ওইখানে গেলেই দেখতে পাবা।
ফেরদৌস মাহমুদ : আপনার সাথে তো স্টিফেন ডব্লিউ হকিংয়ের দেখা হয়েছিল...
নাসির আলী মামুন : স্টিফেন হকিংয়ের ছবি তোলাও একটা নাটকের মতো। ২০০৯ সালের ১২ আগস্ট নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. মুহম্মদ ইউনুসের সাথে আমি গিয়েছিলাম হোয়াইট হাউসে। হোয়াইট হাউসের ‘প্রেসিডেন্টশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম’ দেবেন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, সেই অনুষ্ঠান কাভার করার জন্য।
আমরা রিসিপসনের পাশে বসে আছি, অপেক্ষা করাতাছি। তখন দেখলাম যে অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর থেকে কাচের ভেতর দিয়ে স্টিফেন হকিং। আমি ড.ইউনুসকে বললাম যে, স্যার স্টিফেন হকিং, তার যদি একটা ছবি তোলা যায়। আমরা রুম থেকে বের হয়ে হকিংয়ের সামনে গেলাম।
আমি হকিংয়ের হাস্যোজ্জল ছবি তুললাম। দেখলাম, যখন ছবি তুলছিলাম তখন তার মেয়ে দূরে সরে গেল। তার মেয়ের নাম লুসিয়া হকিং। তিনিও নাকি বিখ্যাত লোক। লুসিয়া আমাকে পরে কানে কানে বলল, প্রফেসর ইউনুস সাহেবের সাথে যদি আমার একটা ছবি তুলে দাও। আমার খুব অবাক লাগলো, হকিংয়ের কাছে গেছি আর তার মেয়ে বলছে ড. ইউনুসের সাথে ছবি তুলতে!
এই সুযোগে আমি হকিংয়ের সাথে ছবি তুললাম। স্টিফেন হকিংয়ের শরীরে হাত দিয়ে ধরলাম, নরম একটা শরীর। নীর্জিব, নিস্প্রাণ...লাশের মতো। শুধু মাথটা কাজ করে, কথা বলতে পারেন না।
ভয়েজ সিন্টোফাইজার নামে একটা মেশিন আছে, ওইটার মাধ্যমে সে কথা বলে। স্পেশালি তার জন্য ওইটা তৈরি করা হয়েছে। সম্ভবত আইবিএম কোম্পানি তার ওই মেশিনটা, কম্পিউটারটা বানিয়ে দিছে, সারাক্ষণ ওইটা তার হুইল চেয়ারের সঙ্গেই থাকে। সারাক্ষণ ওইটা টিক টিক করতে থাকে।
ফেরদৌস মাহমুদ : হকিংকে তো নোবেল দেওয়া হলো না। এর কারণ কি মনে হয় আপনার?
নাসির আলী মামুন : আমি যতটুকু শুনেছি বা জেনেছি তারে নোবেল দিতে অন্তরায় হলো সৌরজগতের যেসব সৃষ্টিরহস্য নিয়ে উনি কাজ করেন, উনি যে সব বিষয়ে রিসার্চ করছেন, প্রবন্ধ লিখছেন সেগুলি প্রমাণ করা নাকি সম্ভব হচ্ছে না। এই কারণে তাকে বিজ্ঞানে নোবেল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তিনি নোবেল পাওয়ার যোগ্যতো অবশ্যই। পৃথিবীর অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী, এই মুহূর্তে তার চেয়ে সেরা বিজ্ঞানী আর নেই।
ফেরদৌস মাহমুদ : হকিং তো এই মাসখানেক আগেই বলল, ভিনগ্রহে প্রাণ আছে। তারা পৃথিবীতে যদি আসে ওটা আমাদের জন্য একটা আতঙ্কের বিষয়। এটা অবশ্য প্রমাণ করা চাইলেই সম্ভব না...
নাসির আলী মামুন : হ্যাঁ, উনি বলতেছেন ভিন গ্রহে প্রাণ আছে। যেখানে আমাদের যাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি, তবে ওরা হয়ত আসতে পারবে। তার সেই বিখ্যাত বই ‘দ্য ব্রিফ হিস্টরি অব টাইম’। এত সরল লেখা, বিশ্বমানের এত বড় একজন লেখক, হাত দিয়ে তার শরীর স্পর্শ করাটা আমার জন্য বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল। তার একটু ভিডিও আমি করেছি। সারাক্ষণ দেখি তার মুখ থেকে লালা ঝরতেছে। দেখলাম এত আকাশচুম্বি, এত বিখ্যাত একজন মানুষ কি অসহায় হতে পারে।
ভয়ংকর বেদনার্ত লোক সে। অসম্ভব নিঃসঙ্গ একজন লোক। সে চাইলে কি না পায়। সে যদি চায় শত শত সুন্দরী তাকে ঘিরে রাখতে পারে।
তার মেয়ে বলল এখন তো তার বাবা বিখ্যাত হইছে তার যে কোনো জায়গায় প্রবেশাধিকার আছে। আগে যখন সে বিখ্যাত ছিল না, তখন লন্ডনে কোনো রেষ্ট্রুরেন্টে তাকে নিয়ে ঢুকলে বের করে দিত। ওরা বলত বাচ্চারা তাকে দেখলে ভয় পায়। অথচ এখন সে ঢুকলে তার জন্য আলাদা জায়গা করে দেয়। বলা যায় ওইটা একটা বিজ্ঞাপন হয়ে যায়।
ফেরদৌস মাহমুদ : জসীমউদদীন তো আপনার ফুপা। তার সাথে আপনার সম্পর্ক নিয়ে কিছু বলুন।
নাসির আলী মামুন : জসীমউদদীনের সাথে আত্মীয়তার কারণে ঠিক না, এমনিতেই আমি যেহেতু বিভিন্ন সৃজনশীল মানুষের ছবি তুলতাম এ কারণেও তার সাথে আমার ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়। তার স্ত্রী সে সময়ের অসাধারণ একজন মহিলা, আমার ফুফু অসাধারণ একজন মহিলা। ২০০৩ সালে জসীমউদদীনের শতবর্ষ উপলক্ষে ফরিদপুর সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে আমি সম্পাদনা করি জসীমউদদীন স্মারক গ্রন্থ। বাংলা একাডেমী তাকে নিয়ে স্মারকগ্রন্থ করেছে এরও দুই বছর পর। তাও সেখানকার অর্ধেক লেখাই নাকি রিপ্রিন্ট। আমার মধ্যে জসীমউদদীন বাস করতো বলেই আমি এ কাজটি করতে পেরেছিলাম। তার পরিবারের পক্ষ থেকেও এরকম একটি কাজ করা সম্ভব হয়নি।
আমি প্রথম যখন কবি দেখি ছোটবেলায় জসীমউদদীনকে দেখি। কাজেই আমার চোখ অনেক বড়। আমার মনের ভিতরে যে হার্ডড্রাইভ আছে সেটা অনেক বড়, কেননা জসীমউদদীনের মত একজন মানুষকে আমাকে ধারণ করতে হয়েছে, কত গিগাবাইট জায়গা লাগছে তখন ওই শিশুবয়সে। তখনই তো সে অনেক বড় কবি। তার রচনা বিপুল বিশাল। তখনই তিনি বিরাট কবি। ট্র্যাকের বাইরে গিয়ে গ্রামের মানুষ নিয়ে সাধু ভাষায় লিখছে। তার লেখা সাধু ভাষা অনেকেই চেইঞ্জ করে চলতি ভাষায় লিখতে বলছে কিন্তু তিনি চেইঞ্জ করেননি। বিরাট সাহসের কাজ করেছেন তিনি।
ফেরদৌস মাহমুদ : একটি জাতীয় দৈনিকে আপনি ‘ঘর নাই’ শিরোনামে ছিন্নমূলদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। এটার নাম ‘ঘর নাই’ কেন? এই সাক্ষাৎকারগুলি নিয়ে এবারের একুশে মেলায় বই প্রকাশ হওয়ার কথা, এ বিষয়ে কিছু বলুন।
নাসির আলী মামুন : আমি সাধারণত বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা সেলিব্রেটি তাদের পোট্রেট করি। করতে করতে দেখলাম যে আমাদের কারণে যারা ফুটপাতে পড়ে গেছে, রাস্তায় পড়ে গেছে তাদের মনের অবস্থা কি? কিছুদিন কিছুকাল তাদের দিকে যদি চোখ ফেরাই তাহলে কেমন হয়? আমি কাওরান বাজার যেখানে অফিস করতাম, সেখানে আশপাশে রাস্তায়-ফুটপাতে অনেককেই দেখতাম ঘুরে বেড়াতে। এদের মধ্য থেকে যারা হোমলেস, যাদের ঠিকানা নাই, ঘরবাড়ি নাই ভাবলাম তাদের কি অবস্থা? এরা কিন্তু মাইনোরিটি। ভিক্ষা করে, চুরি করে, নানা রকমের ছোটখাট ক্রাইমও করে তারা। এরা বেশির ভাগই কিন্তু থাকে বস্তিতে। গ্রামে কোনো না কোনো জায়গায় তাদের একটা ছোট্ট ঠিকানা আছে। নড়বড়ে ঠিকানা। এরমধ্যে খুব মাইনোরিটি একটা গ্রুপ আছে যাদের গ্রামেও কোনো ঠিকানা নাই। তারা ফুটপাতের মধ্যেই থাকে, রেললাইনের কাছে থাকে। তখন আমি শুরু করলাম এদের ইন্টারভিউ করা। প্রথমে চারটি ইন্টারভিউ করলাম আমি, অসাধারণ সব ব্যপার। ওদের সম্পর্কে আমার ধারণা পাল্টাইয়া গেল। একটি জাতীয় দৈনিকে প্রায় ৫ বছর যাবত ছাপা হয়েছে আমার এই সাক্ষাৎকারগুলো।
এইসব সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে ওদের এমনও প্রশ্ন করছি ‘ঘর কেমন ক দেখি’। দেখলাম কইতে পারে না। কেননা এরা কখনো ঘরেই থাকে নাই। যখন জিগাইলাম ‘বাথরুম কি রকম’? দেখলাম কইতে পারে না, কেননা এ সম্পর্কে ওদের কোনো ধারণাই নেই। বিচিত্র সব জীবন আমি দেখলাম।
কিন্তু এই যে একটা শ্রেনী যাদের কোনো ঘর নাই, তাদের আমরা কাজ দেই না। ফলে ওরা অনেক ছোটখাট ক্রাইম করে। কি করব? বাঁচতে তো হইবো। আমি দেখছি ওদের মধ্যে অনেক মানবিকতাও আছে। আমি একজনও পাই নাই যে আসলে ভিক্ষা করতে চায়, ওরা আসলে চায় কাজ করতে। কিন্তু ওদের আমরা কাজ দেই না। রেফারেন্স ছাড়া তো আমরা সাধারণত কাউকে বাসায় কাজ দেই না।
ফেরদৌস মাহমুদ : এই সাক্ষাৎকারগুলি করতে আপনাকে কোথায় কোথায় ঘুরতে হয়েছে?
নাসির আলী মামুন : আমি ইন্টারভিউ করতাম ঢাকার শহরের বিশেষ কয়েকটি স্পটে, যে স্পটগুলিতে এই গৃহহীন মানুষদের আনাগোনা। সেটা কমলাপুর রেলস্টেশন, গুলিস্তান, পল্টন, বাইতুল মোকাররম, ফার্মগেইট, সদরঘাট টার্মিনাল যেখানে ওদের জন্য সামান্য খাদ্যের ব্যবস্থা আছে। সামান্য কাজাটাজ করলে ওরা খাইতে পারে। এই জায়গাগুলিতে আমি ছোট্ট টেপরেকর্ডার আর ক্যামেরা নিয়ে ঘুরতাম আর ঘুইরা ঘুইরা ইন্টারভিউ করতাম। ভুল উচ্চারণে ভুল ব্যকরণে ওরা যা বলত ওইভাবেই আমি ছাপতাম। ওই লেখাগুলোর মধ্যে কোনো চন্দ্রবিন্দু ছিল না। অনেকেই বলত যে আপনি এটা করেন কেন? আমি বলতাম, যে শ্রেনীর সাথে আমি কথা বলি সেখানে আমার মনে হয় চন্দ্রবিন্দুর কোনো দরকার পড়ে না। এইগুলি যে পাঠকরা পড়ে তারা ওইরকমের মাইন্ডসেট হইয়াই পড়ে, এইখানে ব্যাকরণের কোনো দরকারও নাই। কোনো পাঠক অবশ্য এ বিষয়ে অভিযোগ করেনি, করেছে দু’চারজন পণ্ডিত। আমি তাদের বলেছি, এই শ্রেনীর কথ্যভাষার ফ্লেভার আনার জন্য আমি এইভাবে কাজটা করছি। বিপুল পাঠক এইটা সমাদৃত করছে।
২০০০ সালে মাওলা ব্রাদার্স ৪০টা ইন্টারভিউ নিয়ে ‘ঘর নাই’ বই ছেপেছে। বই সবই বিক্রি হয়ে গেছে।
এই ইন্টারভিউ করতে গিয়ে এমনও লোক পাইছি, যে বলতেছে ‘রাজধানীর সব লোকরা দোজখে যাবে।’ সে নিশ্চিত। কী কারণে সেটাও সে বলতেছে ‘রাজধানীর লোকেরা বেশি পাপ করে, মিথ্যাবাদী তারা, প্রতারক’।
আরেকজন বয়স্ক ভদ্রলোক, ৭০ বছর বয়সী তারেও পাইছি। তার ঘর নাই। সে একটা ব্যাগভর্তি, আর গলার মধ্যে একটা ক্যাসেট প্লেয়ার আর একটা ব্যাগভর্তি ক্যাসেট... । জিজ্ঞেস করলাম ‘কী এগুলা’। বলল ‘গীত’। এইগুলি বাজারে বাজারে ফেরি করি। আমি বললাম, আপনে বলতেছেন যে গান করা হারাম, আপনিই আবার গান ফেরি করতেছেন। লোকটা বলে যে, ‘এগুলি তো গান না, এগুলি গীত, এগুলিতে কোনো যন্ত্র নাই’। জিজ্ঞেস করলাম, কার গলা। সে বলল ‘কাদেরের গলা’। গানগুলি খালি গলায় গাওয়া ‘নূর নবী মোস্তফা রাস্তা দিয়া হাইটা যায়’ টাইপ।
একজন পাইছিলাম ব্যাংকের অফিসার, কেরানি আর কি...। প্রেসিডেন্ট সাত্তারের আমলে ১২ হাজার কর্মচারি ছাটাই করছিল, ওর মধ্যে উনি পড়ছিল। হোমলেস হইয়া গেছিল। তার দেখা আমি পাইছিলাম মতিঝিলে। বিচিত্র সব ঘটনা এগুলি। এগুলির কোনো শেষ নাই। গল্প-উপন্যাস-নাটক-সিনেমার মত ঘটনা সব। এগুলি বললে শেষ হবে না।
ফেরদৌস মাহমুদ : আপনার এই বইটা কারা করছে?
নাসির আলী মামুন : আমার বন্ধু সাখাওয়াত টিপু এইগুলি নিয়ে দীর্ঘ চার মাস ধরে কাজ করছে। তার সম্পাদনায় বইটা প্রকাশ হচ্ছে। আগামী প্রকাশনী থেকে বইটা ফেব্রুয়ারির মেলায় বের হবে আশা করছি। এই বইটা নিয়ে সে রীতিমত গবেষণা করছে। এখানকার কথ্য ভাষা থেকে অনেকগুলি শব্দ নিয়ে একটা অভিধানের মত সে দাড় করাইছে। এইখানে অনেকগুলি শব্দ আছে যেগুলি বাংলা একাডেমীর অভিধানে নাই। যেমন দিকনেছারা, সলিমুল্লাহ খান এই শব্দটার ব্যাখ্যা করছে। ‘ঘর নাই’ সিরিজে অনেক ইন্টারভিউ করছিলাম, ওইগুলি থেকে ১১০ টা ইন্টারভিউ সিলেক্ট করা হয়েছে।
আমি মনে করি এই লেখার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব ওদেরই, যারা ‘ঘর নাই’ ব্যক্তিত্ব। যারা আমাকে সময় দিছে। আমার প্রশ্নগুলি ইম্পপরটেন্ট কিছুই না। ওদের কথাগুলিই ইম্পরটেন্ট। ওদের ভাষা, ওদের জীবনযাপন পদ্ধতি, ওদের চিন্তা, পেশার প্রকরণ, ওদের গৃহহীণ হওয়ার কারণ সবই লেখাগুলির মধ্যে আছে। এই কাজটার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব ওদেরই। আমি মনে করি এটা একটা উল্লেখযোগ্য বই।
ফেরদৌস মাহমুদ : এই সাক্ষাৎকারগুলি নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ঝামেলার মুখোমুখি হন নাই?
নাসির আলী মামুন : আমি ক্যামেরা লুকাইয়া নিয়া যাইতাম। কারণ ব্যাগ ট্যাগ আর ক্যামেরা দেখলে ওরা ভয় পাইয়া যাইতো। ওরা মনে করতো এনজিওর লোক কিনা, সরকারী লোক কিনা, কিডনি কাইটা নিয়ে যাবে কিনা। নিয়া খারাপ কাজ করবে কিনা। ধইরা নিয়া যাইবো কিনা বর্ডার পার কইরা ইন্ডিয়াতে। নিয়া খারাপ কাজ করবে কিনা। এই জাতীয় ঘটনার মুখোমুখি তো ওরা হয়। তাই অনেকেই বলছে, আপনার সাথে আমরা কথা বলব না। আপনাকে আমরা সন্দেহ করি।
ইন্টারভিউ করতে চাইলে অনেকেই ইন্টারভিউ দেয় নাই। এমনও হইছে যে, ৭/৮ জনরে সিলেক্ট করছি দেখা গেছে ওইখান থেকে হয়ত একজন ইন্টারভিউ দিছে।
আমি মনে করি, এই যে ‘ঘর নাই’ এখানকার সাক্ষাৎকারগুলি নিয়ে ভবিষ্যতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম বিভাগ, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় বা অনেক বেসরকরি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ হবে এবং ছাত্রদের পড়াবে। এই যে এই লেভেলের মানুষের ইন্টারভিউ নিলে তার রেজাল্ট কি, এই লেভেলের মানুষের ইন্টারভিউ কিভাবে করতে হয় এটা তো উপলব্ধির ব্যপার আছে।
ফেরদৌস মাহমুদ : আপনি তো শিল্পী এস এম সুলতানের অনেক ছবি তুলেছেন। তাকে নিয়ে আপনার একটা আলাদা অ্যালবামও আছে। আপনার একটা ছবি আছে না, বেশ রহস্যময় ভঙ্গিতে বিড়াল নিয়ে সুলাতান বসে আছেন। অদ্ভুত ছবিটা। আমি আপনার সাথে সুলতানের সম্পর্ক ও তার ছবি তোলা প্রসঙ্গে শুনতে চাচ্ছি।
নাসির আলী মামুন : সুলতানের ছবি তোলার সময় সুলতান যে কোঅপারেট করছে আমায় তা না। তার চেহারা, জীবনযাপন, তার পরিবেশটা, তার পোশাকটাই ছিল এরকম যা এ ভারত উপমহাদেশে বা এ সাবকনেটেনের মধ্যে কারও ছিল না। ওরকম চুল, কালো আলখাল্লা বলা যায় রহস্যময় জীবনযাপন। কাজেই নিষ্ঠার সঙ্গে সুলতানের ছবি যে তুলতো সেই আলোচনায় আসতো। তবে সুলতান আমার আলোকচিত্রের যথেষ্ট প্রশংসা করেছে, যেগুলি মুখে না লিখিত আকারে। এগুলির ডকুমেন্ট আছে।
সুলতান আমার মোট ৭টি পোট্রেট করছে। সুলতান আমার ছবির খুব উচ্চ মূল্য দিত। আমি মনে করি বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে এধরণের চিত্রশিল্পী আর আসবে না। তার উপর নয় বছর আমি কাজ করেছি।
ফেরদৌস মাহমুদ : সুলতানের সাথে আপনার প্রথম কবে দেখা হয়?
নাসির আলী মামুন : সুলতান সম্পর্কে আমি প্রথম জানলাম, মুনতাসীর মামুনের একটি লেখা থেকে সাপ্তাহিক বিচিত্রায়। লেখাটির শিরোনাম ‘যে জীবন যার’। ১৯৭৬ সালে। সেখানে তার একটা ছবিও ছিল, যে খালি গায়ে ছবি আঁকতেছে সুলতান। ওই লেখাটা পড়ে এত উজ্জিবিত হয়েছি যে, আমি শিল্পকলায় তার ছবি দেখতে যাই, তাকে সেখানে দেখি কিন্তু কথা বলার সাহস হয়নি।
সুলতান সম্পর্কে আগেই শুনেছি সে নাকি মেরে দেয়। তার সাথে নাকি বেজি থাকে, সাপ থাকে। পরে সুলতানের সাথে অবশ্য সখ্যতা গড়ে ওঠে। সুলতান আমাকে পছন্দ করত। সুলতানের ওপর আমি একটি প্রদর্শনী করেছিলাম। এস এম সুলতান আমার দুইটা প্রদর্শনী ওপেন করছে আর তিনটাতে উপস্থিত ছিল। সে বক্তৃতায় বলেছে ‘এই ফটোগ্রাফারের সাথে আমার সেন্টিমেন্টাল এটাস্টমেন্ট আছে’।
ফেরদৌস মাহমুদ : আপনার মুখের পোট্রেট তো মনে হয় অনেক বিখ্যাত আর্টিস্টই করেছেন।
নাসির আলী মামুন : ৫০ জন আর্টিস্ট আমার মুখের পোট্রেট করছে। সুলতান করেছেন আমার ৭টি পোট্রেট, কামরুল হাসান করছেন ২টি। এই ছবিগুলি দিয়ে আসলে একটা বইই হইতে পারে।
ফেরদৌস মাহমুদ : এ পর্যন্ত কত জন বিখ্যাত লোকের ছবি তুলেছেন ?
নাসির আলী মামুন : এ পর্যন্ত দেশ-বিদেশের প্রায় সাড়ে চার হাজার বিখ্যাত ও সৃজনশীল মানুষের ছবি আমি তুলেছি।
এর মধ্যে কাজী নজরুল ইসলাম, মাওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবর রহমান, জসীমউদদীন, জয়নুল আবেদীন, কামরুল হাসান, অমিয় চক্রবর্তী, সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, বিসমিল্লাহ খাঁ, সল বেলো, নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী আবদুস সালাম, অমর্ত্য সেন, ডেরেক ওয়ালকট, বিল ক্লিনটন, মাহতীর মুহম্মদসহ বিভিন্ন অঙ্গনের দেশ-বিদেশের অনেক বিখ্যাত লোকই রয়েছেন।
ফেরদৌস মাহমুদ : মামুন ভাই, এবার ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। আপনার তোলা আলোকচিত্রগুলো নিয়ে কোনো মিউজিয়াম করার ইচ্ছে আছে নাকি?
নাসির আলী মামুন : আমার ছবিগুলি নিয়ে, সংগ্রহকে নিয়ে একটা মিউজিয়াম করার ইচ্ছা আছে ‘ফটোজিয়াম’ নামে। ২০১৩ সালের জুলাইতে আমার ৬০ বছর হবে। আমার উপর আরেকটা ডকুমেন্টারি করতেছে একজন আর একটা বইও করতেছে। ২০১২ তে আমার ফটোগ্রাফির ৪০ বছর হবে।
আমি কিন্তু ছবি তুলেই চলে আসি না। একটা ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তুলি। আজকাল আমি আরেকটা কাজ করি যারা কোনোদিন ছবি আঁকে না, লেখালেখি করে তাদের দিয়ে ছবি আঁকাই।
ডকু জিনিসটা আমার খুব পছন্দের জিনিস। আমি যাদের ছবি তুলছি তাদের মধ্যে অনেককেই আমি যৌবনকালে দেখছি, পরে তাদের বার্ধক্য এবং মৃত্যু পর্যন্ত দেখেছি। যেমন শামসুর রাহমানের কথাই, তাকে প্রথম যখন দেখি ১৯৭৩ সালে কি হ্যানসাম, কি সুশ্রী। এরকম সুশ্রী লোক খুব কমই ছিল। চোখের সামনেই পরে দেখলাম তার বার্ধক্য, ভঙ্গুর স্বাস্থ্য এবং মৃত্যু। এরকম অনেককেই আমি দেখেছি।
ফেরদৌস মাহমুদ : চল্লিশ বছরে আপনি যত বিখ্যাত লোকের ছবি তুলেছেন, তাদের মধ্যে তো অনেকেই এখন নাই। ওই ছবিগুলি দেখলে আপনার কি অনুভূতি হয়।
নাসির আলী মামুন : যাদের ছবি তুলেছি তাদের মধ্যে ৪০০ জনের উপরে মারাই গেছেন। তাদের নেগেটিভ, তাদের ছবি যখন নাড়াচাড়া করি মনে হয় তারা বুঝি এখনই নড়েচড়ে উঠবে। জীবন্ত হয়ে উঠবে, আমার সাথে কথা বলবে, আমি তাদের সাথে গল্প করবো, ছবি তোলার সময় চাইবো, আমি তাদের অনেক মুহূর্ত বন্দি করবো। এরকম মনে হয়। হঠাৎ এখন কবি শামসুর রাহমানের ছবি দেখলে মনে হয় তিনি মারা যাননি।
অ্যালেন গিন্সবার্গের মৃত্যুর পর যতবারই নিউইয়র্কে গেছি মনে হয়েছে গিন্সবার্গহীন নিউইয়র্ক বিষাদময়। গিন্সবার্গ থাকলে নিউইয়র্ক শহর আরও অনেক ঐশ্বর্যমণ্ডিত হতো আমার অনুভূতিতে। এরকম যাদের মৃত্যু হয়, প্রিয়জনদের যাদের ছবি আমি তুলেছি বা যাদের সাথে দীর্ঘদিন যোগাযোগ ছিল, তাদের মৃত্যুতে খুবই খারাপ লাগে। এটা খুব সহজে মেনে নেওয়া যায় না। এদেরে হাতের লেখা, আঁকা ছবি, বইপত্র এইগুলি ঘাটতে ঘাটতেই তো আমার দিন যায়। আমি এগুলি থেকে অনেক কিছু শিখি, দেখি।
আমি প্রত্যেকের ফেইস রিড করি। তাদের চেহারা আমি পাঠ করি। সেই কারণে যাদের ছবি তুলি কেবল ছবিই তুলি না, তাদের হাতের লেখা, পাণ্ডলিপি, চিঠিপত্র, ডায়েরি আমার সংগ্রহে থাকে। জরাসন্ধ থেকে শুরু করে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সাগরময় ঘোষ, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজসহ অনেকের আমার কাছে লেখা চিঠি আছে।
ফেরদৌস মাহমুদ : শুধু মুখোমণ্ডলের ছবি দিয়ে মানুষের প্রকৃতিকে কি ধারণ করা সম্ভব?
নাসির আলী মামুন : খুব ভালোভাবেই সম্ভব। মানুষের মুখটা হলো আয়নার মতো। আয়নায় তাকাইলে তুমি কি দেখো। তোমার নিজেকে কি দেখা যায় না। তুমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাসতে থাকো হাসিটা দেখবা, কাদতে থাকো কান্নাটা দেখবা। সেরকম মানুষের চেহারা আয়নার মতো, চেহারা দেখলে সেই মানুষটাকে মোটামুটি সনাক্ত করা যায়, তার মনের অবস্থাটা বর্ণনা করা যায় যদি তোমার সেরকম মন থাকে, শিক্ষা থাকে।
একটা মানুষের আঙুল দিয়েও প্রমাণ করা যায়, এই লোকটা অমুক। পিছন দিক দিয়ে ছবি তুলেও বলা সম্ভব এটা অমুক। এটা ফটোগ্রাফারের মুন্সিয়ানার উপর নির্ভর করে সে কতদূর শৈল্পিকভাবে, কতটা দক্ষতার সাথে ছবি তুলতে পারছে।
ক্যানাডার যে বিখ্যাত ফটোগ্রাফার ইউসুফ কার্স, তার বিখ্যাত বই আছে কার্স পোট্রেইট। তার একটা ছবি আছে বিশ্ববিখ্যাত কম্পোজার মিউজিশিয়ান পাবলো ক্যাসালোর। ক্যাসালোর ছবি সে তুলেছে পেছন দিক থেকে। ওইটা দেখে তাকে কিভাবে চেনা যায়? পাবলো ক্যাসাল একধরণের ওভারকোট পড়তো, যেটা বেল্টের মতো তার পেছন দিক থেকে তার ওভারকোটের সাথে লাগানো ছিল, ওইটা সে সামনে বাধতো না, পেছন দিক থেকে ছেড়ে দিত। তার টাক মাথা ছিল। দেখলেই বোঝা যেত ওটা কে।
আমার তোলা এস এম সুলতানের একটা ছবি আছে যেখানে কেবল হাত দেখা যায়। দেখলেই বোঝা যায় অত লম্বা লম্বা আঙুল ওই সময় সুলতান ছাড়া আর কারও ছিল না। কালো আলখাল্লা পরা। আমি তো পুরা চেহারা আনি নাই।
আমার তো মনে হয় একটা মানুষের একটা বিশষে অঙ্গ দিয়েও বুঝানো সম্ভব মানুষটা কে? এইগুলি তো কিছু না, একেকটা চিহ্ন, একেকটা সিগনালের মতো। কাজেই তুমি যখন একটা ফেইসের ছবি তুলবা তোমার ঠিকানা, তোমার অন্তর্দৃষ্টি তার মধ্যে ঠিকই থাকবে। বিষয়টা নির্ভর করে ফটোগ্রাফারের দক্ষতার উপর।
ফেরদৌস মাহমুদ : মামুন ভাই, সারা দিনে অনেক কথা হলো। এবার তো উঠতে হবে...
নাসির আলী মামুন : হ্যাঁ... সন্ধ্যা হয়ে গেছে। তোমাকে তো অনেক দূর যেতে হবে।
ফেরদৌস মাহমুদ : আমাকে এভাবে দীর্ঘ সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
নাসির আলী মামুন : এত দূর এসে আমার সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য তোমাকেও ধন্যবাদ।
বাংলানিউজ, এপ্রিল ১৮, ২০১১
ছাত্রছাত্রীদের কেন নৈরাজ্যবাদী হওয়া উচিত?
_ নোওম চমস্কির সাক্ষাৎকার
১৪ জুন ২০১১ তারিখে ইনডিবেই ডট অর্গ সাইটে জেইট ক্যাম্পাস এর সঙ্গে স্বস্বীকৃত নৈরাজ্যবাদী নোওম চমস্কির এক সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। এই সাক্ষাতকারটি বেশ মজার মনে হয়েছে আমার নিজের একটি প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার প্রেক্ষিতে। সুশীল বুদ্ধিজীবিদের শাণিত বুদ্ধিদীপ্ত কথার ফুলঝুরির সামনে একটি প্রশ্ন অনেকসময় করতে ইচ্ছে হতো: আপনার মত ' সুশীল বুদ্ধিজীবী ' কি আদৌ কিছু সমাধা করতে পারে?
এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন নোওম চমস্কি। তার প্রত্যুত্তরটি এতটাই সাদামাটা যে সাক্ষাতকারটি অনুবাদের ইচ্ছা জাগলো। চমস্কির যে বিষয়টি আমাকে সবচে বেশী ভাবিয়েছে তা হলো তার ' কৌশলহীন ' উত্তরদানের কৌশল, যেন কোন ত্যানা পেঁচাপেঁচি ছাড়াই ভেতর থেকে আসা উত্তর। আপনাদের বিশেষ কোন অনুভূতি হলে শেয়ার করলে ভাল লাগবে।
প্রফেসর চমস্কি, আপনি এমন এক পন্ডিত যাকে সারা বিশ্বে বারবার উদ্ধৃত করা হয়ে থাকে, সেসঙ্গে ৪৫ বছর ধরে আপনি একজন রাজনৈতিক একটিভিস্ট হিসেবেও কাজ করে যাচ্ছেন। আজকের রাজনীতির দিকে তাকিয়ে কেউ যদি প্রশ্ন করে: আপনার মত ' সুশীল বুদ্ধিজীবী ' কি আদৌ কিছু সমাধা করতে পারে, তাহলে আপনি কি বলবেন?
আপনি কি ভেবে অমন প্রশ্ন করলেন?
আফগানিস্তানে যুদ্ধ চলছে। পুরো বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার চাপে ভুগছে। সামাজিক দূরত্ব বেড়েই চলেছে, এমন আরো কত কিছু ঘটছে।
সমস্যাটা খুব সাধারণ। বেশীরভাগ বুদ্ধিজীবিই ক্ষমতার দাস এবং সরকারের আজ্ঞাবহ ও পরামর্শক। তারা নিজেদেরকে বিশেষজ্ঞ দাবি করে। এভাবে এমন বুদ্ধিজীবিরা শতাব্দিকাল ধরে সম্মান অর্জন করে আসছে, এটা কেবল বর্তমান বিশ্বের কথা না। তবে প্রতিটি সমাজেই প্রান্তিক সীমানায় বাস করা কিছু সমালোচক বুদ্ধিজীবি বাস করে আসছে। দুধরনের বুদ্ধিজীবিরই প্রভাব আছে: তা সে ক্ষমতার দাস হোক কিংবা বিরুদ্ধবাদীই হোক।
আমরা এখনো সন্দিহান। গত ৪৫ বছরে আপনি কি পরিবর্তন করেছেন?
ব্যক্তিগতভাবে আমি কোন কিছু পরিবর্তন করিনি। আমি একটি আন্দোলনের অংশ ছিলাম এবং এই আন্দোলন বেশ কিছু সমাধা করেছে। আজকের জগত ৪৫ বছর আগের জগতের চেয়ে মৌলিকভাবে আলাদা। নাগরিক অধিকার, মানবিক অধিকার, নারী অধিকার, পরিবেশ সংরক্ষণ, নিপীড়ন ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন এই পৃথিবীকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে। আমি ঠিক বুঝছি না কেন আপনি বলতে চাচ্ছেন যে কোন কিছুর পরিবর্তন ঘটেনি।
আপনি কি মনে করেন যে আজকের বিশ্ব ৪০ বা ৫০ বছর আগের চেয়ে শ্রেয়?
অবশ্যই! আপনি এখানে ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিট্যুট অব টেকনোলজির উম্মুক্ত প্রান্তর ধরে হাঁটাহাটি করেন। দেখতে পাবেন, অর্ধেক শিক্ষার্থী নারী। এক তৃতীয়াংশ এসেছে জাতিগত সংখ্যালঘু সমপ্রদায় থেকে। মানুষ এখন অনেক বেশী অনানুষ্ঠানিক-স্বাচ্ছন্দময় পোষাকে চলাফেরা করছে। তারা যে কোন কিছু করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছে। আমি যখন এখানে আসি সেই ৫০ বছর আগে, তখন এটি ছিল অন্যরকম এক স্থান। সেসময় দেখতেন, শ্বেতাঙ্গ পুরুষ, আনুষ্ঠানিক পোষাকে সজ্জিত, তারা কেবল নিজের কাজেই আগ্রহী ছিল। একই রকম পরিবর্তন আপনি দেখবেন জার্মানিতে আর সবখানে।
কিন্তু শিক্ষার্থীরা কি এখন বেশী রাজনীতিমনস্ক? আজকের প্রজন্মকে দোষ দেয়া হয় একথা বলে যে তারা এই বিশ্ব সম্বন্ধে উদাসীন।
এই দোষারোপ মিথ্যে বলে মনে করি। বিশ্ববিদ্যালয়ে অতি উচ্চ রাজনীতিমনস্ক পরিবেশ ছিল ক্ষণস্থায়ী- সেই ১৯৬৮ থেকে ১৯৭০। এর আগে শিক্ষার্থীরা রাজনীতিমনস্ক ছিল না। ভিয়েতনাম যুদ্ধের কথা ধরুন, সেটা ছিল ২য় বিশ্ব যুদ্ধ শেষে সবচে বড় অপরাধ। তখন প্রথম চার পাঁচ বছর আমেরিকায় তেমন কোন প্রতিবাদের চাঞ্চল্য চোখে পড়েনি। প্রতিবাদমুখর হওয়ার কিছু পরে ১৯৭০ এর শেষের দিকেই তা আবার মিইয়ে যায়। ইরাক যুদ্ধের আগ পর্যন্ত অবস্থাটা বেশ আলাদা ছিল। আমার জানা মতে, পৃথিবীর ইতিহাসে ইরাক যুদ্ধ সেই যুদ্ধ যা ঘটার আগেই পৃথিবীব্যাপী প্রতিবাদ আন্দোলন হয়েছে। আমার শিক্ষার্থীরা আমার বক্তৃতা না শুনে প্রতিবাদ সভায় গেছে। ৫০ বছর আগে এটা কখনো ঘটেনি। এই প্রতিবাদ যুদ্ধ থামাতে পারেনি, সত্য, কিন্তু তা যুদ্ধটাকে সীমাবদ্ধ রাখতে পেরেছে। আমেরিকা ভিয়েতনামে যা করেছে তার একাংশও ইরাকে করতে পারে নি।
এসব প্রতিবাদ কি কেবলই প্রতিবাদ ছিল?
আজকের রাজনীতিকরণ ১৯৫০ এর চেয়ে অনেক বেশী ব্যাপ্তি ও গভীরতা পেয়েছে। বিভিন্ন ধরনের স্থায়ী একটিভিজম বৃদ্ধি পেয়েছে যার মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন খন্ডযুদ্ধ জিততে পারছি। উদাহরণ চাইলে নারী অধিকারের বলা যায়, এক্ষেত্রে আমরা ক্রমাগত উন্নয়ন অর্জন করেছি। আমি যদি আমার দাদীকে জিজ্ঞেস করতাম: তুমি কি নিপীড়িত? তাহলে তো দাদী বুঝতেই পারতো না আমি কি বলতে চাচ্ছি? আমার প্রশ্নটিই বুঝতে পারতো না। আমার মা বলতো: আমি নিপীড়নের শিকার কিন্তু আমি জানি না আমার কি করা উচিৎ। এমন প্রশ্ন করলে আমার মেয়ে হয়ত আমার দিকে চেঁচিয়ে কথা বলবে। আমাদের জগতটা এখন আগের চেয়ে অনেক মানবিক!
আপনি কি ঐতিহাসিক উন্নয়নে বিশ্বাসী?
উন্নয়ন একটি ধীর প্রক্রিয়া, তবে লম্বা সময় পরে তা দেখলে একে নাটকীয় মনে হয়। দাসপ্রথার বিলোপের কথা ধরুন, অথবা বাকস্বাধীনতার কথা ধরুন। অধিকার কখনো এমনি এমনি দিয়ে দেয়া হয় না। যারা বিভিন্ন বাহিনী বা দলে যুক্ত হয়েছে, একত্রিত হয়েছে তারা একথা ভাল বুঝবে। তবে উন্নয়ন একরৈখিক বিষয় না। অবশ্য কখনো কখনো তা পিছনেও হেঁটে চলে।
তাহলে যদি সামনে এগোনো যেমন আছে, তেমনি যদি পেছনে যাওয়াও ঘটে থাকে, তাহলে এখন থেকে ৫০ বছর পরের পৃথিবী কি শ্রেয় হবে?
৫০ বছর পরে পৃথিবী কেমন হবে তা নির্ভর করছে আজকের যুব প্রজন্ম কি করছে তার উপর। দুটি বিপদ পৃথিবীর অস্তিত্বকে হুমকির মুখে রেখেছে: পরিবেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ও পারমানবিক অস্ত্র। পারমানবিক অস্ত্রের কথা না হয় বাদই দিলাম, আমরা যদি পরিবেশের বিষয়ে খুব শক্তিশালী অবস্থান না নিই, তাহলে ৫০ বছর পরে আমরা অতি গুরুতর পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবো। ফুকুশিমার উদাহরণ আমাদেরকে দেখিয়ে দিয়েছে যে, পারমানবিক শক্তির অসামরিক ব্যবহারও মানবজাতিকে অতি ভয়ানক বিপদের মুখোমুখি করতে পারে। কোন অবস্থাতেই আমরা এসবকে উপেক্ষা করতে পারি না।
৬০ বছর পরে এখনকার ছাত্রছাত্রীরা আপনার মত বৃদ্ধ হয়ে যাবে। তাদের কি করা উচিত যাতে তারা পরবর্তীতে জীবনের দিকে পিছন ফিরে তাকালে সন্তুষ্টি পেতে পারে?
স্বাভাবিকভাবে তারা বলতেই পারে যে, তারা বন্ধুবান্ধব, সন্তান এবং ফানসহকারে জীবন কাটিয়েছে। তবে সত্যিকার অর্থে পরিপূর্ণ ও সন্তুষ্টির জীবন যাপনের জন্য তাদেরকে পৃথিবীর সমস্যা অনুধাবন করতে হবে এবং তা সমাধানে অবদান রাখতে হবে। ৮০ বছর বয়সে পেছন ফিরে তাকিয়ে যদি বলতে না পারে, হ্যাঁ, কিছু একটা করেছি, তাহলে তার জীবনে সার্থকতা থাকবে না।
৮২ বছর বয়সে আপনি কি আপনার জীবনে সন্তুষ্ট?
সন্তুষ্ট হওয়া অসম্ভব। আমার জীবনে বহু ক্ষেত্র, মাত্রা আছে, পরিবার, পেশা, রাজনীতি এবং আরো কিছু। কিছু ক্ষেত্রে আমি সন্তুষ্ট, তবে অন্যান্যগুলোতে নয়। এই পৃথিবীর সমস্যাগুলো বিশাল। আমেরিকায় অসাম্যের লেভেল এখন ১৯২০ দশকের মতো এবং অর্থনীতি এখনো আমাদের জীবনে বিশালবপু প্রভাব রাখে। এসব প্রেক্ষিতে আমার সন্তুষ্ট হওয়া সম্ভব না!
আপনার মত এমন রাজনীতিক সংশ্লিষ্টতা পন্ডিতদের মধ্যে বিরল। আপনার কি কখনো ' ক্ষমতার দাসদের ' প্রতি, আপনি যেভাবে বলেছেন, অথবা যারা কেবল তাদের একাডেমিক কাজের মধ্যে ডুবে আছে সেসব সহকর্মী প্রফেসরদের প্রতি বিরক্তিতে ক্রোধোম্মত অনুভুতি জাগে?
ক্ষমতার সিস্টেম এর সমর্থক হওয়াটাকে আমি অনৈতিক মনে করি। তার মানে এই নয় যে আমি কারো প্রতি ক্ষুব্ধ, বিরক্ত, ক্রোধোম্মত। সহজাতভাবে পন্ডিতেরা অন্যদের চেয়ে বেশী গভীর রাজনৈতিক মননের অধিকারী হন না, তারা অন্যদের চেয়ে নৈতিকভাবেও উন্নত না। তবে তাদের কর্তব্য হচ্ছে রাজনীতিবিদদের সাহায্য করা যেন রাজনীতিবিদরা সত্যকে খোঁজেন এবং তা পান।
মনে হচ্ছে যেন বৃদ্ধ বয়সে আপনি এখন নমনীয় হয়ে পড়ছেন।
না। কয়েক দশকেও আমার মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটেনি। কৈশোরে যা বিশ্বাস করতাম, এখনও তা করি।
এটা কি ভাল কিছু? এমন কিছুতে বিশ্বাস করা যা আপনি ৭০ বছর আগে বিশ্বাস করতেন?
হ্যাঁ, ভাল। যখন মৌলিক নীতির প্রশ্ন বিচারে তা ঠিক থাকে। অবশ্যই বিভিন্ন বিষয়ে আমি আমার অভিমত পরিবর্তন করেছি। কিন্তু আমার আদর্শ সেই একই আছে।
আপনি প্রায়ই বলেন, আপনি একজন নৈরাজ্যবাদী। একথা বলে আপনি কি বোঝাতে চান?
নৈরাজ্যবাদীরা ক্ষমতার কাঠামো বুঝতে চায়। তারা ক্ষমতা প্রয়োগকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে তাদের কাজের বৈধতার প্রমাণ দিতে বলে। এই বৈধতা প্রমাণের চেষ্টা বেশীরভাগ সময় সফল হয় না। তখন নৈরাজ্যবাদীরা মুখোশ উম্মোচনের ও কাঠামো পুনর্নিমানের কাজে রত হয়। এসব হতে পারে পিতৃতান্ত্রিক পরিবার, আন্তর্জাতিক মাফিয়া ব্যবস্থা অথবা অর্থনীতির বেসরকারি অত্যাচার বা করপোরেশন এর মুখোশ উম্মোচন এর কাজ করার মাধ্যমে।
কোন বিশেষ অভিজ্ঞতা আপনাকে নৈরাজ্যবাদী করেছে?
তেমন কোন কিছুই জীবনে ছিল না। বার বছর বয়স থেকে আমি পুরনো বই বিক্রির দোকানে যেতে শুরু করি। সেগুলো বেশীরভাগই ছিল স্পেন থেকে আসা নৈরাজ্যবাদীদের দ্বারা পরিচালিত। আর তাই আমার পক্ষে নৈরাজ্যবাদী হওয়াটা বেশ স্বাভাবিক হয়ে পড়েছে।
সব শিক্ষার্থীরই কি নৈরাজ্যবাদী হওয়া উচিৎ?
হ্যাঁ। শিক্ষার্থীদের উচিৎ অথরিটিকে প্রশ্ন করা এবং এভাবে নৈরাজ্যবাদীদের সুদীর্ঘ ইতিহাসের সারিতে অংশ নেয়া।
' অথরিটিকে প্রশ্নের মুখোমুখি করা ' - লিবারাল বা মডারেট বাম ধারার ব্যক্তিরা এটাকে সাদরে গ্রহন করতে পারে।
যখনই কেউ অবৈধ ক্ষমতাকে চিহ্নিত করে, তাকে প্রশ্নের মুখোমুখি করে এবং তাকে পরাভূত করে তখনই সে নৈরাজ্যবাদী হয়ে পড়ে। বেশীরভাগ মানুষই নৈরাজ্যবাদী। তারা নিজেদেরকে কোন দলের অন্তর্ভূক্ত করে তা নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই।
এখনকার ছাত্রসমাজকে কোন বিষয় বা কোন ব্যক্তির চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে?
এই জগতটা যন্ত্রণাভোগ, বঞ্চনা, সন্ত্রাস এবং দুর্যোগে পরিপূর্ণ। শিক্ষার্থীদের অবশ্যই সিদ্ধান্ত নিতে হবে: এসব কিছু কি তোমাকে পীড়িত করছে? নাকি করছে না? আমি বলি: তোমার চরিদিকে তাকাও, সমস্যার বিশ্লেষণ করো, নিজেকে জিজ্ঞেস করো তুমি কি করতে পারো এবং এরপর কাজে নেমে পড়ো!
এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন নোওম চমস্কি। তার প্রত্যুত্তরটি এতটাই সাদামাটা যে সাক্ষাতকারটি অনুবাদের ইচ্ছা জাগলো। চমস্কির যে বিষয়টি আমাকে সবচে বেশী ভাবিয়েছে তা হলো তার ' কৌশলহীন ' উত্তরদানের কৌশল, যেন কোন ত্যানা পেঁচাপেঁচি ছাড়াই ভেতর থেকে আসা উত্তর। আপনাদের বিশেষ কোন অনুভূতি হলে শেয়ার করলে ভাল লাগবে।
প্রফেসর চমস্কি, আপনি এমন এক পন্ডিত যাকে সারা বিশ্বে বারবার উদ্ধৃত করা হয়ে থাকে, সেসঙ্গে ৪৫ বছর ধরে আপনি একজন রাজনৈতিক একটিভিস্ট হিসেবেও কাজ করে যাচ্ছেন। আজকের রাজনীতির দিকে তাকিয়ে কেউ যদি প্রশ্ন করে: আপনার মত ' সুশীল বুদ্ধিজীবী ' কি আদৌ কিছু সমাধা করতে পারে, তাহলে আপনি কি বলবেন?
আপনি কি ভেবে অমন প্রশ্ন করলেন?
আফগানিস্তানে যুদ্ধ চলছে। পুরো বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার চাপে ভুগছে। সামাজিক দূরত্ব বেড়েই চলেছে, এমন আরো কত কিছু ঘটছে।
সমস্যাটা খুব সাধারণ। বেশীরভাগ বুদ্ধিজীবিই ক্ষমতার দাস এবং সরকারের আজ্ঞাবহ ও পরামর্শক। তারা নিজেদেরকে বিশেষজ্ঞ দাবি করে। এভাবে এমন বুদ্ধিজীবিরা শতাব্দিকাল ধরে সম্মান অর্জন করে আসছে, এটা কেবল বর্তমান বিশ্বের কথা না। তবে প্রতিটি সমাজেই প্রান্তিক সীমানায় বাস করা কিছু সমালোচক বুদ্ধিজীবি বাস করে আসছে। দুধরনের বুদ্ধিজীবিরই প্রভাব আছে: তা সে ক্ষমতার দাস হোক কিংবা বিরুদ্ধবাদীই হোক।
আমরা এখনো সন্দিহান। গত ৪৫ বছরে আপনি কি পরিবর্তন করেছেন?
ব্যক্তিগতভাবে আমি কোন কিছু পরিবর্তন করিনি। আমি একটি আন্দোলনের অংশ ছিলাম এবং এই আন্দোলন বেশ কিছু সমাধা করেছে। আজকের জগত ৪৫ বছর আগের জগতের চেয়ে মৌলিকভাবে আলাদা। নাগরিক অধিকার, মানবিক অধিকার, নারী অধিকার, পরিবেশ সংরক্ষণ, নিপীড়ন ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন এই পৃথিবীকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে। আমি ঠিক বুঝছি না কেন আপনি বলতে চাচ্ছেন যে কোন কিছুর পরিবর্তন ঘটেনি।
আপনি কি মনে করেন যে আজকের বিশ্ব ৪০ বা ৫০ বছর আগের চেয়ে শ্রেয়?
অবশ্যই! আপনি এখানে ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিট্যুট অব টেকনোলজির উম্মুক্ত প্রান্তর ধরে হাঁটাহাটি করেন। দেখতে পাবেন, অর্ধেক শিক্ষার্থী নারী। এক তৃতীয়াংশ এসেছে জাতিগত সংখ্যালঘু সমপ্রদায় থেকে। মানুষ এখন অনেক বেশী অনানুষ্ঠানিক-স্বাচ্ছন্দময় পোষাকে চলাফেরা করছে। তারা যে কোন কিছু করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছে। আমি যখন এখানে আসি সেই ৫০ বছর আগে, তখন এটি ছিল অন্যরকম এক স্থান। সেসময় দেখতেন, শ্বেতাঙ্গ পুরুষ, আনুষ্ঠানিক পোষাকে সজ্জিত, তারা কেবল নিজের কাজেই আগ্রহী ছিল। একই রকম পরিবর্তন আপনি দেখবেন জার্মানিতে আর সবখানে।
কিন্তু শিক্ষার্থীরা কি এখন বেশী রাজনীতিমনস্ক? আজকের প্রজন্মকে দোষ দেয়া হয় একথা বলে যে তারা এই বিশ্ব সম্বন্ধে উদাসীন।
এই দোষারোপ মিথ্যে বলে মনে করি। বিশ্ববিদ্যালয়ে অতি উচ্চ রাজনীতিমনস্ক পরিবেশ ছিল ক্ষণস্থায়ী- সেই ১৯৬৮ থেকে ১৯৭০। এর আগে শিক্ষার্থীরা রাজনীতিমনস্ক ছিল না। ভিয়েতনাম যুদ্ধের কথা ধরুন, সেটা ছিল ২য় বিশ্ব যুদ্ধ শেষে সবচে বড় অপরাধ। তখন প্রথম চার পাঁচ বছর আমেরিকায় তেমন কোন প্রতিবাদের চাঞ্চল্য চোখে পড়েনি। প্রতিবাদমুখর হওয়ার কিছু পরে ১৯৭০ এর শেষের দিকেই তা আবার মিইয়ে যায়। ইরাক যুদ্ধের আগ পর্যন্ত অবস্থাটা বেশ আলাদা ছিল। আমার জানা মতে, পৃথিবীর ইতিহাসে ইরাক যুদ্ধ সেই যুদ্ধ যা ঘটার আগেই পৃথিবীব্যাপী প্রতিবাদ আন্দোলন হয়েছে। আমার শিক্ষার্থীরা আমার বক্তৃতা না শুনে প্রতিবাদ সভায় গেছে। ৫০ বছর আগে এটা কখনো ঘটেনি। এই প্রতিবাদ যুদ্ধ থামাতে পারেনি, সত্য, কিন্তু তা যুদ্ধটাকে সীমাবদ্ধ রাখতে পেরেছে। আমেরিকা ভিয়েতনামে যা করেছে তার একাংশও ইরাকে করতে পারে নি।
এসব প্রতিবাদ কি কেবলই প্রতিবাদ ছিল?
আজকের রাজনীতিকরণ ১৯৫০ এর চেয়ে অনেক বেশী ব্যাপ্তি ও গভীরতা পেয়েছে। বিভিন্ন ধরনের স্থায়ী একটিভিজম বৃদ্ধি পেয়েছে যার মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন খন্ডযুদ্ধ জিততে পারছি। উদাহরণ চাইলে নারী অধিকারের বলা যায়, এক্ষেত্রে আমরা ক্রমাগত উন্নয়ন অর্জন করেছি। আমি যদি আমার দাদীকে জিজ্ঞেস করতাম: তুমি কি নিপীড়িত? তাহলে তো দাদী বুঝতেই পারতো না আমি কি বলতে চাচ্ছি? আমার প্রশ্নটিই বুঝতে পারতো না। আমার মা বলতো: আমি নিপীড়নের শিকার কিন্তু আমি জানি না আমার কি করা উচিৎ। এমন প্রশ্ন করলে আমার মেয়ে হয়ত আমার দিকে চেঁচিয়ে কথা বলবে। আমাদের জগতটা এখন আগের চেয়ে অনেক মানবিক!
আপনি কি ঐতিহাসিক উন্নয়নে বিশ্বাসী?
উন্নয়ন একটি ধীর প্রক্রিয়া, তবে লম্বা সময় পরে তা দেখলে একে নাটকীয় মনে হয়। দাসপ্রথার বিলোপের কথা ধরুন, অথবা বাকস্বাধীনতার কথা ধরুন। অধিকার কখনো এমনি এমনি দিয়ে দেয়া হয় না। যারা বিভিন্ন বাহিনী বা দলে যুক্ত হয়েছে, একত্রিত হয়েছে তারা একথা ভাল বুঝবে। তবে উন্নয়ন একরৈখিক বিষয় না। অবশ্য কখনো কখনো তা পিছনেও হেঁটে চলে।
তাহলে যদি সামনে এগোনো যেমন আছে, তেমনি যদি পেছনে যাওয়াও ঘটে থাকে, তাহলে এখন থেকে ৫০ বছর পরের পৃথিবী কি শ্রেয় হবে?
৫০ বছর পরে পৃথিবী কেমন হবে তা নির্ভর করছে আজকের যুব প্রজন্ম কি করছে তার উপর। দুটি বিপদ পৃথিবীর অস্তিত্বকে হুমকির মুখে রেখেছে: পরিবেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ও পারমানবিক অস্ত্র। পারমানবিক অস্ত্রের কথা না হয় বাদই দিলাম, আমরা যদি পরিবেশের বিষয়ে খুব শক্তিশালী অবস্থান না নিই, তাহলে ৫০ বছর পরে আমরা অতি গুরুতর পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবো। ফুকুশিমার উদাহরণ আমাদেরকে দেখিয়ে দিয়েছে যে, পারমানবিক শক্তির অসামরিক ব্যবহারও মানবজাতিকে অতি ভয়ানক বিপদের মুখোমুখি করতে পারে। কোন অবস্থাতেই আমরা এসবকে উপেক্ষা করতে পারি না।
৬০ বছর পরে এখনকার ছাত্রছাত্রীরা আপনার মত বৃদ্ধ হয়ে যাবে। তাদের কি করা উচিত যাতে তারা পরবর্তীতে জীবনের দিকে পিছন ফিরে তাকালে সন্তুষ্টি পেতে পারে?
স্বাভাবিকভাবে তারা বলতেই পারে যে, তারা বন্ধুবান্ধব, সন্তান এবং ফানসহকারে জীবন কাটিয়েছে। তবে সত্যিকার অর্থে পরিপূর্ণ ও সন্তুষ্টির জীবন যাপনের জন্য তাদেরকে পৃথিবীর সমস্যা অনুধাবন করতে হবে এবং তা সমাধানে অবদান রাখতে হবে। ৮০ বছর বয়সে পেছন ফিরে তাকিয়ে যদি বলতে না পারে, হ্যাঁ, কিছু একটা করেছি, তাহলে তার জীবনে সার্থকতা থাকবে না।
৮২ বছর বয়সে আপনি কি আপনার জীবনে সন্তুষ্ট?
সন্তুষ্ট হওয়া অসম্ভব। আমার জীবনে বহু ক্ষেত্র, মাত্রা আছে, পরিবার, পেশা, রাজনীতি এবং আরো কিছু। কিছু ক্ষেত্রে আমি সন্তুষ্ট, তবে অন্যান্যগুলোতে নয়। এই পৃথিবীর সমস্যাগুলো বিশাল। আমেরিকায় অসাম্যের লেভেল এখন ১৯২০ দশকের মতো এবং অর্থনীতি এখনো আমাদের জীবনে বিশালবপু প্রভাব রাখে। এসব প্রেক্ষিতে আমার সন্তুষ্ট হওয়া সম্ভব না!
আপনার মত এমন রাজনীতিক সংশ্লিষ্টতা পন্ডিতদের মধ্যে বিরল। আপনার কি কখনো ' ক্ষমতার দাসদের ' প্রতি, আপনি যেভাবে বলেছেন, অথবা যারা কেবল তাদের একাডেমিক কাজের মধ্যে ডুবে আছে সেসব সহকর্মী প্রফেসরদের প্রতি বিরক্তিতে ক্রোধোম্মত অনুভুতি জাগে?
ক্ষমতার সিস্টেম এর সমর্থক হওয়াটাকে আমি অনৈতিক মনে করি। তার মানে এই নয় যে আমি কারো প্রতি ক্ষুব্ধ, বিরক্ত, ক্রোধোম্মত। সহজাতভাবে পন্ডিতেরা অন্যদের চেয়ে বেশী গভীর রাজনৈতিক মননের অধিকারী হন না, তারা অন্যদের চেয়ে নৈতিকভাবেও উন্নত না। তবে তাদের কর্তব্য হচ্ছে রাজনীতিবিদদের সাহায্য করা যেন রাজনীতিবিদরা সত্যকে খোঁজেন এবং তা পান।
মনে হচ্ছে যেন বৃদ্ধ বয়সে আপনি এখন নমনীয় হয়ে পড়ছেন।
না। কয়েক দশকেও আমার মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটেনি। কৈশোরে যা বিশ্বাস করতাম, এখনও তা করি।
এটা কি ভাল কিছু? এমন কিছুতে বিশ্বাস করা যা আপনি ৭০ বছর আগে বিশ্বাস করতেন?
হ্যাঁ, ভাল। যখন মৌলিক নীতির প্রশ্ন বিচারে তা ঠিক থাকে। অবশ্যই বিভিন্ন বিষয়ে আমি আমার অভিমত পরিবর্তন করেছি। কিন্তু আমার আদর্শ সেই একই আছে।
আপনি প্রায়ই বলেন, আপনি একজন নৈরাজ্যবাদী। একথা বলে আপনি কি বোঝাতে চান?
নৈরাজ্যবাদীরা ক্ষমতার কাঠামো বুঝতে চায়। তারা ক্ষমতা প্রয়োগকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে তাদের কাজের বৈধতার প্রমাণ দিতে বলে। এই বৈধতা প্রমাণের চেষ্টা বেশীরভাগ সময় সফল হয় না। তখন নৈরাজ্যবাদীরা মুখোশ উম্মোচনের ও কাঠামো পুনর্নিমানের কাজে রত হয়। এসব হতে পারে পিতৃতান্ত্রিক পরিবার, আন্তর্জাতিক মাফিয়া ব্যবস্থা অথবা অর্থনীতির বেসরকারি অত্যাচার বা করপোরেশন এর মুখোশ উম্মোচন এর কাজ করার মাধ্যমে।
কোন বিশেষ অভিজ্ঞতা আপনাকে নৈরাজ্যবাদী করেছে?
তেমন কোন কিছুই জীবনে ছিল না। বার বছর বয়স থেকে আমি পুরনো বই বিক্রির দোকানে যেতে শুরু করি। সেগুলো বেশীরভাগই ছিল স্পেন থেকে আসা নৈরাজ্যবাদীদের দ্বারা পরিচালিত। আর তাই আমার পক্ষে নৈরাজ্যবাদী হওয়াটা বেশ স্বাভাবিক হয়ে পড়েছে।
সব শিক্ষার্থীরই কি নৈরাজ্যবাদী হওয়া উচিৎ?
হ্যাঁ। শিক্ষার্থীদের উচিৎ অথরিটিকে প্রশ্ন করা এবং এভাবে নৈরাজ্যবাদীদের সুদীর্ঘ ইতিহাসের সারিতে অংশ নেয়া।
' অথরিটিকে প্রশ্নের মুখোমুখি করা ' - লিবারাল বা মডারেট বাম ধারার ব্যক্তিরা এটাকে সাদরে গ্রহন করতে পারে।
যখনই কেউ অবৈধ ক্ষমতাকে চিহ্নিত করে, তাকে প্রশ্নের মুখোমুখি করে এবং তাকে পরাভূত করে তখনই সে নৈরাজ্যবাদী হয়ে পড়ে। বেশীরভাগ মানুষই নৈরাজ্যবাদী। তারা নিজেদেরকে কোন দলের অন্তর্ভূক্ত করে তা নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই।
এখনকার ছাত্রসমাজকে কোন বিষয় বা কোন ব্যক্তির চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে?
এই জগতটা যন্ত্রণাভোগ, বঞ্চনা, সন্ত্রাস এবং দুর্যোগে পরিপূর্ণ। শিক্ষার্থীদের অবশ্যই সিদ্ধান্ত নিতে হবে: এসব কিছু কি তোমাকে পীড়িত করছে? নাকি করছে না? আমি বলি: তোমার চরিদিকে তাকাও, সমস্যার বিশ্লেষণ করো, নিজেকে জিজ্ঞেস করো তুমি কি করতে পারো এবং এরপর কাজে নেমে পড়ো!
প্রতুল মুখোপাধ্যায়। সাক্ষাৎকার
সঙ্গীতের প্রচলিত ফর্মার ভিতরে নিজেকে সঁপে দেননি। সোজা সড়কে না হেটে, তিনি হেটেছেন কানা গলিতে। বাদ্য বাজনার গেড়োয় নিজের সুর ও গানের কথাকে না বেধে তিনি সুর ও কথা দিয়ে বেধেছেন বাদ্য বাজনাকে। ‘ আমি বাংলার গান গাই’সহ বহু বিখ্যাত গানের, কিংবদন্তির শিল্পী প্রতুল মুখ্যোপাধ্যায়। যার গান জনতার, বৈষ্যমহীন সমাজ ও স্বপ্নের। কিংবদন্তীর এই গণসঙ্গীত শিল্পী গত এপ্রিলে বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন। তার সাথে কথা বলেছেন এটিএন নিউজের সিনিয়র রিপোর্টার আলমগীর স্বপন। এই আলাপে উঠে এসেছে তার শৈশব, কৈশোরের পাশাপাশি গণ সংগীত নিয়ে তার দর্শন, কমিউনিজম, বাংলাদেশ, আর মাওবাদ ইস্যুও।
কেমন ছিল আপনার শৈশব ?
প্রতুল : আমরা পাঁচভাই দু বোন যেমন খুশি ঘুরে বেড়াতাম। আমি ক্লাশ ফোরের আগে কোন স্কুলে ভর্তি হইনি। বাবা স্কুলের কাজে ব্যস্ত থাকতেন, মা সংসারের নানা রকম কাজে থাকতেন। বাবা যে আমাদের খুব বেশী খোঁজ নিতে পারতেন তাও নয়। যা খুশি তাই করে বেরাতাম আমরা। এখন একটা কথা মনে আছে যখন প্রথম দেশভাগের পর খড়গপুর এসেছিলাম। খড়গপুরে আমার এক বড় কাকা ছিলেন। তার বাসাতে উঠে ছিলাম প্রথমে। তিনি আমার বড় ভাই জনুুকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ আমি তোমার কে হই’। জনু বললো ‘বড় কাকা’। তখন আমি স্বীকৃতীটা নেয়ার চেষ্টা করলাম, বললাম ‘ আমি ওরে শিখাই দিছি’। এই কথাটা বলার পরে তিনি বললেন, ‘এরকম করে কথা বলোনা। এরকম করে বললে,এখানে সবাই হাসবে’। তার এই কথা আমার মনে একটা বিরাট আঘাত হিসেবে এসেছিলো। আমি আমার মতো করে কথা বললে, লোকে হাসবে। তাহলে আমি এ কোথায় এলাম। সেই শিশু বয়স থেকে যেরকম করে কথা বলছি, তা শুনলে লোকে হাসবে কেন ? লোকে বাঙ্গাল বলবে কেন ? এই যে একটা অদ্ভুত চিন্তা, মানে দেশ বিভাগের আগেকার একটা যে বিভাজন এটা আমাকে প্রথমের দিকে পীড়িত করেছিলো।
শুনেছি ছোট বেলা থেকেই আপনাদের পরিবারে বই পড়ার একটা আবহ ছিল ।
প্রতুল : আমি ছোট বেলায় বড়দের বই পড়েছি আর বড় বেলায় ছোটদের বই পড়েছি। আমাদের বাড়িতে যে খুব একটা বলা হতো না, ‘এখন শৈশব এখন এই বইগূলো পড়ো,তারপর এই বইগুলো পড়ো। বাবার বই,যার,যে বই ছিলো তাই পড়তাম। আমার অক্ষর পরিচয় হয়েছে ছোটদার ফেলে দেওয়া একটা বই দিয়ে। যার প্রথম চার পাচটা পাতা নেই,সেরকম বই। আমরা কখনও কোন নতুন বই পাই নি। এরকম করেই আমরা বড় হয়েছি। আমাদের কখনও বলা হয়নি,এই বয়স পর্যন্ত এই নিয়ে পড়বে, তারপরে এই পড়বে এরকম কিছু নির্দেশনা আমাদের পরিবারে ছিলো না।
আপনার শৈশবের বাংলাদেশ কেমন ছিল ?
প্রতুল : শৈশবের ওরকম কীর্তনখোলা নদী দেখেছি। একবার কোন মুুক্তাগাছা বলে একটা জায়গা দেখেছি, সেখানে বিশাল বিশাল হাতি দেখেছি জমিদার বাড়িতে। এরকম কিছুু ছায়া ছায়া মনে আছে। মানে এখন যেটা বাংলাদেশ হয়ে গেছে, সেই পূর্ব বঙ্গের কথা আমার সেরকম মনে নেই।
সঙ্গীতের সাথে কিভাবে গাটছাড়া বাধলেন…
প্রতুল : বাল্যকাল থেকেই আমি সঙ্গীতের সাথে আছি। আমার ক্ষেত্রে বিষয়টি এমন না যে, ‘ এটা একটা সঙ্গীতের ঘর। সেখানে আমি নক করলাম।’ তারপরে আমাকে বলা হলো , ‘ কি ব্যাপার আপনি কি সঙ্গীতে ঢুকবেন,..আসুন,আসুন সঙ্গীতে আসুন’ এরকম করে আমি সঙ্গীতে আসিনি। আমাদের সারা পৃথীবি জুড়ে সঙ্গীত ছিলো, পাখির ডাক থেকে শুরু করে যে ভিখারী সকাল বেলা কীর্তন গাইতো, কেউ শ্যামা সঙ্গীত গাইতো, বাবার সঙ্গে বসে একজন বেহালা বাজাতেন এবং গাইতেন-এরাই আমাকে সংগীতে এনেছেন। এদের গলা, এদের গানগুলো আমি গলায় তুলেছি।
এক্ষেত্রে আপনার পরিবারের উৎসাহ কেমন পেয়েছেন ?
প্রতুল :আমি কখনও ভাবিনি গানটা আমার আনন্দ ছাড়া অন্য কোন কাজে লাগবে। তখন দেখতে পেলাম গানটা আর কারও কারও কাছেও প্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে। এ রকম সময়ে দাদা আমাকে একটা বই দিলেন। বইটার নাম হচ্ছে ঘুম তাড়ানি ছড়া। তাতে সুকান্ত ভট্টাচার্য, মঙ্গলাচরন চট্টোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে ও জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র-এই চার কবির কবিতা এবং ছড়া রয়েছে, সেটা আমার জীবনে একটা মস্ত বড় সোপানের মতো। কারণ শৈশবে নানারকম শিশু পাঠ্যই পড়া হয়ে থাকে। কিন্ত এটি সে রকম বই নয়। সেখানে একটা সমাজতন্ত্রী ভাবনা ছিলো, তখনকার দিনের গরীব শিশুরা শিক্ষা পাচ্ছে।
এর আগে ভগবত ভক্তির দিকে আমরা মন থাকলেও ‘ঘুমতাড়ানির ছড়া ’ পড়ার পর একেবারে জনভক্তির আমার মন চলে গেলো। মাকর্সবাদের প্রতি আগ্রহ, সমাজতন্ত্রের প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে তোলার ক্ষেত্রে এই বইটি একটা মস্তবড় ভূমিকা পালন করেছিল, পরে যত মাকর্সবাদী সাহিত্য পড়েছি সেটা যে ভূমিকা পালন করেছিল ওই চার কবির কবিতা আমাকে, আমার মনটাকে অনেক অনেক বেশী রকম করে বদলে দিয়েছিলো। আমি ১০ বছর বয়সে এই বইটা পেয়েছিলাম। ১২ বছর বয়সে যখন ১৯৫৪ সেখানে আমি তখন মঙ্গলাচরন চট্টোপাধ্যায়ের ‘ ধান কাটার গান গাই, লোহা পেটার গান’- কবিতাকে আমি গান করেছি। সেই কবিতা সে রকম সুরে, মানে ১৯৫৪ এর সেই সুরে ১৯৯৪ সালে রেকর্ড করেছি। এবং ১৯৯৫ কিংবা ৯৬ এর দিকে কবি মঙ্গলাচরন চট্টোপাধ্যায়কে আমি সেই গান শুনিয়েছি। গান শুনে তিনি বলেছেন, ‘ তুমি খালি এটা করছো কেন, আমার আরও কত কবিতা আছে সেগুলোও করো।’ এরকম করে আমাকে উৎসাহিত করেছেন। এই যে এরকম করে এতো মাইল পথ হাটা, এটা আমাকে অনেক আশ্চর্য করেছে।
সংগীতে বাদ্য বাজনার ব্যবহার না করে প্রচলিত ধারার বাইরে আপনি হেটেছেন। আপনার গানে বাদ্য বাজনার চেয়ে আপনি স্বতন্ত্র হয়ে ওঠেন….
প্রতুল : আমি শুনে শুনে, ঠেকে ঠেকে শিখেছি। এ আরেক রকমের শেখা। এতে যে অসুবিধা হয়নি তা নয়, কিন্তু সুবিধে হচ্ছে যেহেতু আমি কোন ব্যাকরণগত রাস্তায় হাটিনি,আমি এমন অনেক জায়গায় হেটেছি যেখানে বাংলা গান কখনও হাটেনি। কারণ একটা প্রকরণে শিক্ষিত হয়ে গেলেই তখন সেই রাস্তা দিয়েই যাতায়াত করতে হয়। আমি ঢাকার কোন উদাহরন দিতে পারবো না। ধরা যাক কলকাতা বিমান বন্দর থেকে মানিকতলা। বাস ধরবো আর মানিকতলায় চলে যাবে। এটাই সহজপথ। কিন্তু আমি তো সেইভাবে যাইনি।
আমি একটুখানি গিয়ে কোন গলির ভিতর ঢুকে পড়েছি, গলির মধ্যে আবার পথ হারিয়ে ফেলেছি। তারপর আবার পিছিয়ে এসেছি। এরকম করতে করতে হয়েছে কি ওই গলিগুলো আমার চেনা হয়ে গেছে। যে গলিতে অন্যরা কখনও যেতো না, অন্যরা সব সময় বাধা সড়ক দিয়ে যেতো। আমি এরকম বাধা সড়ক যেহেতু চিনিনা,তাই আমি এখানে ওখানে ঘুরতে ঘুরতে সে জায়গায় যখন পৌছেছি। তখন আমি দেখেছি ওরা যেসব জায়গায় গেছে তার থেকে বেশি জায়গায় আমি গেছি । কিন্তু ওখানে তো তারা যেতে পারেনি। এই যে অপ্রশিক্ষণ এবং তার সঙ্গে বিদ্যাটির প্রতি একটা অপরিসীম ভালোবাসা,পেশান,উদগ্র্র একটা ইচ্ছে এবং তার সাথে নুন্যতম জ্ঞান যদি থাকে সেটাই আসল কথা। তবে গলা যদি সুরে না যায় তাহলে তো সেটা হবে না।
আপনার গান জনগনকে নিয়ে বা আপনি কিভাবে জনগণের হয়ে গেলেন ?
প্রতুল : আমার একটা গান আছে যে, ভগবানে আমাদের কেষ্ট বিষ্টুু নয়। জনগনে ভগবান সর্বশক্তিময়।
জনশক্তি মহাশক্তি যদি থাকে সাথে/গুড়াইবে পাহাড় আর না থাকিবে পথে/ বাচাঁর পথে দিশা দেখো রে।
এই যে ইশ্বর ভক্ত থেকে জনগন ভক্ত হওয়া এটা কিন্তু আমার কাছে ধারাবাহিকভাবে এসেছে। আমরা জনগনের ভক্ত,তাদের দয়া করিনা। আমাদের ভিতর এমন একটা এপ্রোচ হচ্ছে যে, এই দরিদ্র জনসাধারণ আছে তাদের তুমি করুনা করো। এরকম করুনা করার কথা কিন্তু আমি কখনও ভাবিনি। আমি দেখেছি আমাদের বাড়িতে কারা গান করতে আসতেন বেহালা নিয়ে। বাবা তাদের আপন করে নিতেন,কথা বলতেন, বসতে দিতেন। বাবা যাদের গান শুনতেন, তাদের একটা সম্মানী দিতেন। আমাদের বাড়ীতে যাকে আমরা ম্যাথরানী বলি। বাবা তাদের মা বলে সম্বোধন করতেন এবং অত্যন্ত সম্মান করে কথা বলতেন। এটা অন্য কিছু না দরিদ্র মানুষদের সমাদর করা,তাদের করুনা না করা এই জিনিসটা আমি বাবার কাছে শিখেছিলাম।
আমি যে গণসংগীতে এসেছি এর পেছনের প্রেরণা বা স্পৃহা হিসেবে কাজ করেছে এগুলো। বীজ হিসেবে কাজ করেছিল। এর ফলে আমি স্বচ্ছন্দে দরিদ্র্য মানুষের বাড়ীতে যেতে পারি। তার দেখি আমাকে,বুকে জড়িয়ে ধরে। আমি তো তাদের মতো করে মানুষই হইনি। সত্যি কথা বলতে কি আমাকে উচ্চ মধ্যবিত্ত বলা যেতে পারে। তারপরও কিন্তু আমি তাদের সাথে কথা বলতে গেলে আমি কতগুলো ধাপ নীচে নেমে কথা বলছি এরকম আমার কখনও মনে হয় না।
তাইতো আমরা করুনা করতে পারছি। তা কিন্তু নয়। এই দারিদ্র্য একটা অভিশাপ। একে দূর করতে হবে। এবং এর জন্য যারা দায়ী তাদের সঙ্গে প্রয়োজনে সংগ্রাম করতে হবে।
গনসঙ্গীত ও প্রতুল কি এক সত্বা, কিভাবে মাপবেন ?
প্রতুল : সঙ্গীত একটা মস্তবড় ইউনিভার্স। তার মধ্যে নানা ধরনের শ্রেণী বিভাজন হতে পারে। গণসঙ্গীত অনেকটা গণতন্ত্রের মতো, ‘ অব দ্যা ম্যাস,ফর দ্যা মাস, বাই দ্যা মাস’-বলেও একে বলা যায়। মানুষের জন্যে, মানুষের গান,মানুষের পক্ষের গান। এখন বাই দ্যা পিপল বা গণসঙ্গীত দুই প্রকার একটা হচ্ছে ব্যপ্ত মানুষের সৃষ্ট গান। আরেকটা হচ্ছে ব্যপ্ত মানুষের জন্য সৃষ্ট গান। আমরা কিন্তু সেদিক থেকে যারা ব্যপ্ত মানুষ যারা বঞ্চিত শোষিত মানব, তাদের ঠিক অংশ নই। কিন্তু আমরা যখন গান করি তাদের জন্যে গান করি ।
আরেকটা ব্যাপার যেটা হেমাঙ্গ বিশ্বাস বলেছিলেন,দেশপ্রেমের গান, দেশের জন্য ভালোবাসার গান বা দেশের জন্য ভালোবাসার নদী যখন আন্তর্জাতিকতার সাগরে গিয়ে উপনীত হয় তখনই দেশ ভক্তির গান গণসঙ্গীতে পরিণত হয়। এ রকমের সংজ্ঞা তিনি দিয়েছিলেন। কিন্তু আমার সংজ্ঞা, গণসঙ্গীত হচ্ছে আমাদের ঐতিহ্যগত ভক্তি সঙ্গীতের একটি শাখা নদী। আমাদের দেশে যে ইশ্বরের প্রতি ভক্তি,চিন্তা ঘুরতে থাকে, তাদের জন্য যে গান, এর একটি ধারা হচ্ছে গণসঙ্গীত। তবে এখানে যে ইশ্বর, সে ইশ্বরের চোখ,মুখ,হাত, পা সব আছে। সেই ইশ্বর জীবন্ত। সেই ইশ্বর সারা পৃথিবীতে পরিব্যপ্ত। এবং সেই ইশ্বর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বঞ্চিত,শোষিত, অত্যাচারিত। তার প্রতি ভক্তি সঞ্চারিত হয় যে গানে, যাকে নিয়ে সারা পৃথিবী।
যারা আমাদের ভাত দেয়,যে চেয়ারে বসে আছি সেই চেয়ারটা দেয়,যে বইটা পড়ি তার কাগজ দেয়। আমাদের প্রত্যেকটি জীবনের প্রত্যেক মুহুর্তের যে কনা সমস্ত কিছুর জন্য যারা দায়ী, যারা সেই সৃষ্টিটা করছে, তার প্রতি ভক্ত না হবো তো কার প্রতি হবো। তার মানে আমাদের জনভক্ত হতে হবে।
একুশে ফেব্রুয়ারী বা আমাদের ভাষা আন্দোলন আপনাকে কতটা প্রভাবিত করেছে। যখন আপনি বলছেন, আমি বাংলায় গান গাই, আমি বাংলার গান গাই…..
প্রতুল : দেখুন, একদম সত্যি কথা বলবো। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস তখন সেইভাবে পশ্চিমবঙ্গে প্রচারিত হয় নি। ১৯৫২ সালে আমি যতদূর জানি পশ্চিমবঙ্গ তাদের সাধারণ নির্বাচন নিয়ে এতো ব্যস্ত ছিলো যে, এতোবড় একটা ঘটনা তখন পূর্ববঙ্গে ঘটে গেছে, তার কিছু কিছু খবর নিশ্চয়ই পৌছেছে। কিন্তু সেটা জন মানুষকে উদ্বেল করতে পারেনি। লজ্জার কথা। কিন্তু পারেনি আমার মনে হয়।
ভাষা আন্দোলন নিয়ে নানারকম সভাসমিতি পরে হয়েছে,ভাষিক অধিকারের কথা, এইসব চিন্তাগুলো বেশী করে হয়েছে ষাটের দশকের সময় থেকে। কিছু কিছু পান্না লাল দাশ গুপ্ত, এমন কিছু মানুষ যাদের বাংলাদেশের সাথে ভালো যোগাযোগ ছিলো, তারা ছোট ছোট সভা করে বলেতেন যে, ‘ এরা এরকম করে নিজের ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার জন্য প্রাণ দান করেছে।’ আসলে আমাদের ভেতর এরকম একটা বিষয় ছিলো যে ‘ আমাদের বাংলার আর কি হবে,আমাদের এখানো তো আর উর্দু টর্দু হচ্ছে না।’ কিন্তু পরে দেখা গেলো আমাদের বাংলাকে পশ্চিমবঙ্গে উৎখাত করার একটা চমৎকার চেষ্টা চলছে। ইতিমধ্যে ১৯৬১ তে শীলচড়ে যখন ভাষা আন্দোলন হলো মানে অহমিয়াকে জোড় করে চাপিয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে যখন ওখানকার বাংলাভাষীরা প্রতিবাদ করলো তখন আমরা বাহান্ন নিয়ে আরো বেশী চিন্তা করতে লাগলাম। ভাষিক অধিকারের জন্যে, ভাষার মর্যাদার জন্যে পরপর কুড়ি পচিশ জন তাদের জীবন দিলো। কেননা ভাষা দিয়েই তো আমাদের চেনা যায়, ভাষার মর্যাদাই তো আত্ম মর্যাদা। এই চিন্তা গুলো আমাদের মধ্যে হলো এবং একুশে নাম দিয়ে আমাদের ওখানে কিছু প্রতিষ্ঠান তৈরী হলো। কিন্তু ১৯৫২ সালে আমার তখন ১০ বছর বয়স তখন আমাদের বাড়ীতে ভালো করে খবরের কাগজ আসতো না। আমার সন্দেহ আছে, ‘ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী কলকাতার কোন পাতায় কতটুকু দখল করেছিলো ’।
তবে আপনার গানে কিন্তু ৫২’ ভাষা আন্দোলনের সেই প্রাণের কথা গুলোই এসেছে…
প্রতুল :: গানটাতো আমি লিখেছি ১৪০০ সালে। ইংরেজী ১৯৯৩।
স্লোগান দিতে গিয়ে, আমি চিনতে শিখেছি নতুন মানুষ জন..এই গানে যেমন আপনি মানুষ চেনার কথা বলেছেন তেমনি আপনার গণসংগীত শিল্পী হয়ে ওঠার কথাও বলেছেন…
প্রতুল : ১৯৬৯ এ আমার বিপ্লবী গানগুলো, মানুষের মুখে মখে ছড়াতো। তখন আমি তো অজ্ঞাতবাসের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। নাটকের গান করতাম, কেউ আমাকে চিনতো না। আমাকে সবাই চিনতে আরম্ভ করলো যে এই লোকটাই সেই লোকটা, যার গান আমরা সন্ধ্যে বেলা জেলে গাইতাম। এইসব ভাবে যখন আমাকে চিনতে পারলো তখন বিভিন্ন জায়গায় আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো। ১৯৮২ সালে যখন আমার পুনরাবিস্কার হলো। এরকম একটি জায়গায় পার্থ বন্দোপাধ্যায় ‘পোষ্টার অথবা কবিতা’ নামে একটি কাব্যগ্রন্থ আমাকে দিয়েছিলেন। শারদ সংখ্যায় তার একটা কবিতা বেরিয়েছিলো, ‘স্লোগান দিতে গিয়ে আমি চিনতে শিখি নতুন মানুষ জন।’ এই গানটা আমি সেদিনই করি, যেদিন আমি বইটা পেয়েছিলাম। পার্থ পরে বলেছিলো আমার কবিতাকে গানে পরিণত করার মতো লোক আমি পেয়ে গেছি। তার এই কবিতা নিয়ে আমি এমন চার্জড হয়েছিলাম, সাধারণত এরকম কথা তো হয়,স্লোগানধর্মী। তখন স্লোগানকে একটু যেন তিরস্কারই করা হতো। এর সাথে আরেকটি কথা বলতে চাই। এটা শুনলে ইশ্বরবাদীরা একটু খেপে যেতে পারেন। সেটা হচ্ছে ভক্তি তন্ত্রে, মন্ত্র বা জপ যে কাজ করতো তারই বিবর্তিত রূপ স্লোগান।
আমাদের চিন্তার সারৎসারকে একটা ছোট বাক্যে পরিণত করে ঠিক যেমন যারা ইশ্বরভক্ত তারা মন্ত্র পড়েন বার বার বার মন্ত্র জপ করেন, একইভাবে আমরা ওই স্লোগানটা যখন করি তখন আমাদের চিন্তার সারৎসার ওই কতগুলো বাক্যে সংহত হয় এবং যখন আমরা বলি ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ তখন আমরা বলি বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক, এটা হচ্ছে আমাদের সমস্ত কর্মকান্ডের সারৎসার। সেটা হচ্ছে মন্ত্র। বৌদ্ধরা মন্ত্র পড়ে। কেউ জপ মালা দিয়ে মন্ত্র পড়ে। সেটা কি। আমাদের মস্তিস্কের মধ্যে নানা রকমের চিন্তাতো সব সময় আক্রমন করছে, এই মন্ত্র কি করে সেই সমস্ত বৈষম্যমূলক চিন্তাগুলোকে,বিরোধী চিন্তাগুলোকে আশার পথে দারোয়ানের মতো বাধা দেয়। এই জন্যে স্লোগানটা দেওয়া দরকার হয়।
মাওবাদীদের বিরুদ্ধে সরকার নাশকতা, মানুষ হত্যার অভিযোগ তুলে বিভিন্ন অপারেশনে নেমেছে ?
প্রতুল :হত্যাকান্ড আমি সমর্থন করি না। তবে যে জন্য ওরা টেরোরিজম করছে অর্থাৎ ভাত, কাপড়, রুটি, চিকিৎসা এগুলোর যদি নিশ্চয়তা থাকতো তাহলে কিন্তু ওরা টেরোরিজমে আসতো না। কিন্তু সেটা তো সরকারের উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য হলো জঙ্গল হাসিল করে সেটা বহুজাতিকদের হাতে দিয়ে দেয়া।
বাংলাদেশ আপনার মনস্তত্বে কিভাবে বাস করে ?
প্রতুল : আমার মনজুড়ে¡ তো বাংলাদেশ নেই। আমার মনজুড়ে বাংলা আছে। কতগুলো মানুষ তাদের নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য এই দেশভাগটা করেছিলো। এতে তাদের নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি হয়েছে। আবার এখন যখন বাংলাদেশ হয়েছে তখন কিছু কিছু মানুষ আছে তারা রি-ইউনাইট ও রি-ইউনিফিকেশনের কথা বলছে। আমার মনে হয় যেটা হয়ে গেছে,সেটা হয়ে গেছে।
তবে অন্তত সংস্কৃতির দিক থেকে, অন্তরের দিক থেকে আমরা একজন আরেক জনকে তো আপন ভাবতেই পারি। কিছু দেয়া নেয়ার মধ্য দিয়ে, আমাদের মধ্যে যে সৌহার্দ থাকার কথা ছিলো সেটা টিকিয়ে রাখতেই পারি। শুধু পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশ কেনো আমরা যে কোন দেশের মানুষের সঙ্গে আমাদের ভালোবাসা টিকিয়ে রাখতেই পারি। তার জন্য যেটা করা উচিত সেটা হচ্ছে, নিজের সংস্কৃতিটাকে একেবারে শ্রেষ্ঠ মনে না করে সমস্তসংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া।
‘ আমি যা কিছু মহান বরণ করেছি বিনম্র শ্রদ্ধায়, মিশে তেরো নদী সাত সাগরের জল গঙ্গায় পদ্মায়’-এই কথা দিয়ে আমি বলতে চেয়েছি যে কোন জায়গায়, যে কোন বড় সংস্কৃতি তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, মনোযোগী হওয়া। এভাবে আমরা যদি কিছুূ গ্রহন করতে পারি এবং তার মধ্যে বর্জনীয় অংশগুলো বাদ দিতে পারি, তাহলে সমস্ত মানুষ একদিন একসঙ্গে হাত ধরাধরি করে কাধে কাধ ঠেকিয়ে এক হতে পারে। এবং দেখাও তো যাচ্ছে, যে সমস্ত দানবের বিরদ্ধে বিশ্বের সমস্ত দেশ একসাথে হচ্ছে। সমস্ত অত্যাচারের হেডকোয়ার্টারকে তারাতো ‘না’ বলছে। এতগুলো লোক যে না বলছে এবং তারা দেশ কাল, সীমানার কথা ভাবছে না। এটাতো অন্ধকারের মধ্যে একটা বিশাল আশার আলো।
আলমগীর স্বপন: আমরা যে স্বপ্নের বাংলাদেশের কথা বলি..বাইরে থেকে আপনি যতটা বাংলাদেশকে বোঝেন সেই বোঝার জায়গা থেকে কেমন বাংলাদেশ আপনি চিন্তা করবেন ?
প্রতুল : সেটা বলা আমার জন্য অন্যায় হবে। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র। বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে প্রায় মন্ত্রের মতো উচ্চারণ করতে হয় সেটা হলো , ‘ আমি জানি না। ’এটা আপনারাই ঠিক করবেন আপনার বাংলাদেশের জনগন। আপনারা তো চালিকাশক্তি। সরকার যদি ভাবতে জানে জনগনই হচ্ছে চালিকাশক্তি, তাদের ইচ্ছাকে রূপায়নই আমাদের কাজ, তাদের ব্যাপক রূপায়নই আমাদের (সরকার) কাজ, তাহলেই হবে। এখন আমি শুনতে পাই ‘ ইনক্লুসিভ ইকোনমি’র কথা। এর মানে হচ্ছে ওপরের তলায় যারা আছে, যারা সমস্ত ভোগ করছে, যাদের ছেলে ৫’শ টাকায় ব্রেকফাস্ট খায় তারা তো এই ইকোনমির মধ্যে থাকবেই। এর সাথে গরীবদেরও ইনক্লুড করতে হবে। এটা কি রকম কথা। সমাজের উচুঁ তলার ১৫ জন তো থাকবে আর ৮৫ জনকে ভাই একটুু ইনক্লুড করা হবে এর সাথে। কিন্তু যা হওয়া উচিত ৮৫ জন থাকবে ১৫ জনকে তাতে ইনক্লুড করতে হবে। তবে ১৫ জনকেও তাড়িয়ে দিও না তাদের থাকতে দেও। দেশটা হচ্ছে এই ব্যাপক ৮৫ শতাংশের। তারা পানীয় জল পায় না। খাদ্য পায় না। শিক্ষা পায় না। বস্ত্র পায় না,আচ্ছাদন পায় না, তাদের সংস্কৃতির বিকাশ পায় না। তাদের সংস্কৃতি মুক্ত করে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে, তাদের সংস্কৃতিকে শেষ করে দেওয়া হচ্ছে, তাদের যে শিক্ষা সেটাকে অপ্রয়োজনীয় করে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এরাই তো ইতিহাসের চালিকাশক্তি। এই ইতিহাসের চালিকাশক্তিকে অবজ্ঞা করে যদি কেউ মনে করে আমরা এগিয়ে যেতে পারবো, তাহলে কিন্তু তারা ঠিক জায়গায় যাচ্ছে না।
এবার আপনার ব্যক্তি জীবনে উকি দিতে পারি কি ?
প্রতুল : ব্যক্তিগত জীবন, যতখানি সমষ্টিগত জীবনে মিলিয়ে দিতে পারি ততই ভালো। এমন একটা সময় আসবে যখন আমরা ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে নিশ্চয়ই ভাববো, কিন্তু সেটা সবাইকে বলার মতো কিছু হবে না। আমরা সমষ্টির প্রতি অনুরক্ত থাকবো। আমরা থাকবো ‘ উই সেল বি লোনলি অ্যামং দ্যা ক্রাউড’। একজন মানুষ যখন সৃষ্টি করে তখন তাকে কিছুক্ষণ একা হয়ে থাকতে হয়। কিন্তু সেই একা হয়ে থাকার ফলে সেই সৃষ্টিটা যখন সমস্ত মানুষের সম্পতি হয়ে যায় তখন মনে হয় এই কিছুক্ষণ একা থাকাটা সার্থক হয়েছে।
অনেকদিন পড় বাংলাদেশে এলেন–কেমন লেগেছে ?
প্রতুল : বিষয়টা যেন আমার নতুন গানের মতোই, ‘ দ’ুজনই বাঙ্গালী ছিলাম/ দেখো দেখি কান্ডখান/তুমি এখন বাংলাদেশী/আমারে কও ইন্ডিয়ান…চল মন মা বাবার ভূমি/দেখি নিজের ভাই বোনে/শুনছি নাকি তারা আজো/এই পাগলের গান শোনে।’ আমি আসলে আমার বাড়িতে এসেছি। এটাই মনে হয়েছে। দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশে এসে এখানকার মানুষের যে ভালোবাসা পেয়েছি তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। কিন্তু এর চেয়েও আমার ভালো লেগেছে যে গান গাইতে গিয়ে দেখেছি, এমন এমন গানের জন্য অনুরোধ এসেছে, আমার সাথে গলা মিলাচ্ছে যা শুনে আমি অবাক হয়েছি। প্রতুলের গান এখানে শোনা হয়। যাওয়ার সময় তাই খুবই খারাপ লাগছে।
:ধন্যবাদ
প্রতুল : আপনাকেও ধন্যবাদ
আলমগীর স্বপন,
সিনিয়র রিপোর্টার, এটিএন নিউজ
কেমন ছিল আপনার শৈশব ?
প্রতুল : আমরা পাঁচভাই দু বোন যেমন খুশি ঘুরে বেড়াতাম। আমি ক্লাশ ফোরের আগে কোন স্কুলে ভর্তি হইনি। বাবা স্কুলের কাজে ব্যস্ত থাকতেন, মা সংসারের নানা রকম কাজে থাকতেন। বাবা যে আমাদের খুব বেশী খোঁজ নিতে পারতেন তাও নয়। যা খুশি তাই করে বেরাতাম আমরা। এখন একটা কথা মনে আছে যখন প্রথম দেশভাগের পর খড়গপুর এসেছিলাম। খড়গপুরে আমার এক বড় কাকা ছিলেন। তার বাসাতে উঠে ছিলাম প্রথমে। তিনি আমার বড় ভাই জনুুকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ আমি তোমার কে হই’। জনু বললো ‘বড় কাকা’। তখন আমি স্বীকৃতীটা নেয়ার চেষ্টা করলাম, বললাম ‘ আমি ওরে শিখাই দিছি’। এই কথাটা বলার পরে তিনি বললেন, ‘এরকম করে কথা বলোনা। এরকম করে বললে,এখানে সবাই হাসবে’। তার এই কথা আমার মনে একটা বিরাট আঘাত হিসেবে এসেছিলো। আমি আমার মতো করে কথা বললে, লোকে হাসবে। তাহলে আমি এ কোথায় এলাম। সেই শিশু বয়স থেকে যেরকম করে কথা বলছি, তা শুনলে লোকে হাসবে কেন ? লোকে বাঙ্গাল বলবে কেন ? এই যে একটা অদ্ভুত চিন্তা, মানে দেশ বিভাগের আগেকার একটা যে বিভাজন এটা আমাকে প্রথমের দিকে পীড়িত করেছিলো।
শুনেছি ছোট বেলা থেকেই আপনাদের পরিবারে বই পড়ার একটা আবহ ছিল ।
প্রতুল : আমি ছোট বেলায় বড়দের বই পড়েছি আর বড় বেলায় ছোটদের বই পড়েছি। আমাদের বাড়িতে যে খুব একটা বলা হতো না, ‘এখন শৈশব এখন এই বইগূলো পড়ো,তারপর এই বইগুলো পড়ো। বাবার বই,যার,যে বই ছিলো তাই পড়তাম। আমার অক্ষর পরিচয় হয়েছে ছোটদার ফেলে দেওয়া একটা বই দিয়ে। যার প্রথম চার পাচটা পাতা নেই,সেরকম বই। আমরা কখনও কোন নতুন বই পাই নি। এরকম করেই আমরা বড় হয়েছি। আমাদের কখনও বলা হয়নি,এই বয়স পর্যন্ত এই নিয়ে পড়বে, তারপরে এই পড়বে এরকম কিছু নির্দেশনা আমাদের পরিবারে ছিলো না।
আপনার শৈশবের বাংলাদেশ কেমন ছিল ?
প্রতুল : শৈশবের ওরকম কীর্তনখোলা নদী দেখেছি। একবার কোন মুুক্তাগাছা বলে একটা জায়গা দেখেছি, সেখানে বিশাল বিশাল হাতি দেখেছি জমিদার বাড়িতে। এরকম কিছুু ছায়া ছায়া মনে আছে। মানে এখন যেটা বাংলাদেশ হয়ে গেছে, সেই পূর্ব বঙ্গের কথা আমার সেরকম মনে নেই।
সঙ্গীতের সাথে কিভাবে গাটছাড়া বাধলেন…
প্রতুল : বাল্যকাল থেকেই আমি সঙ্গীতের সাথে আছি। আমার ক্ষেত্রে বিষয়টি এমন না যে, ‘ এটা একটা সঙ্গীতের ঘর। সেখানে আমি নক করলাম।’ তারপরে আমাকে বলা হলো , ‘ কি ব্যাপার আপনি কি সঙ্গীতে ঢুকবেন,..আসুন,আসুন সঙ্গীতে আসুন’ এরকম করে আমি সঙ্গীতে আসিনি। আমাদের সারা পৃথীবি জুড়ে সঙ্গীত ছিলো, পাখির ডাক থেকে শুরু করে যে ভিখারী সকাল বেলা কীর্তন গাইতো, কেউ শ্যামা সঙ্গীত গাইতো, বাবার সঙ্গে বসে একজন বেহালা বাজাতেন এবং গাইতেন-এরাই আমাকে সংগীতে এনেছেন। এদের গলা, এদের গানগুলো আমি গলায় তুলেছি।
এক্ষেত্রে আপনার পরিবারের উৎসাহ কেমন পেয়েছেন ?
প্রতুল :আমি কখনও ভাবিনি গানটা আমার আনন্দ ছাড়া অন্য কোন কাজে লাগবে। তখন দেখতে পেলাম গানটা আর কারও কারও কাছেও প্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে। এ রকম সময়ে দাদা আমাকে একটা বই দিলেন। বইটার নাম হচ্ছে ঘুম তাড়ানি ছড়া। তাতে সুকান্ত ভট্টাচার্য, মঙ্গলাচরন চট্টোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে ও জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র-এই চার কবির কবিতা এবং ছড়া রয়েছে, সেটা আমার জীবনে একটা মস্ত বড় সোপানের মতো। কারণ শৈশবে নানারকম শিশু পাঠ্যই পড়া হয়ে থাকে। কিন্ত এটি সে রকম বই নয়। সেখানে একটা সমাজতন্ত্রী ভাবনা ছিলো, তখনকার দিনের গরীব শিশুরা শিক্ষা পাচ্ছে।
এর আগে ভগবত ভক্তির দিকে আমরা মন থাকলেও ‘ঘুমতাড়ানির ছড়া ’ পড়ার পর একেবারে জনভক্তির আমার মন চলে গেলো। মাকর্সবাদের প্রতি আগ্রহ, সমাজতন্ত্রের প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে তোলার ক্ষেত্রে এই বইটি একটা মস্তবড় ভূমিকা পালন করেছিল, পরে যত মাকর্সবাদী সাহিত্য পড়েছি সেটা যে ভূমিকা পালন করেছিল ওই চার কবির কবিতা আমাকে, আমার মনটাকে অনেক অনেক বেশী রকম করে বদলে দিয়েছিলো। আমি ১০ বছর বয়সে এই বইটা পেয়েছিলাম। ১২ বছর বয়সে যখন ১৯৫৪ সেখানে আমি তখন মঙ্গলাচরন চট্টোপাধ্যায়ের ‘ ধান কাটার গান গাই, লোহা পেটার গান’- কবিতাকে আমি গান করেছি। সেই কবিতা সে রকম সুরে, মানে ১৯৫৪ এর সেই সুরে ১৯৯৪ সালে রেকর্ড করেছি। এবং ১৯৯৫ কিংবা ৯৬ এর দিকে কবি মঙ্গলাচরন চট্টোপাধ্যায়কে আমি সেই গান শুনিয়েছি। গান শুনে তিনি বলেছেন, ‘ তুমি খালি এটা করছো কেন, আমার আরও কত কবিতা আছে সেগুলোও করো।’ এরকম করে আমাকে উৎসাহিত করেছেন। এই যে এরকম করে এতো মাইল পথ হাটা, এটা আমাকে অনেক আশ্চর্য করেছে।
সংগীতে বাদ্য বাজনার ব্যবহার না করে প্রচলিত ধারার বাইরে আপনি হেটেছেন। আপনার গানে বাদ্য বাজনার চেয়ে আপনি স্বতন্ত্র হয়ে ওঠেন….
প্রতুল : আমি শুনে শুনে, ঠেকে ঠেকে শিখেছি। এ আরেক রকমের শেখা। এতে যে অসুবিধা হয়নি তা নয়, কিন্তু সুবিধে হচ্ছে যেহেতু আমি কোন ব্যাকরণগত রাস্তায় হাটিনি,আমি এমন অনেক জায়গায় হেটেছি যেখানে বাংলা গান কখনও হাটেনি। কারণ একটা প্রকরণে শিক্ষিত হয়ে গেলেই তখন সেই রাস্তা দিয়েই যাতায়াত করতে হয়। আমি ঢাকার কোন উদাহরন দিতে পারবো না। ধরা যাক কলকাতা বিমান বন্দর থেকে মানিকতলা। বাস ধরবো আর মানিকতলায় চলে যাবে। এটাই সহজপথ। কিন্তু আমি তো সেইভাবে যাইনি।
আমি একটুখানি গিয়ে কোন গলির ভিতর ঢুকে পড়েছি, গলির মধ্যে আবার পথ হারিয়ে ফেলেছি। তারপর আবার পিছিয়ে এসেছি। এরকম করতে করতে হয়েছে কি ওই গলিগুলো আমার চেনা হয়ে গেছে। যে গলিতে অন্যরা কখনও যেতো না, অন্যরা সব সময় বাধা সড়ক দিয়ে যেতো। আমি এরকম বাধা সড়ক যেহেতু চিনিনা,তাই আমি এখানে ওখানে ঘুরতে ঘুরতে সে জায়গায় যখন পৌছেছি। তখন আমি দেখেছি ওরা যেসব জায়গায় গেছে তার থেকে বেশি জায়গায় আমি গেছি । কিন্তু ওখানে তো তারা যেতে পারেনি। এই যে অপ্রশিক্ষণ এবং তার সঙ্গে বিদ্যাটির প্রতি একটা অপরিসীম ভালোবাসা,পেশান,উদগ্র্র একটা ইচ্ছে এবং তার সাথে নুন্যতম জ্ঞান যদি থাকে সেটাই আসল কথা। তবে গলা যদি সুরে না যায় তাহলে তো সেটা হবে না।
আপনার গান জনগনকে নিয়ে বা আপনি কিভাবে জনগণের হয়ে গেলেন ?
প্রতুল : আমার একটা গান আছে যে, ভগবানে আমাদের কেষ্ট বিষ্টুু নয়। জনগনে ভগবান সর্বশক্তিময়।
জনশক্তি মহাশক্তি যদি থাকে সাথে/গুড়াইবে পাহাড় আর না থাকিবে পথে/ বাচাঁর পথে দিশা দেখো রে।
এই যে ইশ্বর ভক্ত থেকে জনগন ভক্ত হওয়া এটা কিন্তু আমার কাছে ধারাবাহিকভাবে এসেছে। আমরা জনগনের ভক্ত,তাদের দয়া করিনা। আমাদের ভিতর এমন একটা এপ্রোচ হচ্ছে যে, এই দরিদ্র জনসাধারণ আছে তাদের তুমি করুনা করো। এরকম করুনা করার কথা কিন্তু আমি কখনও ভাবিনি। আমি দেখেছি আমাদের বাড়িতে কারা গান করতে আসতেন বেহালা নিয়ে। বাবা তাদের আপন করে নিতেন,কথা বলতেন, বসতে দিতেন। বাবা যাদের গান শুনতেন, তাদের একটা সম্মানী দিতেন। আমাদের বাড়ীতে যাকে আমরা ম্যাথরানী বলি। বাবা তাদের মা বলে সম্বোধন করতেন এবং অত্যন্ত সম্মান করে কথা বলতেন। এটা অন্য কিছু না দরিদ্র মানুষদের সমাদর করা,তাদের করুনা না করা এই জিনিসটা আমি বাবার কাছে শিখেছিলাম।
আমি যে গণসংগীতে এসেছি এর পেছনের প্রেরণা বা স্পৃহা হিসেবে কাজ করেছে এগুলো। বীজ হিসেবে কাজ করেছিল। এর ফলে আমি স্বচ্ছন্দে দরিদ্র্য মানুষের বাড়ীতে যেতে পারি। তার দেখি আমাকে,বুকে জড়িয়ে ধরে। আমি তো তাদের মতো করে মানুষই হইনি। সত্যি কথা বলতে কি আমাকে উচ্চ মধ্যবিত্ত বলা যেতে পারে। তারপরও কিন্তু আমি তাদের সাথে কথা বলতে গেলে আমি কতগুলো ধাপ নীচে নেমে কথা বলছি এরকম আমার কখনও মনে হয় না।
তাইতো আমরা করুনা করতে পারছি। তা কিন্তু নয়। এই দারিদ্র্য একটা অভিশাপ। একে দূর করতে হবে। এবং এর জন্য যারা দায়ী তাদের সঙ্গে প্রয়োজনে সংগ্রাম করতে হবে।
গনসঙ্গীত ও প্রতুল কি এক সত্বা, কিভাবে মাপবেন ?
প্রতুল : সঙ্গীত একটা মস্তবড় ইউনিভার্স। তার মধ্যে নানা ধরনের শ্রেণী বিভাজন হতে পারে। গণসঙ্গীত অনেকটা গণতন্ত্রের মতো, ‘ অব দ্যা ম্যাস,ফর দ্যা মাস, বাই দ্যা মাস’-বলেও একে বলা যায়। মানুষের জন্যে, মানুষের গান,মানুষের পক্ষের গান। এখন বাই দ্যা পিপল বা গণসঙ্গীত দুই প্রকার একটা হচ্ছে ব্যপ্ত মানুষের সৃষ্ট গান। আরেকটা হচ্ছে ব্যপ্ত মানুষের জন্য সৃষ্ট গান। আমরা কিন্তু সেদিক থেকে যারা ব্যপ্ত মানুষ যারা বঞ্চিত শোষিত মানব, তাদের ঠিক অংশ নই। কিন্তু আমরা যখন গান করি তাদের জন্যে গান করি ।
আরেকটা ব্যাপার যেটা হেমাঙ্গ বিশ্বাস বলেছিলেন,দেশপ্রেমের গান, দেশের জন্য ভালোবাসার গান বা দেশের জন্য ভালোবাসার নদী যখন আন্তর্জাতিকতার সাগরে গিয়ে উপনীত হয় তখনই দেশ ভক্তির গান গণসঙ্গীতে পরিণত হয়। এ রকমের সংজ্ঞা তিনি দিয়েছিলেন। কিন্তু আমার সংজ্ঞা, গণসঙ্গীত হচ্ছে আমাদের ঐতিহ্যগত ভক্তি সঙ্গীতের একটি শাখা নদী। আমাদের দেশে যে ইশ্বরের প্রতি ভক্তি,চিন্তা ঘুরতে থাকে, তাদের জন্য যে গান, এর একটি ধারা হচ্ছে গণসঙ্গীত। তবে এখানে যে ইশ্বর, সে ইশ্বরের চোখ,মুখ,হাত, পা সব আছে। সেই ইশ্বর জীবন্ত। সেই ইশ্বর সারা পৃথিবীতে পরিব্যপ্ত। এবং সেই ইশ্বর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বঞ্চিত,শোষিত, অত্যাচারিত। তার প্রতি ভক্তি সঞ্চারিত হয় যে গানে, যাকে নিয়ে সারা পৃথিবী।
যারা আমাদের ভাত দেয়,যে চেয়ারে বসে আছি সেই চেয়ারটা দেয়,যে বইটা পড়ি তার কাগজ দেয়। আমাদের প্রত্যেকটি জীবনের প্রত্যেক মুহুর্তের যে কনা সমস্ত কিছুর জন্য যারা দায়ী, যারা সেই সৃষ্টিটা করছে, তার প্রতি ভক্ত না হবো তো কার প্রতি হবো। তার মানে আমাদের জনভক্ত হতে হবে।
একুশে ফেব্রুয়ারী বা আমাদের ভাষা আন্দোলন আপনাকে কতটা প্রভাবিত করেছে। যখন আপনি বলছেন, আমি বাংলায় গান গাই, আমি বাংলার গান গাই…..
প্রতুল : দেখুন, একদম সত্যি কথা বলবো। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস তখন সেইভাবে পশ্চিমবঙ্গে প্রচারিত হয় নি। ১৯৫২ সালে আমি যতদূর জানি পশ্চিমবঙ্গ তাদের সাধারণ নির্বাচন নিয়ে এতো ব্যস্ত ছিলো যে, এতোবড় একটা ঘটনা তখন পূর্ববঙ্গে ঘটে গেছে, তার কিছু কিছু খবর নিশ্চয়ই পৌছেছে। কিন্তু সেটা জন মানুষকে উদ্বেল করতে পারেনি। লজ্জার কথা। কিন্তু পারেনি আমার মনে হয়।
ভাষা আন্দোলন নিয়ে নানারকম সভাসমিতি পরে হয়েছে,ভাষিক অধিকারের কথা, এইসব চিন্তাগুলো বেশী করে হয়েছে ষাটের দশকের সময় থেকে। কিছু কিছু পান্না লাল দাশ গুপ্ত, এমন কিছু মানুষ যাদের বাংলাদেশের সাথে ভালো যোগাযোগ ছিলো, তারা ছোট ছোট সভা করে বলেতেন যে, ‘ এরা এরকম করে নিজের ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার জন্য প্রাণ দান করেছে।’ আসলে আমাদের ভেতর এরকম একটা বিষয় ছিলো যে ‘ আমাদের বাংলার আর কি হবে,আমাদের এখানো তো আর উর্দু টর্দু হচ্ছে না।’ কিন্তু পরে দেখা গেলো আমাদের বাংলাকে পশ্চিমবঙ্গে উৎখাত করার একটা চমৎকার চেষ্টা চলছে। ইতিমধ্যে ১৯৬১ তে শীলচড়ে যখন ভাষা আন্দোলন হলো মানে অহমিয়াকে জোড় করে চাপিয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে যখন ওখানকার বাংলাভাষীরা প্রতিবাদ করলো তখন আমরা বাহান্ন নিয়ে আরো বেশী চিন্তা করতে লাগলাম। ভাষিক অধিকারের জন্যে, ভাষার মর্যাদার জন্যে পরপর কুড়ি পচিশ জন তাদের জীবন দিলো। কেননা ভাষা দিয়েই তো আমাদের চেনা যায়, ভাষার মর্যাদাই তো আত্ম মর্যাদা। এই চিন্তা গুলো আমাদের মধ্যে হলো এবং একুশে নাম দিয়ে আমাদের ওখানে কিছু প্রতিষ্ঠান তৈরী হলো। কিন্তু ১৯৫২ সালে আমার তখন ১০ বছর বয়স তখন আমাদের বাড়ীতে ভালো করে খবরের কাগজ আসতো না। আমার সন্দেহ আছে, ‘ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী কলকাতার কোন পাতায় কতটুকু দখল করেছিলো ’।
তবে আপনার গানে কিন্তু ৫২’ ভাষা আন্দোলনের সেই প্রাণের কথা গুলোই এসেছে…
প্রতুল :: গানটাতো আমি লিখেছি ১৪০০ সালে। ইংরেজী ১৯৯৩।
স্লোগান দিতে গিয়ে, আমি চিনতে শিখেছি নতুন মানুষ জন..এই গানে যেমন আপনি মানুষ চেনার কথা বলেছেন তেমনি আপনার গণসংগীত শিল্পী হয়ে ওঠার কথাও বলেছেন…
প্রতুল : ১৯৬৯ এ আমার বিপ্লবী গানগুলো, মানুষের মুখে মখে ছড়াতো। তখন আমি তো অজ্ঞাতবাসের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। নাটকের গান করতাম, কেউ আমাকে চিনতো না। আমাকে সবাই চিনতে আরম্ভ করলো যে এই লোকটাই সেই লোকটা, যার গান আমরা সন্ধ্যে বেলা জেলে গাইতাম। এইসব ভাবে যখন আমাকে চিনতে পারলো তখন বিভিন্ন জায়গায় আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো। ১৯৮২ সালে যখন আমার পুনরাবিস্কার হলো। এরকম একটি জায়গায় পার্থ বন্দোপাধ্যায় ‘পোষ্টার অথবা কবিতা’ নামে একটি কাব্যগ্রন্থ আমাকে দিয়েছিলেন। শারদ সংখ্যায় তার একটা কবিতা বেরিয়েছিলো, ‘স্লোগান দিতে গিয়ে আমি চিনতে শিখি নতুন মানুষ জন।’ এই গানটা আমি সেদিনই করি, যেদিন আমি বইটা পেয়েছিলাম। পার্থ পরে বলেছিলো আমার কবিতাকে গানে পরিণত করার মতো লোক আমি পেয়ে গেছি। তার এই কবিতা নিয়ে আমি এমন চার্জড হয়েছিলাম, সাধারণত এরকম কথা তো হয়,স্লোগানধর্মী। তখন স্লোগানকে একটু যেন তিরস্কারই করা হতো। এর সাথে আরেকটি কথা বলতে চাই। এটা শুনলে ইশ্বরবাদীরা একটু খেপে যেতে পারেন। সেটা হচ্ছে ভক্তি তন্ত্রে, মন্ত্র বা জপ যে কাজ করতো তারই বিবর্তিত রূপ স্লোগান।
আমাদের চিন্তার সারৎসারকে একটা ছোট বাক্যে পরিণত করে ঠিক যেমন যারা ইশ্বরভক্ত তারা মন্ত্র পড়েন বার বার বার মন্ত্র জপ করেন, একইভাবে আমরা ওই স্লোগানটা যখন করি তখন আমাদের চিন্তার সারৎসার ওই কতগুলো বাক্যে সংহত হয় এবং যখন আমরা বলি ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ তখন আমরা বলি বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক, এটা হচ্ছে আমাদের সমস্ত কর্মকান্ডের সারৎসার। সেটা হচ্ছে মন্ত্র। বৌদ্ধরা মন্ত্র পড়ে। কেউ জপ মালা দিয়ে মন্ত্র পড়ে। সেটা কি। আমাদের মস্তিস্কের মধ্যে নানা রকমের চিন্তাতো সব সময় আক্রমন করছে, এই মন্ত্র কি করে সেই সমস্ত বৈষম্যমূলক চিন্তাগুলোকে,বিরোধী চিন্তাগুলোকে আশার পথে দারোয়ানের মতো বাধা দেয়। এই জন্যে স্লোগানটা দেওয়া দরকার হয়।
মাওবাদীদের বিরুদ্ধে সরকার নাশকতা, মানুষ হত্যার অভিযোগ তুলে বিভিন্ন অপারেশনে নেমেছে ?
প্রতুল :হত্যাকান্ড আমি সমর্থন করি না। তবে যে জন্য ওরা টেরোরিজম করছে অর্থাৎ ভাত, কাপড়, রুটি, চিকিৎসা এগুলোর যদি নিশ্চয়তা থাকতো তাহলে কিন্তু ওরা টেরোরিজমে আসতো না। কিন্তু সেটা তো সরকারের উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য হলো জঙ্গল হাসিল করে সেটা বহুজাতিকদের হাতে দিয়ে দেয়া।
বাংলাদেশ আপনার মনস্তত্বে কিভাবে বাস করে ?
প্রতুল : আমার মনজুড়ে¡ তো বাংলাদেশ নেই। আমার মনজুড়ে বাংলা আছে। কতগুলো মানুষ তাদের নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য এই দেশভাগটা করেছিলো। এতে তাদের নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি হয়েছে। আবার এখন যখন বাংলাদেশ হয়েছে তখন কিছু কিছু মানুষ আছে তারা রি-ইউনাইট ও রি-ইউনিফিকেশনের কথা বলছে। আমার মনে হয় যেটা হয়ে গেছে,সেটা হয়ে গেছে।
তবে অন্তত সংস্কৃতির দিক থেকে, অন্তরের দিক থেকে আমরা একজন আরেক জনকে তো আপন ভাবতেই পারি। কিছু দেয়া নেয়ার মধ্য দিয়ে, আমাদের মধ্যে যে সৌহার্দ থাকার কথা ছিলো সেটা টিকিয়ে রাখতেই পারি। শুধু পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশ কেনো আমরা যে কোন দেশের মানুষের সঙ্গে আমাদের ভালোবাসা টিকিয়ে রাখতেই পারি। তার জন্য যেটা করা উচিত সেটা হচ্ছে, নিজের সংস্কৃতিটাকে একেবারে শ্রেষ্ঠ মনে না করে সমস্তসংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া।
‘ আমি যা কিছু মহান বরণ করেছি বিনম্র শ্রদ্ধায়, মিশে তেরো নদী সাত সাগরের জল গঙ্গায় পদ্মায়’-এই কথা দিয়ে আমি বলতে চেয়েছি যে কোন জায়গায়, যে কোন বড় সংস্কৃতি তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, মনোযোগী হওয়া। এভাবে আমরা যদি কিছুূ গ্রহন করতে পারি এবং তার মধ্যে বর্জনীয় অংশগুলো বাদ দিতে পারি, তাহলে সমস্ত মানুষ একদিন একসঙ্গে হাত ধরাধরি করে কাধে কাধ ঠেকিয়ে এক হতে পারে। এবং দেখাও তো যাচ্ছে, যে সমস্ত দানবের বিরদ্ধে বিশ্বের সমস্ত দেশ একসাথে হচ্ছে। সমস্ত অত্যাচারের হেডকোয়ার্টারকে তারাতো ‘না’ বলছে। এতগুলো লোক যে না বলছে এবং তারা দেশ কাল, সীমানার কথা ভাবছে না। এটাতো অন্ধকারের মধ্যে একটা বিশাল আশার আলো।
আলমগীর স্বপন: আমরা যে স্বপ্নের বাংলাদেশের কথা বলি..বাইরে থেকে আপনি যতটা বাংলাদেশকে বোঝেন সেই বোঝার জায়গা থেকে কেমন বাংলাদেশ আপনি চিন্তা করবেন ?
প্রতুল : সেটা বলা আমার জন্য অন্যায় হবে। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র। বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে প্রায় মন্ত্রের মতো উচ্চারণ করতে হয় সেটা হলো , ‘ আমি জানি না। ’এটা আপনারাই ঠিক করবেন আপনার বাংলাদেশের জনগন। আপনারা তো চালিকাশক্তি। সরকার যদি ভাবতে জানে জনগনই হচ্ছে চালিকাশক্তি, তাদের ইচ্ছাকে রূপায়নই আমাদের কাজ, তাদের ব্যাপক রূপায়নই আমাদের (সরকার) কাজ, তাহলেই হবে। এখন আমি শুনতে পাই ‘ ইনক্লুসিভ ইকোনমি’র কথা। এর মানে হচ্ছে ওপরের তলায় যারা আছে, যারা সমস্ত ভোগ করছে, যাদের ছেলে ৫’শ টাকায় ব্রেকফাস্ট খায় তারা তো এই ইকোনমির মধ্যে থাকবেই। এর সাথে গরীবদেরও ইনক্লুড করতে হবে। এটা কি রকম কথা। সমাজের উচুঁ তলার ১৫ জন তো থাকবে আর ৮৫ জনকে ভাই একটুু ইনক্লুড করা হবে এর সাথে। কিন্তু যা হওয়া উচিত ৮৫ জন থাকবে ১৫ জনকে তাতে ইনক্লুড করতে হবে। তবে ১৫ জনকেও তাড়িয়ে দিও না তাদের থাকতে দেও। দেশটা হচ্ছে এই ব্যাপক ৮৫ শতাংশের। তারা পানীয় জল পায় না। খাদ্য পায় না। শিক্ষা পায় না। বস্ত্র পায় না,আচ্ছাদন পায় না, তাদের সংস্কৃতির বিকাশ পায় না। তাদের সংস্কৃতি মুক্ত করে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে, তাদের সংস্কৃতিকে শেষ করে দেওয়া হচ্ছে, তাদের যে শিক্ষা সেটাকে অপ্রয়োজনীয় করে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এরাই তো ইতিহাসের চালিকাশক্তি। এই ইতিহাসের চালিকাশক্তিকে অবজ্ঞা করে যদি কেউ মনে করে আমরা এগিয়ে যেতে পারবো, তাহলে কিন্তু তারা ঠিক জায়গায় যাচ্ছে না।
এবার আপনার ব্যক্তি জীবনে উকি দিতে পারি কি ?
প্রতুল : ব্যক্তিগত জীবন, যতখানি সমষ্টিগত জীবনে মিলিয়ে দিতে পারি ততই ভালো। এমন একটা সময় আসবে যখন আমরা ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে নিশ্চয়ই ভাববো, কিন্তু সেটা সবাইকে বলার মতো কিছু হবে না। আমরা সমষ্টির প্রতি অনুরক্ত থাকবো। আমরা থাকবো ‘ উই সেল বি লোনলি অ্যামং দ্যা ক্রাউড’। একজন মানুষ যখন সৃষ্টি করে তখন তাকে কিছুক্ষণ একা হয়ে থাকতে হয়। কিন্তু সেই একা হয়ে থাকার ফলে সেই সৃষ্টিটা যখন সমস্ত মানুষের সম্পতি হয়ে যায় তখন মনে হয় এই কিছুক্ষণ একা থাকাটা সার্থক হয়েছে।
অনেকদিন পড় বাংলাদেশে এলেন–কেমন লেগেছে ?
প্রতুল : বিষয়টা যেন আমার নতুন গানের মতোই, ‘ দ’ুজনই বাঙ্গালী ছিলাম/ দেখো দেখি কান্ডখান/তুমি এখন বাংলাদেশী/আমারে কও ইন্ডিয়ান…চল মন মা বাবার ভূমি/দেখি নিজের ভাই বোনে/শুনছি নাকি তারা আজো/এই পাগলের গান শোনে।’ আমি আসলে আমার বাড়িতে এসেছি। এটাই মনে হয়েছে। দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশে এসে এখানকার মানুষের যে ভালোবাসা পেয়েছি তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। কিন্তু এর চেয়েও আমার ভালো লেগেছে যে গান গাইতে গিয়ে দেখেছি, এমন এমন গানের জন্য অনুরোধ এসেছে, আমার সাথে গলা মিলাচ্ছে যা শুনে আমি অবাক হয়েছি। প্রতুলের গান এখানে শোনা হয়। যাওয়ার সময় তাই খুবই খারাপ লাগছে।
:ধন্যবাদ
প্রতুল : আপনাকেও ধন্যবাদ
আলমগীর স্বপন,
সিনিয়র রিপোর্টার, এটিএন নিউজ